বাংলাদেশের মানুষকে প্রতারণা ও অপমান করা হয়েছে
– চঞ্চল আশরাফ
আশা করছি কুশলে আছেন। আপনার কী মনে হয়- ভালো থাকা, না-থাকা একটি রাজনৈতিক ঘটনা?
কোনো ব্যক্তিমানুষের ভালো থাকা না-থাকার সঙ্গে রাজনীতির বা রাজনৈতিক পরিস্থিতির সম্পর্ক প্রায় অনিবার্য, তবে তা বেশ গোলমেলে ও পরিবর্তনশীল। আপেক্ষিক তো বটেই। যেমন আন্দোলনের সময় যারা পিকের্টং করে, তাদের ভালো থাকা না-থাকা এবং যারা পিকেটিংয়ের কারণে জীবিকার দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাদের অনুভূতি একরকম নয়। আবার হরতালের কারণে যে তরুণী প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করতে পারে না, তার আবেগের ব্যাপারটা ভাবুন। অর্থাৎ কারও ভালো থাকা না-থাকা নির্ভর করে সে কতটা স্বাধীন বা আদৌ স্বাধীন কি-না, তার ওপর। কিন্তু বাংলাদেশে তো রাজনীতি নেই; বেশ আগেই তা সমাধিস্থ হয়েছে। যেমন, ৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশের ধর্মান্ধ/সাম্প্রদায়িক মুসলমানরা আগের চেয়ে বেশি বিপজ্জনক মাত্রায় স্বাধীনতা উপভোগ করছে; এত যে, তারা পেয়ে গেছে অন্য সম্প্রদায় ও ভিন্ন মতাবলম্বী, এমন-কি নারী ও শিশুর ওপর আন্তুরিকভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ার অধিকার। তবে তারা অন্যান্য অধিকার থেকে বঞ্চিত, [কিংবা সে-সম্পর্কে অজ্ঞ/অসচেতন। এটাও রাজনীতিহীনতার লক্ষণ], ফলে ধর্মীয় স্বাধীনতার বেপরোয়া ও নির্দয়-নির্বিচার প্রয়োগে তাদের সুখ। দেশে রাজনীতি থাকলে এমনটি হওয়ার কথা নয়। পুলিশের কাছ থেকে ছিনতাই করে উৎসব মণ্ডল নামের এক কলেজছাত্রকে পিটিয়ে মারার পর তারা বলেছে ‘আলহামদুলিল্লাহ’! [মুসলমানরা আনন্দিত হলেই এটা বলে।] মানুষ পিটিয়ে সুখানুভব এবং তা প্রকাশের স্বাধীনতা রাজনীতিহীন রাষ্ট্রেই বোধ করি সম্ভব।
রাজনীতির বাইরে মানুষ থাকতে পারে না। কিন্তু যেখানে রাজনীতি নেই? বা, যেখানকার মানুষ রাজনীতির ধ্বংসস্তূপের ওপর কিংবা গোরস্তানে বসবাস করছে? সেখানকার মানুষ আসলে কোথাও নেই। নিজের কাছেও না।
তবে আমাদের মধ্যে যেসব নারীপুরুষ অবরুদ্ধ সময়ে বসবাস করেও একে অন্যের প্রতি যৌন ও অন্যান্য জৈবিক দায়িত্ব পালন করতে থাকে উদ্বেগহীনভাবে, তাদের কথা ভিন্ন। এখন যেমন দেখছেন, দেশের অস্থির সময়েও একদল নারীপুরুষ ঈদের শপিং বেশ উপভোগ করছে, সেহরি পার্টিতে জিভ বার করে খাচ্ছে, সেই ছবি প্রচার করছে সামাজিক মাধ্যমে। এদের মতো হতে পারলে ‘ভালো থাকা’ যায়। তবে সেজন্য নির্বোধ হতে হবে।
২০২৪-এর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনকে আপনি কীভাবে দেখেন? প্রধান উপদেষ্টা্র কথিত “ম্যাটিকুলাসলি প্ল্যানড” সম্পর্কে আপনি কি ভাবেন?
