You are currently viewing Social media test post 100049420214008

Social media test post 100049420214008

ফেরা না ফেরা
মাহবুব আলী

তারপর সময় হলে মধ্যাহ্নের শেষভাগ, রেশন ডিলার আবুল কাশেমের দোকান বারান্দায় মানুষজনের ভিড়ে যে ছেলেটি ধীরে ধীরে ছন্দোবদ্ধ এসে দাঁড়ায়, চেহারা-ছবিতে শুকনো বিষাদ আর অল্পবয়সি দেখালেও আসলে সে স্কুলের দশম শ্রেণি অতিক্রান্ত ছাত্র, পরপর দু-তিন বছর ক্লাসের ফার্স্টবয় অবস্থান থেকে সেবার এসএসসি পরীক্ষার্থী হয়েছিল, কিন্তু পরীক্ষা দিতে পারেনি, কেননা সেটি হয়নি, আর তার চোখের সামনে উজ্জ্বল দিনগুলো ভাবনার অলিগলিতে অনেকখানি ম্লান হতে শুরু করেছে। যুদ্ধ শেষে সকলেরই আলাপ-আলোচনা, যা অনুচ্চ বা প্রকট এবং কখনো হয়তোবা প্রগলভ, সর্বোপরি এতদিন যা মাতিয়ে রেখেছিল, অন্যকোনো ভাবনার অবকাশ প্রায়ই ছিল না, সে-সবের অবসান হয়েছে কিংবা মুক্তি, অতএব যা হোক না কেন কমবেশি অনেকেই দলবদ্ধ অবস্থান থেকে হয়তো বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। যেহেতু লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে, পৃথিবীর মানচিত্রে এখন নতুন রাস্ট্র বাংলাদেশ, সবুজ জমিনের মধ্যখানে লাল সুর্য আর পদ্মা-মেঘনা-যমুনার প্রচ্ছন্ন রেখাঙ্কিত মানচিত্র জ্বলজ্বল করে; এখন নেতার ফেরার পালা।
মানুষজন সেই ভিড়ের মধ্যখানে একটি তিনব্যান্ড ফিলিপস্‌ ট্রানজিস্টার রেডিওর দিকে সকল মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করে রাখে। সেটির চকচকে ঊর্ধ্বমুখ অ্যান্টিনা, স্পিকারের ফুল ভলিউমে বেশ জোরালো ধারাভাষ্য চলমান। তারই মধ্যে মানুষের প্রতীক্ষার, আনন্দ কথপোকথন, উল্লাস-চিৎকার উঁকিঝুঁকি মেরে মাইক্রোফোনের তরঙ্গ বেয়ে ইথারে ভেসে ভেসে এখানেও নীরব-নিশ্চুপ শ্রোতাদের মধ্যে এসে পড়ে এবং অদ্ভুতভাবে অনেকের ভেতর একইরকম উপলব্ধি সংক্রমিত হতে থাকে। তখন ছেলেটি ভিড়ের গহিনে একে-ওকে দেখার বা চেনার চেষ্টায় অনেক কথা ও ঘটনার নিশ্চুপ প্রবাহে স্মৃতিকাতর হয়ে যায়। সে-সময় কেউ কেউ ঠিকই শনাক্ত করে ফেলে তাকে। তার কাঁধ ছড়ানো ঘন চুল, নাকের নিচে গোঁফের হালকা রেখা আর উদাস আকাশের মতো দীর্ঘায়ত চোখ যদিও অনেক অচেনা লাগে। সেই জটলায় কারও উৎসুক অথবা ভাবলেশহীন দৃষ্টি বৃত্তাকার ঘুরে আসতে আসতে পুনরায় খেই হারিয়ে ফেলে। কারও চোখে বিষাদ জানুয়ারির কুয়াশা-মেঘের মতো ভেসে উঠে স্থির অনড়। কেননা কথা বা প্রতিশ্রুতির সবটুকু যে নির্ঝঞ্ঝাট এবং সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হতে পারে, সে-সময় সেটি ধারণা করা কষ্টকর ছিল, যেহেতু কথা অনেকসময় কথার মতো থাকে না, বিবিধ কুটকৌশলে বদলে যায়, তখন কারও কাছে স্বপ্ন বা অঙ্গীকার ভিন্নরূপ পরিগ্রহ করতে পারে। যে ব্যক্তি আকার-ইঙ্গিতে বুঝে নিতে জানে তার মুখে কোনো কথা নেই। ছেলেটিও অপেক্ষায় নিশ্চুপ ছিল। সেই মৌনতার মধ্যে হাজারও কথা, সে যা বলতে চাইছিল না; অথচ কেউ একজন সরাসরি জিজ্ঞেস করে বসে, –
‘রাইসুল কেমন আছিস?’
‘এই তো!’
‘তারপর?’
রাইসুল এখানে আর থাকবে কিনা ভেবে নিতে নিতে ধারাভাষ্যের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলে। মনের অগোচরে হাজারও কথা, ঘটনা ঘাত-প্রতিঘাত জীবন সংশয় কত কী-ই না সেলুলয়েড ফিতের মতো চোখের আলোয় প্রতিবিম্বিত হতে থাকে, যার কোনোটি বিষাদ কোনোটি কষ্টদহন আর দু-চারটি আনন্দ বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ে, সে-সবের কিছু মনে দাগ কেটে আছে, আর কিছু হারিয়ে যাওয়ার অবসর খুঁজে নেয়। পশ্চিমবঙ্গের কালিয়াগঞ্জ ক্যাম্পে যেদিন দেখা হয়েছিল, জুনের প্রথম কিংবা মধ্যভাগ প্রায়, আকাশে প্রগাঢ় মেঘ, এপ্রিল-মের তপ্ত দিনকালের পর সে-সময় আকাশ সময়-অসময়ে নিজেকে গম্ভীর করে রাখে, সে তেমনই অচেনা কোনো কান্না নিয়ে দিশেহারা একটি আশ্রয় কোনো ঠিকানা বা গন্তব্যের সন্ধানে সবকিছু পিছুটান ছেড়ে চলে গিয়েছিল, হয়তোবা তেমনভাবে নিয়তি সকল ঘটনা আর কুশীলব সাজিয়ে রাখে, কে জানে; মানুষের অনিশ্চিত জীবন বোধকরি পথহারা-দিগ্‌ভ্রান্ত কোনো গাঙচিল বিশাল সমুদ্রের জলরাশি ছেড়ে একটু তীরভূমি কিংবা সামান্য মাটির জন্য অস্থির কাঙাল হয়ে পড়ে; অবশেষে দেখা হয়েছিল।

