You are currently viewing সাহিত্যে আন্তর্জাতিকতা ও ঐতিহ্যিক উপাদান || খালেদ হামিদী

সাহিত্যে আন্তর্জাতিকতা ও ঐতিহ্যিক উপাদান || খালেদ হামিদী

সাহিত্যে
আন্তর্জাতিকতা ও ঐতিহ্যিক উপাদান

খালেদ হামিদী

আন্তর্জাতিকতাবাদ (Internationalism) যেখানে এমন একটি ধারণা বা মতবাদ যা বিভিন্ন রাষ্ট্র বা জাতিকে একই বা বিভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে সহযোগিতামূলক সম্পর্কের মধ্যে সক্রিয় রাখে, জাতীয়তাবাদ (Nationalism) সেখানে কাউকে কোনো জাতির অন্তর্ভুক্ত জ্ঞান করতে শেখায়। কেবল তা-ই নয়, সেই জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, বিকাশ, অগ্রগতি, ভৌগোলিক অবস্থান, আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক মুক্তির আকাক্সক্ষা ইত্যাদির সাথে একাত্মতাবোধ এবং সংশ্লিষ্ট জাতির ঐতিহ্য, মূল্যবোধ, স্বকীয়তা রক্ষা ও বিকাশে আস্থাশীল হতে উদ্বুদ্ধ করে। আন্তর্জাতিকতার সঙ্গে জাতীয়তার সম্পর্ক এবং জাতীয়তার অংশস্বরূপ ঐতিহ্যের অনিবার্যতা বিষয়ে আমরা কম-বেশি অবহিত। কিন্তু ঐতিহ্য অনড়। তবে জাতীয়তার ধারণাটি জঙ্গম, ইতিহাসের নানা বাঁকে। কেননা জাতীয়তা আর্থ-রাজনীতিক স্বাধীনতার প্রশ্নে একেকটি জনগোষ্ঠীকে আন্দোলিত, উদ্বোধিত এবং ঐক্যবদ্ধ করে।

কিন্তু ঐতিহ্যের স্বরূপ কি? ইয়োরোপ ও ভারতবর্ষের ইতিহাস যেমন ভিন্ন তেমনি ভারত ও বাংলার ইতিহাসে বিদ্যমান সাংস্কৃতিক পার্থক্যও বিভিন্নতা সৃষ্টি করে এবং তা একেকটি জনপদকে কেন্দ্র করে এক একটি অঞ্চলে দিনে দিনে গড়ে ওঠে। একেক এলাকার মানুষের জীবনশৈলী, মানসিকতা ইত্যাদি তার মূল্যবোধের দিগন্তে একটি আঞ্চলিক সংস্কৃতির জন্ম দেয় আর তা-ই মূলত কালক্রমে সেই অঞ্চলের ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়ায়। এই যে দিনে দিনে ঐতিহ্যের গড়ে ওঠা, এটি সম্ভব হয় উত্তরাধিকার সূত্রে বংশপরম্পরায় বিশেষ একটি সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলভুক্ত দৈনন্দিন চর্চার গণ্ডিতেই। আর, সংস্কৃতি তখনই কোনো না কোনো উত্তরাধিকারের সামগ্রী হয়ে ওঠে, যখন তা কোনো না কোনো সম্প্রদায়ের নিজের হয়ে উঠতে পারে। বিশেষ বিশেষ সম্প্রদায়, বিশেষ কোনো একটি সাংস্কৃতিক জীবনশৈলীকে যখন বংশপরম্পরায় বহন করতে থাকে, তখনই তাকে ঐতিহ্য বলে অভিহিত করা হয়। যে উত্তরাধিকারের মাধ্যমে ঐতিহ্যের প্রবহমাণতা অটুট থাকে, সেই উত্তরাধিকার প্রকৃতিগতভাবে সাম্প্রদায়িক। তাই ঐতিহ্য যেমন আঞ্চলিক, কথিত উত্তরাধিকারও তেমনই সাম্প্রদায়িক। এ জন্যেই কি আবদুল মান্নান সৈয়দ তিরিশের কবিতায়, বিশেষত, বিষ্ণু দে এবং সুধীন্দ্রনাধ দত্তর কাব্যে, মিথের ব্যবহারকে ‘হিন্দু পুরাণের অবিরলতা’ বলে উল্লেখ করেন? মান্নান সৈয়দের জীবৎকালীন রাজনীতিক অবস্থান বা সমর্থনের বিষয়টি এক্ষেত্রে স্মর্তব্য। কিন্তু সম্প্রদায়, উপনিবেশের সংস্কৃতি গ্রন্থে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী যেমন বলেন, শ্রেণীবৈষম্যকে বৈধতা দেয় এবং শ্রেণীশোষণকে আড়াল করে। মনে রাখা দরকার, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা উল্লিখিত আঞ্চলিক সাম্প্রদায়িকতাপ্রধান ঐতিহ্য মোটেও নয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসামান্য আহ্বানে এ দেশের মানুষ পাকিস্তানি উপনিবেশের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয় অবশ্যই অসাম্প্রদায়িক জীবনচেতনার প্রতিভাস ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের প্রেরণায়। প্রতিক্রিয়াশীলতার দীর্ঘ ছায়ার নীচে বইয়ে হুমায়ুন আজাদ প্রায় এমনই বলেন যে, সম্প্রদায় মানুষকে মেলায় না, মানুষকে মেলায় অভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতি। যদিও, এ বক্তব্যে শ্রেণীবাস্তবতার বিষয়টি উপেক্ষিত।

সংক্ষেপে হলেও কবিতায় ঐতিহ্যিক উপাদানের প্রসঙ্গটি দেখার আগে উল্লেখ্য যে, ইউরোপের শিল্পবিপ্লবের আগে, একেক অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উপর অন্য অঞ্চলের প্রভাব এসে পড়ে সামান্যই। সেই প্রভাবের আওতাও সীমাবদ্ধ থাকে মূলত পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মধ্যেই। কিন্তু তার মধ্যেও ব্যতিক্রম ছিল না তা নয়। আদি ভারতবর্ষে আর্যদের পদার্পণে ভারতীয় ঐতিহ্য নতুন এক সংস্কৃতির জন্ম দেয় যাকে আর্যসংস্কৃতি বা বর্তমান কালের পরিভাষায় হিন্দুত্ব বলতেই মূলত পছন্দ করেন সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অনেকেই। অনেকে একে আবার সনাতন ভারতীয় সংস্কৃতি বলেও অভিহিত করেন। কিন্তু এই সনাতন ভারতীয় আর্যসংস্কৃতি আদি ভারতীয় সংস্কৃতি নয়। আবার পরবর্তী কালে ভারতবর্ষে মোঘল পাঠানদের হাত ধরে ইসলামী সংস্কৃতির অনুপ্রবেশে ভারতীয় সংস্কৃতি কালক্রমে আরও এক নতুন রূপ পরিগ্রহ করে। এভাবে একেক ঔপনিবেশিক শক্তির প্রতাপে-প্রভাবে আঞ্চলিক সাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যেরও ধরন বদলাতে থাকে। ঠিক যেমন দুই শত বছর বৃটিশ শাসনাধীন থাকার ফলে বঙ্গীয় সংস্কৃতির মধ্যেও কিছু পরিবর্তন ঘটে যায়। ইয়োরোপের শিল্পবিপ্লবের হাত ধরে যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্রমোন্নতি এবং ঔপনিবেশিকতার বিস্তার এক অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ওপর অন্যান্য অঞ্চলের প্রভাবকে এক প্রকার গুরুত্বপূর্ণই করে তোলে। ফলে বিভিন্ন অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ক্রমাগত অপরাপর সংস্কৃতির প্রভাবে আবর্তিত হতে থাকে যুগে যুগে। আর, এটিই হয়ে ওঠে উপনিবেশকালীন আন্তর্জাতিকতা। এ জন্যেই ইংল্যান্ডের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ওপর বঙ্গীয় সংস্কৃতির কোনো প্রভাবই মুদ্রিত হয় না। এই আন্তর্জাতিকতার প্রসঙ্গে অপেক্ষাকৃত বিশদরূপে যাবার আগে বলে রাখতে হয়, আন্তর্জালে প্রকাশিত ওপার বাংলার অখ্যাত বা নবীন লেখকের গদ্যেও ঐতিহ্যের সাম্প্রদায়িকতার বিষয়টির উল্লেখ মেলে। কিন্তু তা ভারতে হিন্দু মৌলবাদের উত্থানের প্রতি সূক্ষ পক্ষপাতদুষ্ট বলেই প্রতীয়মান হয়।