এই কথা বলে ড. ইউনূস নিজেকে সন্দেহজনক করে তুলেছেন। আমেরিকায় গিয়ে তিনি একটা বাহাদুরি দেখাতে চেয়েছেন, আমার মনে হয়। এই অভ্যুত্থান যদি তাঁর কথা অনুযায়ী ‘ম্যাটিকুলাসলি ডিজাইন্ড’ হয়, তাহলে বলতে হয়, পরিবর্তনপ্রত্যাশী বাংলাদেশের মানুষকে প্রতারণা ও অপমান করা হয়েছে। অথবা, ইউনূসের কাছে জনগণ মানুষই নয়, পাপেট মাত্র; বা গবেষণাগারের কিছু প্রাণী, যাদের ওপর পরিকল্পনামাফিক পরীক্ষানিরীক্ষা করা যায়। কিংবা বাংলাদেশের মানুষ মাত্রই অসহায় গর্দভ।
ড. ইউনূসের কাণ্ডজ্ঞান আছে নিশ্চয়, মানুষকে অসম্মান করা তাঁর উদ্দেশ্য হতে পারে না। কিন্তু এই কথায় আমি অসম্মানিত বোধ করেছি, প্রতারিত হয়েছি বলে অনুভব করেছি। এমনটা ঘটতো না, যদি জুলাইয়ের আন্দোলনকে সমর্থন না করতাম।
ইউনূসের এই কথা বাদ দিলেও, আমার মনে হয়, জনগণ প্রতারিত হয়েছে। বিশেষত যারা সেকুলার, পেশাজীবী মধ্যবিত্ত, প্রগতিশীীল, বামপন্থি, মানবতাবাদী, বাকস্বাধীনতাকামী, সহজসরল মেহনতি, ধর্মপ্রাণ কিন্তু ধর্মান্ধ বা সাম্প্রদায়িক নয় এমন মানুষ, উদারনৈতিক গণতন্ত্রের সমর্থক। তারা চায়নি সাম্প্রদায়িক হিংসা-পীড়ন, মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মান, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, হত্যা, স্থাপনা ধ্বংস, ধর্ষণ, ধর্মীয় আস্ফালন আর জবরদস্তি; তারা শান্তি চেয়েছিল। মুক্তি চেয়েছিল ফ্যাসিস্টের হাত থেকে, শেখ হাসিনা এবং তার দুষ্ট সঙ্গিদের থেকে, লুণ্ঠনকারী গ্যাং থেকে। নিষ্ঠুরতা থেকে। কিন্তু অবস্থা এখন আগের চেয়ে ভয়ঙ্কর। মব নামে নতুন এক হিংস্রতা যোগ হয়েছে। রেলিজিয়াস পুলিশিংয়ের উপদ্রব তো আছেই। আইনশৃঙ্খলা-পরিস্থিতিও খারাপ। তবে বাংলাদেশে এটা কখনো ভালো ছিল বলে মনে পড়ে না।
লক্ষ করার বিষয়, চব্বিশের আন্দোলন থেকে যত স্লোগান শোনা গেছে, কর্মসূচির যত টার্ম বা শব্দ কিংবা রাজনৈতিক পরিভাষা ব্যবহৃত হয়েছে, সবই সেকুলার-প্রগতিশীল-শিক্ষিত শহুরে মধ্যবিত্তের ভাষার সঙ্গে সম্পর্কিত। ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক কোনো স্লোগান হয় নাই। ফলে এক যুগের বেশি সময় ধরে-চলা অপশাসন-দুর্নীতি থেকে মুক্তির অপেক্ষায় থাকা সব শ্রেণি-পেশার মানুষ এই আন্দোলনে বিভিন্নভাবে অংশ নিয়েছে। কিন্তু আন্দোলন সফল, মানে স্বৈরাচার-পতনের পর ‘নারায়ে তাকবির’ ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগান শুরু হয়ে গেল এবং এখনও সেসব চলছে। এমনকি, শহীদমিনারে, জাতীয় স্মৃতিসৌধেও। আন্দোলনে যদি এই স্লোগানগুলি শোনা যেতো, সেকুলার, প্রগতিশীল, গণতন্ত্রের সমর্থকরা এতে অংশ নিতো না। আন্দোলনও গণঅভ্যুত্থানে রূপ পেতো না।
জুলাই আন্দোলনের শুরুতে আপনার বিবেচনা কেমন ছিল?
