You are currently viewing বাতিঘর || জাকিয়া শিমু

বাতিঘর || জাকিয়া শিমু

বাতিঘর

জাকিয়া শিমু

উপসচিব কামরুজ্জামান সন্ধ্যা থেকে দক্ষিণের বারান্দায় পায়চারী করছেন। একগুঁয়ে-জেদি কামরুজ্জামান, যখন কোনো গুরুতর বিষয়ভাবনায় আচ্ছন্ন থাকেন, জরুরি না হলে কেউ তাকে ত্যক্ত করার দৃষ্টতা দেখায় না। পরিবার,বন্ধুবান্ধব এমনকি পোষা কুকুরটিও তার মেজাজ-বুঝে চলতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।

বসারঘরের দেয়াল-ঘড়িটি, টিকটিক আওয়াজে সময় জানান দেয়- মধ্যরাত হতে মাত্র আধঘণ্টা বাকি। তাকে খুব বেশিরকম অস্থির দেখায়। সচরাচর কোনোবিষয় নিয়ে এতোটা উদগ্রীব হতে দেখা যায় না। স্বভাবচরিত্রে সে খুব কৌশলী, ঠাণ্ডা মাথায় কঠিন কাজ করা মানুষ। কামরুজ্জামান বারান্দা থেকে জানালার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে ঘন ঘন বসারঘরের ঘড়ির সময় দেখছেন। তার নিজের বাঁহাতে রোলেক্স ব্রান্ডের ঘড়ি ঝুলছে, সেদিকে তার খেয়াল নেই ! 

কামরুজ্জামান বুঝতে পারেননি মন্ত্রী তাকে এতবড়ো একটা ফ্যাসাদে ফেলবেন। যদি তার মনোবাসনা বিন্দুমাত্র আঁচ করতে পারতেন তাহলে আস্তসচিব হওয়ার স্বপ্ন ভেস্তে দিতে একমুহূর্ত দেরি করতেন না। কামরুজ্জামান যেনতেন কিছিমের উপসচিব নন,পুস্তকেরভাষায় যাকে বলে জাঁদরেল -পুরোসচিবপাড়া তাকে বিশেষ আমল দিয়ে চলতে বাধ্য হয়।

উঁচুমহলের সাথে তার সখ্যতা হেলায় খেলায় এড়িয়ে যাওয়ার মতো বিষয় নয়। যদিও মন্ত্রীর যৎসামান্য সুনজরের জন্য সচিবের চেয়ারটির স্বাদভোগ হয়নি। চাকুরীর শুরু থেকে কামরুজ্জামানের একটা স্বপ্ন ছিল-.সচিবের চেয়ারটিতে পাকাপোক্ত হয়ে বসার। অতিরিক্ত’ কিংবা উপ’ এসব লেজুরেপদবি থেকে বেরিয়ে পুরোদস্তুর সচিব হওয়ার লোভ সেই কবেকার ! বিভিন্নভাবে মন্ত্রীর নজর পড়তে চেষ্টা তদবির করে গেছেন তাও বহুদিন হয়। মন্ত্রীর ইশারা ইঙ্গিত এবং আশ্বাসের তালিকায়ও ছিলেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় নাই। এতদিন পর অবশ্য মন্ত্রী নিজউদ্যেগে এগিয়ে এলেন কিন্তু বিনিময়ে তাকে সবার বিচারে অত্যন্ত-সহজ কিন্তু কামরুজ্জামানের জন্য ভয়ঙ্কর কঠিন কাজের ভার চাপিয়ে দিলেন ! 

কাজটি যৎসামান্য-ই বটে। 

মন্ত্রীর শ্যালিকা পরপর দু’বার এস এস সি পরীক্ষা দিয়েও পাশমার্ক পেতে ব্যর্থ হয়। শহুরে স্কুলগুলোতে এখনো নকলটকল করে ধরা পড়ার ধকল বেশি, সে-অনুপাতে গ্রামগুলো সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। গ্রামের বেশিরভাগ স্থানে পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে নকলের জয়জয়কার বেশ জোরালো। শুধু ছাত্রছাত্রীরা নকল করে না। পরীক্ষা কমিটির বেশিরভাগ লোক নকলের সাথে অষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে বেশিরভাগ শিক্ষকও আকাশ-ভাঙ্গা লোভ সামলে উঠতে না পেড়ে নকলে সরাসরি সাহায্যে করে থাকে। কারো কারো অবশ্য নীতি এবং ইচ্ছার বাইরে যেয়েও বাধ্য হয়ে একাজে যুক্ত হতে হয়।

