অমিত রেজা চৌধুরী
ভাঙা খাঁচা
পাখি কেনাবেচার বাজারে গিয়ে দেখি,
রোজ যে দুটো ঘুঘু আমাদের উঠোনে খেতে আসত
তাদের এ্যারেস্ট করে আনা হয়েছে, বিনা ওয়ারেন্টে!
উন্নয়নভীতি পররাষ্ট্রভীতি এমনকি হায়ারার্কিভীতি নিয়েও
যার কোন ধারণা নেই,
সেও পাখি কেনাবেচার বাজারে
উদ্ধত ছুরি হাতে নিজেকে আয়নার মধ্যে দৌড়াতে দেখেছিল!
জ্ঞানমাত্রই নেক্রোফিলিয়াক।
ড্রাগনের রক্তের নেশা
কাঁটা মান্দার গাছের আরেকটা নাম মাদার
যেভাবে চন্দ্রসুড়ঙ্গের ভিতরে
খেয়ার ক্ষতগুলি আমি হৃদয় পেতে নিয়েছি
একটা ডানা নিয়ে উড়তে উড়তে যে ছোট্ট পরীটা
ফুল বিক্রি করছে পথে, থমথমে আলেয়ায়
তার মকর সংক্রান্তি, নিঝুম দৈত্য, সেতুচূর্ণ এড়াতে
আমি তরজাগানের এক নর্তক হয় আমৃত্যু নেচে চলেছি
মাঝনদীতে ডুবে যেতে থাকা ভেলার উপর
ঈশ্বরের মনের বিষ হল সময়।
জতুগৃহ
মানুষের বেশি গভীরে যেতে নেই
আঁশবটি, উদাসী মল্লিকা, রেশমকীট বেরিয়ে আসে
মানুষের বেশি গভীরে যেতে নেই
ঘোড়দৌড়ের মাঝে হতভম্ব নীটশের ঘোড়াটি দাঁড়িয়ে পড়ে
গ্রাফিক নভেলিস্টের এর বেশী এগোতে নেই
অর্ণব আহমেদ
রাতের অভিধান জুড়ে অন্তর্গত নিনাদ শুয়ে আছি গভীর রাতের তলায় শরীর নিংড়ে রোজ রাতের গভীর তলায় আমাকে ভর করে পিঁপড়ে হেঁটে যাই , শুয়ে থাকি কদর্য আমার ভেতর বাজার ভর্তি বাজারের মূর্ছনায়, ভীমরুলের চাকে ছোড়া শিশুর ঢিলের ভঙ্গিমায় চোখ অরণ্যে অই উড়ছে যে পাখি,সেই ডানার শব্দে ফেটে যায় ডালিম।বনে উড়ুক্কু মাছের চোখে ঘনায় রক্তাভ শিহরণ। শব্দকে ভাংতি করে বোধের আচকান টান মারে দৃশ্যেরা, আদি নিভৃত বেদনা। চোখ এক নরম নদী, যেখানে সাঁতার কাটতে আসে বিভৎস দৃশ্যেরা। মুখ তীব্রতার বনাঞ্চলে সারাদিন পাতাদের ঝরা।তুমুল ক্ষয় জুড়ে প্রপঞ্চ, অন্তরমোহ কার? ভাবি,অয়োময় ভেঙে কেটে যাবে খরা ,উদ্যানে হাসা বকুলের মুখ তোমার। দাউদাউ আমার পোড়ার প্রতিকৃতি। বুক এই তঞ্চক পথ হারিয়ে ফেলেছে সীমানা। আবেগসর্বস্ব গাছগুলো উঁচু, জঙ্গল হয়ে দাঁড়িয়ে, ঘর বাড়ি নেই কোনও। এখানে মনে পড়লে তুমি কোথাকার কোন শিলাস্তৃত ভূমি, ফুল ফোটেনা আর। ক্ষুধার্ত জলের রেখায় আকাশ ভেঙে পড়লেও মানুষের মাটি থাকে অস্ত যাওয়া মানুষের আকশ কেমন হয়? খুলে দেখি মাংস মেদ হাড় ক্ষুধার্ত জলের রেখাগুলো-
|
অসীম ইশতিয়াক এর তিনটি কবিতা
মাছরাঙা ও কাছিমের গাথা
রাজকন্যাকে মাছরাঙা ভাবা হয়
সে রঙীন সুখের জন্মজাত, আমাদের মর্যাদার স্কেল।
কাছিম হলো দুখীদের ঈশ্বর
খুবই স্লথ, সাদাকালো আর আটপৌরে।
কাছিম বলতে একটা ঢাউস পাহাড় কিংবা জঞ্জাল ভাবুন।
কখনও ভাববেননা পায়ের নিচে লুকিয়ে থাকা ঘাস
প্রতিটি রাজকন্যা হত্যার পর একটি কাছিমের জন্ম হয়
আমাদের কাছিম ও রাজকন্যারা হলো রূপক
এদের কোনো প্রয়োজন নেই।
একজন দোতারাবাদককে আপনারা গ্ল্যাডিয়েটর বানালেন
আর খেলতে দিলেন সাপলুডু; হাস্যকর।
সুফিদের আয়না
প্রিয় সুফির সঙ্গে সমতালে নৃত্যে মেতে থাকা চাঁদ, তোমার শক্তি সঞ্চয় হতে আর কতো সময় লাগবে?
