‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা’ আন্দোলনে নারীর অবদান: আমরা কি চেয়েছিলাম || অন্তর চন্দ্র
মানভূম ভাষা আন্দোলন থেকে একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলন বাঙালির জীবনে অন্যতম মাত্রা এনে দিয়েছিল। এত দীর্ঘকাল ভাষার জন্য বাঙালি যে মরতে পারে তার একমাত্র উদাহরণ ভাষা আন্দোলন। ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনে ছাত্ররা যেমন সক্রিয় ছিল, তেমনি মেয়েরাও অদম্য সাহস নিয়ে নেমে পড়েছিলেন ভাষা আন্দোলনে। দেশ-বিভাগোত্তর পরিস্থিতিতে বিশিষ্টজনেরা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে যে স্মারকলিপি প্রদান করেন, স্বাক্ষর প্রদানকারী নারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন আনোয়ারা খাতুন, লিলি খান, লীলা রায়, রুকিয়া আনোয়ার প্রমুখ। নারীরা প্রত্যক্ষভাবে দলে দলে নেমে এসেছিলেন, ভাষা আন্দোলনে যা ইতিহাসে এক অমর অধ্যায়ের সূচনা করেছে। বাঙালির অস্থি-মজ্জায় ভাষা আন্দোলনের কালচিত্র প্রবাহমান। যতবার বাংলা ভাষাকে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল, বাঙালি ঠিক ততবার প্রতিবাদী কন্ঠে রুখে দিয়েছেন।
দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের তথাকথিত জাতির পিতা গভর্নর জেনারেল কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এসে ঘোষণা দেন যে ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ পরবর্তীতে ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন পল্টন ময়দানে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত প্রকাশ করেন। সেই সিদ্ধান্ত বাঙালি পক্ষে সুখকর ছিল না; কারণ পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ মানুষ ছিলেন বাঙালি। বাংলা ছিল তাদের মাতৃভাষা। বাঙালিরা খাজা নাজিমুদ্দিনের বক্তব্য মেনে নিতে পারেননি, তাই ঢাকার রাজপথে নেমে এসেছিল শিক্ষার্থীরা। রক্তে রক্তে ভেসে গিয়েছিল ঢাকার রাজপথ। প্রাণ দিয়েছিলেন রফিক উদ্দিন, শফিক, আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, অহিউল্লাহ, আবদুস সালাম সহ নাম না জানা অনেকে। গুলিবিদ্ধ শহীদ আসাদের রক্তমাখা শার্ট নিয়ে ছাত্রছাত্রীবৃন্দ ২২ ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদ মিছিল বের করেছিলেন। গঠিত হয়েছিল সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মতো বেশ কয়েকটি সক্রিয় সংগঠন, যারা ভাষা আন্দোলনে সরব ছিলেন।
১৪৪ ধারা ভঙ্গের দায়ে পুলিশ লাঠিচার্জ, টিয়ার গ্যাস এবং গুলিবিদ্ধ করে হত্যা করেছিল বাংলার সোনার সন্তানদের। কিন্তু বাঙালি তো থেমে যাওয়ার বস্তু নয়! সকল বাধা অতিক্রম করে, দিন-রাত আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইডেন কলেজ এবং অন্যান্য জায়গা থেকে দলবেঁধে মেয়েরা এসেছিলেন মিছিলে। ‘বাংলা ভাষা অমর হোক’ ‘একুশে ফেব্রুয়ারি বাঁচার লড়াই’ ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ ‘উর্দু হরফে বাংলা লেখা চলবে না’ ‘ভাষার মান, নয়তো জীবন দান’ ইত্যাদি স্লোগানে সারাদেশ ছেঁয়ে গিয়েছিল। সরাসরি রাজনীতির সাথে যুক্ত না থেকেও অনেক নারী এসে যুক্ত হয়েছিল রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মিছিলে। ভাষার প্রতি বাঙালির এত টান, এত প্রেম, একুশে ফেব্রুয়ারিকে অমর উপাধি দিয়েছে।
