You are currently viewing আবুল সাপুড়িয়ার মজমা || লুৎফর রহমান মণ্ডল

আবুল সাপুড়িয়ার মজমা || লুৎফর রহমান মণ্ডল

আবুল সাপুড়িয়ার মজমা

লুৎফর রহমান মন্ডল

ছুঁ মন্তর ছুঁ ।
জয় বাবা শাহ আলি।
ভুট্টোর ভাইয়ের শালি।
লুঙির গিট্টু ধরে খালি।
চ্যাংড়া প্যাংরা দে তালি।
‘ভাল করি হাত দিয়া চিপি ধরো না হইলে পলায় যাবে।’

তারপর দেখতাম বয়স্করা লুঙি ধরে ভাঁজ করে দুই পায়ের চিপায় ঢুকাত। কেউ কেউ লুঙি জোরে ঝারা মেরে মালকাচ মারত। যারা লুঙি ছাড়া আসত তাদের জন্য অবশ্য সুবিধা হতো। একটা মনো প্রটেক্টিভ ব্যাপার থাকতো। পলায়নপর প্যানিস পেনিক তাদের তেমন তাড়া করতো না। তারা কিছুটা দুঃচিন্তা মুক্তভাবে আবুলের বিখ্যাত সাপ খেলা দেখতে পারত। এর মধ্যে যাদের ফুল স্টপ মাইন্ডি তারা লুঙি না পরলেও প্যান্ট বা পায়জামার পকেট দিয়ে বিচির গোড়ায় চিমটি দিয়া ধরে থাকত। কথিত ছিল আবুলের সাপের খেলা দেখতে এসে অনেকে মুলধন সহ চালান হারিয়েছে । যত বড় ব্যবসায়িই হোক এ মজমা বিপদসীমার বাইরে থাকতো না। আবুলের মজমা আগায় নানান ছলে, নানান গল্পে। স্কুল ড্রেস পড়া আমি, রাকিব আর আরিফ সাইকেল মাটিতে শোয়ায় রেখে জটলায় দাঁড়াতাম, আবুল সাপুড়িয়া আমাদের উদ্দেশ্যে হাঁক ছেড়ে বলত,
এ খাকি ড্রেস পড়া স্কুলের চ্যাংড়া গুলাক একনা সামনোত বসপের দেও।
ভবিষ্যৎ বাপ এরা, জাতি বৃদ্ধিতে এগ্লাই কান্ডারি। এগ্লার হাত ধরি দ্যাশ স্বাধীন হবে।
তখন এইসব শব্দ মাধুরী আমার মাথায় তেমন খেলতো না। তবে আস্তে আস্তে এসব শব্দের সাথে পরিচয় ঘটতে থাকে। তার সরস কথা আর বাক্সের সাপই ছিল আমার প্রধান ধান্দা।
আবুল সাপুড়িয়া গান ধরে,

ফান্দে পরিয়া ইয়াহিয়া কান্দে রে-
ফাঁদ বসাইছে মুজিব রে ভাই পুঁটি মাছও দিয়া
ওরে মাছের লোভে বোকা খান পড়ে উড়াল দিয়া রে।
ফান্দে পরিয়া ইয়াহিয়া কান্দে রে-

