You are currently viewing কায়েস আহমেদের গল্পপাঠ/ জাকির তালুকদার

কায়েস আহমেদের গল্পপাঠ/ জাকির তালুকদার

কায়েস আহমেদের গল্পপাঠ

জাকির তালুকদার

কায়েস আহমেদের গল্প পড়লে মনে হবে পাঠক কয়েক হাত জলের তলায় ডুবে আছেন। বাতাসের অভাবে তার বুকে আগুন জ্বলছে। বুকের পেশিগুলো ফেটে যাবার উপক্রম। তিনি প্রাণপণ চেষ্টা করছেন নিজেকে জলের ওপরে টেনে তুলতে। জলের ওপরে আছে বিশুদ্ধ বাতাস। পরশ পাথরের মতো এ বাতাস তাকে মুক্তি দিবে নিশ্বাসহীনতার অভিশাপ থেকে। সর্বোচ্চ চেষ্টা করে তিনি একটা হাত ঠেলে দিতে পারলেন জলের ওপরে। কবজি পর্যন্ত। মনে প্রবল আশা, কেউ একজন কবজি ধরে টেনে তুলবে তাকে। কিন্তু কেউ নেই! তার হাত ধরার। কিংবা তাকে মুক্তি দেবার। এ অসহনীয় শ্বাসরোধী কষ্টই তার নিয়তি। এভাবে বুকে জগদ্দল নিয়ে মৃত্যুবরণ করাই তার নিয়তি।
এক কথায় কায়েস আহমেদকে দুঃখবাদী বলে ঘোষণা করে দিলে প্রথাগত আলোচকদের অনেক সুবিধা হতো। কিন্তু দুঃখবাদীদের সঙ্গে রোমান্টিকতার যে দুর্মর সংযোগ, কায়েস আহমেদ তার থেকে শত হাত দূরে। এমনকি তার গল্পে স্বপ্নাচ্ছন্নতার অবকাশ পর্যন্ত নেই। তার চরিত্ররা স্বপ্ন দেখে কদাচিৎ। দেখলেও সেটা দুঃস্বপ্ন। সাহিত্যের নামে মিথ্যা স্বপ্নের বেসাতি ফেরি করে বেড়াননি কায়েস আহমেদ। বরং পাঠককে জানিয়ে দিতে চেয়েছেন তার নিজের অবস্থান। যাতে মধ্যবিত্ত পাঠক জানে যে, তার কবজি ধরে টেনে তুলবার কেউ নেই। প্রাণ বাঁচাতে যা করা দরকার, তার নিজেকেই সেটি করতে হবে।
এরকম একজন লেখকের জনপ্রিয় হবার কোনো সুযোগ নেই আমাদের দেশে। এমনকি বোদ্ধা পাঠক বলতে যাদের বোঝায়, তারাও খুব একটা স্বস্তি নিয়ে পাঠ করেন না এ ধরনের গল্প। ফলে খুব সহসাই হারিয়ে যাবার আশঙ্কা থাকে কায়েস আহমেদের মতো লেখকদের। তারা শুধু পঠিত হন সেই ছোট্ট গোষ্ঠীর দ্বারা, যারা পরিস্থিতিটা বোঝেন, স্বীকার করেন এবং এ থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজে বেড়ান নিরন্তর। এদের কাছেই কায়েস আহমেদ প্রাসঙ্গিক।
কায়েস আহমেদের আত্মহত্যাকে কেউ কেউ নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখেন। তাকে হেরে যাওয়া মানুষ, (উল্লেখ্য কায়েস আহমেদ আত্মহত্যা করেন ১৯৯২ সালের ১৪ জুন) পলায়নপর মানুষ ভাবেন। যিনি জলের অতলে ডুবে থেকে উপরের দিকে আকুল প্রত্যাশায় চেয়ে থেকেও কোনো আলোর আভাসমাত্র পাননি, যার জলের তলায় হাত-পা ছোড়াছুড়ি করার সামর্থ্যটুকু শেষ হয়ে গেছে, সে যদি শেষ পর্যন্ত হার স্বীকার করে নেয়, তাকে পরাজিত বলা যায় কিন্তু পলায়নবাদী কি বলা যায়? বিশেষত কায়েস আহমেদের রচনাবলি পাঠ করার পরে তাকে পলায়নবাদী আখ্যা দিতে দ্বিধা হয়।
মানুষের আশ্রয় কী? অপর মানুষ, যে আত্মীয়, পরমাত্মীয় কিংবা বান্ধব। আর কী? তার অর্জিত বিত্ত, সঞ্চিত অর্থ। আর কী? তার ধর্ম কিংবা মতাদর্শ।
সবগুলোই অনুপস্থিত কিংবা দূরস্থিত থাকে যদি কারো জীবনে, সে তাহলে কিসের জন্য টেনে নিয়ে চলবে জীবন নামের জগদ্দলটিকে? কায়েস আহমেদের গল্পের চরিত্ররা সবসময় এ প্রশ্নের মুখোমুখি হয়। তারা হয় আঘাতে-অপঘাতে মরে, নয়তো তিলে তিলে মরে, দগ্ধে দগ্ধে মরে।
