কমোড সিট
সজল আশফাক
সকালবেলা বাথরুম থেকে ডালিয়ার চিৎকার- এই ডিউক তুমি কমোডের সিট ভিজাইয়া কেন রাখসো? এত্তবার বলি, বাথরুমের পর কমোডের সিটটা টিস্যু দিয়ে মুছে দিবা। ভিজা কমোডের সিটে আমি কেমনে বসব? আমার গা ঘিনঘিন করতেছে। আমি চুপচাপ বসে আছি। ডালিয়ার এমন চিৎকার চেঁচামেচি নতুন কিছু নয়। ডালিয়ার সাথে বাথরুম শেয়ার করা খুব কঠিন। কোথাও একফোঁটা পানি পড়ে থাকলে তা নিয়ে যে পরিমাণ ঝড় তোলে, অনেক সময়ে তা সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়ে। যে কারণে আমি বাংলাদেশে থাকতে অন্য বাথরুম ব্যবহার করতাম, কিন্তু নিউ ইয়র্কে সিঙ্গেল ফ্যামিলির বাসায় দুই বাথরুম পাওয়া কঠিন। দাঁত ব্রাশ, শেভ করতে যেয়ে বেসিনের আশেপাশে একটু আধটু পানির ঝাপটা পড়তেই পারে। কমোডের সিটে কয়েকফোঁটা পানি যে পড়ে না তা কিন্তু নয়। আমি তাই কমোডের সিটটা উল্টো করে উঠিয়ে রাখি, যাতে করে পানিটুকু ঝরে সিটটা শুকিয়ে যায়। কিন্তু আজ কখন যে কমোডের সিটে পানি পড়েছে বুঝতে পারছি না। বাথরুম থেকে এসে আয়েশ করে একটু শুয়েছি আর তখনই ডালিয়ার এই রুদ্র মূর্তি সাথে বাঘিনীর গর্জন।
আমি আর ডালিয়া দুজনেই একটা বড় স্টোরে কাজ করি। একসাথে ছুটি সহসা পাই না। লেবার ডে বলে আজ দুজনেরই ছুটি। ছুটির দিন সকাল বেলা এরকম একটা ঝগড়া না করলেও পারত ডালিয়া। আমি জানি ডালিয়া বাথরুমে গোসলের জায়গা ছাড়া অন্যত্র পানি পড়া পছন্দ করে না। পারলে গোসলের পর বাথটাবটাও টাওয়েল দিয়ে মুছে রাখে। আমিও যে এটা পছন্দ করি তা নয়। এটা পছন্দ করার মত বিষয়ও নয়। তাছাড়া এইসব দেশে প্রায় সব বাড়িই কাঠের। আর বাথরুম যেহেতু ঘরের মধ্যেই তাই কোথাও পানি পড়লে তা ফাঁক গলে নিচের ফ্লোরে চলে যায়। বাড়ির ক্ষতি হয়।
বাংলাদেশের বাথরুম এইদেশে রেস্টরুম নামেই বেশি পরিচিত। নিউ ইয়র্কে আসার পর তাই রেস্টরুম ব্যবহারের থেকে আমি অনেক সতর্ক। তারপরও কিছু ঘটনা অসাবধানতায় ঘটেই যায়। এর কারণ আমি এটাকে অতটা সিরিয়াসলি নেই না। আমি ভাবি, সামান্য পানিই তো, কিছুক্ষণ পর এমনিতেই শুকিয়ে যাবে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পানি শুকানোর আগে ডালিয়ার মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে। আর সেই আগুনে পুড়ে যায় আমার মান-সম্মান। আজও তাই হয়েছে। প্রথমে চিৎকার, তারপর গালিগালাজ এবং শেষে গজগজ করতে করতে ডালিয়ার মেজাজের আগুন নিভে যাবে। আমি এটা জানি তাই চুপ করে থাকি। চুপ করে না থাকলে গজগজানি দীর্ঘায়িত হবে। আমি শোয়া থেকে উঠে বসি। শুয়ে আরাম করছি দেখলে আগুনের মধ্যে সেই আরাম; ঘি এর কাজ করবে। আমি চেহারায় একটা ফেইক অপরাধীভাব আনার চেষ্টা করি যদিও নিজেকে আমি ততটা অপরাধী মনে করি না। প্রথম দিকে আমি এটুকুও করতাম না। দেখলাম তাতে সমস্যা আরও বাড়ে। তাই ধীরে ধীরে চেহারায় অপরাধীভাব আনা, মাঝেমধ্যে সরি বলা চালু করেছি। এত কাজ হচ্ছে। কিন্তু এর ফলে একটা বাধ্যতামূলক শিক্ষাধর্মী লেকচার শুনতে হয় ডালিয়ার কাছ থেকে। এটা করা উচিত, এভাবে করবে, বাথরুম সুন্দর