You are currently viewing দু’টি অনুগল্প || কুমার প্রীতীশ বল

দু’টি অনুগল্প || কুমার প্রীতীশ বল

দু’টি অনুগল্প || কুমার প্রীতীশ বল

অপূর্ণ-পূর্ণতা

মিলার একটা স্বপ্ন ছিল। ছোট্ট একটা ছিমছাম সংসার হবে। বর ওকে খুব কেয়ার করবে। চালাক মানে ধূর্ত হবে না। স্মার্ট হবে। পদে পদে ভুল ধরে বকা দিতে পারবে।
মিলা পেয়েছেও তেমন বর। নেহাল ওর সেই স্বপ্নের বর।
সংসার পাততে গিয়ে ওরা সিদ্ধান্ত নিল, প্রথম বছরে কোনো সন্তান নেব না।
সাত মাসের মাথায় মিলার শরীর জানান দিল, কেউ একজন আসছে।
সন্তান নারীর জীবনে পূর্ণতা আনে।
মিলা আর নেহাল আগের সিদ্ধান্তে স্থির থাকল।
স্ব-ইচ্ছেয় মিলা গর্ভপাত করল।
তখন জ্ঞানহীন মিলা জড়ানো কন্ঠে বার বার বলল, আমার বাবুটা। আমার বাবুটা।
ডাক্তার বললেন, জ্ঞান ফিরছে।
বছর গড়িয়ে যায়।
পাড়া-পড়শী, আত্মীয়-স্বজন সবাই জানতে চাইল, খবর কী? কতদিন আর গায়ে বাতাস লাগিয়ে বেড়াবে?
ওরা সিদ্ধান্ত নিল, এবার সংসারে পূর্ণতা আনতে হবে।
চেষ্টার কমতি থাকল না। মিলার শরীর সে খবর দেয় না।
ডাক্তার, বদ্যি, ঝাঁর-ফুঁক কিছুই বাদ থাকল না। কিছুতেই কিছু হয় না।
কেউ কেউ বলল, টেস্ট টিউব বেবি নাও।
কেউ কেউ দত্তকের কথাও বলল।
মিলার বুক ফেটে কান্না আসে। কাঁদেও।
নেহাল প্রবোধ দেয়। তারও বুক ভেঙে যায়। প্রকাশ করে না।
এক-দুই করে সাত বছর পার হয়ে গেল। বছর তো না যেন যুগ।
মিলার শরীর একদিন জানান দিল, এবার কেউ একজন আসছে।
মিলার জীবন পূর্ণতা পেল। অন্ধকার ভরে গেল চাঁদের আলোয়।
এ আরেক জীবন।
এখন মিলার ছেলের বয়স দশ পেরিছে। ছেলে ক্রমশ বালক হয়। নাগালের বাইরে চলে যেতে থাকে। তারও একটা জগৎ তৈরি হয়।
মিলা আবার নিঃসঙ্গ হয়ে ওঠে। চোখে-মুখে আবার অপূর্ণতার ছাপ।
মনে মনে বলল, একটা মেয়ে থাকলে ভালো হতো। কত কাজেই না আসত সে।
পূর্ণ-অপূর্ণতা নিয়েই তো জীবন। নেহাল প্রবোধ দেয়।

 

আমার একটা গল্প ছিল

আমার একটা গল্প ছিল।
হ্যাঁ, সত্যি বলছি। আমার একটা গল্প ছিল। প্রবাহমান। ছিপছিপে। তন্বী। আমরা বেশ পছন্দের।
গল্পটা কেউ শুনল না।
পত্রিকা অফিসের সাহিত্য পাতার দপ্তরে হাঁটতে হাঁটতে জুতোর সুক তলা ক্ষয় হয়ে গেছে।
এখন আর জুতো পড়ি না তাই। সলতে দেওয়া চটি পড়ি।
গল্পটা লেখা ছিল না।
কেউ একজন বলেছিল, লিখে রাখুন। লিখে রাখুন।
শেষ বার কথাখানা একটু চড়িয়ে টেনেই বলেছিল।
আমি তাকে বলেছিলাম, লিখলে থেমে যাবে যে। প্রবাহমানতা হারাবে।
আমার কথাটুকু তাঁর কান অবধি পৌঁছে ছিল কিনা জানি না। কারণ কোনো প্রতিক্রিয়া পাইনি। তার আগেই চরাচরে নির্জনতা নেমে আসে।
তারপর!
তারপর একদিন গল্পটা লিখতে গেলাম। কারণ আমি এবার স্থানু হতে চেয়েছিলাম। পাহাড়ের মতো। পাহাড় মেঘ ছুঁতে পারে। মেঘ ছুঁতে পারে বিপুলা পৃথিবী। দূর দিগন্তে।
লিখলাম আর ছিঁড়লাম।
ছিঁড়লাম আর লিখলাম।
শেষ করতে আর পারলাম না। লেখার আশা ছেড়ে দিলাম। বলার অপেক্ষাতেই থাকলাম।
এর মধ্যে সুজন এসে হাজির। আরেক গল্প। নতুন গল্প । নতুন জীবন। হৈ, হৈ করে আসল। নতুন জীবনের নতুন সঙ্গী। শৈশবের মতো। ঝিলমিলিয়ে চলে। প্রশ্ন করে। উত্তরও আছে অনেক প্রশ্নের। সন্ধ্যে বেলার ছল ছলিয়ে এক ফসলা বৃষ্টি নামার মতো।
সুজন, আমার মতো। পথ ভোলা এক পথিক।
মেলার ভিরে একলা পথে দেখা। ওর মুখের দিকে তাকালে আকাশ দেখা যায়। পায়ের দিকে বিপুলা পৃথিবী।
পদ্মা নদীর কপিলার কথা ধার করে বললেন, ‘আইলা মাঝি?’
বললাম, ঢেউয়ের তালে ভেসে, ভেসে।
বললাম, বৃষ্টি নেবে, বৃষ্টি?
কারণ, ওরও ছিল ছোট্ট একটুখানি একটা দ্বীপ। সে একলা দ্বীপের কথা জানত না কেউ। একলা দ্বীপে উৎসব হতো। শিবের গাজন। বাদ্যি বাজত। মেলা হতো। মেলা। জব্বারের বলী খেলা। আর আকাশ ভাঙা বৃষ্টি।
মনে মনে নিজেকে তৈরি করে নিচ্ছিলাম বেশ। তাকে নিশ্চয় শোনানো যাবে গল্পখানা।
শোনাতেও চেয়েছিলাম। শুরু করেছিলাম বলা।
মিলিয়ে নিয়েছিলাম বেশ। দৃশ্যের পর দৃশ্য। অঙ্কের পর অঙ্ক।
না। শেষ পর্যন্ত মিলল না। অঙ্ক যে মিলে না। জানা ছিল না এ কথা।
সুজন হাসলেন।
বললেন, বোকা। অঙ্ক আবার মেলে না! মেট্রিকে ইলেকট্রিক মেথে নাইনটি নাইন পেয়েছিলাম।
বললাম, দুইয়ের সঙ্গে দুই মিলালে যে চার হয় তা কিন্তু অঙ্ক না। অঙ্ক হলো দুইয়ের সঙ্গে দুই মিলিয়ে পাঁচ বানানো।
সুজন থমকে গেলেন। আমার দিকে তাকালোও একবার। দাঁড়াল না। মুখ ফিরিয়ে চলে গেলেন।
তাঁকে আমরা গল্পখানা আর শোনাতে পারলাম না। আমি ভুলে গেছিলাম, শৈশবে আর ফেরা যায় না।

********************