এ-গদ্যের শুরুতেই ঐতিহ্যের সাম্প্রদায়িকতার প্রসঙ্গ আসে গেলো শতকের নব্বইয়ের দশকে দেশের অনেক কবিতা-পদ্য লোককথা ও পৌরাণিক অনুষঙ্গে প্লাবিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে। পুরাণ ঐতিহ্যের সাম্প্রদায়িকতারই একটি প্রপঞ্চ, তা স্থানিক বিশিষ্টতার স্মারক হলেও। পশ্চিমের পোস্ট মডার্নিজম এবং স্থানীয় উত্তর আধুনিকতার প্রভাবে-প্রেরণায় সৃষ্ট ওই জলোচ্ছ্বাসে বাংলাদেশের কবিতাঙ্গনে তেমন কোনো পলি জমে বলে মনে হয় না। দ্য পাওয়ার অফ মিথ (The Power of Myth; Publisher: Knopf Doubleday Publishing Group; Publication Date: 06/01/1991) গ্রন্থে জোসেফ ক্যাম্পবেল যদিও বলেন: ÔPeople say that what we’re all seeking is a meaning for life. I don’t think that’s what we’re really seeking. I think that what we’re seeking is an experience of being alive, so that our life experiences on the purely physical plane will have resonances with our own innermost being and reality, so that we actually feel the rapture of being alive.Õ অন্যত্র তিনি বলেন: ০১. ÔMyths are public dreams, dreams are private myths.Õ
০২. ÔAs you proceed through life, following your own path, birds will shit on you. Don’t bother to brush it off. Getting a comedic view of your situation gives you spiritual distance. Having a sense of humor saves you.

শেষ উদ্ধৃতিতে নিজস্ব পথে চলা কারও ওপর মলত্যাগী পাখি কি ঔপনিবেশিক শক্তির প্রতীক? আমরা জানি, বিশ্বসাম্রাজ্যবাদের মোকাবেলায় উত্তর আধুনিকগণ স্থানীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ওপর গুরুত্বারোপ করেন। ক্যাম্পবেল শিমুল মাহমুদকেও বেশ উদ্বুদ্ধ করেন। আদিম মানুষ মিথের সাহায্যেই জীবন ও জগতের রহস্য বুঝতে সচেষ্ট হয় বলে শিমুল উল্লেখ করেন এবং পুরাণভাবনা বলতে মানবজীবনের অনন্ত সম্ভাবনার জাগরণই বোঝেন। কিন্তু মনে পড়ে, লোককথা বা মিথকে ফ্রান্সিস বেকন মিথ্যা অভিহিত করেন। পুরাণ কি আসলেই অসত্য এবং দুঃখের অবিরলতার গল্প? ঔপনিবেশিক যুগের অবসানের পরে এই প্রশ্ন নবতর গুরুত্ববাহী হয়ে ওঠে। ঔপনিবেশিক শক্তিসমূহ আফ্রিকায়, এমেরিকায় অনেক ভাষা, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে শুধু নয়, সংশ্লিষ্ট জাতি-গোষ্ঠীকেও ধ্বংস করে দেয়। তাই পুরাণের নতুনতর পাঠ খোদ পশ্চিমেই অনিবার্য হয়ে ওঠে প্রায়। ক্লদ লেভি-স্ত্রসের কাঠামোবাদ অতীতকে বুঝতে সহায়ক হয়ে ওঠে অনেকটা। ক্লদ লেভি-স্ত্রস তাঁর মিথ এন্ড মিনিং ( অনুবাদ: প্রিসিলা রাজ) গ্রন্থে যেমন বলেন: ‘বিজ্ঞান যেখানে সতের শতক থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত শুধুমাত্র পরিমাণগত বিষয়ে আগ্রহী ছিল, সেখানে এখন এটি বাস্তবের গুণগত দিকগুলিও বিবেচনায় নিয়ে আসছে।’ এমনটি হয়ে উঠছে মিথ পর্যালোচনার মাধ্যমেই। কিন্তু স্বয়ং লেভি-স্ত্রসই প্রশ্ন তোলেন: ‘কোথায় মিথলজির শেষ এবং ইতিহাসের শুরুই বা কোথায়?’ (প্রাগুক্ত) আর, উত্তর ও দক্ষিণ এমেরিকার মৌখিক ভাষাসম্পন্ন প্রাগৈতিহাসিক-প্রাচীন জনপদসমূহের পরবর্তীতে লিপিবদ্ধ নানা কাহিনি বা ‘বইগুলো পড়ে আমরা মিথলজি ও ইতিহাসের মধ্যেকার বৈপরীত্যের আরেকটি স্তর আবিষ্কার করি। এমনিতে আমরা ইতিহাস ও মিথলজিকে আলাদা করে দেখতে অভ্যস্ত। [..] মিথলজি ও ইতিহাসের মধ্যে কোনো স্পষ্ট বিভাজন রেখা নেই। এবং, এ দুয়ের মাঝামাঝি আবার আরেকটি স্তর আছে। মিথলজি স্থির, আমরা মিথের উপাদানগুলোকে উপর্যুপরি ফিরে আসতে দেখি একটা বদ্ধ প্রক্রিয়ার মধ্যে। এর বিপরীতে ইতিহাস একটি মুক্ত প্রক্রিয়া।’ জানান ফরাসী এই নৃতত্ত্ববিদ উল্লিখিত গ্রন্থে। আমাদের এও ভুলে গেলে চলে না যে, প্রাচীন মিথ সামন্তীয় শাসকদেরই শুধু অনড়তা দেয় না, অধুনাতন ধনতন্ত্র-সৃষ্ট মিথ জনবিরোধী (সেইসঙ্গে প্রকৃত অর্থে জনবিমুখ) চরিত্র ও বিষয়গুলোকেও, নানান মিডিয়ার মাধ্যমে, অমর করে তোলার প্রয়াস পায়। আর, পৌরাণিক চরিত্রগুলোর ডিকনস্ট্রাকশন বা অবিনির্মাণও শেষ অব্দি আসলে হয় না। কেননা, দৃষ্টান্তস্বরূপ, স্বদেশকে দ্রৌপদী বললে আপাত রূপকের ব্যঞ্জনা মেলে বটে, কিন্তু দ্রৌপদীর মহাভারতীয় ইমেজ বদলায় না। কেননা হৃতাবস্থা থেকে স্বদেশকে রক্ষা করবে কি দ্রৌপদীরই সম্ভ্রমরক্ষক শ্রীকৃষ্ণ (নিজেকে অদৃশ্য রেখে) প্রতিম অলৌকিক কোনো ক্ষমতা? মোটেও নয়। দেশকে বিদেশি লুটেরাদের হাত থেকে বাঁচাতে পারে দলিত জনমণ্ডলির জাগরণসম্ভব সম্মিলিত শক্তি, অন্য কিছু নয়। এদিকে আরো বিশেষভাবে লক্ষযোগ্য, ক্লদ লেভি-স্ত্রস তাম্র ও লৌহযুগ পর্যন্ত কল্লোলিত প্রধান ধর্মগুলোর পুরাণ ও ইতিহাস বিষয়ে কিছুই বলেননি উপর্যুক্ত গ্রন্থে। তিনি কাজ করেন মানুষের লিখন-পদ্ধতি আবিষ্কারের পূর্বেকার পরস্পর দূরবর্তী স্বতন্ত্র নানা মানবগোষ্ঠীর মিথ নিয়ে, যাতে ক্লদ, কাঠামোবাদের সুবাদে, ভৌগলিক ও সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতা সত্ত্বেও মনুষ্যগোত্রগুলোর জাগতিক বোধ ও দৃষ্টির মধ্যে, বিস্ময়কর সামঞ্জস্য আবিষ্কার করেন। অবশ্য প্রধান ধর্মগুলির মূল নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেও ঘোরতর অমিল নেই।

