You are currently viewing সিকস্তি কথা || লুৎফর রহমান মন্ডল

সিকস্তি কথা || লুৎফর রহমান মন্ডল

Spread the love

সিকস্তি কথা

লুৎফর রহমান মন্ডল


ঘর ঘেষাঁ জমি ধরে সবুজ শরীরের তিসি, কাউনের ডালগুলো ঢোলের শব্দ আর নদীবুক থেকে আসা বাতাসের মাতৃস্নেহের পরশে অনবরত দোল খায়। সজনে চিকন পাতায় বাতাস আঙুল বোলায় হারমোনিয়ামের। মন খেয়ালের সাথে একটা গান ধরলে সুর তোলার জন্য আলাদা করে লয়, তাল, মন্দিরা ঠিক করতে হয় না। বুক জমে যাওয়া পানিতে মৃদু তরঙ্গে নর্তকী নদী তানপুরা বাজায়-সেই সুর বাতাসে মিশে পুরো খরকটিয়া চরে ছড়িয়ে পড়ে। পেপে গাছে চোঙা ডালে বসে থাকা শালিক পাখিটি ডানা ঝাপটায়। ঢোল, শঙ্ক শব্দ আরো বেরে ঘর বিরানে পৌঁছালে সুবেছান বেওয়া ঘর থেকে উঠোনে আসে। চোখে পড়া রোদ হাত দিয়ে ঢেকে ধরে জিঙ্গেস করে-
-‘তা কোন চরের তোমরাগুলা’
-বিলঘরিয়া-নেমাই ঘোষের বাড়ির।
কালি সাজা ছেলেটি ককসিটের সাজানো খড়গ নিয়ে তিরিং বিরিং করে। পুরো কালোয় মিশে যাওয়া রং মাখা দুজনের খেলতামাশার খড়গ যুদ্ধ চলছে উঠোনে।
-‘তা কাকি-তোমারে নিমতন্ন করতে আইলাম। মেছের কাকা কম করেনি গো ভাগ্যপোড়াদের জন্যি। আমরা তো তোমার জন্যি কিছুই করতে পারি নাই।’
– তোমার বেটা হাফিজ ভাই গেছে কনে?
‘-দিঘর চরে গেছে সাজবিয়ানে-নতুন বাদাম, ভুট্টা বুনতে’
ষাট ছুয়ে যাওয়া সবেজান বেওয়া সময় নেন।
-তা তোমরা জিরোও-পানি, মুড়ি খাও।
‘আরো ছুটতে হবে মা লক্ষী-সাজাই বাজারে মেলা – এসো নিকি।’
সবেজান বেওয়া ঘর থেকে একটালা তিষি আনলে খড়গওয়ালা কালিমাখা ছেলেটি বস্তার মুখ খুলে ধরে। টানা ঘোড়ার গাড়ি চেপে সাজ সজ্জার মেলা আয়োজনের দলটি বিলঘড়িয়ার দিকে যাত্রা ধরে।
বিলঘড়িয়া, সাজাই বাজারের কয়েক ঘর হিন্দু পরিবার। চর খরকটিয়ার ভেতরের এই একমাত্র সন্ধ্যা বাজারের ও উত্তরের বিলঘড়িয়ার আশেপাশে কয়েক পরিবার হিন্দু কীভাবে এসে পড়ল তা কোন লিখিত ইতিহাস থেকে জানা যায় না। তবে লোকমুখে প্রচলিত দেশ স্বাধীনের সময় এখানে কয়েকজন হিন্দু এসে মুছলমানের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। দেশ স্বাধীন হলেও তারা আর অন্যখানে ফেরেনি। ফেরেনি মানে সবার তো আর ফেরার আশ্রয়ও থাকে না। আবার অনেকে বলে-দেশভাগের সময়, কেউ বলে দাঙ্গার সময়-কেউ বলে দীঘরের আশ্রমের লোকজন এসব এলাকায় এসেছিল। সবগুলি উৎস কথা আনুমানিক-কোন লিখিত বা অকাঠ্য প্রমাণ নেই। দিন বদলে সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে