You are currently viewing ভাতজ্বর || সজল আশফাক

ভাতজ্বর || সজল আশফাক

ভাতজ্বর
সজল আশফাক

ভৈরবে তখন একটাই সিনেমা হল। সিনেমা হলের নাম ছবিঘর। ছবিঘর নামটা বেশ পছন্দ আমার। ভৈরব তখন ময়মনসিংহ জেলাধীন একটা থানা। সিনেমা হলের নাম না হয় ছবিঘর বুঝলাম কিন্তু সিনেমাকে কেন ‘বই’ বলা হয়, বুঝতে পারতাম না। আমার মা ফরিদা খানম সিনেমাকে ‘বই’ বলতেন; তখনকার দিনে এটাই ছিল চল। তখনকার দিনে মানে ১৯৭০ সাল। সেই সময়ে অনেককেই এমনটা বলতে শুনেছি। আমার বয়স তখন বড়জোর ৭/৮ বছর হবে, তখন আমি এতকিছু বুঝতাম না। বড় হয়ে এই বিষয়টি নিয়ে ভেবেছি। হয়তো গল্প-উপন্যাসের বইয়ের কাহিনী নিয়ে সিনেমা বানানো হয় বলে সিনেমাকে ‘বই’ বলে অভিহিত করা হয়। এটা আমার ব্যক্তিগত অভিমত।
মাকে আমি আম্মা ডাকতাম। সেদিন সন্ধ্যার আগেই আম্মা প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ‘বই’ দেখতে যাওয়ার। সাধারণভাবে উনি বাসায় একপ্যাঁচে শাড়ি পরতেন। বিয়ের পর সাধারণ মেয়েরা তখন সেলোয়ার-কামিজ ছেড়ে শাড়ি পরতো, এটাই ছিল রেওয়াজ। খুব অল্পসংখ্যক মেয়েরা বিয়ের পর সেলোয়ার-কামিজ পরতো। হয়তো বিয়ের পর সেলোয়ার-কামিজ পরাটা ছিল তখনকার আধুনিকতা। আমার মা অতটা আধুনিক না। বাসায় খালা-মামী-চাচীদেরকে একপ্যাঁচেই শাড়ি পরতে দেখেছি, আম্মাও সেটাই অনুসরণ করতেন। কদাচিৎ দু’একজনকে দেখেছি ঘরে থাকা অবস্থায় সামনে কুঁচি দিয়ে শাড়ি পরতে। সেই সময়ে বেড়াতে গেলে সামনে কুঁচি দিয়ে শাড়ি পরাটা ছিলো সাজগোজের অংশ। কুঁচি দিয়ে শাড়ি পরার মধ্যে প্রকাশ পেতো, ফ্যাশন সচেতনতা আর স্মার্টনেস। শাড়ি পরার চৌকস কৌশল অনেকেরই পুরোপুরি আয়ত্তে থাকে না। যারা শাড়ি পরেন তারা খুব ভালোই জানেন বিষয়টি। একা একা শাড়ি পরতে দক্ষ নয় অনেকেই, কারো না কারো সাহায্য লাগে। এখন এই পঞ্চাশোর্ধ বয়সে স্বামী হিসাবে আমি নিজে স্ত্রীর শাড়ি পরায় সাহায্য করেছি অনেকবার।
আমার অল্পবয়সী মা ফরিদা খানম তখনো শাড়ি পরায় দক্ষ হয়ে ওঠেন নি। প্রায়ই শাড়ি পরার ব্যাপারে আমার সাহায্য নিতেন তিনি। আমার আজও স্পষ্ট মনে আছে সেদিনের সিনেমা দেখার দিনটির কথা। আম্মা কোনভাবেই সেদিন শাড়িটিকে বাগে আনতে পারছিলেন না। শাড়ি পরার পর নিচের দিকের পাড়টা উঁচু নিচু হয়ে থাকছিলো। এক পর্যায়ে আম্মা টেবিলের ওপর দাঁড়িয়ে আমাকে ডেকে বললেন, শাড়ি নিচের পাড়কে টেনে একই লেভেলে এনে দিকে। কিশোর বয়সের আমি তখন খুব দক্ষতার সাথে কাজটি করেছিলাম। পাশের রুমে বসে আমার বাবা আকবর আলী বিরক্ত হচ্ছিলেন তার স্ত্রী ফরিদা মানে আমার মায়ের শাড়ির পরার বিলম্ব দেখে, পাছে সিনেমা হলে পৌঁছাতে দেরি হয়ে যায়। ফাঁকে একটা কথা বলে রাখি। আমার বাবা ছিলেন রাশভারি মেজাজের লোক, বাবাকে আমি আব্বা বলে সম্বোধন করতাম।
