“দ্বিতীয় বিয়ের পূর্ব পর্যন্ত তালাকপ্রাপ্তাকে ভরণপোষণ দিতে হবে”
-বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী
সাক্ষাৎকার: লোপা মমতাজ
জন্ম, বেড়ে ওঠা রাজশাহীতে। আইন পেশাও শুরু করেছেন রাজশাহী থেকেই। অ্যাডভোকেট হিসেবে ফৌজদারি মামলায় তাঁর ছিল ব্যাপক খ্যাতি। রাজশাহী থেকে চলে আসেন ঢাকায়। তাঁর খ্যাতি আরো বিস্তৃত হয়। এরপর নিয়োগ পান বিচারপতি হিসেবে। সর্বশেষ ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি।
মুসলমি ব্যক্তিক আইনের বেশ কিছু সময়পযোগী ব্যাখ্যা এসছেে বিচারপতি রাব্বানীর দেয়া কয়কেটি রায়। তবে তার দুটি রায় বাংলাদশেরে বাইরওে আলোড়ন সৃষ্টি করছেলিো। এদরে একটি রায় হচ্ছে যে, একজন স্বামী তার স্ত্রীকে তালাক দিলে তাকে ততোদিন উপযুক্ত ভরণপোষন দিতে বাধ্য থাকবেন যতদনি না তালাকপ্রাপ্তা পুর্নববিাহ করবেন। যদিও রায়টি আপলি বিভাগ র্কতৃক বাতিল হয়। অপরটি হচ্ছে ফতোয়া প্রদান প্রসঙ্গে ঐতহিাসকি রায়, যেখানে বিচারপতি রাব্বানী এই সিদ্ধান্ত দেন যে, আদালত ছাড়া কোনো ব্যক্তি মুসলমি আইনের ব্যাখ্যা কিংবা সিদ্ধান্ত দেয়ার অধিকারী নন। এই মামলাটিও এখন আপলি বিভাগের বিবেচনাধীন আছে।
একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির উপদেষ্টা হিসেব কাজ করছেন তিনি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে খোলাখুলভিাবে বভিন্নি লখোলখেতিে ব্যক্ত করেছনে নিজস্ব মতামত। বিভিন্ন বিষয়ে যুদ্ধাপরাধীদের চালানো প্রপাগান্ডার জবাব দিয়েছেন তথ্য ও তত্ত্ব দিয়ে। যুদ্ধাপরাধীদের ষড়যন্ত্র এবং লবিং গ্রুপিংকে ব্যর্থ করে নিয়োগপ্রাপ্ত আইনজীবীরা বিজয় ছিনিয়ে এনে শহীদদের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা প্রকাশ করবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। মত প্রকাশ করেছেন মৃত্যুদন্ডের বিধানের যৌক্তিকতা নিয়েও।
বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানীর সাথে আলাপচারতিায় ছিলেন লেখক লোপা মমতাজ।
………………………………………………………………………………………………………………………………………
লোপা মমতাজ : যার কলমের অনুমতিতে একজন মানুষ ফাঁসির কাষ্ঠে ঝোলে, হয়তোবা সেখান থেকে ফিরেও আসে, সেই কলমের লেখককে আমরা বলি বিচারপতি। এই রকম একটি পেশায় একজন গোলাম রাব্বানী কেন এলেন?