অনেকেই কাইম ডাঙায় এসে থিতু হয়। নদী ভাঙনের পরও আবার কেউ কেউ পূর্বের বসতভিটার মাপে জাগা চরে ঠাঁই নিয়েছে। মেছের দস্তিগার হিন্দু পরিবারগুলোকে খুব যত্ন করতেন। সাজাই বাজারে দূর্গা পূজা কালিপূজার সময় মেলার আয়োজন পড়লে পুরো খরখটিয়ার সবাই এগিয়ে আসে। চরের মেঘের ভেলার মতো অস্থায়ী জীবনে তারা আপোষ করেছে। বছরান্তে এই টুকরো আয়োজনে পুরো চরে বেশ হৈ হৈ রৈ বিরাজ করে।
মেছের দস্তিগারের একমাত্র মেয়ে সবেছান বেওয়া। জোতদার বাপের মেয়ে দো’চালা টিন ঘরে দিন গুজরান করে। পাটকাঠি দিয়ে ঘেরা দু’ঘরের বাড়িতে হাত দশেক উঠোন। কোনায় ধান খড়ের গাদি। পাটকাঠি বেড়া ধরে কয়েক ডজন বিচি কলার ধর। উঠোনে দু’একটা বনজ ফলজ বৃক্ষ ক্রমান্বয়ে মাথা তুলে দ্বাড়াতে চাইছে। বছর তিনেক হতে নদী বিলঘড়িয়া থেকে এদিকে আর ভাঙছে না। সেই সুযোগে কিছুটা থিতু হওয়া ভিটায় বৃক্ষগুলো একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ছে। সে স্বস্তি এবার বর্ষা আসলে কোথায় গিয়ে ঠেকবে খরখটিয়া চরের কেউ জানে না।
গল্প তো জীবনের কথা বলে-জীবন যে কত রকমের গল্প থাকতে পারে তা কোন মানুষের গল্প না শুনলে বোঝা যায় না। এই যে সবেছান বেওয়ার গল্প আমি লিখছি তাকে দেখলে চরের আর আটদশজন নারীর মতো মনে হবে। মনে হবে শিক্ষা দীক্ষায়, সুযোগ সুবিধায়, জীবন যাপনের সব স্তরে পিছিয়ে পড়া এক নারী। কিন্তু যখন তার ফেলে আসা পুরো জীবনের গল্প শুনবো তখন তাকে হয়তো আর গড়পড়তা একজন চরের যাপিত নারী হিসেবে মনে হবে না। সময়, ভাগ্য, স্থান অনেকক্ষেত্রে পক্ষে থাকে না। বিপক্ষে গিয়ে পুরো জীবনকে দূর্ভাগ্যের পক্ষে নিয়ে দাঁড় করায়। সবেছান বেওয়ার উঠোন থেকে নেমে যাওয়া জমি ধরে কিলোখানিকের কম দুরত্বে বর্তমান নদীর ধারা। দিন বেলাতে সে নদীর সো সো সাঁই সাঁই শব্দ অতিসহজে কানে আসে। একটু রাত হলে সে শব্দ আরও বাড়ে। কোন অতিথির কাছে নিছক শব্দ হলেও সবেছান বেওয়ার কাছে ধব্বংস দৈত্যর তীব্র হুংকার মনে হয়।


এখন পুরো এলাকা চরখরখটিয়া নাম হলেও আগে এটি চর ছিল না। উত্তর থেকে খাড়া চলে আসা ব্রক্ষপুত্রের স্থুল শরীরে উদোম প্রবাহ নিয়ে খেমটা নাচে মিশেছে তিস্তা। অন্যদিক থেকে আসা ছোট নদী ঘাঘট, দুধকুমারের সাথে মিলিত মোহনা। সব স্রােত জোর দিয়ে ছুটে চলে ব্রহ্মপুত্র ধরে। মোহনার তীর থেকে ভূমিরুপ ধরে ঘাট লাল চামার, উত্তরে বিলঘড়িয়া-মাঝখানে সাজাই বাজার, দক্ষিণ-পশ্চিমে কনকসা, কামারজানি। সেই লাল