বৃদ্ধ সিংহ মরেছে অনেক আগেই। গুহাতে প্রদীপ জ্বালানো হয়েছে তাও বহুকাল আগে। শিকারের আইন একই রয়ে গেছে। গোত্রপিতার মতো মহান কোন নেকড়ে তার ঔদার্য ছড়িয়েছে বহু আকাশে, সাদা ফুলের মতোই। আর তোমার হিংস্রতার ঠিকানা হয়েছে বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা। পৃথিবীর জৌলুস আরও উজ্জ্বল হয়েছে। পাখিদের ভাষা বুঝে নিতে কবিগণ হয়েছে আরও ক্লান্ত। কোথাও শান্তি নেই; নেই প্রেমিকাদের বুকে বা সন্তানদের মুখে। এই তো নিষ্পাপ অভিশাপ। এর পরিনতি হলো নিজেকে মহান ঘোষণা করা, সকলে এবার বশ্যতা স্বীকার করুক। একেই বলে রাজা হয়ে ওঠা।
পৃথিবীর প্রাচীনতম মমতাসমূহে মিশে আছে বিষ। তোমার সুফলা সময়ে সে তোমাকে মেরে ফেলতে পারে। এবং খুন হবার পর তার পরিচয় পাওয়া যাবে সে তোমার বন্ধু ছিল। এখন তোমার শহরের রাজকীয় পদধারী।
বেলুনের মতো কিছুটা বাতাস তোমার প্রাণের কাছে বলবে তুমি শক্তিশালী হয়ে ওঠো, রাজা হয়ে ওঠো। রাজা হবার পথটা সহজ। কানের কাছে কোকিলের গান বলে যাবে জাহাজের ব্যাবসার খোঁজ। তুমি হয়ে উঠবে পুঁজিপতি। বেড়ালের ঘ্রাণ শক্তির মতো আদুরে অবিশ্বাস তোমাকে বজ্রপাতের মতোই নিখুঁত কারিগর বানিয়ে নেবে। যুদ্ধের ময়দানে তুমি ফিরে পাবে অপার কোনো মরমী সঙ্গীত।
নক্ষত্রকুমির
হা হা করে হাসতে থাকো আর উপভোগ করতে থাকো নিজেকে। যা কিছু মনে আসে করো। তোমার উপভোগ্যতা, পাগলামী প্রাচীন জ্ঞান বিকাশের মতো মানুষের কাছে প্রয়োজনীয় হয়ে উঠবে। কী আর মেনে নেয়না সমাজ? সবইতো নেয়। এক সুমহান ইলাস্টিসিটি নিয়ে টিকে আছে সে। আছে মদ, জুয়া, অভিশাপ আর ক্ষমতার গান।
সময়ের অজস্র ত্রাসে তুমি হয়ে উঠবে নক্ষত্রকুমির। এ যেন ঘনায়িত চাপ বা অমূলক সংখ্যা নির্ণয়। কী-ই বা চাও তুমি? ক্ষমতা, স্বচ্ছলতা! এভাবে ভাবতে থাকার পর মানুষই তোমার স্বপ্নসাইকেল থেকে খুলে নিয়েছে চাকা। এই সরল অংকে পড়ে আছে অনাদি জীবন। স্বপ্নে পাখা গজালে তুমি ক্লান্তিতে ভর দিয়ে উড়ো।
নিস্ফলা আকাশ, বেবুনবৃক্ষের মতো অনাদি স্মৃতিচিহ্নসমেত শান্ত সমাধিস্থ কবর আমাদের যন্ত্রনাখন্ড। ভেসে থাকো মহাকালে সুফিদের জ্ঞান আর প্রেমরস নিয়ে। বাজারে যাও; চাল কেনো। ডাক্তারের কাছে যাও, বাসনা জিইয়ে রাখো, যেন আশ্চর্যকে মেনে নিয়েছো।