উনিশ শ একাত্তর, এপ্রিলের তেরো তারিখ, মঙ্গলবার, একসময় দশমাইল-রামডুবি-চেহেলগাজী এলাকা আর পুবে একদিকে রাজবাড়ি অন্যদিকে মোহনপুর হতে মর্টার শেলের মুর্হুমুর্হু নিনাদ জেগে ওঠে। শহরের মানুষজন উত্তর-দক্ষিণ-পুব-পশ্চিম অলিগলি রাস্তা ধরে যে যার মতো প্রাণ হাতে নিয়ে পালাতে শুরু করেছে, বোমা বিস্ফোরণের ভয়ংকর ধ্বনি-প্রতিধ্বনি আকাশে; পাকিস্তান সেনারা এগিয়ে আসছে। সেই উনত্রিশে মার্চ, সোমবার, কুঠিবাড়ি বিদ্রোহে শত্রু অবমুক্ত শহর বুঝি হারাতে হয় আর হলোও তাই; এই তো যুদ্ধ কৌশল। রাইসুল তখন মডার্ন সিনেমার রাস্তা থেকে চকবাজার-মালদহপট্টি আর উত্তর বালুবাড়ি হয়ে মহারাজের মোড় পেরিয়ে যায়। সাইকেলের দুটো চাকায় নরম বাতাসে গতিবেগ অসম্ভব মন্থর, পায়ের জোর আর অপরপক্ষে এপ্রিলের দগ্ধ দুপুর বিরুদ্ধ বাতাস, অদ্ভুতভাবে শহরের কাকগুলিও দিগ্‌বিদিক ছোটাছুটি করে বেড়ায় নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে; রাইসুল উদ্‌ভ্রান্ত অনেকক্ষণ পর নিশ্বাস নেওয়ার মতো অবসরে এসে দাঁড়াতে পারে। আকাশে আগুন আর ধোঁয়ার বিস্রস্ত কুণ্ডলী, কাঁকড়া নদীর পুবপাড়ে জোলাপাড়া জ্বলেপুড়ে ছারখার, এখানে-ওখানে কতগুলো লাশ, তারা শিশু-নারী-পুরুষ, তারা কিশোর-যুবা-বৃদ্ধ, তাদের চেহারা বোঝা যায়…বোঝা যায় না, অভিব্যক্তিহীন কিংবা যন্ত্রণাদগ্ধ বীভৎস, নদীর জল আর পাড়ের বালিয়াড়িতে লুটিয়ে থাকা অসহায় খোলা চোখগুলো শুধু বলে যায় তারাও মানুষ। তাদের ছোট ছোট ঘরদোর পুড়ে অঙ্গার-কয়লা-ছাই, এলোমেলো ছড়িয়ে থাকা তৈজসপত্র আর অন্ন-আহার, এতকিছুর মধ্যেও অগ্নিশিখার কবল থেকে বেঁচে যাওয়া দু-একটি কলাগাছের পাতা তখনো নদীবাহিত বাতাসে একবার বুক অন্যবার পিঠ দেখাতে ব্যস্ত থাকে, অন্যদিকে পশ্চিমপাড়ের বিশাল ন্যাড়া শিমুল গাছে লালে লাল ফুলের মধ্যে একদল শকুন উৎসুক আর লোভাতুর দৃষ্টি মেলে লাশগুলো দেখে যায়। রাইসুল চোখ বন্ধ করে দিশেহারা কী যেন ভেবে নেয় অথবা কিছুই ভাবতে পারে না, মূলত জানে না এরপর কী হতে যাচ্ছে অথবা কী হতে পারে; সে দ্রুত পালাতে থাকে। কোথা হতে কোথায় পালায়? সে তখন মনে মনে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বুঝে নেয়, পথ আর গন্তব্য নির্ধারিত হয়ে গেছে, পথ হারাবার আর আশঙ্কা নেই, মুলত ক্ষণিকের বিভ্রান্ত মন যেমন চেনা পথে দাঁড়িয়ে ঠিক বুঝে নিতে পারে না কোথায় এসে দাঁড়িয়ে গেছে আর গন্তব্য কতদূর; সেইসব ভুল ক্রমশ মিলিয়ে যেতে শুরু করে।