ভাষা আন্দোলনে নারীরা প্রত্যক্ষভাবে সক্রিয় ছিল, তারা পোস্টার, ফেস্টুন, ব্যানার নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন, দেয়ালের গায়ে অঙ্কিত করেছিলেন ভাষা আন্দোলনের স্থিরচিত্র; বাড়ি বাড়ি অর্থ সংগ্রহ করে প্রেরণা যোগাচ্ছিলেন আন্দোলনকারীদের। ভাষা আন্দোলনে অসংখ্য নারীর নাম পাওয়া যায় তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আনোয়ারা খাতুন, কল্যাণী দাস, বেগম সুফিয়া কামাল, হেনা দাস, চেমন আরা, বেগম কাজী মোতাহার হোসেন, মমতাজ বেগম, কায়সার সিদ্দিকী, নাদিরা বেগম, প্রতিভা মৎসুদ্দি প্রমূখ।
১৯৪৮ সালের ৩১ জানুয়ারি ঢাকার বার লাইব্রেরিতে সর্বদলীয় সভায় ছাত্রীদের পক্ষ থেকে ইডেন কলেজের ছাত্রী মাহবুবা খাতুন বলেন, ‘বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি স্বীকার করিয়ে নেওয়ার জন্য প্রয়োজন হলে মেয়েরা তাদের রক্ত বিসর্জন দেবে।’ বাংলা ভাষার জন্য মেয়েদের ভালোবাসা ছিল অঢেল। সরকার ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে একমাস ১৪৪ ধারা জারি করে কিন্তু শিক্ষার্থীরা ২১, ২২, ২৩, ও ২৪… ফেব্রুয়ারি তারিখে জোরালোভাবে তৎপরতা চালিয়ে যান। এই আন্দোলনের মূল জোগানদাতা ছিলেন, নারীরা; তাঁদের নিবেদিত সাহসের বহিঃপ্রকাশ সেদিন দেখেছিল সারাবিশ্ব।
ভাষা সৈনিক রানী ভট্টাচার্য বলেন…“আসলে মনের মধ্যেই গেঁথে গিয়েছিল বাংলাকেই রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। আমরা যে ভাষায় কথা বলতে পারছি সেই ভাষা ছাড়া অন্য কোন ভাষা রাষ্ট্রভাষা হবে, তা মেনে নিতে পারছিলাম না। তাই নিজের বিবেকের তাড়নায় সেদিন আমি আরেক শিক্ষিকা মঞ্জুশ্রী মিছিলে গিয়েছিলাম। সকলের নিষেধ থাকা সত্ত্বেও।” এরকম অদম্য সাহস নিয়ে মেয়েরাও আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। জীবনের চরম দুর্ভোগ এবং অনিশ্চিয়তা সত্ত্বেও তাঁদের নিবেদিত প্রাণ, অকুতোভয়, আপোসহীন ত্যাগ বাংলা ভাষাকে সর্বশিখরে প্রতিষ্ঠা করেছে। তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলের ছাত্রী ভাষা সৈনিক মোসলেমা খাতুন এখনো শুনতে পান, শাফিয়া খাতুনের সেই বজ্রকন্ঠ ‘মেয়েরা, তোমরা সবাই চলে এসো। ছাত্রীদের ওপর গুলি চলছে। অনেকে মারা গেছে।’ এভাবেই মেয়েরা ভাষা আন্দোলনে প্রেরণা জুগিয়েছেন, বাংলা ভাষার প্রতি তাদের ভালোবাসা এবং জীবনদানের জন্য বাঙালি আজীবন কৃতজ্ঞ।
মহান একুশে সংগ্রামের প্রধান দাবি ছিল তিনটি, ১. রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই ২. সর্বস্তরে বাংলা চালু করা ৩. ভাষা সাহিত্য ও সংস্কৃতিক বিকাশ। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের পর তাদের চাওয়াটা কি পূর্ণ হয়েছে? নাকি অপূর্ণত্বের কোলাহলে— আমরা বেড়ে উঠেছি? এই প্রশ্ন নিজেকে করা দরকার। সর্বস্তরের মানুষের জন্য বাংলা ভাষা বেগবান করার জন্য আজও লড়াই করতে হয়! ভাষা সৈনিক হেনা দাস বলেন… “সত্যি বলি, আমরা এমন চাইনি। এরা এমন হয়েছে, এদের আধুনিক বলা যায় না। আমরা সব ইংলিশম্যান হয়ে গেছি। আমরা পড়ি ইংরেজিতে, লিখি ইংরেজিতে এবং আমাদের গোড়াটা এখন ইংরেজি হচ্ছে। এসব চাইনি আমরা। ওদের কি দোষ! ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসটা ওদের জানানো দরকার, পড়ানো দরকার। কী হয়েছিল তখন। এগুলো জানতে হবে।’