তবে বলে রাখতে হয়, সব ঐতিহ্যই সাম্প্রদায়িক নয়। যতোটা গভীর ও ততোটাই প্রসারিত রবীন্দ্রসাহিত্য ও সঙ্গীত যেমন আমাদের ঐতিহ্য, তেমনি, এদিকে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ এবং পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রাও তা-ই। এ ক্ষেত্রে জাজ্বল্যমানরূপে যুক্ত হন জীবনানন্দ দাশও। বলে রাখা দরকার, রবীন্দ্রনাথ উপনিষদনির্ভরতা, রোমান্টিসিজম ও মিস্টিসিজম থেকে শেষাবধি ইনফাইডালিটিতে নিজেকে উত্তীর্ণ করেন। এর আগে বলাকা কাব্যে ঈশ্বরকে গৌণ অভিহিত ক’রে জীবন ও জগতের গতিশীলতার কাব্যানুবাদ সম্পন্ন করেন। কবিতায় ঐতিহ্যিক উপাদান প্রসঙ্গে, উদ্ধৃতির বাহুল্য এড়িয়ে শুধু এটুকু বলে রাখতে হয়, মহাকাব্য ও লোককাব্যের অনুষঙ্গের প্রাধান্যের পাশাপাশি, বুঝিবা এনকাউন্টার হিসেবে, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠের দিনযাপনের বিশেষ ভাষা ও শব্দরাশি এবং কতিপয় পীরের নাম ও মাজারকেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গও ভিড় জমায় প্রাগুক্ত নব্বইয়ের পদ্যে। আরেকটি অংশে প্রমিত ভাষায় অনুপ্রবেশ ঘটানো হয় কথ্য ও আঞ্চলিক শব্দ এবং ক্রিয়াপদের। কিন্তু এই মিশ্রভাষা উৎপাদনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত জনমণ্ডলির নয় বিধায় তা বিপ্লবী চেতনার স্মারক হয়ে ওঠে না। এমনিতেই, লিখিত ভাষা আবিষ্কারের আগেই কবিতা মুখে মুখে রচিত ও শ্রুত হলেও পুঁজিবাদের আবির্ভাবের পর থেকে তা মধ্যবিত্তেরই হয়ে ওঠে। নব্বইয়ের উল্লিখিত সদর্থক রাজনীতিশূন্য প্রবণতাগুলোর বাইরে, সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশের প্রেক্ষাপটে প্রাগ্রসর জীবনচেতনার প্রতি উন্মুখ নানা মাত্রিক কবিতা রচনা করেন ওবায়েদ আকাশ, শোয়াইব জিবরান, সরকার আমিন, ভাগ্যধন বড়ুয়া প্রমুখ। কবি ওবায়েদ আকাশ তাঁর আবির্ভাবকালের উল্লিখিত কলরবে সাড়া না দিয়েই নিজের দেশীয় ও বৈশ্বিক জীবনবোধের কাব্যানুবাদে ব্রতী হন এক সূক্ষ্ম পৃথকতাযোগে। তাঁর ‘লৌকিক বাংলায় প্রত্ন-অনুসন্ধিৎসু অভিযাত্রা (দ্র: শামসুজ্জামান খান লিখিত ভূমিকা; উদ্ধারকৃত মুখমণ্ডল বইয়ে)’র কথা বলা হলেও, তিনি বাংলায় বিচরণ কেবল করেন না, যে কোনো জৈবনিক অবস্থানে গ্রাম-বাংলাকে গ্রথিত করে নেন নিজ সমগ্র সত্তায়। এদিকে শূন্য দশকেও পুরাণনির্ভরতা এড়িয়ে কবিতা লেখেন ইমতিয়াজ মাহমুদ, নওশাদ জামিল, মুয়িন পার্ভেজ (প্রথম কাব্য পর্যন্ত), ফুয়াদ হাসান এবং আরও কয়েকজন।

এবার আমরা সাহিত্যে আন্তর্জাতিকতার বিষয়টি, বক্ষ্যমাণ গদ্যের নির্ধারিত কলেবরে, উপলব্ধির বা পুনঃঅনুধাবনের প্রয়াস পেতে পারি। বলা বাহুল্য, সাহিত্যে আন্তর্জাতিকতা আর আন্তর্জাতিক সাহিত্য এক নয়। আর, সাহিত্যে আন্তর্জাতিকতার ধরনও একাধিক। তবে এর প্রধান তিনটি ক্ষেত্র অবশ্যউল্লেখ্য: (১) ঔপনিবেশিক বা উপনিবেশের প্রতিষ্ঠাতা দেশের সাহিত্য; (২) উপনিবেশিত দেশসমূহের উপনিবেশকালীন ও উত্তর ঔপনিবেশিক সাহিত্য এবং (৩) মানুষের মৌলিক অনুভূতি কিংবা বিশ্বমানবমণ্ডলির অভিন্ন অনুভূতির কবিতা ও কথাসাহিত্য। এই ক্ষেত্রগুলোর আলোচনা-পর্যালোচনা বুঝিবা শেষ হবার নয়। সাহিত্যে আন্তর্জাতিকতা বিষয়ে সিরিজ গদ্যই বরং অনিবার্য। এই রচনায় কেবল এর সূত্রপাতই সম্ভব।