মানুষের চারপাশে কাকদের কা কা, নৌকার চলাচল আর ছোটগল্প থেকে বেঁচে ফেরা তরকারি বিক্রেতার হরেক পসরায় তোমার ক্লান্তির ঘা। অতৃপ্ত আত্মার মতো সবখানে বিতাড়িত হতে গিয়ে তুমি প্রাণ নিয়ে এক জটিল অঙ্ক উপহার পাবে। নিমগাছে বসে থাকা ঘুঘুদের দেখ। আরোগ্য সাড়াতে নয়, তোমাকে আরও বিভ্রান্ত করতে পাশেই উড়বে হলুদ প্রজাপতি, লাল পিঁপড়া আর কালো পিঁপড়ারা। সময়ের গভীর ক্ষত হতে তুমি শুধু দুর্গন্ধ পাবে গলিত শবের।
আপন রহমান
(১) ক্ষুধার কথকতা
নুয়ে পড়া বিকেলের-বাদামী রোদ্দুরে বসে; পশ্চিমের সূয্যিটাকে মনে হয় ঝলসানো রুটি!
চেয়ে দেখো;
হালের সুকান্ত আমি নিজেই-
নিয়তির কলম দিয়ে পেটের জমিনে লিখে যাই ক্ষুধার কথকতা!
পড়ে নাও-বুঝে নাও- যদি থাকে অন্তরে আলো।
-না থাকলে?
জনপদে জ্বলা ঐ শোকের মলিন চিতা থেকে আগুন এনে অন্তরে ঢালো;
বুঝবে তবে সব…!
এ নিঠুর সময় একে একে কেড়ে নিলো নগর শহরের যত হাসি কলরব -ছন্দ -আনন্দে মোড়া গীতি…
নিতে পারলোনা শুধু;নিতে পারলোনা এই জঠরে জ্বলা ক্ষুধার আগুনটুকু!
বড়বেশী তেজ বুঝি তার?
ভেসে যাক সে প্রশ্ন মহাকালের দ্বারে…
হালের সুকান্ত লিখুক-
ক্ষুধার কথকতা……..!
আর?
-ক্যামেরায় বন্দী থাক
তোমাদের এইসব মেকি মানবতা….!
(২) জীবন ও নদী
জীবন নদীর মত বয়ে চলে?
নাকি; নদী বয়ে যায় জীবনের মত!
অমীমাংসিত এই প্রশ্ন
কুঁরে-কুঁরে খায় মগজের ঘিলু!
এদিকে ক্রমশ: জাগ্রত হয়
পায়ের তলার নিদ্রিত মাটি!
ভীষণ সংগোপনে জীবনকে কাছে টানে সময়ের নদী…!
অবশেষে,
যখন বুঝি-
জীবন জীবনের মতই বয়ে চলে
নদী নদীর মতই…!
কিন্তু;
ততোদিনে সময় হারিয়ে গেছে ঢের!
নিয়ে গেছে জীবনের সব কিছুই
সময়ের নদী
লিখে রেখে গেছে তারও উত্তর
-পৃথিবীর বয়সী এ বিছানার বুকে
সময়ের ফসল আমরা সবে…!
(৩) সুখ মলম
কিছুটা সুখ জমিয়ে রেখেছিলাম
দূর্দিনে-মলমের মত ব্যবহার করবো বলে…
ভেবেছিলাম;
যাপিত জীবনে যখন হৃদয়টা ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যাবে
হৃদয়ের গাত্র জুড়ে যখন ভরে উঠবে
অপার্থিব বিষন্নতা-দু:খ-কষ্ট ও গøাণি নামক ক্ষতে…
তখন;
গোধূলির আলোয় মোড়া আঁধারে বসে বসে
একটু একটু করে সুখের সে মলম
দু:খের ক্ষতের
উপরে ছিটিয়ে দিবো…
বিধিবাম!
