নজরুলের ভাবনায় শ্যামা সংগীত
পীযূষ কুমার ভট্টাচার্য্য
কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) বিচিত্র পর্যায়ের সংগীত রচনা করেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি পর্যায় হলো শ্যামা সংগীত। শ্যামা মায়ের বিভিন্ন রূপকে হৃদয়ে লালন করে প্রাসঙ্গিক বাণী ও সুরের সাযুজ্যে যে সংগীত রচনা করা হয়েছে সমাজে সেটিকে ‘শ্যামা সংগীত’ মনে করা হয়। অথবা সনাতন হিন্দু ধর্মের দেবী শ্যামা বা শক্তির উদ্দেশ্যে রচিত এক ধরনের গান হলো ‘শ্যামা সংগীত’। শ্যামা সংগীত এক ধরনের ভক্তিগীতি। খ্রিস্টিয় দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকে বাংলায় বৈষ্ণব ধর্মের পাশাপাশি শাক্ত ধর্মের উদ্ভব হয়। অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি শাক্তগীতি চর্চার একটি ধারার প্রচলন হয়। সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন (আনুমানিক ১৭২০-১৭৮২ খ্রিস্টাব্দ) সে ধারায় প্রাণ সঞ্চার করে বাংলা গানের জগতে ‘শাক্তপদাবলী বা শ্যামা সংগীত’ নামে একটি বিশেষ সংগীত ধারা প্রতিষ্ঠিত করেন। অর্থাৎ রামপ্রসাদ হলেন শাক্ত সংগীত রচনার পথিকৃৎ। রামপ্রসাদ তাঁর শ্যামা সংগীতে দেবতা ও মানবকুলের মধ্যে ব্যক্তিতান্ত্রিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। পুরাণে বর্ণিত ভয়ঙ্করী, লোলরসনা কালীকে তিনি স্নেহবাৎসল্য মাতৃরূপে উপস্থাপন করেন। রামপ্রসাদ বাংলা মঙ্গলকাব্যের আখ্যানগীতিকার ধারা ক্ষয়িষ্ণু হয়ে আসলে তিনি শক্তিদেবীর মাহাত্ম্যকে অজস্র গীতরচনায় উচ্ছ্বসিত করে তোলেন। কীর্তন যেমন বৈষ্ণব পদাবলী অবলম্বনে গাওয়া হয়, তেমনি শ্যামা সংগীতও শাক্ত পদাবলী অবলম্বনে গাওয়া হয়। শাক্ত পদাবলীর কাঠামো গঠিত হয়েছিল বৈষ্ণব পদের কাঠামো অনুসরণে। তাই বাৎসল্য রসের পদাবলী হিসেবে শাক্ত পদাবলী বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। উলেখ্য রামপ্রসাদের হাত ধরেই শ্যামা সংগীত জনপ্রিয়তা লাভ করে। বাংলার মধ্যযুগ থেকে বৈষ্ণবরা কীর্তন রচনা করেন। রামপ্রসাদ শ্যামা সংগীতকে সহজ আবেদনপূর্ণভাবে তুলে ধরেন। বাণী, সুর ও গায়নভঙ্গিতে শ্যামা সংগীত এমন এক ধারার প্রচলন করেন, যা এক স্বতন্ত্র পরিচিতি লাভ করে। তাঁর শ্যামা সংগীতগুলো রামপ্রসাদী গান হিসেবে পরিচিত। রামপ্রসাদের শ্যামা সংগীতে সমসাময়িক অসঙ্গতি দূর করার আহ্বান ফুটে উঠে। তিনি শ্যামা সংগীতের