হেলিকপ্টার ও সোনার তলোয়ার
খালেদ হামিদী
কিস্তিঃ বারো
২৩
খোকনের মাথায় প্রশ্ন জাগে:
তন্ময় কি ওর বউয়ের কলারদের সন্ধান পায়নি?
নিজেই নিজেকে উত্তর দেয়:
না। কেননা শান্তিকে তারা কল দেয় ছদ্ম নামে। তাছাড়া শান্তির ফোন সেটগুলো পাসওয়ার্ড দেওয়া। আমার বন্ধুর আবার অন্যের, সে যে-ই হোক, ফোন ঘাঁটার অভ্যাস নেই, ছিলো না কখনও। কী লাভ! কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে যদি সাপ বের হয়! তবু সে যে সেসব ছেলেদের ট্রেস আউট করতে চায়নি, তা নয়। অনুসন্ধানের সুযোগ লকড্ থাকায় টিকিও মেলেনি।
খোকন অবাক হয় সেসব হামলা প্রসঙ্গে তন্ময় স্ত্রীকে কিছু বোঝাতে চেয়েও ব্যর্থ বলে। উল্টা আরও জবাব মেলে, মানে, শান্তি বলে:
আবার বললে সব ভেঙে ফেলবো।
সেই বিজয় দিবসের পরের দিন সকালে অফিসে যাবার সময় তন্ময় আরও শোনে:
ঘরে খালি লাশ পড়বে।
এতে মহাতঙ্কে তন্ময়ের শ্বাস-প্রশ্বাস অসম্ভব বেড়ে গেলে, শান্তি, অদ্ভুতভাবে, বিনম্র হয়ে ওঠে। খোকনের প্রশ্ন: তন্ময় এমন কাপুরুষ হয়ে পড়ে কীভাবে? শুধু সন্তানদের মুখের দিকে চেয়ে?
খোকনের ভাবনা আরেকটু এগোয়:
চন্দ্রিকার আবির্ভাবের প্রশ্নে শান্তির প্রতিক্রিয়া অমানবিক হলেও সম্পূর্ণ নেতিবাচকও নয়। সে আসলে নিজের ছানাপোনাদের স্বার্থের প্রশ্নে, তাদের বাঁচানোর ধরনে, বাঘিনীই হয়ে ওঠে।
ওদিকে আরেক বাঘিনী, খসরুর সাবেক স্ত্রী, তালাকের পরেও, নিজের গর্ভজাত দুই পুত্রকে অদ্ভুতভাবে আগলে রাখে। মন্ত্রী পর্যায়ে স্বজন থাকায় নারী নির্যাতনের মামলা রুজুর মাধ্যমে, আদালতে প্রমাণ হাজির করতে না পেরেও, খসরুকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ে। তার দ্বিতীয় সংসারেও খসরু দুই সন্তানের জনক হলেও কুড়ি বছরের আইনি লড়াইয়ে তাকে হার মানানো হয়। শিক্ষা বোর্ডের চাকরি না গেলেও প্রতি মাসে মূল বেতনটাই শুধু মেলে। খসরু একবার সিনিয়রস্ ক্লাব থেকে সাবেক স্ত্রীকে বেরুতে দেখে আরেক পুরুষের সাথে, প্রাইভেট কারে।
ওদিকে ঢাকায় একবার দশ-বারো জন পুরুষ ব্যানার হাতে জড়ো হয় পুরুষনির্যাতন থেকে প্রতিকার চেয়ে, ওই নিপীড়নবিরোধী আইন প্রণয়নের দাবিতে। দুয়েকটা বাক্য লিখে ফেসবুকে নিউজটির লিংকটি দেয়ায় শান্তি তা পরিহারে নয়, তন্ময়কে খবরটির প্রায় বিপক্ষে কমেন্ট লিখতে বাধ্য করে।
২৪
শেফালি, শান্তির দিদির জায়ের বিবাহিতা কন্যা, দাম্মাম থেকে ঢাকায় ফিরেই সংবাদ শিরোনাম হয়ে ওঠে। খোকন কিছুটা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করে, বাকি নির্যাতিত গৃহপরিচারিকাদের ধরনে, স্বামী পরিত্যাগ করে না শেফালিকে। খোকন ভাবে, পতি বিজন নিজেকে হয়তো প্রবোধ দেয় এই বলে: সে তো মুসলিম নারীরূপেই ধর্ষিত হয়, মূল হিন্দু পরিচয়ে নয়। বিজনই সিঁদুর মুছে ছদ্মনামে পাসপোর্ট বানিয়ে দাম্মাম যেতে তাকে