You are currently viewing ষষ্ঠী ভ্যারাইটিস স্টোর ও মজল || লুৎফর রহমান মন্ডল

ষষ্ঠী ভ্যারাইটিস স্টোর ও মজল || লুৎফর রহমান মন্ডল

ষষ্ঠী ভ্যারাইটিস স্টোর ও মজল
লুৎফর রহমান মন্ডল

একাকী মেঠো রাস্তাটি ঢুলতে ঢুলতে মোহনগ্রাম থেকে উঠে এসে যেখানে পাকা রাস্তায় মিলেছে সেই মোচড়েই মনোহারি দোকানটি। দুই ঝাপের মাঝখানের কালো কাঠে চকরঙে এবড়ো থেবড়ো করে লেখা-ষষ্ঠী ভ্যারাইটিস স্টোর। একটি বুড়ো পাকুড়গাছের হেলানো ছায়ায় বসার জন্য ইটের বাঁধানো সান আর দোকান ঘিরে বেশ কটি টং পাতা। গ্রামীন নিরিবিলি পাকা রাস্তাটিতে থেকে থেকে দুএকটি অটো, সাইকেল বা হোন্ডা মটর সাইকেল সাঁইসাঁই করে চলে যায়। একটু জিরানোর জন্য ছায়াবিশিষ্ট টং দোকানটি বেশ লোভে ফেলে দেয় যে কাউকে। বসলেই মেলে বিড়ি, চা, খিলিপান আর প্রিয়দর্শী ষষ্ঠী ভাবীর দর্শন। পশ্চিমে বয়ে চলা শিরশিরে ভেজা বাতাসে ঘাম ঝরা বা ক্লান্ত শরীর নিমিষেই চনমনে হয়ে উঠে। ক্ষণিক বিরতিতে এ মনোহারি দোকানে মন ফুরফুরে হতে বাধ্য। এখানকার গুড় মেশানো লাল চায়ের বেশ সুনাম উপজেলা শহর অব্দি। মাঝে মাঝে দূর দূরান্ত থেকে সমঝদার লোকজন আসে এখানে শুধু চা খেতেই। হাতে যাদু মেশানো জব্বারের বউ কাউকে নিরাশ করে না স্বাদ আস্বাদানে। নিজের আয়োজনের সবটুকু উপকরণ দিয়ে সে চা বানায় আগত কাস্টমারের জন্য।
নিয়ম মাফিক প্রতিদিন সকালে সুরা আর রহমান এর সুরেলা কণ্ঠ ভেসে আসে দোকান থেকে।
‘ফাবি আইয়া আলা ই রাব্বিকু মা তুকাযি¦বান‘ এর দরদ মাখানো ধব্বনি সকালের ধীর স্থির প্রকুতিকে ¯িœগ্ধ করে তোলে। দোকান খোলার প্রস্তুতি চলে জব্বারের। সাফসুতরো কাজ শেষ করে কেটলি চুলোয় তুলে দেয় জব্বার। মোহনগ্রামের বাসিন্দা সে। দোকান থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে বাড়ি। স্ত্রী ষষ্ঠীসহ ঢাকায় বেশ কয়েকবছর ছিল। কিছু ক্যাশপাতি করে এখন গ্রামেই থিতু। এ দোকানটি দিয়েছে বছর খানিক হলো। জব্বার ছোট একটি পিকআপ কিনেছে। সেটায় করে রংপুর, বগুড়া এবং আশেপাশের বিভিন্ন হাট থেকে কাচামাল আনা নেয়া করে। সকাল সকাল দোকান চালু করে প্রতিদিনই কোন না কোন হাটের উদ্দেশে যাত্রা তার। আজও সে শটিবাড়ির হাট যাবে। সেখান থেকে নতুন সবজি নিয়ে যাবে মান্দারহাট। পাইকারদের কাছ থেকে আগেই চালান নেয়া আছে। সারাদিন স্ত্রী ষষ্ঠীই চালায় দোকানটি। দুই সন্তানের জননী ষষ্ঠীর ভরাট কামকাতুরে শরীর। লোকজন জমা শুরু করলে ক্যাবল লাইনের সিনেমা চলে । শাকিবখানের ছবি চললে পোলাপান সরতে চায় না। বেচাবিক্রিও হয় ছবির তালে।