গানের তালে লোক সমাগম আরও বাড়ে। চরের মানুষ, উচার মানুষ, উজানের-ভাটির সবখানের মানুষ আবুলে বিনোদন খোঁজে। যে বিনোদনে কোন ফরমালিন নাই, যান্ত্রিকতা নাই, আছে মনের অফুরন্ত খোরাক। এই খোরাক নদীর প্রবাহমান জলের মতো, বাধাহীন মুক্ত পাখির মতো। কারও পছন্দ বা রুচির স্টেরিওটাইফ না। কারও বেঁধে দেয়া ঢং তাল লয়ের মুখস্ত কলা না।
গান শুনতে শুনতে আমরা স্কুলের বই বগলে চেপে বসে যেতাম আবুলের মজমা দেখতে। জনশ্রুত জনপ্রিয় গানগুলো তিনি নিজস্ব ঢংয়ে গাইতো। বিশেষ করে গাইতো মাটির সাথে মিশে থাকা ভাওয়াইয়া গান। আব্বাস উদদীনের সেসব গান মানুষের মুখে মুখে ঘুরত। সে গায়কী তার ট্রেডমার্ক করা। কোন কপি বা কর্জ করা নয়।
সুন্দরগঞ্জের আবুল সাপুড়িয়ার সাপখেলা একসময় খুবই জনপ্রিয় ছিল। মীরগঞ্জের হাট বসত সপ্তাহে দুদিন-রবিবার আর বিষুধবার। সপ্তাহের এই দুদিন স্কুল ছুটি হলেই খুঁজতাম, আবুল সাপুড়িয়ার মজমা বসছে কোথায়। সাধারণত আমাদের বয়েজ স্কুলের উত্তরে পুরনো বাসস্টান্ড, পাটনি পাড়া, মজিদ মন্ডল স্কুলের সামনের জুয়াহাটি, ষষ্ঠীর মোড়, হাটের ভিতরে ফাঁকা জায়গায় মজমা বসত। অনেক সময় খুঁজে না পেলে হাটফেরত মানুষকে জিজ্ঞেস করতাম,
ও চাচা সাপের মজমা বসাইছে কই?
খোঁজ পেলে সাইকেল টান মেরে চলে যেতাম। তারপর চলত ঘন্টাব্যাপী সাপখেলা দেখা। কয়েক রকমের বাক্সের পসরা সাজানো থাকত। ছোট, মাঝারি, বড় আকারের।
তার গলায় পেচাঁনো অজগর সাপ আজও আমার কাছে এক বিস্ময়ের নাম। সে এক মহা কারবার। মানুষ যা ভয় পায় বা করতে সাহস করে না-তা করার মাঝে এক ধরনের বাহাদুরি থাকে। মানুষের চোখ ছানাবড়া হওয়ার একটা ম্যাটার কাজ করে। একটা হিরোইজিম ফ্যাক্ট কাজ করে নিজের মাঝে।
আমাদের বন্ধু রাকিব কিছুটা দুর্ধর্ষ প্রকৃতির ছিল। দুর্ধর্ষ মানে আমাদের মধ্যে কেউ যেটি করার সাহস পেতো না সে সেটি আনায়াসে করতো । সে রিস্ক নিতো প্রচুর। একদিন ঐ অল্প বয়সে কোথা থেকে যেন সে একদলা পাতা এনে আমাদের আগুন জ¦ালিয়ে ধোয়া নিতে বলে। পরে বলে এগুলো ভাং পাতা। ধোয় নিলে পেট ভরে। আমরা তো অবাক । বলে কী ও। এই কথা কেমনে জানি স্কুলের স্যারেরা জেনে যায়। স্কুলের সব চেয়ে কড়া স্যার ছিলেন তৈয়ব স্যার। আমরা তাকে ভয়ে গজব স্যার বলে ডাকতাম। অবশ্য এই ডাকটা আমাদের মধ্যেই প্রচলিত ছিল। সেই রাকিবকে পুরো সকাল পিরিয়ডটাই স্যার নীলডাউন করে রেখেছিলেন।
আর বার বার বলেছিলেন, কী রে ভাং খাবি- ভাং এনে দেই।
রাকিবের এতো কথা কারণ আবুল সাপুড়িয়ায় মজমার সেই হিরোইজম। রাকিব আমাদের কাছে বলতে থাকে সেও ঐরকম সাপ গলায় ঝুলিয়ে খেলা দেখাতে পারবে-এটা তার জন্য ব্যাপার না। চাপা, এটা ওর পক্ষে সম্ভব নয় বলে আমরা ক্ষেপাতাম। সেদিন সম্ভবত শনিবার ছিল। মাসের প্রথম দিন। আমাদের স্কুলে সাধারণত মাসের প্রথম দিন বেতন ডে ছিল। স্কুল আর লা ফি বাবদ কয়েক পয়সা জমা দিতে হতে। আর যেদিন বেতন দিতাম সাধারণত প্রথম দিকের দু’একটি ক্লাস হতো না। রাকিব আমাদের বলে,
চল মাঠে তোদের মজমা দেখাব।
আমরা চোখ বড় করে ওর দিকে তাকাই। সে জোর করে আমাদের স্কুলের পেছনে যে নির্জন মাঠ সেখানে নিয়ে যায়। তারপর যা করেছে তা রীতিমতো সুপারম্যানের মতো। সে স্কুল ব্যাগে আস্ত বড় একটা জীবন্ত সাপ ধরে এনেছিল। এবং সেটি গলায় ঝুলিয়ে হুবহু আবুল সাপুড়িয়ার ঢ়ংয়ে মজমা দেখানো শুরু করে। সে কথা ভাবলে এখনো গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়।