আজ এ দু:সময়ে সুখের মলম ভর্তি কৌটা হাতড়ে দেখি
হাওয়াই মিঠাইয়ের মত দু:খ হাওয়ার পরশ লেগে
চুপসে গেছে জমানো সে সুখ মলম!
আসলে জাগতিক নিয়ম হয়তোবা এমনিই-
“অভাগা যেদিকে চায়
সাগরও সুখিয়ে যায়!”
(৪) অভুক্ত
ভীষণ অভুক্ত আছি;
বহুকাল কোন কিছু খাওয়া হয়না!
তোমার সুর্বণরেখার মাতাল করা জলে
বহুকাল বহুকাল নাওয়া হয়না!
আজকাল কোথাও আর যাওয়া হয়না
প্রিয় -প্রিয় কত কিছু খাওয়া হয়না!
প্রিয় ওষ্ঠযুগল আমাকেই খোঁজে বুঝি?
বহুকাল অভুক্ত আছে সই
বলে দিও তারে তুমি, হবে ঢের পাগলামী
এ যুদ্ধ শেষে যদি বেঁচে রই।
পেট -মন ও মনন আছে বড় কষ্টে
চাইলেও কত কিছু পায়না!
আহ্!ভীষণ অভুক্ত আছে;
পেট ও হৃদয় জমিন!
বহুকাল কোন কিছু…খায়না!
আব্দুল্লাহ আল রিপন
শিকার
পোকাটির
নির্জন চোখের দিকে চেয়ে
নিজের ভেতর ডুবে গেল টিকটিকি।
এই অপরাধে, সমস্ত শরীর থেকে
কেটে গেল তার মগজের স্নায়ু।
ছাদের আঙুল খুলে ঝরে গেল
তরুণ টিকটিকিফুল।
আসে মাছি, পিপীলিকা…
অসুখের ঘ্রাণ
শরীর মগজ মন
ছুড়ে ফেলে দিয়ে কি যে নৃত্য তোলে
অ-টিকটিকির ক্ষত-মুদ্রিত লেজ!
এমন কি নয়, এমনই তো হয়,
অসুস্থ হয়েছে বলে, অমন সুগন্ধ আসে
গন্ধরাজের মাংস গলে গলে।
কোন ফুল আর অসুখের মতো সুরভি ছড়ায়!
সুস্থ মানুষের শরীর থেকে তো
সারাদিন শুধু সাবানের গন্ধ আসে–
মুখ খুললেই যেমন নেইলপলিশ, তেমন প্রত্যেকে।
স্মৃতিসুরভি
প্রতিসন্ধ্যায় প্রতিমুহূর্তে
সহস্র চিন্তার ভিড়ে ঘুমে স্বপ্নে
ধুয়ে রাখি মুছে রাখি
আজন্মআপন স্মৃতিছায়াছবি।
মুকুরিত স্মৃতিশব শত গ্রীষ্মে
জ্বলে পুড়ে রান্না হয়ে ফল হয়ে ওঠে।
সেই রেণু সেই অলি
সেইসব বাতাসের সমস্ত স্বর
পাতার পাঁকে গুটি– কিছুই নেই আর
আছে শুধু এক সুমিষ্ট ফল।
এ এক অদ্ভুত আহার
নির্যাস যার একক পথ্য
আমাদের প্রতিটি মৃত্যুঅসুখে।
এক বুড়ো বিধাতা আড়াল হতে নাড়ে
মানুষের প্রতিবিন্দু শরীর মগজ মন।
নাড়ে যে, বুঝতে দেবে না।
আরিফা মহুয়া
গুম
গুম হয়ে যাওয়া সেই চোখ দুটোর খোঁজে আজও ফেরারি।
গল্পের শেষে দেখা মেললো একজোড়া অন্ধ চোখের যা ছিল
প্রায়শ্চিত্ত।
ডুব
আজও জানিনা এই আমি, আমাকেই।
ডুব দিলাম নিজের মাঝেই, দেখি মন মন্দিরে ধ্যানে বসে এক সন্ন্যাসী,
আমিতো নেই কোথায় নিজ দেহ মনে।
ধ্যান ভেঙ্গো সন্ন্যাস আমার আয়ুর শেষ দিনে।
কাকতাড়ুয়া
নিজ দেহে গেঁথে রেখেছি কাকতাড়ুয়া
পাহাড়া দিচ্ছে পাহাড়া দিচ্ছে পাহাড়া দিচ্ছে।
আমি এখন কাকতাড়ুয়ার দখলে।
আলতাফ শাহনেওয়াজ
আলাদীনের গ্রামে
১.
