পারমিতা ভৌমিক
একা শঙ্খ ::একক কবিতা …
।।১।।
বৈরাগীতলা
–শঙ্খ ঘোষ
(অভিনন্দন মাইতির জন্য এই প্রয়াসটুকু রইলো।)
সেদিন কোথায় গিয়েছিলাম জানতে চেয়েছিলে
সহজ করে বলেছি বন্ধুকে—
গাঁয়ের নাম উজালডাঙা, সইয়ের নাম জবা
পথ গিয়েছে বৈরাগীদের বুকে।
শরীর থেকে শীতের বাকল শহর গেছে খুলে
মাথার উপর ছড়িয়ে গেছে হাঁস—
ঠিক তখনই সৌরধুলোয় অন্ধ, বলেছিলাম
এই গোধূলি অনন্তসন্ন্যাস!
অমনি সবাই প্রান্তে মিলায়, ঝাপসা রেখে আমায়
সঙ্গিনী যায় বৈরাগীগৌরবে—
দুহাত দিয়েই ধরেছিলাম, রইল না তো তবু
হাতেই কোনো ভুল ছিল কি তবে?
বৈরাগীতলা—-একটা স্থানের পরিচয়কে বহন করছে। শঙ্খ ঘোষের কবিতার জগৎ যতটা স্পেসনির্ভর ততটা টাইমনির্ভর নয়। অথচ সময় তাঁর নির্মাণে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বৈরাগীতলা যদি কোনো স্থান হয় তাহলে তাকে ঘিরেই আবর্তিত হবে টাইম এবং স্পেস। স্থান কাল ও পাত্রের বিজ্ঞান এরকমই । যদি বৈরাগীতলা মানসসৃষ্ট হয় তখন কিন্তু পর্ব বা পর্যায় বিভাগ শঙ্খের কবিতায় কিছুটা দুরূহ হয়ে ওঠে।
তাঁর এই কবিতাটির চলনে একই সঙ্গে রয়েছে “বাইরের দিকে মুখ করা” ও “ভিতরের দিকে মুখ ঘোরানো ” —যুগপৎ অব্যাহত টান।
অদ্ভূত সংলাপধর্মে এই বিষয়টি ধরা রয়েছে। আসুন পড়ে নিইই—
“সেদিন কোথায় গিয়েছিলাম জানতে চেয়েছিলে”—- এটি একটি সাধারণ ন্যারেটিভ ডিসকোর্স। উদ্দিষ্ট যে কে এখনো জানিনা আমরা। এই পর্যন্ত বয়াননির্ভর ( textual)
অধিবাচন পেলাম। কিন্তু পরেপরেই কবিতাটির অন্তর্বয়ান আশ্চর্যভাবে রূপান্তরিত হল কবির শৈলীবদ্ধ প্রকৌশলে। মূল বয়ানকে কেন্দ্রিত করতে আনুষঙ্গিক প্রতিবেশ আনলেন কবি—-
“সহজ করে বলেছি বন্ধুকে—“—– এটি একটি প্রতিবেশমূলক অনুষঙ্গ। পরে পরে এল—
“গাঁয়ের নাম উজালডাঙা,” “সইয়ের নাম জবা”
“পথ গিয়েছে বৈরাগীদের বুকে”——
এইসব অনুষঙ্গিত (contextual) বয়ানগুলোতে শঙ্খের ভাষারীতি আটপৌরে।কবি এক আশ্চর্য উপায়ে এইসব ভাষিক লক্ষণকে রূপান্তরিত করেছেন নিজস্ব স্টাইলে।
আগেই বলেছি শঙ্খের কবিতাতে একদিকে রয়েছে বহির্মুখিনতার চলন , একই সঙ্গে রয়েছে ভিতরের দিকে মুখ ফেরানোর টান।এই ভাষিক ও ভাবগত দ্বান্দ্বিকতাই সম্পূর্ণভাবে কেন্দ্রস্থ করে রেখেছে শঙ্খের কবিতাটিকে। বৈরাগীতলার ইমাজিনারি টান যতটা ব্যাপ্তি দিচ্ছে পাঠকের শিলীতসত্তাকে ততটাই বেঁধে রাখছে তাকে ইহস্থিতিতে— যখন কবি বলছেন—
