You are currently viewing ওরা ফেরেনি কেউ – পাঁচ || বিচিত্রা সেন

ওরা ফেরেনি কেউ – পাঁচ || বিচিত্রা সেন

ওরা ফেরেনি কেউ

বিচিত্রা সেন

কিস্তি-৫

সেদিনের পর থেকে নন্দলাল আরও কয়েকবার চেষ্টা করেছে হাট জমাতে। নিজের টাকা খরচ করে হাটুরেদের জিনিসপত্র কিনে দিয়েছে। তারপর তাদের জোর করে হাটে বসিয়েছে। কিন্তু কী আশ্চর্য! কোনোবারই কেউ কিছু কেনে নি। নন্দলাল বুঝে উঠতে পারছে না গ্রামের লোক তার সাথে এমন অসহযোগিতা করছে কেন? অথচ ওরাই তো তার কাছে গিয়ে ধরেছিল গ্রামে একটা হাট দিতে। তাহলে আজ কেন ওরা হাট থেকে কিছু কিনছে না? ভাবনাটা নন্দলালকে পেয়েই বসে। তার আর কিচ্ছু ভালো লাগে না। স্ত্রী-পুত্র-মা সবাইকে অসার মনে হয়। মাঝে মাঝে একটা ভাবনা তার মস্তিষ্কে ঝিলিক মারে। ওসানি আর সূর্যের সাথে সে যে বেঈমানী করেছে তার ফল ভোগ করছে না তো সে?

নানামুখী ভাবনায় সে কেমন উদ্ভ্রান্ত হয়ে পড়ে। সেই উদ্ভ্রান্ত ভাব থেকে বাঁচতে সে ইদানিং আফিমের নেশায় ডুবেছে। ভানুর বাপই এই জিনিসটা তাকে চিনিয়েছে। আফিমের ছোট একটা গোলা দাঁতের ফাঁকে রেখে ঝিম মেরে বসে থাকতে তার খুব ভালো লাগে। বারা ন্দায় যে ইজিচেয়ারটা আছে, তাতে সে সারাদিন আধশোয়া হয়ে পড়ে থাকে। মা আর মনিবালা চেয়ে চেয়ে দেখে। কিন্তু কিছু বলতে পারে না। বললেই নন্দলাল প্রচন্ড রেগে যায়। হুমকি দেয় তাকে বিরক্ত করলে সে আবার রেঙ্গুন চলে যাবে। ভয়ে মা এবং মনিবালা নীরব থাকে। আদিত্য বাবার পাশে বসে বসে ছবি আঁকে, পড়ালেখা করে। কিন্তু বাবাকে বিরক্ত করে না। এই ছোট বয়সে সে বুঝে গেছে তার বাবা পাল্টে গেছে। এই বাবার সাথে বেশি কথা বলা যাবে না। মাঝে মাঝে নন্দলাল চোখ খুলে দেখে আদিত্যকে। কখনো কখনো মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। ওইটুকু আদরেই আদিত্য সন্তুষ্ট।

মনিবালা সারাদিন সংসার তদারকিতে ব্যস্ত থাকে। অনেক জমি বিক্রি করে টাকাপয়সা নষ্ট করার পরও এখনো তাদের প্রচুর ভূ-সম্পত্তি। সেসব তদারকি করার চাট্টিখনি কথা নয়। লেখাপড়া শিখে ফেলাতে সে এখন অনেক কিছু বুঝতে পারে। নন্দলাল একেবারে দেশে ফিরে আসাতে সে খুব খুশি হয়েছিল। ভেবেছিল, এবার বুঝি তার সব দুঃখের অবসান হলো। কিন্তু বিধি বাম! হাট বসাতে গিয়ে এ লোকটি একেবারে পাল্টে গেলো। এখন সারাদিন নেশায় ঝিম মেরে পড়ে থাকে। ছেলেটা পাশে ঘুর ঘুর করলেও সেদিকে পর্যন্ত ফিরে তাকায় না। আদিত্যকে নিয়ে তার এখন সব আশা ভরসা। ছেলেটাকে সে শহরে পাঠিয়ে দেবে পড়ালেখার জন্য। আগে স্কুলের গন্ডিটা শেষ হোক। সে শহরের কলেজে ছেলেকে পড়াবে। শিক্ষিত না হলে এত সম্পত্তি সে রাখতে পারবে না। ছেলের জন্য সে স্কুলের মাষ্টার রেখেছে। মাষ্টার বলেছেন, একদিন আদিত্য এ গ্রামের নাম রাখবে। মনিবালা দুহাত কপালে ঠেকিয়ে ভগবানের উদ্দেশ্যে একবার প্রণাম করে। মনে মনে বলে,

