You are currently viewing আলোকিত মানুষ || পিওনা আফরোজ

আলোকিত মানুষ || পিওনা আফরোজ

আলোকিত মানুষ

পিওনা আফরোজ

দুপুরটা যখন ধীরে ধীরে বিকেলের কোলে ঢলে পড়ছিল ঠিক তখন থেকেই দাঁড়িয়েছিলাম একা। ওর ফেরার অপেক্ষায়! এইতো, কিছু সময় আগে যখন ওর কাছে জানতে চাইলাম, ‘কোথায় যাচ্ছ?’ ও আমার প্রশ্ন শুনে থমকে দাঁড়িয়ে বলল, ‘তুমি এখানে দাঁড়াও । আমি ওয়াশরুম থেকে আসছি।’
রিয়াজের অপেক্ষায় থেকে থেকে দেখছিলাম, সময় গড়িয়ে যাবার সাথে সাথে মেলাপ্রাঙ্গনে বেড়েছে দর্শক ও ক্রেতার ভিড়। সেমিনার, সংগীতানুষ্ঠানেও যোগ দিচ্ছে মেলায় আসা অনেকেই। কিছু কিছু স্টলে লেখকগণ পরস্পর মত বিনিময় করছেন। দেখে মনে হচ্ছে , গত কয়েকবছরের তুলনায় স্টলের পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে। বইয়ের কাছে এলেই কেন যেন মন শান্তি খুঁজে পায়। রাশি রাশি বইয়ের ভাঁজে শান্তি বড় স্বস্তিতে মুখ ডুবিয়ে থাকে। সেরকম পড়ুয়া না হলে ও বই বরাবরই ভীষণ প্রিয় আমার। বইমেলা শুরু হলেই মেলায় ছুটে আসার জন্য মনটা কেমন আঁকুপাঁকু করে। প্রতি বছরের এই সময়টাতে শরীরের খোলস ছেড়ে মনটা বুঝি উড়ে চলে আসে বাংলা একাডেমীর চত্বরে। নতুন বইয়ের ভাঁজে নাক ডুবিয়ে বুক ভরে গন্ধ নিতে চায় মন।
এখানে প্রায় দুই ঘন্টা পেরিয়ে গেছে, রিয়াজের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি, তবুও ও আসছে না। মোবাইলে ফোন করেছি কয়েকবার, সুইচড অফ। হয়তো নেটওয়ার্ক পাচ্ছে না, না কি সত্যিই মোবাইল বন্ধ, কী জানি? কী যে করি এখন! কোথায় খুঁজি ওকে? বিকেলের নরম আলোয় বইমেলার মাঠে দাঁড়িয়ে থেকে এসবই ভাবছিলাম আর আমার অনুসন্ধিৎসু চোখ দুটি চারপাশ ঘুরে ঘুরে খুঁজছিল ওকে।

রিয়াজের সাথে সম্পর্কের পর থেকে প্রতি বইমেলাতে দু’জনে একসাথে আসতাম। ও পাঞ্জাবি আর আমি শাড়ি পরতাম। লম্বা খোলা চুল আমার ফাগুন হাওয়ায় উড়ত। কপালে থাকতো টিপ আর হাতে কাঁচের চুড়ি। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে মুগ্ধ চোখে বারবার তাকিয়ে দেখত আমায়। মুচকি হেসে ওর দিকে তাকিয়েই আবার সেই হাসি লুকাতাম। তারপর পুরো মেলা ঘুরে, পায়ের দফারফা করে, ওর পছন্দের বইগুলোকে সাথে নিয়ে তবেই দু’জনে বাড়ি ফিরতাম, ঠিক সন্ধ্যেবেলায়।