মন্ত্রীর কাছে সেসব বিষয় অজানা নয়। সে নিজেও পরোক্ষভাবে হলেও এমন নিকৃষ্ট কাজে জড়িত। মন্ত্রীর চাওয়া সেরকম উপায়ে গ্রামের স্কুলে শ্যালিকাকে ভর্তি দেখিয়ে এস এস সি পাশ করিয়ে আনা। যেকোনো স্কুল কলেজ পাশ সার্টিফিকেট একদিনের মধ্যে মন্ত্রীর সামনে হাজির করা কামরুজ্জামানের কাছে নস্যি। তারপরও কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম বলে কথা আছে। মন্ত্রী, খাবেন তবে সহজপথে নয়,ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে তবে-ই গলাদকরণ করবেন। কামরুজ্জামানের গ্রামের বাড়ি ঢাকার অদূূরে- বিক্রমপুরে। তিনি সেটা জানেন এবং সেই স্কুলে শ্যালিকাকে ভর্তি করাতে নির্দেশ দেন। 

কামরুজ্জামানের নিজের উপর নিজের বড়ো করুণা হচ্ছে।

তার কাছে মন্ত্রী প্রস্তাবটা পারতেই সে আদ্যোপান্ত না ভেবে তা লুফে নেয়। যে-করেই হউক সচিবের আসনটা যে তাকে পেতেই হবে এবং মন্ত্রীকে খুশি করা ছাড়া এপথে বিকল্প কোনোপথ খোলা নেই।

কিন্তু কামরুজ্জামানের সামনে পাহাড়সমান ব্যক্তিত্বধর এবং বর্তমান সমাজের জন্যে খুবই বেমানান প্রধান শিক্ষক আছেন, সেমুহূর্তে সেটা তার স্মরণে ছিল না।

সহজসরল অথচ পাথরের মতো শক্তদৃঢ় ব্যক্তিত্ববিশিষ্ট চেহারাটি তার কিছুক্ষণ পরে মনে পড়ে যায়। প্রধান শিক্ষকের কথা মনে পড়তে- কামরুজ্জামানের দু‘হাটু ঠকঠক করে কেঁপে উঠে। মন্ত্রীর সামনে ব্যাপারটা চেপে গেলেও পরের মুহূর্ত থেকে তার মধ্যে আর স্বস্তি-স্থিরতা ফেরেনি। মন্ত্রীকে কথা দিয়েছেন নিজের স্কুল থেকে কাজটি করিয়ে দিবেন। কিন্তু যার মাধ্যমে করাবেন, সেই প্রধান শিক্ষকের কাছে অন্যায় আবদার নিয়ে যাওয়ার দৃষ্টতা কামরুজ্জামান কেনো তার বাবারও নেই !

প্রধান শিক্ষক,কামরুজ্জামানের বাবারও শিক্ষক ছিলেন।

তিনি কামরুজ্জামানের বাবাকে খুব স্নেহ করতেন। বাবা উপজেলা অফিসে কাজ করতেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সৎ এবং সহজসরল জীবনবহনে অভ্যস্ত।

কিন্তু সংসারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি, কামরুজ্জামানের বাবা, হঠাৎকরেই পৃথিবীর পাঠ চুকিয়ে পরপারে চলে যান। কামরুজ্জামান সংসারের বড় ছেলে। চার ভাইবোনের সংসারে বাবার রেখে যাওয়া সম্পদ বলতে ভিটেমাটিটুকু। সংসারের দুর্দশায় তার পড়াশুনা বন্ধ হয়ে যায়। সংসারের হাল ধরতে পনের বছরের বালক কামরুজ্জামান স্থানিয়বাজারে কাপড়ের দোকানে কাজে লেগে পড়ে। 

একদিন প্রধান শিক্ষকের চোখে পড়লে তিনি তাকে জোর করে স্কুলে নিয়ে আসেন। এবং পরবর্তীতে পড়াশুনা বিষয়ের সমস্ত খরচ তিনি নিজ খরচায় চালিয়ে নেন। স্যার শুধু কামরুজ্জামানকে নয় এমন বহু ছাত্রছাত্রীকে নিজের কষ্টের উপার্জনের টাকায় পড়াশুনা করান।