-ভগবান, তুঁই আঁর আদিত্যরে মানুষ করি দিয়ু।

আজ অনেকদিন পর নন্দলাল মনে হয় আফিম খায়নি। সে ছেলেকে নিয়ে পুকুরে যায়। তারপর বাপ-ছেলে স্নান সেরে এসে বলে,

-হডে গেলা তোঁয়ারা? আাঁরা বাপ-পুতরে ভাত দেও।

আদিত্য বাবার হাতটা শক্ত করে ধরে আছে। কতদিন পর বাবা আজ তাকে আদর করছে। তার যেন আজ খিদেও বেশি পেয়েছে। রান্নাঘরের আসন পেতে মনিবালা বাপ-ছেলেকে খেতে দেয়। তাদের রান্নাঘরটা ভারি সুন্দর। দুটো ঘর পাশাপাশি, একটা নিরামিষ রান্নাঘর, একটা আমিষ রান্নাঘর। দুটো ঘরের সামনে বারান্দা। এই বারান্দাতে পাত পেতে অন্তত ৪০ জন মানুষকে একসাথে খাওয়ানো যায়। খুব তৃপ্তি করে নিরামিষ-আমিষ মিলিয়ে সাত-আটরকম তরকারি দিয়ে নন্দলাল ও আদিত্য ভাত খায়। তারপর নিজের রুমে ঢুকে বাপ-ছেলে শুয়ে পড়ে। অনেকদিন পর নন্দলালের মায়ের মুখে হাসি ফোটে। মনিবালাও কেমন স্বস্তি পায় আজ অনেকদিন পর। দুপুরে খেয়ে শোয়ার অভ্যাস তার নেই। সে শ্বাশুড়ির সাথে নকশিকাঁথা নিয়ে বসে। বৌ-শ্বাশুড়ি দুজন দুদিক থেকে নকশিকাঁথায় ফুল তুলতে থাকে। হঠাৎ নন্দলালের রুম থেকে ওয়াক ওয়াক বমির শব্দ শুনে মনিবালা চমকে ওঠে। সে তার শ্বাশুড়ির মুখের দিকে তাকায়। কিন্তু তাঁর চোখে কোনো ভাবলেশ নেই। বোঝা যায় তিনি শুনতে পাননি। আবার ওয়াক ওয়াক শব্দ হতেই আদিত্যের চিৎকার কানে আসে। সে চিৎকার করে মা-ঠাকুরমাকে ডাকছে। মনিবালা সুুঁইসুতো ফেলে এক লাফে ছুটে যায় নিজের রুমে। দেখে নন্দলাল বমি করে সমস্ত মেঝে ভাসিয়ে দিয়েছে। আদিত্য বাবার পিঠে হাত বুলোচ্ছে। নন্দলাল হা করে বড় বড় নিঃশ্বাস নিচ্ছে। চোখগুলো যেন বেরিয়ে আসছে তার। মনিবালা ছুটে গিয়ে স্বামীর পিঠে হাত বুলোতে থাকে। মনিবালাকে ছুটে আসতে দেখে নন্দের মাও ছুটে এসেছেন এ ঘরে। বৌ-শ্বাশুড়ির দুজনেই নন্দলালকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। নন্দের মা বলেন,

-অ আদিত্য, যা তো, তোর কবিরাজ দাদুরে ডাকি আনগুই।

আদিত্য ছুটে বেরিয়ে যায় কবিরাজকে আনতে। নন্দলালের বমি কিন্তু থামে না। একটু পর পর সে বমি করতেই থাকে। মাকে নন্দের পিঠে হাত বুলাতে বলে মনিবালা মেঝের বমিগুলো পরিষ্কা র করতে লেগে যায়। একটা গামলা দেওযা হয় নন্দকে বমি করতে। একটু পর আদিত্যের সাথে ঘরে ঢোকেন কবিরাজ মশাই। নন্দ তখন হা করে বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে। কবিরাজ বমিগুলোর দিকে তােিকয় নন্দলালে হাতের নাড়ী টেপেন। নাড়ী টেপে, পেট চেপে, চোখ দেখে কবিরাজ মশাই মুখ খোলেন। বলেন,