ভাষা সৈনিক রানী ভট্টাচার্য আরো জোরালো কন্ঠে বলেন…“ভাষার জন্য লড়াই করেছি। বলতে গেলে দাম দিয়ে কেনা বাংলা ভাষা। সেই বাংলা ভাষা সর্বস্তরে প্রচলিত হবে। সবকিছু হবে এই ভাষায়, শিক্ষাঙ্গনে, চলার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষায় কাজ হবে। ভাষার উন্নতি হবে। কিন্তু ক্যাডেট, কিন্ডারগার্ডেন প্রায় সব জায়গাতেই এখন ইংরেজি চালু হয়েছে । ইংরেজি শিখতে পারাই যেন পরম পাওয়া। এগুলো দেখলে দুঃখ লাগে, লজ্জাবোধ হয়। পৃথিবীর কোনো দেশ নিজের ভাষার জন্য এভাবে লড়াই করেনি। সেখানে আমাদের জীবন দেওয়াই বৃথা।” একজন ভাষা সৈনিক যখন এ কথা বলেন তখন আমাদের বলার মত আর কোন ভাষা থাকে না। এমন কিছু লোক আছে যারা মাতৃভাষায় কথা বলতেও লজ্জা পায়। এসব লোককে দেখলে ঘৃণা হয়! ওরা ভিনদেশী ভাষাকে সর্বউচ্চে রেখে— নিজের মায়ের ভাষাকে অপমান করে। বাংলা ভাষাকে বাঁচাতে এতগুলো প্রাণ ঝরে গেল, রক্তের বন্যা বয়ে গেল, এত তাড়াতাড়ি বাঙালি সেগুলো কি ভুলে যেতে বসলো? লজ্জা হয়! ঘৃণা হয়! বুকের ভেতর লুকানো সত্যকে হৃদয় খুঁড়ে আবার বের করতে হবে। নতুন প্রজন্মকে জানাতে হবে, বোঝাতে হবে, বাঙালির এই আত্মত্যাগ বৃথা যাবার নয়!
ভাষা সৈনিক মালেকা খান দৃঢ়কন্ঠে বলেন…“একুশ যেন আমার চেতনার উন্মেষ ঘটানোর একটি রবির কিরণ। আমার একান্ত বিশ্বাস, একুশ মানুষের সাংস্কৃতিক চেতনাকে সমৃদ্ধ করে। ফুলে ফুলে ঢাকা শহীদ মিনারটিও একুশে যেন মানুষের ভালবাসা পেয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠে।’ ফাগুনে রক্তরাঙা পলাশ-শিমুলও একুশের পানে চেয়ে থাকে, তার দেহের উদ্যানে জানায় রক্তিম শুভেচ্ছা।
নারীদের অবদান অবহেলায় পরিণত হয়েছে; একটা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা সবসময় হেয়প্রতিপন্ন! এ অবস্থা থেকে উঠে এসে, ভাষাসৈনিকদের হৃদয়কে আমাদের বুঝতে হবে, এই মহৎ প্রাণগুলি বাঙালির শক্তি। সালাম, বরকত, রফিকের মতো নারীরাও সে মাঠে নেমে এসেছিল, তা প্রজন্মকে জানাতে হবে। বাঙালির আত্ম-গৌরবের প্রতি শ্রদ্ধান্নিত হয়ে, ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক মহান একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। ২০০০ সাল থেকে অমর একুশে ফেব্রুয়ারি পালিত হচ্ছে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে। বাংলা ভাষা অমর হোক! সকল শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।
কৃতজ্ঞতা:
১. বায়ান্নর ৫২ নারী — সুপা সাদিয়া, কথা প্রকাশ/ প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০১১
২. ভাষার লড়াই কত দূর — মনোরঞ্জন রায়, প্রথম প্রকাশ: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২২
*********************************