গাঁয়ের নাম উজালডাঙা,সই-এর নাম জবা তখন কবি কি আন্তরকোনো অভীপ্সার ছবিকে দিলেন লোকাল নেম এন্ড হ্যাবিটেশন??এই কবিতাটিতেও কবির কাছে কল্পনা ও বাস্তবের দ্বান্দ্বিকতা থেকেই বেরিয়ে এল ভাষা—- নিসর্গ অনিসর্গের একটিমাত্র টানে আঁকা হল—শরীর থেকে খুলে গেল শীতের বাকল শহর —অনন্য প্রতীকে মূর্ত হল অবাস্তবের বাস্তবায়ন। এর ঠিক পরেই নিসর্গের ক্রমিক মূর্তিটিকে দেখছি— মাথার ওপর ছড়িয়ে গেছে হাঁস! সেই অন্যবিরল কাব্যমুহূর্তে জেগে উঠল কবিসত্তার সম্যগ-ন্যাস। অ্দভূত বৈপরীত্য ও দ্বান্দ্বিকতায় কবির আপূর্যমান চৈতন্যের ভাষা পাল্টে গেলো—-“ঠিক তখনই সৌর ধুলোয় অন্ধ”—কবি বলেছিলেন—“এই গোধূলি অনন্তসন্ন্যাস”….
দ্বান্দ্বিকতা এবার চরমে পৌঁছলো —-“অমনি সবাই প্রান্তে মিলায়,/ ঝাপসা রেখে আমায়”—–
সঙ্গিনী কিন্তু যায় “বৈরাগী গৌরবে”—-কে এই সঙ্গিনী? কবির অন্তরচারী মানসপ্রকৃতি সত্তা? তাঁর নিজেরই কেন্দ্রস্থিত পুরুষসত্তার গৌরবেই দ্বান্দ্বিকতা মুক্তির পথে সঞ্চরণশীল ?
শেষপর্যন্ত কি এমনটাই মনে হয়েছে কবির—“দুহাত দিয়েই ধরেছিলাম, রইল না তো তবু
হাতেই কোনো ভুল ছিল কি তবে?”
—–এ কবিতা বহুস্বরিক ( polyphonic)… বস্তুবাদী সামাজিক জীবনের প্রেক্ষিতে ভাববাদের রঞ্জনতত্ত্বে (idealism) রঞ্জিত ।
একথা সত্য যে শঙ্খের কবিতা কোনো মিনার-বাসী সৌন্দর্যচর্চা বা নন্দনতত্ত্ব প্রকাশ মাত্র নয়। বাস্তবের স্বেদাক্ত প্রাত্যহিকতায় স্পৃষ্ট। তবুও কবিতালোকই তাঁর উজ্জীবন। এই খানেই শঙ্খের দ্বান্দ্বিকতা ও তা থেকে মুক্তির সন্ধান চিরজঙ্গম।।
।।২।।
পদ্মসম্ভব
শ ঙ্খ ঘো ষ
পাহাড়ের এই শেষ চূড়া
এইখানে এসে দাঁড়িয়েছ আজ ভোরবেলা
তোমার পায়ের নীচে পদ্মসম্ভবের মূর্তি,গুম্ফার উপরে আছো তুমি
বর্ণচক্র ঘোরে চার পাশে
ঘৃতপ্রদীপের থেকে তিব্বতি মন্ত্রের ধ্বনি মেঘের মতন উঠে আসে
ধ্বনির ভিতরে তুমি অবলীন মেঘ হয়ে আছো
যতদূর দেখা যায় সমস্ত বলয় জুড়ে পাষাণের পাপড়ি মেলে দেওয়া
দিগন্তে দিগন্তে ওই কুয়াশামথিত শিখরেরা
পরিধি আকুল করে আছে
তার কেন্দ্রে জেগে আছো তুমি
আর এই শিলামুখে বহুজনমুখরতা থেকে