বাধ্য করে প্রায়, শুধু অভাবের তাড়নায় নয়, ওই আরব দেশটির জন্যে দেশের অমুসলিম নাগরিকদের ছাড়পত্র দেয়ার বিধান না থাকায়ও। এ ক্ষেত্রে দেশের সংবাদ পত্রে শেফালি বিশিষ্ট হয়ে ওঠে তারই তলপেটে ইনজেকশন দিয়ে তাকে বলাৎকার করা হয় বলে। কয়েক মাস ধরে পিতা-পুত্রের উপর্যুপরি বলাৎকারের পর এক পর্যায়ে সে তাদের নিতে অপারগ হয়ে ওঠায়, নার্সকে দিয়ে এনেসথেশিয়ার মাধ্যমে ওর নি¤œাঙ্গ অবশ করিয়ে, দুই ধর্ষকই তাদের উদ্দেশ্য পূরণ করে। প্রথমবার আক্রমণের সময়েই শেফালির মাথায় ঠাডার পড়ে, সে রাজি না হওয়ায় যখন শোনে:
তোকে তো আমি কিনে এনেছি।
খোকনের মনে পড়ে কিছু শোনা ও জানা কথা:
অন্য কোনও ধর্মের চর্চা প্রকাশ্যে অনুমোদিত নয়। এখানে বসবাসকারী হিন্দুরা সবাই বিদেশীভিত্তিক প্রবাসী, কাজের এবং পর্যটন পারমিটে বসবাসকারী, যাদের মধ্যে বেশিরভাগই ভারতীয় এবং নেপালি বংশোদ্ভূত। অন্যান্য অমুসলিম ধর্মের মতো, সৌদি আরবে হিন্দুদের প্রকাশ্যে উপাসনা করার অনুমতি নেই। কর্তৃপক্ষের দ্বারা হিন্দু ধর্মীয় সামগ্রী ধ্বংসের কিছু খবর পাওয়া যায়। মুসলমানদের স্বধর্ম ত্যাগের অনুমতি দেয়া হয় না, কারণ এটি ধর্মত্যাগ হিসাবে মৃত্যুদন্ড দন্ডনীয়। বাইবেল, ভগবদ্গীতা এবং আহমেদি বইয়ের মতো ভিন্ন ধর্মীয় সামগ্রী বিতরণ ও মুসলিমদের ধর্ম পরিবর্তন অবৈধ। দেড় দশকেরও কিছুকাল আগে সরকার রিয়াদের একটি হিন্দু পরিবারের পূজার সরঞ্জাম ধ্বংস করে। এ ছাড়াও, সাড়ে তিন দশকেরও আগে থেকে এখনও পর্যন্ত, গোপনে বৌদ্ধ ধর্ম অনুশীলনের দায়ে কমপক্ষে পাঁচ জন শ্রীলংকান বুড্ডিস্টের মৃত্যুদন্ড কার্যকর হয় বলে শোন যায়। শুধু তা-ই নয়, এখানে অন্য কোনও ধর্ম প্রচার বা অন্য কোনও ধর্মের উপাসনালয় নির্মাণ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এমনকি প্রকাশ্যে প্রার্থনা, অন্য ধর্মের চিহ্ন সংবলিত লকেট বা যে-কোনও জিনিস পরা যা অন্য ধর্মের চিহ্ন, নিষিদ্ধ।
খোকন মনে মনে বলে:
এ জন্যেই তো এয়ার বেইসে বাঙালি শ্রমিকদের মধ্যে বাংলায় অনূদিত বাইবেল বিতরণের দায়ে বি-টু কম্পাউন্ডের সেই থরম্যান, ইসম এবং জনকে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যেতে হয়। অন্যদের সাথে পার্থক্য এই, তারা ইউএস সিটিজেন বিধায় শাস্তি কেবল প্রস্থান, কোনও দন্ড ভোগ নয়।
খোকন জানে, এ-দেশে অমুসলিমদের প্রতি অবাধ বৈষম্য ও বিরাগ একেবারে সরাসরি প্রকাশমান, ইকামা বা পরিচয়পত্রের দ্বারা। যেমন অমুসলিমদের পরিচিতিপত্র গাঢ় লালচে বাদামি এবং মুসলিমদেরটা সবুজ। তাছাড়া, রিয়াদ এবং অন্য যে কোনও প্রোভিন্স থেকে মক্কা ও মদিনাগামী রাস্তাগুলোর মুখে লেখা আছে: মুসলিমস্ অনলি। খোকনের মাথায় প্রশ্ন জাগে:
তাহলে ইরাক-কুয়েত যুদ্ধের সময় পবিত্র তীর্থস্থানগুলোতে অমুসলিম মার্কিন সেনা মোতায়েন করা হয় কীভাবে!