জনক হলেও তাঁর রচনার সাথে নজরুলের রচনার কিছু মিল খুঁজে পাওয়া যায়। অষ্টাদশ শতাব্দীর কালী যে সে সময়কার সামাজিক পরিস্থিতি থেকে মানবকুলকে রক্ষা করার জন্যে পূজিতা হয়েছেন, তা থেকে কিছুটা সরে আসেন নজরুল। কারণ সেই সময়কার সামাজিক অবস্থা ও রাজনীতি গেছে বদলে। নজরুলের সমকালীন সমস্যাকে ও শত্রুকে নিধন করতেই তাঁর মাতৃবন্দনা। তিনি মাতৃ-আরাধনায় গেয়েছেন ‘মানবধর্মের’ জয়গান-(‘আয় অশুচি আয়রে পতিত/ এবার মায়ের পূজা হবে’)। ‘নবীন মন্ত্রে’ কবি পুজো করতে চান মাতাকে। নজরুল ১৯৩০-৩১ অর্থাৎ ১৩৩৭ বঙ্গাব্দ থেকে শ্যামা সঙ্গীত রচনা শুরু করেন। তাঁর ভাবনায় শ্যামা সংগীতগুলো এই ভুবনে এক অনন্য মাত্রা পেয়েছে।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে যখন উদ্বেগজনক সামাজিক পরিস্থিতি বিরাজ করে মানুষ তখন এক অস্থিরতার শিকার, সেই অবস্থায় বৈষ্ণব ধর্মের শান্ত প্রেমসাধনার মানবকূলকে সান্তনা দেবার মতো ক্ষমতা ছিল না। সেই সময় প্রয়োজন হয়েছিল শক্তিরূপিণী কালীর। একথা সত্য যে, অষ্টাদশ শতাব্দীর দুর্যোগময় সামাজিক পরিস্থিতিতে শক্তি লাভের উদ্দেশ্যেই কালীর সাধনা বেড়ে যায়। তিনি তাঁর করাল ও ভয়ঙ্কর রূপ ও ক্ষমতার দ্বারা রক্ষা করতে পারেন তাঁর সন্তাানদের। মা কালী একাধারে রক্ষাকর্ত্রী আবার আর এক দিকে তিনি জগজ্জননী। কোমল স্বভাবের বাঙালির দেবতা ধরা দেন সখা ও প্রেমিক রূপে। তাই ভয়ঙ্করী উগ্রচণ্ডী মহাশক্তিও বেশিদিন রইতে পারলেন না তাঁর উগ্ররূপে। তিনি হয়ে গেলেন বাঙালির ঘরের মেয়ে-ও একান্ত আপন জননী। কাজী নজরুল ইসলামের- ‘শাক্ত পদাবলীগুলিও এই নিয়মের বাইরে নয়। তাই তাঁর কালোমেয়ের উগ্ররূপের অন্তরালে কবি উপভোগ করেন সৌন্দর্য স্বরূপিণী জননীকে-যাঁর রূপ দেখে স্বয়ং মহাদেবও দেন বুক পেতে। তন্ত্রের দেবী শক্তিকে নতুন মাত্রা দিয়ে কবি সৃষ্টি করলেন এক মধুর স্নিগ্ধ জননী মূর্তি – কখনো তিনি দেবী – কখনো কন্যা, ভক্ত যাঁকে চোখে হারান প’লে প’লে। ভক্তহৃদয়ের বিভিন্ন অনুভূতিতে ভর করে কালী, দুর্গা, উমা, চণ্ডী হয়ে যান ঘরের মেয়ে।’১