চামারের ঘাট এখন কামারজানিতে এসে ঠেকেছে। ভাঙনপিষ্ট পুরো এলাকাটি চর খরখটিয়া হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। চরখরখটিয়ার বুকে ভাঙা-গড়ার মাঝে নামমাত্র টিকে আছে বিলঘড়িয়া, সাজাই বাজার। পশ্চিম দিকের কনকসায় জোতদারি ছিল সবেছান বেওয়ার বাপ মেছের দস্তিগারের। ছোটোখাটো জোতদারি ছিল তার। সানবাঁধানো পুকুর, নারিকেল গাছে ঘেরা ঘর চৌহদ্দি, গোয়ালের গরু, গোয়ালঘরের চালা ভর্তি দেশি কবুতর। শত চড়ুই পাখির সাথে সেই বাড়িতে মানুষজন লেগেই থাকতো। বাড়ির সামনে কাচারি ঘরে খাতির আপ্যায়নের ব্যবস্থা ছিল আগত অতিথীদের জন্য। এখন যেখানে নৌকা ঘাট তার একটু ভেতরে নদীর বুকে সেই সব মিশে গেছে। কোন নামগন্ধ নেই। ব্রহ্মপুত্র তখন এখনকার থেকে আরও প্রমত্তা। কোন বছর কোন দিকে থাবা দিবে আগে থেকে আঁচ করা যায় না। কনকসা থেকে অনেক দূর ছিল ব্রহ্মপুত্র। পাকিস্থান আমলের বাঁধ ছিল পুরো বিলঘড়িয়া, লাল চামারের সীমানা দিয়ে। সেই বাঁধে বাবার হাত ধরে বেশ কয়েকবার গিয়েছিল সবেছান বেওয়া। বাঁধ ধরেই ছিল লাল চামারের ঘাট। সেখান থেকে কুড়িগ্রামের চিলমারি আর জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জের ঘাটে যাওয়া যেত। সারি সারি পাল তোলা নৌকা অপেক্ষায় থাকত যাত্রীদের জন্য। নদীর বুক ধরে অনেক ঢাকার যাত্রী এই পথে পার হতো। পাবনা-আরিচা দিয়ে যাওয়ার চেয়ে এ পথে ব্রহ্মপুত্র পার হলেই জামালপুর-সেখান থেকে লোকাল বা মেইল ট্রেনে ঢাকা। এখন সেসবের আর কোন চিহ্ন নাই। খরস্রােতা ব্রহ্মপুত্র পুরনো সব মানচিত্র নিজের মতো করে এঁকে নিয়েছে। নদী পাড়ের ছবি স্থির নয়-সময়ে অসময়ে তা পাল্টায়। সে পাল্টানো জীবনকেও পাল্টে দেয়।
তখন কার্তিকের শেষের দিকে। উত্তর থেকে আসা হালকা বাতাসে শীত শীত আমেজ। রাতভর গাছের পাতায় জমা নব শীত জল হয়ে পড়া বৃষ্টির ফোটার মতো টিনের চালায় টুপ টুপ করে পড়ে। লাল চামারের ঘাট থেকে বাবার আনা কোয়েল পাখিটার সারারাত ধরে কেত কোত শব্দে ঠিকভাবে ঘুম আসে না সবেছান বেওয়ার। ভোর সকালে উঠলে মনে হয় আমন ধানের বিস্তর পাকা ক্ষেত জুড়ে শিমুল তুলা উড়ছে পূর্ণিমা রাতের খন্ড খন্ড শুভ্র মেঘের মতো। এমন তোলা চাদর গায়ে মোড়ানো সময়ে সবেছান বেওয়ার বিয়ে হয়। পাত্র দিঘর এলাকার। দিঘর মোটামুটি সম্ভান্ত এলাকা। মমিনসিংঘের জমিদার সূর্যকান্ত এখানে আসতেন শিবপূজা করার করার জন্য। জমিদার বহর বলতে কথা। বছরের সবসময়ে দিঘর থাকত সরগরম। রাজার আয়োজনে