গোপন সুখের কথা বিভূতিরা জানে।
গ্রাম ঘুরে ছল জাগা কাতর শরীর
খুঁজে পায় দমকল।
পাশের পাহাড়ে
তার কলঙ্কটি থাকে। সে আমার বিভা
প্ররোচিত কলঘরে নারীর মুহূর্ত
করেছে ধারণ আর মেপেছে অবোধ্য
স্তন—আঙুরের পাশে জাগিল যে আলো
সূর্যাস্তে ডুবুরি তারা।
ঢেউ আসে, এলো…
তোমাদের ঘরে গিয়ে এ কথা সে কথা—
এরপর সেই ঢেউ ভিজিয়েছে জল
শানের ঘাটলাগুলো। না-করো স্বীকার
আজ, ঘটিবাটি ভেসে তবু ফের আসো
আলাদীনদের গ্রামে।
এ পথ চেনো না
কুটিলা, নেমেছো জন্মে—বিভূতি মুহূর্তে…
২
ভাষাহীন গ্রামে তুমি অন্ধ আলাদীন
আগেই তৃষিত ছিলে তিষ্ঠ তারপর
বক্ষজুড়ে ছাতি ফাঁটে—পানির চিৎকার,
জলে কোনো নদী নেই, তিরে বিঁধে আছো!
তোমার ভেতরে একা বসে নমরুদ
জ্বেলে দেয় অষ্টধাতু, মোমের রমণী,
আটঘাট বেঁধে সেই আলোপথ ধরে
এখনো অনেক ক্রোশ…চল গেঁয়োভূত…
ফিরে এসো খেলাচ্ছলে আপন আড়ালে
পিপাসা তোমার মধ্যে দুই চক্ষু মেলে
আমার কাহিনীকার—লেখে পানিফল।
ওই ফল খেতে গিয়ে সহসা আবার
মিতালি-দোসর তুমি এসো আলাদীন,
এই দেহ ফুলগাছ, কাঁটা হয়ে বসো।
৩
গভীর যমুনা যদি শাস্ত্র-মতে দোলে
নদীতে বসিয়ে দিও বাক্য মুখোমুখি।
খেয়াপার হবে কারা, কাদের প্রস্থান?
তোমাকে জানাতে হবে ফিরতি চিঠিতে।
আবার আলোক বর্গি, চক্ষুসহ জ্বলে
ঘূর্ণিপথে বলে তারা, ‘কানাগলি ছেড়ে
দর্জির দোকানে বসো। থাকো চুপচাপ
নিয়তি ডালিমে একা, জেনানা মহলে। ’
তোমাকে বুঝতে হবে মঞ্জুরিত সব
কথার ভেতরে আছে বোবা নিঃসঙ্গতা
আড়েঠাড়ে আছে গাঢ় অনর্থের বন,
সেই বনে কাঠ কাটে অচেনা কাঠুরে।
দিন শেষে কাঠ নিয়ে গ্রামে সে পৌঁছায়;
তুমি পথে বাক্যহীন ফোয়ারা ছোটাও…
আশিক রহমান
বেদনাভারাতুর
কোন তারকার কণা কসমিক স্রোতে
অখিলে ভেসে এসে হয়েছে ফুল!
কোন সে ছায়াপথের নেবুলা বিস্ফারে
নীলিমা জুড়ে ওড়ে লাল শিমুল!
মগজের কোষে কোষে বাজে যে সন্তুর,
মহান হাহাকারে সাতটি তারে ;
কোন মহাজাগতিক বেদনাভারাতুর
ব্যথিত-নির্মান-টঙ্কারে!
কুয়াশা
দেখ, চারদিক ঘিরে কুয়াশা কিরকম ঘন হয়ে আসতেছে
আধাস্বচ্ছ কাঁচের পর্দার মত; গাছপালা, তুমি, তোমরা, সে,
তারা…সব, সবাই-ই কিরকম দূরে দূরে মনে হয়,
কিরকম সব অচেনা অচেনা মনে হয়!