আমার কাছে শিক্ষার্থিদের দাবিগুলি যৌক্তিক মনে হয়েছে। এটাও মনে হয়েছে, ওই সময় শেখ হাসিনা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থিদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলে গালি না দিলে, তাদের তাচ্ছিল্য না করলে ভালো হতো তার জন্য। সুযোগটা তারা নিয়েছে এবং পূর্ণমাত্রায় কাজে লাগিয়েছে। যেন তারা ওই গালি আর তাচ্ছিল্যের জন্য অপেক্ষা করছিল। তবে এমনটি না-ঘটলেও শেখ হাসিনার পতন অবধারিতই ছিল। এত দুর্নীতি, নির্মমতা, লুণ্ঠনের ভার বহন করতে করতে মানুষ বিরক্ত হয়ে পড়েছিল। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি ফোকলা হয়ে গিয়েছিল। এর সঙ্গে যোগ হয়েছিল দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি। কিন্তু প্রতিবাদ করা যেতো না। সেই রাজনীতিও ধ্বংস করা হয়েছে। ফলে, ‘কোটাবিরোধী’/‘বৈষম্যবিরোধী’ আন্দোলনের ছদ্মবেশ নিয়ে শিক্ষার্থিরা রাস্তায় নেমেছে। শুরুতে বোঝা যায়নি। যখন বোঝা গেছে, তখন কিছুই করার ছিল না। শেখ হাসিনাকে মানুষ চায়নি; চেয়েছে তার অপসারণ, যেভাবেই তা হোক।
ফ্যাসিস্টের কাজ রাজনীতি ধব্ংস করা, রাজনৈতিক পরিবেশ হাপিস করে দেওয়া। নিজেদের অনুকূলে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের ক্ষেত্র/পরিমণ্ডল/উপাদান তৈরি এবং প্রয়োজনমতো ব্যবহার করা। কোনো ব্যক্তি/সংগঠন প্রতিবাদ, বিরোধিতা করলে বা এমন কিছুর দাবি (যা মেনে নিলে শাসকের স্বার্থহানি ঘটে) জানালে সে/তারা ‘রাজাকার’/‘রাজাকারের বাচ্চা’/‘পাকিস্তানের দালাল’, ব্ল্যাকমেলিংয়ের এই চেষ্টাও বুমেরাং হয়েছে। তৈরি হয়েছে বিপরীত এক আবেগ, আন্দোলনকারীরা সেটি কাজে লাগিয়েছে। তারপর ছাত্রলীগ যা করলো, খুব নিকৃষ্ট ও নিন্দনীয়। এতে জনসমর্থন আন্দোলনকারীদের দিকে চলে গেছে। অধিকন্তু, আগে থেকেই জনগণ নানা কারণে শাসকদলের ওপর বেজায় বিরক্ত ছিল। ক্ষুব্ধ ছিল। এত যে, ‘আমরা না থাকলে দেশ জামাত-শিবির-জঙ্গিদের হাতে চলে যাবে’-ধরনের ব্ল্যাকমেইলিংও কাজে আসেনি। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য মানুষ সেই ঝুঁকিও নিয়েছে এটা ভেবে যে, আগে আপদটা যাক, পরেরটা পরে দেখা যাবে!
৫ই আগস্টের রাজনৈতিক রদবদলের পর আপনার ভাবনা, কী দুর্ভাবনা কোন বিষয়ে আবর্তিত হচ্ছিল?