-ইতার অবস্থা তো ভালা ন। তোঁয়ারা ইতারে শহরত নিত্ পারনি চ।

মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে নন্দলালের মায়ের। ছেলেকে নিডে ওরা শহরে কোথায় যাবে। তিনি তো কখনো শহরে যাননি। মনিবালাও কখনো শহর দেখেনি। নন্দলাল হয়তো সব চেনে, কিন্তু সে তো এখন গুরুতর অসুস্থ।

এরই মধ্যে জ্ঞাতিরা এসে ভিড় করেছে নন্দদের ঘরে। কবিরাজ কী একটা পুরিয়া খাইয়ে দেওয়ার পর এখনো পর্যন্ত নন্দ আর বমি করেনি। আরও ছয়টা পুরিয়া দেন তিনি দুদিনের জন্য। তারপর আবারও শহরে নেওয়া তাগাদা দিয়ে তিনি বেরিয়ে যান। যাওয়ার আগে নন্দলালের মা তাঁর হাতে টাকা গুঁজে দেন। জ্ঞাতিরা নানা উপদেশ দিতে থাকে। তবে নন্দলালের মায়ের কাছ থেকে তেমন সাড়া না পেয়ে তারা একে একে বেরিয়ে যায়। নন্দলালকে এক কাত হয়ে ঘুমোতে দেখে মাও বেরিয়ে যান। যাওয়ার সময় সাথে করে আদিত্যকেও নিয়ে যান।

সে রাতে আর কারো খাওয়া হয় না নন্দলালদের ঘরে। স্বামীকে অঘোরে ঘুমোতে দেখে মনিবালাও পাশে শুয়ে পড়ে। তারপর তলিয়ে যায় ঘুমের রাজ্যে। রাত তখন কত হবে জানা নেই। হঠাৎ কারো ফোঁপানির শব্দে ঘুম ভেঙে যায় মনিবালার। আস্তে আস্তে সে চোখ খোলে। হারিকেনের মৃদু আলোয় সে দেখতে পায় নন্দ পালঙ্কের ওপর হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। প্রথমে সে বুঝে উঠতে পারে না সে কি স্বপ্ন দেখছে নাকি বাস্তবেই তার স্বামী কাঁদছে। এবার সে নিজেই ওঠে বসে। স্বামীর পিঠে হাত রেখে সে বলে,

-কী ওয়ে যে অনর? এন হরি কাঁদতন ক্যায়া?

নন্দলাল চমকে ওঠে। একটু থেমে আরও জোরে ফুঁপিয়ে ওঠে। তারপর বলে,

-আঁই হয়তো আর বাইচ্তাম না। মরনর আগে তোঁয়ারে একখান হতা হোই যাইতাম চাইর।

মনিবালা সহানুভূতির স্বরে বলে,

-অনে বাচিবাক, আরও বোত্ দিন বাচিবাক্। কী হতা হোইতাক চাতন যে?

হঠাৎ নন্দলালের কান্না থেমে যায়। একদম স্বাভাবিক গলায় বলে,

-হতা ইয়ান হুনিয়ারে আঁরে ঘৃণা ন হইরগু। আঁই বড় অপরাধী। তোঁয়ারে বোত্ ঠগাই। আরও বোত্জনরে ঠগাই।

ভ্রু কুঁচকে যায় মনিবালার। এসব কী বলছেন তার স্বামী? কীভাবে তিনি তাকে ঠকিয়েছেন? হাট বসাতে গিয়ে তাদের অনেক টাকা নষ্ট হয়েছে ঠিক, তবে তাতে তো তাঁর দোষ ছিল না। গ্রামের লোক যদি ওই হাট থেকে কিছু না কেনে তবে তাঁর কী করার আছে? এসব কথা স্বামীকে বুঝিয়ে বলতে তার খুব ইচ্ছে করে। কিন্তু সে মুখ খোলার আগে নন্দলালই আবার মুখ খোলে। বলে,

-হুনো, রেঙ্গুনত আঁর বউ-ফোয়া আচে। তোঁয়ারে বিয়া হরনর আগে আঁই রেঙ্গুনত বিয়া হোইরগিলাম। হেই ঘরত আঁর উগ্গা ফোয়াও আছে। আঁই তোঁয়ারারে সুখত রাখিবার লাই হিতারারে ন হোই এডে চলি আইশ্শি।