গলায় ঝুলে রাখা অজগর আর হাতের মাউথপিচে অনবদ্য হয়ে উঠে তার মজমা। মন্ত্রমুগ্ধ শ্রোতা হিম হয়ে যায় তার কথার জাদুতে। সে মুগ্ধতা একচুলও নড়তে দেয় না দর্শকদের।
তার মোঁচ পাকিয়ে রসাল কথায় মানুষ বিনোদন পেত। তিনি কথা বলা শুরু করা মানে হাস্যরসের ঢেউ উটা। মানুষকে হাসানো পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজের একটি। তার মজমা দেখলে পাথর মনের মানুষও নিমিষে শিশু হয়ে যেত। হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা না হলেও তিনি ছিলেন আমাদের আনন্দের বাঁশিওয়ালা।
একদিনের ঘটনা তো ভোলার মতো নয়। এখনও মনে হলে আমার শরীর ঠান্ডা হয়ে আসে। অন্যদিনের মতো জুতা পাচার নিচে দিয়ে মজমা দেখছি। ঘুরতে ঘুরতে আমার সামনেই এসে দাঁড়ান তিনি। আমাকে মজমার মাঝখানে টেনে নিয়ে সেই অজগর আমার গলায় ঝুঁলিয়ে দেন। আমার তো জান বের হবার মতো অবস্থা। মনে হচ্ছিল একটা ছোট খাটো ভারি বস্তা আমার গলায় তুলে দিয়েছে। ভয়ে, সংকোচে আমার গলা শুকিয়ে যাবার যোগাড়। শেষে পিঠে চাপড় দিয়ে বলল, কইলজা আছে এই চ্যাঙড়ার। আমি বাড়িতে এসে ভয়ে দু’রাত ঘুমাতে পারিনি। ঘুমের মধ্যে সাপ সাপ বলে চিৎকার করে উঠতাম।
মা শুধু বলত, যা আবুলের সাথে সাপখেলা কর গিয়ে।
মনে মনে বন্ধু রাকিবের কথা স্মরণ করে সাহস স ার করার চিন্তা করতাম। কিন্তু সবার মন তোর আর একই ধাঁচের হয় না।
মজমায় সাপখেলার সাথে কিছু দাওয়াই বিক্রি করতেন তিনি। তাবিজ, শিকড়- বাকড়, মালিশের তেল ইত্যাদি। মানুষ কিনতোও সেসব। একালের জিনসেং এর মতো। মজমা শুরু হলেই আমার মতো অল্প বয়সীদের কাজ হতো তালি বাজানো। একটা করে সাপের বাক্সের মুখ খুলত আর তালি বাজানোর দায়িত্ব পড়ত আমাদের উপর। একবার জোড়ে শব্দ না হলে আবার। আমি শুধু বিস্ময় ভরা চোখে ভয়ংকর সাপগুলো নাড়াচাড়া করা আবুল সাপুড়িয়াকে দেখতাম আর তার ক্ষমতার অসীমতার কথা ভাবতাম। ভাবতাম ইনি পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর লোক, সাহসী মানুষ। সাপ যার কথা শোনে-বাপরে বাপ।
ভাবতাম ইশ, আমিও যদি এরকম সাপ খেলা দেখাতে পারতাম। আমাকেও মানুষ সাহসী ভাবতো, ছেলে ছোঁকরারা দলবেঁধে আমার মজমা দেখত। দারুণ একটা বনেদি বিষয় হয়ে দাঁড়াত। কিন্তু বন্ধু রাকিবের সেই জ্যান্ত সাপের ছবি মাথায় আসলে এ চিন্তা মরে যেত।
মজমায় দু’একটা সাপ দেখানোর পর একটা ছবিওয়ালা বই হাতে দারুন উচ্ছসিত দেখাত তাকে।
হাঁক দিয়ে বলতেন, এ হাফ প্যান পড়া চ্যাঙড়াগুলা পাউছেন তো।
আমি ফুল প্যান্ট পড়া থাকায় বসেই থাকতাম। আকুপাঁকু করতাম হাতের মুষ্টিতে থাকা ছবিটা দেখার জন্য। আমার কাছে আসলে, ছবিটা পকেটে ঢুঁকিয়ে বলত, এই চ্যাঙড়ার এলাও মোঁেচ গাজায় নাই আর ইয়ার শখ দেখছেন দ্যাখার।
ধমকের সুরে আমাদের-যাদের বয়স স্কুলপড়–য়া তাদের লাইনের বাইরে পাঠায় দিতো। এই হাতমুঠো স্থির চিত্র দেখানো হলে আবার সামনে ডাক পড়তো আমাদের। এরপর তিনি ঐশ্বরিক তেল-শিকড়-ছাল-ডাল বিক্রি শুরু করতেন। কোন এক বুড়ো লোককে টেনে এনে এই তেলের একটি শিশি হাতে ধরিয়ে দিতেন। সেই পৌঢ় তখন তার বলবর্ধক তেলের বিজ্ঞাপনের নায়ক হতেন।
এই বুড়াক দ্যাখো, আজকে যদি এক শিশি নিয়া যায়। আহা, চাচার বাড়িত সকালে ইদ হইবে বাহে।
আবুল সাপুড়িয়া ধরতেন,
সময় গেলে সাধন হবে না
পুঁড়িয়া খেলে যৌবন যাবে না।
নদীতে স্রােত না থাকলে
পাড় ভাঙে না।
গান শেষ করে তিনি তার স্বভাবসুলভ ভঙিতে বলতে থাকেন- এই চাচা পরের হাটে আসি কইবে, মোক কি দিলু রে আবুল তোর চাচী তো মোক দেখলে খালি পলায়। বোগলতে আইসে নারে!
তারপর হাসির রোল পড়ত মজমায়। আমি শুধু বুড়ি কেন পালাবে এই ভেবে পাকা দাঁড়িমোচওয়ালা বুড়োর দিকে তাকাতাম।

