You are currently viewing শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস ও আজকের বুদ্ধিজীবী সমাজ

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস ও আজকের বুদ্ধিজীবী সমাজ

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস ও আজকের বুদ্ধিজীবী সমাজ

১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের প্রাক্কালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের সাথে রাজাকার, আল বদর, আল শামস বাহিনী বাংলাদেশের অসংখ্য শিক্ষাবিদ, গবেষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, কবি ও সাহিত্যিকদের চোখ বেঁধে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে তাঁদের নির্যাতনের পর হত্যা করে। বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর চূড়ান্ত বিজয়ের প্রাক্কালে স্বাধীন বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করতে পরিকল্পিতভাবে এ হত্যাযজ্ঞ সংগঠিত হয়। পরবর্তীতে ঢাকার মিরপুর, রায়ের বাজারসহ বিভিন্ন স্থানে গণকবরে তাঁদের মৃতদেহ পাওয়া যায়। ১৬ই ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর নিকটাত্মীয়রা মিরপুর ও রাজারবাগ বধ্যভূমিতে স্বজনের মৃতদেহ শনাক্ত করেন। অনেকের দেহে আঘাতের চিহ্ন, চোখ, হাত-পা বাঁধা, কারও কারও শরীরে একাধিক গুলির চিহ্ন দেখা যায়। অনেককে ধারালো অস্ত্র দিয়ে জবাই করে হত্যা করা হয়েছিল। হত্যার পূর্বে যে তাঁদেরকে নির্যাতন করা হয়েছিল, সে তথ্যও বের হয়ে আসে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে জাতীয়ভাবে প্রকাশিত বুদ্ধিজীবী দিবসের সংকলন, পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ও আন্তর্জাতিক সংবাদ সাময়িকী নিউজ উইক-এর সাংবাদিক নিকোলাস টমালিনের রচিত নিবন্ধ থেকে জানা যায় যে নিহত শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা মোট ১ হাজার ৭০ জন।

 

২০২১ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় “শহীদ বুদ্ধিজীবী” কথাটির একটি সংজ্ঞা প্রদান করে। সংজ্ঞাটি অনুযায়ী “১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ৩১ জানুয়ারি ১৯৭২ পর্যন্ত সময়কালে যেসব বাঙালি সাহিত্যিক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, ভাস্কর, সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারী, রাজনীতিক, সমাজসেবী, সংস্কৃতিসেবী, চলচ্চিত্র, নাটক ও সংগীতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন এবং এর ফলে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী কিংবা তাদের সহযোগীদের হাতে শহীদ কিংবা ওই সময়ে চিরতরে নিখোঁজ হয়েছেন, তাঁরা শহীদ বুদ্ধিজীবী।”

 

বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত ‘শহিদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ’ (১৯৯৪) থেকে জানা যায়, ২৩২ জন বুদ্ধিজীবী নিহত হয়েছেন। তবে তালিকায় অসম্পূর্ণতার কথাও একই গ্রন্থে স্বীকার করা হয়। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের ১৮, মতান্তরে ২৯ তারিখে বেসরকারীভাবে গঠিত বুদ্ধিজীবী নিধন তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়নি। এরপর “বুদ্ধিজীবী তদন্ত কমিটি” গঠিত হয়। এই কমিটির প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলা হয়, রাও ফরমান আলী এদেশের ২০ হাজার বুদ্ধিজীবীকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু এই পরিকল্পনা মতো হত্যাযজ্ঞ চলেনি। কারণ ফরমান আলীর লক্ষ্য ছিল শীর্ষ বুদ্ধিজীবীদেরকে গভর্নর হাউজে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা। বুদ্ধিজীবী তদন্ত কমিটির প্রধান জহির রায়হান বলেছিলেন, “এরা নির্ভুলভাবে বাংলাদেশের গণতন্ত্রমনষ্ক বুদ্ধিজীবীদেরকে বাছাই করে আঘাত হেনেছে।” তবে ১৯৭২ সালের ৩০শে জানুয়ারি জহির রায়হানও নিখোঁজ হন। ১৯৭১ সালের ৩১শে ডিসেম্বর তারিখে তাজউদ্দিন আহমেদ এ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্ত তাঁর ঐ সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়নি। ১৯৭১ সালের ২৭শে ডিসেম্বর দৈনিক আজাদের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পরিকল্পনাটি পূর্বেই করা হয়েছি। আর এতে সহায়তা করে জামায়াতে ইসলামী ও এর ছাত্র সংগঠন ছাত্রসংঘ। এ হত্যাকাণ্ডে সবচেয়ে সক্রিয় ছিলেন ব্রি. জে. আসলাম, ক্যাপ্টেন তারেক, কর্নেল তাজ, কর্নেল তাহের, উপাচার্য অধ্যাপক ডঃ সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন, ডঃ মোহর আলী, আল বদরের এবিএম খালেক মজুমদার, আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মাইনুদ্দিন; আর তাদের নেতৃত্ব দেয় মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী।