একটা বজ্রপাতে ঘরটা এই মুহূর্তে বিদীর্ণ হয়ে গেলেও মনে হয় এর চেয়ে ভালো ছিল, কথাটা শুনে মনিবালার সেরকমই মনে হয়। রেঙ্গুনে তার স্বামীর স্ত্রী-পুত্র আছে এবং সে এ সংসারে আসার আগে ওই স্ত্রীই নন্দলালের জীবনে এসেছিল এত বড় সত্যটা মনিবালার মেনে নিতে কষ্ট হয়। মনে হয় তার স্বামী বোধয় অসুখের ঘোরে আবোল-তাবোল বকছে। তার একটা সতীন আছে, সেই সতীনের আবার ছেলেও আছে এত বড় একটা সত্য লুকিযে নন্দলাল এত বছর কী করে কাটালো। আসলে সব মিথ্যা। অসুখে হয়তো উনার মাথাটা নষ্ট হয়ে গেছে। মনিবালাকে চুপ থাকতে দেখে নন্দ বলে,

-তুঁই চুপ হোই গেলা যে? আঁরে ঘিন লাগের ন?

মনিবালা বোঝে তার স্বামীর মাথা ঠিক নেই। এ মুহুর্তে তাকে শান্ত করে আবার ঘুম পাড়িয়ে দিতে হবে। তাই স্বামীর কথার সূত্র ধরে সে বলে,

-আইচ্ছা, এহন ঘুম যন্। রেঙ্গুনত বউ-ফোয়া থাকিলে থাকক্। অনে তো আঁরারে লইয়ারে আছন। অর্নত আর রেঙ্গুন যন ফইরতুন।

মনি কথা শুনে নন্দ যেন কিছুটা আশ্বস্ত হয়। মনির হাতদুটো নিজের হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে গভীর আবেগে চেপে ধরে। তারপর মনির দিকে তাকিয়ে বলে,

-তুঁই আঁরে ঘৃণা না হর্র ত?

মনি নন্দকে শান্ত করার জন্য বলে,

-না, না, আঁই অনরে ঘৃণা ন হর্রি।

নন্দ যেন পরম প্রশান্তি পায়। মনির হাত দুটো ছেড়ে দিয়ে বালিশে মাথাটা রেখে শুয়ে পড়ে। ক্লান্তিতে চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসে বিড় বিড় করে বলে,

-এসব হতা আঁর মারে ফোয়ারে না হইও।

বলতে বলতে এক নিমিষে সে ঘুমিয়েই পড়ে। মনিরও দুচোখ জুড়ে রাজ্যের ঘুম নেমে আসে। ঘুমে তলিয়ে পড়ার আগে একবার তার মনে হয় তার স্বামী তাকে এসব কী বললো।

-রেঙ্গুনে কি সত্যি সত্যি তার স্বামীর আরেকটা সংসার আছে? এরপর আর ভাবতে না পারে মনিবালা। গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়।

পরদিন একটু দেরিতেই ঘুম ভাঙ্গে মনির। সারা শরীর কেমন ম্যাজম্যাজ করছে। জানালার দিকে তাকিয়ে দেখে বাইরে বেশ আলো। ধড়মড় করে উঠে বসে সে। পাশে ঘুমন্ত স্বামীর দিকে তাকিয়ে এক লাফে সে পালংক থেকে নেমে পড়ে। তারপর ছুটে যায় পুকুরঘাটের দিকে। আজ অনেক দেরি হয়ে গেছে। পুকুরঘাটে হয়তো এতক্ষণে জ্ঞাতিরা চলে এসেছে। বিয়ের পর থেকে সে আঁধার রাতে উঠে পুকুরে গিয়ে স্নান সেরে নেয়। যদিও একই ঘাটে বাড়ির নারী-পুরুষ সবাই স্নান করে, এমনকি তার শ্বাশুড়িও করে, কিন্তু সে কখনো করেনি। তার খুব লজ্জা লাগে। ভাগ্য ভালো, এখনো পুকুরঘাটে কেউ আসেনি। মনি চট করে ঘাটে নেমে একটা ডুব দিয়ে উঠে পড়ে। তারপর বেড়া দিয়ে ঘেরা রাখা কাপড় বদলানোর জায়গাটিতে গিয়ে শাড়ি পাল্টে আসে। কাপড়চোপড় ধুয়ে শুকাতে দিয়ে ঘরে এসে দেখে শাশুড়ি চা বানিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছেন। মনিকে ঘরে ঢুকতে দেখে শ্বাশুড়ি বললেন,

