You are currently viewing দ্বিজাতিতত্ত্বকে কবর দিয়ে বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছিল তার পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়- দীপেন ভট্টাচার্য

দ্বিজাতিতত্ত্বকে কবর দিয়ে বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছিল তার পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়- দীপেন ভট্টাচার্য

দ্বিজাতিতত্ত্বকে কবর দিয়ে বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছিল তার পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়
– দীপেন ভট্টাচার্য

আশা করছি কুশলে আছেন। আপনার কী মনে হয়- ভালো থাকা, না- থাকা একটি রাজনৈতিক ঘটনা?

নিশ্চয়। পৃথিবীর যে কোনো জায়গায় থাকুন না কেন সেখানকার এবং সারা বিশ্বের চলমান রাজনৈতিক ঘটনা আপনার জীবনকে প্রভাবিত করবে। যেমন নতুন ট্রাম্প প্রশাসনের কার্যক্রম সরাসরি আমার দৈনন্দিন মানসিক অবস্থার ওপর প্রভাব ফেলছে, অন্যদিকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়েও চিন্তিত হচ্ছি। আবার ইজরায়েল-ফিলিস্তিন কিংবা ইউক্রেন-রুশ সংঘর্ষও ভালো থাকতে দিচ্ছে না। মাঝে মধ্যে সুদানে কী হচ্ছে তা নিয়েও ভাবি। বৈশ্বিক নাগরিক হিসেবে আমার ভালো মন্দ বিশ্বের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিবেশের সঙ্গে যুক্ত।

২০২৪-এর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনকে আপনি কীভাবে দেখেন? প্রধান উপদেষ্টা্র কথিত “ম্যাটিকুলাসলি প্ল্যানড” সম্পর্কে আপনি কি ভাবেন?

এটা জটিল প্রশ্ন। হয়তো রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের একটা প্রয়োজন ছিল, কিন্তু সেটি যদি পেছনের একটি গোপন সুনিয়িন্ত্রিত পরিকল্পনার অংশ হয়ে থাকে তাহলে বলব সাধারণ মানুষকে কিছুটা ধোঁকা দিয়ে ব্যাপারটা করা হয়েছে।

জুলাই আন্দোলনের শুরুতে আপনার বিবেচনা কেমন ছিল?

আন্দোলনের শুরুতে আমি এটাকে বিশেষভাবে অনুসরণ করছিলাম না, প্রথমে ভেবেছিলাম এটা রাজপথ আন্দোলনের মতন একটা ব্যাপার। পরবর্তীকালে সরকার যখন এটাকে সুকৌশলে একটা সমঝোতার ভিত্তিতে এড়িয়ে যেতে পারত তখন ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম, বিশেষত যখন প্রাণহানির ঘটনা ঘটতে থাকল।

৫ই আগস্টের রাজনৈতিক রদবদলের পর আপনার ভাবনা, কী দুর্ভাবনা কোন বিষয়ে আবর্তিত হচ্ছিল?

৫-ই আগস্টের অব্যবহিত পরেই বোঝা গেল কারা এই আন্দোলনকে চালনা করেছে, যেটা আগে বোঝা যায়নি। বঙ্গবন্ধুর বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া এবং দেশব্যাপী মুক্তিযোদ্ধাদের ভাস্কর্য ভেঙে দেবার মাধ্যমে বোঝা গেল আগের থেকেই এগুলো একটা তালিকায় ছিল। একই সাথে সেই সময় ঢাকার বাইরে হিন্দুদের ওপর আক্রমণ এবং পরবর্তীকালে মাজার ভেঙে দেবার যে প্রক্রিয়া চলল তাতে খুবই মনোকষ্টে ছিলাম, এখনো আছি। সরকার থেকে যে এগুলো প্রতিরোধের বিশেষ চেষ্টা ছিল বলে মনে হয়নি।

জুলাই অভ্যুত্থানকে আমাদের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের নিরিখে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে উদ্ভূত বাংলাদেশের কিছু আদর্শ ছিল। একটি আধুনিক রাষ্ট্রের জন্য ধর্মনিরপেক্ষতা অন্যতম স্তম্ভ এবং পূর্ব পাকিস্তান থেকে যে আইডিওলজি বাংলাদেশ পৃথক করে সেটি হলো ধর্মনিরপেক্ষতা। স্বাধীনতা লাভের পরে প্রতিটি সরকারই ধীরে ধীরে এই বোধটিকে খর্ব করেছে, এমনকি শেখ হাসিনার সরকার ১৬টি বছর ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও ১৯৭২-এর সংবিধানে ফিরে যায়নি। সাহস দেখাতে পারেননি, বরং আপোষ করেছেন। তো তাতে লাভ কী হলো? শেষ পর্যন্ত আমও গেল, ছালাও গেল। উনি যদি মুক্তিযুদ্ধের মূল আদর্শ সামনে রেখে কাজ করতেন, দুর্নীতিকে প্রশ্রয় না দিতেন, সুষ্ঠ নির্বাচন দিতেন এবং তাতে যদি হেরেও যেতেন, তাহলেও আজ বঙ্গবন্ধুর বাড়িকে সরকারি প্রশ্রয়ে বুলডোজার দিয়ে কেউ ভাঙার সাহস পেত না।

