You are currently viewing মাত্রিক পঙ্‌ক্তিমালা // মুহাইমীন আরিফ

মাত্রিক পঙ্‌ক্তিমালা // মুহাইমীন আরিফ

মাত্রিক পঙ্‌ক্তিমালা // মুহাইমীন আরিফ

(কবি ফিরোজ শাহ-কে)

নদীর শরীরে জাগা

চরগুলো পলল অর্বুদ

স্রোতের পায়ে প্রদাহ!

 

ধরা-গর্ভ-গোর

ঈশ্বরের জ্যামিতিক বাস্তুকর্ম

মৃত আর জীবিতের-

 

আয়ুর সীমান্তে পোস্টম্যান!

ছিটমহলে জলপাই সিটি…

মহাকালের খামে চিঠি-

 

কচি রোদ্দুরের ভোর

কবিতাশরীরে ঝাঁঝাঁ দুপুর

সন্ধ্যেতে ঝিঁঝির জোর

 

কাস্তে কাটে ধান,

কাস্তের মতো দেহকাঠামো

বয়সি উদরে টান।

 

ঝাড়ে কোপায় চোর,

উজাড়ে উদোম চাঁদ!

চুরির বাঁশেই গোর।

 

বায়ুর হাতে লাঠি,

মেঘমিছিলে ঝড় পোশাকি-

ঋতুর সভা মাটি।

=================

 

বাংলা সাহিত্যে এ ফরমেটে কবিতার খুব একটা প্রচল নেই। কবিতার শরীর প্রাচীন, ধূসর অতীতে সৃষ্ট। ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের “সন্দীপন : জাপানি হাইকু, বিশাখ ও মাত্রিক কাব্য”-এর ১৪১ পৃষ্ঠাটি পড়তে গিয়ে মাত্রিককাব্য সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাই।

কবিতাপ্রেমীদের জন্য আমার এই ‘সন্দীপন’-পাঠের চুম্বকঅংশ হুবহু তুলে ধরলাম-
“…ব্যাসঋষি দেবভাষায় ‘শ্রীমদ্ভাগবতম্’ রচনা করেন। এই মহাগ্রন্থের দশম পরিচ্ছদে উল্লিখিত আছে যে মহামান্য সান্দীপনি মুনির নিকট শ্রীকৃষ্ণ এবং বলরাম বিজ্ঞান কলা ও অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে বিভিন্ন সুর, ছন্দ ও মাত্রিক কাব্য শিক্ষা করেন। স্পষ্টতই ব্যাসঋষি বা সান্দীপনি মুনি মাত্রিক কাব্য উদ্ভাবন করেননি। বৈদিক সমাজে এর অস্তিত্ব তৎপূর্বেই ছিল। সান্দীপনি মুনি অন্যান্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে বৈদিক জ্ঞান-সমুদ্র থেকে আহরণ করে এই মাত্রিক কাব্য শ্রীকৃষ্ণ এবং বলরামকে মায়া মোহময় মত্ত সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন আশ্রমে দান এবং অভ্যেস করিয়েছিলেন মাত্র।”

 

কবিতার কাঠামো ও বৈশিষ্ট্য

তিন পঙ্‌ক্তি। প্রতি পঙ্‌ক্তিতে শব্দসংখ্যা তিনটি। সে হিসেবে মোট শব্দ নয়টি। কবিতার কাঠামো ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে ভাস্করের আরও বর্ণনা- “মাত্রিক কাব্যে প্রতিটি চরণে তিনটি মাত্র শব্দ থাকবে এবং তিনটি পঙ্‌ক্তিতে বক্তব্য সম্পূর্ণ হবে। যে দিক থেকে, যে ভাবেই গণনা করা হোক না কেন, সরলরেখা ধরে গণনা করলে সর্বতই শব্দসংখ্যা দাঁড়াবে তিন। এর সুর, ছন্দ ও বৈশিষ্ট্য কাব্যের উদ্দেশ্য অনুযায়ীই হওয়া উচিত। প্রতিটি কুলক জাপানি হাইকুর মতোই স্বাধীন। বিষয়বস্তুর সংযোগ রক্ষা করে মাত্রিক কাব্যে সোপান রচনা করা হত কিনা বা কাব্যের সাহিত্যের রস সম্পূর্ণ রেখে সোপান রচনা করা সম্ভব কিনা তা গবেষণা সাপেক্ষ।