গোলাম রাব্বানী : আমার ইচ্ছা ছিল অধ্যাপক হওয়ার। আমি যখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি পাবনা জেলা স্কুলে তখন রাষ্ট্রভাষা নিয়ে আন্দোলন হয়। আমরা স্কুলের ছেলেরা, কলেজের ছেলেরা মিলে মিছিলে যাই। তখন মুসলিম লীগের একজন মেম্বার আমাদের স্কুলে এসে বক্তৃতায় বলেন যে, ‘তোমরা এত যদি রাষ্ট্রভাষা নিয়ে আন্দোলন করো তাহলে জিন্নাহ সাহেব পূর্ববঙ্গকে ভারতের সাথে দিয়ে দেবে। তার বদলে কাশ্মির নিয়ে নেবে।’ আমার তখনি মাথা চমকে উঠলো। এ কী ব্যাপার। একটা দেশকে একটা লোক বিক্রি করে দেবে? জনগণের কোন দাম নাই? তখন আমি ঠিক করলাম অধ্যাপক হবো না, আমি রাজনীতিবিদ হবো। তারপর থেকে আমি যখন বরিশালে, আব্বা তখন বরিশাল জেলা স্কুলের হেডমাস্টার। তখন আমি ছাত্রলীগের জেলা সেক্রেটারি ছিলাম, নির্মল সেন হলেন প্রেসিডেন্ট। ওই সময় নুরুল আমিন এসেছিলেন। ৫৪ সালের নির্বাচনের সময় ছিল সেটা। কিন্তু আমরা তাকে সভা করতে দেইনি। তার ফলে মারামারি হয় এবং একটা মুসলিম লীগের গুন্ডা মারা যায়। তাতে আমাকে একটা মার্ডার কেসে দিয়ে জেলে ঢোকায়। ফলে ওখানে আমার একবছর নষ্ট হয়। তারপর আব্বা যখন ময়মনসিংহ টিচার্স ট্রেনিং কলেজের প্রফেসর তখন আমি ময়মনসিংহ কলেজে বিএসসি পড়ছি। আমার নামে ওয়ারেন্ট বের হয় তখন। আমাকে পালিয়ে যেতে হয়। বিএসসি’র আরেক বছর নষ্ট হয়। এভাবে শিক্ষাজীবন ব্যাহত হওয়ায় লোকে বলে, যার নাই গতি সে করে ওকালতি। আমি কিন্তু ওসব না ভেবে সোজাসুজি ওকালতির জীবনই বেছে নিয়েছিলাম।
লোপা : সার্থক মানুষের অতীত নিয়ে কিন্তু আমার বেশ কৌতূহল, তাই একটু শৈশবে ফিরে যেতে যাই, সে সময়ের একটা ঘটনার কথা বলুন না, যা আজো আপনাকে খুব আলোড়িত করে।
রাব্বানী : আমরা তখন হুগলিতে থাকি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলছে। জাপানি বোমার আতঙ্ক তখন হুগলির দিকে ছিল প্রবল। মৌমাছির মতো একটানা বো শব্দ হতো যুদ্ধ বিমানের। আর তখন সাইরেন বাজতো। বুক কাঁপতো আমাদের। সরকার স্কুল, কলেজ ছুটি দিচ্ছিলো না প্যানিক তৈরি হবে বলে। একদিন আব্বা বললেন, আমাদেরকে গ্রামের বাড়িতে রেখে আসবেন। আমরাও রওয়ানা দিলাম বগুড়া জেলায়। নৌহাটি থেকে ট্রেনে যাচ্ছি। দেখা গেল একই ট্রেনে যাত্রীদের সঙ্গে মার্কিন সৈন্য যারা বার্মা ফ্রন্টে যাবে তারাও আছে। সব ছোকরা ছোকরা, অল্পবয়সী সৈন্য। ড্রেস পরে, রাইফেল নিয়ে, পিছনে স্যাক পরে, একেবারে যুদ্ধ বেশে যাচ্ছে। তাদের একজনের হাতে একটা পিঁপড়া এসে পড়লো। আব্বা বসে ছিলেন ওই সৈন্যটির পাশে। সে আব্বাকে জিজ্ঞেস করলো, এ্যান্ট এর বাংলা কি। আব্বা বললেন, পিঁপড়া। অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করলো সে, কিন্তু পিঁপড়া বলতে পারলো না। তারপর হেসে পিঁপড়াটাকে আস্তে করে নামিয়ে দিলো মেঝেতে। আমি অবাক হয়ে গেলাম লোকটার আচরণে। যুদ্ধের মাঠে খুনোখুনির মধ্যে যাচ্ছে অস্ত্র হাতে অথচ একটা পিঁপড়াকে সে টিপে মারতে পারলো না। মানুষ আসলে মনের দিক থেকে কখনো হিংস্র হয় না। হিংস্র করে কতগুলো বিশ্বপুঁজির লোক, যারা চায় যুদ্ধ করে লাভবান হতে।