রাখা সবার দায়িত্ব ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে ডালিয়ার এই লেকচারে কাজ হয়েছে এবং হচ্ছে। তবে এই হঠাৎ চিৎকার চেঁচামেচিটা সবসময় হজম হতে দীর্ঘসময় নেয়। অনেক সময় দুই-তিনদিনও লাগে। এভাবে চলতে চলতে আমি অনেকটা কমোড ফোবিয়ায় আক্রান্ত। বলা যায়, এটা আমার সেল্ফ ডায়াগনোসিস। ফলে আমি এখন কমোড, বেসিন, রেস্টরুমের ফ্লোর ফাইভ স্টার হোটেলের মত শুকনো তকতকে ঝকঝকে রাখার চেষ্টা করি। সবসময় যে পারি তা নয়, স্বভাবে নাই, তা মাঝেমধ্যে ঐ যে আমার ফর্মূলা; কমোডের ভেজা ডিম্বাকৃতির সিটটা উল্টে খাড়া করে রাখি, যাতে পানি ঝরে সেটা শুকনো থাকে।
ডালিয়া ইতোমধ্যে খিস্তির স্তরে পৌঁছে গেছে। সাধারণত চিৎকার তিন চার মিনিট স্থায়ী হলেই সেটা খিস্তির স্তরে পৌঁছে যায়। খিস্তি চলবে দুই-তিন মিনিট। শেষ হবে গজগজানি দিয়ে। গজগজানি চলতে পারে দশ থেকে পনের মিনিট। আমি দূর থেকেও খিস্তি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। কারণ শোনানোর মত ডেসিবেলেই বলা হচ্ছে। একেবারে ৯৫ ডেসিবেল।
– জীবনে কমোড ইউজ করছে বলে মনে হয় না, একেবারে বস্তির টাট্টিখানা বানাইয়া রাখছে। মানুষ এত নোংরা হয় কীভাবে? মনে হয় বাপজন্মে কমোড ব্যবহার করে নাই। এই হলো আজকের খিস্তির বচন।
দশ বছরের বিবাহিত জীবনে এইরকম গালির ভাষণ আমি কমপক্ষে মাসে একবার করেও হলেও বছরে ১২ বার, মানে দশ বছরে দশ বারং একশো বিশবার শুনেছি। ডালিয়ার এই গালির ক্ষমতা এককথায় অসাধারণ। চাইলে ওকে হায়ার করা যায় এই কাজে, এতটাই চৌকস। গালির চোটে চামড়ার তিনস্তরের বাইরের এপিডার্মিস লেয়ার সাথে সাথে এমনভাবে উঠে যাবে যেন শিরিষ কাগজ দিয়ে ঘষে দেয়া হয়েছে। যাকে বলে এ্যাবরেশন । কমপক্ষে একশো বিশবারের ঘষায় আমার ত্বকের বেশিরভাগ নার্ভ মরে অসাড় হয়ে গেছে। এখন আর এই গালি বা উত্তেজক আমার সংবেদনশীলতাকে তেমন জাগাতে করতে পারে না। উল্টো মাঝেমধ্যে যখন ভালো ব্যবহারের মৌসুম চলে তখন হালকা আতঙ্কে অপেক্ষা করি আবার কখন ফিরে আসবে গালিময় রক কনসার্ট। একপ্রস্থ খিস্তি হয়ে গেলে অন্তত সপ্তাহ দুয়েক শান্তি।
আজকে গালির হাওয়াটা অন্যদিনের চেয়ে তীব্র এবং গরম। অনেকটা লু হাওয়ার মত। যদিও লু হাওয়ার অভিজ্ঞতা আমার নেই। যতটা বিবরণে জেনেছি তাতে মনে হচ্ছে, ডালিয়া এখন লু হাওয়া আর আমি মরুভূমির কোন অঞ্চল। আমি মরুভূমির অঞ্চল হয়ে আর বেশিক্ষণ বেডরুমে থাকলাম না। বেডরুম থেকে বেরিয়ে লিভিং রুমের দিকে রওনা হলাম। ডালিয়া আমার এড়িয়ে চলার প্রবৃত্তি বুঝতে পেরে আমাকে থামালে।
তাই দূর থেকেই ডাকলো- এই ডিউক, কই যাও। দুধ-ডিম নাই, পিয়াঁজ নাই, নিয়ে আসো।
ডালিয়া আমাকে একটু বেশি শাস্তি দেয়ার জন্য এমনটা করছে। ওর এই আচরণ আমার পরিচিত। আমাকে আরো কিছুক্ষণ গালি শোনাতে না পারার জন্য তার এই অতিরিক্ত শাস্তির ব্যবস্থা। আমি জানি, যে জিনিসগুলো আনতে বলেছে সেগুলোর সবই বাসায় আছে। এখন যদি আমি বলি- এগুলো তো মনে হয় বাসায় আছে। তখন ডালিয়া বলবে- থাকুক, কাল লাগবে, কাল তুমি কই না কই থাকো তখন কে আনবে?