প্রতি পঙ্‌ক্তিতে তিনটি করে শব্দ নিয়ে তিন চরণে শব্দ সংখ্যা দাঁড়াবে নয়। হাইকু বা বিশাখ কাব্যের সতেরো মাত্রার নিয়মের মতো এ নিয়মে কোনও ব্যতিক্রম চলবে না। উল্লিখিত আছে যে এই নিয়মের মধ্যে মাত্রিক কবিতা বিভিন্ন ধরনের হতে পারে এবং বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতে পারে।”

উদ্ধৃত অংশটি এবং হাইকুবৈশিষ্ট্য থেকে সারসংক্ষেপাকারে মাত্রিক কাব্য-সংক্রান্ত বিষয়াবলির উল্লেখ করা যেতে পারে-

মাত্রিক কবিতাগুলো হাইকুপ্রকৃতি সাদৃশ। ভাব, গাম্ভীর্য বজায় রেখে, কাঠামোগত কঠিন নিয়ম মেনেই মাত্রিক কবিতা রচনা করতে হয়। কবিতার বিষয় মুক্ত। প্রকৃতি, মানবকিতানির্ভর যে-কোনও বিষয়ের রূপকল্প বা চিত্রকল্প বা দৃশ্যকল্প ফুটিয়ে তোলা হয় এই কাব্যে।

কবিতার চরণ- গদ্য, পদ্য বা মিশেলও হতে পারে। অন্ত্যমিলের ব্যাপারটি থাকতে পারে; আবার না-ও থাকতে পারে। কবিতায় মাত্রাবৃত্ত বা অক্ষরবৃত্ত ব্যবহৃত হবে- এ ধরনের বাধ্যবাধকতা নেই। ভাবপ্রকাশে যতিচিহ্নের ব্যবহার রয়েছে। বিষয়ভিত্তিক এ কবিতাগুলো শিরোনাম-সহ বা শিরোনামহীনও হতে পারে।

‘সন্দীপন’-এ লিখিত মাত্রিক কবিতাগুলো পাঠ করলে উপরের বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়।

মাত্রিক কাব্য তার রূপ-রস-মাধুর্যের কারণে বাংলাসাহিত্যের নিজস্ব সম্পদ হিসেবে সমাদৃত হবে একদিন- এই আশা রাখি।

এই কবির কবিতা শুধু মাত্রিক কবিতার কাঠামোয় (তিন চরণে নয় শব্দ) সাজানো। বিষয়- সামসময়িক ও সাম্প্রতিক মুহূর্তের রূপকল্প।

সূত্র :

১. KRSNA by Bhakti Vedanta Swami, ISCON, Boston, 1970, Chapter 44.

২. শ্রীমদ্ভাগবতম্, স্রষ্টা : বেদব্যাস। দশম স্কন্ধ, ৪৫ অধ্যায়।

৩. Basho-on Love and Barley, Haiku of Basho.

 

পরিচিতি

মুহাইমীন আরিফ

অ্যাকাউন্টিং নিয়ে স্নাতকোত্তর করলেও সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ ছোটোবেলা থেকেই। হাইকু ছাড়াও প্রবন্ধ, ছোটোগল্প, অণুগল্প লিখে থাকেন। উচ্চমাধ্যমিক স্তর থেকে স্নাতকোত্তর শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য অ্যাকাডেমিক বই লিখেছেন  সাতটি।
হাইকুর প্রতি আগ্রহ বেশ পুরনো। বাংলাদেশ ও কলকাতার পত্রিকা ও ওয়েবজিনগুলোতে নিয়মিত হাইকু লিখছেন। উল্লেখ্য, অমর একুশে বইমেলা ২০২২, ঢাকা-তে তাঁর রচিত প্রথম হাইকুগ্রন্থ ইউক্লিডের আঙুলে বৃত্তের চাঁদ প্রকাশিত হয়েছে।