সেই সময়ের অনুমান এক-দেড় মাস পর, যখন আকাশে সর্বদা ঘনঘোর মেঘ, ইরি ক্ষেতের সেচনালা দিয়ে টলটলে পানি চলমান চাঞ্চল্যে ধরে রাখে সবুজ চারাগাছ, সেই জলের নহরে কিছু পোনামাছ মনের আনন্দে সাঁতার কেটে যায়; চোখের অশ্রু মুছে বাধাহীন মুক্ত বিহঙ্গের মতো পথে নামে রাইসুল। একা একা একান্ত গোপনে, পঁচিশ-তিরিশ মাইল, তারপর সীমান্ত; সেখানে গিয়ে খুঁজে নেবে হারানো ঠিকানার সঠিক গন্তব্য, অভিযাত্রা কৌশল। তারপর এখানে-ওখানে খুঁজে নিতে নিতে কালিয়াগঞ্জ ক্যাম্পে জেনে যায় সকল নিয়মকানুন আর সত্যি সত্যি একদিন ‘অ্যান্টি ট্যাংক ওয়ারফেয়ার ইউনিট’-এর ‘সুইসাইডাল গ্রুপ’ সদস্য থেকে দক্ষ সৈনিক হয়ে যায়। নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা ভাবতে কিংবা বলতে বেশ ভালো লাগে। সেই সংগ্রাম বা যুদ্ধ শেষ হয়েছে। যেখানে একটি শেষ হয়, আরেকটি নতুনের শুরু অবশ্যম্ভাবী; তাই এই ধ্বংসস্তূপের উপর উঁকি মারে অন্য এক যুদ্ধের সূচনা। নেতা ফিরে এসে আরও একবার সেই যুদ্ধের ডাক দেবেন, এমন উপলব্ধি মনের কোণায় গুনগুন করতে থাকে; এসবের মধ্যেই চলতে থাকে ধারাভাষ্য। নেতা ফিরে আসছেন। একুশ দফা, ছয় দফা, এগারো দফা পার হয়ে এক দফা বাংলার স্বাধীনতা। বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের বন্ধু প্রথম রাস্ট্রপতি ফিরে আসছেন। ঢাকা বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দান পর্যন্ত দীর্ঘপথ মানুষের দৃষ্টি উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে, পথের দিকে; কখন আসছেন প্রাণপ্রিয় নেতা?