আবেগের উপত্যকা থেকে
মুহূর্তের ঘূর্ণি থেকে চোখ তুলে মনে হয় তুমিই পদ্মসম্ভব
তোমার নিরাশা নেই তোমার বিরাগ নেই তোমার শূন্যতা শুধু আছে।
পর্যবেক্ষণশক্তি, সংবেদনশীল মানস এবং অনুভববেদ্য দৃষ্টিলোক থেকে কবি শঙ্খ ঘোষ জীবন-সময়-সমাজ-সংসারকে চিরদিন অন্বেষণ করেছেন। সে দৃষ্টিলোকে আশ্রয় পেয়েছে জীবনবাস্তবতা এবং প্রবহমান সময়। অর্থাৎ কবিতায় বস্তুপৃথিবীর চিহ্ন ও সময়ের স্বাক্ষর বহনের মধ্য দিয়ে তাঁর সৃষ্টিকর্ম পৌঁছে গেছে একটি নান্দনিক উৎকর্ষের প্রান্তে।
শঙ্খ ঘোষ তাঁর স্বীয় অভিজ্ঞতা ও অনুভবকে প্রকাশ করেন নানা আঙ্গিকে, বিভিন্ন কৌশলে। তাঁর কবিতার স্বতন্ত্র ভাষারীতি, শব্দচয়ন, চিত্রকল্প ও প্রতীক ব্যবহার, ছন্দ-অলঙ্কার প্রয়োগনৈপুণ্য, লোকচেতনা, মিথ-পুরাণ-রূপকথার ব্যবহার প্রভৃতি কবির শিল্পীসত্তার সঙ্গে তাঁর নির্মাণশৈলীর সৌকর্যকে উপস্থাপন করে পাঠকদের দরবারে। ফলে কবিতায় সৃজন-মননের যথার্থ সমন্বয় ঘটে।
বস্তুবিশ্বের নান্দনিক শিল্পভাষ্য শঙ্খ ঘোষের কবিতায় চিত্রিত হয় ভাষার সাবলীল বুননের মাধ্যমে। তাঁর কবিতার ভাষা তাই সরল ও প্রাঞ্জল। বাকচাতুর্য ও বাকবৈদগ্ধ্য তাঁর কবিতায় সাধারণত অনুপস্থিত থাকে। এগুলোর পরিবর্তে কবিতার ভাষায় হালকা চালের সুর তথা ছড়ারীতিসহ ঠাট্টা,কখনো ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ বা শ্লেষাত্মক ভঙ্গিও ব্যবহার করেন। তবে তা প্রায় সর্বাবস্থায় সরল হয়। জটিল ও আড়ম্বরপূর্ণ নয়। কথ্যভাষারীতি তাঁর কবিতার অবলম্বন। এ তো গেল শঙ্খ ঘোষের (সমগ্র প্রতিভার অতি সামান্য) স্পেশাল আইডেন্টিটি।
এখন অন্য স্বাদের কবিতা পড়বো। কবিতার নাম “পদ্মসম্ভব”।
শিরোনাম ধরে এগুলে পাঠকের বোধ কথা বলে।বলে দেয়, পদ্মজাত কিছুর কথা।—-
পদ্মসম্ভব হলেন তিব্বতের বুদ্ধ।শ্রেষ্ঠগুরু। তিনি বুদ্ধ শাক্যমুনির ফুল এনলাইটমেন্ট নিয়ে আবির্ভূত হন।মতান্তরে তিনিই ছিলেন শাক্যমুনি স্বয়ং এবং কায় পাল্টে এসেছিলেন।মূলতঃ এই পদ্মসম্ভব ( Guru Rinpoche of Tibet)…বজ্রযান(তন্ত্র) প্রচার করেছিলেন। অদ্ভুত এই “পদ্মসম্ভব” নামকরণেই কবিতার উত্তুঙ্গবোধটি প্রতিভাসিত।পাঠক সঙ্গে থাকুন। পড়তে পড়তে কবিতার পরিণতিতে পৌঁছে যাব।