উপর্যুক্ত প্রথম ক্ষেত্র বা ধরনে দৃষ্টিপাত মাত্রই সামনে চলে আসে টি. এস. এলিয়টের জগদ্বিখ্যাত কবিতা The Waste Land । কেননা তিনি এতে ভারতীয় দর্শন, উপনিষদ ও বৌদ্ধ দর্শন, বলা যায়, অংশত আত্তীকৃত করেন। কিন্তু এই কবিতায় কবি পুঁজিবাদ যে পণ্যে ও মানুষে কোনো ভেদ রাখে না এবং এগিয়ে রাখে শুধু যন্ত্রসভ্যতা তারই চমৎকার কাব্যিক উপস্থাপনা নিশ্চিত করেন। ধনতন্ত্রসৃষ্ট ভয়াবহ অহল্যাভূমির হেতু এবং মানুষের প্রাগ্রসরতার কোনো উপলক্ষ নির্দেশে ব্যর্থ হন। যদিও কবিতাটি শেষ হয় ÔShantih shantih shantihÕ ব’লে। এ-পর্যায়ের সাহিত্যের নমুনা যে আর নেই তা নয়। এদিকে এই ইতিহাস প্রায় সুবিদিত যে, এলিয়টের আগে, সমকালে ও পরবর্তী সময়ে ক্লাসিক ইংরেজি সাহিত্য ও রোমান্টিসিজম যথাক্রমে মধুসূদন, বিহারী লাল ও রবীন্দ্রনাথকে, যুক্তরাষ্ট্রের হুইটম্যান ও অংশত মার্কসবাদ নজরুলকে, ইংরেজি ও ফরাসী আধুনিক কাব্য তিরিশের পঞ্চকবিকে এবং মার্কসবাদ ও রুশ বিপ্লব চল্লিশের সমর সেন, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্য, অরুণ মিত্র, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ কবিকে আমূল আন্দোলিত করে। তবে, বাংলা কবিতায় আন্তর্জাতিকতা প্রসঙ্গে বিশ্বজিৎ ঘোষও যেমন বলেন, এলিয়ট কিংবা হুগোর কবিতায় ভারতবর্ষের প্রসঙ্গ আসে বটে, কিন্তু তা কবিতা নয়, দর্শনের আশ্রয়ে। ইউরোপ-এমেরিকায়ও রবীন্দ্রনাথ কবি নয়, দার্শনিক, ঋষি এসব পরিচয়েই বরণীয় হয়ে আছেন। সেই সঙ্গে স্মরণীয় যে, তিরিশের কবিদের কবিতায় ভারতীয় পুরাণের সমান্তরালে গ্রিক পৌরাণিক অনুষঙ্গও যেভাবে অঙ্গীকৃত হয় তা প্রাগুক্ত সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে প্রশ্নাতীত উৎকর্ষে ভাস্বর। এই মার্গীয় ধারা পরবর্তী কালের কবিতায়ও কম-বেশি প্রবহমাণ থাকে। শামসুর রাহমানের কাব্য ইকারুসের আকাশ কিংবা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা অজরামর কবিতা আগামেমনন সচেতন পাঠকের স্মৃতিতে ঝিলিক দিয়ে ওঠে। একটি কবিতায় তিনি নারী-পুরুষের মিলনকে ঘড়ির কাঁটার রূপকে উপস্থাপন করেন অনেকটা এভাবে: এদিকে ঘণ্টা ও মিনিটের কাঁটা যখন এক হয়, ওদিকে, ঠিক তখন, ভিয়েতনামে বোমা পড়ে। আবুল হাসান বলেন: ‘মৃত্যু আমাকে নেবে, জাতিসংঘ আমাকে নেবে না।’ তাছাড়া শহীদ কাদরীসহ গেলো শতকের পঞ্চাশের দশক থেকে শূন্য দশক পর্যন্ত রচিত কিছু কবিতায় আন্তর্জাতিক অনুষঙ্গ বাঙময়তা লাভ করে।

তবে দ্বিতীয় ঘরানার সাহিত্যের, বিশেষত কথাসাহিত্যের, অসামান্য বিস্তৃতি অনেক বেশি চিত্তাকর্ষক। এই উত্তর ঔপনিবেশিক সাহিত্য আবার দুই প্রকার: (ক) যুদ্ধবিগ্রহের শিকার দেশান্তরিত আর (খ) স্বেচ্ছায় অভিবাসীদের সাহিত্য। এই সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত পাঠ নেয়ার আগে আরো একটি বিষয়ের উল্লেখ অনস্বীকার্য হয়ে ওঠে। উপনিবেশের প্রবক্তা দেশগুলোর চিন্তাবিশ্ব উপনিবেশিত দেশগুলোর উপনিবেশকালীন ও উপনিবেশ-উত্তর সাহিত্য-সংস্কৃতিকে কিভাবে দেখছে সে-প্রসঙ্গ। দ্য আর্কিটাইপস্ অ্যান্ড দ্য কালেক্টিভ আনকনশাসনেস (The Archetypes and the Collective Unconscious/Series: Collected Works of C.G. Jung/Author: C.G. Jung/Imprint: Routledge) বইয়ে কার্ল জি. জাঙ যে মা ও সন্তানের সম্পর্ক মায়ের আর্কিটাইপ বা স্থিরিকৃত-রক্তবাহিত-চিরপরিচিত আদর্শ কিংবা মনস্তত্ত্ব দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় বলে জানান, মরমী চেতনাও এর অনুরূপ। তাছাড়া সমস্ত পুরাণও যৌথ অবচেতনের সম্মিলিত বিচিত্র প্রকাশ বলে জাঙ অভিহিত করেন। যৌথ অবচেতনের বিশ্লেষণে চিন্তার ইতিহাসও অন্তর্ভুক্ত হয় যা তিন প্রকার কেন্দ্রিকতার মধ্যে আবর্তিত: (ক) আদি যুগের কসমোসেন্ট্রিক (ব্রহ্মাণ্ডকেন্দ্রিক আদি চিন্তা, কার্যকারণ, সৃষ্টিরহস্য, মানুষের মৃত্যূত্তর পরিস্থিতি সংক্রান্ত ভাবনা), (খ) মধ্যযুগের থিয়োসেন্ট্রিক (দেবদেবীকেন্দ্রিক চিন্তা, দেবদেবীদের ওপর মানুষের বৈশিষ্ট্যারোপমূলক চিন্তা) আর (গ) আধুনিক যুগের লোগোসেন্ট্রিক (জ্ঞানকেন্দ্রিক চিন্তা যা থেকে ইউরোসেন্ট্রিজম উৎপন্ন হয়)। প্রায় মানুষের মধ্যে এখনো, উল্লিখিত প্রথম দুই ধরনের চিন্তাই, জন্মগতভাবে এবং এমনকি জন্মের আগে থেকেই (যৌথ অবচেতন বলতে আসলে যা বোঝায়) সক্রিয়। সেই সঙ্গে মধ্য বিংশ শতাব্দীতে সমাপ্ত ইয়োরোপীয় ও অংশত আমেরিকান উপনিবেশ বিষয়ে প্রণীত খোদ ইয়োরোপেরই তত্ত্ব প্রসঙ্গে, কিছুটা আলোকপাত অনাবশ্যক নয়। উল্লিখিত দুই মহাদেশের প্রত্যক্ষ বৈশ্বিক আধিপত্যের ইতিহাসের আর্থসামাজিক-রাজনীতিক-মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব অধ্যয়নই এই তত্ত্বের মূল উপজীব্য। এডওয়ার্ড ডব্লিউ. সাঈদকে পোস্ট কলোনিয়ালিজমের প্রবক্তা ধরা হলেও ফ্রাঞ্জ ফানো এতে সঞ্চারিত করেন নবতর প্রাণ আর হোমি কে. ভাভা তাতে জুড়ে দেন নতুনতর বিশ্লেষণ। দ্য লোকেশন অফ কালচার (The Location of Culture/Routledge Classics/Publisher: Psychology Press, 2004) গ্রন্থে ভাভা গেলো মধ্য শতকে উপনিবেশ থেকে মুক্ত জনমণ্ডলির মিশ্র সংস্কৃতির কথা বলেন। উপনিবেশের প্রবক্তা দেশসমূহের নানা সাংস্কৃতিক প্রপঞ্চ উপনিবেশিত জনগণের যাপনে গ্রথিত হয়ে যায়। ফলে, তিনি ব্যাখ্যা করে দেখান যে, নিজস্ব সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় ব’লে নিরঙ্কুশ কিছু আর অবশিষ্ট থাকে না। কেননা, তাঁরই ভাষায়, এই ‘হাইব্রিডিটি’যোগে উপনিবেশিতগণ এক ‘কাল্পনিক’ জাতীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচয় ‘গঠন’ করে। একই বইয়ে ভাভা আবার এও বলেন : ‘এই ধারণা ক্ষয়যোগ্য ও আত্মবিধ্বংসী যে, তত্ত্ব প্রয়োজনীয়ভাবেই সামাজিক- সাংস্কৃতিক সুবিধা প্রাপ্ত এলিটদের ভাষায় রচিত হয় আর সাম্রাজ্যবাদী অথবা নিও-কলোনিয়াল ওয়েস্টের ইয়োরোসেন্ট্রিক আওতার মধ্যেই প্রাতিষ্ঠানিক সমালোচকের অবস্থান।’ টনি মরিসন এবং ন্যাডিন গর্ডিমারের কাজ পর্যালোচনার মাধ্যমে, ভাভা আধিপত্যবিস্তারী সমাজ-সংগঠনের মধ্যেই, প্রান্তিক, সর্বদা যাতায়াতযোগ্য ও গৃহহীন ধরনের স্থানে লোকেশন অফ কালচার বা সংস্কৃতির অবস্থান অনুসন্ধান করেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পূর্ব তথা পাকিস্তানি উপনিবেশকালীন সাহিত্যের স্বরূপ বুঝতে হলে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর কদর্য এশীয় (দ্য আগলি এশিয়ান-এর শিবব্রত বর্মণকৃত অনুবাদ) এবং জহির রায়হানের যুদ্ধের উপন্যাস আর কত দিন-এর কথা বলতেই হয়। ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে মুক্ত সদ্য স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রমুখি, জনবিচ্ছিন্ন এবং সামরিক অভ্যুত্থানের হুমকির সম্মুখীন হয়ে কিভাবে ঔপনিবেশিক হয়ে ওঠে তা-ই বিশদ করেন ওয়ালীউল্লাহ, বিশাল ক্যানভাসের এই উপন্যাসে। আর, জহির কোনো স্থানের উল্লেখ না করে দুই দুটি বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাত চিত্রায়ণের মাধ্যমে তাঁর উপন্যাসটিকে আন্তর্জাতিক করে তোলেন যুদ্ধবিরোধী মানবিক বোধের উজ্জীবনের মধ্য দিয়ে। এ-পর্যায়ে সাহিত্যে ১৯৪৭-এর দেশভাগ কিংবা দেশভাগের গল্প-উপন্যাসও সাহিত্যে আন্তর্জাতিকতার আরেক উজ্জ্বল অথচ ট্রাজিক দৃষ্টান্ত। খুশবন্ত সিং, সালমান রুশদী, আর কে নারায়ণ ইংরেজিতে লেখেন দেশভাগের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার উপন্যাস। কৃষণ চন্দর, ভীষ্ম সাহীন, সাদাত হোসেন মান্টোর হিন্দি-উর্দু রচনায় এবং বাঙালি লেখক মানিক বন্দোপাধ্যায়, রমেশচন্দ্র সেন, অতীন বন্দোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, দেবেশ রায়, স্বপ্নময় চক্রবর্তী প্রমুখের উপন্যাসে বয়ে যায় দেশভাগের রক্ত ও অশ্রু। এদিকে আনোয়ার পাশা, আবু জাফর শামসুদ্দীন, আবুল ফজল, আবু ইসহাক, সত্যেন সেন, রাজিয়া খান, শহীদুল্লাহ কায়সার, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সরদার জয়েনউদ্দীনের কথাসাহিত্যে যেমন তেমনি পরবর্তীকালে হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শওকত আলী ও সেলিনা হোসেনের উপন্যাসেও বাঙময়তা লাভ করে দেশবিভাগের অভিঘাত।