রাতে সিনেমা দেখা শেষে বাসায় ফিরেই ঘটলো অপ্রত্যাশিত এক দুঃখজনক ঘটনা। আমরা কেউই ঘূর্ণাক্ষরেও ভাবিনি সিনেমা দেখে আসার পর হঠাৎই বাসার আনন্দঘন পরিবেশটা পাল্টে এতটা বিষাদময় হয়ে যাবে! দুধ-কলা দিয়ে ভাত আব্বার খুব প্রিয় ছিল। রাতে খেতে বসে শেষাংশে দুধ কলা দিয়ে আব্বা এবং আমি ভাত খাবো এমনটাই কথা ছিলো। আম্মা সবসময় পরে একা খাবার খেতেন। সেদিনও আম্মা আমাদের দুজনকে খাবার পরিবেশন করছিলেন। আমরা রান্নাঘরে মাদুর পেতে খেতে বসেছি। খাওয়ার শুরুতেই প্লেটের পাশে সাগর কলাও রাখা ছিলো। ঢাকা থেকে আসার সময় নিয়মিতভাবেই নরসিংদী রেলস্টেশন থেকে অন্তত একডজন কলা কিনতেন আমার বাবা। গতকালই আমরা গ্রামের বাড়ি বরিশাল থেকে ঢাকা হয়ে ট্রেনে ভৈরব এসেছি। আসার পথে নরসিংদী স্টেশন থেকে যথারীতি সাগর কলা কিনেছেন আমার বাবা আকবর আলী। নরসিংদীর সাগর কলা তার খুব প্রিয়, আকারে বড়, বিশেষ একটা সুঘ্রাণ আছে। কলা দুধভাতের আয়োজন করার সময় দুধের পাতিলটা মিটসেফের ওপর থেকে নামাতে যেয়ে আম্মা দেখেন তাতে খুব সামান্য পরিমাণে দুধ রয়েছে। কারণ বুঝতে বাকি রইলো না। বিড়ালটা মানে আমাদের চেনা বেড়াল ‘মিনি’ জানালা খোলা পেয়ে বেশিরভাগ দুধই সাবাড় করে চলে গেছে। দুধের পাতিল খালি দেখে আম্মা বিস্মিত কণ্ঠে বলে উঠলেন- হায় হায়, এ কী! মিনি তো দুধে মুখ দিয়েছে।
আম্মার কথা শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আব্বা ক্ষেপে গিয়ে বললেন- মানে? আব্বার রাগী চেহারায় উচ্চারিত এই একটি শব্দ শুনেই আম্মা ভয়ে চুপসে গেলেন। এই ঘটনার জন্য আম্মা যেন নিজেকেই দোষ দিলেন, ছবিঘরে যাওয়ার আগে জানালা আটকাতে ভুলে গিয়েছিলেন তিনি। যদিও দুধের পাতিলটা ঢাকনা মতন একটা কিছু একটা দিয়ে খানিকটা ঢাকাও ছিলো, তাতে কাজ হয়নি।
রান্নাঘরের মেঝেতে মাদুর পেতে কী সুন্দর খেতে খেতে গল্প করছিলাম। বরিশালের গ্রামের বাড়ির গল্প, সিনেমার গল্প। তারমধ্যে দুধ নিয়ে হঠাৎ পরিস্থিতি চরম থমথমে হয়ে গেলো। কোনকিছু বুঝে ওঠার আগেই ভাতের প্লেট হাত দিয়ে ঝাড়ু দেয়ার মতো করে সামনের দিকে জোরে সরিয়ে আব্বা উঠে গেলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় স্তম্ভিত এবং ভীত আমি নিমিষেই কুঁকড়ে গেলাম। বিছানো মাদুর পেরিয়ে মেঝেতে উল্টে পড়ে আছে ভাতের প্লেট, তার পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ভাতগুলো। আম্মার ভীষণ কান্না পেলেও তিনি কাঁদলেন না। ছেলের সামনে প্রাপ্ত অপমান তাকে কাঁদতে দিলো না। আম্মা যতটা না কষ্ট পেয়েছেন, অপমানিত হয়েছেন তার চেয়ে বেশি। দেখলাম, অপমানে তার চোখ ফেটে কয়েক ফোঁটা উষ্ণজল উঁকি দিয়েছে। টুপ করে গড়িয়ে পড়ার আগেই আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে ভাতগুলোকে প্লেটে তুলে রাখলেন তিনি। সাধারণত সবাইকে খাওয়ানোর পর আম্মা খেতেন, এটাও সেই সময়ের মায়েদের একটা নিয়ম ছিলো। এমন ঘটনার পর আম্মার আর খাওয়া হয় নি, সেই রাতে তিনি উপোস কাটালেন।