তার গল্পের নারী- পুরুষরাও কিছুতেই পরস্পরের কাছে আসতে পারে না। তাদের মধ্যে যেন বাস করে অন্তর্লীন চখাচখী। সেই কাব্যশ্রুতি মূর্ত হয়ে ওঠে প্রত্যেকের জীবনে- চখাচখী ‘সারাদিন খুব কাছাকাছি থাকে, পাশাপাশি, দিন শেষ হয়ে রাত নামলে একজন অপরজনকে আর দেখতে পায় না। সারারাত পরস্পর পরস্পরকে ডেকে ডেকে ফেরে; কিন্তু কেউ কাউকে কাছে পায় না।’
তার গল্পের অনেক পুরুষ চরিত্র নারীসঙ্গবঞ্চিত। ফলে তারা অবদমনের বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করে। নিজে নিজেই পরিণত হয় বিকৃতির শিকারে। খুব খুঁজে পেতে যেসব দম্পতির সন্ধান পাওয়া যায় তারাও পরস্পরের প্রতি ঠিক মানুষসুলভ ব্যবহার করে না। সবচেয়ে মোলায়েম ব্যবহার যেখানে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে, সেখানেও স্ত্রীকে দেখা যায় স্বামীতে অতৃপ্ত। স্বামীর সঙ্গে সঙ্গমকালে তার মনে পড়ে স্বামীর অপেক্ষাকৃত সচ্ছল, অবিবাহিত বন্ধুর কথা। কায়েস আহমেদ তার গল্পগুলোতে যে কথা প্রায় সুস্পষ্টভাবেই বলতে চান, তা হচ্ছে দাম্পত্য সুখ শুধু স্বামী-স্ত্রীর ওপরেই নির্ভর করে না। বরং বহুলাংশে নির্ভর করে পারিপার্শ্বিকতা, পরিবেশ, ন্যূনতম অর্থ, নিশ্চিত জীবনের নিশ্চয়তাসহ আরো অনেক বিষয়ের ওপর। আর তিনি তার গল্পে যেসব পাত্রপাত্রী হাজির করেন, তারা প্রায় সবাই বঞ্চিত উপরোক্ত উপাদানগুলো থেকে।
কায়েস আহমেদ বিত্তহীন সর্বহারাদের নিয়ে কিংব গ্রাম ও গ্রামবাসী নিয়ে বেশি গল্প লেখেননি। তার অভিজ্ঞতার সীমা মূলত কেন্দ্রীভূত নগরবাসী নিম্নমধ্যবিত্ত এবং তাদের নিয়েই গল্প লিখেছেন বেশি। এ শ্রেণীর মানুষ যেমনটি হয়ে থাকে, ঠিক তেমনভাবে তাদের এঁকেছেন। কোনো ভাবালুতাকে প্রশ্রয় দেননি। কেননা তার কাছে ভাবালুতার আরেক নাম আদিখ্যেতা। এ শ্রেণীর মানুষরা বহন করে নগরজীবনের পুঁজ-রক্ত। নিজেরা সবসময় শিকার হয় দিনগত পাপক্ষয়ের, ক্ষমাহীন অভাববোধের, ফতোয়ার, সমাজশক্তির, রাষ্ট্রের, পুলিশের, মৌলবাদের। কিন্তু সবচেয়ে নির্মম সত্য হচ্ছে এই যে, এসব অনাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে তারা নিদারুণভাবে পঙ্গু এবং নপুংসক। লক্ষণীয়, এখানে লেখক দুর্মরভাবে নিজেকে সামলাতে পেরেছেন। কেননা তার সমকালীন, পূর্বজ এবং অনুজ অনেক লেখকই আমরা দেখেছি এ ধরনের জীবনের ঘনিষ্ঠ বর্ণনা দিয়ে গল্প লিখলেও গল্পের শেষদিকে এসে আর নিজের রাশ টানতে পারেননি। যান্ত্রিক সরলীকৃত একটি বিক্ষোভ বা বিদ্রোহের সৃষ্টি করেছেন যার কোন উপস্থিতি সমাজে নেই। এ বিষয়ে কায়েস আহমেদ যে অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন তার গল্পগুলো তার সাক্ষী। পাশাপাশি তিনি প্রবন্ধেও এ বিষয়ের অবতারণা করেছেন। ‘অন্য অবলোকন (সাহিত্যে বাস্তবতা)’ প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, ‘সমাজ, মানুষ এবং সময়কে যিনি এ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেন তার ভেতর কোনো ভাবালুতা থাকতে পারে না, ভাবালুতা আসে দুরত্ব থেকে। যিনি সরাসরি মোকাবিলা করেন অভিজ্ঞতা তার কাছে ভাসিয়ে তোলা বিষয় থাকে না, অভিজ্ঞতা রূপান্তরিত হয় উপলব্ধির সারাৎসারে, উপলব্ধি লেখকের চেতনায় আনে নৈর্ব্যক্তিকতা, এ নৈর্ব্যক্তিতাই বাস্তবের উপরকার সব বায়বীয় আবরণকে ছিন্ন করে দেয়।’