একসময় কামরুজ্জামান ভালো ফলাফল করে এস এস সি পাশ করে। ঢাকা কলেজে পড়ার খরচও স্যার নিজে বহন করেন। এভাবে বিশ্ববিদ্যালয় অবধি স্যারের সাথে যোগাযোগটা বরাবরই ছিল। স্যারের পরামর্শ এবং সহযোগিতায় বিশ্ববিদ্যালয়েও ভালো ফলাফল করে সে বেরিয়ে আসে।

মানুষের আত্নিকবোধের দরজা যখন বন্ধ হয়ে যায়, তখন জাগতিক মোহের জন্ম হয়। কামরুজ্জামানের আত্নিকজগতে চির ধরতে শুরু করে, ধীরে ধীরে সে ভিন্ন মানুষ হয়ে উঠে। অতীত ভুলে যেয়ে পচে-যাওয়া সমাজের সাথে সখ্যতা গড়ে। এবং সত্যকে আগাছা আর মিথ্যাকে আরাধ্য করে বসবাস করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। অবধারিতভাবে স্যারের সাথে যোগাযোগটা বন্ধ হয়ে যায়। স্যার অবশ্য লোকমুখে কামরুজ্জামানের উনথানের কাহিনি শুনেন এবং স্বভাবত খুব আহত হোন। সে খবর অবশ্য কামরুজ্জামানের কান অবধি পৌঁছে কিন্তু তারমধ্যে অনুশোচনাবোধের ক্ষমতাও ততদিনে নষ্ট হয়ে গেছে।       

এতদিন পরে এসে স্যারের সামনে দাঁড়ানোর দুঃসাহস দেখানো কামরুজ্জামানের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। কিন্তু মন্ত্রীর কাছে সে কথা দিয়ে এসেছে। পিছু হটার পরিণাম কামরুজ্জামানের অজানা নয়। সময় ঘনিয়ে আসে বাধ্য হয়ে কামরুজ্জামান তার শ্যালক এবং তার অফিসের সদ্য বি সি এস পাশ করে চাকুরী শুরু করা রওনককে আবদার সমন্বিতপত্র দিয়ে প্রধান শিক্ষকের ঠিকানায় পাঠিয়ে দেয়। 

ঢাকা থেকে বিক্রমপুরের দূরত্ব অনতিদূর হলেও যাতায়াত ব্যাবস্থা সেই পুরনো আমলের।

মাত্র মাইল পনের পথ, বাসযোগে পেরোতে সূর্য মাথার উপর দাঁড়িয়ে যায়। এরপর নিদিষ্ট বাসঘাটে নেমে, আরও প্রায় দুই মাইল পায়ে হাঁটাপথ পেরোলে- স্যারের বাড়ি। বর্ষাকালে অবশ্য নৌকোপথের ব্যবস্থা থাকে। তারা সরুপথ ধরে হাঁটতে শুরু করে।

পথের একপাশে আঁকাবাঁকা শান্তকোমল ইছামতি নদী,অন্যপাশে পটে আঁকা ছবির মতোন টিন-কাঠের দু’চালা, চৌচালা ঘরের বসতবাড়ির সারি; এ অঞ্চলের ঐতিহ্য। বৈশাখ মাসের স্যাতস্যাতে গরম প্রকৃতি; খাঁ খাঁ রোদ্দুরে তপ্ত বাতাসের আঁচ গায়ে এসে লাগে। চারদিক চুপচাপ নীরব নিস্তব্ধ। পথের দু’পাশে ঝুপঝারে ঢোলকলমির বেগুনীফুলগুলো চোখ মেলে যেন তাকিয়ে আছে। কোথাও কোথাও মান্দার,মূতরা, পিটালি,জিগা,বাঁশের সারি। মেটেপথ, দূর্বাঘাসে ছেয়ে মনেহয় যেন সবুজ চাদরে ঢাকা দিয়ে আছে। অচেনা গাঁয়ের মেঠোপথে মাঝে মাঝে ঘূর্ণিহাওয়ায় ধূলোকণা উড়ে বেড়ায়; বাতাসে উড়ে-পড়া গাছের শুকনো ঝরা হলুদপাতায় ঢেকে আছে পায়েহাঁটা পথ। ঝরাপাতা পায়ে দুমড়ে বনোগন্ধ ছড়ানো অচেনা এপথে হাঁটতে তাদের মন্দ লাগে না। 