“পাহাড়ের এই শেষ চূড়া”——- এ পাহাড় কি চড়াই উৎরাই ভেঙে-চলা বিজ্ঞানময় অধ্যাত্মপথ ও কাদব্যপথ? তারি শেষ চূড়ায় এসে দাঁড়িয়েছেন কবি শঙ্খ ঘোষ? যে এসে দাঁড়িয়েছে সে কিন্তু কবি নয় তা হল শঙ্খ ঘোষের কবিতা।একথা কবিতাই বলছে। কবিতার এমন মঙ্গলবলয়ের প্রকাশ ক্ষেত্রে এসে তবে কি কবি আর দূরে থাকতে পারলেন না? কবিতায় তিনি তো নিজেই তাঁর অনুস্যুতির কথা এইমাত্র বললেন।
আমরা অবাক হয়ে দেখলাম, যে কবির আত্মসত্তা আজীবন ট্রানসেন্ডেন্ট ছিল , আজ সেই তাঁকেই অন্যভাবে পাচ্ছি। কবির দৃষ্টিতেই কবিতা দেখছি যা নাকি, —-“এইখানে এসে দাঁড়িয়েছ আজ ভোরবেলা” —এ কেমন ভোর যা উদাসীন এক স্রষ্টাকে এমন করে বাঁধল? তবে কি তিনি তাঁর স্ফুরণকালের ইঙ্গিত পেলেন? কবি অদ্ভুত ভাবে বলছেন—-
“তোমার পায়ের নীচে পদ্মসম্ভবের মূর্তি,”—–কে তিনি তবে? যাঁকে শঙ্খ দেখছেন—-
“গুম্ফার উপরে আছো তুমি”??
কে সেই তিনি????……আর
“বর্ণচক্র ঘোরে চার পাশে”…. শক্তির স্ফুরণকালের রঙ ছিল। তাকেই বলি বর্ণ। পরে তাইই অক্ষর হয়েছে। আরো পরে লিপিত বৈখরী।তবে ইনি স্বয়ং বাক নাকি ব্রহ্মাণী সরস্বতীশক্তি স্বয়ং? পরাবাক? প্রজ্ঞাশক্তি? তাঁরই তো প্রজ্ঞাতে নেমে আসার কথা।তিনি এসেছেনও পদ্মসম্ভব বুদ্ধ হয়ে !!!
কি অলৌকিক ডিসকোর্স দিয়ে শঙ্খ সাজাচ্ছেন তাঁর কবিতার পট——
“ঘৃতপ্রদীপের থেকে তিব্বতি মন্ত্রের ধ্বনি মেঘের মতন উঠে আসে”—– বজ্রযান তন্ত্রের ধ্বনি গুম্ফায় প্রতিধ্বনিত হয়ে উপরে আসীনা অনন্তপ্রজ্ঞাময়ী দেবী সরস্বতী-পারমিতার পদতল ছুঁয়ে যাচ্ছে। স্পষ্টতঃই কবির চৈতন্যময় আলোচনে ফুটে উঠছে সেই ছবি—-
“ধ্বনির ভিতরে তুমি অবলীন মেঘ হয়ে আছো”—শব্দশক্তির সান্দ্রতায় ঘনিষ্ঠ কিম্বা ঘনীভূত।একান্ন পাকে তিনি নামবেন সৃষ্টির বুকে অক্ষর হয়ে। এইই বুদ্ধের সাধনা।তারপর দেখি আমাদের সময়ের মন্ত্রদ্রষ্টা কবি শঙ্খের দৃষ্টিতে—-“যতদূর দেখা যায় সমস্ত বলয় জুড়ে পাষাণের পাপড়ি মেলে দেওয়া
দিগন্তে দিগন্তে ওই কুয়াশামথিত শিখরেরা
পরিধি আকুল করে আছে
