You are currently viewing তিনটি কবিতা || আশরাফুল কবীর

তিনটি কবিতা || আশরাফুল কবীর

তিনটি কবিতা || আশরাফুল কবীর

দেবীপুরাণ

— স্বতন্ত্র সুর বাজে মেঘেদের আত্মম্ভরিতায়
বৃষ্টির-দূতালিতে উপচানো জারুল-নিংড়ানো ঘ্রাণ
ডুবুডুবু সুরে ফুটে বেরোয় অনাবিষ্কৃত-ব্যাকরণ
কিছুটা নিরীক্ষ্যমাণ, অগোছালো বাদাবন!

বাড়ি ফিরেছে সে অনুচ্চারিত সুর, নৈকট্যবিহীন
অস্তিত্বের ক্রূরলোচনে সম্মোহিত দিঘল-পৌর্ণমাসী
অনুবাদ হওয়ার অপেক্ষায় বিবদমান তামাম-প্রত্যাশা
ছায়াপথের পিঠ বেয়ে উঠে আসা তম্বুরিন-সুর
এক বৃষ্টিসজল রাত —

বাত্যাতাড়িত হয় আকাঙ্ক্ষার বেতসপত্র, কিয়ৎ দুরুদুরু
ফুলস্ক্যাপ-বাথানে লুক্কায়িত তরঙ্গোচ্ছ্বাসে
লাগাতার ছলাৎ-ছলাৎ; সংনমিত শেয়াকুল
বঙ্কিম-পথে প্রকোপিত হয় প্রদোষের শ্বেতকাঞ্চন

পরিত্যক্ত সমীকরণে বাজে সূক্ষ্মকোণী-সুর, তমোময়
প্ল্যানেটরিয়মের ভাঁজে-ভাঁজে নিশির ডাক
বাঙ্ময় হয় ঝরনাকলমের আহ্লাদিত বাক্যসকল।

জানে না মহাকাল, কিভাবে সে বুক পেতে নেবে
ফ্যাসিবাদী এ-ফোটন কিংবা সান্ধ্যাকাশের
আরেকটি দেবীপুরাণ!

ইনফিনিটির গল্প

অনেকদিন আগে একটি বৃষ্টির কবিতা পড়তে গিয়ে
সাতপ্রহরের উপকণ্ঠে আটকে পড়েছিলাম। সেই থেকে
কবিতার একটি উপশহরেই বৃত্তবন্দি হয়েছিল আমার সকল বৃত্তান্ত।
অতঃপর চোরকাঁটার মতো ঝুলতে থাকা খেয়ালগুলো একদম   

বেখেয়ালি হয়ে সমস্ত শহরজুড়ে স্বর্গ-দেবতাদের দ্বৈরথ করে চলল।

ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টিতে কাকভেজা হওয়ার বদলে আমি
ঘেমেছিলাম তীব্র ভাদুরে উত্তাপে, হাওয়ায় মিলিয়েছিল
আমার হারিয়ে যাওয়া কবিতা-অপেরার সকল প্রত্যুদ্ধার প্রচেষ্টা।

একটি কদমস্পর্শের সন্ধানে উজানে পাল জুড়তেই
ভর করেছিল জুবিলি রোডের পুরোনো সেই আবছায়া ছবি;
একগুচ্ছ তাজা কদম হাতে ভর সন্ধ্যাবেলায় একা পথে হেঁটে যাওয়া;
হুডতোলা রিকশার টুংটাং, স্যাঁতস্যাঁতে ক্যামবিস;
যতদূর মনে পড়ে, শেষ পর্যন্ত বিরহোৎসুক কদমগুলো ছুঁড়েছিলাম
বর্ষার অপার জলরাশিতে।

