You are currently viewing শিপ জাম্পার: বাঙালির আমেরিকাযাত্রাঃ আদনান সৈয়দ || পাঠপর্যালোচনাঃ অনুপদাশ গুপ্ত

শিপ জাম্পার: বাঙালির আমেরিকাযাত্রাঃ আদনান সৈয়দ || পাঠপর্যালোচনাঃ অনুপদাশ গুপ্ত

আদনান সৈয়দ

শিপ জাম্পার: বাঙালির আমেরিকাযাত্রা

পাঠপর্যালোচনাঃ অনুপদাশ গুপ্ত

ভারতবর্ষ তথা বাংলা নামক ভূখন্ডে পুর্তগীজ, ওলোন্দাজ, ফরাসি, ডাচ এবং ইংরেজদের আগমনের ইতিহাস যেভাবে শিল্পসাহিত্য এবং ইতিহাসের প্রাতিষ্ঠানিক চর্চায় আলোচিত হয়েছে কিন্তু এই বাংলার মাটি থেকে সুদূর আমেরিকায় অভিবাসনের ইতিহাস এবং অভিবাসীদের জীবন ও জীবিকার কঠিন সংগ্রামের ইতিবৃত্ত সেভাবে আলোচিত নয়।যেকোনো যুগের কিংবা ভূখন্ডের ইতিহাসের প্রচলিত ধারাবাহিক লিখিত বিবরণের বাইরেও অনেক বিখন্ড উপাদানকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকু রবলেছেলেন-‘ইতিহাসচূর্ণ’, যা সাধারণত আমাদের নজরে পড়েনা। বড়-বড় ঘটনার নীচে চাপা পড়া এসব খন্ডিত ও পার্শ্বকাহিনি ইতিহাসের প্রাতিষ্ঠানিক চর্চায় কমই ধরা পড়ে বেশির ভাগ সময়। কিন্তু এরকম অনেক ঘটনাবা কাহিনি থেকে অতীতের সমাজ ও সংস্কৃতির এক ভিন্ন রকম চালচিত্র উদ্ধার করা সম্ভব বইকি।সেরকম এক প্রচেষ্টারই অনন্য অসাধারণ নিদর্শন আদনান সৈয়দের লেখা-“শিপ  জাম্পার:বাঙালির আমেরিকা যাত্রা”গ্রন্থটি।

লেখক এই গ্রন্থের সূচনা অধ্যায়ে জানিয়েছেন শিপজাম্পারের সংজ্ঞা।সুদীর্ঘযাত্রায় পরিশ্রান্ত জাহাজের শ্রমিকেরা আমেরিকা বা বিলাতের কোনো বন্দর স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গেই জাহাজের সব কর্মচারীকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্দরে নামার জন্য ক্যাপ্টেনের অনুমতিপত্র বা শোর পাস( Shore Pass) দেওয়া হতো। শিপজাম্পারা তা নিয়ে পালিয়ে আমেরিকার বাল্টিমোর, বোস্টন,নিউইয়র্ক বা কোনো বন্দরে নেমে পড়তেন এবং গোপনে গা ঢাকা দিতেন। জাহাজ থেকে জাহাজকর্মীদের বন্দরে নেমে পড়ে গোপনে গা ঢাকা দেওয়াকেই শিপ-জাম্পিংবলে।বন্দরের আইনপ্রয়োগকারী সংস্হার চোখে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে বেড়ানো জাহাজের খালাসিদের স্হানীয় ভাষায় বলা হতে ”শিপজাম্পার”(পৃষ্টা১৭,১৮)