সাহিত্যের প্রতি রিয়াজের ছিল গভীর ভালোবাসা । খুব ভালো লিখত সে। গল্প, কবিতা দুটোই। সেই কলেজ জীবনেই ওর সাথে পরিচয় হয়। আর তখন থেকেই ওকে আমার ভালো লাগত। সেই সময়ের যত কথা, যত ব্যথা, সবই ছিলো ওকে ঘিরে। সে ছিল আমার দিনের শুরুর প্রার্থনায়, ছিল রাত্রি যাপনের ভাবনায়। ওকে ভাবতে ভালো লাগত কিন্তু কেন ভালো লাগত এই প্রশ্নের মুখোমুখি হইনি কখনো। কী হতো নিজেকে অযাচিত প্রশ্নের সম্মুখীন করে? তাকে দেখতে না পেলে মনের যে অস্থিরতা, তার গলার স্বর না শুনলে যে আকুলতা তৈরী হতো হৃদয়ে তা থেকে নিজেকে ফিরাব কী করে? কেন ভালো লাগে আর কী করা উচিৎ এই দোলাচলে দুলতে দুলতে কখন যে কী হয়ে গেল, বুঝতেই পারিনি। একবার টি.এস.সিতে বসে গল্প করতে করতে বলেছিল, জীবনে সে আলোকিত মানুষ হতে চায়। নিজেকে, নিজের স্বপ্নকে ছড়িয়ে দিতে চায় মানুষের মাঝে।

তারপর হঠাৎ একদিন তার লেখা কবিতা ছাপা হয় জাতীয় দৈনিকে। সেদিন যে ও কী খুশি হয়েছিল! আমার মনে হয় সেই অনুভূতি কোনো শব্দ বা উপমা দিয়ে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তারপর থেকে আর ও থেমে থাকেনি। একের পর এক ওর লেখা গল্প ছাপা হতে থাকে দেশের জাতীয় দৈনিকগুলোতে। ধীরে ধীরে রিয়াজের নাম ছড়িয়ে পড়ে সাহিত্যানুরাগীদের কাছে। স্বপ্ন দেখে সে, একদিন দেশসেরা সাহিত্যিক হবে। শুনে ভীষণ খুশি হয়েছিলাম। ওর প্রথম পান্ডুলিপিরও প্রথম পাঠক ছিলাম আমি। আর সেই পান্ডুলিপিই আজ বই আকারে মেলায় এসেছে। কিন্তু রিয়াজ আজ আর মেলায় নিয়ে আসেনি আমায়। বাসা থেকে যখন ও বেরিয়েছে, ভেবেছিলাম নিচে যাচ্ছে, হয়তো সিগেরেট ফুরিয়ে গেছে সেটা কিনবে। ফিরতে দেরী হওয়ায় ফোন দিয়ে জানলাম ও বইমেলায় আছে। শুনার সাথে সাথেই ছুটে আসি। মেলায় আজ প্রথম ওর বই এসেছে, যত মান অভিমানই থাকুক না কেন আমি কি না এসে পারি?