একদা আমাকে কাঁপিয়েছিল দণ্ডায়মান ল্যাম্পপোস্টগুলো।
অথচ অদ্ভুতুড়ে শহরের এ পোস্টগুলোর সাথেই ছিল
আমার সকল নীরবতার ভাগাভাগি, কাব্য-সখ্যের মেলবন্ধন।
তবে বৃষ্টির ক্যানভাসে অনাকাঙ্ক্ষিত উপযোগ হয়েছিল
ক্রমাগত বর্ষোপল। অতএব, অনেকটা বাধ্য হয়ে
শহরের ক্যারিকেচারে কিছুটা পরিমার্জন করেছিলাম।

আমি ছুটেছিলাম যাদুবৃক্ষের সন্ধানে, অমরত্বের পিছু পিছু,
অমরত্বের ছোঁয়ায় বাঁধা হয়ে দাঁড়ান দেবতা গিলগামেশ
আমাকে ফেরত পাঠায় কবিতা-শহরে; বৃষ্টিশহরে সিক্ত হতে
আমি ফিরে আসি হেলেদুলে, বাধ্য হয়ে আবার ফিরে আসি
আমার জীবনবোধের চৌরাস্তায়।

কোন্ পথে যাব আমি?
সিদ্ধান্ত নিতে গিয়েই বেলা পার!
ফিরতি পথে কবিতা শহরের সাঁকোটি ভেঙে গিয়েছিল,
সাথে অবরুদ্ধ হয়েছিল তীর্থে পৌঁছুনোর সকল দরোজা;
জলাঞ্জলি দিয়ে ফিরে চলেছিল রাতের হাজারো নিশীথ-কুটুম

আমি থমকে যাই, খোঁজ করি খেয়া নৌকার মাঝিকে —
এই অবেলায় খেয়াঘাটের মাঝি নাই, শুনি হাহাকার কোরাস,
মাঝি নাই! মাঝি নাই! বৈঠা হারানো কিরণ মাঝির
আজ কোনো প্রক্সিও নাই!

একদা আমি ডুবসাঁতারেই পার হতাম
জীবনবোধের নদী। পারাপারের জন্য আমার প্রয়োজন হয়নি
কোনো কেতাবি যানের, পা-হড়কানো রাস্তায়
আমাকে সতর্ক করেনি কোনো ‘পদ্ম-সাইরেন’
যজ্ঞ-যাত্রায় আমাকে পথ দেখিয়েছিল
শুধুমাত্র কতিপয় দেয়াসিনী।

আমি অবাক হইনি; হইনি কিংকর্তব্যবিমূঢ়, মুগ্ধ হয়ে
আবারো সতেজ স্পর্শের দিকে হাত বাড়িয়েছিলাম,
ডাহুকের সাথে আমার বাড়ানো হাতের ছোঁয়ায় চমকে উঠেছিল
একগুচ্ছ কচুরিফুল।

আমার কবিতাযজ্ঞে ছাপ ছিল নিঃসঙ্গতার
ছাপ ছিল কুহেলিকার, আমি অবারিত তৃণভূমিতে
আবিষ্কার করেছিলাম জড়বদ্ধ হয়ে থাকা চরণগুলোকে,
বিক্ষিপ্ত হয়ে থাকা মেটাফিজিক্যাল কবিতাগুলোকে,
সময়ের পালকিতে বিক্ষিপ্ত হয়ে থাকা কবিতাগুলোই হয়ে উঠেছিল
একেকটি কাব্যস্তম্ভ, আমার আশ্রয়ের দেরাজ।

বিষণ্ন শহর হতে আমি মুক্তি চেয়েছিলাম।
তাই তো আমি ভজেছিলাম অন্ধ-বাউলের সাথে;
তার দোতারায় শুনেছিলাম কীর্তন-সুর
বাউলা-বেশে অবশেষে আমি খুঁজে পেয়েছিলাম
আমার আত্মচেতনাকে, আঃ! মুক্তি!
বিষণ্ন সন্ধ্যায় কবিতার মরফোলজিতে ডুবে যায়
উর্মিমালার সাজসজ্জা, আমার অন্দরমহলে সলজ্জ হাসি দিয়ে
রাতের শেষ ট্রেনের শিকল টানেন রাজাধিরাজ! বর্ষবলয়ে ঘুরেফিরে
কাছে চলে আসে বৃষ্টিনগর, কবিতানগর… ক্রমান্বয়ে
আরো কিছুটা দূরে উঁকি দেয় আবছায়া ভালোবাসানগর