প্রায় ঘণ্টা দুই হাঁটাপথের শেষে স্যারের বাড়ির দেখা মিলল বটে তবে ততক্ষণে সূর্য ঢলে পড়ে সিথান নিয়েছে পশ্চিম আকাশের কোণায়।

কামরুজ্জামানের মুখের বর্ণনার সাথে হুবহু মিলে যায়, স্যারের বাড়ির সাথে। প্রকৃতির কোলে ঘুমিয়ে আছে তার স্যারের বাড়ি। সত্যি তাই। মূলরাস্তা হতে সরু ঢোরাসাপের মতো এঁকেবেঁকে পাট,ধঞ্চে ক্ষেতের আল ধরে খানিকটা পথ পেড়িয়ে প্রকৃতির সবুজ সমুদ্রের ভেলায় ভেসে আছে স্যারের বাড়ি। রওনক মুগ্ধ হয়ে বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে, স্বপ্নরাজ্য যেন! ক্যানভাসে আঁকা ছবির মতো মনে হয়। বাড়ির চারপাশটাজুড়ে যতদূরে চোখ যায়- পাট আর ধনচের মাঠ। শেষ বিকেলের বৈশাখী বাতাসে ফসলের মাঠ দোলে উঠলে চোখে ভ্রম ঠেকে ! যেন গভীর সমুদ্র থেকে উঠে আসা সবুজঢেউ দূরযাত্রার কোন জাহাজকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ! স্যারের বাড়িটাকে সবুজসমুদ্রে ভেসে থাকা জাহাজ মনে হয়। 

দু’পাশে জমির আল ধরে খানিকটা পথ এগোতে স্যারের দেখা মিলল। কামরুজ্জামানের বর্ণনায় তার স্যারের কথা জানা ছিলো বইকি; না- হলে স্যারের বেশভূষায় তাঁকে ঠাহর করা বেশ কঠিন হয়ে পড়ত। পরনে সাধারন সুতির পাড়হীন ধূসর সবুজরঙা লুঙ্গি, কাঁধে লালসবুজে ডোরাকাটা গামছা। লম্বা, সুঠামদেহী, টিকালো নাকের দু’পাশের চোখদুটো থেকে ঠিকরে পড়ছে সততার উজ্জ্বলদ্যুতি। পাটক্ষেতে নিড়ানির কাজ করছিলেন- শরীরে বিন্দু বিন্দু ঘাম, হাতপা প্যাক-কাদার মাখামাখি। কাঁধে রাখা গামছায় গা মুছতে মুছতে সহাস্যে এগিয়ে আসেন।

রওনক, একদৃষ্টিতে স্যারের দিকে তাকিয়ে থাকে। অতি সাধারন চাষীবেশী মানুষটির অসাধারণত্ব তাকে মোহিত করে। তিনি যেন কোনো মানুষ নন, সাক্ষাৎ দেবতা। যার সামনে দাঁড়ালে পৃথিবীর সবচেয়ে পাপী লোকটিও সমস্ত অকাজ ছেড়েছুঁড়ে সত্য, সুন্দরের পথ খুঁজবে। স্যার,তাদের নিয়ে বাড়ির দক্ষিণের উঠোনে, বাঁশেরমাচায় বসেন।

তিনি সদালাপী মানুষ কিন্তু কামরুজ্জামানের শ্যালক এবং রওনকের অবস্থা আলাপের পর্যায়ে নেই। দু’জনই ঘামছেন, তাদের মন কঠিন চিন্তায় আচ্ছন্ন। কামরুজ্জামানের অন্যায় আবদারপত্র স্যারের হাতে তুলে দেবার দুঃসাহস তাদের কারোরই এমুহূর্তে নেই। ‘স্যারের সংস্পর্শে গুছানোসব কথাবার্তা উলটপালট হয়ে যায়,তবে তা ভয়ে নয়- স্যারের পাহাড়সম সততা আর দৃঢ়চেতা ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে’। কামরুজ্জামান তাদের স্যারের কাছে পাঠানোর শুরুত এই আশঙ্কার কথা বলছিল। এ মুহূর্তে দুজনের-ই  তা মনে পড়ে যায়। কামরুজ্জামানের কথায় বিন্দুমাত্র মিথ্যে নেই, তারা এমুহূর্তে তা বেশ ভালোভাবে টের পায়। 