-অ বৌমা, আগে চা খাই ল। তারপর নন্দরে আর আদিত্যরে ডাকি দেও।

মনিবালা স্নান সেরে প্রথমে সিঁন্দুর দেয় কপালে সিঁথিতে। আজ শাশুড়ি চা খেতে ডাকাতে সে একটু দ্বিধায় পড়ে। আগে কি চা খাবে নাকি সিঁদুরটা দিয়ে আসবে? সিঁদুরের কথা মনে পড়ার সাথে সাথে তার মনে পড়ে যায় গতরাতে বলা নন্দলালের কথাগুলো। মনটা কেমন অশান্ত হয়ে যায় কথাগুলো মনে পড়ার সাথে সাথে। শ্বাশুড়ি আবার ডাক দেয়-

-কী অইলু? থিয়াই ক্যায়া থাইক্কু? চা খাইতা আইয়ু।

মনিবালা শ্বাশুড়ির সাথে বসে চা আর মুড়ি খায়। শ্বাশুড়ি জানতে চায়-

-নন্দ কালোবা আর বমি হইর গেনা?

মনিবালা অন্যমনস্কভাবে মাথা নেড়ে নাসূচক উত্তর দেয়। তারপর শ্বাশুড়িকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে উঠে নিজের রুমের দিকে চলে যায় নন্দকে ডেকে দিতে।

শ্বাশুড়ি চায়ের কাপগুলো একটা গামলাতে নিয়ে ধুয়ে ফেলেন। তারপর সবজিগুলো বেছে নিতে থাকেন নিজের নিরামিষ রান্নার জন্য। ঠিক এসময়ই মনিবালার বিকট চিৎকারটা ভেসে আসে নন্দলালের রুম থেকে। তিনি সবজি ফেলে ছুটে যান ছেলের রুমের দিকে। মনিবালার চিৎকারটা এতটাই তীব্র ছিল যে ছুটে আসে আশেপাশের জ্ঞাতিরাও। সবাই এসে দেখে মনিবালা উপুড় হয়ে পড়ে আছে নন্দলালের পায়ের ওপর। নন্দলালের মা ভালো করে তাকান ছেলের দিকে। ছেলের বুক ওঠানামা করছে না। তিনি কাঁপতে কাঁপতে হাতটা নন্দের নাকের কাছে নিয়ে যান। না, নন্দের নিশ্বাস নেই। “অ ফুত রে, তুই হডে গেলি রে” বলে তিনি ছেলের বুকের ওপর আছড়ে পড়েন। নন্দের জ্ঞাতি ভাই অবস্থা বুঝতে পেরে ছুটে যায় কবিরাজের বাড়িতে। এই সকাল বেলায় কবিরাজকে সাথে করেই সে নিয়ে আসে। জ্ঞাতি কাকী-জেঠিরা নন্দের মা এবং বৌকে সরিয়ে নেন। ওদের বুকফাটা চিৎকারে তখন আদিত্যও এসে হাজির হয় ঘরে। কবিরাজ নাড়ী টিপে জানিয়ে দেন নন্দলাল আর নেই।

কবিরাজ বেরিয়ে যাবার পর নন্দের মা এবং বৌকে সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে। মনিবালা মুহূর্মুহু জ্ঞান হারাচ্ছিলো। আদিত্য বাবার লাশের ওপর পড়ে কাঁদছিলো। আদিত্যের বয়সেই নন্দলাল বাবাকে হারিয়েছিল। সেই থেকে মা-ই তাকে বড় করেছে। সেই ছেলে বড় হয়ে মাকে প্রাচুর্য দিয়েছিল। আজ সে প্রাচুর্যকে পায়ে ঠেলে এত অল্প বয়সে সে কীভাবে মাকে ছেড়ে পালালো এ কথা বলে বলে নন্দের মা তাঁর বুক চাপড়াচ্ছিলেন।

এই শোকাবহ পরিবেশের মধ্যেও সংসারের নিয়মে কাউকে কাউকে কঠিন হতে হয়। সমস্ত শোককে বুকে চেপে যাবতীয় কর্তব্য সেরে নিতে হয়। তেমনিভাবে নন্দলালের জ্ঞাতি কাকাতো-জেঠাতো ভাইয়েরা নন্দলালের শ্মশান সাজাতে চলে গেলো। গ্রামের মানুষ আজ সব এসে জমাত নন্দলালের উঠোনে। ওদের গ্রামের প্রথম রেঙ্গুন যাওয়া ছেলে আজ একেবারেই বিদায় নিচ্ছে গ্রাম থেকে। তাকে তো শেষ বিদায় জানাতেই হয়। সবার সহযোগিতায় অশ্রু বিসর্জনে নন্দলালের দাহকার্য সম্পন্ন হয়ে গেলো। আদিত্যের পরতে হলো ধুতি ও উত্তরীয়।