মনে হয়, এ পৃথিবী নয়, অন্য কোনও তারকার গ্রহ,
আমরাও মানুষ নই, গাছেরাও গাছ নয়,
কেউই কেউ নয়। মনে হয় গাছেরা মাটিতে নাই;
ভাসতেছে শূন্যে, মানুষের পা-টা নাই;
ভেসে ভেসে চলে, ভেসে ভেসে থাকে,সবকিছু ভাসা ভাসা!
কুয়াশা ভেদ করে আসা ঘোলা জোসনা
কি অবাস্তব লাগে, ভৌতিক লাগে, অতিবাস্তব লাগে!
মনে হয়, ঘনতর হয়ে হয়ে এই কুয়াশা জমাট বরফ হয়ে যাবে;
আমি, তুমি, সে, আমরা, তোমরা ও তারা,
গাছপালা, সোনালী-রূপালী সব, সবকিছু,
সবাই আধাস্বচ্ছ স্ফটিকের ভেতরে জমে
অদ্ভুত জীবাষ্ম হয়ে থেকে যাব!
জাদু-টোনা
এ মফস্বলের ছায়াচ্ছন্ন আনাচে-কানাচে
ভাঁজে ও ভাঙায়, নোনাধরা দেওয়ালের বাঁকে
সেঁটে থাকে স্মৃতিসব কিরকম আঠায় আঠায়
আর তার জাদু-টোনা দিয়ে ব্যর্থ করে দেয়
ক্রমাগত আমাদের বিমান-প্রনালী!
#
কখনও কখনও দূরের নগর আর তার জুয়া
আর তার সুরা আর তার যাবতীয় চূড়া
টান দেয় ছিনালের মত আর
কি কি সব হুল্লোরের শব্দ আসে কানে,
ঈপ্সা উঁকি দেয়, ইচ্ছা বুদবুদ তোলে।
তবু মিলায় সেসব সন্ধ্যার আকাশে
চায়ের চুলার ধোঁয়া সাথে করে নিয়ে,
তবু সে কাঙ্খার ডানা মুড়ে আসে,
ব্যর্থ হয় আমাদের উড্ডয়ন-প্রকল্প সকল
সম্ভবত ঘোলা জোসনায় ধোয়া পোড়ো ঘাট
কিংবা ঐ প্রত্ন-সড়কের তুক-তাকে!
মানুষ অদ্ভুত প্রানী!
আমরাও মানুষের মত এইসব ব্যর্থতাকে ভালবাসি
মাদকের নাছোড় টানের মত!
আহমেদ স্বপন মাহমুদ
আগুনের রং
আমি আসলে ভাবতেছিলাম জারুল ফুল আর বরুণ গাছের কথা। দেশে কী কোনো বরুণ গাছ আছে? এ নিয়া কারো ব্যথা নাই মাথা! সে কথা জানি। এমনকি ক্রসফায়ারে না সড়কে খুন হইল কতজন, কে বা কারা তাতে কারো বাড়া কিছু আসে যায় না। টিয়া বা তোতার কোনো বায়না নাই! দেদারসে চলছে সব, যে যা চালাচ্ছে, এমনকি রদ্দি মালেরও কদর খুব বেশি, মেলায় খুব খুশি খুশি ভাব তাই, গলে ঢলে পড়ে!