রাতে বিছানায় আব্বা উল্টো দিকে মুখ করে ঘুমিয়ে পড়েছেন। এমন ঘটনার পর এত তাড়াতাড়ি নিশ্চিন্তে ঘুম আসার কথা নয় সেটা বুঝতে পেরেও কিছু বললেন না আমার সর্বংসহা মা। তিনিও উল্টো দিকে মুখ করে চুপচাপ শুয়ে রইলেন। পুরো বাসায় কবরের নিস্তব্ধতা। পাশের রুমে বুকে ভারী পাথরচাপা কষ্ট নিয়ে আমি শুয়ে আছি । সেই রাতে কারোরই ঘুম হওয়ার কথা না থাকলেও দীর্ঘভ্রমণের ক্লান্তিতে একসময় সবাই ঘুমিয়ে পড়ি।
পরদিন সকালের নিশ্চুপ রোদ আমাদের বারান্দায় এলিয়ে পড়লেও তা কোনভাবেই তা আমাদের কারো মনকে আলোকিত করলো না। আমি আগেভাগে উঠে স্কুলের পড়া পড়তে বসেছি। যদিও আজ রবিবার স্কুল বন্ধ। তারপরও পড়তে বসেছি আব্বাকে দেখানোর জন্য, যাতে পড়াশুনা নিয়ে বকা দেয়ার সুযোগ না পান। আব্বার মেজাজ খারাপ এখনো আছে কী না, জানি না। ঘুম থেকে উঠে দেখি, আম্মা আটার রুটি বানাচ্ছেন সাথে আলুভাজি। আব্বা এখনো ঘুমাচ্ছেন। এতো বেলা করে তিনি ঘুমান না। আম্মা একটা ছোট্ট টুকরিতে করে কিছুটা মুড়ি সাথে কোড়ানো নারকেল আর আখের গুড় দিয়ে গেছেন আমার রুমে। আম্মার মুখ এখনো দু:খ ভারাক্রান্ত। আমি শান্তভাবে শুধু একপলক মায়ের দিকে তাকালাম। মুড়ি, নারকেল আর গুড় দিতে দিতে আম্মা মনক্ষুন্ন গলায় বললেন- খেয়ে নে। তারপর হন্ হন্ করে রুম থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর আমার বাবা ঘুম থেকে উঠে যথারীতি শেভিংব্রাশ দিয়ে মুখে কোন আইসক্রিমের মতো একগাদা সাদা ফেনা তুলে সেভেন ও’ক্লক ব্লেড দিয়ে শেভ করলেন। তারপর গোসলের জন্য মেঘনা নদীর ঘাটের উদ্দেশে বেরিয়ে গেলেন।
ভৈরবে তখন টানা পানির যুগ। পানিওয়ালারা বাসায় বাসায় টিনের ভাড়ে করে মাস হিসাবে পানি দিতো। যে কারণে পুরুষদের গোসল, কাপড় ধোয়া ইত্যাদির বেশিরভাগই অধিকাংশরা নদীর ঘাটে করতো। কাজের বুয়ারা নদীর ঘাট থেকে কাপড় ধুয়ে বাসায় আনতো। বড় মাটির মটকাতে পানি জমা রাখা হতে বাসায় ব্যবহারের জন্য।

ইতোমধ্যে সকালের নাস্তা তৈরি করে বেডরুমের টেবিলে রেখে দেয়া হয়েছে বাবার জন্য। গোসল সেরে এসে সেদিকে ফিরেও তাকালেন না আব্বা, না খেয়েই বাসা থেকে বেরিয়ে গেলেন কাউকে কিছু না বলে। আব্বা বাসায় ফিরলেন একদম সন্ধ্যায়। বাসায় ফিরে কাউকে কিছু বললেন না, একবার শুধু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন- পড়াশুনা করছো? উত্তরে জড়োসড়ো আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক শব্দ করে বললাম- হুম।
