রশীদ হারুণ ।। একগুচ্ছ কবিতা।।
হৃদয়
তোমার হাতেই ভাসতে থাকলো আমার হৃদয়
—বরিস পাস্তেরনাক
শুধু এই ভেদচিহ্ন— আমি ভাসতে থাকি শীর্ষস্তরে
সংলাপের ঘোড়াগুলি ন্যারেটিভ আঁকছে অবিরাম
নাভিকুণ্ডলের গানে কিছুটা উল্লাস হও, পুষ্প,
উর্ধ্বমুখী বায়ুকলে নেচে যাচ্ছে লবণের খেত
তোমাতেই চূর্ণ করো— গান শুনি গীতল গমের
লালমাটির টিলায় ভাঙে রক্তজলের অঙ্কুর
ঘামের পিঁপড়াগুলি চিরল নদীর দিকে ভাসছে—
এবং চরমপন্থী একটা মাছের জিভ নড়ে যাচ্ছে
আমাকে আঁকড়ে ধরো পাখি, বেতবনের সবুজ
দেহের নরুনে খোঁচো দেহের বিনাশি দেহকাল
এবং অভিযোজিত, তলসিঁড়ির মেঘের নীচে
ঝরতে থাকে শিল্প আর সাহিত্যের লাল পুতুলেরা
মাটির তৈজসপত্রে তারা আঁকা। রক্তের তর্জনী
নড়ে ওঠে, নড়ে ওঠে মৃত্যুবাহিত অসংখ্য শ্বাস…
একজন পরপার
ঘুম। এক শীত নদী।
শীর্ণকায়া নিষ্কম্পের মধ্যে অগণন অর্থ আর নিরন্তর সঙ্কেতের ঝিল্লি থেকে দেখি— গোপন কম্পন হয়ে যাচ্ছে আয়ুর নালিতে। কোথাও থামছে না কিছুই— না জড়, না স্পন্দনের অলৌকিকতা, না দৃশ্যময়তা, না অদৃশ্যের দৃশ্যলীলা।
এবং ব্যাখ্যা ও ব্যাখ্যাশূন্যতার কলকব্জা ঘিরে এক নিরুপম আর কষ্টদায়ী ঘোড়া ওড়ে— দুলদুল, দুলদুল—
আমার চোখের ছাপ রেখে এখানে দুলে যাচ্ছে পথ ও পথের সলতে; অজস্র মেলোডি সরুগলি ধরে জেয়ারত করছে আমার দেহ! আমিই কী উপলক্ষ্য, ঝড় আর ঝড়কেন্দ্র? আড়ালকে ঢেকে দিতে সাজানো হয়েছে আড়ালের উৎসগুলি?
হে কলস্বর, আমার জেয়াফতে কারা-কারা হেসে-হেসে খায়
ঘুম। এক মৃত নদী!
মেধা
অনেকগুলি বানর লাফাচ্ছিল—
ডাল থেকে ডালে কম্পনধ্বনিও ছুটছে একটানা।
বানরছানাগুলি অবাক ও লাজুক ভঙ্গিমায়
শিখছে পৈতৃক ও মাতৃক মূল্যবোধের কলা—
একটুস্ লাফ। একটুস্ জননীর কোল।
ভয়ার্ত বিস্ময়… ভয়ার্ত আনন্দ…
দর্শক, উৎসুক— হাততালিতে কাঁপাচ্ছে চারপাশ।
প্রত্যেকে প্রশংসা করছে প্রত্যেকের বংশবাজি মানসিকতার।
প্রত্যেকে তালাশদাতা ও কত্থক— উন্নত বিশ্লেষক—
গোয়ার শুকর, পাশে— ওলকচু খায় ও বাবার পাছা কামড়ায়
চোখ ও আঙুল ও হাত ও থাবা ও মুখ ও দাঁত চলছে একটানা—
ষাঁড়ের বৃত্তের মাঝে, তার পাশে, কয়েকজন চতুর-ষাঁড়
গুঁতিয়ে শেখাতে চাচ্ছে ইতিহাস ও ভূগোলতত্ত্ব। আর,
জিভের তলায় ঝুলে আছে সমস্ত স্বদেশ
