You are currently viewing পিপুফিশু, কিস্তি- ১৮ || আলী সিদ্দিকী

পিপুফিশু, কিস্তি- ১৮ || আলী সিদ্দিকী

পিপুফিশু

আলী সিদ্দিকী

কিস্তি- ১৮

লাম্পট্যে বিক্ষুব্ধ বিশাখা

আমি টের পাচ্ছি একটা উটকো ঝামেলা আমার দিকে ধেয়ে আসছে। গত কিছুদিন ধরে আমি ব্যাপারটা বুঝতে পারছি। আমাদের শিফটের সব সহকর্মীরার ব্যাপারটা লক্ষ্য করছে। কেউ কেউ আবার রসিকতা করছে তা নিয়ে। কিন্তু বিষয়টা যে আমার কাছে রসিকতার চেয়ে অনেক কষ্টকর তা বুঝেছে সারা, চেতনা, নীতা, মাই। ব্যাপারটি এমন যে, আমি আফসারকেও খুলে বলতে পারছি না। আমাদের বাঙালী মুসলমান সমাজে এ ধরণের ঘৃন্য ঘটনার অনেক কাহিনী চালু আছে আমেরিকায়। দেশে তো এমন অনেক মুখরোচক কাহিনী শুনেছি। কিন্তু বহুগামিতার এ দেশে এসে আমাদের নারী পুরুষদের মধ্যে এই হীনতা যেন চরমাকার ধারণ করেছে। আম্মার কড়া শাসনে থেকে আমরা পাঁচটি বোন এমনভাবে বড়ো হয়েছি যে, আত্মসম্মান বজায় রেখে সবার শ্রদ্ধা নিয়ে যৌবনকাল কাটিয়েছি। কখনো কারো কাছ থেকে কটুক্তি শুনিনি, কেউ উত্যক্ত করার সাহসও পায় নি। বিয়ের পরে আফসারের দাপটের কারণেও কেউ কখনো কোন রকম অসভ্য ব্যবহার করার সাহস পায় নি। অথচ সুদূর পরবাসে এই বয়েসে এসে এমন একটি নাজেহাল দশায় পড়তে হবে তা কল্পনাও করিনি।
আমাদের সাথেই কাজ করে লোকটা, তিন সন্তানের জনক, নাম খোদাবক্স, বাড়ী সিলেটে। চৌধুরী ভাই, সমীর ভাই, আমি আর খোদাবক্স সেকেন্ড শিফটে কাজ করি। বেশীর ভাগই গুজরাটি, ভিয়েতনামী আর স্প্যানিশ। এক ধরণের মুখ বন্ধ করেই সবাইকে কাজ করতে হয়। গুটি কয়েক বাঙালী এক সাথে কাজ করি, থাকিও পাশাপাশি শহরে। স্বাভাবিক ভাবেই নিজেদের ভাষায় কথা বলা, দেশের খবরাখবর নেয়া, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে মেলামেশা করা, এবং এশীয় গ্রোসারীতে দেখা সাক্ষাত প্রায়ই হয়ে থাকে। কাজের সুবাদে আলাপচারিতা একটু বেশীই হয় বলা চলে। এসব সৌজন্যমূলক আচার-ব্যবহার স্বভাষীদের মধ্যে হতেই পারে। আফসারও সবার সাথে পরিচিত এবং সে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কই বজায় রাখে সবার সাথে।
কিন্তু কিছুদিন থেকে লক্ষ্য করছি খোদাবক্স কেমন যেন অস্বাভাবিক আচরণ করছেন। কাজের অজুহাতে তিনি সব সময় আমার কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করছেন, অপ্রয়োজনে কথা বলছেন, অদ্ভূত চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছেন। কাজের সময়ের আগে ক্যাফেটেরিয়াতে উপস্থিত থাকছেন, আমাদের (সারাহ্ হিগিংস আমাকে রাইড দেয়) গাড়ীর পাশে গাড়ী পার্ক করছেন। ব্যাপারটা সবাই লক্ষ্য করছে এবং সবাই মুখ টিপে হাসে।
দেখো তোমার বয়ফ্রেন্ড কেমন করে তাকাচ্ছে – কোরিয়ান গ্রুপ লীডার খোয়াং একদিন বললো।
আমি কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেলাম তার কথা শুনে।
বিশুর বয়ফ্রেন্ড আসছে- আরেকদিন এলিজাবেথ খোদাবক্সকে প্রোডাকশন ফ্লোরে ঢুকতে দেখে নীচু স্বরে আমাকে শুনিয়ে বললো। খোদাবক্স মূলতঃ আলাদা জায়গায় কাজ করে। ওখানে কাজ কম থাকলে সে আমাদের ফ্লোরে এসে কাজ করে।
ডোন্ট সে দ্যাট লিজ, আমি প্রতিবাদ করে উঠলাম, আই ডোন্ট হ্যাভ এ্যানি বয়ফ্রেন্ড। আই হ্যাভ হাজব্যান্ড এন্ড ফ্যামিলি, ইউ নো দ্যাট।
তাহলে ও যে তোমার পেছনে ঘুর ঘুর করে কিছু বলো না কেন ? গুজরাটি চেতনাদি পাশ থেকে বলে উঠলো।
আসলে তুমি তো জানো, আমার মা ব্রেনস্ট্রোক হয়ে হাসপাতালে, আমার মানসিক অবস্থা ভালো নেই, আমি চেতনাকে বললাম, কি করে যে দেশে যাবো সে চিন্তায় আমি অস্থির।
আফসারকে এ ব্যাপারে কিছু বলেছিস্ ?