আরো একটা ঘটনা, আব্বা তখন বরিশাল জেলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন সময়টা ১৯৫১ থেকে ১৯৫৪ সাল। সে সময়টা ছিলো মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্রদের আন্দোলন প্রবল সময়। মুসলিম লীগ সরকারের টালমাটাল আবস্থা। তারই পরিণতিতে নির্বাচনে সরকারি দলের চরম পরাজয় ঘটে। সে সময় জেলা পুলিশ কর্মকর্তা আব্বার কাছে আন্দোলনকারী ছাত্রদের নাম চাওয়ায় তিনি খুব সহজমুখ করে অথচ দৃঢ স্বরে বলেছিলেন- ‘ছাত্ররা মেষপালক। আমি তাদের রাখাল। কি করে আমি তাদের নেকড়ের হাতে তুলে দেবো।’
আরেকটা ঘটনা আব্বা তখন রাজশাহী শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজের অধ্যক্ষ। সে সময় প্রাদেশিক গভর্নর মোনায়েম খান রাজশাহী আসায় তাঁর সম্বর্ধনা সভার জন্য জেলা প্রশাসক আব্বার কাছে কলেজের চেয়ারগুলি চেয়ে চিঠি দেন। তার উত্তরে আব্বা জানালেন চেয়ারগুলি দেয়া সম্ভব নয়। এবং তিনি সম্বর্ধনা সভায় যাননি। মোনায়েম খান ঢাকায় ফিরেই আব্বাকে পদাবনতি করে কুমিল্লা শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজের উপ-অধ্যক্ষ পদ দিয়ে টেলিগ্রাফ মারফত বদলী করে দিলেন। আব্বাকে কুমিল্লা কলেজের ছাত্রাবাসে একা থাকতে হলো। তাঁর এক বছর পর অধ্যক্ষ হিসেবে আব্বা ফিরে আসলেন।
লোপা : আচ্ছা এই যে দীর্ঘ জার্নি আপনার, সেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, বাংলার মুক্তিযুদ্ধ, দূর্ভিক্ষ আরো কতো ঘটনা দূর্ঘটনার সাক্ষী আপনি। সেইসব অভিজ্ঞতা থেকে এমন একটা বিষয়ের বা দৃশ্যের কথা বলুন, যা খুব ছোটোবেলায় যেমনটি দেখেছেন বড়বেলাতেও তেমনটিই আছে।
রাব্বানী : আমরা তখন দিনাজপুরে থাকি। আমরা যে বাড়িতে থাকতাম, এখনও মনে আছে আমি সেই বাড়ির গেটের কাছে দাঁড়িয়ে প্রায়ই দেখতাম একপাল ফকির যাচ্ছে। কেউ ল্যাংড়া, কেউ বা চার চাকার গাড়িতে, তাদের ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে অন্যরা এবং তারা গান করছে আল্লা হু আল্লা হু আল্লা…। এই সত্তর বছর বয়সে এসে গুলশানের বাড়ির দোতলায় আমার পড়ার টেবিলের পাশের জানালা দিয়ে ওই একই ডাক এখন শুনছি, আল্লা হু আল্লা হু আল্লা…। ছোটবেলায় শোনা সেই ডাক! এই যে আমি সত্তর বছর বা ষাট বছর পেরিয়ে এলাম, ছোটবেলায় দেখা বাঙালিদের সেই দারিদ্র আজও যায়নি! চোখের দেখা বাংলার এই চেনা মুখ এখনো একই রকম রয়ে গেছে!
লোপা : এতো একটি চরম সত্য উপলব্ধি। কিন্তু এই উন্নয়নশীল দেশে যখন আপনার নামের সঙ্গে আজীবনের জন্য উকিল এবং পরবর্তীতে বিচারপতি শব্দটি যুক্ত হয়ে গেলো, তখন?