আমি কথা না বাড়িয়ে গ্রোসারির উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ি। বাইরের পরিবেশটা অনেক ভালো লাগছে, একা একা ডালিয়াকে সামনে কল্পনা করে কথা আর ঝগড়ায় তাকে পরাস্ত করার চেষ্টা করি। অলীক প্রতিপক্ষের সাথে কথা কাটাকাটি করতে করতে সওদা সেরে মনে হল, বাসায় ফিরতে ইচ্ছে করছে না। খুব অপমানিত মনে হচ্ছে নিজেকে।
বাজারের থলে হাতে নিয়ে আর কতক্ষণ ঘোরা যায়! ইচ্ছে করছে, ঘন্টাখানেক পার্কের বেঞ্চে শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখে তারপর বাসায় ফিরি। রাগে আমার মেজাজটা এংরি বার্ড হয়ে আছে। এটাই আমার সমস্যা। স্ত্রীর ভাল থাকার সাথে আমার ভাল থাকা জড়িত। ডালিয়ার এইসব কথাবার্তা দীর্ঘসময় আমার কাজকর্মকে স্থবির করে দেয়। এক সায়কিয়াট্রিস্ট বন্ধুর সাথে কথা বলে জেনেছি, এটাকে বলে, সেল্ফ লাভ ডেফিসিট ডিসঅর্ডার। নিজের প্রতি ভালবাসা কম, অন্যে আমার ভাল থাকাকে নিয়ন্ত্রণ করে।
বুঝতে পারি ডালিয়ার এই সমস্যা নেই। তাই বাসায় ফিরে দেখি ডালিয়া ইতোমধ্যে আমার অবর্তমানে গজগজানি ধাপ পার করে খুবই শান্ত স্বাভাবিক অবস্থায় আছে। ফোনে হেসে হেসে বান্ধবীর সাথে কথা বলছে। যেন কিছুক্ষণ আগে কিছুই হয় নাই। আমাকে ইশারা করে দেখাল যে, টেবিলে ব্রেকফাস্ট দেয়া আছে। অথচ একটু আগে ব্রেকফাস্ট করার সুযোগ না দিয়েই আমাকে বাসা থেকে বের করে দিয়ে গ্রোসারি শপে পাঠিয়েছে। আমি ডাইনিং টেবিলের দিকে ইচ্ছে করেই না তাকানোর ভাব করে বাজার রেখে লিভিং রুমে গিয়ে বসলাম৷ আমার কানে এখনো ভাঙ্গা রেকর্ডের মত একটু আগের সেই কথাগুলো বেজেই চলেছে। যদিও এই ধরনের গালাগাল নিত্যকার ব্যাপার হয়ে গেছে তারপরও তাৎক্ষণিকভাবে তা হজম হতে চায় না, মেজাজটা পাম্প দেয়া কেরোসিন স্টোভের মত ফুঁসে ওঠে। মনে মনে পণ করলাম আমিও তক্কে তক্কে থাকবো, দেখবো তুমি কখনো কমোডের সিটে পানি ফেলো কী না। সকাল থেকেই কিছুই খাই নি। ডালিয়ার বানানো ব্রেকফাস্ট খাওয়া তো দূরে থাক স্পর্শ করতেই ইচ্ছা করছে না।
ভাবলাম একটু চা, মুড়ি খেয়ে ক্ষুধাটাকে আপাতত শান্ত করি। কিচেনে টি-ব্যাগ নিয়ে চা বানাতে উদ্যত হলে ডালিয়া স্টোভের দিকে চোখ ঘুরিয়ে বলল- চা বানানো আছে। আগে নাশতা করে নাও।
মনে মনে রেগে বললাম- তোর নাশতা আর চা তুই খা। ডালিয়া আমার জায়গায় থাকলে হয়তো এভাবেই বলতো। আমি যে কথা মনে মনে বলেছি, ডালিয়া সেটি মুখে বলতো।
আমি মুখশ্রীতে মূক ও বধিরের মত নির্বিকার চিত্র এঁকে টি-ব্যাগে করে চা বানিয়ে মুড়ির কৌটোসহ দ্রুত কিচেন থেকে বেরিয়ে এলাম।
সপ্তাহের প্রথম ছুটির দিনে বেশির সময়েই আমরা ২/৩ ঘণ্টার লং ড্রাইভে যাই। নিউ ইয়র্কে আসার পর সামারের টাইমটাতে এটাই আমাদের রুটিন। গতরাতেও ডালিয়া যখন জিজ্ঞাসা করলাম- কাল কি কোথাও যেতে
চাও?