এবং কারা যেন চেটে-চেটে খায় যায় বিপ্লবের মধু।
যারা হাততালি দিচ্ছে তারাও লাফাচ্ছে আর
আরও জোরে তালিয়া লাগাচ্ছে—
চাটাচাটি আর লাগানোর মজা অসম্ভব সে-রকম আর আর্টস্টিক।
নির্জনতা
নির্জনতা ছাড়া কিছুই করা যায় না। আমি আমার নির্জনতা ঠিক তৈরি করে নিয়েছি, যা নিয়ে তেমন কোন সন্দেহও তৈরি হয়নি। ইদানীং একা হওয়া বেশ কঠিন, কারণ এখন সকলেরই নিজস্ব ঘড়ি আছে।
— পাবলো পিকাসো
সনেট গঠন হচ্ছে, শীতে, নিরিবিলি; মতিচ্ছন্ন
একটা নিস্তব্ধতার জলনোট নিয়েছে দখল
দু-চোখের কাচ। গুড়ো-গুড়ো-জল গুঞ্জরিত
হৃদয় দেয়ালে, আর, গাঢ়, কিউবিক-কান তুলে
রাখাল বালিকা, ঘাসের শিশিরে পা-ডুবিয়ে শুনছে
মাদি ছাগলের ডাক।
‘সবার নিজস্ব ঘড়ি আছে’।
মর্মপথের সঙ্কেতে ধূসর বিরামচিহ্ন রাখা—
ওশ ঝরে ঘুম-ঘুম। নিখিল নির্জনতায় আজ
তোমাকে পবিত্র লাগে এবং সেতুর শিস ওঠে
পৃথিবী মুড়িয়ে। নাকে ওড়ে শ্বাসের এপ্রোন—
শাদা-শাদা দূর-ডাক; …ঘুমের গড়নে, আর্টঘরে,
তোমার ড্রয়িং খাতা দাগ তোলে পেন্সিলের মন।
নির্জন-নিসর্গ-চোখ কুয়াশা-শাসিত শীতে স্থির—
এবং কুকুরছানা, এতিম, শার্সির নিচে কাঁপছে।
মুখচ্ছবি
মানুষ ঘুমালে মুখচ্ছবি জেগে থাকে
এই ভেজা ধানবীজ, কুসুম রেখার গলা—
বাতাসের লতা ধরে সমর্পণ ছুঁতে চায়!
ঝিঁঝিঁ ডাকে। ইতস্তত তারাগুলো অন্তর্বাস খুলে শরীর দেখাচ্ছে শান্ত সমুদ্রকে। সমস্ত যন্ত্রাংশ ডুবে আছে। নিঃশব্দের ছায়া ধাক্কা দিচ্ছে দূরের রোয়াকে। কোন খেলা নেই, তবু অজস্র খেলার মুখ— চোখে-ধরা ধূসর কার্নিশ দিগন্তের দিকে ছুটে যাচ্ছে…। নিস্তব্ধতাও একটি জাগরণ— ঠাণ্ডা ও নিটোল হিমের ভেতর ভেজা বীজধান! তুষার অশ্বের মত উড়ছে প্রতিটি সময়ধ্বনি। বায়ুর উঠোনে উড়ে-উড়ে কি করছো হে তুষারশ্বাস! হে ধ্যানলিপ্ত আয়না! হিমের ভেতর যে কোলাহল, অস্থির ভাঁজ, উড়ে-পড়া টেবিলক্লথের ফুলগুচ্ছ— ছায়া, সব, চুম্বনের মত পড়ে থাকা বিহ্বল মাদুর, বিব্রত হ্যাঙার, শুয়ে থাকা হরিণের মুখ, ঘাসের আঙুলে ঝুলে থাকা জল, গোগ্রাসে ঘুমানো মাংসুটে কসাই, নীল কুঁড়েঘর, রগতোলা ঝরাপাতা, সব— আদ্রসেতুর মিছিল…
দূর জানালায় ছিটানো-ছিটানো আলো
দৃশ্যের ভেতর আর্শির নিখিল
ভেঙে-ভেঙে কার মুখচ্ছবি তৈরি করছে!
**********************************