০২.

দুঃস্বপ্নের দিনলিপি লেখাই যার বিধিলিপি হয়ে দাঁড়ায় তার পক্ষে বেশিদিন লেখনী সচল রাখা কঠিন। এমন নিষ্করুণ, ভবিষ্যৎহীন জীবনের ছবি এঁকে যাওয়া, ক্রমাগত আঁকতে থাকা প্রায় অসম্ভব একটি ব্যাপার। কায়েস আহমেদ সেই অসম্ভবকে সম্ভব করার চেষ্টা করেছিলেন। পারেননি। পারেননি যে তার প্রমাণ তার রচনার স্বল্পতা। সমগ্র বাংলা সাহিত্যে খুঁজে পেতে কায়েস আহমেদের প্রতিতুল্য একজনই পাওয়া যায় – আবুল বাশার। বিশ্বসাহিত্যে আছেন ইভান বুনিন। আর প্রকটভাবে আছেন দস্তয়ভস্কি। শেষোক্তদের রচনায় তবু কিছুটা দুঃস্বপ্নের ঘোরে পাশ ফেরার অবকাশ পাওয়া যায়। কিন্তু কায়েস আহমেদ সেই অবকাশটুকুও রাখেননি। যে তামাটে, দুঃখপোড়া, দীর্ঘশ্বাসময় জীবন তিনি ক্রমাগত এঁকে গেছেন তা শেষ পর্যন্ত লেখককেই একটি ঘেরাটোপে আটকে ফেলেছে। ফলে লেখক নিজেই তার সৃষ্ট জগতের কাছে সংগ্রামহীন আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়েছেন। বিষয়ের বৈচিত্র্যহীনতায়, জীবন-যাপনের নিরাবেগ বর্ণনায় তার রচনা একঘেয়ে হয়ে উঠেছে। আঙ্গিক বা প্রকরণের কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার ছাপ তার গল্পে প্রায় নেই বললেই চলে। ইচ্ছাও যেন তার ছিল না। তার সৃষ্ট চরিত্রগুলোর জীবনে যেমন একটা দিন শুধু আগের দিনগুলোকে অনুসরণ করে, কায়েস আহমেদের গল্পগুলো যেন সেইভাবে একটি অপরটিকে অনুসরণ করে। সেই একঘেয়ে, না উঁচু না নিচু স্বরে তিনি কথা বলে যান। গদ্যের মধ্যে ভাঙা ভাঙা কর্কশতা এক ধরনের পৌরুষ এনে দেয় তার গদ্যে। কিন্তু সেই একই গদ্যে তিনি বহন করে চলেন ষাট দশকে তার শুরু থেকে আশির দশকের শেষ পর্যন্ত। কিছু কিছু শব্দ নতুন ব্যবহার করেন বটে, পুরনো কিছু শব্দ ঝেড়েও ফেলেন, তবু তার গদ্য শরীর পাল্টাতে পারে না। কারণ বোধকরি তা তিনি চানওনি। একই অস্ত্রে তিনি বারংবার চেষ্টা করেছেন একই শবব্যবচ্ছেদের। এ তার সম্পর্কে কোনো নেতিবাচক মূল্যায়ন নয়। বরং বিষয়ের ঘেরাটোপে বন্দি লেখক যে শেষ পর্যন্ত আকরণের একঘেয়েমিও উপহার দিতে বাধ্য হন, কায়েস আহমেদ তারই প্রমাণ এবং শিক্ষণীয়ও বটেন।
কায়েস আহমেদের রচনার একটি বড় দিক আমাদের অনেকেরই দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। তার রচনার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হিন্দু সমাজকে নিয়ে। হতে পারে তাঁর জন্ম ও কৈশোর পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে কাটানো এবং পরবর্তীকালে পুরোনো ঢাকার হিন্দু-অধ্যুষিত এলাকায় অবস্থানের কারণে। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের হিন্দু প্রতিবেশীর সঙ্গে কাটানোর ফলে তাঁদের জীবনের সঙ্গে তাঁর মোটামুটি নিখুঁত ও ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয়েছিল। এতে তাঁর অনুসন্ধিৎসু ও সংবেদনশীল মনেরই পরিচয় পাওয়া যায়। সৃষ্টিশীল লেখকরা সচরাচর নিজের ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং মতাদর্শের গতিতে চির আবদ্ধ থাকেন না। তবু প্রতিবেশী সম্প্রদায় নিয়ে লিখতে তাঁরা একটু দ্বিধান্বিত থাকেন। কারণ সুযোগসন্ধানী এবং সংকীর্ণমনা ব্যক্তিরা লেখকের