স্বাধীন বাংলাদেশ থেকেও ঠিকানাচ্যুতির আরেকটি মর্মান্তিক ঘটনা চলমান রয়েছে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ধারাবাহিক নীরব দেশত্যাগ। এ-পর্যায়ে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর একটি তুলসি গাছের গল্প এবং হাসান আজিজুল হকের পরবাসীর পরে সম্প্রতি প্রকাশিত হয় মহীবুল আজিজের চতুর্থ উপন্যাস প্রশান্ত পরিত্যাগ। ১৯৯০ সালে আক্রান্ত হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় সনাতনী এক পরিবারের প্রতিবেশী দেশে পাড়ি জমানোর মর্মস্পর্শী কাহিনি এতে বিধৃত। উপন্যাস শেষ হয় এই মর্মবিদারী ভাষ্যে: ‘মাসিমার গায়ে আমার অশ্রু লেগে আছে, মাসিমা জানে। সমরের গায়ে আমার অশ্রু লেগে আছে, সমর জানে। বিন্দুর গায়ে আমার অশ্রু লেগে আছে, বিন্দু জানে। কিন্তু আমার গায়ে লেগে রয়েছে মাসিমা, সমর এবং বিন্দু ওদের সকলের চোখের জল। কোনটা যে কার চোখের জল সেটা একটা থেকে আরেকটা আলাদা করা আমার পক্ষে সম্ভব হয় না।’ মহীবুলের তৃতীয় উপন্যাস বর্ণসন্তান-এর প্রেক্ষাপট মূলত ইংল্যান্ড, ভারত ও বাংলাদেশ, কাহিনি লন্ডনে আবর্তিত হলেও। নিঃসন্তান শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশ স্বামী ও পর্তুগিজ বংশোদ্ভূত ভারতীয় স্ত্রীর বাংলাদেশী দত্তক পুত্র নিহত হয় ঐ দম্পতিরই ঢের পরে জন্মানো ও বেড়ে ওঠা কন্যার বয় ফ্রেন্ডের ছেলে বন্ধুর হাতে। হন্তারক এর আগে বন্ধুর ওই গার্ল ফ্রেন্ডকে বলাৎকারে প্রবৃত্ত হলে দত্তক পুত্র বাধা দেয় বিধায় শেষে নিহত হয়। নিহতজন একাত্তরের যুদ্ধশিশুও হতে পারে। তাছাড়াও এই উপন্যাসে রয়েছে অনেক ঐতিহাসিক তথ্য ও লোমহর্ষক সিকোয়েন্স যা অভিবাসী সাহিত্যের মূল্যায়নে অবশ্যউল্লেখ্য হয়ে উঠবে।

শুধু কি একাত্তরে বলাৎকৃত কোনো কোনো নারীর পাশাপাশি যুদ্ধশিশু এবং তখন থেকেই এখনো পর্যন্ত সবিরাম প্রক্রিয়ায় আক্রান্ত হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষই দেশত্যাগে বাধ্য হয়? না। কবি-লেখকদেরও কারো কারো এমন দুর্ভাগ্য ঘটে। দাউদ হায়দারের কাব্য এই শাওনে পরবাসে, তসলিমা নাসরিনের উপন্যাস ফরাসী প্রেমিক-এর উল্লেখ, সাহিত্যে আন্তর্জাতিকতার প্রশ্নে অনস্বীকার্য। এ ক্ষেত্রে, হয়তো অনেকেরই অগোচরে, যুক্ত হয় কমপক্ষে আরও দুটি বই, বাস্তব অভিজ্ঞতার অভিঘাতে লেখা, মহীবুল আজিজের কাব্যগ্রন্থ রৌদ্রছায়ার প্রবাস এবং বর্তমান গদ্যকারের এখনো পর্যন্ত একমাত্র গল্পগ্রন্থ আকব্জিআঙুল নদীকূল। শেষোক্ত দুই বইয়ের প্রথমটি বিলেত প্রবাসী কবি এবং দ্বিতীয়টি মধ্যপ্রাচ্যপ্রবাসী বাংলাদেশী শ্রমিকদের করুণতম অভিজ্ঞতার অনুবাদ।

