You are currently viewing ঈশ্বর আসছেন || ময়ূরী মিত্র

ঈশ্বর আসছেন || ময়ূরী মিত্র

ঈশ্বর আসছেন
ময়ূরী মিত্র

কত মেঘের পথ বেয়ে ফকার প্লেনে পৌঁছেছিলাম পোখরা ৷ এয়ারপোর্টে পা দিয়ে বুঝলাম অনেকটা বৃষ্টি গোটা অঞ্চলটাকে হদ্দমুদ্দ ভিজিয়ে রেখেছে ৷ হোটেলে যাওয়ার পথে পাহাড়ঘেরা ভেজা গ্রামটিকে দেখে ট্যাক্সিতে বসে উল্লাসে ফেটে বললাম —
এ যে নদীর মতো পাহাড় —ওপরে নীচে একভাবে বয়ে চলেছে ৷ দেখতে পাচ্ছ না ? তাই তো আকাশেও নৌকো চলছে ৷

বলাবাহুল্য –ফকার প্লেনের দুদিক সরু ও মোটা পেটের গড়ন দেখে আকাশযানটিকে নৌকো বলেই ভ্রম হয়েছিল সদ্য সিঁদুররঞ্জিত ময়ূরবউয়ের ৷ ওটাই ছিল তার প্রথম ফকার প্লেন দেখা ৷ তখন সে যা দেখে তাতেই আনন্দ ও বিস্ময় ৷ পছন্দের বান্ধবকে কাছে পেয়ে প্রকৃতিতে আরো সমাহিত হতে চায় মন – সঙ্গে জাগরণের একটা প্রক্রিয়াও চলতে থাকে ৷
হোটেলে পৌঁছে অন্ধকার ঘুপচি সিঁড়ি বেয়ে উঠলাম ছাদে ৷ ছাদ ভর্তি ফুল আর মেঘ ফুরোনোর আলো ৷ ছায়া ফুরোলে যত মৃদু হোক আলো আসবেই ৷

হেই গো মা দুগ্গা — ঘুপচির ধোঁয়াটে ময়লার পর এত রঙ ! রঙদার ফুলে ঘেরা ছাদের ওপর একটিমাত্র ঘর — যেখানে আমরা থাকব ৷ ঘরের জানলা দিয়ে পাহাড় দেখা যায় –আমার সেই নদীর মতো পাহাড় ৷ রাতে পাহাড়ের মন্দিরে দীপ জ্বলল তো ঘরে আমার চোখের সাদা মণিতে রঙ এল ৷ মন্দিরের আলোয় কাছাকাছি গ্রামের মানুষদের অস্পষ্ট চলাচল বোঝা যাচ্ছিল ৷ বড্ড ভুল করতে — ভুল দেখতে ইচ্ছে জাগছিল সেরাতে ৷ মন্দিরের দিকে হাঁটতে থাকা মানুষগুলোকে ভাবছিলাম দেবমানুষ বা দেবতা ৷

অবশ্য সেঅর্থে পরিশ্রমী ও দরিদ্র চিরকালই আমার দেবতা ৷ হোটেল মালিক বললেন —
সারাটা দিন ওরা জনপদে টুরিস্টদের সেবা দিয়ে হেঁটে হেঁটে গ্রামে ওঠে ৷ অভাব সত্ত্বেও নেপালের পাহাড়বাসীরা কখনো নাকি চুরি করে না ৷ খিদেয় মরলেও না ৷ তাই কি মন্দিরের আলো ওদের বাড়িও আলোকময় রাখে ?

অনেক ভগবান দেখতে দেখতে ঘুমলাম ৷ ভোর তিনটে নাগাদ গাড়ি করে পাহাড়ি খাদের পাশ দিয়ে যাচ্ছি সারাংকোট ৷ একটি ছোট চাতালের কাছে গাড়িগুলো থেমেছে ৷ হঠাৎ চিৎকার —এক বৃদ্ধা অস্ট্রেলিয়ান খাদের কিনার ধরে ঝুলছেন ৷ একটি দলের সঙ্গে এসেছিলেন ৷ তারা শুধু ঘিরে চেঁচিয়েই যাচ্ছে –কিন্তু বাঁচাতে আর এগোয় না ৷ ভদ্রমহিলা অন্ধ — ৷ হাত ধরলেও যদি বাঁচবার অঙ্কটা কষতে না পারেন –এই ভয়ে হাত ধরা থেকে পিছিয়ে থাকে নিরাপদে থাকা মানুষ ৷

আমার বন্ধু অতনু দুজন গাইড নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ৷ হাত ধরে বললাম —তুমি এই অন্ধকারে পারবে ওঁকে ঠিক করে তুলতে ? অতনুর সেদিনের উত্তর ছিল —আমি তো তাও একটা চোখে দেখতে পাই ৷ উনি তো দুচোখে দেখেন না ৷ মরে যাবেন ৷ মানুষ বাঁচাবার জন্য নিজের একটিমাত্র চোখকে সেদিন যথেষ্ট মনে করেছিলেন অতনু ৷
গাইডরা সবাই অতনুর পাশে সেদিন দাঁড়ালেন ৷ আমার দেবমানুষের ঢল নামল মৃত্যুর কিনারায় ৷ ভদ্রমহিলা যখন উঠে এসে চাতালে বসলেন তখন অল্প অল্প আলো উঠেছে ৷ মাতৃহীন অতনু ভদ্রমহিলার প্যান্টের ঘাস ময়লা ঝেড়ে দিচ্ছেন ৷

স্তম্ভিত হয়ে দেখলাম — অস্ট্রেলিয়া দেশের সেই ভ্রমণকারী বেঁচে উঠে একবার শুধু অতনুর বুকের কাছের জামাটা খামচে ধরলেন ৷ কিছু বললেন না — ভয়ও পেলেন না ৷ সঙ্গের বন্ধুরা যে তাঁকে বাঁচায় নি সেজন্য দেখালেন না কোনো ক্ষোভ ৷ শুধু আশ্চর্য শৈলীতে নিজেকে কেবল একা করে নিলেন ৷ তারপর ? একা একাই উঠতে লাগলেন ৷ উঁচু শিখরে এবার সূর্য উঠবে ৷ চক্ষুহীন এক মানব এবার সূর্য দেখবে —পাহাড়ের ওপরে চায়ের দোকানের ঠাণ্ডায় জমে থাকা বিক্রেতা মেয়েটাকে দেখবে —দূরে আরো কোনো নতুন দেশের অবয়ব দেখবে ৷ দেখবে আর তার জীবনদাতার মতোই সমান সমুজ্জ্বল হবে ৷ সেদিন কে বেশি মহান হয়েছিলেন আজো বুঝতে পারিনি ৷ যিনি ওই বৃদ্ধার প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন তিনি — নাকি যিনি সেই বাঁচাটাকে মুহূর্তে ভুলে আবার পাহাড়ের চূড়ার দিকে উঠছিলেন তিনি !

পাহাড় তো নদীর মতোই — দেশের সীমানা ভুলিয়ে দেয় ৷
অনন্যকে দেখতে একা হতে হয় ৷
মূরতি টুকরো হয়ে মানুষে ছড়ায় ৷

****************************