একদিকে সামরিক সরকারের জাঁদরেল মন্ত্রী অন্যদিকে তাদের সন্মুখে দাঁড়ানো অতিসাধারন বেশভূষায় কিন্তু পৃথিবীর দীর্ঘতম গিরিখাতের মত গভীর ব্যক্তিত্বধারী, প্রধান শিক্ষক। 

তারা গভীর বিপদসমুদ্রে দাঁড়িয়ে থাকে। তাদের চোখেমুখে এবং আচারআচরণে স্বাভাবিকভাবে ভেসে উঠে অসহায়ত্বের ছায়া। স্যার, অবশ্য তাদের আগমনের কারণ কিছুটা হলেও আঁচ করতে পারেন। এবং বুদ্ধিমান স্যার তাদের সঙ্কটাপন্ন বিপদ থেকে পরিত্রাণ দিতে নিজেই এগিয়ে আসেন। হাসিমুখে কামরুজ্জামানের কথা জানতে চান। কামরুজ্জামানের শ্যালক এ সুযোগে পত্রটি কাঁপাহাতে স্যারের দিকে এগিয়ে দেয় ! স্যার যত্ন করে পত্রেরভাঁজ খুলে পড়তে শুরু করেন। 

রওনক শেষদৃশ্য দেখার অপেক্ষায় স্থিরদৃষ্টিতে স্যারের দিকে তাকিয়ে থাকে। সামরিক সরকারের মন্ত্রীর নির্দেশনামা বলে কথা, ভয়ে তার নিজের শরীরই কাঁপছে। এমন একজন মানুষকে কামরুজ্জামান কীভাবে এমন বিপদে ঠেলে দিতে পারল ভেবে নিজেকে নিকৃষ্ট গোবরেপোকার মতো মনে হচ্ছে কারণ সে নিজেও এ-কুকর্মে যুক্ত হয়ে গেছে। 

স্যার গভীর মনোযোগে পত্রপাঠ শেষে উন্মুক্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। তাঁর মুখে শূন্যতার নিস্পৃহ ঢেউখেলানো হাসি ছড়িয়ে পড়ল। কপালের দু’পাশের রগের শিরায় টান স্পষ্ট হয়ে উঠল। বৈশাখী বিকেলের পুঞ্জিভূত মেঘদল আকাশময় উড়াউড়ি করছে। তারপরও সূর্যের আলোর কমতি পড়ে নাই পৃথিবীর কোথাও। মাথা নিচু করে খানিকক্ষণ কী যেন ভাবলেন। 

তারপর কামরুজ্জামানের পত্রের উল্টোপাতায় একটানে দু’চার লাইনের একটা চিরকুট লিখলেন। চিরকুট-টা রওনকের হাতে ধরিয়ে দিয়ে, তিনি আবার পাটক্ষেতের নিড়ির কাজে ফিরে গেলেন।

রওনক চিঠির পাতায় চোখ রাখলঃ “ বাঘ না খেয়ে মরে গেলেও কুকুরের মতো উচ্ছিস্ট মুখে তোলে না। তোমার কিংবা মন্ত্রীর অন্যায় আবদার আমারপক্ষে রাখা সম্ভব নয়। আমার দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনের ব্যর্থতা, তোমার মতো মেরুদণ্ডহীনকে শিক্ষার আলোতে আলোকিত করার প্রচেষ্টা”। 

এসব ঘটনা কুড়িবছর আগেকার।

সেই বৈশাখী বিকেলের ঘটনা, রওনকের বোধের শিকড়ে তুমুল বেগে নাড়া দিয়ে গেছে। সেই থেকে স্যারের আদর্শ নিজের মধ্যে ধারণ করে সমস্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সমাজে আজ সে বিশেষ অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত। তার সততার স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরষ্কার দেওয়া হয়েছে ! রওনকের এ অবস্থানের নেপথ্যে ছিল স্যারের নীতি- আদর্শের অনুসরণ। স্যার চলে গেছেন পৃথিবী ছেড়ে কিন্তু স্যারের আদর্শে গড়ে-ওঠা রওনকদের মাধ্যমে চিরকাল তিনি রয়ে যাবেন সমাজের বাতিঘর হয়ে।

=====================