শাক্ত পদে আরাধ্যা জননী শক্তির সঙ্গে ভক্তের সম্পর্ক যেমন সামাজিক, তেমনি সর্বোপরি সাংসারিকও। পুরাণে শক্তিকে বিভিন্নভাবে পাওয়া যায়। কখনো তিনি ভয়াল ভয়ঙ্করী চামুণ্ডা, কখনো তিনি স্নিগ্ধ মাতৃরূপা, আবার কখনো দেবী স্নিগ্ধ কন্যা স্বরূপিণী। প্রাচীন অনার্য নারী দেবতা চণ্ডী। চণ্ডী হলো শক্তিরূপিণী। তিনি প্রাচীন অনার্য সমাজে শতাধিক নামে পূজিতা হতেন। সময়ের ব্যবধানে আর্য সমােেজ তিনি শিব বা হরগৃহিণীরূপে শিবানী, উমা, গৌরী, তারা প্রভৃতি নামে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। পৌরাণিক যুগে এঁর সম্মান ও প্রতিষ্ঠা অসামান্যরূপে বেড়ে যায়। দশ প্রকার শক্তির আধাররূপে তাঁর দশমহাবিদ্যার দশ মূর্তি পরিকল্পিত হয়েছে। তাঁরা হলেন : কালী, তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমন্তা, ধূমাবতী, বগলা, মাতঙ্গী ও কমলা। দশমহাবিদ্যার দশ রূপের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা তুলে ধরা হলো :
কালী : দশমহাবিদ্যার প্রথম হল কালী। মহাভাগবতের মতে মহাকালীই হচ্ছেন মুখ্য (প্রধান) এবং তাঁর উগ্র ও সৌম্য দুই রূপের অন্তবর্তী অনেক রূপ ধারণকারিণী হল দশমহাবিদ্যা। বিদ্যাপতি ভগবান মহাদেবের শক্তি এই দশমহাবিদ্যা অনন্ত সিদ্ধি প্রদানকারিণী। দার্শনিক দিক থেকেও কালতত্ত্বের প্রাধান্যই সবার উপরে।
তারা : ভগবতী কালীকেই নীলবরণা হওয়ায় তারাও বলা হয়। আবার কোনও মতে তারা নামের রহস্য এই যে ইনি সর্বদা মোক্ষদায়িনী, তারিণী, তাই তাঁকে তারা নামে ডাকা হয়। মহাবিদ্যার মধ্যে এঁর স্থান দ্বিতীয়। বিনা আয়াসেই বাক্শক্তি প্রদানে সমর্থা, এইজন্য এঁকে নীলসরস্বতীও বলা হয়। ভয়ানক বিপদ থেকে ভক্তকে রক্ষা করেন এইজন্য তিনি উগ্রতারা।
ষোড়শী : মাহেশ্বরী শক্তির সবচেয়ে সুন্দর শ্রীবিগ্রহধারিণী সিদ্ধ দেবী হলেন ষোড়শী।
ভুবনেশ্বরী : দেবীভাগবতে বর্ণিত মনিদ্বীপের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হৃলেখা (হ্রীং) মন্ত্রের স্বরূপশক্তি এবং সৃষ্টির ক্রমপর্যায়ে মহালক্ষ্মীস্বরূপা-আদিশক্তি ভগবতী ভুবনেশ্বরী হচ্ছেন দেবাদিদেব মহাদেবের সমস্ত লীলাবিভূতির সহচরী। জগদম্বা ভুবনেশ্বরীর স্ব-রূপ হচ্ছে সৌম্য এবং অঙ্গকান্তি অরুণবর্ণ। ভক্তকে অভয় প্রদান ও সর্বসিদ্ধি প্রদান করাই হল এঁর স্বাভাবিক গুণ।
ভৈরবী (ত্রিপুরভৈরবী) : ক্ষীয়মাণ বিশ্বের অধিষ্ঠান হল দক্ষিণামূর্তি কালভৈরব। সেই ভৈরবের শক্তিই ত্রিপুরভৈরবী। ইনি ললিতা বা মহাত্রিপুরসুন্দরীর রথবাহিনী। ব্রহ্মাণপুরাণে এঁকে গুপ্তযোগিনীদের অধিষ্ঠাত্রী দেবীরূপে চিত্রিত করা হয়েছে। মৎস্যপুরাণে এঁর ত্রিপুরভৈরবী, কোলেশভৈরবী, রুদ্রভৈরবী, চৈতন্যভৈরবী ও নিত্যভৈরবী ইত্যাদি রূপের বর্ণনা পাওয়া যায়।