ঘাটতি বলতে কিছু থাকত না। দিঘরের শৈব দিঘীর পারে দোতলা সমান শিব মন্দির। শে^ত মার্বেল পাথরের মাটি ধরে উপরে দোতলায় উঠার সিঁড়িপথ। মন্দিরের মেঝে থেকে পুকুর অব্দি আরও দুটি সিড়ি, মাথায় চারটি রত্নচূড়া। মন্দিরের ভেতরের বই তাকে শোভা পায় মুঘল সম্্রাট আওরজ্ঞজেবের সময়কার মহাভারত, রামায়ণ। মন্দিরের গা জুড়ে পশু পাখি দেবদেবির ছবি চিত্র, টেরাকোটা, পোড়ামাটির ফলক। সামনের ঢোকা পথের দু’ধারে একটি শিউলি আর একটি ফুলমাখা বকুল গাছ। সেই আয়োজনে দূর থেকেও অতিথি হতেন সম্মানিত অনেকে। দিনাজপুরের কান্তজীর এলাকার জমিদার ভূবনবাদ্য, শিলিগুড়ির রাজা ভামস, জলপাইগুরির শিবটাকুর, তাজহাটের মহারাজা গোপাল লাল রায়, পুটিয়ার জগমোহন সহ অনেকেই। মাসব্যাপী চলত কাঙালিভোজ-সাধন ভজন। সবেছান বেওয়ার বিয়ে সেই এতিহ্যবাহী দিঘরেই। লালচামারের ঘাট ধরে ওপারে দিঘর। তার যখন বিয়ে হয় তখনও দিঘরে নানা জায়গার মানুষের আসা যাওয়া। জমিদার স্মৃতি বিজরিত শিবমন্দির- পুকুর এখন সবই স্মৃতি। খরখটিয়ার ঘরের উঠোনে আসে সবেছান বেওয়া। পুব আকাশে পানির বুকে মিশে যাওয়া দিঘরের উপর রক্তবর্ণ সুর্য মুখ তুলছে। একটু পরে আগুন গলাবে মুখ থেকে। সেই দিঘরে রাজা-প্রজাদের আনাগোনা নেই আছে শুধু দীর্ঘ নিঃশ^াস-রাজা, মন্দির সবই স্মৃতি। শত কিউসেক পানি নিয়ে সেসব এখন মাটির নিচে চাপা পড়া ইতিহাসের খাদ্য।
বিয়ের পরের বছর বর্ষা দানব হয়ে আসে। ঘর গেরস্থি তার তেমন হয়ে উঠে না। আকাশ ভেঙে সে বছর বৃষ্টি নামতে থাকে। কনকসা, দিঘর ঘর অব্দি পানি প্রবাহ আসতে থাকে । তিস্তা, ব্রহ্মপুত্রে পৃথীবির সব পানির প্রবাহ নেমে আসে। সে কী স্বোত আর ঘূর্ণ পাক। নির্দয় বৃষ্টির সাথে উজান থেকে আসা পানিতে নদী রাক্ষুসে হয়ে উঠে। উন্মাদ দেবতার মতো বিধ্বংসী জলস্রােত দু’কুল ছাপিয়ে ছড়িয়ে পড়ে চারদিক। একরাতেই বাঁধ ভেঙে নদী পূবে দিঘর অব্দি চলে আসে। রাজার আরামপ্রসাদ, শিব মন্দির, মন্দিরের দুয়ারে ফুলশোভীত বকুল আর শিউলী গাছ সপ্তাহ খানিকেই মিশে যায় নদীতে। নদী আরও ক্ষিদে নিয়ে পশ্চিমে চলে যেতে থাকে। পশ্চিমে কনকসা, উত্তরে বিলঘড়িয়া, মাঝের সাজাই বাজার নদী বুকে টেনে নামাতে সপ্তাহ দু’য়েক সময় নেয়। কোথাও নিস্তার নেই। মূহূর্তে জোতদার ফকিরে পরিণত হয়-জায়গা হয় সরকারি অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে। সে এক মহাপ্রলয়ের ঘটনা। সদ্য বিবাহিতা সবেছান বেওয়ার সংসারই চেনা হয়নি। কোন ঘরের দরজা কোন মুখে