এখন পর্যন্ত আব্বা এবং আম্মা কেউ কারো সাথে কোন কথা বলছেন না। আমিও ভয়ে আব্বার সাথে কথা বলছি না। যা কিছু দরকার আম্মার কাছে নিভৃতে বলছি, যেন আব্বা টের না পায়। ভাবখানা এমন যেন আম্মার সাথে আমার কথাবার্তা চলছে এটা আব্বা জানলে আব্বা আমাকে তিরস্কার করবেন। প্রায় ২৪ ঘণ্টা ধরে চলছে এই পরিস্থিতি। এমন গুমোট বোবা পরিস্থিতির অবসান কীভাবে হবে, কখন হবে, সেটাই ভাবছি আমি।

রাত তখন ১টা। আম্মা আব্বা এবং আমি গত রাতের মতো একই অবস্থানে আছি। হঠাৎ রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে শোনা গেল তুমুল চিৎকার চেঁচামেচি। সেই সাথে বারান্দার শেষপ্রান্তের মূল দরজায় সজোরে ধপধপ শব্দও শোনা যাচ্ছে। কেউ যেন হাতের মুঠি দিয়ে জোরে আঘাত করছে। মধ্যরাতে চারিদিকের এমন তীব্র শোরগোলে আম্মার ঘুম ভেঙ্গে যায়। আম্মা উঠে এসে আমাকে ডেকে ওঠান। তারপর নিজেদের শোয়ার রুমে ফিরে যেয়ে কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে উল্টো দিকে মুখ করে শুয়ে থাকা আব্বাকে কয়েকবার ধাক্কা দিয়ে জাগানোর চেষ্টা করেন।
– এই ওঠো, বাইরে এত হইচই কেন? আম্মার কণ্ঠে আতংক।
আব্বাও হুড়মুড়িয়ে জেগে হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। আব্বা বিছানা ছেড়ে নেমে দ্রুত রুমের লাইটটা জ্বালিয়ে দেন। রুমের দরজা খুলে বাইরে বের হতেই বারান্দার মূল দরজায় আঘাত আরও তীব্রভাবে শোনা গেল এবং সেখানে বাড়িওয়ালা আলফাজউদ্দিনের কণ্ঠ। আলফাজ চাচা আব্বার নাম ধরেই ডাকছেন, আকবর সাহেব, ওঠেন, বের হন।
আমার বাবা আকবর সাহেব তার কথায় সাড়া দিতেই তিনি বললেন- রাস্তার ওপারে আগুন লাগছে, তাড়াতাড়ি বাসায় তালা দিয়ে বাইরে আসেন, আগুন এদিকেও আসতে পারে। রাস্তার অন্যপাশটা রান্নাঘর থেকে ভালো দেখা যায়। অবস্থা বোঝার জন্য আম্মা রান্না ঘরের দরজা খুলতেই জানালা গলে দেখলাম, মধ্যরাতে সেখানে দুপুরের সূর্য যেন গড়াগড়ি খাচ্ছে। লালাভ আলোয় আলোকিত রান্নাঘরের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখা গেলো পাহাড় সমান আগুনের কুণ্ডলী। ইতোমধ্যে আমার এবং আম্মার পিছনে এসে আব্বা দাঁড়িয়েছেন। আগুনের উত্তাপ আমাদের মুখকেও স্পর্শ করছে। দাউদাউ করে জ্বলছে রাস্তার পার ঘেঁষা দোকান-পাট, দোকানের পিছনে অনেকেরই বাড়িঘর। লোকজনকে দূর থেকে বালতি দিয়ে পানি দিতে দেখা যাচ্ছে। পানির পরিমাণ এতই কম যে তা বিশাল এই আগুন নেভানোর জন্য ছিলো খুবই অপ্রতুল। আগুনের লেলিহান শিখাগুলোকে আমার কাছে রূপকথার বিশাল দৈত্যের লকলকে জিহবার মতো মনে হচ্ছিলো। আম্মা হঠাৎ বালতিভরা পানি এনে মগ দিয়ে জানালার কাঠের পাল্লাগুলো ভিজাতে থাকলে আম্মাকে থামিয়ে দিয়ে আব্বা তার হাতটা ধরে বললেন- চলো, বের হয়ে যাই। আম্মাও যাওয়ার জন্য তৈরীই ছিলেন। আব্বা শুধু একবার জিজ্ঞাসা করলেন- সবকিছু নিয়েছো?