ছোট্ট শহরের লাল টুকটুকে পলাশ ফুলের যে গাছটাতে পাখির কিচির মিচিরে প্রতিদিন শুরু হতো-এখন সেই সকাল শুরু হয় মিলিটারির গুলির আওয়াজে। শহরের উপকণ্ঠে যেখানে নীলকুঠিদের বড় বড় দালান ঘর সেখানে তারা ক্যাম্প বসিয়েছে। পাশেই তিস্তা নদী ছুঁয়ে গোঁয়ালের ঘাট। সেই ঘাট দিয়ে দূর দূরান্তের মানুষ নৌকা নিয়ে বাজার করতে আসে। হাটবারে আসা মানুষের সংখ্যা মিলিটারিদের ভয়ে অনেক কমে গেছে। ঘাটের পূর্ব দিকে হেলে পড়া একটা পরিত্যক্ত ঘর থেকে প্রতিদিন রাতে মানুষের চিৎকার ভেসে আসে। সে চিৎকার তিস্তার পানির ঢেউয়ের সাথে মিশে হারিয়ে যায় অনতিদূরে। ঘাটে যারা আগে সারাক্ষণ নৌকা দিয়ে দূরের চর গুলোতে মানুষ আনা নেয়া করতো তাদের সংখ্যা নেই বললেই চলে। দ’ুএকটা নৌকা দিনে দাঁড়িয়ে থাকলেও সন্ধ্যা নামার আগেই তারা ঘাট ত্যাগ করে।
আবুল সাপুড়িয়ার সাপ খেলা কমে গেছে আগের চেয়ে। যেখানে আগে প্রতি হাটবারে দু তিনবার মজমা বসাতো সেখানে একবার করলেই লোক জমে না। লোক না জমলে মজমা বসবে কোথা থেকে। লোক না আসলে তার পুড়িয়া বিক্রি হবে কীভাবে? পুড়িয়া বিক্রি না হলে তার সংসারেও টানাপোড়ন শুরু হবে। তা হোক সংসার তো আর এক্কেবারে জলে যাবে না। দেশ আগে ভালো হোক। তিনি আগে থেকেই দেশের খোঁজ খবর রাখেন। মজমার ফাঁকে ফাঁকে বলা হাসি ঠাঠ্্রার মাধ্যমে ঢাকার অনেক খবর মানুষকে আগে জানায় দিতো। কয়েকদিন আগে তিনি পাকিস্তানিরা যে ক্যাম্প বসিয়েছে সেখানে সাপের খেলা দেখিয়ে এসেছে। সেখানকার এক আর্মি তার গোখরা সাপটা রেখে দিয়েছে জোর করে।
মিলিটারিরা আসার পর বেশ কয়েকদিন আমাদের স্কুল বন্ধ ছিল। পরে স্কুল খুলে দেয়া হয়। সেই আগের জীবন নেই। কোথায় যেন হারিয়ে গেছে সবকিছু। চারদিকে একটা থমথমে পরিবেশ।
সেই আগের মতো আমরা আর স্কুল শেষে আবুল সাপুড়িয়ার মজমা খুঁজি না। রাস্তায় থেকে থেকে আর্মির গাড়ি ঘোরা ফেরা করে। বাড়ি থেকে বারবার বলে দেয়া আছে-স্কুল শেষেই যেন সোজা বাড়ি চলে আসি। তারপরও তার মজমার নেশা তো আর যায় না। আমরা স্কুল শেষ হলেই দ্রুত বের হয়ে খুঁজতাম যদি মজমা বসে। পরে জানলাম প্রায় প্রতি শনিবার হাটবারের দিন পুরান বাসস্টান্ড বা ষষ্টীর তলে মজমা বসে। কারণ এ দুটো জায়গায় আর্মির লোকজন তেমন যায় না।