দিনসকাল না হলে সে বলতে পারে না। সে কী জলযুদ্ধ! সবেচান বেওয়া ভাবছিলো- নুহ নবীর আলামত শুরু হলো হয়তো। নির্দয়ভাবে নদী ভাঙছে-চোখের পলকে আবাদী, বসতবাড়ি, পুকুর, বনজ, ফলদ গাছগাছালি ডুবে যাচ্ছে নদীতে-গোয়ালঘরের দড়িসমেত গরু, আদরের ছোট্র শিশু, অশিতীপর বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, কুকুর, বিড়াল লাশ হয়ে ভেসে এসে নদীপাড়ে আটতে থাকে। মানুষ মাছ না খুঁজে মানুষ খোঁজে কবর, সৎকার করার জন্য। চারদিকে জলসমুদ্র। জনমের অভূক্ত গোগরাসে গিলছে সবকিছু-ধানের জমি, গরু-মহিষ, মাছ পুকুর, শতবর্ষী পাকুর গাছ, কনকসার জামে মসজিদ। দিন পনের লাগেনি নদী ওপারে দিঘর আর এপারে লাল চামারের ঘাট, বিলঘড়িয়া, সাজাই বাজার থেকে কনকসা, নদী বুকে বিলীন করে কামারজানিতে গিয়ে কিছুটা শান্ত হয়। লোকজন চোখের পলকে নিঃস্ব হয়ে আশ্রয় নেয় ত্রাণশিবিরের উজান বাঁধে।


সেই শুরু এক ভাঙা-চোরা জীবনের। যে জীবনে কোন স্থায়ীত্ব নেই-জোর নেই, পায়ের তলায় স্থায়ী মাটি নেই। ভূমিপুত্র থেকে ভূমিহীন। আগুনে সব পুড়লেও তো মাটিটুকু থাকে-নদী ভাঙনে আর কিছুই অবশিষ্ঠ থাকে না। সবেছান বেওয়ারও কিছুই রইল না। পানি নামার আগে বাপটাও হঠাৎ মারা গেল। জোতদারি বাপের জায়গা হলো অন্যের দেয়া মাটিতে-পানি ভর্তি বাথটাবের মতো কবরে। স্বামীর সম্পর্কের দিক থেকে এক আত্মীয়র জমিতে ঠাঁই হয় তাদের। বছর দুয়েক পর সাজাই বাজারের চর জাগলে সেখানে থাকতে শুরু করে। চর এই জাগে তো পরের বছর আবার ভাঙে। আবার নতুন জাগা চরে মাথা গোজাঁর ঠাই খোাঁজা। তখন দিঘরের দিকে কেবল চর জাগতে শুরু করেছে। চিকচিকে রাশি রাশি বালুতে বনেদী দিঘর মাথা নাড়ছে। সেখানে থাকতে স্বামীকে হারায় সবেছান বেওয়া। কোলের সন্তান হাফিজকে নিয়ে দিঘর ছেড়ে সাজাই বাজারে আসে। আশি^ন কার্তিকে নদীর খোলায় বোয়াল মাছের বৈত নামে। শৈবিন্দু কৈরাল, উমেশ, ইউনুস, মৈ জালালের বাপ, ছপিয়াল, দবির সোনামুখী ব্রহ্মনদীর বোয়াল সৈনিক। সাজাই বাজারে সাজ সকালে যে বোয়াল উঠে এরাই রাতে ধরে সেগুলো। কিনার ধরে যেদিকে নদীর চোয়াল চর ছুঁয়েছে সেদিকে বোয়াল ছোটে। টোপ বড়শি দিয়ে বড় বড় বোয়াল ধরে তারা। বোয়ালের আাদার করা হয় চ্যাপা, মলন্দা, চলা ও চাপিলা প্রজাতির ছোট মাছ দিয়ে। বাঁশের চোঙায় পচানো এসব মাছ আর গাছ জামলা ডিম দিয়ে লেই বানানো হয়। সেগুলো টোপ বড়শিতে গেথে বাঁশ খুঁটিতে বেঁধে গেরে দেয়া হয় নদী কিনারে। টোপ খেতে এসে বড়শি গিলে আটকে