সময় গড়িয়ে যায়। কালের নিয়মেই একসময় নন্দলালের শ্রাদ্ধও সম্পন্ন হলো। মনিবালাকেও বরণ করতে হলো হিন্দু বিধবার বেশ। মাকে ঠাকুরমার বেশে দেখে আদিত্য ভয় পায়, চিৎকার করে কাঁদে। বলে,

-তুঁই ঠাকুরমার মতো সাদা শাড়ি ক্যায়া ফইরগু? আগের মতো লাল শাড়ি ফরো।

মনিবালা হু হু করে কাঁদে। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে। বলে,

-বাবা মরি গেইলি মা অল লাল শাড়ি ফরিত না ফারে।

ওদের এসব কথা শুনে নন্দের মা বিলাপ করে কাঁদেন। বলেন,

-অ ফুত্, তুই হডে গেইলি? যম আঁরে ক্যায়া না দেখিল্?

এইভাবে নন্দলালকে হারিয়ে তিনজন শোকার্ত মানুষ সারাক্ষণ নন্দলালের স্মৃতিতেই ডুবে থাকে।

১০.

 নন্দলাল মারা যাবার পর সমস্ত সম্পত্তি এখন মনিবালাই দেখাশোনা করে। সে দলিলপত্রও ভালো বোঝে। নন্দলালের এক জ্ঞাতি জেঠাতো ভাই তাকে কাগজপত্র চেনা শিখিয়েছে। স্বভাবে খুব কঠিন হয়ে গেছে মনিবালা। ছেলেকে সে একদম কাছ ছাড়া করে না। সে ঠিক করে রেখেছে মেট্টিক পাশ করিয়েই সে ছেলেকে শহরে পাঠাবে আরও বেশি লেখাপড়া করার জন্য। ভালো ছাত্র হিসেবে স্কুলে খুব সুনাম আদিত্যের। আর চিত্রশিল্পী হিসেবে তো গ্রামের তার প্রচুর খ্যাতি। পাড়ার বউঝিরা আদিত্যের কাছে আছে নকশিকাঁথা আঁকতে। আদিত্য খুশি মনেই তা এঁকে দেয়।

ছেলে মারা যাবার পর থেকে তার শাশুড়ি একদম চুপচাপ হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে নাতিকে বুকে নিয়ে তিনি বিলাপ করেন। মনিবালা চিৎকার করে কাঁদে না ঠিকই, তবে বুকের ভেতর গুমরে গুমরে ওঠে তার। ছেলেকে মানুষ করার জন্য আর সম্পত্তি রক্ষার জন্য সে নিজেকে কাঠিন্যের বেড়াজালে ঘিরে ফেলেছে। এতে বেশ লাভ হয়েছে। জ্ঞাতিগুষ্ঠি থেকে শুরু করে গ্রামের লোকজনও তাকে এখন বেশ সমীহ করে। সংসার এবং সম্পত্তি নিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চাইলেও একটা ভাবনা তাকে সবসময় সূঁচের মতো বেঁধে। নন্দলাল মরার আগের রাতে তাকে বলেছিল রেঙ্গুনে তার আরেকটা সংসার আছে। আবার এও বলেছিল যেন ব্যাপারটা তার মা ও ছেলে না জানে। মনিবালা এখনো পর্যন্ত কাউকে বলেনি কথাটা। বলার ইচ্ছাও নেই। তবে মাঝে মাঝে রাতে সে ঘুমাতে পারে না। একবার মনে হয় অসুখের ঘোরে নন্দলাল ভুল বলেছে। পরক্ষণেই মনে হয়, না, ভুল বলেনি। মারা যাওয়ার আগে নন্দলাল আসল সত্যটা স্বীকার করে গেছে।