ছিন্নমস্তা : পরিবর্তনশীল জগতের অধিপতি হচ্ছেন কবন্ধ আর কবন্ধের শক্তি হলেন ছিন্নমন্তা। বিশ্বের হ্রাস-বৃদ্ধি তো সর্বদা হয়েই চলেছে। হ্রাসের মাত্রা যখন কম এবং বিকাশের মাত্রা বেশি হয় তখন ভুবনেশ্বরীর আবির্ভাব হয় এর বিপরীত প্রক্রিয়ায় অর্থাৎ নির্গম বেশি এবং আগম কম হলে ছিন্নমন্তার প্রাবল্য হয়।
ধূমাবতী : ধূমাবতী দেবী মহাবিদ্যাদের মধ্যে সপ্তম স্থানে আছেন বলে মনে করা হয়। এঁর সম্বন্ধে কাহিনীতে বলা হয়েছে যে একসময় ভগবতী পার্বতী ভগবান শিবের সাথে কৈলাস পর্বতে বসেছিলেন। মহাদেবের কাছে তিনি তাঁর ক্ষুধার কথা জানালেন এবং ক্ষুধা নিবারণের অনুরোধ জানালেন। কয়েকবার বলার পরেও যখন ভগবান শিব সে কথায় কান দিলেন না, তখন তিনি মহাদেবকেই তুলে নিয়ে গিলে ফেললেন। তাঁর শরীর থেকে ধূমরাশি বেরুতে লাগল। তখন ভগবান শঙ্কর পার্বতীকে বললেন ‘তোমার সুন্দর চেহারাখানা ধোঁয়ায় ঢেকে যাওয়ায় তোমাকে ধূমাবতী বা ধূম্রা বলে ডাকা হবে।’ ধূমাবতী মহাশক্তি একলা এবং স্বয়ং নিয়ন্ত্রিতা। তাঁর কোনও স্বামী বা প্রভু নেই। এইজন্য তাঁকে বিধবারূপে চিন্তা করা হয়।
বগলা (বগলামুখী) : ব্যাষ্টিরূপে শত্রুনাশের ইচ্ছাযুক্তা এবং সমষ্টিরূপে পরমাত্মার সংহারশক্তিই হলেন বগলা। পিতাম্বরাবিদ্যা নামে বিখ্যাত বগলামুখীর সাধনা প্রায়শই শত্রুভয়মুক্তি ও বাক্সিদ্ধি লাভের জন্য করা হয়। এঁর পূজায় হরিদ্রামালা, পীতপুষ্প এবং পীতবস্ত্রের বিধান আছে। মহাবিদ্যাগণের মধ্যে এঁর স্থান অষ্টম।
মাতঙ্গী : শিবের নাম মাতঙ্গ, তাঁর শক্তি মাতঙ্গী। মাতঙ্গীর ধ্যানে তাঁর রূপের বর্ণনায় আছে যে তিনি শ্যামবর্ণা, তাঁর শিরে অর্দ্ধচন্দ্রশোভিত। দেবী মাতঙ্গী ত্রিনয়না, রত্নসিংহাসনে আসীনা, তাঁর কান্তি নীলকমলের মত এবং বি¯তৃত অরণ্য সদৃশ্য রাক্ষসকুলকে ভস্ম করতে দাবানলের ন্যায়। দশমহাবিদ্যার মধ্যে এঁর স্থান নবম।
কমলা : শ্রীমদ্ভাগবতার অষ্টম স্কন্ধের অষ্টম অধ্যায়ে কমলার উদ্ভবের বিস্তৃত বর্ণনা আছে। দেবতা ও অসুরদের দ্বারা অমৃত লাভের উদ্দেশ্যে সমুদ্র মন্থনের ফলস্বরূপ তাঁর আবির্ভাব। ভগবান বিষ্ণুকে ইনি পতিত্বে বরণ করেছিলেন। মহাবিদ্যাদের মধ্যে ইনি দশম স্থানাধিকারিণী।২
উল্লেখ্য কথিত আছে দেবীর এই দশরূপ দর্শন করেন দেবতাদের মধ্যে মহাদেব এবং মানুষের মধ্যে একমাত্র সর্বানন্দ। তিনি চাঁদপুর জেলার, শাহরাস্তি উপজেলার, মেহার এ জন্মগহণ করেন।