এই বেড়া ডিঙানোকে অনধিকার চর্চা বলে প্রমাণ করতে চান। রবীন্দ্রনাথকেও আমরা দেখেছি প্রতিবেশীর ঘরে উঁকি দেবার চাইতে বেশি সাহস তিনি সংগ্রহ করতে পারেননি। এমনকি যে নজরুল ইসলাম কবিতা ও গানে অহরহ হিন্দু সমাজের আঙিনাকে ও জীবনকে তুলে এনেছেন, তিনি পর্যন্ত গল্প-উপন্যাস-নাটকে অর্থাৎ কথাসাহিত্যে হিন্দু সমাজকে আনেননি। কায়েস আহমেদের হিন্দু চরিত্ররা অন্যান্য চরিত্রের মতৎ নিম্ন-মধ্যবিত্ত। তারা গল্পে ক্বচিৎ ধর্মাচরণ বা ধর্ম-সম্প্রদায়ের কথা বলে। সমাজ ও সংসারের যূপকাষ্ঠে তারা প্রতিনিয়ত বলি হচ্ছে। তা সত্ত্বেও তাদের এক ধরনের টানও আছে এই দেশ, সমাজের প্রতি। তারা কথায় কথায় ইন্ডিয়া চলে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করে না। কিংব জমানো টাকা ইন্ডিয়া পাচার করে না। কিংবা এ দেশে মাটির ঘরে থেকে ইন্ডিয়াতে পাকা বাড়ি তৈরি করে না। প্রতিবেশী হিন্দু সমাজ সম্পর্কে আমাদের দেশে একশ্রেণীর লোকের দৃষ্টিভঙ্গি এই রকমই। তো লেখক কায়েস আহমেদ সেই শ্রেণীতে পড়েন না বিধায় তাঁর সৃষ্ট হিন্দু চরিত্রগুলোকে মাানুষের মতো করেই উপস্থাপন করেন। কামনা-বাসনা-উচ্চাকাঙক্ষা, সংসারের শত অভাব, বঞ্চনার আঘাতে জর্জরিত মানুষগুলো তাদের মুসলমান প্রতিবেশীদের মতোই দুঃখে কাঁদে, আনন্দে হাসে কিংবা অবিচারে আন্দোলিত হয়। কায়েস আহমেদের কলমে হিন্দু চরিত্রগুলো চিহ্নিত হয়েছে জড়তাহীন দক্ষতায়। তাঁর অন্যান্য গল্পের মতোই হিন্দু চরিত্রসমৃদ্ধ গল্পগুলো একই ঢংয়ে লেখা। বোঝা যায়, এই গল্পগুলো লেখার জন্য কায়েস আহমেদকে বাড়তি কোনো কসরত করতে হয়নি। বোঝা যায় যে, মানুষকে ধর্মীয়- সম্প্রদায় হিসেবে না দেখে কায়েস আহমেদ শ্রেণী হিসেবে দেখেছেন। এই শ্রেণীদৃষ্টি অর্জন তাঁর একটি বড় সাফল্য।
আবার তাঁর শ্রেণীদৃষ্টি যে যান্ত্রিক নয় তার প্রমাণও পাওয়া যাচ্ছে তাঁর গল্প এবং প্রবন্ধে। গল্পের শৈল্পিক দাবি সম্পর্কে তিনি সচেতন থাকার চেষ্টা করেছেন। শ্রমিক শ্রেণীমাত্রই যে বিপ্লবী শক্তি নয়, সে ধারণাও তার ছিল। আর শ্রেণীর মধ্যেও যে নাানা উপশ্রেণী বিদ্যমান এবং তারা যে প্রতিনিয়ত নতুন করে বিন্যস্ত হচ্ছে, সে সম্পর্কেও তিনি সচেতন ছিলেন। সচেতন যে ছিলেন, সে প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর ‘ঘূর্ণির চান ও নিরাবেগ বোঝাপড়া’ প্রবন্ধে। তিনি লিখেছেন- ‘আমাদের দেশের কর-কারখানায় যে শ্রমিক সে শ্রমিক ক্লাসিক্যাল শ্রমিক নয়, তাঁরাও উঠে এসেছে কৃষিনির্ভর জীবন থেকে, তাঁর মনের ভেতরেও রয়ে গেছে মৃত্তিকার তৃষ্ণা। শোষণের চেহারাও নানা সূত্র জটিল রূপ নিচ্ছে। গ্রামে ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা বাড়ছে ভয়াবহ রকমে। শহরের ওপর চাপ বাড়ছে, জটিলতা বাড়ছে। শহর ক্রমে ঢুকে যাচ্ছে গ্রামে, গ্রাম উঠে আসছে শহরে। চল্লিশ বছর আগের বাস্তবতার সঙ্গে আজকের বাস্তবতা এক হয় না, হতে পারে না। আর একটি বিষয়, বাংলাদেশের শ্রেণীবিন্যাসটিতে এখন চলছে দারুণ অস্থিরতা। এর ফলে শহরে- গ্রামে সর্বত্র জটিলতার নানান মাত্রা যুক্ত হচ্ছে। এই সমুদয় বিষয় মিলিয়ে একজন লেখকের কাজের ধারাও হয়েছে জটিল এবং কঠিন।’