কেবল কি কবিতা ও কথাসাহিত্যেই আন্তর্জাতিকতা অনুসন্ধানযোগ্য? না। আমাদের প্রবন্ধসাহিত্যেও এর কিছু মাইল ফলকপ্রতিম জ্বলজ্বলে নমুনা উপস্থিত। নিরাপোষ দুই অগ্রচিন্তক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এবং হুমায়ুন আজাদের প্রবন্ধের বইগুলি আংশিক অথচ তীব্র প্রভাব ফেলে আমাদের সমাজে, জাতীয় জীবনে। চৌধুরীর শেক্সপীয়রের মেয়েরা, ধ্রুপদী নায়িকাদের কয়েকজন এবং আজাদের নারী ভেতরে ভেতরে, অংশত হলেও, গভীর বিপ্লব ঘটিয়ে দেয় দেশে। শ্রেণী নির্বিশেষে না হলেও, আমাদের নারীদের শিক্ষা ও স্বনির্ভরতা অর্জন সংক্রান্ত পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে, অনেক পরিবর্তন আসে। এই তালিকায় যোগ করতে হয় আকিমুন রহমানের দুর্দান্ত গবেষণার ফসল পৌরাণিক পুরুষ এবং মহীবুল আজিজের সোলঝেনিৎসিন ও অন্যান্য প্রবন্ধ বই দুটি। এখানে প্রশ্ন জাগে: বিদেশ ভ্রমণের কাহিনি কি সাহিত্যে আন্তর্জাতিকতার অন্তর্ভুক্ত হতে পারে? কেন নয়, যদি তাতে নানা দেশের মানুষের সঙ্গে লেখকের সংযোগের গল্প থাকে? ভ্রমণসাহিত্যের তালিকা প্রণয়ন প্রয়োজনীয় নয়। তা খুব ছোটও নয়। তবে, সৈয়দ মুজতবা আলীর দেশে-বিদেশে, হাসনাত আবদুল হাইয়ের ট্রাভেলগ কিংবা কামরুল হাসান ও মইনুস সুলতানের চলমান ভ্রমণবৃত্তান্ত স্মৃতিতে জাগ্রত থাকে। সেই সঙ্গে স্মর্তব্য, বিশ্বসাহিত্যের অনুবাদ তো আন্তর্জাতিক সাহিত্যই। কিন্তু বিদেশী ভাষায় লেখা বাংলাদেশী লেখকের বই তো সাহিত্যে আন্তর্জাতিকতার আরেক দৃষ্টান্ত। কায়সার হকের Black Orchid -এর পাশে বছর দুই আগে এসে দাঁড়ায় মহীবুল আজিজের ইংরেজি কবিতার বই Private Moments। প্রসঙ্গটির অবতারণা এ জন্যে যে, আন্তর্জাতিক ভাষায় সাহিত্য রচনাও সাহিত্যে আন্তর্জাতিকতার আরেক নাম। এ-পর্যায়ে উদীয়মান বাংলাদেশী ইংলিশ রাইটার হিসেবে তাহমিনা আনাম, রশিদ আশকারি, মারিয়া চৌধারি, কে. আনিস আহমেদ, ফারাহ গজনভি, আফসান চৌধুরী ও ফকরুল আলমসহ দশজনকে চিহ্নিত করে The Daily Star। তাঁদের মধ্যে মাহমুদ রহমান মাহমুদুল হকের উপন্যাস কালো বরফ-এর ইংরেজি অনুবাদ সম্পন্ন করেন Black Ice নামে। আর, ফকরুল করেন বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীর অনুবাদ: The Unfinished Memoir।

এবার আমরা সংক্ষেপে অভিবাসী ও ইংরেজি ভাষার কয়েকজন লেখকের উৎকর্ষের স্বাদ গ্রহণের প্রয়াস পেতে পারি। কেননা তাঁদের কথাসাহিত্যের প্রেক্ষাপট যেমন দারুণ আন্তর্জাতিক তেমনি ভাষাও নবতর মাত্রিক, কিছুটা বুঝিবা উপনিবেশিতের নতুন আন্তর্জাতিক জবান যা কখনো কখনো ঐন্দ্রজালিক ঠেকে এবং খুলে দেয় দলিতের সত্তার গভীরে প্রবেশের দুয়ার। ভি. এস. নাইপল, আর কে নারায়ণ, সালমান রুশদি, অমিতাভ ঘোষ, কিরণ দেশাই, অরুন্ধতী রায়, ঝুম্পা লাহিড়ি, অরবিন্দ আদিগা ও শশী থাহুরসহ আরও কয়েকজন লেখকের দৃপ্ত সক্রিয়তা সচেতন পাঠককে ভীষণ আকৃষ্ট করে। এ-পর্যায়ে প্রথমেই প্রণিধানযোগ্য হয়ে ওঠে সালমান রুশদির Midnight’s Children (First published by Jonathan Cape in the UK in 1981)। দ্য টিন ড্রাম উপন্যাসের ম্যাডোনা ৪৯ অধ্যায়ে গুন্টার গ্রাস বলেন: ‘শিল্প হচ্ছে একটা অভিযোগ, অভিব্যক্তি, অনুরাগ। শিল্প হচ্ছে সাদা কাগজ আর কালো কাঠকয়লার মধ্যকার চূড়ান্ত সমর।’ এই শিল্পের অবিস্মরণীয় মহত্ত্বকে আরেকভাবে, বলা যায়, প্রতিষ্ঠিত করেন সালমান রুশদি, তাঁর মিড নাইটস্ চিলড্রেন উপন্যাসে। যেমন : ১. পশ্চিমা সাহিত্য সমালোচকদের অনেকেই গ্রাস ও রুশদির এই দুটি নভেলকেই সাহিত্যিক জাদুবাস্তবতার দৃষ্টান্ত ব’লে ধরে নেন এবং ইয়োরোপে গ্রাসকেই এই কৃৎকৌশলের পথিকৃৎ বিবেচনা করেন, রুশদি যাঁর অনুসারী। ২. গণঘটনাবলীর প্রতিফলনে মূল চরিত্রের ব্যক্তিজীবন ব্যবহারের মাধ্যমে রুশদি তাঁর উল্লেখিত উপন্যাসের মেইন স্ট্রাকচারাল ডিভাইস গ্রাসের উপর্যুক্ত নভেলের কাঠামো থেকে ধার নেন ব’লে দাবি করেন উক্ত সমালোচকগণ। এ ক্ষেত্রে, তাঁরা নির্দ্বিধায় বলেন, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস্ অফ সলিচিউডও গ্রাসের কাছে কিছুটা ঋণী। ৩. ওই ক্রিটিকদের বিবেচনায়, রুশদির উপন্যাসটির চরিত্র সেলিম সিনাই, যার জন্ম ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির লগ্নে, অদ্ভুতভাবে ১৯৪৭ সালের ১৫ অগাস্ট ঠিক মধ্যরাতে, গ্রাসের অস্কারের মতোই দানবিক শিশু। অস্কার দাবি করে, সে তার উচ্চস্বরের আঘাতে কাচ ভাঙতে পারে আর সেলিম ব্যবহার করে টেলিপ্যাথি। অস্কার ক্ষুদ্রকায় আর সেলিমের রয়েছে নাসিকাযন্ত্রের সমস্যা। ৪. উভয়ের প্রত্যেকে বিশ্বাস করে যে, মায়ের প্রেমিকই তার পিতা। জার্মান অস্কার জনক হিসেবে ধরে নেয় পোলিশ বা পোল ইয়ান ব্রনস্কিকে, হিন্দু সেলিম মুসলিম নাদির খানকে। ৫. দ্য টিন ড্রাম নানাভাবে ডানজিগে অতিবাহিত গ্রাসের শৈশবের দিনগুলির গল্প বলে। আর, মিড নাইটস্ চিলড্রেন বলে মুম্বাইয়ে শিশু রুশদির বেড়ে ওঠার নানা কথা। কিন্তু রুশদি নিজে বলেন: ÔMidnight’s Children is a product of its moment in history, touched and shaped by its time in ways which its author cannot wholly know.Õ
অমিতাভ ঘোষের বিশাল দুর্দান্ত উপন্যাস THE GLASS PALACE (First published by HarperCollins Publishers UK 2000; First Published in India by HarperCollins India 2000) শুরু হয় ধীর গতির বর্ণনায়, ভারতীয় বংশোদ্ভূত এক বার্মিজ অনাথ বালক রাজকুমার রাহার শৈশবের গল্প ফেয়ারি টেইল স্টাইলে বলার ধরনে, খুব নিবিড়ভাবে। তার কাহিনি এই উপন্যাসে বিধৃত। গল্পের শুরু ঊনবিংশ শতাব্দির শেষের দিকে। ঔপনিবেশিক শক্তি ব্রিটিশ প্রশাসন তৎকালীন বার্মার রাজা থিবকে বলপ্রয়োগে ক্ষমতাচ্যুত করে ভারতে নির্বাসনে পাঠালে পাল্টাতে শুরু করে ওই ভূখণ্ডের জনজীবন এবং হুমকির সম্মুখীন হয় বার্মিজদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিও। ব্রিটিশ প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা এবং পশ্চিমা উচ্চ প্রযুক্তির সঙ্গে বার্মিজ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সমন্বিত হতে পারে না। বিশ শতকে সেখানে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। এদিকে শৈশবে সেই নির্বাসিত রানির সেবিকা হিসেবে রাজকুমার মান্দালয়ে দেখে ডলিকে। তার সন্ধানে পরে সে ভারতে যায়, অবস্থা সচ্ছল হওয়া সাপেক্ষে তাকে বিয়ে করার পূর্ব-প্রতিশ্রুতি রাখতে। কেননা কাঠের ব্যবসার সুবাদে ততোদিনে সে সম্পদশালী। খুঁজে পেয়ে ডলিকে বিয়েও করে। কিন্তু যুদ্ধ এবং নানান আন্তর্জাতিক ঘটনার অভিঘাতে বার্মা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান বার্মা আক্রমণ করলে রাজকুমার সর্বস্ব হারায়। ওদিকে নির্বাসিত রাজপরিবার বোম্বের এক জেলেপাড়ায় ভিন্নতর জীবনসংগ্রামে নিরত হয়। উপনিবেশবাদী-সাম্রাজ্যবাদী বৈশ্বিক ঘটনার ভয়ংকর অমানবিক অভিঘাতে অখণ্ড ভারতবর্ষের মধ্যেই আন্তঃআঞ্চলিক বাস্তুচ্যুতির ঘটনাগুলোর সঙ্গে রোহিঙ্গাদের দেশত্যাগের ঘটনার অমিল কোথায়? সে-প্রসঙ্গে আসা যাবে পরে।

