জন্ম যদি তব বঙ্গে…
নুসরাত সুলতানা
মা, জন্মভূমি, সন্তান আর দু:খ নিজেরটাই সবসময় সেরা। মা যত কুৎসিত, চরিত্র ভ্রষ্টা কিংবা অশিক্ষিতই হোক না কেন। প্রত্যেক সন্তানের কাছে তার মা সেরা। তেমনি দেশ বা জন্মভূমি প্রত্যেকের কাছে নিজেরটাই সেরা। বলা হয়ে থাকে- দেশের জন্য মনের ভেতরে আবেগ যদি না থাকে তাহলে তার শরীরে রক্ত নয় জল প্রবাহিত হচ্ছে ।
কিন্তু ফিলিস্তিনের একটা শিশু কী বলতে পারে- আমার জন্মভূমিই সেরা? কিভাবে বলবে? যে জনপদে জন্মে তাদের এক মুহূর্তের জীবনের নিশ্চয়তা নেই। নেই মা কিংবা বোনেদের আব্রুর নিশ্চয়তা! কিংবা ইয়েমেনের যে শিশুগুলো না খেয়ে কঙ্কালসার হয়ে মারা যাচ্ছে তাদের জন্মভূমি নিয়ে গর্বের জায়গাটা কোথায়? আর আমরা বাংলাদেশের মানুষ? আমরা তো তেরোশত নদীর পলল ধোয়া, সবুজ, শ্যামল একটা দেশ পেয়েছি! আমরা কী বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি- আমার দেশই সেরা। গরীব হয়েছি, তাতে কী? আমার আছে সমৃদ্ধ, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি আর লড়াইয়ের গর্বিত দলিল! সেই সত্তুর দশকের একেবারে শেষে আমার জন্ম। বহুদিন দেশ ছিল আমার বুকের গহীন বন্দরে এক হীরকখণ্ড। যাকে গভীর যতনে পুষেছি নিরবধি। ইতিহাস পাঠ ছিল সহজাত অভ্যাস। তাই বৃটিশ আর পাকিস্তানিদের দেখলে গায়ে যেন আগুন ধরে যায়..।
মনে হয় আমাকে কে যেন চাবুক দিয়ে প্রহার করছে। কে যেন আমার কৃষক বাবাকে মেরে উল্টো ঝুলিয়ে দিয়েছে! বাবা মুক্তিযোদ্ধা তাই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তন্নতন্ন করে পড়তে চেষ্টা করেছি বরাবর। আর কেবলই ভেবেছি- যে দেশে সাধারণ জনগণ পাকিস্তানের মতো সামরিক অস্ত্রে সজ্জিত একটা দেশের সাথে পতাকা ছিনিয়ে আনে, সেই দেশের স্বাধীনতা কী করে বিপন্ন হতে পারে? হ্যাঁ ভারত আমাদের সহযোগিতা করেছে। কিন্তু আমাদের ত্যাগ, তিতিক্ষা এবং সাহসী লড়াই ছিল সর্বাত্মক। বড় আফসোস তো এই যে, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেয়া দলটির হাতেই এদেশের গনতন্ত্র বিপন্ন হল।
সেই শুরু থেকে আজ অব্দি এদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর দেশপ্রেম হীনতা, ক্ষমতার লিপ্সা, জনগণের প্রতি জবাবদিহিতা বোধের অভাব একটা সাজানো গোছানো দেশকে বদ্ধ ভূমিতে পরিনত করেছে। আজ দেশের স্বাধীনতা প্রকৃত অর্থেই বিপন্ন। সারা দেশে খুন, রাহাজানি, ধর্ষণ আর ইতিহাস, ঐতিহ্যের বিনাশ একটা অতি সাধারণ ঘটনায় পরিনত হয়েছে। কিছু মানুষের ক্ষমতার উচ্চাভিলাস একটা জাতিকে অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। বাংলাদেশ যেন একটি অভিশপ্ত রাষ্ট্র..! প্রকৃত অর্থে গণতন্ত্র এবং সুশাসনই পারে সবাইকে রক্ষা করতে। ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতির প্রতি ঝোঁক থাকে। জন ডালবার্গ-এক্টন (John Dalberg-Acton) যথার্থই বলেছেন-
“সীমাহীন ক্ষমতা সীমাহীন দুর্নীতির কারণ।
Power tends to corrupt and absolute power corrupts absolutely.”