আমার দুর্ভাবনা ধর্মভিত্তিক চরমপন্থি রাজনীতির উত্থান নিয়ে। তবে এর ক্ষেত্র তৈরি করে গেছে আওয়ামী লীগের সরকার, এক যুগেরও বেশি সময় ধরে। এটা তারা করেছে ক্ষমতায় টিকে থাকার উদ্দেশ্যে এই বলে জনগণকে ব্ল্যাকমেইল করার জন্য যে, শাসক হিসেবে তাদের না রাখলে দেশটাকে জামাত বা ধর্মীয় মৌলবাদী জঙ্গিরা গ্রাস করবে। শেষ পর্যন্ত কাজ হয়নি। তবে ক্ষতি হয়েছে বাংলাদেশের; সাম্প্রদায়িক শক্তি তার হিংস্রতা নিয়ে দিকে দিকে আজ প্রকাশিত। আরেক দুর্ভাবনা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক রাজনীতির মারপ্যাঁচ বর্তমান সরকার কিভাবে সামলাবে! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-চীন-ভারত এই তিনের সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য কিভাবে রক্ষিত হবে? ভারত-বিরোধিতা বাংলাদেশের রাজনৈতিক খাদ্যের ভালো একটা মশলা; কিন্তু সব বদলানো গেলেও প্রতিবেশি পাল্টানো সম্ভব নয়।
এই যে কিছুদিন আগে জাতিসংঘপ্রধান রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এসে আর্থিক সহায়তা কমিয়ে দেওয়ার যে বার্তা দিয়ে গেলেন, তার ভবিষ্যৎ প্রতিক্রিয়া কিভাবে সামলাবে বাংলাদেশ? প্রথমত ঘটতে পারে মানবিক বিপর্যয়, বিশেষত রোহিঙ্গা শিশুরা অপুষ্টিজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়বে; দ্বিতীয়ত এই জনগোষ্ঠির মধ্যে নতুন করে হতাশা ও অস্থিরতা দেখা দেবে এবং অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যাবে, যার প্রভাব পড়বে স্থানীয়দের ওপর; তৃতীয়ত, তাদের প্রত্যাবর্তন বিলম্বিত ও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে, বাংলাদেশের ওপর এটি ফেলবে নেতিবাচক প্রভাব; চতুর্থত, আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়তে পারে ইত্যাদি। তবে এসবের সঙ্গে ৫ আগস্ট-পরবর্তী রদবদলের সম্পর্ক নেই। ভাবা হয়েছিল, ড. ইউনূস আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে নিজের ভাবমূর্তি ও গ্রহণযোগ্যতা দিয়ে রোহিঙ্গা-সমস্যার সমাধান করতে পারবেন।
ভেবেছিলাম, স্বৈরাচার উৎখাত হলে দুর্নীতিমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক ও দায়িত্বশীল সমাজ দেখতে পাবো। সমন্বয়করা বারবার ইনক্লুসিভ সোসাইটির কথা বলেছিলেন বলেই এমন আশা করেছিলাম। কিন্তু সেরকম কিছুই দেখছি না। ‘জয় বাংলা’ বললে প্রকাশ্যে পেটানো হচ্ছে। স্বাধীনতা দিবসে জাতীয় স্মৃতিসৌধে এই স্লোগান দেওয়ার কারণে লাঞ্ছিত করে দুজনকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখা গেল। অথচ ‘জয় বাংলা’ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ অকল্পনীয়; মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া বাংলাদেশ আর জাতীয় স্মৃতিসৌধ স্বপ্নেও অসম্ভব। তা ছাড়া, এটা কি আওয়ামী লীগেরই স্লোগান? মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং বিজয়ের পর স্বাধীনতার আবেগে কে স্বর উঁচু করেনি এই দুটি শব্দে? যা