নজরুল শ্যামা সংগীত রচনা করার পূর্ব থেকে তাঁর মধ্যে একটা মাতৃভাব জেগে উঠে। সেটির প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর কিছু রচনার মধ্যে। নজরুলের কবিতায় ভারতীয় আধ্যাত্মিকতা শক্তির উৎস হিসেবে মাতৃতান্ত্রিকতার প্রভাব মেলে। তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় ভারতীয় আধ্যাত্মিকতা বেদ, উপনিষদ, পুরাণের আলোকে স্রষ্টা ও সৃষ্টিতত্ত্বের শক্তি বিকাশের প্রমাণ মেলে। পৌরাণিক সময় থেকে বর্তমান পর্যন্ত সমাজে দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন, মানবিকতা ও সাম্যের কথা ফুটে ওঠে। বিদ্রোহী কবিতার প্রতিটি শব্দ, পঙক্তি এবং পৌরাণিক প্রতীকের অর্থ অত্যন্ত চমৎকার। আর্য-অনার্যের দ্বন্দ্বে নজরুল মূলত অনার্য এবং লোকসংস্কৃতির দিকে তাঁর কবিতা ও সাহিত্য সুমিষ্ট সুরে ফুটে ওঠে। শক্তির প্রভাব হিসেবে মহাকাল বা কালীশক্তি তাঁর কবিতায় জেগে ওঠে। কাজী নজরুলেরও অনন্য সৃষ্টি হলো শ্যামা সঙ্গীত। তাঁর উলেখযোগ্য শ্যামা সংগীতগুলো হলো : ‘আর লুকাবি কোথায় মা’ , ‘আমার কালো মেয়ের পায়ের তলায় ’, ‘শ্মশানে জাগিছে শ্যামা মা’, ‘আমার শ্যামা মায়ের কোলে চ’ড়ে’, ‘বল্ মা শ্যামা বল্ তোর বিগ্রহ কি মায়া জানে’, ‘শক্তের তুই ভক্ত শ্যামা (তোরে) যায় না পাওয়া কেঁদে’, ‘থির হয়ে তুই ব’স দেখি মা খানিক আমার আাঁখির আগে’, ‘শ্যামা বলে ডেকেছিলাম, শ্যাম হয়ে তুই কেন এলি ’,‘ আমি মা ব’লে যত ডেকেছি’, ‘শ্মশান-কালীর নাম শুনে রে ভয় কে পায়’, ‘মহাকালের কোলে এসে গৌরী হ’ল মহাকালী’ প্রভৃতি। তাঁর রচিত শ্যামা সঙ্গীতগুলোর মধ্য থেকে দুটো শ্যামা সংগীতরে প্রেক্ষাপট এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক তথ্য উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা হলো :
প্রেক্ষাপট : প্রতিভা সোম লিখেছেন, নজরুল কীর্তন লিখতে শুরু করেছিলেন তাঁর পিসিমার অনুরোধে। প্রতিভা সোম ঢাকা থেকে কলকাতায় এলে চুঁচুড়ায় তাঁর পিসেমশাইর বাড়িতে উঠতেন। তিনি স্থানীয় কলেজিয়েট স্কুলের সহকারি শিক্ষক ছিলেন। শ্যামা সংগীত রচনা করতে শুরু করেছিলেন নজরুল প্রখ্যাত গায়ক কৃষ্ণচন্দ্র দে’র অনুরোধে। ‘ঐ মহৎ শিল্পীর অনুপ্রেরণায় নজরুল সৃষ্টি করেছিলেন, ‘আর লুকাবি কোথায় মা’, ‘আমার কালো মেয়ের পায়ের তলায়’ ইত্যাদি অপূর্ব শ্যামা সংগীত।৩