যুক্তরাষ্ট্রের সেনসাস ব্যুরোতে রাখা নথিপত্রে উল্লেখ রয়েছে ১৭৮৫ সালের শুরুর দিকে তৎকালীন পূর্ববাংলা অঙ্চলের কিছু লোক আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছিলেন উন্নত জীবনের আশায়। তাঁরাই মূলত শিপজাম্পার।ভারত তখন ইংল্যান্ডের অধীনে। তৎকালীন সময়ে ব্রিটিশদের কড়া নজর এড়িয়ে মোট বারোজন বাঙালি আমেরিকায় এসেছিলেন। পরে বারোজন বাঙালির ভাগ্যে কী জুটেছিল সে সম্পর্কে বিশদভাবে জানার সুযোগ ঘটেনি। তবে এতটুকু জানাগেছে,বেনিয়ামিন ফ্রান্কলিন নামে এক আমেরিকান ব্যবসায়ী ১২ জন বাঙালি নাবিককে পেনসিলভানিয়ার নিউহ্যাভেন পোর্ট থেকে উদ্ধার করে পেনসিলভানিয়ার সুপ্রিমকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন (পৃষ্টা৪৪)।

শিপ জাম্পারদের জাহাজ থেকে নেমে বন্দরের ইমিগ্রেশনের চোখ ফাঁকি দিয়ে লুকিয়ে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাটি পড়ামাত্রই মনে পড়ে যায় বহুদিন আগে পড়া প্রখ্যাত রম্যলেখক সৈয়দমুজতবাআলীর’ নোনাজল’গল্পটির কথা। গল্পটিতে একজন বাঙালি জাহাজের খালাসি থেকে কীভাবে আমেরিকায় স্হায়ী হয়েছিলেন,সেই ইতিহাসের অসাধারণ এক চিত্রায়ন ঘটেছে।জাহাজ থেকে তীরে পৌঁছানোর ঘটনা উঠে এসেছে এভাবে, ”আমাকে সাহায্য করতে হলো শুধু একটা পেতলের ডেকচি জোগাড় করে দিয়ে। সন্ধ্যার অন্ধকারে সমীরুদ্দী সাঁতারের জাঙিয়া পরে নামল জাহাজের উল্টোধার দিয়ে, খোলা সমুদ্রের দিকে।ডেকচির ভেতরে তার জুতো,মোজা আর একখানা তোয়ালে। বুক দিয়ে সেই ডেকচি ঠেলে ঠেলে বেশ খানিকটা চক্কর দিয়ে সে প্রায় আধামাইল দূরে গিয়ে উঠবে ডাঙায়।পাড়ে উঠে,তোয়ালে দিয়ে গা মুছে, জাঙিয়া ডেকচি জলে ডুবিয়ে দিয়ে শিস দিতে দিতে চলে যাবে শহরের ভিতরে। সেখানে আমাদেরই এক সিলেটি ভাইকে সে খবর দিয়ে রেখেছিল হামবুর থেকে। পুলিশের খোঁজাখুজি শেষ না হাওয়া পর্যন্ত সে গা ঢাকা দিয়ে থাকবে কয়েকদিন, তারপর দাড়ি-গোঁফ কমিয়ে চলে যাবে নুউক থেকে বুগুর, যেখানে সিলেটিরা কাঁচাপয়সা কামায়।পালিয়ে ডাঙায় উঠতে গিয়ে পুলিশের হাতেধরা পড়ার যেকোনো ভয় ছিল না তা নয়,কিন্তু একবার স্যুটটি পরে রাস্তায় নামতে পারলে পুশিল দেখলেও ভাববে সে নুউক বাসিন্দা, সমুদ্রপাড়ে এসেছিল হাওয়া খেতে”।