স্কুল শেষে একদিন তার মজমায় চলে যাই। তেমন লোকজন নেই। কেবল প্রস্তুতি নিচ্ছেন খেলা শুরু করবেন। আমাদের কয়েকজনকে দেখে তিনি যেন প্রাণ ফিরে পেলেন। দেখে মনে হলো তিনি মনে মনে আমাদেরই হয়তো খুঁজতেছিলেন। রাকিবও ছিল সেদিন আমাদের সাথে। রাকিবদের বাসায় প্রায় নাকি পাক মিলিটারিরা যায় রাকিবের আব্বাকে খোঁজার জন্য। রাকিবের আব্বা ভারতে গেছেন যুদ্ধ প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য। সেদিন তিনি আর বেশিক্ষন খেলা দেখালেন না। দ্রুত শেষ করে আমাদের থাকতে বললেন। লোকজন চলে গেলে আমরা অপেক্ষায় থাকলাম-তিনি কী বলেন তা শুনার জন্য।
তিনি যা বললেন তা শুনে আমার গা শিউরে উঠল। পুরো শহরে আর্মিরা কী কী করে তা আমাদের বজরা পার হয়ে ওপারে থাকা মুক্তিযুদ্ধের এক সংবাদ বাহক সাদেক আলিকে তা পৌঁছে দিতে হবে। সাদেক আলি চাচা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। তিনি শহরে মজমার ছলে যেসব তথ্য পাবেন তা আমাদের মাধ্যমে বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপনে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের দিতে হবে। তিনি আমাদের ভালো করেই চেনেন। বারবার শুধু সতর্ক করলেন কাউকে না জানানোর জন্য। এমনকি পরিবারের কাউকে নয়। রাকিবের আব্বা কোথায় আছেন তাও তিনি আমাদের বললেন।
এর পর শুরু হলো প্রায় ডাক হরকরার কাজ। সপ্তাহে কখনো পুরান বাসস্টান্ডে আবার কোন দিন ষষ্টীর তলে মজমা বসলে আমরা সেখানে যাই। তারপর অল্প মজমা শেষে আমাদের তিনজনার কোথায় কাকে খবর পাঠাতে হবে তা নির্ধারণ করে দেন। সেই আনন্দ নিয়ে আর সাপ খেলা দেখা হয় না। কেমন যেন একটা গোয়েন্দা গোয়েন্দা আত্মপরিচয় নিজের মাঝে অনুভব হচ্ছে। দেশ, স্বাধীনতা, মুক্তি এসবের তখন তেমন একটা বুঝতাম না। এখন বুঝি। এখন বুঝি সেই মজমার মধ্যমণি আবুল সাপুড়িয়া দেশের জন্য কত গুরুত্বপূর্ন দায়িত্ব পালন করেছেন।
আমরা তিনজনই তিন মাসের মতো বিভিন্নখানে তার দেয়া বিভিন্ন ধরনের খবর বিভিন্ন জায়গায় মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দিতাম। একেক দিন একেক জায়গায় খবর দিতে হতো আমাদের। অক্টোবরের শেষের দিক থেকে তাকে আর ছোট্ট শহরের কোথাও দেখা যায় না। আগের মতো আর আমরাও খুঁজে পাই না তার মজমার আসর। ছোট্ট শহরে চাউর হয়ে গেল মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগী হিসেবে পাক আর্মিরা তাকে গোঁয়ালের ঘাটে নিয়ে গিয়ে সেই গোখরা সাপের ছোবল দিয়ে খুন করেছে।

=================