তার কেন্দ্রে জেগে আছো তুমি”—– এ কি তবে সহস্রার কথা? কোন কেন্দ্র? শতদল মণিপদ্মের কেন্দ্রভূতা ? সেই যে অলৌকিক, সেই বিমূর্ত প্রজ্ঞা এমন সহজ উচ্চারণে ধরে ফেলা, এ কেবল আর একজন বুদ্ধচৈতন্যই পারেন ঠিক এমনিভাবে। সেই তিনি, কবি শঙ্খ।সেই পার্বত্যপ্রাকৃত অনুভব রামকিঙ্করের ভাস্কর্যের মত অক্ষরপেন্টিং এ এঁকে চলেছেন আর এক নিমগ্নচিত্ত “আনন্দ”…. তিনি শঙ্খ ঘোষ। আশ্চর্য কুশলতায় ছড়িয়ে পড়লেন শঙ্খ-অনুভব, চারপাশের জনজীবনে। ঐ শিখরচুম্বী পরাক্ষেত্র থেকে নামলেন মানুষের পৃথিবীতে আর তখনই এই শিলামুখে বহুজনমুখরতা থেকে এবং
আবেগের উপত্যকা থেকে কিম্বা মুহূর্তের ঘূর্ণি থেকে চোখ তুলে স্বয়ং কবিরই কি মনে হলো—-” তুমিই পদ্মসম্ভব”??? এই তুমিই বা কে? আলাদা তো নও। শঙ্খের গভীরে তখন প্রজ্ঞাদেবী পদ্মসম্ভব এবং কবিআত্মা,মিলে মিশে এক—-সো অহম্। কী গভীর গহন প্রকাশে নেমে এলো অখণ্ডের উপলব্ধি কবিহৃদয়ের অনিকেত আলোর গভীরে ! তাঁর বোধ বলে দিল ——হে হেমপ্রভ-প্রজ্ঞা পারমিতা
“তোমার নিরাশা নেই তোমার বিরাগ নেই তোমার শূন্যতা শুধু আছে।”—-এ শূন্যতা পূর্ণ হয়ে আছে একে….. একত্রে…..। এ শূন্যতা নাথিংনেস। এ শূন্যতায় লুকিয়েছে পৃথিবীর যামল অনুভব।
।।৩।।
শঙ্খ ঘোষ
তোমার দুঃখের পাশে বসে আছি ।
বসে বসে দেখি
দিগন্তবিসারী দূর্বাদল
প্রতি শীর্ষে ধরে আছে স্নিগ্ধ কোনো রক্তবিন্দু যেন
লাল নীল সবুজের মোহে ভরা
মিলনমায়ায় যেন ভরে আছে চোখ ।
আর কোনো দৃশ্য নেই, শব্দ নেই আর কোনোখানে ।
তোমার ঘুমের পাশে বসে আছি ।
ঘুমন্ত সে-মুখে এক আভা
ছড়িয়ে রেখেছে যেন আমার দুঃখের প্রতিচ্ছবি ।
ব্যর্থ আর সবই ।
■মিলনমায়া— নামটিতেই জাদুগ্রস্ত হই। এ এক প্রচেত মায়া ,যে মায়া মিলনেই স্থিতি পায়। এ যেন বৈশ্বানরের দেবমায়া থেকে বেরিয়ে আসা অন্য এক বৃহতের কাব্যকথা। এ এক কল্যাণী সংকল্পমায়া।
এই কবিতাটির চেহারাতে কোথায় যেনো উদাসীন রূপ আছে জড়িয়ে। অস্ফুট সহজ শব্দে রীতি-আলগা ছন্দের দোলা। এর আড়ালে উঁকি দিচ্ছে এক আনকোরা আত্মবিলয়ের সুর যার গতিমুখ মঙ্গলের দিকে। কবি কিভাবে বলছেন সেসব শুনবো কবিতার সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে —-
“তোমার দুঃখের পাশে বসে আছি । “—–কেননা তোমার
” ঘুমন্ত সে-মুখে এক আভা
ছড়িয়ে রেখেছে যেন আমার দুঃখের প্রতিচ্ছবি । “—-এই তুমি আর আমি —-কে? দুই স্বতন্ত্র সত্তা? নাকি একই এক সত্তার দ্বিখণ্ডিত হয়ে পড়ার ছল-রূপ (pseudo entity)?