অরুন্ধতী রায়ের শক্তি কোথায়? ব্যতিক্রমী উপন্যাসে নাকি স্বাধীনতার স্পৃহায় টগবগ সাহসী প্রবন্ধে? উভয় ক্ষেত্রেই তিনি সমান জঙ্গম। তাঁর The God of Small Things (IndiaInk/An imprint of RST IndiaInk Publishing Co Pvt Ltd/CI Soami Nagar, New Delhi 110017 India) উপন্যাসের ঘটনাবলী ভারতের কেরালা প্রদেশের। দুই যমজ সন্তান এসথাপ্পেন ও রাহেল এবং তাদের ভগ্ন পিতৃপরিবারের কাহিনি। তাদের মা ওদের উগ্র পিতাকে ত্যাগ করে তার পিত্রালয়ে ফিরে যায় এবং সেখানে একসময় এসে হাজির হয় তারই সবজি ব্যবসায়ী ভাই চেকোর সাবেক ইংরেজ স্ত্রী। বিশাল এলাকায় ছড়ানো কাহিনির বিন্যাস এমন যে, আগ্রহী পাঠকের বুঝিবা মহাভারত পাঠের অভিজ্ঞতা হয়। গভীর অভিনিবেশ ছাড়া ঘটনাগুলোর সংযোগ আবিষ্কার কিছুটা কঠিনই হয়ে পড়ে। কাহিনি বয়ানের এ প্রায় এক নতুন রীতিই যা ভিন্নতর নান্দনিকতা সঞ্চারিত করে পাঠকের চেতনায়। বলা হয়, অরুন্ধতী এই উপন্যাসে শ্রেণীব্যবস্থা, ভারতীয় সমাজে নারীর অবস্থান এবং ভারত ও ব্রিটেনের মধ্যকার স্থান বদলরত উত্তর ঔপনিবেশিক সম্পর্ক যাচাই করে দেখেন।

কিরণ দেশাইয়ের The Inheritance of Loss (Grove Press/an imprint of Grove/Atlantic Inc./841 Broadway/New York, NY 10003) উপন্যাসের উপজীব্য ভারতের উত্তর দিককার দার্জিলিংয়ের নিকটবর্তী কালিমপং এলাকার আশির দশকের কাহিনি। এক বিচারপতি, ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকে ডিগ্রি প্রাপ্ত, যিনি দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার শিকার হয়ে প্রায় শ্রেণীচ্যুত, নিজের অনাথ নাতনি সাইকে লালন পালন করেন। তিনি দাম্পত্য সমস্যাক্লিষ্ট। তাঁর পাচকের ছেলে বিজু উন্নত জীবিকার আশায় নিউইয়র্কে পাড়ি জমায় এবং সেখানে অবৈধভাবে কিচেনে কাজ করে। কালিমপংয়ের জনজীবন এবং যুক্তরাষ্ট্রে বিজুর অপমানিত-নিগৃহীত অবস্থার গল্পই আলোচ্যমান উপন্যাসকে অবিস্মরণীয় করে রাখে। বিজুর চারপাশের শ্রমিকেরা তাকে হেয় প্রতিপন্ন করে। পতিতালয়ে গিয়ে পুরুষত্ব প্রমাণে বাধ্য করে প্রায়। সহজাত লজ্জাবশত সে প্রমাণ না দিয়েই ফিরে আসে। এমনকি পাকিস্তানি শ্রমিকও তাকে পরিহাসে বিদ্ধ করে যাকে সে তার চেয়ে হেয়তর জ্ঞান করে। এমনকি সাই ক্যামব্রিজে স্কুলে পড়ার সময় শোনে প্রায় এমন কথা: ‘নিম্ন শ্রেণীর মানুষেরা নিছক প্রাণীর মতো। তোমরা রাস্তায় মলত্যাগ কর!’ ওদিকে ক্রমান্বয়ে বিজু বুঝতে পারে সে পাচকের পুত্রই, আর কিছু নয়।

