জুলাই অভ্যুত্থান কোন ভাবেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে খারিজ করে না
– হাসান তারিক চৌধুরী
আশা করছি কুশলে আছেন। আপনার কী মনে হয়- ভালো থাকা, না- থাকা একটি রাজনৈতিক ঘটনা?
ভালো থাকা না থাকা অবশ্যই রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে। আর যেহেতু রাজনীতি দেশের ও জনগণের অর্থনীতি- সমাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে রাজনীতির উপরই মানুষের ভালো থাকা বহুলাংশে নির্ভর করে। রাজনীতি অস্থিতিশীল থাকলে মানুষও ভালো থাকে না।
২০২৪-এর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনকে আপনি কীভাবে দেখেন? প্রধান উপদেষ্টা্র কথিত “ম্যাটিকুলাসলি প্ল্যানড” সম্পর্কে আপনি কি ভাবেন?
২০২৪ এর অভ্যুত্থান বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের অপশাসন ও গনতন্ত্রহীনতার অনিবার্য পরিনতি। যে কোন গণঅভ্যুত্থানে স্বতঃস্ফূর্ত এবং মেটিকুলাস উভয় ধরনের পরিকল্পনাই থাকে। কিন্তু দেখতে হবে অভ্যুত্থানের রাজনৈতিক নেতৃত্ব বহুমতের প্রতি এবং গণতন্ত্রের প্রতি ওয়াদাবদ্ধ কি না?
জুলাই আন্দোলনের শুরুতে আপনার বিবেচনা কেমন ছিল?
জুলাই আন্দোলনের শুরুতে আমার মতো অধিকাংশ মানুষই মনে করেছে, পুলিশ, বিজিবি এবং দলীয় গুন্ডা লেলিয়ে দিয়ে ছাত্র-শ্রমিক- জনতার আন্দোলন দমন করা যাবে না। আমি বিভিন্ন জনসমাবেশ এবং টেলিভিশন আলোচনাতেও বলেছি, আন্দোলনের বিজয় হবে।
৫ই আগস্টের রাজনৈতিক রদবদলের পর আপনার ভাবনা, কী দুর্ভাবনা কোন বিষয়ে আবর্তিত হচ্ছিল?
৫ আগষ্টের রাজনৈতিক রদবদলের পর আমার ভাবনায় ছিলো যে, দেশে সুশাসন নিশ্চিত করতে সবাই তৎপর হবে। মব নৈরাজ্য হবে না। কিন্তু বাস্তবে মব নৈরাজ্য এবং মব সন্ত্রাসই গণতন্ত্রের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়ালো। আমার দুর্ভাবনা ছিলো, ধর্মীয় উগ্রবাদের নবায়িত উত্থান নিয়ে। সেই আশংকা সত্য হলো। দেশে নারীর প্রতি বিদ্বেষ, সংহিসতা, বাউল, সুফি, মাজারে হামলা এক বিরাট উদ্বেগের বিষয়।
জুলাই অভ্যুত্থানকে আমাদের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের নিরিখে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
জুলাই অভ্যুত্থান কোন ভাবেই ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে খারিজ করে না। মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ছিলো শোষণ বৈষম্যহীন বাংলাদেশ। জুলাই অভ্যুত্থানও সেটাই বলে। কিন্তু আজ কেউ কেউ অভ্যুত্থানের মূল শ্লোগান থেকে বিচ্যুতির রাজনীতি করতে চাইছে।
এতো রক্তপাতের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট শক্তির পতন হলো। মানুষ আশাবাদী হলো। প্রধান উপদেষ্টার বলা “রিসেট বাটন চেপে দিয়েছি” প্রচারিত হবার পর থেকে দেশে ব্যাপকভাবে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য, স্থাপনা, স্মৃতিস্তম্ভ ধ্বংস করা হলো। মুক্তিযোদ্ধার কবরে আগুন দেয়া হলো। এসব ঘটনাকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
জুলাই অভ্যুত্থানের স্পিরিট কখনোই মুক্তিযুদ্ধের ন্যারেটিভস এর বিরুদ্ধে নয়। কিন্তু রিসেট বাটন তত্ত্ব দিয়ে নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধকেই প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা হয়েছে।
জুলাই অভ্যুত্থানের পর রাজনীতির মাঠে একটা বল ক্রিয়াশীল আছে-সুস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে যে, এরা কট্টর ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী- যারা বলছে ধর্মীয় মূল্যবোধ ছাড়া গণতান্ত্রিক সমাজ গঠিত হতে পারে না। এই বয়ানকে আপনি কীভাবে দেখেন?
যে কোন সভ্য গনতান্ত্রিক সমাজে রাজনৈতিক ধর্ম অথবা ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক দলসমূহকে বহুদলীয় গণতন্ত্র এবং মুক্তবুদ্ধির চর্চার প্রতিবন্ধক বলে গন্য করা হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তাই।
ইসলাম একত্ববাদী। ইসলামিস্ট দলগুলোর বহুত্ববাদের শ্লোগানকে আপনি কিভাবে দেখেন?
শুধু ইসলামি দল নয়, যে কোন ধরনের ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক দলই বহুত্ববাদের চর্চার বিরোধী। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এর উদাহরণ রয়েছে।
বাংলাদেশকে দ্বিতীয় রিপাবলিক হিসাবে দেখতে আপনি আগ্রহী, নাকি আতঙ্কিত?
দ্বিতীয় রিপাবলিকের কন্সেপ্ট এখনো বাংলাদেশের প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল সমূহের কাছে স্পষ্ট নয়। এটি এখনো বিভ্রান্তিমূলক। বাংলাদেশের সংবিধানের কিছু প্রয়োজনীয় সংশোধন সাপেক্ষে এবং ১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল আকাংখা ৭২ সংবিধানে চার মূলনীতির আলোকেই বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া সম্ভব।
দেশের বর্তমান নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে মানুষ শঙ্কিত, সন্ত্রস্ত। এমন বাস্তবতায় সামগ্রিকভাবে আপনি কেমন বাঙলাদেশ দেখতে চান?
দেশের বর্তমান বাস্তবতায় অতি দ্রুত একটি বিশ্বাসযোগ্য, অবাধ এবং নিরপেক্ষ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সাধারণ জনগণের আন্তরিক চাওয়া। ফলে, একটি নির্বাচিত গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সরকারই দেশের রাজনীতি এবং অর্থনীতির গণতান্ত্রিক রূপান্তর ঘটাতে পারবে বলে আমি আশা করি। ধন্যবাদ।
***********************************
এডভোকেট হাসান তারিক চৌধুরী
সাধারণ সম্পাদক
বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতি
আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন
************************************