১৯৯৭ সালের ২৪শে সেপ্টেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘটনায় রমনা থানায় প্রথম মামলা দায়ের করা হয় (মামলা নম্বর ১৫)। সেখানে আলবদর বাহিনীর চৌধুরী মাইনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানকে আসামি করা হয়। মামলাটি দায়ের করেন অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিনের বোন ফরিদা বানু। ১৯৭১ সালে বছরব্যাপী পাকিস্তান সেনাবাহিনী বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। পরিকল্পিতভাবে ১৪ ডিসেম্বরে সবচেয়ে বেশীসংখ্যক বুদ্ধিজীবী হত্যা করা হয়েছিল। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ এই দিনকে “শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস” ঘোষণা করেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহত বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে ঢাকার মিরপুরে প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়। স্মৃতিসৌধটির স্থপতি হলেন মোস্তফা হালি কুদ্দুস। ১৯৯১ সালে ঢাকার রায়েরবাজারে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ নামে আরেকটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ শুরু হয়, যা ১৯৯৯ সালের ১৪ই ডিসেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেন। এর নকশা করেন জামী-আল সাফী ও ফরিদউদ্দিন আহমেদ। বাংলাদেশ ডাক বিভাগ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে একটি স্মারক ডাকটিকিটের ধারাবাহিক প্রকাশ করেছে।

 

উপরোক্ত দাপ্তরিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতা স্বাভাবিকভাবেই গতানুগতিকতায় পর্যবসিত হয়েছে কিন্তু যে স্বপ্ন ও আদর্শের জন্য হাজার হাজার বুদ্ধিজীবীকে আত্মদান করতে হয়েছিলো বাংলাদেশ সেই স্বপ্ন থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। দলদাসে পরিণত আজকের বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীসমাজ শিরদাঁড়াহীন ক্ষমতার উচ্ছিষ্টভোগী গোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। ত্রিশলক্ষ শহীদ ও হাজার হাজার বুদ্ধিজীবীদের স্বপ্নপূরণে ভুমিকা রাখার যোগ্যতাও তারা আজ হারিয়ে ফেলেছে। গণতন্ত্রহীন পারিবারিক ও গোষ্ঠী স্বৈরতন্ত্রের যাঁতাকলে পিষ্ঠ স্বদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় পরিচালিত করার ব্যাপারে বর্তমান বুদ্ধিজীবীদের কোনো ভুমিকা নেই। তারা মূলতঃ জ্ঞানপাপীতে পরিণত হয়েছে। তাদের ভণ্ডামি ও স্বার্থান্ধতার কারনে আদর্শবান, ত্যাগী ও দেশপ্রেমিক শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মর্যাদা ও সম্মান ক্ষুন্ন হচ্ছে। আমরা এসব জ্ঞানপাপীদের হাত থেকে বাঙালী জাতির বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ রক্ষাকল্পে সকল সচেতন ও আদর্শবান বুদ্ধিজীবীদের সোচ্চার হতে আহবান জানাই।

*************************************

 

This Post Has One Comment

Leave a Reply