০৩.

কায়েস আহমেদের জীবৎকালে গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল ৪টি। অন্ধ তীরন্দাজ (১৯৭৮), দিনযাপন (১৯৮৬), নির্বাসিত একজন(১৯৮৬), এবং লাশকাটা ঘর (১৯৮৭)। ৪টি গ্রন্থের মধ্যে গল্পগ্রন্থ ৩টি। গ্রন্থিত সর্বমোট গল্পের সংখ্যা ২৩টি। মৃত্যুর পরে (বলা ভালো আত্মহত্যার পরে) ১৯৯৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ভূমিকাসমতে প্রকাশিত হয় কায়েস আহমেদ সমগ্র। তাতে নতুন কোনো গল্প (ইতোপূর্বে অগ্রন্থিত) জুড়ে দেওয়া সম্ভব হয়নি। ফলে কায়েস আহমেদ লিখিত গল্পের সংখ্যা ঐ ২৩টিতেই সীমাবদ্ধ। এদের মধ্যে ২টি বড় গল্পকে কেউ কেউ উপন্যাসেরও আখ্যা দিয়ে থাকেন। সেই দুটি বড় গল্প হচ্ছে ‘জগদ্দল’ এবং নির্বাসিত একজন’।
কায়েস আহমেদের চরিত্রগুলো যেন তাঁর সব লেখাতেই ঘুরে ঘুরে আসে। গল্পের চরিত্রগুলো ঢুকে যায় উপন্যাসে, উপন্যাস থেকে হঠাৎ গল্পের কোনো এক কোণে চকিত উদ্ভাসের মতো। তাদের নামকরণ আলাদা, আলাদা- আলাদা কর্মেও তারা ব্যাপৃত, কিন্তু সবাই যেন এক! কারণ একই বদ্ধদশার ঘানি টানছে প্রত্যেকেই। বাচ্চাদের চাঁদ দেখাবে মা কীভাবে? চাঁদের শরীরে বড় বড় চাকা চাকা ঘা। তাই গগন যায় বীরেন ডাক্তারের কাছে। বেটনোভেট মলম নিয়ে মাখাতে যায় চাঁদের গায়ে। তখন কালীনাথ অন্ধকারের ভেতর দু হাত মেলে হাতড়ে হাতড়ে সদর দরজাটা খুঁজতে এগোয়। পেছন থেকে স্ত্রী গিরিবালার অদৃশ্য কণ্ঠ তাকে মনে করিয়ে দেয় যে ‘মরতে চাইলে একাই মরণ লাগবো, বুঝছো, তখন আর সহমরণ নাই।’ অন্যদিকে রমণী মুখুজ্জে জানেনও না যে তাঁর ছেলে তাঁকে ভবিষ্যতের বাধা মনে করে প্রতিমূহুর্তে মৃত্যুর প্রতীক্ষায় আছে। অথচ তিনি যখন পুত্রের নামটি টেনে টেনে উচ্চারণ করেন, সেই উচ্চারণে কী যে স্নেহ এবং নিশ্চিত নির্ভরতা ফুটে ওঠে, তার কোনো বর্ণনা হয় না। এইভাবেই মানুষের ভেতর ও বাইরে কুশ্রী থেকে কুশ্রীতর হয়ে ওঠে। এমনই কুরূপী হয়ে ওঠে তারা যে তাদের একজন, ফজর আলী দশইঞ্চি থান ইটটার ওপর বসে আমু, গলা বাড়িয়ে দিলে মুখে ফ্যানা লাগানো ব্রাশ ঘষতে ঘষতে দেবেন নাপিত বসে বসে ‘তোর মুখের দিকে চাইলে মন বলে না যে দাড়ি কামাই।’ আর ছবিরাণীর স্বামী সহদেব খালিশপুর মিলে চাকরি করে,বাড়িতে আসে মাসে মাত্র দুই দিন। ছবিরাণীর লম্বা ঠাস বাঁধুনির শরীর লাস্যে কলকল করে সবসময়। তার ইচ্ছা স্বামীকে সবসময় কাছে পাওয়া। অথচ তাকে মাসে আটাশ রাত ঝুপসী অন্ধকারে রাজ জেগে বসে বসে কুপির আলোয় শাশুড়ির সঙ্গে ঠোঙা বানিয়ে কাটাতে হয়। গ্রামের অন্য মানুষেরা কী করে? ফজর আলী