হোক, অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ হলো না। তবে সমন্বয়কদের পকেট পূর্ণ হলো। তদ্বিরব্যবসাও চলছে মহাসমারোহে। এখন বুঝতে পারছি, দুর্নীতিমুক্ত, বৈষম্যহীন ও শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে স্বৈরাচার উৎখাতের কোনো সম্পর্ক নেই। তা থাকবে কিভাবে? এদেশের মানুষের নৈতিক বৈশিষ্ট্য বলে কিছু নাই। থাকলেও তা মৌলিকভাবে খুবই নিম্নমানের।
জুলাই অভ্যুত্থানকে আমাদের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের নিরিখে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
মুক্তিযুদ্ধ মানে একাত্তরের জনযুদ্ধ, আলাদা করে ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ’ বললে বিভ্রান্তি ও বিকৃতির ক্ষেত্র তৈরি হয়ে যায়। কথাটা এজন্য বলছি, স্মৃতিবিমুখ বাঙালি মুসলমানের মনে হতে পারে, বিভিন্ন সময়ে এই অঞ্চলের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করেছে; কিন্তু স্বাধীনতার জন্য একবারই, ১৯৭১ সালে, এদেশের মানুষ যুদ্ধ করেছে। এমন সর্বাত্মক সশস্ত্র সংগ্রাম পূর্ব বাংলা নামের ভূখণ্ডে একবারই ঘটেছিল। যারা চব্বিশের জুলাই-আগস্টের ছাত্রগণঅভ্যুত্থানকে তুলনা করছেন মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে, বলছেন ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ’ এবং স্বৈরাচারের কবল থেকে ‘মুক্তি’কে চিহ্নিত করছেন ‘স্বাধীনতা’ বলে, তাদের উদ্দেশে বলি, সবই বাস্তববুদ্ধিহীন কল্পনা কিংবা গালভরা কথা; মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে এই ধরনের আজগুবি চিন্তা মিলিয়ে দেখার চেষ্টাও হাস্যকর। এমনকি গণঅভ্যুত্থান হিসেবে মেনে নিতে গেলেও খানিকটা ভাবতে হবে; কেননা, স্বৈরাচারের এক প্রধান ও কিছু খারাপ লোক পালাতে বাধ্য হলেও আরেক প্রধান টিকে রয়েছেন সংবিধানেরই প্রযত্নে; এবং সব আগের মতোই আছে, কেবল ভবনটির অভ্যন্তর পাল্টেছে, ভাস্কর্য-ম্যুরাল, মাজার আর ৩২ নম্বরের বাড়িটি ধ্বংস করা হয়েছে। এসব করে কিছু হয় না, যা হয়, তা অসভ্যতা, বর্বরতা; সারা পৃথিবী এগুলি দেখে ছি ছি করে। গণঅভ্যুত্থানের ফল হচ্ছে একটা ভারসাম্যপূর্ণ জাতীয় সরকার, যার প্রাথমিক কাজ দেশে স্থিতাবস্থা তৈরি করা, শান্তি প্রতিষ্ঠা; নির্বাচন নামক খেলার রেফারিগিরি নয়। কারা ক্ষমতায় আসবে, তা নির্ধারণের বন্দোবস্ত তো নয়ই।
আর দেখছি, অনেকেই, এমনকি কোনো-কোনো গণমাধ্যমকর্মিও চব্বিশের আন্দোলনকে ‘বিপ্লব’ বলছেন। বিপ্লবের সম্ভাবনা ছিল এবং তা প্রত্যাশিতই ছিল। কিন্তু হয়নি। আগের কাঠামোতেই দেশ চলছে। চেয়ারগুলিতে নতুন নতুন নিতম্ব স্থাপিত হয়েছে মাত্র। এই অর্জন মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত স্বাধীনতার সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে না। একাত্তরের পর আর মুক্তিযুদ্ধের দরকার নেই। যদি কিছুর প্রয়োজন হয়, সেটি হলো বিপ্লব; মানে, বিদ্যমান ব্যবস্থা থেকে উত্তরণ।