দোকানের পেছনে কেরাম ঘর। বরিক পাউডার দেওয়ার আগে বোর্ডটা কনডম দিয়ে ভাল করে ঘষে নেয় মজল। কনডমের গাঢ় তেল কেরামের বোর্ডকে শ্যাওলা পড়া এটেল মাটিতে বৃষ্টি পড়লে যেমন পিছলা হয় তেমন পিছলা করে। পাউডার মেশালে একশুটে গুটি দশ চক্কর ঘোরে-পালানোর জন্য পকেট খোঁজে। কোন হিট ই মিস হয় না। মজল কেরাম খেলে বাজি ধরে। এক গেম পাঁচশ। প্রতি বোর্ডে পঞ্চাশ টাকা হেসকা। ত্রিশ পয়েন্টে গেম। জব্বারের দোকান হলেও, এলাকার চ্যাংড়া পোলাপান আদর করে ষষ্ঠী ভাবীর মোড় নাম দিয়েছে। এলাকার উটতি পোলাপান খেরামের গুটি শুটায় আর চিল্লায়-
ও ভাবী সিগ্রেট আর টান্ডা পেছনে দেও।
একহাতে ডার্বির শলা বোর্ড কিনারে ঠান্ডা কোমল পানি। স্টিকারের টেলায় গুটি পকেটে ঢোকে-চলে একটার পর একটা পান, বিড়ি, ঠান্ডা।
মজল এখানে সপ্তাহে দুদিন আসে – বিশেষ করে শুক্র আর শনি। রাজনৈতিক দল করা মজলের অনেক গুলো পরিচয়। উপজেলার কেন্দ্রীয় পোস্টে সে আছে। মিছিল, মিটিং হলে ছেলে-পেলে সাপ্লাই দেয়। শুধু কী উপজেলায়! বিভাগ, রাজধানীতেও কোন রাজনৈতিক প্রগ্রাম হলে তার ডাক পড়ে। চর এলাকায় তার একটা গ্রুপই আছে। ডাকলেই শত লোক হৈ দিয়া চলে আসে। শুধু মাথা ধরে দিন হাজিরা দিতে হয়। রাস্তার বিভিন্ন গাছ, খুঁটি, উপজেলার বিভিন্ন দপ্তরের দেয়াল-দরজায় তার হাস্বোজ্জ্বল ছবি টাঙানো।
মজল বেসরকারি একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দপ্তরি পোস্ট চাকুরি করে। সেখানে স্থায়ী চাকুরি হলেও খুব একটা অফিস টপিস করা লাগে না। সে তার বদলি হিসেবে একটা ছেলে রেখে দিয়েছে-প্রক্সি চাকুরে। মাসশেষে কিছু টাকা ধরিয়ে দেয় তাকে। শুধু উপর থেকে যদি কখনো লোকজন আসে তখনই সে অফিসে যায়-তাছাড়া নয়। দপ্তরি পোস্টে চাকুরি করলেও সে নিজেকে লেকচারার হিসেবে পরিচয় দেয়। তার ছাপা পোস্টারেও রাজনৈতিক পরিচয়ের পাশাপাশি কোড করে প্রভাষকও লেখা। পরিচিত কেউ পোস্টার নিয়ে প্রশ্ন করলে মজল হাসিমুখে উত্তর দেয়-
লোকজন ভালবেসে পোস্টার করছে-আমি তো তাগো মানা করতে পারি না। হেরা আমারে ইজ্জত দেয়-আমিও দেই। কেউ আমারে ইজ্জত দিলে আমি না কইতে পারি না।