নয়টি গল্পের সংকলন ঝুম্পা লাহিড়ির Interpreter of maladies: (HarperCollins Publishers India Pvt. Ltd/7/16 Ansari Road, Darya Ganj, New Delhi 110 002/First Published in the USA in 1999 by Houghton Mifflin Company)-এও ভেঙে-পড়া কিংবা ক্ষতবিক্ষত মানুষের দেখা মেলে। নাম গল্পে ভারতীয় এমেরিকান পরিবারেও দাম্পত্য সমস্যা এবং এক সন্তানের পিতৃপরিচয়সংকট আবর্তিত হয়। আসলে প্রাক্তন উপনিবেশিত দেশের বর্তমান ডায়াসপোরা উত্তর ঔপনিবেশিক মানুষেরাও ঔপনিবেশিক সংস্কৃতি থেকে মুক্ত নয়।
অরবিন্দ আডিগার The White Tiger (দ্য হোয়াইট টাইগার: অনুবাদ: মহসীন হাবিব/প্রথম প্রকাশ: হারপার কলিন্স পাবলিশার্স, ভারত ২০০৮/বাংলা ভাষায় প্রথম প্রকাশ: চারদিক, ২০০৯), বলা যায়, পত্র-উপন্যাসই। চাইনিজ প্রিমিয়ার ওয়েন জিয়াবাওকে সাত রাতে লেখা ভারতীয় বলরাম হালোয়াইয়ের চিঠিগুচ্ছে বিবৃত খোদ পত্রকারের দাসত্ব, আর্থিক উচ্চাশা এবং হত্যাকাণ্ডের কাহিনিই উপন্যাসটিকে দাঁড় করিয়ে দেয়। জিয়াবাওয়ের ব্যাঙ্গালোর বিষয়ে সত্য কিছু জানার মিশন সম্পর্কে রেডিওতে শুনে বলরাম এই চিঠিগুলো লেখে। লক্ষণীয় যে, চিঠির শুরুতেই বলরাম জিয়াবাওকে ধন্যবাদ দেয় চীনের নেতারা বাইরের কাউকে, কোনো শক্তিকে সে-দেশ শাসনের অনুমোদন দেয়নি ব’লে। উচ্চাকাঙ্ক্ষী অপরাধী দলিতের দুর্ধর্ষ অভিজ্ঞতার অভিঘাত এক হাহাকারময়তায় ধরা থাকে এই ধন্যবাদে।

জিয়া হায়দার রহমানের In the Light of What We Know (Farrar, Straus and Giroux/2014) আরেক বিশাল এবং মহাকাব্যিক উপন্যাস। দুই বন্ধুরই কাহিনি যা যুদ্ধবিগ্রহসহ শতাব্দীর ইতিহাসের ভেতর দিয়ে কাবুল থেকে লন্ডন, নিউইয়র্ক, ইসলামাবাদ, অক্সফোর্ড এবং প্রিন্সটন অব্দি গড়ায়। বিশ্বাসঘাতকতার গল্পও এতে আছে। এই এনসাইক্লোপিডিক নভেলও ডায়াসপোরা সাহিত্যে এক শক্তিধর সংযোজন।

এবার আমরা বাংলাদেশে অবস্থানরত বিহারী কবিদের কবিতার অন্তত দুটি নমুনার সঙ্গে পরিচিত হতে পারি:
আহমেদ ইলিয়াস লেখেন: ÔThe village has no home for me now/Even the sky has rejected us.Õ (উর্দু থেকে ইংরেজি অনুবাদ: রুখসানা চৌধুরী; A Search for the Self: Trials and Tribulations of Urdu Writers in Bangladesh) আমাদের স্বনামখ্যাত চলচ্চিত্রকার তানভীর মোকাম্মেলের বৃদ্ধা বিহারি (প্রথম আলোতে প্রকাশিত) কবিতায় বিহারী বৃদ্ধা বলেন: ‘মেজ ছেলে অনেক তকলিপ করে পালিয়েছে পাকিস্তান/আরেক মেয়েও করাচি রঙ্গি টাউন/বাইশ বছর ওদের সুরত দেখি না/আর ছোট ছেলেটা গুল্লু/ভিসার অপেক্ষায় দারু খায় আর কী কী যেন খায় জোয়ান ছেলেরা/ক্যাম্পে তো আসমান নেই ফেরেশতারা তাই দেখতে পান না!’ উল্লিখিত পত্রিকায় মাসুদুজ্জামান অনুবাদ করেন প্রবাসী রোহিঙ্গা কবি আলী জোহারের কবিতা।

ওদিকে চিনুয়া অ্যাচিবি, নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গা, এমে সেজায়ারসহ আফ্রিকার উত্তর ঔপনিবেশিক সাহিত্য তো রয়েছেই। বিশাল লাতিন সাহিত্যজগৎও তো অপূর্ব। কোথায় নেই আন্তর্জাতিকতা? মার্কেসের অসাধারণ উপন্যাস ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস্ অফ সলিচিউড-এও ঔপনিবেশিক আঘাত-অভিঘাত অভিব্যঞ্জিত। জঙ্গলে উঠে-আসা স্পেনীয় জাহাজ, গেরিলা অভ্যুত্থান, কলা কোম্পানির গণহত্যা, বাষ্পীয় ইঞ্জিনের আবির্ভাব ইত্যাদি দ্বারা বুয়েন্দিয়া পরিবারের গড়ে তোলা গ্রাম মাকোন্দো নানাভাবে প্রভাবিত-আন্দোলিত হয়।

বাংলাদেশে বসবাসরত রাষ্ট্রহীন (প্রায়ই) বিহারী এবং প্রত্যাবাসিত রোহিঙ্গাদের সাহিত্যপ্রয়াসের কিছু নমুনা তো আমাদের সামনে আছেই। বিহারীদের বিষয়ে হরিপদ দত্ত লেখেন মোহাজের উপন্যাসখানা। রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে রচিত হয় চারটি উপন্যাস, বুলবুল চৌধুরীর রাচী, সানাউল্লাহ নূরীর রোহিঙ্গা কন্যা, নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীরের উদ্বাস্তু এবং স্বকৃত নোমানের বেগানা। ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয় আলী প্রয়াস সম্পাদিত ছোট কাগজ তৃতীয় চোখ-এর অভিবাসন, দাস বাণিজ্য, মানব পাচার, মানবিক বিপর্যয় সংখ্যা। বর্তমান গদ্যকারের তুমি কি রোহিঙ্গা মাছি (২০১৮) কাব্যগ্রন্থে উল্লিখিত বিষয়ে কয়েকটি কবিতা রয়েছে। কিন্তু সাহিত্যে এ নিয়ে আরও কাজ হওয়ার কি সুযোগ নেই? আমাদের কেউ কি রোহিঙ্গাদের হয়ে পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, সামরিক তন্ত্র ইত্যাদির বিরুদ্ধে বলতে পারি না, জঁ জাক রুসো তাঁর মানব জাতির অসমতার উৎস এবং ভিত্তি (অনুবাদ: হারুন-উর রশিদ) গ্রন্থে যেমন বলেন: “যে মানুষটি সর্বপ্রথম এক টুকরো জমি ঘের দিয়ে একথা বলার কথা চিন্তা করেছিল ‘এ জমি আমার’ আর যার চারপাশে একথা বিশ্বাস করার মতো সহজ সরল লোক ছিল, সে মানুষটিই সভ্যসমাজের আদি প্রতিষ্ঠাতা। কেউ যদি সেদিন তার পোঁতা খুঁটিগুলো উপড়ে ফেলে, গর্ত ভরাট করে দিয়ে বলত ‘তোমরা এ প্রতারকের কথায় বিশ্বাস করো না-আমাদের সর্বনাশ হয়ে যাবে আমরা যদি একথা ভুলে যাই যে পৃথিবীর ফুলফল আমাদের সকলের, কিন্তু এ মাটি কারো একার নয়’-তাহলে কত খুনজখম, অপরাধ, যুদ্ধ, বিভীষিকা আর দুর্ভাগ্যের হাত থেকেই না মানবজাতি রক্ষা পেত।”

************************