মেলায় ঢুকে তার স্টলের দিকে এগিয়ে আসতেই চোখে পড়ে, রিয়াজকে ঘিরে তার কয়েকজন পাঠক দাঁড়িয়ে রয়েছে। সে তাদের অটোগ্রাফ দিল, একসাথে সেলফি তুলল। তখন দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম ওর আনন্দে ঝলমলে মুখ।
কিন্তু এখন কোথায় যে গেলো মানুষটা? কতক্ষণ আর একটা স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে উৎকন্ঠা নিয়ে বইয়ের পাতা উল্টানো যায়! তাছাড়া এই জায়গা থেকে সরে অন্য কোথাও ওকে খুঁজতে গেলে এখানেই যদি আবার সে আসে আর আমায় না পায়, তবে তো আরও রাগ করবে। কী যে করি! ওর মোবাইলেও কানেক্ট করতে পারছি না। হতে পারে চার্জ ফুরিয়ে গেছে। আর যদি তাই হয়, তাহলে তো আমার সাথে যোগাযোগও করতে পারবে না। কী করি এখন? কীভাবে খুঁজে পাই ওকে!
এমন উৎকন্ঠার মধ্য দিয়ে হঠাৎ মনে হলো, গতরাতের ঝগড়ার শাস্তিই হয়তো দিচ্ছে আমাকে। কিন্তু কোনোভাবেই বুঝে উঠতে পারছি না, কি দোষ ছিলো আমার? ফেসবুকে ওর বন্ধু তালিকায় থাকা একটা মেয়েকে নিয়ে দু’ একটা প্রশ্ন করতেই ও ক্ষেপে যায়। তারপর চিৎকার, চেঁচামেচি করে বাড়ি মাথায় তুলল। আমি বুঝি, ও ভালো লিখে আর তাই তার কিছু ভক্ত, শুভাকাঙ্খী থাকাটাই খুব স্বাভাবিক। কিন্তু তাকে কেন যেচে যেচে মেয়েটার সব পোস্টেই দীর্ঘ মন্তব্য করতে হবে? মেয়েটাও রিয়াজের সব পোস্টেই প্রায় হাফ পৃষ্ঠার মতো লম্বা কমেন্ট করে। গতকালকের ঝগড়ার সূত্রপাত ওই মন্তব্যকে ঘিরেই। মেয়েটার একটা পোস্টে রিয়াজকে কমেন্ট করতে দেখেই খুব রাগ হয়েছিল। আর তা নিয়ে জিজ্ঞেস করতেই সে ক্ষেপে যায়। উচ্চস্বরে বলে, ‘কোথায় কী লিখবো, কতটুকু লিখবো, তোমার কাছ থেকে শিখতে হবে? তোমার অনুমতি নিয়ে লিখতে হবে?’
প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গিয়ে অসহায়ের মতো জানতে চাইলাম, ‘ফেসবুকের একটা অচেনা, অজানা মেয়ের সাথে ভিডিও কলে কথা বলাটা কি ঠিক?’
‘অচেনা? অজানা? আরে এরকম করে ভাবলে তো পৃথিবীর সবাই অচেনা । তাহলে তো কারো সাথেই কথা বলা যাবে না। শুনো, এ নিয়ে তোমার সাথে কোনো কথা বলতে চাই না। পড়াশুনা জানা শিক্ষিত মেয়ে তুমি, অন্যের ব্যক্তিগত বিষয়ে কানের কছে ঘ্যানঘ্যান করো না তো! আর একটা কথা তোমাকে পরিস্কার জানিয়ে দেই, এসব সহ্য করে থাকতে পারলে থাক, না পারলে বাসা থেকে বেরিয়ে যাও। দরজা খোলাই আছে।’
ওর কথা শুনে এতদিনের চেনা মানুষকে মুহুর্তেই কেমন অচেনা লেগেছিল। ওর আচরণে ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল হৃদয়। তারপরও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছি। কোনো প্রতিউত্তর না করেই ওর রুম থেকে বেরিয়ে অন্য ঘরের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই। বাতাসের দোলায় তখন বাড়ির জানালাগুলো থেমে থেমে কেঁপে উঠছিল। রাস্তায় তখন ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলোর নিচে ছোট ছোট বৃষ্টির ফোঁটাগুলো ঝরছে । পথে কোনো পথিক নেই। কোলাহলহীন নিশ্চুপ শহর। হঠাৎ পাশের বাড়ি থেকে ভেসে আসে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সেই গানটি –
এই রাত তোমার আমার/ ওই চাঁদ তোমার আমার/ শুধু দু’জনের। কী মিষ্টি প্রেমের গান। জমাট ভালোবাসায় পূর্ণ। যে গান হারিয়ে যাওয়া মুহুর্তকে স্মরণ করিয়ে দেয়, নতুনভাবে রাঙায় জীবনের কিছু সময় । হয়তো তাই সেই সময়টায় খুব মনে পড়ছিলো রিয়াজকে। রিয়াজের সাথে কাটানো নিকট অতীতের সুন্দর কিছু মুহুর্তকে ভেবে মনে হলো- রিয়াজ তো লেখক, বহু নারী-পুরুষের সাথে ওর যোগাযোগ থাকবে, এটাইতো স্বাভাবিক। এই সবকিছু মেনে নেয়ার ইচ্ছে থেকেই তো ওকে চেয়েছিলাম, আমার জীবনজুড়ে। ভালোবেসেছিলাম ওর লেখকস্বত্তাকে। জীবনসঙ্গীও করেছিলাম। না, না, আমারি ঠিক হয়নি, ফেসবুককে কেন্দ্র করে তুচ্ছ বিষয়ে কথা বলে নিজেদের মধ্যে সমস্যা তৈরী করা।
তারপর আবার নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করি, নিশ্চুপ, নীরব রাতের আঁধারকে গায়ে জড়িয়ে। ও এতো কিছু বোঝে, গল্প, কবিতা লিখে আর ভালোবাসার মানুষকে বোঝে না? বোঝে না ওকে ভালোবাসি বলেইতো ওর সাথে অন্য কোনো নারীর সখ্যতাকে সহজভাবে মেনে নিতে পারি না। আর যদি ওকে ভুলও বুঝে থাকি ও কি পারত না আমার ভুল ভাঙাতে, চিৎকার চেঁচামেচি করলেই কি সব ঠিক হয়ে যায়? না কি ভালোবাসি, ভালোবাসি বললেই বোঝানো যায়, কতটা ক্ষত বিক্ষত হয় হৃদয়, তারই অবহেলায়?
ভালোবাসা তো তাই, যা নিরবধি বয়ে যায়, কিন্তুু নদীর ঢেউয়ের মত ছলাৎ ছলাৎ শব্দ তোলে না। বৈশাখের দাবদাহ রৌদ্রের মত তার উত্তাপ নেই। কিংবা কালবৈশাখী ঝড়ের তান্ডবে সব এলোমেলো করে দেবার ভয় নেই। থাকে শুধুই নির্ভরতার একজন মানুষ।