২৫
তিন শ সিনেমা হল, ক্যাসিনো এবং হালাল পতিতালয় চালু আর মেয়েদের গাড়ি চালানোর খবর পড়ে দেশ থেকে বন্ধুরা ম্যাসেঞ্জারে, হোয়াটস্অ্যাপে জানতে চায় নির্ভয়ে চলাচলে খোকনের আর অসুবিধা হয় কি না, মেলে কি না দেহরঞ্জনের সুযোগ। আজান হলে রাস্তাঘাটে অযথা সময় ক্ষেপণকারী সবুজ ইকামাধারীদের ধরে নিয়ে গিয়ে নামাজ পড়ানো তথা ক্ষমাহীন মোথাওয়াদের অধ্যায় শেষ হওয়ায় সে আগের তুলনায় নির্ভার বোধ করলেও পুরোপুরি ত্রাসমুক্ত নয় বলে কৌত‚হলীদের জানিয়ে দেয়। এই সেদিনও সরকারবিরোধী কী যেন বলার অপরাধে ১৫ বছর বয়সী এক কিশোরের মৃত্যুদন্ড কার্যকর হয়। খেলাধূলা বিষয়ক আরেক ঘটনায় আটক আরেক কিশোরের মা-বাবা সরকারের কাছে ক্ষমা চান। এখন, ছেলে অপ্রাপ্ত বয়স্ক বলে, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সহায়তা চাইছেন। এই অবস্থায় অনলাইন পোর্টালের আরেক খবরে খোকনের দৃষ্টি গেঁথে যায়:
“চুমুর দৃশ্য নিয়ে আরবে বিপাকে নেটফ্লিক্স
জুরাসিক ওয়ার্ল্ড: ক্যাম্প ক্রিয়েচার্স সিনেমার একটি দৃশ্য নিয়ে আরব বিশ্বে বিপাকে পড়েছে নেটফ্লিক্স। দুই কিশোরীর চুমুর ওই দৃশ্য দেখার পর এই স্ট্রিমিং সেবার কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করা হয়েছে। বিবিসি জানিয়েছে, নেটফ্লিক্সকে তাদের প্ল্যাটফর্ম থেকে ‘ইসলামিক এবং সামাজিক মূল্যবোধ ও রীতি-নীতি’বিরোধী সব কন্টেন্ট সরিয়ে নিতে বলেছে উপসাগরীয় আরব দেশগুলো। সৌদি আরবের সংবাদ মাধ্যমের বরাতে বলা হয়েছে, উপসাগরীয় অ লের আরব দেশগুলোর জোট গালফ কোঅপারেশন কাউন্সিল এবং সৌদি আরবের গণমাধ্যম নজরদারি সংস্থা এক বিবৃতিতে নেটফ্লিক্সকে সতর্ক করেছে। সৌদি জেনারেল কমিশন ফর অডিওভিজুয়াল মিডিয়া এবং জিসিসি কমিটি অফ ইলেকট্রনিক মিডিয়া অফিশিয়ালস্-এর যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, ‘এ ধরনের কনটেন্ট, যার মধ্যে শিশুদের জন্য নির্ধারিত কনটেন্টও রয়েছে, সরিয়ে নিতে এবং আইনের সঙ্গে সঙ্গতি বজায় রাখতে (নেটফ্লিক্সকে) বলা হয়েছে।’ বিবৃতিতে সতর্ক করা হয়েছে, এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা হয়েছে কি না, কর্তৃপক্ষ তা পর্যবেক্ষণ করবে এবং এমন কনটেন্টের সম্প্রচার অব্যাহত রাখা হলে আইনি পদক্ষেপ নেয়া হবে। নেটফ্লিক্সের সাম্প্রতিক কনটেন্টগুলো, যেগুলোর মধ্যে শিশুদের জন্য নির্মিত কনটেন্টও রয়েছে, আরব দেশগুলোর আইন ও সামাজিক মূল্যবোধের বিরোধী বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে। কনটেন্টের বিষয়ে এর বেশি বিস্তারিত কিছু উল্লেখ করা হয়নি। তবে সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে এ নিয়ে প্রচারিত সংবাদ প্রতিবেদনে জুরাসিক ওয়ার্ল্ড: ক্যাম্প ক্রিয়েচার্স সিনেমার চুমুুর ওই দৃশ্য ‘ব্লার’ বা ঘোলা করে প্রচার করা হয়।