না এখনো বলিনি।
বলে রাখা উচিত, নীতা পাশ থেকে বললো, না হলে তোকে ভুল বুঝতে পারে।
তাকে আমি চিনি।
পুরুষদের বিশ্বাস নেই, চেতনা বললো, তুই ওকে সব বলে দে।
ও দেশে যাওয়ার জন্যে খুব ঝামেলায় আছে দিদি-।
তুই যা ভালো বুঝিস্ কর।

দেশে যাওয়ার দিনক্ষণ ঠিক হয়ে গেলো। বারো দিনের জন্যে আম্মাকে এক নজর দেখতে যাওয়া। এতো টাকা খরচ করে দেশে অল্প দিনের জন্যে যাওয়ার কোন মানে হয় না। কিন্তু একদিকে যেমন চাকরী, অন্যদিকে বাচ্চাদের লেখাপড়া। দু’দিক সামলাতে গেলে এ ছাড়া উপায় নেই। যাহোক দেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হবার পর থেকে মনটা আমার উচাটন হয়ে গেলো। অপেক্ষা যেনো এক দুঃসহ বোঝা হয়ে গেলো। কখন পৌছঁবো দেশের মাটিতে, কখন দেখবো আব্বা-আম্মাকে, ভাই-বোনদের। এক নিদারুণ অস্থিরতা আমাকে পেয়ে বসলো।
এর মাঝে খোদাবক্স দুয়েকটা সিনক্রিয়েট করে ফেললো।
একদিন পাঞ্চ আউটের লাইনে দাঁড়িয়ে পেছন থেকে বললো, আপনি আমাকে এড়িয়ে চলেন কেন ? অন্যদের সাথে এমন ঘনিষ্টভাবে কথা বলেন, অথচ আমাকে দেখেও যেনো চেনেন না।
দেখুন, আমি কার সাথে কথা বলবো না বলবো সেটা সম্পূর্ণ আমার ব্যাপার, আমি রেগে গেলাম, আপনি নিজের আচরণ ঠিক করুন। আমার পেছনে কেনো আপনি ঘুর ঘুর করেন, আপনার কোন লজ্জাবোধ নেই ?
কি যে বলেন ভাবী– সে আমতা আমতা করে, আমি তো আপন ভেবে কথাটা বললাম।
ভুলে যাবেন না আমরা এখানে শুধু কলিগ, আমি খরচোখে তাকালাম, এখানে আপনপর বলতে কিছু নেই।
আপনি খুব কঠিন মানুষ- মৃদু গলায় এ কথা বলে সে সরে গেলো।
খুব ভালো করেছিস্- বিল্ডিং থেকে বের হবার সময় বললো চেতনাদি।
বলো তো দিদি, কাঁহাতক এসব বাদঁরামি সহ্য করা যায় ?
