শহিদ সন্তানের আকুতি
বিচিত্রা সেন
বছর ঘুরে আবারও এলো মহান স্বাধীনতা দিবস। মুক্তিযুদ্ধের পর ৫৪টি বছর কেটে গেলো। অপেক্ষায় থেকে থেকে ১৯৮৫ সালে মামী বিদায় নিলেন। ১৯৮৯ সালে মেজদি বিদায় নিলো। ১৯৯৮ সালে ঠাকুরমা বিদায় নিলেন। ২০০৩ সালে দিদিমা বিদায় নিলেন। ২০১২ সালে মা বিদায় নিলেন। তাঁরা সবাই অপেক্ষায় ছিলেন। এখন যেমন আমরা আছি। জানি এ অপেক্ষার ফলাফল শূন্য। তবুও বুকের ভেতর দ্বিতীয়ার চাঁদের মতো ক্ষীণ আশা -যদি ফেরে। আসলে আমরাও জানি ফিরবে না। তাঁরা অনেক আগেই এ বাংলাদেশের মাটি কিংবা জলে মিশে গেছেন,তবুও ভাবি অলৌকিক কিছু যদি ঘটে। ঠিক এমনটি ভেবে ভেবে মামী,মেজদি,ঠাকুরমা,দিদিমা,মা অপেক্ষার পালা চুকিয়েছেন। আমরাও একদিন পালা চুকাবো,কিন্তু তাঁরা আর কখনো ফিরবেন না।
বলছিলাম আমার বাবা,একমাত্র কাকা এবং দুই মামার কথা। কেউ কাউকে একা ছাড়তে চাননি বলে সবসময় একসাথেই ছিলেন। মৃত্যু কি তাঁদের আলাদা করতে পেরেছিল? জানি না। কারণ তাঁদের মৃত্যু কোথায় হয়েছিল, কীভাবে হয়েছিল আমরা কিছু জানি না। আদৌ তাঁদের মেরে ফেলেছিল কিনা সেটাও আমরা জানি না। তাঁদের ধরে নিয়ে গিয়েছিল পাকিস্তানি হায়েনারা। সাথে ছিল এদেশীয় বিশ্বাসঘাতকদের দল রাজাকাররা। দিনটি ছিল ১১ ডিসেম্বর ১৯৭১। তারপর থেকে তাঁদের আর কোনো হদিশ পাওয়া যায়নি। আমার দাদু মানে নানা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থানায় থানায়,ক্যান্টনমেন্ট ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে তাঁদের খোঁজ করেছিলেন,কিন্তু পাওয়া যায়নি।
একসাথে এতজনকে হারিয়ে আমার দাদু ঠিক থাকতে পারলেন না। স্ট্রোক করে স্থবির হয়ে গেলেন। তিনি সবাইকে চিনতে পারতেন,কিন্তু কথা বলতে পারতেন না,চলাফেরা করতে পারতেন না। তাঁর সে দুঃসহ যন্ত্রণার অবসান ঘটলো ১৯৭৪ সালে। আমার অত কিছু মনে নেই। বাবা,কাকা, মামাদেরকে হারিয়েছিলাম দেড় বছর বয়সে। দাদুকে হারালাম চার বছর বয়সে। আমাদের পরিবার একেবারে অভিভাবকশূন্য হয়ে পড়লো। আমরা সবাই আমার মামাবাড়িতেই থাকতাম। চট্টগ্রাম শহরের আগ্রাবাদের গোসাইলডাঙ্গায় আমার মামাদের বিশালবাড়ি। সরকার অনেক সম্পত্তি জবরদখল করার পরেও তাদের বিশাল বাড়ি। সেই বাড়িতেই আমার শৈশব কেটেছে। আমার শৈশব অনেক বর্ণাঢ্য। একঝাঁক সমবয়সী বন্ধুর সাথে সারা বিকেল হৈ হৈ করে মাঠ দাঁপাটাম। সবরকম খেলায় পারদর্শী ছিলাম। ছেলেদের সাথে সবরকম খেলায় অংশ নিতাম। হাডুডু,দাড়িয়াবান্ধা,বৌচি,সাতচাড়া,মার্বেল,লাটিম,ঘুড়ি ওড়ানো,এমনকি ফুটবল,ক্রিকেটও। কিন্তু এতকিছুর পরও মাঝে মাঝে আমি মনখারাপ রোগে আক্রান্ত হতাম। সেটা হতো যখন বন্ধুদের বাবারা মাঠে এসে বন্ধুদেরকে ডেকে নিয়ে বেড়াতে চলে যেতো। আমার মনটা হু হু করে উঠতো। বুঝতে পারতাম আমার বাবা নেই। কিন্তু তখনও আমি জানতাম না,আমার বাবা নেই মানে পৃথিবীতেই নেই। আমার মা আমাকে বলেছিল আমার বাবা বিদেশ থাকে। পূজার সময় আমার জন্য লালজামা আর বড় একটা পুতুল নিয়ে বাড়ি আসবে। কয়েকবছর আমি অপেক্ষাও করেছি বাবার জন্য।