—সে নগরে রাত ফুরোয়, গান ফুরোয়,
এক সময় বুঝি ভালোবাসাও ফুরোয়;
শেষ অবধি যাত্রামঞ্চে আবির্ভূত হয় সাতপ্রহর।

নিঃসঙ্গতার কফিন মুচড়িয়ে প্রথম প্রহরে সেরা কুশীলবরা
একে-একে উপস্থিত! সময়ের ঘণ্টা বাজিয়ে আমাকে জানান দেন
কবিতামঞ্চ ত্যাগ করার; তবে যাবার আগে আমি আশ্রয় খুঁজি
প্রকৃতির কাছে, ত্রাতা হয়ে সম্মুখে দণ্ডায়মান হয় রাতের ছায়া
আসে হিমায়িত প্রহর, কালো ঝুপড়ির আড়ালে জমাটবদ্ধ হয়ে
কেটে যায় নিষ্ফলা কয়েকশ বছর!

আমাকে জাগিয়ে তোলেন নিঃসঙ্গতার রাজা!
তাই তো পুনর্জীবনে ওয়ার্ডসওয়ার্থেই ঝুঁকেছিলাম,
ছিনিয়েছিলাম তার নিঃসঙ্গতার সংজ্ঞা; তবে
ঘুরেফিরেই কাটতে থাকে ম্যালাপ্রপিজমের রোশনাই!
মাঝের প্রহরগুলো কিছুটা অস্পষ্টই থেকে যায়।

সমস্ত শহর চষে আমি থমকে দাঁড়িয়েছিলাম
না, কোনো নিদ্রাকারকের তীব্রতায় এ থমকে যাওয়া নয়।
আমাকে থামিয়েছিল কেবলই বৃষ্টিশহরের উপপাদ্য।
কাঁটা-কম্পাস নিয়ে আমি মত্ত হয়েছিলাম ফেলে আসা শহরের
আদি-অন্তের হিসেব কষবার; উৎসমুখ খুঁজে বের করবার
হিসেব বরাবরের মতোই এক অসমাপ্ত — ইনফিনিটির গল্প!

আজ কবিতার ডালপালায় গজিয়ে ওঠা আষাঢ়ে ঝোড়ো হাওয়া
সময়ের পন্টুনে এসে একদম পাল গুটিয়ে বসে থাকে।
বুনন-বর্ণনে বর্ষণসিক্ত সময় হয়ে ওঠে চিরবসন্তের পুঞ্জি।

হয়তো নই দুজন

জোনাক আলো লুট হয়েছে নিয়ন আলোর কাছে
হয় না এখন জোনাক খোঁজা বাঁশ-বাগানের পাছে।

নিয়ন আলো কত্ত ভালো বৃথাই জোনাক খোঁজা
কোন সুদূরে দূর পাহাড়ে জোনাক-দুঃখ গোঁজা।

নিধুবনে কোনো ক্ষণে হারিয়ে যেত পথও —
আজকে পথে জোনাক-সঙ্গী আলেয়ারূপী ক্ষত।

বড্ড উদাস মনটি যেন ধু-ধু করা মাঠ
জোনাক জ্বলে অন্য গলে তেপান্তরের হাট।

চাঁদের আলোয় নিবিড় কালো জোনাক-ফাঁকা ঝাড়
লম্বা বাঁশে স্মৃতি হাসে যেন বারবার।

হয় না যাওয়া জোনাক ছাওয়া বাঁশ-বাগানের মাঝ
বাগান ভর্তি করুণ আর্তি সুর হারানোর ভাঁজ।

ভালো থেকো জোনাক বন্ধু গহীন বনের সুজন
হয়তো ছিলাম হয়তো আছি হয়তো নই দুজন।

*********************

This Post Has 2 Comments

Leave a Reply