ডালিয়া কেমন একটা তন্দ্রালু কন্ঠে আধবোঁজা চোখে বলল- এই সপ্তাহ থাক, শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে।
তারপর পাশ ফিরে ঘুমিয়ে গেল। আমিও ওর কথায় সায় দিয়ে ভাবলাম, এই শনিবারটায় অ্যালার্ম বন্ধ করে ঘুমাবো। সেই ঘুমের তো বারো দুইগুণে চব্বিশটা বেজেছে সকাল সাতটায়। খুব ভোরে হয়তো রেস্টরুমে গিয়ে সিটে পানি ফেলে এসেছি, এখন সেই পানিতে আগুন লেগেছে ।
লিভিংরুমে বসে কিছুক্ষণ কিছু বইপত্রে চোখ রাখতেই ঘুম এলো। ঘুম থেকে জেগে দেখি সত্যি সত্যি ঘড়িতে বারোটা বেজেছে। সেই সাথে রেস্টরুমের দুর্বার আহবান টের পেলাম। সাড়া না দিয়ে উপায় নাই। অগত্যা সেই রেস্টরুমে ঢুকে প্রথমেই চোখ পড়লো কমোড বোলের দিকে। কমোডের সিটটা নামানো, তার ওপর লাল রঙের কয়েকটি ছোট ছোপ ছোপ দাগ। যাক মওকা পাওয়া গেছে। আমি আরও কাছ থেকে দাগগুলো দেখার চেষ্টা করলাম। মনে হল দাগগুলো রক্তের। তারপর টয়লেট পেপার দিয়ে সেগুলোকে মুছে বিনের মধ্যে ফেলতে যেয়ে বিনের ঢাকনা খুলতেই দেখি, ছোট পলিথিনে পেঁচানো আরও কিছু রক্ত মাখানো টয়লেট পেপার। স্বছ পলিব্যাগের বাইরে থেকে রক্তের দাগগুলো বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হচ্ছিল না। নিশ্চিত হওয়ার জন্য গ্লোভস পরে পলিব্যাগ খুলে বুঝতে বাকি রইলো না এ কীসের রক্ত। কারণ ব্যাগের মধ্যে একটা ব্যবহৃত সেনিটারি প্যাডও আছে। আমি পুরো টয়লেট বিনের ব্যাগটা বন্ধ করে বাইরে রেগুলার গার্বেজ বিনে ফেলে এসে নতুন ব্যাগ দিলাম সেখানে। তারপর নিজে ফ্রেশ হতে হতে লক্ষ করলাম মনটা দ্রুতই বিষাদের মেঘে আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে, এখনই বুঝি সেই মেঘ থেকে বৃষ্টি নামবে। যে বৃষ্টিতে ধুয়ে যাবে মওকা লাভের প্রতিশোধ স্পৃহা,সব ক্ষোভ, শীতল হয়ে যাবে সব রাগ।
তুমুল সেই বৃষ্টির পর রেস্টরুম থেকে বের হয়ে দেখি ডালিয়া এই অবস্থায় খিঁচুড়ি মাংস রান্না করছে। আমাকে দেখেই বলল- ভাবলাম, বাসায় যখন আছি, কিছু রান্না করি; তোমার জন্য গোল বেগুন ভাজা করেছি। দেখ তো মাংসের লবন ঠিক আছে কী না?
ডালিয়াকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে, সে একটা কষ্টকর অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে । সব শারীরিক কষ্ট ছাপিয়ে ডালিয়ার প্রানবন্ত হাসির আলোটাই আমার চোখে পড়ছে। সেই আলোর প্লাবনে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে আবুল
হাসানের কবিতার কিছু পংক্তি-
ঝিনুক নীরবে সহো, ঝিনুক নীরবে সহে যাও
ভিতরে বিষের বালি, মুখ বুজে মুক্তা ফলাও!
***********************************