যখনই ভাবে বিষয়টা সত্য, তখন তীব্র বিষণœতায় সে মুষড়ে পড়ে। কিন্তু কথাগুলো সে কারো কাছে বলে নিজেকে হালকাও করতে পারে না। তখন সে নকশিকাঁথা নিয়ে বসে। নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে সে এঁকে চলে ফুল, পাখী, ঘর, বাড়ি এসব। তারপর সুঁই এ রঙ্গিন সুতো ভরে নানান ফোঁড়ে কাঁথাটা ভরিয়ে তোলে। কখনো কখনো শাশুড়িও এসে তার সঙ্গী হয়।

সময় গড়িয়ে যায়। বছরের পর বছর গড়িয়ে চলে। আদিত্য নারায়ন এর মেট্টিকুলেশন পরীক্ষা শেষ হয়। চার মাইল দক্ষিণের এক গ্রাম সুন্দরপুর, সেখানেই তার পরীক্ষাকেন্দ্র ছিল। শাশুড়িকে ঘরে রেখে মনিবালা ছেলেকে নিয়ে সেই গ্রামে এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়িতে উঠেছিল। মনিবালা বৈষয়িক, তাই তারা যেন বিরক্ত না হয় সেইদিকে খেয়াল রেখে তাদের জন্য প্রচুর জিনিসপত্র নিয়ে গিয়েছিল। সেই জিনিসপত্রের মধ্যে যেমন ছিল চাল, ডাল, শাক, সবজি, তেমন ছিল শাড়ি, লুঙ্গিও।

ছেলের পরীক্ষা শেষ হবার পর থেকে মনিবালা পড়েছে এক নতুন চিন্তায়। যে করেই হোক তার ছেলেকে সে শহরে পড়াবে। একবার সাধ জেগেছিল কলকাতায় পড়ানোর। তার এক জ্ঞাতি ভাসুরের ছেলেকে কলকাতায় পাঠিয়েছে উচ্চ শিক্ষার জন্য। আদিত্য ও কলকাতায় গিয়ে পড়–ক এমন ইচ্ছে মনিবালারও জেগেছিল, কিন্তু এত দূরে ছেলেকে পাঠিয়ে সে নিজে শান্তিতে থাকতে পারবে না ভেবে সে ইচ্ছা থেকে আবার নিজেই সরে এসেছে। তাদের গ্রাম থেকে তিনমাইল দূরে একটা কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শহর থেকে নাকি অনেকে এসে এখানে ভর্তি হয়েছে। বিশেষ করে যারা স্বরাজী আন্দোলনের সাথে জড়িত তারা নাকি শহরের কলেজটাতে পড়তে পারছে না পুলিশের উৎপাতে। তাই তারাই বেশিরভাগ এ কলেজে ভর্তি হয়েছে। এসব আন্দোলনে তার ছেলে জড়াক মনিবালা তা চায় না, তাই সে শহরের কলেজটাতেই তার ছেলেকে পাঠাবে বলে মন:স্থির করেছে। শাশুড়িকে সে এসব কথা বলে না। তার ভয় শাশুড়ি হয়তো একমাত্র বংশপ্রদীপকে দূরে কোথাও যেতে দিতে চাইবে না। তবে তিনি যেতে দিতে না চাইলেও যে করেই হোক তাঁকে রাজি করাতে হবে।

আদিত্যের এখন একটা নতুন কাজ জুটেছে। ভাত খাওয়ার পর প্রতি দুপুরে ঠাকুরমাকে রামায়ন অথবা মহাভারত পাঠ করে শোনাতে হয়। সে যখন সুর করে রামায়ন অথবা মহাভারত পড়ে তখন তাদের জ্ঞাতিগুষ্ঠিরাও এসে তাদের বারান্দায় উপস্থিত হয়। কখনো কখনো মনিবালা তাদের চা-মুড়ি খাওয়ায়। আদিত্যের খুব ভালো লাগে এসময়টা। পরীক্ষা শেষ হবার পর থেকে তার মনের মধ্যে একটা চাপা দুশ্চিন্তা কাজ করছে। পরীক্ষা যদিও তার খুব ভালো হয়েছে, তবুও প্রথম বিভাগ পাবে কিনা এ নিয়ে তার দুশ্চিন্তা কিছুতেই কাটছে না। মা তাকে চুপি চুপি বলে রেখেছে সে ভালোভাবে পাশ করলে তাকে শহরে পড়তে পাঠাবে। সে স্বপ্নেই তার দিনগুলো কাটছে। দেখতে দেখতে তিনমাস পেরিয়ে যায়।