এতো রক্তপাতের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট শক্তির পতন হলো। মানুষ আশাবাদী হলো। প্রধান উপদেষ্টার বলা “রিসেট বাটন চেপে দিয়েছি” প্রচারিত হবার পর থেকে দেশে ব্যাপকভাবে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য, স্থাপনা, স্মৃতিস্তম্ভ ধ্বংস করা হলো। মুক্তিযোদ্ধার কবরে আগুন দেয়া হলো। এসব ঘটনাকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
খুব হতাশাজনক। ৫৩ বছরে কতটা পিছিয়েছে বা অবিকশিত রয়ে গেছে এই দেশের মানুষ, তা ভেবে লজ্জিত হতে হয়। নিশ্চিতভাবেই, এইসব বর্বরতায় যারা নেতৃত্ব ও প্ররোচনা দিয়েছে এবং অংশ নিয়েছে, সমর্থন করেছে, তারা বাংলাদেশবিরোধী। ‘রিসেট বাটন’ বলতে প্রধান উপদেষ্টা সম্ভবত পুনর্গঠনের ইঙ্গিত দিয়েছেন। কিন্তু ঘটলো এর বিপরীত এবং ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডে সরকারের আপত্তিও দেখা গেল না। স্বৈরাচার উৎখাতের পর মবের ভয়ংকর প্রাদুর্ভাব ঘটলো; সেটি দেখে অনেককেই বলতে শুনেছি যে ফ্যাসিস্ট সরকারই ভালো ছিল। আর কারা কী ভেঙেছে, কাকে মেরেছে, দেখে বোঝা যায়, তারা কোন রাজনীতি বা আদর্শের লোক। তারা কি শয়তান, না মূর্খ, না-কি বিভ্রান্ত?
জুলাই অভ্যুত্থানের পর রাজনীতির মাঠে একটা বল ক্রিয়াশীল আছে-সুস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে যে, এরা কট্টর ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী- যারা বলছে ধর্মীয় মূল্যবোধ ছাড়া গণতান্ত্রিক সমাজ গঠিত হতে পারে না। এই বয়ানকে আপনি কীভাবে দেখেন?
ধর্মীয় মূল্যবোধ ছাড়া গণতান্ত্রিক সমাজ গঠিত হতে পারে না, এটা যারা মনে করে এবং বলে, তারা গণতন্ত্র সম্পর্কে অজ্ঞ; ধর্ম কী, তাও জানে না। তারা বিজ্ঞানবিরোধী, কিন্তু ধর্মকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য ধর্মগ্রন্থে বিজ্ঞানের আবিষ্কারগুলির উৎস খোঁজে; প্রযুক্তির সুবিধা নিতেও তাদের আপত্তি নেই। এটা সবাই জানে। এই উপমহাদেশে বহু আগেই রাজনীতিতে ভর করেছে ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতা। ইতিহাসে এটা প্রমাণিত, রাজনীতি যখন দুর্বল হয়ে যায়, তখন তা ধর্মের আশ্রয় নেয় আর ধর্ম যখন দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন রাজনীতি থেকে শক্তি গ্রহণ করে। বাংলাদেশে বল সবসময় ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও রাজনীতিপুষ্ট ধর্মের কাছেই ছিল। তবে এখন বেশ ভয়ংকররূপে দেখা যাচ্ছে। ধর্মে গণতন্ত্র চলে না, তবে গণতন্ত্র এমন এক ব্যবস্থা, যাতে বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায়ের মানুষ একসঙ্গে অবস্থান করতে পারে। বিশেষ কোনো সম্প্রদায় বা ধর্মীয় গোষ্ঠির আধিপত্য গণতন্ত্রে চলে না। ধর্মে প্রশ্নের কোনো সুযোগ নেই; কিন্তু বিচিত্র তর্কের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র সুরক্ষিত ও বিকশিত হয়।
ইসলাম একত্ববাদী। ইসলামিস্ট দলগুলোর বহুত্ববাদের শ্লোগানকে আপনি কিভাবে দেখেন?