দুনিয়াটা শক্তের ভক্ত বিশু।
তা জানি, আমি বললাম, কিন্তু ভদ্রতাকে অনেকেই দুর্বলতা মনে করে।
যে যেমন তার সাথে তেমন ব্যবহারই করতে হয়, নিজের গাড়ীর দিকে যেতে যেতে সে বললো, তবে তুই শিগগিরই আফসারকে সব বলে দে।
দেশ থেকে ঘুরে এসে বলবো দিদি, আমি সারার গাড়ীর দিকে এগিয়ে গেলাম, এখন ওর মেজাজ ঠিক নেই।
ঠিক আছে, ভালো থাকিস্ ।
চেতনাদি ক’দিনের ছুটিতে ক্যালিফোর্নিয়া যাচ্ছে।
লাগেজ গোছাতে একপ্রকার হিমশিম খেতে হচ্ছে। বাচ্চাদের ছোট হয়ে যাওয়া অনেক নতুন কাপড় নিতে হচ্ছে। এগুলোতেই প্রায় তিনটা বড়ো লাগেজ ভরে গেলো। স্বপন না থাকলে আফসার আর আমার পক্ষে এগুলো গোছানো খুবই কষ্টকর হয়ে যেতো। এর ওপর তো আছে দিন ফুরনোর মনের তাগিদ। আফসার দৌড়াচ্ছে বাচ্চাদের হোম ওয়ার্ক ম্যানেজ করতে, টুকিটাকি গিফট কিনতে, প্রকাশিতব্য বইয়ের পান্ডুলিপি তৈরী করতে, দু’ছেলের স্পোর্টস সিডিউল বদলাতে, বাড়ীর সকল বিল পে করতে এবং বেসমেন্ট আর স্টোররুম গুছাতে।
একটা ঝড়ো ব্যস্ততায় যেমন অস্থির সময় কাটাচ্ছি তেমনি শুরু হয়েছে শৈত্যপ্রবাহ। এবার সেপ্টেম্বরের শুরুতেই ঠান্ডার প্রকোপ বেড়েছে। বেশী খারাপ লাগছে অল্প সময়ের জন্যে দেশে যাওয়া। হয়তো কারো সাথেই তেমন দেখা সাক্ষাতের সুযোগ হবে না। অপরদিকে দেশের আবহাওয়াও তেমন সুবিধের নয়। যেমন হচ্ছে বৃষ্টি, তেমনি প্রচন্ড গরম, তার ওপর আছে বৈদ্যুতিক লোডসেডিং, পানীয়জলের সংকট। ছেলে মেয়েদের নিয়ে কি অবস্থার মুখোমুখি হবো জানি না।
এসব নানান চিন্তায় ভারাক্রান্ত মন নিয়ে সারার পিছু পিছু কাজ শেষে গাড়ীতে উঠতে যাবো এসময় খোদাবক্স এসে হাজির। দেখলাম সে আমাদের পাশেই গাড়ী পার্ক করেছে।
কি ভাবী কিছু যে খাওয়া দাওয়া করেন না দেখলাম – বেহায়া ভঙ্গীতে সে গাড়ীর দরোজা ধরে দাঁড়ালো।
আমার খাওয়া দাওয়া নিয়ে আপনার মাথাব্যথা কেন, আমি মুখিয়ে উঠলাম।
এমন করে বলেন কেন ? সে মুখে মলিন ভাব ফোটালো, মনে তো হয় কিছুই আনেন না।
তাই নাকি ? আমার গা জ্বলে গেলো, তাহলে কি আমি খালি টিফিনবক্স নিয়ে আসি ?