মূলত ”শিপ জাম্পার:বাঙালির আমেরিকাযাত্রা”-গ্রন্থটিতে পূর্ববাংলা তথা তৎকালীন ভারতবর্ষ থেকে আসা কিছু স্বপ্নচারী মানুষের আমেরিকায় অভিবাসী হওয়ার ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে।তাঁদের কঠিন জীবনযুদ্ধের ইতিহাসকে অসাধারণ গদ্যশৈলীর মুন্সিয়ানায় এই গ্রন্থের পাতায় তুলে আনার চেষ্টা করেছেন। আমার জানাছিল বিশ্বপর্যটক ইবনে বতুতার দু:সাহসিক ভ্রমণের কাহীনি,জানা ছিল ভাস্কোদাগামা অথবা কলম্বাসের আমেরিকা আবিস্কারের কাহিনি। কিন্তু শিপজাম্পরের সম্পর্কে আগে কখনো জানাছিলনা।গ্রন্থটি পড়তে গিয়ে প্রতিটি ছত্রে ছত্রে দেখা পাওয়া যায় শিপজাম্পারদের সম্পর্কে অজানা অসংখ্য শিহরণ জাগানো তথ্যের। তাই গ্রন্থটি পড়তে পড়তে অনবদ্য মুগ্ধতায় এবং একঘোর লাগা ভালোবাসায় ডুবে যায়।প্রতিটি মুহূর্তে পাওয়া যায় ইতিহাসের বাঁক বদলের টান টান উত্তেজনাকর তথ্য। এক বসাতেই পড়া শেষ না করে উঠতে পারিনি।মানবজাতির একভূখন্ড থেকে অন্য ভূখন্ডে এবংএক দ্বীপ থেকে অন্যদ্বীপে স্হানান্তরের ইতিহাস হাজার বছরের পুরানো। এই স্হানান্তর মূলত হয়েছে আর্থিক অবস্হার পরিবর্তন, উন্নত জীবন ও জীবিকা,  ধর্মীয় হানাহানি, ভিনদেশে উন্নত পরিবেশে স্হায়ীভাবে বসবাস অথবা রাষ্ট্রকতৃক নিপীড়ন, নির্যাতন ও শোষণ অথবা যুদ্ধবিগ্রহের কারণে।এসব স্হানান্তরের দু:সাহসিক ইতিহাস শিল্পসাহিত্যে উঠে এসেছে অবলীলায়, সেই ড্যনিয়াল ডিপোর রবিনসন ক্রুশোর মতো হোক বা হাওয়ার্ড পাইলের দস্যু রবিনহুডের মতো হোক অথবা মার্ক টোইনের হাঁকল বেরিফিনের মতো হোক।

 ২১৪ পৃষ্টার ’শিপ জাম্পার:বাঙালির আমেরিকাযাত্রা’ গ্রন্থে লেখক দুঃসাহসিক বাঙালি অভিবাসীর কৌতূহললোদ্দীপক, বিস্ময়কর ইতিহাস তুলে আনার চেষ্টা করেছেন পানকৌড়ির মতো।কীভাবে তাঁরা জাহাজ থেকে পালিয়ে আমেরিকায় এসেছিলেন সেই তথ্যতো আছেই,  সঙ্গে জানা যায় আমেরিকায় তাঁদের জীবন কেমন ছিল? শিপ জাম্পররা যে স্বপ্ন নিয়ে আমেরিকায় এসেছিলেন সেই স্বপ্নইবা কতটুকু পূরণ হয়েছিল তার আদ্যোপান্ত খোঁজা হয়েছে এই গ্রন্থটিতে। লেখক ভূমিকাতে জানিয়েছেন-শিপ জাম্পারদের ইতিহাস খুঁজে পাওয়া এত সহজ ছিলনা।তাদের জীবনকথা সেভাবে কোথাও লিপিবদ্ধ নেই। তারপরও তিনি ২০১৩ সালে প্রকাশিত এমআইটির বিখ্যাত গবেষক ও অধ্যাপক ভিভেক বাল্ডের লেখা গবেষণাগ্রন্থ “বেঙ্গলিহারলেম অ্যান্ড দ্যল্স্ট হিস্টোরিস অব সাউথ এশিয়ান আমেরিকান”-কে তথ্য সহায়ক হিসেবে এ গ্রন্থলেখাতে অনেকখানি নির্ভর করেছেন এবং বাঙালি শিপ জাম্পারদের খোঁজে নিজেই প্রায় সময়ই এই গ্রন্থের প্রকাশক বিশ্বজিত সাহার ব্রুকলিনের চার্চম্যাগডোনাল্ড অ্যাভিনিউতে গিয়েছেন এবং স্হানীয় কিছু মানুষের সহায়তায় কিছু শিপ জাম্পারদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। যা ছিল সত্যি শ্রমসাধ্য,কঠিন ও দুরূহ কাজ।