কালী মা যে শক্তিরূপিণী চিন্ময়ী, তাঁর চরণে ঠাই পাবার জন্যে নজরুলের আকুল কামনা। যথার্থ উপাসনার পথ খুঁজতে কখনও বা মায়ের পায়ের জবার কাছেও নজরুলের মিনতি-‘বল্ রে জবা বল -্/ কোন্ সাধনায় পেলি শ্যামা মায়ের চরণ- তল’। ‘ভয়ঙ্করী কালীকে যখন বাংলার কবিরা রণরঙ্গিনী থেকে মাতৃরূপিণীতে পরিণত করলেন, তখন কাজী নজরুল ইসলামও তাঁদের সঙ্গেই মেনে নিতে পারলেন না মায়ের উগ্র ও কালো রূপ। কারণ সন্তানকালো হলে পিতা-মাতার মনের দুঃখকে ঢাকার জন্য তাঁরা নানা অজুহাত খাড়া করেন। এখানে নজরুল ইসলামের কালো মেয়ে রাগ করে কালি মাখেন – ‘আমার কালো মেয়ে রাগ করেছে, কে দিয়েছে গালি।/ রাগ ক’রে সে সারা গায়ে মেখেছে তাই কালি ॥
নজরুল বিপুল পরিমাণে ভক্তিভাবাশ্রিত গান রচনা করেন। তাঁর ভক্তিসঙ্গীত পর্যায়ে রচিত অনন্য অংশ হচ্ছে শ্যামা সঙ্গীত। শ্যামা সঙ্গীতের বিষয়বস্তু হলো শক্তিদেবী কালী বা শ্যামার মাহাত্ম্য বর্ণনা করা। নজরুলের ভক্তিসঙ্গীতে শ্যামা সংগীত ব্যতীত কীর্তন, ভজন ও অন্যান্য কিছু ভক্তিসঙ্গীতও রচনা করেন। তাঁর রচিত শ্যামা সংগীতগুলোতে প্রচুর রাগের ব্যবহার দেখা যায়। ভক্তকুলের মঙ্গলের জন্যে ব্রহ্মের বিভিন্ন রূপ কল্পনা করা হয়। সৃষ্টিকর্তার সাথে ভাবের সম্পর্ক স্থাপন করার চেষ্টা করা হয়। যার ফলে বৈষ্ণব পদাবলী হোক আর শাক্ত পদাবলী হোক না কেন, তাঁর রস বোঝার চেষ্টা করা হয়। বৈষ্ণব পদাবলীর ন্যায় ভাব হিসেবে শ্রেণী বিভাগ করলে শাক্ত পদাবলীকে বহুভাবে ভাগ করা যায়। যেমন : ১. বাল্যলীলা, ২. আগমনী, ৩. জগজ্জননীর রূপ, ৪. বিজয়া, ৫. মা কি ও কেমন, ৬. ভক্তের আকুতি, ৭. মনোদীক্ষা, ৮. ইচ্ছাময়ী মা, ৯. করুণাময়ী মা, ১০. কাল ভয় হারিণী মা, ১১. লীলাময়ী মা, ১২. ব্রহ্মময়ী মা, ১৩. মাতৃপূজা, ১৪. সাধনা শক্তি, ১৫. নাম মহিমা, ১৬. চরণ তীর্থ।৪
বিদেশিদের মধ্যেও নজরুলের শ্যামা সংগীত বিষয়ে জানার বেশ আগ্রহ রয়েছে। প্রফেসর ড. র্যাচেল ফেল ম্যাকডেরমট হলেন একজন নজরুল গবেষক। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন বার্নার্ড কলেজের দক্ষিণ এশীয় সংস্কৃতি বিভাগের চেয়ারপার্সন। ড. র্যাচেল তাঁর প্রবন্ধে বলেন, ‘বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে নজরুল চর্চা : একটি তুলনামূলক আলোচনা’। তাঁর এই প্রবন্ধে শ্যামা সংগীতকে এক অনন্য মাত্রায় তুলে ধরেন :