মেলার মাঠে স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে আনমনে কথাগুলো ভাবতেই ভাবতেই হঠাৎ বুকের ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে। গাড়িতে আসতে আসতে আজ কত কী ভেবে রেখেছিলাম, ফেলে আসা বইমেলার দিনগুলোর মতো আজও আমি আর রিয়াজ একসাথে পথ চলব, কত কত গল্প থাকবে সময়ের শরীরজুড়ে, কত আনন্দ ভাগ করে নিব বলেইতো এসেছি। অথচ সব অসার এখন!

গতকালের ঘটনার জন্য নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে। আমার এই একলা দাঁড়িয়ে থাকা, ওর জন্য এত এত অপেক্ষা, সবকিছু নষ্ট হবে , যদি ওর অভিমান না ভাঙে। আজকের দিনের কোনো সুখস্মৃতিই তোলা থাকবে না আগামীর জন্যে।

‘ম্যাডাম কোন বইটা দিব?’ আমার ঠিক উল্টোপাশে দাঁড়িয়ে থেকে জানতে চাইলেন বিক্রয়কর্মী ছেলেটি।
 মৃদু হেসে উত্তর দিলাম, ‘বলছি।’
‘শিউর ম্যাম।’

বিক্রয়কর্মীর সাথে কথা শেষ করে স্টলের সামনের দিকে সাজানো বইগুলো থেকে একটি বই হাতে নিয়ে তার পাতা উল্টাতে উল্টাতে মন আবার ফিরে যায় পুরনো ভাবনায়! ভাবি-শুধু নিজেকে কেন দোষারোপ করছি? কেন ভাবছি, অভিমান করে আমাকে শাস্তি দিতেই রিয়াজ এমন করছে। হতেও তো পারে ওর কোনো বিপদ হয়েছে। কিছুদিন আগেই তো, বইমেলা চলার সময় পুলিশের সামনেই একজন লেখককে কুপিয়ে মেরে ফেলা হলো! এদেশে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। তাছাড়া এমনটা যে ঘটছে না, তা তো নয়। ঘটছে তো। কে যে কখন – কাকে- কেন ধরে নিয়ে যাচ্ছে কে জানে! তারপর কোনো খোঁজই মেলে না। আর এর রহস্যও অজানাই থেকে যায় সাধারণ জনমানুষের কাছে। কিন্তু ওকে নিয়ে খারাপ কিছু ভাবতে আমার মন সায় দেয় না। গলা শুকিয়ে আসে। ভয় হয়। ভীষণ ভয় হয়!

বেশ কিছুটা সময় পর আগের স্টল থেকে বেরিয়ে আশেপাশের কয়েকটা স্টল ঘুরে দেখেছি, দৃষ্টি যতদূর যায় ততদূর ওকে খুঁজেছি। পাইনি। ভাবছি- মানুষটা গেলো কোথায়? তবে কি ও বাসায় ফিরে গেছে ? আমাকে না জানিয়েই? হতেও পারে। হয়তো এখনও রাগ কমেনি।