দেখি কি আছে টিফিনবক্সে – বলে সে টিফিনবক্স ধরে টান দিলো।
ছাড়েন বলছি- আমি জোরে বলে উঠলাম।
হোয়াট ইউ ডুয়িং ম্যান ? সারা গাড়ী স্টার্ট দিয়ে বেরিয়ে এলো, হোয়াই ইউ ডিস্টার্বিং হার ? ইটস্ ডিস্ গাস্টিং।
আপনি খুবই নিষ্ঠুরতা দেখাচ্ছেন – সে সারার কথার জবাব না দিয়ে এক পর্যায়ে আমার হাত ধরে ফেললো।
দেখুন, আপনি কিন্তু সীমা ছাড়াচ্ছেন, আমি ঝটকা মেরে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে গাড়ীতে ঢুকে গেলাম, পরিণতি ভালো হবে না বলে রাখলাম।
সরি ভাবী, সরি- বলে তার গাড়ীর দিকে চলে গেলো।
ইউ হ্যাভ টু রিপোর্ট টু দ্য হিউম্যান রিসোর্স, সারা গম্ভীর মুখে গাড়ী নিয়ে রাস্তায় নামলো, ইটস্ টু মাচ।
আই উইল সারা, আমি মৃদু গলায় বললাম, লেট মি কাম ব্যাক ফ্রম মাই কান্ট্রি, আই উইল টিচ হিম।
বুকের ভেতর অব্যক্ত এক যন্ত্রণা নিয়ে আফসারের পাশে শুয়ে আকাশ পাতাল ভাবছি। ও ঘুমুচ্ছে অকাতরে। আমার উপস্থিতি টের পেয়ে ঘুমঘোরে ডেকে উঠলো ’বউ বউ’ বলে। ভোর সাড়ে তিনটায় উঠতে হবে ওকে। ভাবছি ওকে না বলে কি ভুল করছি ? বললে সে বিষয়টাকে সিরিয়াসলি নেবে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এখন বললে দেশে যাওয়ার আনন্দটা তার মাটি হবে। ওর উচ্ছলতায় ভাটা পড়বে এবং এক্ষুনি কিছু একটা করার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠবে।
আমাকে ধৈর্য্য ধরতে হবে। আর মাত্র দু’দিন যাবো কাজে। দেশ থেকে ঘুরে এসে এর একটা বিহিত করতে হবে।
স্বপ্নের মতো দেশে গেলাম আর ফিরে এলাম। প্রতিনিয়ত স্বপ্নে প্রিয়মুখ গুলোকে যেমন দেখি তেমনি যেন দেখে এলাম এক ঝলক। দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তি, আদিবের অসুস্থতা, ট্রাভেল এজেন্সীর জটিলতা এবং ঢাকা এয়ারপোর্টের চালিয়াতি সামলে ফিরে আসতে পেরে যেন স্বস্তিবোধ করছি। তবে আশ্চর্যের বিষয় যে, দীর্ঘ পাঁচটি বছর পরে দেশে গিয়ে একটুও ভালো লাগেনি। মা’র অসুস্থতা, ছোট ভাইটার অসুস্থতা, ভাই-বোনদের মনোমালিন্য, দেশের দুঃসহ আবহাওয়া- সব মিলিয়ে আমি যেন দেশের ব্যাপারে এক রকম আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম। যে উচ্ছাস নিয়ে দেশে গেলাম তা যেন উবে গেলো। তবে সবচেয়ে বেশী খারাপ লাগলো, আমি হয়তো আব্বা-আম্মাকে আর দেখতে পাবো না।
এর ভেতর আফসারের অবস্থা দেখে আমি অবাক হলাম। সে যেনো দেশের আবহাওয়ায় একেবারে কাবু হয়ে গেলো। ঝড়বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বড়ো হওয়া মানুষটি যেন ভ্যাপসা গরম, তুমুল বর্ষণ আর লোডসেডিংয়ে একেবারে অস্থির হয়ে উঠলো। যে দেশের মাটি ও মানুষের সাথে ওর আঁতের সম্পর্ক তা যেন হঠাৎ করে পাল্টে গেলো। অনুভূতি ধারালো থাকলেও এডজাস্ট করা যেন দুরূহ হয়ে গেলো। বাচ্চাদের সাথে সাথে সেও ফিরে আসার জন্যে অস্থির হয়ে উঠলো। ফিরে এসেই স্বাভাবিক মানুষ। ব্যস্ত হয়ে পড়লো কাজ, লেখালেখি আর বাচ্চাদের খেলাধূলা নিয়ে।
এসব ভাবতে ভাবতে বেলা হয়ে গেলো, সময় হয়ে গেলো কাজে যাবার। ঝটপট তৈরী হতে না হতেই সারা এসে হর্ণ দিলো। আমি গাড়ীর কাছে আসতেই সে বেরিয়ে এসে আমাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরলো।
আই মিসড্ ইউ বিশু-।
মি টু – আবেগে আমি প্রায় কেঁদে ফেললাম। রক্তের কোন সম্পর্ক নেই অথচ এমন আন্তরিকতা যেন হৃদয় ছুঁয়ে যায়।
হাউ ইউর মম ?
শী ইজ লিটল বিট ও কে, আমি বেল্ট লাগাতে লাগাতে বললাম, বাট ইট উইল টেক টাইম। এভরিবডি হোপ ফুল, শী কুড বি নরম্যাল সো ফার।
আই নো, সে পার্কিং লটে পার্ক করলো গাড়ী, ইট ইজ সো হার্ড। গড উইল হেল্প হার।
এলেন তাহলে? ফিচকে হাসি নিয়ে খোদাবক্স ক্যাফেটেরিয়াতে চেয়ার টেনে আমার সামনে এসে বসলো, তা আপনার আম্মা কেমন আছেন?