এদেশের রাজনীতিবিদরা সেই পুকুরেই প্রতিনিয়ত মল-মুত্র বিসর্জন করেছেন – যে পুকুরের পানিতে তারা গোসল করবেন এবং রান্না করে খাবার খাবেন। অই পুকুরটি হল এদেশের রাজনীতি। যার সীমাহীন দুর্বৃত্তায়ন ঘটে গেছে রাজনীতিবিদদের হাতে। কিন্তু অত্যন্ত নির্লজ্জ এবং মূর্খের মতো তারা একে অপরকে দোষারোপ করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। কিন্তু কেউই নিজের দোষটা দেখে অনুতপ্ত হচ্ছে না। সংশোধিত হয়ে জনগণের কাছে ক্ষমা চাইছে না। আর হ্যাঁ, জনগণ?
জনগণের যদি শততা, দেশপ্রেম, পরিশ্রমী মানসিকতা থাকত তাহলে এই কজন রাজনীতিবিদ বিশ কোটি জনগণকে জিম্মি করে বাঁদর নাচ নাচাতে পারত না।
এসব ছেড়ে যখন এদেশে ষড় ঋতুর দিকে তাকাই। মনে হয় ধন্য আমার বাঙালি জন্ম। বর্ষার ভরা বুকের নদী কিংবা চির সবুজ পাহাড় শুধু চোখকেই পরিতৃপ্ত করে না বরং বুকের ভেতর এনে দেয় গভীর প্রশান্তি। বিলে, ঝিলে শাপলা, শালুক যেন নিজেদের সৌন্দর্য ঘোষণা করে চলে আর বলে- দেখ, দেখ আমাকেই দেখ। তেমনি বসন্তের সোনালু, জারুল, হিজল রঙ্গন, পলাশ, শিমুল ভরিয়ে তোলে বাঙলি মনন গভীর আনন্দে। কেবলই মনে হতে থাকে আহ! কী কী অপরূপ আমার জন্মভূমি! এত সুন্দর দেশ আর কই আছে? তেমনি শরতের সাদা মেঘমঞ্জুরী, দিকে দিকে সাদা চোখ শীতল করা কাশফুল , শিউলি, শেফালি, ছাতিমের মাতাল গন্ধ এদেশের প্রকৃতি প্রেমীদের এক অদ্ভুত রোমাঞ্চকর অনুভূতির যোগান দেয়। শীতকে আমরা যতই শ্রীহীন বলি তারও আছে নিজস্ব ঐশ্বর্য। খেজুরের রস, পিঠাপুলি, নতুন ধান আমাদের মাতিয়ে রাখে বাঙালির নিজস্ব আনন্দ ভূবনে। এদেশের শালিক, বক, দোয়েল, ময়না, টিয়া, মাছরাঙা, হরিয়াল, ঘুঘু যেন আমাদের আত্মার আত্মীয়। বাংলাদেশের প্রাণ প্রকৃতি আর নদ-নদী, পাহাড়, সমতল ভূমি আমাদের দিয়েছে এক অপার্থিব প্রাণ শক্তি। তেমনি ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের দিকে তাকালেও বুক গর্বে ভরে ওঠে। আর কোন জাতি রক্ত দিয়ে ভাষার অধিকার আদায় করেছে? তেমনি মুক্তিযুদ্ধ আমাদের হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন। কিন্তু এই দেশের রাজনীতি আর রাজনীতিবিদরাই যেন এদেশের মরণঘাতী ক্যান্সার। তারপর ও বিহবল হয়ে ভাবি- সবই কী শেষ? মনে পড়ে জাতীয় সঙ্গীতের সেই পঙক্তি – কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে, নদীর কূলে কূলেএ এ…। এই পঙক্তি মনে এলে মনে হয়- আহা! কত শান্তি এই দেশে..। তারপর প্রজন্মের ওপর বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়- এই দেশে গনতন্ত্র আসবে, সুশাসন আসবে। দেশ হবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির, সমৃদ্ধ সংস্কৃতির বাংলাদেশ। সে কী আশা নাকি দূরাশা! বিশ্বাস নাকি বেদনার বালুচর! তবুও লেখাটির শেষ টানলাম কবি গুরুরই কয়েকটি পঙক্তি দিয়ে-
ওগো মা, তোমার কোলে জনম
আমার, মরণ তোমার বুকে।।
তোমার ‘পরে খেলা আমার দুঃখে সুখে।
তুমি অন্ন মুখে তুলে দিলে,
তুমি শীতল জলে জুড়াইলে,
তুমি যে সকল-সহা সকল-বহা মাতার মাতা ॥
পরিশেষে বলি- যত খারাপই হোক দেশ, মা আর সন্তান কখনো বদলে নেয়া যায় না। আমি এই দেশে জন্মেছি, এই দেশেই মরব। কোথাও যাব না এই দেশ ছেড়ে..। মায়ের বুকের দুধে যদি বিষ থাকে। আমি বিষ পান করে মরে যাব…
*****************
কবি ও কথাসাহিত্যিক
******************