একজন নিরীক্ষণ করছে আর একজনকে। একই সত্তার এ এক অন্য অণ্বেষণ—-
“বসে বসে দেখি
দিগন্তবিসারী দূর্বাদল
প্রতি শীর্ষে ধরে আছে স্নিগ্ধ কোনো রক্তবিন্দু যেন “—-
একটি প্রাকৃতিক ছবিও দুঃখের রক্তবিন্দুর মতো বসেছে সহস্র দুর্বাদলের ডগায়। তবু কি আশ্চর্য স্নিগ্ধ সেসব। এর সঙ্গেই কি জড়িয়ে গেছে কবির নিজ সত্তাকে সন্ধান করার তীব্র সংহত আবেগ? কবির একধরণের আত্মসন্ন্যাসের বিস্তারই কি পাইনা ঐ—“দিগন্তবিসারী দূর্বাদল
প্রতি শীর্ষে ধরে আছে স্নিগ্ধ কোনো রক্তবিন্দু যেন “—-এর মধ্যে? “দিগন্তবিসারী”— শব্দবন্ধটি কবির উল্লেখে যেন নবজাত হল অনন্য প্রসারতায়। প্রচলিত শব্দ থেকেই এই কবি-ব্যবহৃত শব্দবিচ্যুতিটির মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে শঙ্খ ঘোষের গোপন শব্দসন্ত্রাসের ছবি। এত সুন্দর সেই ভাঙচুর যে তা যেন—স্নিগ্ধ কোনো রক্তবিন্দু । যেন সেই রক্তিম অস্তিই শান্ত এক সান্ততায় লাল নীল সবুজের মোহভরা
মিলনমায়ায় ভরে দিয়েছে দেখবার অন্যচোখ ।
এই বর্ণবিলাসেই কবির সোত্তরণ, মায়া ছড়িয়ে দিয়েছে কবিতার অবয়বে আর সেই রঙেই রঙিনতা পেয়েছে পাঠকের তৃষ্ণার্ত মন। এ এক পরানৈশব্দ্যের ইঙ্গিতময়তা কিছুটা যেন শব্দহীন ভাষা যা বারবার আমাদের জানিয়েছে আগেও —“এত বেশি কথা বলো কেন? চুপ করো।”
এই নৈশব্দ্যই কি কবির ভাষায় দুঃখঘুম? এ কিন্তু শূণ্যতা নয়,এ অন্য এমন এক ভাষা যা মনের সঙ্গেই কথা বলার স্ফূর্তি পায়।
এখানেই জেগে ওঠে অসম্ভব আরো কোনো তৃতীয় ভুবন।
কবি যখন বলেন—
“লাল নীল সবুজের মোহভরা
মিলনমায়ায় যেন ভরে আছে চোখ । “—-তখন দেখি তাঁর কবিসত্তা কোনো এক বিশেষ মুহূর্তে পরমের সঙ্গে যোগারূঢ় হয়েও প্রাণপনে আঁকড়ে আছে শিকড়ের মায়া। এই দেখা তবুও একসময় রূপান্তরিত হয়ে যায় অজগতী উত্তরণে আর তখনই—-
“আর কোনো দৃশ্য নেই, শব্দ নেই আর কোনোখানে ।”—
আমরা তখন পাই এমন একজন কবিকে ও তাঁর কবিতাকে যেখানে কাব্য হয়ে ওঠ দুঃখাতীতভাবে আনন্দরসের আকর, হয়ে ওঠে মণীষা ও জ্ঞানের বাস্তবদলিল,হয়ে ওঠে রাধ্যসাধনার সূর্যফসল।
এই নৈশব্দ্যই সত্তার নিকটতম পরিবেশে এসে ঘটিয়ে দেয় সমস্ত অতীতের আকস্মিক বিস্ফোরণ (paramnesia)…। তখনই আত্মনাট্য (self dramatisation) মুদ্রায় কবি বলতে পারেন—-
“তোমার ঘুমের পাশে বসে আছি । “—ঠিক তখনই ঘটে যায় অভিপ্রেত আত্মবিম্বের প্রতিফলন—–
“ঘুমন্ত সে-মুখে এক আভা
ছড়িয়ে রেখেছে যেন আমার দুঃখের প্রতিচ্ছবি । “—–ব্যক্তিক দুঃখ ছড়িয়ে পড়ে বৈশ্বি প্রসারতায়। এইখানে কবির সমাহিতি ও প্রসন্নসন্তোষ। এ দুঃখ নেতিবাচক কোনো শূন্যতা আনেনা। এ দুঃখ alienation এর ব্যথাসারানিয়া। এ দুঃখ কবির উপশম ও পথ্য।
এইখানে অন্য এক পূর্ণতার বৈভব কবিকে বলায়—-
“ব্যর্থ আর সবই ।”