জব্বারের বউরে মজলের ভালো লাগে। আগে সপ্তাহে দুদিন আসলেও এখন প্রায় প্রতিদিনই আসে। নানা কথায় ভাব জমায় ষষ্ঠীর সাথে।
ভাবী কী পেন্দনের কাপড় গো! লাল পাড় শাড়িতে আগুন ঝরছে। পোড়া চোক তো মমের মতো গলছে গো।
ষষ্ঠী একগাল হাসি দেয়-মজল ভাই যে কী কও!
সকাল সকাল এই খিলি না খাইলে দিনটাই মাটি হয় ভাবী। এ তো খিলি নয়-মধু। এক্কেবারে ষষ্ঠী মধু। আর কয়েকটা দেও নি বাইধাঁ।
টিভিতে শাকিব গানের গান শুরু হলে মজল কেরাম ছেড়ে টিভি দেখতে আসে। একচোখ টিভিতে আর একচোখ জব্বারের বউয়ের দিকে। চোখের মণিতে ভেতরের কাম সন্ধ্যা জোনাকের মতো জ¦লে আর নেভে। মজল চা খায় মুখে- ষষ্টী ভাবীরে খায় চোখে। সে আইরাম-বাইরাম করে ইশারার টোপ ফেলে। জব্বারের বউ খিলি বানায় দেয়। মজল তার নিয়মিত কাস্টমার। কাস্টমার লক্ষী। লক্ষীরে পায়ে ঠেলতে নাই-মাথা ঠুকে প্রণাম করতে হয়। জব্বারের দু’ সন্তানের বউ ষষ্ঠীও মজলের ইশারা বুঝতে পারে। কিন্তু না বোঝার ভান করে থাকে। একদিন সুযোগ বুঝে কেরাম বোর্ডের ঘরে একা পেয়ে ষষ্ঠীকে জড়িয়ে ধরে মজল। চিৎ করে মাটিতে ফেলে উপ্রে শুয়ে পড়ে। চোখে চোখ রেখে মজল বলতে থাকে-
‘রৈয়া রৈয়া চাতক ডাকে বর্ষে জলধর
না মিটে আকুল তৃষা পিয়াসে কাতর’
বুঝলা নি কীছু ষষ্ঠী? শরীর পুড়ে গেছে রে-ছাই হওয়ার জোগাড়। মনে শুধু তুই- উথাল পাতাল ঢেউ তুলস।
মজলরে ঠেকাতে হাত দিয়ে বুক ঢেকে দেয় ষষ্ঠী-
ধীরে মজল ধীরে। উথাল নদীতে আস্তে আস্তে বৈঠা বাইতে হয় নইলে জীবন নাশের শঙ্কা। সময় দিলে আইসো। এতো তাড়া ক্যা!
কথা মুখে থাকতেই ঝাটকা দিয়ে মজলের কাছ থেকে নিজেকে আলাদা করে সে। পড়নের কাপড় ঠিক করতে করতে বলতে থাকে-
তুমি আমার দোকানে কেন এতো আসো বুঝি না-সব বুঝি। চোখে এতো খিদা- আরও আগেও তো কইতে পারতা? রান্ধন খাওন বাসি রাখতে নাই-ভাপ হওনে খাইতে হয়-তাইলেই তৃপ্তি। পরশু রাইতে শোয়ার ঘরের পেছনে যে পুকুর আছে তার পশ্চিম পাড়ে আইসো-দেখব কতো দম তোমার।
ঘামে মজলের গোসল করার মতো অবস্থা। লুঙি তুলে মুখ মুছে সে। এক নিঃশ^াসে বের হয়ে পাকুড় গাছের বাঁধানো সানে এসে শুয়ে পড়ে। সোনাই জরদা দিয়ে খিলি পান আগায় দেয় ষষ্ঠী।

মজলের স্বপ্ন একদিন সে সোনাডাঙা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হবে। এ স্বপ্ন তার এমনি এমনি হয়নি। তাকে কতো কাজে চেয়ারম্যানের পেছনে দৌঁড়াতে হয়। সে যদি একবার দল থেকে টিকেট পায় তাহলে তারে কে ঠেকায়? চেয়ারম্যান হলে তার আর আরেকজনের পেছনে তেল মারতে হবে না। প্রতিদিনই সকাল হলেই গ্রামের দু’চারজন মজলের বাড়িতে উপস্থিত থাকবেই। জন্মনিবন্ধন, বয়স্কভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড করা, কাবিখা-টাবিখার নাম, বিচার সালিস-কাজের শেষ নাই তার। এখন তাকে বেশ থানা পুলিশ করতে হয়। উপজেলার পদ পাওয়ার পর থেকে পুলিশি সমস্যা গুলো তার কাছে অনেক আসছে। থানার ওসির সাথে একটা ভাব জমিয়েছে সে। পুলিশের সাথে ভাব না থাকলে এখন আর টেকা যায় না-থাকলে লোকজনও গুণে বেশ। তাছাড়া সে রাজনীতি করে তাকেও পুলিশের দরকার পড়ে পুলিশেরও তার দরকার পড়ে। একটা উইন উইন সিচুয়েশন।
সে লোকজনকে মেম্বারের কাছে যেতে বললেও লোকজন তার কাছেই আসে। কারণ তার কাছে আসলে কাজ হয়। টাকা লাগুক- কাজ তো হয়। মানুষ টাকা দিয়ে কাজ করাতে চায় কিন্তু কাজ হওয়ার নিশ্চয়তা তো সবখানে পাওয়া যায় না। মজল এই কারবারে ইস্টকাঠ। যার কাজে হ্যা বলেছে- হয়নি এমনটা নাই। কিন্তু সে টাকা একটু বেশি নেয়।
মজল যে ডাবল ডিস্কের সেকেন্ড হ্যান্ড পালসার মটর সাইকেলটা চালায় সেটাও এক পার্টির দেয়া। চাকুরীর তদবীর করেছিলো সে। চাকুরি হওয়াতে মজলকে তারা খুশি হয়ে বাইকটা উপহার দেয়। মজলকে তারা নতুন বাইক কিনে দিতে চাইলে সে নতুন বাইকের টাকা নিয়ে সেকেন্ড হ্যান্ড একটা কিনে নেয়। মজল দু’হাত ভরে টাকা কামাতে চায়। সে জানে টাকার উপ্রে কোন বাপ নাই। মজল জানে, টাকাহীন মরদে দরদ আসে না। টাকা না থাকলে কুত্তায়ও পাত্তা দেয় না। সে রাস্তা খুঁজতে থাকে টাকা কামানোর। মজলের টাকা দরকার-অনেক টাকা। যে তরিকাতে টাকা আসবে সে সেটাই ব্যবহার করবে। অঢেল টাকা করে নির্বাচনের আগে মক্কায় যাবে হজ¦ করতে। তখন মানুষ তাকে মজল হাজি বলে ডাকবে। সে চিন্তায় পড়ে কারণ তখন তো এখনকার মতো ষষ্ঠীর দোকানে যেতে পারবে না-হইগুল্লোড় করে কেরাম খেলতে পারবে না। সে ভাবে-একবার চেয়ারম্যান হলে ষষ্ঠীই আসবে তার বাসায়।