আম্মা আব্বার চোখে চোখ রেখে কিছু একটা ইঙ্গিত করে বললেন- হুঁ।
আব্বা আর দেরী করলেন না, দ্রুতই বাম হাত দিয়ে আম্মার ডান হাত আর ডান হাত দিয়ে আমার বাম হাত ধরে বাসা ছেড়ে নিচে নামার জন্য রওনা হলেন। রাস্তায় নেমে দেখি অনেক মানুষ, আমরা বাসার কাছে পৌরসভার ভিতরের ফাঁকা রাস্তায় এসে অন্য পরিবারের সাথে আমরাও দাঁড়িয়ে থাকলাম। আমি আতঙ্কে শক্ত করে বাবার হাত ধরে আছি। কিন্তু এতো আতঙ্কের মাঝেও আমি যখন দেখলাম আব্বা এখনো আম্মার হাত ধরে আছেন, তখন আমার মনে একধরনের স্বস্তি নেমে এলো। আম্মার দিকে তাকিয়ে আরও বুঝলাম, শুধু স্বস্তি নয়, সাথে আস্থা ও ভালোবাসা অনুভব করছেন আমার মা। তাই আম্মাও শক্ত করে ধরে আছেন নির্ভরতার সেই হাত।

আমাদের তিনজনের পরিবারে হঠাৎ যে গুমোট পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়ে ছিলো আপাতত সেটি দূর হয়েছে। কিন্তু তার জন্য অনেক মূল্য দিতে হলো কতোগুলো মানুষকে। বাজারে আগুন না লাগলে কি আমার মা-বাবার মধ্যকার সম্পর্কটা এতো সহজে স্বাভাবিক হতো? কোন্ সমস্যার নিষ্পত্তি যে কীভাবে হয়, কেউ কি জানে?
কী অদ্ভুত না বিষয়টা। আগুন লাগলো বাজারে আর তাতে অন্যের দাম্পত্য সমস্যার আপাত অবসান হলো!
আমি এখন, তখনকার বয়সের বাবার চেয়ে অধিক বয়সী স্বামী এবং বাবা। এখন আমি জীবনের অনেক সমীকরণ বুঝতে পারি, প্রতিদিন আমাকে নানা সমীকরণের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এতদিন পরেও ছোটবেলার সব কথা একটার পর একটা মনে পড়তে থাকে। সেই রাতে আগুন নিভাতে নিভাতে প্রায় ভোর হয়ে গিয়েছিলো। শেষরাতে দমকলের গাড়ি আসার পর আগুনের আক্রোশ যখন প্রশমিত হতে থাকে তখন সবার মতো আমরাও বাসায় ফিরে আসি। আমার দু’চোখে তখন ঘুম আর ঘুম। ঘুম জড়ানো চোখে আমি আম্মাকে কাছে টেনে কানে কানে বলেছিলাম- আম্মা, বুড়া চাচার দোকান কি পুড়ে গেছে? বুড়া চাচা তো দোকানেই ঘুমায়! বুড়া চাচার কোন ক্ষতি হলো কী না তা নিয়ে আমার চোখেমুখে দুশ্চিন্তা। বুড়া চাচার ছোট্ট মনোহারী দোকানটা আমাদের বাসার কাছেই। টংঘরের মতো সেই দোকানে মূলত পান, সিগারেট বিক্রি হয়। এক টুকরো ভেজা লাল কাপড়ে ঢাকা থাকে পানের বিশাল পসরা, পিতলের ছোট ছোট মগের মতো পাত্রে চুন, খয়ের, একটা বাটিতে চিকন করে কাটা সুপারি। লুজ পেপার, খাতা, পেন্সিল, কলমও থাকতো সেই দোকানে। টকটকে লাল রঙের শিস পেন ছিলো আমার খুব পছন্দ। সামনে সারিবদ্ধ বয়ামের মধ্যে সাজানো থাকতো নানাধরনের চকলেট। ঝুলানো থাকতো কলা, বিস্কুটের প্যাকেট। মাঝেমধ্যে চকলেটের প্যাকেটের সাথে অতি সাধারণ প্লাস্টিকের আংটি কিংবা অন্য কোন খেলনা থাকতো উপহার হিসাবে। নিত্যনতুন খেলনাও পাওয়া যেতো সেই স্টলটাতে, যেমন- পানিবদ্ধ কাঁচের টিউবের মধ্যে ঝিলিমিলি কাগজ, তারমধ্যে ছোট ছোট প্লাস্টিকের মাছ কিংবা পানিভর্তি ছোট্ট বেলুন, রঙিন কাগজের চরকি আরো কতো কী!