একটু ভালোর দিকে, আমি অনিচ্ছাকৃত জবাব দিয়ে দরোজার দিকে তাকালাম। চেতনা আসছে। আমি একপ্রকার ছুটে তার কাছে চলে এলাম। সে আমাকে ঝাপটে ধরলো।
কেমন আছিস রে?
ভালো, তুমি কেমন আছো দিদি?
ভালো আছি, সে টিফিনবক্সটা রেখে চেয়ারে এসে বসলো, তা মা’র অবস্থা কেমন?
একটু চলাফেরা করতে পারছে, আমিও বসলাম, তবে কথা আটকে যায়। বলার চেষ্টা করে কিন্তু তেমন কিছু বোঝা যায় না।
স্ট্রোক হলে কিছু না কিছু হারাতে হয়রে, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে উঠে দাঁড়ালো, আমার বাবাতো তিনবছর বিছানাতেই পড়ে আছে।
এখন চল।
চলো। কার্ড পাঞ্চ করে ভেতরে ঢুকে গেলাম।
অল্প ক’দিনের অনুপস্থিতির কারণে সবকিছু কেমন যেন নতুন আর অচেনা লাগছে। মনে হচ্ছে আমি যেন আম্মার কাছে বসে আছি, বোনদের নিয়ে আড্ডা দিচ্ছি, নয়তো চেনা পথ দিয়ে হাঁটছি। যদিও একটা অস্বস্তিকর অবস্থা নিয়ে কয়টা দিন দেশে কাটিয়ে এসেছি কিন্তু এখন এই কাজের ব্যতিব্যস্ততার মধ্যেও মনে হচ্ছে দেশের সুবাস যেন আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।
বিশু কাম ওভার হিয়ার – খোয়াং সিলিং মেশিনের কাছ থেকে ডাক দিলো।
হাতের কাজটা নীতাকে বুঝিয়ে দিয়ে আমি ছুটে গেলাম।
তুমি এ কাজটা একটু জলদি শেষ করে দাও, সে আমাকে এনজিও পাউসগুলো এগিয়ে দিলো।
অলরাইট খোয়াং।
আচ্ছা, তুমি কি খেয়াল করেছো খোদা সব সময় তোমার আশপাশে ঘুর ঘুর করে?
হ্যাঁ। মানে সে আজকেও করছিলো। কই আমি দেখিনিতো?
তাহলে কমপ্লেইন করছো না কেন?
করবো।
ইমিডিয়েটলি করো।
হ্যাঁ।
খোয়াং পাশ থেকে সরে গেলো আর আমি যেন লজ্জায় মাটিতে ঢুকে গেলাম। ভাবতে লাগলাম লোকটার বজ্জাতি কিভাবে ছোটানো যায়। গত এক বছরের ওপর সে আমার শান্তি নষ্ট করে চলেছে, সবার কাছে আমাকে হেয় করে তুলেছে। এমন নচ্ছারকে শায়েস্তা করা ছাড়া কোন উপায় নেই। আফসারকে আজ সব খুলে বলতে হবে। কালকেই ওর বিরুদ্ধে একটা ব্যবস্থা নিতে হবে। ভাবতে ভাবতে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতে গিয়ে দেখি সে আর ফোর মেশিনের পাশের ইনস্পেকশন টেবিলে ট্রে হাতে নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে ক্যাবলার মতো।
চোখ ফেরাতে গিয়ে দেখি চেতনা খরচোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। সেখানে জ্বলন্ত প্রশ্ন, কি এখনো কিছু করবি না?