রাব্বানী : দুঃখবোধ বলা যায়। আমি এক সাঁওতালের কেস করছিলাম। আপনি তো জানেন, সাঁওতালরা খুব সত্যবাদী হয়। সেই সাঁওতালকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, তোমার জমি দখলে আছে? ও বললো, হ্যাঁ বাবু, আমার দখলে আছে। তখন আমি কেসটা ‘জমি দখলে আছে’ এভাবে সাজাতে গিয়ে লিখলাম, অন্য পক্ষ আমাকে দখল থেকে তাড়ানোর জন্য হুমকি দিচ্ছে। কাজেই আমি একটা বিজ্ঞাপনী ডিক্রি চাই যে সম্পত্তি আমার দখলে। ও যখন সাক্ষী দিতে উঠলো তখন বিবাদি পক্ষের উকিল যখন জিজ্ঞেস করছে, আপনার জমি কি দখলে আছে? ও বললো, নাই বাবু। তাহলে তো এখন আর মামলা চলে না। তার পরের দিন ঠিক হলো যে বিবাদি পক্ষের সাক্ষী হবে। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম যে, কি ব্যাপার, তুমি বললে যে জমি তোমার দখলে নাই? অথচ তুমি আগে বলেছ দখলে আছে। ও বললো, বাবু, এখনতো জমিতে পানি, সেজন্য বলেছি যে দখলে নাই। কিন্তু কেসটা তো আর সে অর্থে যাবে না। আমি তখন খুব খাটাখাটনি করলাম। প্রিভি কাউন্সিলের একটা রুলিং পেলাম, যখন ন্যায্য মালিক, যদি অন্য কেউ জবরদখল করে থাকে কিন্তু এমন একটা পরিস্থিতি থাকে যখন সেটার দখল করা যায় না প্রত্যক্ষভাবে। তখন মূল মালিকের কাছে জমির দখলসত্ত্ব ফিরে যাবে। আইনটা দেখে আমি মামলাটা জিতলাম। সাঁওতালদের আরেকটা ঘটনা বলি। একদিন আমি বসে আছি। দেখি একজন সাঁওতাল ওই কোর্টে যাচ্ছে। যেয়ে জজ কোর্টের সামনে গিয়ে গড় দিয়ে একরকম নমস্কার করছে। যেরকম ওরা মন্দিরের সামনে করে। আমি ওকে ডেকে পরে বললাম, কি ব্যাপার, আপনি গড় করলেন কেনো? বলে, কেনো এখানে দেবতা থাকে, ধর্মের দেবতা, বিচারের দেবতা। এই যে সাঁওতালদের বিশ্বাস। এই বিশ্বাসটা যদি আমাদের অন্য সম্প্রদায়ের মনে থাকতো, তাহলে এত মামলা হতো না। এজন্য এ ঘটনা মনে পড়লে আমার দুঃখ পায় যে হাজার হাজার মামলা মিথ্যা হয়, জানে মিথ্যা, তাও করবে।
লোপা : এ প্রসঙ্গে একটু জানতে চাই, আমাদের প্রচলিত ধারণা থেকেই; বিচারপতিরা খুব কঠিন মনের হয় বা লৌহমানব, যে কিনা সাদা কাগজে খস খস করে লিখে দেয় ‘ক’ কে মৃত্যুদন্ড দেয়া হলো, ‘খ’ কে যাবৎজীবন কারাদন্ড… আসলেই কি তাই?
রাব্বানী : আমিতো কোনো লৌহমানব বিচারপতি পাইনি। আমরা হাসিখুশি করেছি, কথা বলেছি। বাইরে এমন ধারণা এ জন্যে যে, আমরা ফাঁসির রায় দেই। কিন্তু ফাঁসির রায় না দিয়ে তো উপায় নাই। একটা জিনিস আপনাকে বলি, আইনের কথা। ইংল্যান্ডে একবার একটা কমিশন হয়েছিল যে মৃত্যুদন্ড দেয়া যাবে কিনা। সেই কমিশনে তখনকার নামকরা বিচারপতিরা ছিলেন। আপনারা জানেন ওই বিচারপতিদের একজন ছিলেন লর্ড ডেলি, তিনি ইংল্যান্ডে প্রধান বিচারপতিও হয়েছিলেন। তিনি সাক্ষী দিলেন, না, মৃত্যুদন্ড দিতে হবে। তার যুক্তি ছিল, মৃত্যুদন্ডটা খালি অন্যকে হত্যা করতে নিরোধ করে না, বাধা দেয় শুধু সেটাও না। এটা হচ্ছে সমাজের ওই অপরাধের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ। কাজেই কঠোর হতে হয় ওই কারণে।
লোপা : আইন বলছে ঠিক কিন্তু মন বলছে ঠিক না, আপনি কোন পক্ষে ছিলেন? বিচারকের ভূমিকায় যখন ছিলেন তখন এমন কোনো রায়ের কথা কি মনে পড়ে?