কবি নজরুল ইসলামকে জানার জন্য আমার আগ্রহের সবচেয়ে কেন্দ্রবিন্দু ছিল তাঁর অসীম-অনন্ত অসাম্প্রদায়িক চেতনা। সেইসঙ্গে একজন মুসলিম কবি হয়েও তিনি যে আন্তরিকতার সাথে হিন্দু বা সনাতন ধর্মের জন্য কীর্তন, শ্যামা সঙ্গীত লিখেছেন তা অসাম্প্রায়িক কবি মানসের পরিচায়ক। একইভাবে তিনি নিজের ধর্মের জন্যও অসংখ্য গান-কবিতা রচনা করেছেন।৫
শ্যামা মাকে-গৌরী, উমা, দুর্গা ও কালী-এ চার স্বরূপে তাঁর মহিমা বর্ণনা করা হয়েছে। বৈষ্ণব পদাবলীতে মধুর রসের প্রাধান্য দেখা যায়। কিন্তু শ্যামা সঙ্গীতে রয়েছে মান-অভিমানের সুরের প্রবলতা। শ্যামা সংগীতে সমন্বয়বাদের সুর রয়েছে। এ সংগীতে শ্যাম (কৃষ্ণ) ও শ্যামা (কালী) যে অভিন্ন তা ভাবা হয়েছে। নজরুলের শ্যামা সংগীতে দেশাত্মবোধের প্রেরণাও অতুৎজ্জ্বল। তাঁর অনন্য প্রতিভার দান হলো শ্যামা সংগীত । কাজী নজরুল এই ধারার গান রচয়িতা হিসেবে শ্রেষ্ঠ সংগীত রচয়িতা। মনে করা যেতে পারে বাংলা গানের ইতিহাসে যে সব শ্যামা সংগীত কালজয়ী গৌরব লাভ করেছে তারমধ্যে নজরুল রচিত গানের সংখ্যাই বেশি।
একবিংশ শতাব্দীতে এসেও সমকালীন পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে ঐশ্বর্য ছড়িয়ে আছে নজরুল রচিত শ্যামা সংগীতে। নজরুলের সূর্যকরোজ্জ্বল এক সৃষ্টি হলো শ্যামা সংগীত। তাঁর রচিত শ্যামা সংগীত নান্দনিকতার যে স্তরে উত্তীর্ণ হয়েছে তা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে উচ্চস্তরে বহমান থাকবে। নজরুলের শ্যামা সংগীত শুধু যে চিত্ত বিনোদনের জন্যে রচিত হয়েছে তাই নয়, তাঁর রচিত শ্যামা সংগীতগুলো সমসাময়িক অসঙ্গতি দূর করার এক প্রতিবাদী ভাষাও বটে।
তথ্যঋণ :
ড.মাধুরী সরকার : গানের ভুবন : কাজী নজরুল, অকাদেমি অফ ফোকলোর, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ, আগস্ট, ২০০৪, পৃ. ৬৫
দশমহাবিদ্যা : প্রকাশক, গীতাপ্রেস, গোরক্ষপুর, কলকাতা,। ৬ষ্ঠ পুনর্মুদ্রণ, ২০০৮, পৃ. ৩-২১
রফিকুল ইসলাম : কাজী নজরুল ইসলাম : জীবন ও সৃজন, নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা, প্রথম মুদ্রণ, ফেব্রুয়ারি ২০১২, পৃ. ৪৫৯-৪৬০
লীনা তাপসী খান : নজরুল-সঙ্গীতে রাগের ব্যবহার, নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা, প্রথম মুদ্রণ, ফেব্রুয়ারি ২০১১, পৃ. ৯৪
খান ফেরদৌসর রহমান : বিদেশীর নজরুল-চর্চা, নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা, প্রথম মুদ্রণ, জুন ২০১৬, পৃ. ৬৭
পরিচিতি :
লেখক ও নজরুল গবেষক
**********************
very informative articles or reviews at this time.