এতো রক্তপাতের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট শক্তির পতন হলো। মানুষ আশাবাদী হলো। প্রধান উপদেষ্টার বলা “রিসেট বাটন চেপে দিয়েছি” প্রচারিত হবার পর থেকে দেশে ব্যাপকভাবে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য, স্থাপনা, স্মৃতিস্তম্ভ ধ্বংস করা হলো। মুক্তিযোদ্ধার কবরে আগুন দেয়া হলো। এসব ঘটনাকে আপনি কিভাবে দেখছেন?

এসব দেখে হৃদয় ভেঙে যাচ্ছে। ৫-ই আগস্টের পরে একটি দিনও যায়নি যে এসব ঘটনা আমাকে মূহ্যমান না করে রাখছে।

জুলাই অভ্যুত্থানের পর রাজনীতির মাঠে একটা বল ক্রিয়াশীল আছে-সুস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে যে, এরা কট্টর ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী- যারা বলছে ধর্মীয় মূল্যবোধ ছাড়া গণতান্ত্রিক সমাজ গঠিত হতে পারে না। এই বয়ানকে আপনি কীভাবে দেখেন?

এই বয়ান বাংলাদেশের মূল ভিত্তিভূমির বিরুদ্ধে বয়ান। যে দ্বিজাতিতত্ত্বকে কবর দিয়ে বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছিল তার পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়। আধুনিক সমাজ ধর্মীয় মূল্যবোধ নিয়ে গড়া হয় না, বরং সামগ্রিকভাবে সমাজের সকল নাগরিকের মঙ্গলে গৃহীত পৌর আইনব্যবস্থায় চালিত হয়। পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত দেশগুলির উদাহরণ তো দেওয়াই যায়। আফগানিস্থান তো এক ধরণের ধর্মীয় মূল্যবোধ দিয়ে চালিত হচ্ছে, বাংলাদেশকে কি সেখানে নিয়ে যাবার পরিকল্পনা?

ইসলাম একত্ববাদী। ইসলামিস্ট দলগুলোর বহুত্ববাদের শ্লোগানকে আপনি কিভাবে দেখেন?

মানব জীবন বৈচিত্রময়। প্রতিটি মানুষ ভিন্ন, তাদের নিজস্ব পথ আছে। যতক্ষণ না সেটি অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ করে তাকে সেই পথে চলতে দেওয়া রাষ্ট্রের কর্তব্য। এখানে শুধু একটা কথা বলা প্রয়োজন – সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা মুছে দিয়ে বহুত্ববাদ যদি লেখা হয় তা নিতান্তই ধোঁকাবাজি, কারণ বহুত্ববাদের কী সংজ্ঞা সেটা তারা ঠিক করেনি। ঠিক করলে তারা ক্রমাগত মাজারগুলির ওপর হামলা করত না।

বাংলাদেশকে দ্বিতীয় রিপাবলিক হিসাবে দেখতে আপনি আগ্রহী, নাকি আতঙ্কিত?

দ্বিতীয় রিপাবলিকের ব্যাপারে আমি সেরকম কিছু জানি না। নতুন সংসদ হবে, সেটা যেভাবেই হোক তার নামে কেন দ্বিতীয় রিপাবলিক হবে তা বোধগম্য নয়।

দেশের বর্তমান নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে মানুষ শঙ্কিত, সন্ত্রস্ত। এমন বাস্তবতায় সামগ্রিকভাবে আপনি কেমন বাঙলাদেশ দেখতে চান?

বাংলাদেশকে আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে হলে সমাজের তৃণমূলে যে পশ্চাদপদতা জন্মেছে তাকে দূর করতে হবে। স্বাধীনতার পর থেকেই ধীরে ধীরে এক ধরণের পিছনমুখী ধর্মীয় ধারনাকে মূল্য দেওয়া হয়েছে যেটার থেকে এই বাংলাদেশকে মুক্ত করা খুব কঠিন। যারা এই ব্যাপারে মধ্যপন্থা অবলম্বন করে এই প্রক্রিয়াকে পরোক্ষভাবে সাহায্য করছেন তাদের শেষ পর্যন্ত জীবন অসহনীয় হয়ে যাবে। যারা এই সমাজকে সম্মুখমুখী দেখতে চান, সবার সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকার বজায় রাখতে চান, তারা যেন তাদের দায়িত্ব পালন করেন।
*****************************

দীপেন ভট্টাচার্য
কবি ও বিজ্ঞানী
*****************************

Leave a Reply