রাব্বানী: ঢাকায় একবার তাঁতীবাজারের দিকে একটা রায়টের মতো পরিস্থিতি হয়েছিল। তাতে একটা ছেলে, সে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পক্ষেই ছিল। কিন্তু কোথা থেকে একটা রিভলবার জোগাড় করেছে। যার কোনো লাইসেন্স ছিল না। সে সেটা পকেটে নিয়ে ঘুরছে। পুলিশ যখন এসেছে। সে ভাবছে আমি তো দোষী না, দিব্যি দাঁড়িয়ে আছে। পুলিশ তারপর ধরেছে। ধরার পর তার কাছে পেয়েছে পিস্তলটা, লাইসেন্স নাই। তাকে নিয়ে তখন মামলা হয়েছে। মামলায় তার সাত বছর জেল হয়েছে। এই মামলাটা যখন আমার কোর্টে আসলো, আপনি দেখেন চিন্তা করে, ওর উদ্দেশ্য কিন্তু খারাপ ছিল না। পিস্তল পাওয়া গেছে, তাকে শাস্তি দেয়া উচিত। আমি তার এডভোকেট সাহেবকে বললাম যে, ওই সময়কার যতগুলো ঘটনা পত্রিকায় বের হয়েছে এগুলো আপনি একটা এফিডেফিট করে সংযুক্ত করে দিন। উনি সেটা দিলেন। তার উপর ভিত্তি করে আমি তাকে নির্দোষ বলে রায় দিয়ে দিলাম।
লোপা : আজকের এ পর্যায়ে এসে বিচারপতি গোলাম রব্বানীকে যদি নিজের সম্পর্কে নিজেকে মূল্যায়ণ করতে বলা হয়?
রাব্বানী : বিচারপতি হিসেবে এক অর্থে আমি ব্যর্থ। এজন্য ব্যর্থ যে, আমি তিনটা রায় দিয়েছিলাম। তার মধ্যে দুটো রায় আপিল বিভাগ বদলে দিয়েছে। আরেকটা আপিল বিভাগ স্থগিত রেখেছে। আজ পর্যন্ত শুনানি করেনি। প্রথমে আমি দিয়েছিলাম যে, কোনো মুসলমান যদি তার বউকে তালাক দেয় তাহলে যতক্ষণ পর্যন্ত না মেয়েটা দ্বিতীয় বিয়ে করছে তাকে ভরণপোষণ দিতে হবে। এটা কোরানের আয়াতে আছে কিন্তু কোরানের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে আপিল বিভাগের বিচারপতিরা আমার এ রায়টা বাতিল করে দিয়েছে। যদিও সম্প্রতি খবর পেলাম ইন্দোনেশিয়ার সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা আমার রায়টা উল্লেখ করে সেখানে এরকম রায় দিয়েছে এবং এটা করার পেছনে ছিল দুজন লোক। তখন যে জজ ছিলেন তিনি তখনকার বিচারপতি এ বিচারকার্যে যার বসা উচিত হয়নি। তিনি নিজে তার স্ত্রীকে তালাক দিয়েছিলেন। তিনি আমার এ রায় দ্বারা এফেকটেড হতেন। আর দ্বিতীয় জন ছিলেন একজন মৌলবাদি গোছের লোক। তারপর আমি আরেকটা রায় দিয়েছিলাম সেটা ছিল একটার বেশি বিয়ে করা যাবে না। জানেন তো আমাদের যে পারিবারিক আইন আছে সেখানে স্বামী দরখাস্ত দিয়ে অনুমতি নিয়ে একটার বেশি বিয়ে করতে পারে। আমি এ আইনটা বাতিল করে দিতে পরামর্শ দিয়েছিলাম। কিন্তু আপিল বিভাগ আমার সে পরামর্শ বাতিল করে দেয়। আমি হাই কোর্টে থাকার সময় শেষ যে রায়টা দেই আপিল বিভাগে যাওয়ার আগে সেটা হলো ফতোয়ার দেয়ার বিরুদ্ধে। আমি একজন বিচারপতি অথচ আমার বিরুদ্ধে পুরানা পল্টনে জনসভা করে বলা হলো, আমি মুরতাদ। তাতে সরকার এগিয়ে আসলো না নির্বাচনের ভয়ে। আমার জন্যে এর চেয়ে আর দুঃখের আর কি হতে পারে।
লোপা : একজন বিচারপতি এবং একজন লেখক এ দুয়ের মধ্যে কে বেশি টানে, কাকে আপনি বেছে নেন?