ভূমিকা ও সূচনা ছাড়া মোট আটটি অধ্যায়ের সমাহারে ’শিপ জাম্পার:বাঙালির আমেরিকাযাত্রা’ গ্রন্থটি রচিত হয়েছে। বাঙালি শিপ জাম্পাররা হুগলি ও কলকাতা বন্দর দিয়ে জাহাজে খালাসির চাকুরি নিয়ে ইংল্যান্ড বা বিলেতের বন্দর হয়ে আমেরিকার এলিস আইল্যান্ড বা বাল্টিমোর বন্দর দিয়ে শিপ থেকে শোর পাস নিয়ে লুকিয়ে পালিয়ে যেতো।তারা ছিল মূলত পূর্ববাঙালা তথা বাংলাদেশের সিলেট, নোয়াখালী, সন্দ্বীপ এবং চট্টগ্রামে অঙ্চলের বাসিন্দা।
শিপ জাম্পারদের স্বপ্ন আর বাস্তবতার মধ্যে দেয়াল হয়ে দাঁড়াত আইন। বৈধ কাগজপত্র না থাকলে স্হায়ীভাবে বসবাস করার আইনগত কোনো ভিত্তি ছিল না।বৈধকাগজপত্র এবং ইমিগ্রেশনের কঠোর আইনের কারণে তারা স্হানীয় কোনো আমেরিকান (আফ্রিকান, আমেরিকান অথবা পুয়ের্তোরিকান) নারীকে চুক্তিতে বিয়ে করে আমেরিকায় স্হায়ীভাবে থাকার জন্য বৈধ কাগজপত্র বানাতেন।

এ গ্রন্থের বর্ণনায় সাবলীল্ভাবে উঠে এসেছে শিপ জাম্পারদের জাহাজের খালাসির চাকুরি নিয়ে স্বপ্নের আমারিকায় পৌঁছানোর জন্য জাহাজের বয়লায় রুমে ৬০০ ডিগ্রী ফারেনহাইট তাপমাত্রায় নির্মম ও নিষ্টুর কাজের মর্মস্পশী ইতিবৃত্ত। জাহাজ শ্রমিকদের নির্মম কষ্টকর দিনকাল, জাহাজ থেকে পলায়ন, শিপ জাম্পারদের প্রবল শক্তিশালী নেটওয়ার্কের বৃত্তান্ত, বিখ্যাত লেকাওয়ানা ইস্পাত কারখানায় বাঙালি শ্রমিকের কাজও তাতে নির্মম বঙ্চনার শিকার ইত্যাদির ইতিহাস এবং আমরা এই গ্রন্থপাঠে জানতে পারি বা ঙালি শিপ জাম্পাদের জীবন ছিল প্রতিকূলতায় ভরা।অনেকটাই যাযাবরের মতো। একদিকে আমারিকায় বর্ণবাদএবং ইমিগ্রেশনের কঠিন কাঁটাতারের বেড়া, অন্যদিকে অনাগত জীবনের আশাপূরণের স্বপ্নের হাতছানি। জাহাজের শ্রমিক হিসেবে কাজে যোগ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাঙালি খালাসিদের কঠোর শারিরীক কাজ করতে হতো। জানা যায় ব্রিটিশ জাহাজগুলোতে সপ্তাহে ৮০ ঘন্টার মতো তাদের কাজ করতে হতো।এই হাড়ভাঙ্গা খাটুনির বিনিময়ে তারা যে পারিশ্রমিক পেতেন, তাতে ভবিষ্যৎ সঙ্চয়  তো দূরের কথা,দেশে ফেলে আসা দরিদ্র সংসারেও কিছু পাঠাতে পারতেন না।যেহেতু সবার মূললক্ষ্য ছিল আমারিকাবা বিলেত যাওয়া এবং সেখানে থিতু হওয়া,তাই তারা কঠিন পরিশ্রমকে মেনে নিতেন। শিপ জাম্পারদের জীবনের করুণ দৃশ্যগুলো পড়ে যেকোন পাঠক বেদনার্ত হবেন।শুধু তাই নয় লেখক তথ্য উপাত্ত দিয়েছেন যে,  ১৯৩০ সালে পলাতক এসব জাহাজ শ্রমিক জীবিকার তাগিদে মিশিগান অঙ্গরাজ্যের ডেট্রয়েট শহরে ফোর্ড গাড়ি কারখানায় কীভাবে শ্রমিকের চাকুরি করেছেন এবং মানেবতর জীবনযাপন করেছেন! তাদের মধ্য থেকে কয়েকজন সম্পর্কে লেখক বিস্তারিত বর্ণনাও দিয়েছেন এ গ্রন্থে।লেখার কলেবর বৃদ্ধিজনিত কারণে, পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি হতে পারে বিধায় আর সবিস্তার বর্ণনা করা হলোনা। যে বিষয়টির উল্লেখ না করলেই নয়, এই গ্রন্থে অসাধারণ একটি সংযোজন, সপ্তম অধ্যায়ে প্রাক্তন কিছু জীবিত শিপ জাম্পারের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন লেখক নিজেই।যেখানে রয়েছেন সন্দ্বীপের কলম্বাসখ্যাত আবদুল হাদি, পিতা হাবিবউল্লাহের স্মৃতি পুত্র আলাদিনের স্মরণ, শিপ জাম্পার মোহাম্মদ আনোয়ার, প্রবীণ শিপজাম্পার আবুলহোসেন ও রাধিকা জলদাস প্রমুখ।