পৃথিবীর সব সত্যের মতো একদিন আমার জীবনের চরম সত্যটাও আমার কাছে প্রকাশিত হলো। আমি খুব কাঁদলাম, ভেঙে পড়লাম। মা আমাকে বোঝালেন,” তোমার বাবা,কাকা,মামাদের তো লাশ পাওয়া যায়নি। তাঁরা হয়তো বেঁচেও আছেন। ভগবানকে ডাকো। তিনি চাইলে তাঁরা ফিরে আসতেও পারেন।” সেই শিশুকালে আমার মনে হয়েছিল, হ্যাঁ,একদিন হয়তো আমার বাবা, কাকারা ফিরে আসবে। কিন্তু না,তাঁরা এখনো পর্যন্ত ফিরে আসেননি। কত রাতে আমি স্বপ্ন দেখেছি আমার বাবা অনেক বড় একটা পুতুল নিয়ে আমাকে ডাকছে। খুশিতে আমার ঘুম ভেঙে গেছে। তারপর যখন বুঝেছি এটা স্বপ্ন ছিল,তখন মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে অঝোরে কেঁদেছি। মা শুধু মাথায় হাত বোলাতেন,আর বলতেন,”তুমি ভালো করে পড়ালেখা করো। তোমার বাবা খুব খুশি হবে।”
ছোটবেলা থেকে আমি একটু অন্যরকম ছিলাম। আমি কখনো আমার দুঃখটা কারো সাথে শেয়ার করতাম না। বাবাকে না পাওয়ায় আমার ভেতর যে তীব্র কষ্ট ছিল,সেটা আমি কাউকে বুঝতে দিতাম না। সারাক্ষণ লেখাপড়া আর খেলাধুলা নিয়ে মেতে থাকতাম। তবে আমি আমার চারপাশকে খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতাম। আমার বন্ধুদের চেয়ে আমি একটু আলাদা ছিলাম। টিভিতে যখন স্বাধীনতা দিবস আর বিজয় দিবসের বিশেষ অনুষ্ঠানমালা দেখানো হতো,তখন আমার মনে হতো আমরাও তো শহিদ পরিবারের সন্তান। আমাদেরকে তাহলে কোথাও ডাকে না কেন? আমাদের পাড়ায় এই দিবসগুলোতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। কিন্তু কখনো এসব অনুষ্ঠানে আমাদেরকে শহিদ পরিবার হিসেবে আলাদা মর্যাদা দেওয়া হয়নি। অথচ সবাই জানতো আমাদের পরিবারে চারজন শহিদ। আমাদের কাছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাক্ষরিত শহিদের স্বীকৃতিপত্র ছিল। কিন্তু আমরা কেউ কখনো কোথাও সেই স্বীকৃতিপত্র ব্যবহার করিনি। না শিক্ষাক্ষেত্রে,না চাকরিক্ষেত্রে,না অন্য কোনো সুবিধাদি পেতে। ব্যবহার করিনি বলে আজও মাথা উঁচু করে সমাজে চলতে পারি। তবে দেশের জন্য আমার পরিবারের উপার্জনক্ষম চারজন পুরুষ প্রাণ দিলেন তাঁর স্বীকৃতি পেতে ইচ্ছে করে। সেটা অর্থ দিয়ে নয়,সম্মান দিয়ে। সেই সম্মান বেশ দেরিতে হলেও কিছুটা আমরা পেয়েছি। আগ্রাবাদের গোসাইলডাঙ্গায় এবং বোয়ালখালীর উত্তরভূর্ষি গ্রামে আমার বাবা,কাকা,মামাদের নাম খোদাই করা শহিদমিনার হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ গবেষক তাজুল মোহাম্মদের “জন্মভূমি বধ্যভূমি” গ্রন্থে আমার বাবা,কাকা,মামাদের পাকিস্তানি সেনা কর্তৃক ধরে নিয়ে যাওয়ার বিস্তৃত বিবরণ আছে। আমার প্রকাশিত বিভিন্ন গ্রন্থে তাঁদের কথা তুলে ধরেছি।
একদিন যখন আমরাও চলে যাবো এ পৃথিবী ছেড়ে তখন হয়তো আমাদের পরিবারের কোনো উত্তরসূরি এসব বই আর শহিদ মিনার দেখে জানতে পারবে তাদের পূর্বসূরিদের দেশের জন্য জীবনদানের কথা। হয়তো তারা গর্বিত হবে। ব্যাস,এতটুকুই। আমাদের আর কিছু চাওয়ার নেই। দেশের জন্য প্রাণ দিয়ে বিনিময়ে কিছু নেওয়া যায় না। কারণ দেশ তো মা। মায়ের কাছ থেকে কি কখনো প্রতিদান নেওয়া যায়? তবে একটাই শুধু চাওয়া,সেটা দেশের মানুষের কাছে। তিরিশ লাখ শহিদের আত্মদান আর তিন লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে পাওয়া এ রক্তস্নাত জন্মভূমি যেন কখনো ৭১ এর পরাজিত শক্তির হাতে চলে না যায়। যদি যায় তবে এত অশ্রু, এত রক্তের অভিশাপে এ দেশ জর্জরিত হয়ে যাবে। আমরা আমাদের প্রিয় বাংলাদেশের এমন পরিণতি চাই না। আমরা যেন আজীবন মাথা উঁচু করে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভাষায় বলতে পারি—
সাবাস বাংলাদেশ! এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়
জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়।
————————