রাব্বানী : এখানে লেখক আর বিচারপতির মধ্যে কোনো তফাৎ নেই। একই বিষয়। এখন বলবেন, সেটা কি রকম? আমি যখন ওকালতি করতাম তখন যে আর্জিগুলো লিখতাম তার মধ্যে সাহিত্যের ভাব থাকত এবং আমাকে অনেকে বলে থাকে এ চর্চাটা তখন থেকে আমার হয়েছে। একটা আইনের ব্যাখ্যা দিয়ে আমি একটা আর্জি করছি, একটা প্রতিকার পাওয়ার জন্য। তারপর রায়ের কথা যদি বলেন তাহলে বলবো রায়ও কিন্তু কবিতার মতো। তা একরকমের সাহিত্যই। কাজেই বিচারপতি জীবনের থেকে অবসর পেয়ে আমার লেখাতে একইরকম ধারাই চলে আসছে।
লোপা : আপনার শৈশবের দুএকটা ঘটনা বলুন যা এখনো মনে দাগ কেটে আছে।
রাব্বানী : আমি তখব খুব ছোট। বারান্দায় আব্বার সাথে বসে অঙ্ক কষছিলাম। আব্বা বারান্দায় বসে পত্রিকা পড়ছিলেন। মা সম্ভবত রান্না ঘরে। পত্রিকা পড়তে পড়তে হঠাৎ আব্বা মাকে ডেকে এনে বললেন, খবর শোনো, দূর্ভিক্ষের সময় যে ত্রাণসামগ্রি দূর্গতদের দেয়া হয়েছে সরকার তা বিলি করতে যেয়ে তারচেয়ে বেশি খরচ করে ফেলেছে। এ নিয়ে আব্বা ভীষণ ক্ষেপে গিয়েছিলেন।
আরেকটা ঘটনা। সেবছর আমাদের স্কুলে নজরুল সাহায্য কমিটি গঠন করা হয়। সময়টা সম্ভবত ইংরেজ শাসনের শেষ দিকে অথবা তার আগের বছর হবে। স্কুলে চাঁদা আদায় করার জন্য আমরা দুই সপ্তাহ ব্যাপক খাটা-খাটনি করি। আমাদের যে কয়টা চাঁদার রশিদ দেয়া হয়েছিলো তার সবগুলো সম্পূর্ণ করি। চাঁদা আদায়ের সম্পূর্ণ টাকা আমাদের স্কুলের নজরুল সাহায্য কমিটির একজনের হাতে তুলে দেই। তার স্বাক্ষরই কিন্তু সেই রশিদ বইয়ের পাতায় ছিলো। অবাক ব্যাপার, তার কয়েকমাস পরে কমিটির অন্য কর্মকর্তার মাধ্যমে জানতে পারলাম, আমাদের আদায় করা টাকা কমিটি পায়নি! তারও অনেক পরে বই পড়ে জেনেছি আমাদের বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম অজ্ঞাত রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। প্রথমে ডা. বিধান চন্দ্র রায় তাঁর চিকিৎসা করেছেন। তারপর তাঁকে লুম্বিনী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিলো কিন্তু সেখানে তাঁর রোগটি কি তা চিকিৎসকগণ ধরতে পারছিলেন না। তারও অনেক পরে নজরুলকে লন্ডনে ও পরে ভিয়েনায় নেয়া হয়। সেখানে জানা যায় নজরুল পিকস ডিজিস অর্থাৎ মস্তিস্ক রোগে ভুগছিলেন। কিন্তু তখন আর কিছু করার ছিলো না। ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। আর কবির প্রাথমিক চিকিৎসাও অপ্রমিত ও অসম্পুর্ণ হয়েছিল। অর্থাভাব যার প্রধান এবং একমাত্র কারণ। আমি আজো ঘটনাটা ভুলতে পারি না।
লোপা : শৈশবের স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে বলেছিলেন সেই সময়কার বাংলার মুখ আর বর্তমান বাংলার মুখ একই রকম রয়ে গেছে, আপনি আসলে কোন বাংলার মুখ দেখতে চান?