বিষন্ন সন্ধ্যাটা আরও গাঢ় হতে লাগলো। মেলায় আসা অনেকেই বেরিয়ে যাচ্ছে । আর তাই বইমেলা প্রাঙ্গনে মানুষের ভিড় খানিকটা কমে এসেছে। না আর অপেক্ষা করা ঠিক হবে না, এখনি বাসায় ফিরতে হবে , নিশ্চিত হতে হবে, ও কোথায় আছে, কেমন আছে ! এসব ভেবে তখনি মেলা থেকে বেরিয়ে একটা সি.এন.জি তে উঠে পড়লাম। তখনও দুশ্চিন্তা হচ্ছিল খুব। আমায় বহনকারী সি.এন.জি টি ছুটে চলেছে দ্রুতগতিতে। আশেপাশের গাড়ির হর্ণের শব্দ একনাগারে কানে বাজছে। পথে চলতে চলতে হঠাৎ গাড়ির গতি কমে আসে, তারপর ধীরে থেমে যায়। সামনে থেকে সি.এন. জি চালক বলছে, ‘হুদাই জ্যাম লাইগ্যা রইছে। আরেকটু আওগুয়াইলে দেহা যাইবো কোনো কারণ ছাড়াই এই জ্যামডা লাইগা রইছে। হইবার পারে দুই একটা বড় গাড়ি প্যাসেঞ্জার তুলবার লাইগা খাড়াইয়া রইছে।’ আমি পিছনের সিটে বসে থাকি নিশ্চুপ। পৃথিবীর সকল নীরবতা যেন আমাকেই ঘিরে আছে তখন। চালকের কথায় বিরক্ত হলেও তাকে কিছু বলতে ইচ্ছে করে না। দুশ্চিন্তায় আমার গলা শুকিয়ে আসে। আচমকা টের পেলাম, গাল বেয়ে ঝরে পড়ছে চোখের জল। সেই জল হাতের উল্টোপাশ দিয়ে মুছতে গিয়েই দেখেছি, কাজল মিশে গেছে চোখের নোনাজলে।

যখন বাড়ি ফিরলাম তখন সন্ধ্যার শরীরজুড়ে রাত্রির ভরাডুবি। কলিং বেল বাজাতেই দরজা খুলে দিলো রিয়াজ। ওকে দেখেই খুব রাগ হলো। ভেবেছিলাম জানতে চাইব, কেন আমায় একা ফেলে চলে এলে? পরে মনে হল, থাক- এ নিয়ে অন্য কোনো সময় কথা বলা যাবে। ও ভালো আছে, এই বা কম কী।