ঘৃণায় আমার গা রি রি করে উঠলো।
রাতে সব শুনে আফসার গুম মেরে গেলো। তার চেহারা দেখে ভয় হলো সে আবার সরাসরি কিছু করে বসে কি না। সে তখুনি সারাকে ফোন করলো। সারা জানালো বিশুর উচিত ছিলো আরো আগে কমপ্লেইন করা। আমিতো রিটায়ারমেন্টে যাচ্ছি পরশু থেকে। দরকার হলে জানিও।
আসলে তুমি বোকাই র’য়ে গেলে, অনুচ্চ গলায় বললো সে, কাল একটু বিজয়দা-কে ঘটনাটা বলি, তারপর যা হয় একটা কিছু করবো।
বলে কোন লাভ হবে না, আমি প্রতিবাদ করলাম, আমি কালই কমপ্লেইন করবো, তুমি একটা চিঠি লিখে দাও।
ঠিক আছে।
আফসারকে খুব ভোরে উঠতে হবে জেনেও মাঝরাতে লিখতে বসালাম। কারণ আমার মাথাটা ঝাঁ ঝাঁ করছে। বজ্জাত লোকটা আমাকে নিয়ে কৌতুকের জন্ম দেবে, সবার কাছে আমাকে হাস্যেস্পদে পরিণত করবে, আর আমি দিনের পর দিন মুখ বুঁেজ সয়ে যাবো তা হবে না।
রাত দেড়টায় চিঠিটা শেষ করে বিছানায় পড়ামাত্রই ঘুমিয়ে গেলো আফসার। আমি ঘুমুতে পারলাম না। দেখতে দেখতে ভোর হয়ে এলো। এলার্ম শুনে লাফ দিয়ে উঠলো আফসার। আমি ঘুমের ভান করে পড়ে রইলাম। ঘুমাইনি দেখলে বকা খেতে হবে।
নীচে সেভিং মেশিনের আওয়াজ হচ্ছে। আমি ধীর পায়ে নেমে এসে কিচেনে ঢুকলাম। ওর সামান্য নাস্তা আর টিফিন বক্সটা তৈরী করে টেবিলে দিলাম।
তুমি আবার উঠে এলে কেন?
আমি কখনো উঠি না বুঝি?
সে তো জানি। স্বাভাবিক ভঙ্গীতে হাসলো আফসার। আমার বুকে সন্তর্পনে চেপে বসা বোঝাটা যেন সুরুৎ করে নেমে গেলো। যদিও ভুল করেও আফসার আমাকে ভুল বোঝে না, তবুও কেন যেন মনের মধ্যে খচ খচ করছিলো।
যা হোক, সে চায়ে চুমুক দিলো,বাচ্চারা চলে যাবার পর দশটার মধ্যে তুমি সেলিনা ভাবীর ছেলে সুমনকে নিয়ে গিয়ে চিঠিটা দিয়ে আসবে। এসে ঘুমিয়ে নেবে।
ঠিক আছে।
আফসার ঝটপট বেরিয়ে গেলো।
দিনের আলো তখন মাত্র চোখ খুলছে।
আম্মা, খিদা -। ঘুম চোখে আবির উঠে দরোজা ধরে দাঁড়ালো।
মুখ ধুয়ে নীচে এসো। আমি মাথা-মুখে হাত বুলিয়ে নীচে নেমে এলাম, কি খাবে?
সিরিয়াল দাও, আবির বাথরুমে ঢুকে গেলো।
আদিব-অর্র্পি জলদি ওঠো-।
আসি আম্মু -লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নামলো অর্র্পি। আদিবটা ভীষণ ঘুম কাতুরে।
বাচ্চাদের রেডি করে বিদায় দিতে দিতে সকালটা একপ্রকার হারিয়ে যায়। দিনের এই ব্যস্ততম সময়টা কি করে যে কেটে যায় ভেবেও পাই না। আবির যায় হেঁটে, শেষে। ও এখনো এলিমেন্টারীতে। আগামী বছর যাবে মিডল্ স্কুলে আদিবের সাথে। অর্পি চলে যাবে হাইস্কুলে। তখন সে যাবে ভোর সাড়ে ছ’টায়। তখন মেয়েটা একা হয়ে যাবে।
আবির বেরিয়ে যাবার পর একদম একা। নিঃছিদ্র সময়ের নীরব দংশন। অবশ্য আফসার এর মাঝে বার দুয়েক ফোন কওে বাচ্চাদের সাথে কথা বলে। পরে আমার সাথে কথা বলে নেয় সংসারের টুকিটাকি বিষয়ে।
একটু আগে ফোনটা রাখার পর এখন মনে হচ্ছে আমি সম্পূর্ণ একা। আজ কিছু রান্না করতে মন চাচ্ছে না। যা আছে তাতে চলে যাবে। আমাকে এখন যেতে হবে সুমনকে নিয়ে, অফিসে। দরখাস্তটা জমা দিয়ে আসতে হবে। ইতর লোকটা আমার মান-সম্মান ধূলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। ওর একটা শাস্তি হওয়া দরকার।
আমি ঝটপট তৈরী হয়ে নিলাম।

******************