শুনেছি, কত দীর্ঘ তোমার হাসি ও চুলের রঙের কথা।
আমি না অযথা এইসব শুনেটুনে মনে নেই নাই কিছু।
তবু মন এমন যে, সে-ও না না-বুঝে কিছু রঙের বর্ণনা দেখতে চায়
আর তার সুরের সাথে দিতে চায় উড়াল, ভূমধ্য সায়রের ওপর দিয়া।
সাগর তো মরে যাচ্ছে অতিদূষণে
জাতিসংঘ তাই ঘোষণা করেছে ওশান ডিকেড।
ঘোষণাতেই সার
তার কাজকারবার সবাই জানি
তবুও দুনিয়ায় তারে কিছু আছে মানামানি– রাষ্টের মাস্তানদের কাছে।
মাস্তান মানে প্রত্যেকটা দেশের সরকার একেকটা মাস্তান
না পুলিশ, না বিচারক, না ব্যবসায়ী, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী কেউ না
কেবল কবির কাছে এসে মাথা নত করে কুর্ণিশ জানায় সংঘের চেহারা
তাহারা যা যা করে, যা যা করতে চায়, যা যা করেছে সকলি গুলজার
আমার অনুদার মন কিনা জানে না প্রশংসার দাবীদার যারা তাদেরও মনে নিতে
কার সাথে কার পিরিতি জানি না
প্যারিস, কেবল তোমার হাসির রঙ লেগে আছে ভ্রমণের গায়ে
বাতাসে বাতাসে উড়ে এসে সে আমারে প্রায়শ জ্বালায়
আমার তাতে আসে যায় কত, যতটা চেয়েছি তোমারে তত
বারবার
আরো একবার
শতবার
যদি দেখা হয়
যদি আগুনের রঙে লিখি নাম
হাসির ছোঁয়া দিয়ে
সুরের স্পর্শে তারে উজল করে দিও
তোমারে রাঙায়ে আপনায় —
জারুলের রঙে, বরুণের রঙে।
হত্যামুখরতা
স্মৃতি নেই, শূন্যতাও।
গুল্ম ও নদীরেখার কথা মনে আছে–
সামান্য প্রেম যেভাবে জ্বলেছিল অসামান্য জলে
মনে আছে– শুভবার্তা প্রভাতের,
গনগনে উত্তাপ ও অস্থিরতা লয়ে
চোখ যেভাবে অনিদ্রায় কাঁপছিল চেয়ে চেয়ে
মন নাচছিল যার কথা ভেবে, তার কথা।
স্মৃতি নেই, হত্যাকারীও; আড়ালে
রেখে যাওয়া ‘মনে রেখ’ পড়ে আছে
নীরব, গহন বেদনার কাছে জমেছে ঋণ
মলিন সুতোয় জড়ানো কারুকাজ দেখে।
তারপর রক্তনদী, হত্যামুখর পরিণয়!
স্বাধীনতা
কামানদাগা শহরে
খরচৈত্র রোদে
বালির বুকে চেপে বসেছে
আগুনদানব
তপ্ত বালি পুড়ছে
শ্বাসকষ্ট বাড়ছে
দম বন্ধ হয়ে মরে যাচ্ছে
আর লম্বা নল উঁচিয়ে শাসাচ্ছে
হানাদার কোম্পানির
আগুনের গোলা
আমাদের পোলারা পতাকামোড়ানো বুক উঁচিযে হাঁকছে:
বালির বুক থেকে নেমে এদিকে আয় বন্ধু
ধাতব গোলার উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ি এবার!
মানুষ মরুক, বালির হাসি তবুও বেঁচে থাক স্বাধীন।
রূপান্তর
ইউসুফ মুহম্মদ
সাধন সঙ্গিনী হাসিতে হাসিতে পাতার বাঁশিতে শেষ চুম্বন রাখিয়া
ভিন্ন রূপ-রস পান করতে করতে উড়ে গেছে ওই আকাশ যানে,
রানওয়ে ছেড়ে- মেঘের ফুলকিতে কম্পমান কণ্ঠ বলিয়া উঠিল
‘তোমার প্রথম সুর অক্ষত থাকিবে’। কেহই বোঝেনি এ কথার মানে।
তোমার চিরকুট দু’ভাগে বিভক্ত। একভাগ আমার চোখের সীমানায়,
অন্যভাগে অভিমান মেখে উড়িয়ে দিয়েছি সংখ্যাগরিষ্ঠ জানালায়।
খোলা জানালায় মুকুলিত আকাশ যদিও কাঁদে… দেখিতে না পায়–
নাগরিক পাখি মন-ফকিরার লোনাজলে অলৌকিক জলযানে নায়।
তোমার নখের ক্ষত, প্রথম কুসুম ছোঁয়া ভ্রমণে বেরোয় আদিগন্ত জুড়ে
আমার সকল পথে ছিন্ন ভিন্ন ছড়িয়ে রয়েছে দুরন্ত ঘোড়ার খুর,
সময় যখন আঙুল বাড়িয়ে হাঁকে ¬- কার আমন্ত্রণে নেবে সে আমায়!
দূরের ঐ কাননের ঠোঁটে ফুটে আছে আরো এক ঠোঁট বিষণ্ন বেহাগ সুর।