গোরস্থানের ধারে দাঁড়িয়ে মাঠের দিকে চেয়ে থাকে। দেখার মতো এমন কোনো শোভা নেই, ফুটিফাঁকা কর্কশ শূণ্য মাঠ, তার ওপারে রেললাইন, তার ওপারে ধূসর গাছপালার আবেষ্টনী। ধূসরই- সবুজ নয়। কেউ কেউ জানতেই পারে না যে ঐ গাছপালার আবেষ্টনীর পেছনের সরু একটা বাথরুমের মধ্যে ১৬ জন মানুষকে আটকে রাখা হয়েছে হত্যা করা হবে বলে। সেই লোকগুলো মৃত্যুভীতির চাইতেও বেশি কাতর শ্বাসরোধী বর্তমান বাস্তবতায়। তখন মনে পড়ে তার ‘বন্দী দুঃসময়’ গল্পটির কথা।
যে শ্বাসরুদ্ধকর, দমচাপা জীবন-যাপন তাঁর রচনার প্রধান উপজীব্য, সেই একই বিষয়ের গল্প এটি। একজন যুবককে কেন্দ্র করে ছেঁড়া-খোঁড়া তুলে আনা সময় এবং সমাজের গল্প। যুবকটির কোনো উদ্দেশ্য খুঁজে পাওয়া যায় না। তাঁর বয়স আটাশ হতে চলেছে তবু মধ্যবিত্ত চাহিদার কোনো কিছুই তার জীবনে সংযোজিত হয়নি। সহসা সংযোজিত হবে তেমন কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। আর কী আশ্চর্য! শুধু পাবলো নেরুদা এবং সালভেদর আলেন্দের উল্লেখে যুবকের সমস্যাটি একটি আন্তর্জাতিক মাত্রা পেয়ে যায়। যুবক আলেন্দের মতো তো নয়ই, তার বন্ধু কবীরের মতো বিপ্লবীও হতে পারে না। সে শুধু নিশ্চেষ্টভাবে দেখে যে তার চারপাশের দেয়াল তার দিকে সরে এসে তাকে পিষ্ট করতে চাইছে। তার হাত কাঁপে মাথা চিন চিন করে, রাত্রে ঘুম হয় না। বন্ধুরা দুপুরের শো- তে বউ নিয়ে সিনেমা দেখতে যাবার সময় ইচ্ছাকৃতভাবে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে, তাকে দেখাতে চায় যে তার বউ আছে। পত্রমারফত আরেক বন্ধু পাওনা টাকা পরিশোধের জন্য তাগাদা দেয়। তার মনে হয় বারবার যে তার বয়স আটাশ হতে চলেছে। তার চারপাশ তাকে গিলে খেতে আসছে। গল্পের পিঁপড়ের সঙ্গে তার অবস্থার আশ্চর্য মিল-
গন্ডিটা ছোট হয়ে আসছে ক্রমে টেবিলের ওপর চারপাশের পানির বৃত্তের ভেতর বন্দী পিঁপড়েটা বেরুবার জন্য অস্থির হয়ে ঘুরছে আর সে গ্লাস থেকে টেবিলের ওপর ছলকে পড়া পানিতে আঙুল ডুবিয়ে বন্দী পিঁপড়ের চারপাশের বৃত্তটা ক্রমে ছোট করে আনতে থাকে আর পিঁপড়েটা তার ভেতর ভীষণ বিপন্ন এপাশ ওপাশ সামনে পেছনে ছোটাছুটি করতে থাকে এবং ক্রমাগত অঙ্গুলী স্পর্শে সরু বৃত্ত ভরাট হতে হতে একসময় শুকনো ডাঙা সম্পূর্ণ জলমগ্ন হয়ে গেলে তার ভেতর দূরাগত এক কিশোরের কণ্ঠ শোনে, ‘পানি পার পানি পার।’
আমাদেরও চারপাশে সেই বৃত্তটা ছোট হয়ে আসছে ক্রমাগত। আর কিশোরের কণ্ঠটা আরো দূরাগত, আরো ক্ষীণ হতে হতে এমনভাবে মিলিয়ে গেছে যে, অমন একটি কণ্ঠ ছিল কি না তা আর মনেই পড়ে না।