যায় বোয়াল-হরহামেশায় নলাই বোয়াল। সাজাই বাজারে কিছু বিক্রি হয়-আরেকটু লাভের আশায় ছুটতে হয় কামারজানিতে। দূর থেকে লোকজন আসে সেখানে। ব্যাপারিরাও আসে। নদীর মাছের বেশ টান থাকে। কিন্তু সেই বাজার অব্দি নিয়ে যাওয়াই কষ্ট। কাইম রাস্তা নেই। চরের বুক জমিন ঠেস দিয়ে যেতে হয়। কখনো পায়ে হেটে কখনো ঘোড়ার গাড়িতে। চর পার হয়ে কনকসা ঘাট-সেখান থেকে নৌকায় ঘন্টা খানিকের পথ পেরিয়ে কামারজানি। বেশ হাঁপিয়ে উঠতে হয় যেতে আসতে। তাও যেতে হয়-জীবন নিয়ে যায়। পৃথিবী কাউকে বুক দেখায়-পিঠ না আবার কাউকে পিঠ-বুক না অথচ কত কম দূরত্ব অবস্থানের। কারও পৃথিবী তাবৎ যুদ্ধক্ষেত্র-কারও কাছে ভোগের, উল্লাসের। আমরা এই খরখটিয়া চরের সাজাই বাজার, কনকসা কে আলাদা গ্রহ-উপগ্রহ ভাবতে পারি। পূথিবী থেকে কাছের মঙ্গল বা আরো দূরের ইউরেনাস বা বৃহস্পতি। উপরে কত স্থির অথচ ভেতরে কতো ধাবমান স্রােত। সবেছান বেওয়া পুরো জীবন স্থির-তার ভেতরের স্রােত হয়তো কোন উচ্চ ভূমিরুপে ধাক্কা খেয়ে গতিপথ পরিবর্তন করেছে, এমনটাও হতে পারে স্রােতউৎস আর নেই। পানিচক্র নদীকে প্রবাহবান করে, দুঃখচক্র মানুষকে স্থির, শান্ত, ভাবলেশহীন করে।

শীত শুরু হয়েছে । দেশের অন্যান্য অ লের চাইতে উত্তরবঙ্গে শীত বেশি পড়ে, আগেই পড়ে। চরেও শীত পড়েছে কোমরবেঁধে। শীতের দলা সাদা ধোয়ার মতো উড়ে বেড়ায়। হাটাপথের চরটুকু সন্ধ্যায় যেতে ধরলে পথ ভূলতে হয় যে কারও। অনেকে কনকসা থেকে পথ হাটা শুরু করে আবার ঘুরে কনকসাতেই চলে আসে। শীত আসলে হাঁপানির ব্যামোটা বেড়ে যায় সবেছান বেওয়ার। একলা বাড়িতে ছেলে দিঘর থেকে মাঝে মাঝে আসে-তার প্রয়োজনীয় কিছু দিয়ে আবার দিঘরে যায়। আলু, বাদাম, ভুট্টার মৌসুমে দিঘরে কামলা খাটে সে। এই চরের অনেকেই হাফিজুরের সাথে নদী পার হয়ে দিঘর চরে যায় শ্রম দিতে। এবার এক সন্ধায় বেশ অসুস্থ হয়ে পড়ে সবেছান বেওয়া। ঘোর হয়ে আসা চোখে তার বাপকে দেখে তাদের সেই নদীবুকে বিলীন হওয়া বাড়ির পুকুর পাড়ে বসে আছে-স্বামীকে দেখে নতুন বধু সেঁজে ছইঘেরা নৌকায় দিঘরের দিকে তাকে নিয়ে যাচ্ছে। ঘি রঙা স্বামীর শরীরে শ্বেত রংয়ের শেরওয়ানী।
সবেছান বেওয়া লজ্জাবনত মাথা না তুলতে চাইলেও ফিরে পাওয়া স্বামীকে সে ছুঁয়ে দেখতে চায়। চোখ বেয়ে কান্নার জল বুক ভাসিয়ে দেয় তার-লাল মেহেদী রাঙা হাতে প্রানের স্বামীর মায়াবী মুখটা বার বার আলগোছে তালুবন্দি করে।
-আপনে সত্যিই আছেন? আমারে এতোকাল একা রাখপের পারলেন!