নেতাদের বিশ্বাস করা দিন দিন কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এতো বড় বড় নেতা অথচ তারা কী না এমন কাজ করবে? ছিঃ ছিঃ! মজলের এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। কিন্তুু তার বিশ্বাস না হয়ে উপায় আছে? সে নিজেই ভুক্তভোগী। হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে। পাচার উপ্রে গরম ভাপ দিচ্ছে এক ওয়ার্ড বয়। মজলের ব্যাথায় জান বের হবার অবস্থা। গলায় পানি এতো পড়েছিল যে কারও তেমন ছ্যাদবোধ ছিল না। তাই বলে নেতা মজলকে ধরে বসবে। লিঙ্গ জ্ঞানহীন এমন নেতা এর আগে সে কখনো দেখে নি। সেও ছোটখাটো নেতা হিসেবে এলাকায় পরিচিত। তারও কাছে শতধরনের মানুষ আসে। কত মানুষের সে বিভিন্ন কাজ করে দেয়। কিন্তু সে কখনো কোন সমলিঙ্গকে যৌনআক্রমণ করেনি। পুকুর পাড়ে সময় কাটানো ষষ্ঠীর কথা তার খুব মনে পড়ছে। নেতা চাইলে সে ষষ্ঠীকে ম্যানেজ করে দিতে পারতো- সে না হলে আরও ব্যবস্থা ছিল।
মজল দূপুর অব্দি অচেতন ছিল। ঘন্টাখানেক আগে তার জ্ঞান ফিরেছে। পায়ুপথে তার প্রচন্ড রক্তক্ষরণ হয়েছে। তার উপর কতজন অত্যাচার করেছে সে বুঝতে পারছে না। তবে ডাক্তাররা বুঝতে পারছে- মজলের উপর একাধিক ব্যক্তি অত্যাচার করেছে।
মজল তার এলাকার লোকজনের কথা চিন্তা করছে। এ ঘটনা ফাঁস হলে তার চেয়ারম্যান হওয়ার কী হবে? জানাজানি হওয়ার পর ভোটে দাঁড়ালে মানুষ বলবে গোয়ারু মজল। এসব ভেবে মজল কুকঁড়ে যায়। তার ইচ্ছে করছে উচ্চ স্বরে কাঁদতে কিন্তু তাও সে করতে পারছে না। সে পণ করে-তার স্বপ্ন সে কোন অবস্থাতেই বিনষ্ট হতে দেবে না। একটু সুস্থ হলে সে আবার নেতার কাছে যাবে-কারণ সামনে নির্বাচন। তাকে এর চেয়ে আরও কঠিন পরিস্থিতি সহ্য করা লাগলেও নির্বাচনী টিকেট কনফার্ম করতে হবে। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে থানা-পুলিশ কিছুই করবে না। আর কোন অবস্থাতেই এ খবর বাইরের কাউকে জানতে দেবে না। ওয়ার্ড বয় জোরে চাপ দিলে মজল কোৎ করে ওঠে।

*******************************