This Post Has 2 Comments

  1. ঋতো আহমেদ

    জাকির তালুকদার। কয়েক বছর আগে পাঠক সমাবেশ কেন্দ্রে সামনাসামনি শ্রোতার আসনে বসে ওনার একটা প্রবন্ধ-পাঠ শোনার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সেই থেকে তাঁর গল্পের সাথে গদ্যও আমাকে খুব টানে। এই প্রবন্ধটিতেও কায়েস আহমেদকে যেই নিগুঢ় উপস্থাপনায় আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন তার প্রশংসা না করলেই নয়। নতুন প্রজন্মের কাছে কায়েস আহমেদ অনেকটাই অশ্রুত এক নাম। তাঁর উপর সংখ্যা করে তাঁকে পাঠের এই আহ্বান মন-মানচিত্রের একটি অনন্য কাজ বলা যায়। শুভ কামনা।

  2. Shakhawat Bakul

    এত সমৃদ্ধ আলোচনা কায়েস আহমেদকে নিয়ে আমি খুব কমই দেখেছি। কায়েস আহমেদের উপর আলোচনায় দ্যুতি ছড়ানো জাকির তালুকদার তার গদ্যের শক্তিমত্তার প্রমাণ দিয়েছেন। প্রিয় কথা সাহিত্যিককে আবারও আন্তরিক ভালোবাসা ।

Leave a Reply