এই তো কয়েক সপ্তাহ আগে নিজেও ফিরে এসেছে রাইসুল। অস্থির মন দৃঢ়পায়ে এগিয়ে এলো বটে তবু আবেগ-উত্তেজনা কাবু করা যায় না, নিজের ঠিকানায় পৌঁছে দেখতে পাবে বাবা-মা আর ছোট ভাইবোনদের, শুধু একজনকে দেখতে পাবে না, মামুনকে যে কাঁকড়া নদীর পুবপাড়ে বাঁশবাগানের এককোণায় শুইয়ে রাখা হয়েছে শেষ এপ্রিলের বিকেলবেলায়। কয়েক মাসের শিশু রক্ত-আমাশায় ভুগতে ভুগতে বিনাচিকিৎসায় প্রাণ ছেড়ে দিলো এক দুপুরে। হতভাগা! এমন মানুষও এত অল্প সময়ের জন্য পৃথিবীতে আসে! এ যে কতবড় অসহায়-অপারগতার যন্ত্রণা বোঝে রাইসুল। সেও মা-বাবার সঙ্গে গড়াগড়ি করে কাঁদে। অশ্রুজলে কি বুক শান্ত হয়? হয় না। সেদিন এইসব বিবিধ ভাবনা আর প্রত্যাশার মায়াজাল ঘোরে এসে দাঁড়ায় মহল্লার গলিমুখে, ধীরপায়ে নিজের ঠিকানায়; একদিন বড় কষ্টে সবকিছু ফেলে শূন্যহাতে পালিয়ে যেতে হয়েছিল।
যেভাবে আঙিনায় এসে দাঁড়ানোর পর দেখা হয় হাঁটু বা কোমর সমান উঁচু ঘাস-আগাছা ছড়িয়ে রেখেছে নিঃসঙ্গতার বিষাদ, দেয়াল আর তার নিচে কবুতরের সফেদ-ধুসর বিষ্ঠার আচ্ছাদন, মেঝেয় ইঁদুরের শত শত গর্ত; দরজা-জানালাহীন ঘরের চৌকাঠও বলে দেয় কোনো নিরাপত্তা নেই। সেই ঘাসের ফাঁকফোকর দিয়ে সবুজ রং কোনো এক সরিসৃপ মৃদুমন্দ পালিয়ে যেতে যেতে পথ ছেড়ে দেয়। তখন রাইসুলের মননে উত্তর ভোলানাথপুর গ্রামের কথা, সবুজ দৃশ্যাবলি আর কোনো এক চেনা-অচেনা সুনয়নার সপ্রতিভ চকচকে দৃষ্টি ভেসে ওঠে। কেমন আছে রামিয়া? বেঁচে আছে তো? সেই আলো-আঁধার গভীর রাতে কলাপাতায় ভাত-তরকারি সাজিয়ে খেতে দিতে দিতে পরম আদরে ফিসফিস করেছিল, –
‘দেশ স্বাধীন করে একদিন ঘুরে যেও কিন্তু।’
‘তোমার নাম কী?’
‘রামিয়া।’
‘পড়াশুনা করো? কোন্‌ ক্লাস?’
‘ক্লাস নাইন।’
‘তোমরা ওপারে যাওনি কেন?’
‘আমরা নিজের দেশ ছেড়ে যাব না।’
‘ও আচ্ছা, এখানে তো বিপদ।…এত রাতে কীভাবে রান্না করলে, তোমাদের খাবার?’
‘ওদিকে রান্না হচ্ছে। তুমি কী করো? কলেজে পড়ো? বাড়ি কোথায়?’

Leave a Reply