আল এখবারিয়া টেলিভিশনের সংবাদে ফরাসি সিনেমা ‘কিউটিস’-এর দৃশ্য ব্যবহার করা হয় এবং ক্যাপশনে উল্লেখ করা হয়, নেটফ্লিক্স ‘অনৈতিক বার্তা দিচ্ছে, যা শিশুর স্বাভাবিক বেড়ে ওঠাকে হুমকিতে ফেলছে।’
নেটফ্লিক্স জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে গোটা বিশ্বেই। এসব অভিযোগের বিষয়ে অবশ্য নেটফ্লিক্সের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। সৌদি আরবে বিয়ে-বহির্ভূত যৌনাচার, সমকামিতা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। সেদেশে আইনে এমন ঘটনায় শাস্তি বেত্রাঘাত থেকে মৃত্যুদÐ পর্যন্ত। ডিজনি তাদের ডক্টর স্ট্রেঞ্জ ইন দ্য মাল্টিভার্স অব ম্যাডনেস সিনেমা থেকে ‘এলজিবিটিকিউ সম্পর্কিত অনুসঙ্গ’ বাদ দেওয়ার বিষয়ে সৌদি সরকারের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করায় সৌদি আরবে সিনেমাটি প্রদর্শন করা হয়নি।”
সব শুনে, পড়ে তন্ময় অনলাইনে খোকনকে বলে:
কাউকে নাচার জন্য এনে ঘোমটা দিতে বলা আরকি! ঢাকার টিএসসিতে তরুণ-তরুণীর চুম্বনের ঘটনা মনে পড়ে কি? কী যে প্রতিক্রিয়া হয়! অথচ ওরা উভয়েই নারী বা পুরুষযুগল ছিলো না।
খোকন বলে:
অথচ এমেরিকান কম্পাউন্ডগুলোতে স্বামী-স্ত্রীর ওপেন লিপ কিসিং দেখতে দেখতে আমি বিরক্ত প্রায়, ভালো লাগে না আর। আমাদের দেশী ভাইয়েরা, মানে, ক্লিনার-গার্ডেনাররাও, আর ফিরে তাকায় না। সাঁতারের পর সুইমিং পুল এলাকায় সানবাথে থাকা বিকিনি-পরা তরুণীরাও আমাদের মধ্যে কোনও বিকার সৃষ্টি করে না। এ ক্ষেত্রে বলতে হয়, আবৃতই লোভনীয়, অনাবৃত আকর্ষণীয় নয়। ওদিকে দেশে অনেকে রোজা রেখেও নানা পশ্চিমা ফিল্মে সবকিছু দেখে। কিন্তু ঘরের বাইরে কাউকে সামান্য কিস করতে দেখলেও মারমুখো হয়ে ওঠে! আসলে আমরা গোপনে যা ভোগ করি প্রকাশ্যে দূর থেকে তা উপভোগেও আমাদের বাধে। নিবেদিত প্রাণ খ্রিস্টান লেনন একবার ক্যাথিকে দেখিয়ে আমাকে বলেন:
দিস ইজ নট দ্য ফ্রিডম অফ আওয়ার বডিস বাট দ্য লিবার্টি অফ আওয়ার সোউলস্।
ব্রা আর পেন্টি পরিহিত ক্যাথি পুল থেকে নিজের ভিলায় ফিরছিলেন।
তবুও ভয় সম্পূর্ণ কাটিয়ে উঠতে না পারার বেদনায় খোকন, আগের মতো, নন-অ্যালকোহলিক বিয়ারে চুমুক দেয়। এতে অ্যালকোহলিক বিয়ারের গন্ধটা পাওয়া যায় কি না! হজ শেষে দেশে ফিরেও কেউ কেউ এই পানীয়ের তারিফ করেন।
**********************************