বসার ঘর পেরিয়ে সে চলে গেল শোবার ঘরে। খাটের এককোণে বসে টিভিতে ইউ.টিউব ছেড়ে গান শুনছিল বিভোর হয়ে। ‘দু’চোখে ওই আলতো হাসি/ চিলতে রোদের আদরে/ নিঝঝুম দুপুর স্বপ্ন সাজায়/ নেশা- নেশা বাসরে।’ এই গানটি আমারও খুব প্রিয়। সেই ছোটবেলায় আমার পরিবার আর রিয়াজের পরিবার যখন পাশাপাশি থাকতাম, তখন আমার বাসায় গানটি বাজালেই রিয়াজও তার বাসা থেকে ওই একই গান বাজাতো। বুঝতাম, আমাকে শুনানোর জন্যই ও এসব করত। বুঝাতে চাইত, ওর প্রেম, ওর ভালোবাসা মানে এই আমিই। কত কত স্মৃতি সেই সময়কে ঘিরে! দুপুরের তপ্ত রোদে আমার কলেজ থেকে ফেরার অপেক্ষায় রাস্তার পাশে রিয়াজের দাঁড়িয়ে থাকা। বিকেলে ফুল গাছে পানি দেবার নাম করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমায় দেখা। সন্ধ্যায় ইলেকট্রিসিটি চলে গেলে বাবা-মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে ছাদে উঠে ওর সাথে গল্প করা আরও কত কী! তখন ওর ভাবনা জুড়ে শুধুই আমি, কখনও ওর উপর অভিমান হলে কিংবা কোনো আচরণে কষ্ট পেলে বারবার সরি বলত। অপরাধ না থাকলেও স্বেচ্ছায় দোষ স্বীকার করে আমার অভিমান ভাঙাত।
আর এখন ওকে দেখি আর ভাবি- এভাবে বদলে গেল কেন ও? তবে কী যে প্রেম পূর্ণতা পায় বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে সে প্রেম ধীরে মুছে যায়? ফুরিয়ে যায়? যদি তাই না হয় তবে কেন আমায় বোঝে না ও? কেন অকারণেই কষ্ট দেয়? অভিমান পুষে রাখে মনজুড়ে। এই প্রশ্নগুলো মনের দরজায় বারবার আঘাত হানলেও মুখে কিছু বলা হয় না।
বুকের ভেতরটা হাহাকার করে। কী যেন মন বলে অতৃপ্তির নীরব চিৎকারে। শুধুই ফিসফিস করি নিজের সাথেই।
এসব ভাবতে ভাবতে মাথাটা খুব ধরে এলো। তাছাড়া জার্নির পর ক্লান্তও লাগছিল। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিলাম। রিয়াজের মনোযোগ তখনো টিভির স্ক্রিণের দিকে। আমি ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবার অন্য পাশ ফিরে শুয়ে থাকি। কিন্তু আমার এই তাকিয়ে থাকা বা পরবর্তীতে অন্য পাশ ফিরে শুয়ে থাকা সবকিছুই ওর চোখ এড়িয়ে যায়! কিংবা ইচ্ছে করেই এড়িয়ে গেছে সে। তারপর বালিশের পাশে রাখা মোবাইলটা হাতে নিয়ে ফেসবুক স্ক্রল করতে করতে যা দেখলাম, তাতে আমূল কেঁপে উঠেছি। তখন হাতের কাছে ছুরি বা কাঁটাচামচ যাই থাকুক না কেন তাই দিয়ে নিজের দৃষ্টিকে চিরকালের মত অকার্যকর করার তীব্র মনোভাবের মধ্যে কতটা যে স্বাভাবিকতা থাকে তাও অনুভব করতে পেরেছিলাম মুহুর্তের মধ্যেই।

সুন্দরী এক নারী কবির সাথে আমার মানুষটির যুগল ছবি। সেদিন সেই নারীও প্রথম তাঁর কবিতার বইখানি ছুঁয়ে দেখেছিলো। সৌভাগ্যক্রমে ফেসবুকের বন্ধু তালিকায় সেই নারী আমার সাথে যুক্ত থাকায় এইসব কিছু খুব সহজেই দেখতে পেলাম। বলে রাখা ভালো, গতকাল রাতে যে নারীকে নিয়ে রিয়াজ আমায় অপমাণ করেছিল, এই নারীটিই সেই নারী। আর সেই নারীই লিখেছেন , ‘জীবনের এই বিশেষ দিনে আমার বন্ধু, শুভাকাঙ্খী, বিশিষ্ট লেখক, অনুপ্রেরণাকারীকে সাথে পেয়ে আজ আমার জীবন ধন্য হলো। তার সাথে অনেকটা সময় কাটালাম, কথা হলো নানা বিষয়ে। তার কথাগুলো আমার কাছে অনেক দামি। সে আমার মনের খোরাক।’
লেখাটি পড়তে পড়তে আমার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো। মাথা ঝিমঝিম করছিলো। শ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসছিলো। অনেক কিছু বলতে চাইছি অথচ কী বলবো গুছিয়ে উঠতে পারছি না। কিছু সময় পর নিজেকে খানিকটা সামলে নিয়ে মোবাইলের স্ক্রিণ অফ করে শোয়া থেকে উঠে বসলাম। শাস্তস্বরে রিয়াজের কাছে জানতে চাইলাম, মেলায় আজ তুমি শ্যমলীর সাথে ছিলে?
সে নিঃসঙ্কোচে জবাব দিলো , ‘হ্যাঁ।’ আরও জানতে চাইল, ‘কেন, তাতে তোমার সমস্যা কী? আর অন্যের ব্যাপারে এতো ইন্টাফেয়ার কর কেন তুমি? সমস্যা কি শুনি?’
ওর প্রশ্নের উত্তরে কিছুই বলিনি আমি। নিশ্চুপ ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসলাম। বুঝলাম, রিয়াজ আলোকিত মানুষ হয়ে উঠছে। সেখানে আমার মতো অন্ধকারে থাকা মানুষের কোনো অস্তিত্ব নেই…।

******************************