পরদিন সকালে আমি খোঁজ নিয়ে দেখলাম, বুড়া চাচার দোকান পুড়ে কালো হয়ে গেছে, লোকজনকে বলাবলি করতে শুনলাম, বুড়ার কিছু হয়নি, আগুনলাগা টের পেয়ে উনি দোকান থেকে বেরিয়ে গেছেন। দেখলাম, দোকানের আশেপাশে পড়ে আছে পোড়া বয়াম, নানারকম খেলনা। খেলনা নিয়ে আমার দুঃখটা অনেক পুরনো। একটা তিনচাকার রিক্সা গাড়ির শখ ছিলো, পূরণ হয়নি। খেলার সামগ্রীর মধ্যে ছিল একটা বল, বাতাস দিয়ে ফোলানো যায় এমন একটা খেলনা উড়োজাহাজ আর একটা লুডু। লুডু খেলতে হতো মায়ের সাথে। স্কুলের খেলার মাঠে যেতে ইচ্ছে হতো কিন্তু বাবার নিষেধ বাইরে যাবার। নিচু শ্রেণীর ছেলেদের সাথে মেশা নিষেধ ছিলো। আমার বাবার ধারণা ওদের সাথে মিশলে আমি খারাপ হয়ে যাবো। কথাটা যে পুরোপুরি সত্যি কিংবা মিথ্যা নয় কিছুদিনের মধ্যেই আমি তা বুঝতে পেরেছিলাম। মানুষের ভালমন্দ ঢালাওভাবে এভাবে শ্রেণিবিন্যাস করা যায় না। তাই আমি মাঝেমধ্যে মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফুটবল খেলা দেখার সময় কখনো সখনো ওরা খেলতে নিলে ওদের সাথে খেলতাম।
একা একা থাকার কারণে মনটা আমার খারাপই থাকে। অথচ বরিশালে দাদার বাড়ি, নানার বাড়িতে আমার বয়সী কতো শতো চেনা মানুষ! কতরকম খেলা, দিনেরবেলায় দাড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট, সাত চারা, ফুল টোকা, ইটকিরি মিটকিরি। আর ফুটবল খেলা তো ছিলোই। সেই সাথে বড়দের হা-ডু-ডু খেলা দেখার মজা। রাতে কাগজ ভাঁজ করে চোর-পুলিশ খেলা। গ্রামে সমবয়সীদের সাথে মাছ ধরা, গাছে চড়া, পুকুরে গোসল এসব ছিলো প্রতিদিনের বিষয়। গ্রামে যাওয়া মানেই ফুলটাইম নানারকম বিষয় নিয়ে ব্যস্ততা। সেই মজার ব্যস্ততা ফেলে হঠাৎ ভৈরব চলে আসায় বুকটা আমার অনেক ফাঁকা ফাঁকা লাগছিলো। গ্রামের সবার জন্য মনটা হাহাকার করে উঠতো, বিশেষ করে জানালার ফাঁক দিয়ে দৃশ্যমান বিকেলের আকাশটাকে আমার কাছে মনখারাপের প্রতীক মনে বলে মনে হতো। জানালার ফ্রেমে বন্দী বিকেলের হলুদাভ আয়তাকার ম্লান আকাশ দেখে আমি একাএকা অনেকবার কেঁদেছি।
বরিশালের গ্রামের বাড়ি থেকে আমরা ভৈরব ফিরে এসেছি মাত্র চারদিন হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাতে লঞ্চে করে শুক্রবার ঢাকায় আসা, তারপর ঢাকায় মামার বাসা থেকে শনিবার ভোরে রওনা হয়ে ভৈরব পৌঁছানো, শনিবার রাতে ভাত খাওয়ার সময় বাবার রাগ দেখানো, রবিবার রাতে আগুন লাগা, আর আজ সোমবার। আমার কাছে এই চারদিনকে মনে হচ্ছিলো চারমাস। আমি জানালার শিকে মাথা ঠেকিয়ে নীরবে কাঁদলাম। আমি জানি স্কুল খুললে বন্ধুদের সাথে দেখা হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। তারপরও আমি কাঁদলাম। গ্রামের সেই আনন্দময় দিনগুলোর তুলনায় আজকের দিনটাকে আমার কাছে কারাগারের দিন বলে মনে হলো। হঠাৎ আমি পিছন থেকে বাড়িয়ে দেয়া একটা হাতের স্পর্শ পেলাম। কিছুটা চমকে পিছনে তাকিয়ে দেখি আমার মা।
– কী হয়েছে? একা একা কাঁদছো কেন বাবা? আদুরে এবং উৎকন্ঠিত গলায় প্রশ্ন করলেন আম্মা। তারপর আমাকে বুকে টেনে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন- বাড়ির জন্য মন খারাপ?