সর্বশেষ অষ্টম অধ্যায়ে লেখক বিস্তারিত তুলে ধরেছেন, আমেরিকায় শিপ জাম্পারদের সামাজিক অবস্হান,সামাজিক অবহেলার চিত্র, কন্ট্রাক্ট বিয়ের সমস্যা ইত্যাদির হতাশাজনক চিত্রএবংতুলে ধরেছে বাঙালি শিপ জাম্পারদের পরবর্তী প্রজন্মের আলেকিত ও গর্বের কিছু বিখ্যাত ব্যক্তি সম্পর্কে, যারা আজ নিজ নিজ জায়গাতে প্রতিষ্ঠিত ও স্বনামধন্য তাদের, মধ্যে আছেন যেমন- মিসিগানের সিনেটর হেনসেন হাশিম ক্লার্ক, বিখ্যাত কবি সোনিয়া কাদির ও নিউইয়র্ক সিটি কাউন্সিল মেম্বারের পরিচালক শাহানা হানিফ প্রমুখ।

আজ থেকে দেড়শ বছর আগে এভাবেই কিছু স্বপ্নচাষী পূর্ববাঙালার বাঙালি জাহাজের খালাসি হয়ে কঠিন জীবনযুদ্ধের মুখোমুখি হয়ে দেশান্তরি হয়েছিলেন এবং আমেরিকায় তাদের বসত গড়েছিলেন। তাদের রেখে যাওয়া পদচিহ্ন অনুসরণ করে আমরা আমাদের অস্তিত্বের ইতিহাস নির্মাণ করি।আদনান সৈয়দের দীর্ঘদিনের কঠোর পরিশ্রম সাপেক্ষ এবং গবেষণালব্ধ এইগ্রন্থ,” শিপ জাম্পার: বাঙালির আমেরিকাযাত্রা” পড়ে আমি সত্যিই অভিভূত।

গ্রন্থটির অন্যতম আকর্ষণ এতে মুদ্রিত অসাধারণ সব ছবি। তার বেশ কয়েকটি যেমন লেখক তুলেছেন শিপ জাম্পারদের সাথে, তেমনি কিছু ছবি সহায়ক গ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে।প্রতিটি তথ্যের সাথে বিশ্বস্তার জন্য সেই সময়ের ছাপানো পত্রিকার কাটিং-এর সংযোজন গ্রন্থটিকে আরো অসামান্য করে তুলেছে। ইদানিং ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে নীরস বিষয় হিসেবে গণ্য হয়।কিন্তু ইতিহাসও যে লেখার গুণে দারুণ প্রান্জল ও সজীব হয়ে উঠতে পারে তাঁর উপযুক্ত প্রমাণ এই গ্রন্থটি।