সম্ভবত তারা সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদের কথা বলতে চেয়েছে। প্রশ্নটি অস্পষ্ট লাগছে। যদি ধরে নিই, একত্ববাদী বলতে একেশ্বরবাদী, তাহলে বলা যায়, ইসলামকে মসজিদে ও ধর্মীয় উৎসব-অনুষ্ঠানের মধ্যে রাখতে পারলে সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদের সঙ্গে এর কোনো গোলমাল হবে না। বাস্তবতা হলো, মূর্খ ও অবিকশিত মানুষের দেশে এটা অসম্ভব। আর যদি ইসলামের একাধিপত্যবাদিতার কথা ধরি, তবে বহুত্ববাদ তাতে অসম্ভব এক কল্পনা; কেননা, উভয়ই পরস্পর সাংঘর্ষিক। যে-কোনো ধর্মীয় আধিপত্য ফ্যাসিবাদের নামান্তর। ইসলামিক দলগুলির বহুত্ববাদের প্রতিশ্রুতি আরেকটা প্রতারণার কৌশল বা ফাঁদ। বাস্তবতা হলো, ইসলামি দলগুলি জোটবদ্ধ হলেও ক্ষমতায় আসতে পারবে না। জায়গায় পৌঁছতে পারে। বাংলাদেশের বিপুল-অধিকাংশ সাধারণ মানুষ, বিশেষত নারী রাজনীতিতে ইসলামি কোনো দলকে দেখতে চায় না বলে আমার ধারণা। ধর্মীয় পুলিশিং দেখে অনেকের মধ্যে ইসলামি দল সম্পর্কে ভয় তৈরি হয়েছে। ভয় থেকে অশ্রদ্ধা আসে।
বাংলাদেশকে দ্বিতীয় রিপাবলিক হিসাবে দেখতে আপনি আগ্রহী, নাকি আতঙ্কিত?
‘দ্বিতীয় রিপাবলিক’ হলে তো ভালো হতো; কিন্তু এটা যে আন্দোলনকারীদের গালভরা চমক! এখন কি দ্বিতীয় রিপাবলিকের কথা কেউ বলছে? একটা রাজনৈতিক দল তারা গঠন করেছে, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য। তবে অলিখিতভাবে তারাই কতৃত্বে রয়েছে এবং তা উপভোগ করছে। ফলে, ‘দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র’ ওই বুলির মধ্যেই শেষ। এছাড়া কিছু হওয়ারও নাই। হতে গেলে বিপ্লব দরকার। রাস্তায় জনতা মরতে মরতে গণভবনে ঢুকে গেলেই তা হয়ে যায় না। এটা একটা প্রক্রিয়া। যা হোক, ‘দ্বিতীয় রিপাবলিক’ বলতে রাষ্ট্রবিজ্ঞান থেকে যা বুঝি তা হলো, একটি দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এমন এক সরকার, যা পুরনো বা বিদ্যমান কাঠামো ভেঙে নতুন এক রাজনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। বিপ্লব, অভ্যুত্থান বা অন্য কোনো রাজনৈতিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এটা ঘটে। ধারণাটি এসেছে মূলত ফরাসি বিপ্লব থেকে।
ফ্রান্স একসময় রাজতন্ত্রের অধীনে ছিল। ১৭৮৯ থেকে ১৭৯৯ সাল পর্যন্ত সংঘটিত ফরাসি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে রাজতন্ত্রের পতন ঘটে। তবে বিপ্লবের মধ্যেই ১৭৯২ সালে ফ্রান্সে প্রথম প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হয়। ১৮০৪ সাল পর্যন্ত তা টিকে ছিল। এরপর আবার রাজতন্ত্র শুরু হয়, চলে ১৮৪৮ সাল পর্যন্ত। ওই বছর ফ্রান্সে দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হয়। এটি টিকে ছিল ১৮৫২ সাল পর্যন্ত।