আমি ডুকরে শব্দ করে কেঁদে কেঁদে শুধু বলছিলাম- হু..।
বুঝতে পারছিলাম, বাড়ির জন্য মনটা আন্মারও কাঁদছে কিন্তু আব্বার সেইদিনের দুর্ব্যবহারে সেই কান্না চাপা পড়ে আছে। বাবার ভাত ছুঁড়ে ফেলার ঘটনায় মা খুব কষ্ট পেয়েছেন। মাঝে মাঝে মনে হয় এই ঘটনা মা-বাবার মাঝে দেয়াল তুলে দিয়েছে, দু’জনের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করেছে। এর আগেও আম্মা রাগ করে সংসার ফেলে আমাকে নিয়ে বাবার বাড়ি চলে যেতে যেয়েও যান নি। আমার নানাভাই যথেষ্ট সামর্থ্যবান ছিলেন৷ কিন্তু আম্মা বুঝতেন, সেখানে স্বামী পরিত্যক্তা নারী হিসাবে তাকে সবাই ভাতের খোঁটা দেবে। ভাতের খোঁটাই যদি শুনতে হয় তা হলে তা স্বামীর কাছ থেকেই শুনবেন। এই ধরনের কথাবার্তা আম্মা মাঝেমধ্যে দু:খ করে একা একা বলতেন। আমি তখন আম্মাকে জড়িয়ে ধরে তার বুকে মুখ গুঁজে থাকতাম। তারপর আস্তে করে মাকে বলতাম- আম্মা, আব্বা কি তোমাকে অনেক বকা দিয়েছে, আমি বড় হয়ে তোমাকে নিয়ে চলে যাবো।
– না না, কেন? আমরা একসাথেই থাকবো বাবা। আমার মা অনেক কষ্টে মুখে হাসি টেনে পাকা অভিনেত্রীর মতো কথাগুলো বলতেন। তিনি চাইতেন না ছেলের মনে এ নিয়ে বাড়তি উদ্বেগ এবং চাপ থাকুক।
সেদিন আম্মা আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে অনুভব করলেন, আমার মাথাটা বেশ গরম, গলায় বুকে হাত রেখে উৎকণ্ঠিত হয়ে ভাবলেন- তাই তো, জ্বর এলো নাকি ছেলেটার! আম্মার চেহারা দেখে আমি সহজেই তার উদ্বেগ বুঝতে পারতাম।
– একি তোর তো জ্বর এসেছে! দুপুরে ভাত খাস নাই, দাঁড়া তোকে ভাত খাইয়ে দিচ্ছি, জ্বর চলে যাবে।
আম্না দ্রুতই রুইমাছের ঝোল দিয়ে ভাত মেখে এনে আমাকে খাইয়ে দিলেন। অবাক ব্যাপার হলো মায়ের হাতে মাখানো ভাত খেয়ে ঘাম দিয়ে আমার জ্বর ছেড়ে গেলো।
আম্মা আমাকে বললেন- আসিফ দেখছিস, জ্বর চলে গেছে, একে বলে ‘ভাতজ্বর’। ভাত না খেলে আমারও গা গরম হয়ে যায়, জ্বর ওঠে, ভাত খেলেই চলে যায়।
‘ভাতজ্বর’ এর কথা আমার আজও মনে আছে। এরপর আরও কয়েকবার আমার এমন জ্বর এসেছে, ভাত খেলেই তা চলে গেছে। জ্বর হলে অনেকেই ভাত খায় না, কিন্তু আমি খাই। ভাত খাওয়ার পর জ্বর চলে যাওয়ার রহস্য আমি আজও জানি না। আপনারা জানেন?
****************************

Leave a Reply