নন্দলালের উঠোনে আজ মানুষের ঢল নেমেছে। এই প্রথম তাদের গ্রামের কেউ প্রথম বিভাগে মেট্টিক পাশ করেছে। কেউ কেউ আফসোস করে ছেলের এ সাফল্য বাবা দেখে যেতে পারলো না বলে। কেউ কেউ আবার আদিত্যের মায়ের প্রশংসায় প মুখ হয়। আদিত্যের ঠাকুরমা লোক পাঠিয়ে এক মাইল দূরের লালির হাট থেকে পাতিলে পাতিলে মিষ্টি আনিয়েছে। পুরো বাড়িতে আনন্দ উৎসব চলছে। মনিবালার জীবনটা আজ সার্থক মনে হয় নিজের কাছে। স্বামীর ছবিতে ফুলের মালা পরিয়ে দিয়ে সে বলে,

-অনে দেখতন না? অনর ফোয়া প্রথম বিভাগে ফাশ হইরগে। অনে অনর ফোয়ারে আশীর্বাদ হরিবাক।

আদিত্যও এসে মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে বাবার ছবিতে প্রণাম করে। বলে,

-অ বাবা, অনে আঁরে আশীর্বাদ হরিবাক। আঁই যেন, মাইনষর মতো মানুষ হই।

সে রাতে বাড়ির জ্ঞাতিদের রাতের নিমন্ত্রণ দেয় আদিত্যের ঠাকুরমা। মনিবালা এবং তার শাশুড়ি মাছ মাংস ছুঁতে না পারলেও কোনটা কীভাবে রাঁধবে তা বাড়ির রাধুনীকে বুঝিয়ে দেয়। সবাই খুব পরিতৃপ্তির সাথে রাতের ভোজন সারে। পরদিন সকালে চা খেতে খেতে মনিবালা শাশুড়ির কাছে কথা তোলে। বলে,

-অ মা, আঁই আদিত্যরে শহরত পাঠাই দিয়ুম ঠিক হইরগি। অনে হনো বাধা না দিবাক।

শাশুড়ি চুপ করে থাকেন। এতদিনে তিনি মনিবালাকে চিনে ফেলেছেন। তিনি জানেন মনিবালা যখন ছেলেকে শহরে পড়াবে মন:স্থির করেছে তখন সে পড়াবেই। তাই তিনি একটু হেসে বললেন,

-তোঁয়ার মন যিয়ান্ চা হিয়ান হরো।

এত সহজে শাশুড়ির অনুমতি পেযে যাবে মনিবালা স্বপ্নেও ভাবেনি। তাই সে শাশুড়ির মুখের দিকে তাকিযে ভালোভাবে পরখ করতে চাইলো শাশুড়ি এ কথাটা রেগে বলেছেন কিনা। কিন্তু শাশুড়ির মুখে রাগের কোনো চিহ্ন নেই। তাই আবারও নিশ্চিন্ত হবার জন্য সে বললো,

-অনে মনত্তুন্ হতন্ ত?

এবার শাশুড়ি হেসেই দিলেন। বললেন,

-হ, হ, মনত্তুন্ হর্ই যে।

আনন্দে মনিবালার চোখে জল চলে এলো। আবেগ সামলাতে না পেরে সে টুক করে শাশুড়ির পা ছুঁয়ে প্রণাম করে ফেললো, তারপর চিৎকার করে আদিত্যকে ডাক দিলো,

-আদিত্য, অ আদিত্য, ইন্দি আয়। তাড়াতাড়ি আয়।

মায়ের ডাক শুনে আদিত্য ছুটে আসলো। বললো,

-অ মা, আঁরে কিল্লাই ডাইক্কু যে?

মনিবালা হেসে বললো,

-তোর র্ঠমারে নর্শা র্হ।

আদিত্য কিছু না বুঝেই ঠাকুরমাকে প্রণাম করলো। ঠাকুরমা নাতিকে বুকে জড়িতে ধরে বললো,

-তোর বাবার নাম রাখিবি। আঁই যেন বুক ফুলাই বেগ্গুনরে হইত্ ফারি তুই আর নন্দর ফোয়া।

আদিত্য মাথা নেড়ে সায় দেয়। এর পরের সপ্তাহেই আদিত্য শহরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। এবার আর নৌকা নয়। ততদিনে তাদের থানার উপর দিয়ে রেললাইন হয়েছে। দুমাইল হেঁটে গেলেই সে ট্রেনে শহরে আসা যাওয়া করা যায়।

************************