তবে এটি এমন এক রাজনৈতিক ধারণা, যা বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। সার্বিকভাবে এমন ধারণায় কোনো দেশে পূর্ববর্তী শাসনব্যবস্থার বদল ঘটিয়ে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বা শাসনকাঠামো গ্রহণ করাকে বোঝানো হয়।
যা বুঝতে পারলাম, তাতে আতঙ্কিত হওয়ার কী আছে? ‘দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র’ তো আমি চাই, যদিও নিজেকে প্রজা ভাবতে রাজি নই। কিন্তু এটা কি সম্ভব, বাংলাদেশে? এমন-কি যে ইসলামি শাসনব্যবস্থার ইঙ্গিত করা হয়েছে দ্বিতীয় রিপাবলিকের নামে, তাও নয় সম্ভব। তবে সেটা সম্ভব হওয়া ঠিক হবে না। বাংলাদেশে যে-কোনো লোক যে-কোনো কিছু করতে পারে; কিন্তু সামগ্রিকভাবে কিছু করার জন্য যে ঐক্য দরকার, তা কখনো হবে না। এবার হতে পারতো, কিন্তু একটা প্রতারক গোষ্ঠি তা হতে দেয়নি। আর কিছু হবে না। পলিটিক্যাল স্টান্ট হবে, মব, রেলিজিয়াস পুলিশিং, চাঁদাবাজি, ধর্মব্যবসা, মাজার-ধ্বংস, তদবির, অগ্নিসংযোগ, ভাস্কর্য ভাঙা, মামলাবাণিজ্য, ধর্ষণ, সাম্প্রদায়িক হিংসা-হামলা, ভিন্নমতাবলম্বীর কণ্ঠরোধ সব হবে; কিন্তু ‘দ্বিতীয় রিপাবলিক’ হবে না। কারণ, এর জন্য দরকার বিপ্লব। এটা তো হবে না এদেশে। পৃথিবীর কোথাও বিপ্লবের সম্ভাবনা আছে কি?
দেশের বর্তমান নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে মানুষ শঙ্কিত, সন্ত্রস্ত। এমন বাস্তবতায় সামগ্রিকভাবে আপনি কেমন বাঙলাদেশ দেখতে চান?
তেমন বাংলাদেশ কখনো হবে না, যেমনটা চাই। ৫৩ বছরে ক্ষমতাসীন কোনো দল বৈষম্যমুক্ত, উদার ও দায়িত্বশীল সমাজ গঠনে মনোযোগ দেয়নি। কেবল নিজেদের পকেট গঠন আর সম্পদের বিকাশে আন্তরিক থেকেছে। কোনো দেশ/জাতি স্বাধীন হলে তার প্রথম প্রজন্ম লুটপাট করে, দ্বিতীয় প্রজন্মের একই অপকর্মের দরকার হয় না। তাদের একটা অংশ লুণ্ঠনের টাকায় ফুর্তি করে; আরেক অংশ কাজে লাগায়, মানে কেউ ব্যবসা করে, কারখানা বানায়, বিদেশে যায় উচ্চশিক্ষার জন্য। মোট কথা, তাদের লুটপাট করতে হয় না। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লুণ্ঠনে তৎপর। যারা এটা পারছে না, তারা সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছে। আর যাদের ধৈর্য কম বা নাই, তারা লুটেরাদের মাসলম্যান বা ভাড়াটে গুন্ডা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ঢাকা ও বিভিন্ন মফস্বলে বহু পরিবার আছে, প্রসিদ্ধ গুন্ডার পরিচয়ে চলে। গুন্ডার শক্তি, টাকার জোর, ক্ষমতার প্রভাব, ধর্মের আস্ফালন এইসব নিয়ে পরম শান্তিতে বাংলাদেশ পিছনের দিকে এগিয়ে চলেছে। আমি চাই আরও চলুক। চলতে চলতে শুয়ে পড়ুক। না শুলে, দাঁড়াবে কিভাবে? হে বাংলাদেশ, প্রাণের বাংলাদেশ, কেমন করে তুমি শোও, দেখি! বালিশটা আছে তো?
*****************************
চঞ্চল আশরাফ
কবি ও কথাসাহিত্যিক
*****************************