গ্রন্থটিতে লেখক একাধিক মান্যসূত্র ঘেঁটেই কঠোর শ্রমের মাধ্যমে সব দলিল, সহায়কগ্রন্থ একত্র করে প্রতিটি অধ্যায় লিখেছেন, তা গ্রন্থটি পাঠ করলেই বোঝা যায়।প্রতিটি অধ্যায়ে নিজের নির্মোহ পর্যবেক্ষণ হাজির করেছেন। নিমগ্ন সমঝদার পাঠকেরা এই গ্রন্থ থেকে শিপ জাম্পারদের অতীত ইতিহাস সম্পর্কে অনেক অজানা উপাদান খুঁজে পাবেন।এটি ইতিহাসের আকরগ্রন্থ হিসেবে পরিগণিত হবে, তা বলা যায়। গ্রন্থটির শেষে ‘সহায়কগ্রন্থপঞ্জির তালিকা ও ওয়েবলিংক এবং নির্বাচিত নির্ঘন্ট’ সংযোজন পাঠককে তথ্যের প্রাপ্যতা সম্পর্কে বেশ সহায়তা করেছে।আদনান সৈয়দের ইতিহাস বর্ণনাশৈলী সুনিপুণ, ঝরঝরে এবং মেদহীন। যেকোনো পাঠক গ্রন্থটি পাঠ করতে বসলেই টের পেতে বাধ্য হবেন লেখকের ইতিহাস সন্ধানী দৃষ্টির গভীরতা কতখানি।তাই এই গ্রন্থটি পাঠ শেষে যেকোন পাঠক মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হতে বাধ্য।

লেখক আদনান সৈয়দ দীর্ঘ সময় ধরে বসবাস করছেন সুদূর আমেরিকাতে। তিনি একজন প্রথিতযশা, স্বনামধন্য কথাসাহিত্যিক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক,উপন্যাসিক, সংগঠক, কবি এবং আমার অত্যন্ত প্রিয় একজন লেখক। ইংরেজী ভাষাপ্রধান পরিবেশে বসবাস করেও তিনি নিরলস বাংলাভাষা ও সাহিত্যে তাঁর সৃষ্টিশীল অবদান রেখে যাচ্ছেন, তার জন্য তাঁকে কুর্ণিশ জানাতেই হয়।
তবে গ্রন্থটি পড়তে গিয়ে কিছু কিছু জায়গাতে মুদ্রণ প্রমাদ বেশ লক্ষণীয়, যা সাবলীল পাঠপক্রিয়াকে ব্যহত করেছে। ভবিষতে সে দিকটায় নজর দেবেন বলে আশা রাখি। মুক্তধারা কতৃক প্রকাশিত, সব্যসাচী হাজরার চমৎকার ও দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদটি পাঠককে মোহিত করবে এবং বলা যায় বেশ সুসম্পাদিত গ্রন্থ।উন্নতমানের বাঁধাইও উন্নতমানের অপসেট পেপারে ছাপার কারণে গ্রন্থটির আকর্ষণ বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সুখপাঠ্য এই গ্রন্থটির বহুল প্রচার ও পাঠকপ্রিয়তা কামনা করছি।

শিপ জাম্পার: বাঙালির আমেরিকাযাত্রা
লেখক: আদনান সৈয়দ।
প্রকাশকাল: অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ ২০২০
প্রচ্ছদ: সব্যসাচী হাজরা
প্রকাশক: মুক্তধারা, নিউইয়র্ক।
দাম: ৪২০টাকা।
লেখক: প্রবন্ধিক ও কলামিস্ট।

======================