রাব্বানী : এর উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের যেতে হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দিকে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে বুঝতাম একটা মুক্ত স্বাধীন দেশ গড়ে তুলব। মুক্ত আর স্বাধীন কথাদুটো কিন্তু সমার্থক নয়। একটা স্বাধীন দেশে দারিদ্র্য থাকতে পারে, অশিক্ষা থাকতে পারে, অস্বাস্থ্য থাকতে পারে। কিন্তু একটা মুক্ত দেশে কোনো অশিক্ষিত লোক থাকবে না, কেনো দারিদ্র্য থাকবে না, কোনোরকম অন্যায় থাকবে না। এখন কথা হলো সেটা সম্ভব হবে কিভাবে? সেটা সম্ভব হবে যদি আপনি প্রত্যেকটা নাগরিককে প্রশাসনের সাথে সম্পৃক্ত করতে পারেন এবং সেটা করার রূপরেখা কিন্তু আমাদের সংবিধানে আছে। বাংলাদেশের সংবিধানের ৫৯, ৬০ অনুচ্ছেদে। আমি এ পর্যন্ত যত লিখেছি, যত বক্তৃতা দিয়েছি বা যেখানে গিয়েছি বলেছি, এই জনগণ কর্তৃত্বের সরকার চায়, ছোট ছোট এলাকার প্রজাতন্ত্রী সরকার যেটার রূপরেখা সংবিধানের ৫৯, ৬০ অনুচ্ছেদে আছে। সেটা যদি প্রতিষ্ঠা করা যায় তাহলে এটা একটা প্রকৃত সোনার বাংলা হবে। এখানে এখন জনগণের শুধু ভোটাধিকার ছাড়া আর কি আছে? কখনও কখনও তাও নাই। কবে আমাদের স্বাধীন শাসনকার্যে প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা থাকবে? কোনোদিন যদি বাংলাদেশের সংবিধানের ৫৯, ৬০ অনুচ্ছেদের সোনার বাংলা দেখে যেতে পারি তাহলে বুঝবো আমার স্বপ্ন সফল হয়েছে।
বাংলাদেশ কিন্তু সুজলা-সুফলা, শস্যশ্যামলা একটি দেশ। আর এ কারণেই কিন্তু এই দেশে নানা জাতীর অঘটন ঘটেছে। তার ফলে কি হয়েছে? নানা জাতীর মিলন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে এই দেশ। এ দেশে ইংরেজ এসেছে, তারও পুর্বে বাংলাদেশে প্রাচ্য সংস্কৃতি ও পশ্চিম এশিয়ার ইসলামী সংস্কৃতির এক ধরনের সম্মিলন হচ্ছিলো। ইংরেজদের শাসন নীতি এই পক্রিয়াকে বন্ধ করে দেয়। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক প্রশ্নগুলি তথা অতিতকালের তর্কগুলি এখনো অমিমাংসিত। কিন্তু সেগুলির ব্যাপারে ততটা নৈব্যক্তিক আলোচনা করা প্রয়োজন যতটা বর্তমানকে পরিবর্তন করার কাজে সহায়ক ও অপরিহার্য। এটা তো সত্য যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি ছাড়া রাজনৈতিক স্বাধীনতা খুব বেশি ফলপ্রসু হতে পারে না। আর এ কথা বাংলাদেশের জন্য এটা বাস্তব সত্য। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জন্ম হলো। গণপ্রজাতন্ত্রী বিপ্লব সম্পূর্ণ হয়ে গেলে বিপ্লবের ভূমিকা কিন্তু সম্পূর্ণ হয় না। আমরা এখন যে দেশে বাস করছি আর যে দেশে বাস করবো বলে স্বপ্ন দেখেছিলাম সেই স্বপ্ন আর বাস্তবতার মধ্যে কিন্তু বিস্তর ফারাক। বলা চলে সেই ফারাকটা দিন দিন বেড়েই চলেছে। বিপ্লব পরবর্তীকালে জীবন-যাত্রার মান উন্নয়নের সাথে সাথে বিলাসবহুল জীবন-যাপনের লোভ তৈরি হতে থাকে মনে মনে। এই লোভের ফলে যাদের কাছ থেকে নিঃস্বার্থ সেবা পাবার কথা তাদের নৈতিক স্খলন ঘটে। একটি নব্য শ্রেণির জন্ম হয় যাদের সাথে প্রতিবিপ্লবীরা মিলেমিশে যায়। এবং এই দুই শ্রেণি এক হয়ে রাষ্ট্র খমতায় জায়গা করে নেয়। তখন জনগণের সামনে দুটি পথ খোলা থাকে। ১. তাদের বর্তমান অবস্থা মেনে নিতে হবে যাকে তুলনা করা যায় একটি বদ্ধ উপত্যকার সাথে যেখানে আছে শুধু অন্ধকার এবং দমবন্ধ হয়ে আসার মতো শ্বাসরুদ্ধকর বাতাস। ২. অথবা তাদের এই পরিবেশের বিরুদ্ধে ফাইট করে যেতে হবে উঁচু পাহাড়ের চুড়ায় যেখানে আছে শ্বাস নেবার মতো পরিচ্ছন্ন বাতাস এবং পর্যাপ্ত আলো।