দিঘরের শিব মন্দির, শৈব পুকুর, রাজাদের বছরওয়ান্তে সাধন-ভোজন চলছে। সব যেন ফিরে পায় সে । ঘোরের মধ্যে নিজেই নিজেকে চিমটি কাটতে চায়।
-কোন উত্তর আসে না নিশ্চুপ স্বামীর কাছ থেকে। শুধু ইশারা দিয়ে মাঝিকে দ্রুত নৌকা আগাতে বলে।
শ্বাসকষ্টের সাথে কাশিটাও বেঘোরে বাড়তে থাকে তার। অদূরে থাকা কয়েকঘর প্রতিবেশি জড়ো হয় খবর পেয়ে। সময়ের সাথে অসুস্থতা কমার কোন লক্ষণ দেখা যায় না। এই কনকনে শীত রাতে চোখ মুখ বের করারই কষ্ঠ। সাজাই বাজার থেকে একজন পল্লীচিকিৎসকও আসে। চোখের পর্দা টেনে, হাতের নাড়ি দেখে তিনি বিচলিত হন-
-অবস্থা বেশি ভালা না-সদর হাসপাতাল যাওন লাগবো-

সাথে থাকা প্রতিবেশিরা মুখ চাওয়া চাওয়ি করে। একা মানুষটার রাতেই আবার কী না কী ঘটে ! কিন্তু এখান থেকে সদরে যাওয়া তো মুখের কথা নয়। সুস্থ মানুষ যেতেই হাপ ছাড়তে হয়। একদিকে অসুস্থ তার উপর ঠেসে পড়া শীত। কোন উপায় না পেয়ে সাই বানানো হয়। খবর পেয়ে আরও কয়েকজন যুবক চলে আসে। সাইয়ে করে শোয়ায়ে কাঁধে নিয়ে রওনা দেয় ঘাট মুখে। একটু পরপর ঘাড় পাল্টায় কাঁধে সাই বহন করা যুবকরা। কত ভার তারা বহন করে। কিন্তু মানুষের এই সাই বহন যেন অনেক ওজনের। কাঁধ পিট লেগে আসে বারবার। একটানে সাজাই বাজার পৌঁছায় তারা। সেখানে আরও কয়েকজন যোগ হয় সাইবহনে। কাঁধ লেগে আসলে পরিবর্তন হয় লোক। কনকসা ঘাট যেন লক্ষ মাইল দূরের পথ হয়েছে আজ। পথ ফুরাতেই চায় না। এমন এক জনপদ চিকিৎসা নাই, শিক্ষা নাই, যোগাযোগ নাই। শুধু কিছু দলছুট মানুষ আছে এখানে যাদের মাথায় কোন ছায়া নেই। প্রসূতির বাড়িতে খালাস না হলে এই সাই ই ভরসা। প্রসূতির কষ্ট দেখলে পৃথিবী গুমোট হয়ে আসে। কত মায়ের মৃত্যু হয়েছে এই সাই এ তার হিসেব কে রাখে?
সাইয়ের ওজন ক্রমেই যেন বাড়তে থাকে। এতটুকু মানুষের কতই বা ওজন! ঘাটে পৌঁছালে বুড়ির কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। হাত পা আরও ঠান্ডা হয়ে আছে। নদীর ঢেউ আচড়ে পড়ছে ঘাট পাড়ে। ছোট বড় ঢেউয়ে দোল খাচ্ছে পাড়ে বেঁধে রাখা নৌকাগুলো। সাথে আসা পল্লি ডাক্তার হাতের নাড়ি টিপে দেখে। শুশ্রুমন্ডিত চোয়াল শক্ত হয়ে আসে তার।
-ফিরতি পথে সাই ঘোরাও। আর যায়া কাম নাই-হাফিজরে তাড়াতাড়ি খবর দিয়া আননের ব্যবস্থা করো।

***************************