You are currently viewing অনন্ত গোধূলির ছায়া >  রিমি রুম্মান

অনন্ত গোধূলির ছায়া > রিমি রুম্মান

অনন্ত গোধূলির ছায়া 

রিমি রুম্মান

সূর্যাস্তকে আমার সবসময় কেনো যেন বেদনাময় প্রস্থান মনে হয়। আর তা যদি হয় জলের নিকটে, তবে ব্যথাভার আরো প্রকট হয়ে ওঠে। এখন, এই মুহূর্তে ঠিক তা অনুভূত হচ্ছে। নদীতীরে অবস্থিত নিউইয়র্কের এই রেস্তোরাঁয় সূর্যাস্তের সময় ব্যপক জনসমাগম হয়। রাতের খাবার খেতে খেতে সূর্যের অস্ত যাওয়া, প্রকৃতির রঙ বদলের দৃশ্য চিরকালই আমায় অভিভূত করে। এই পশ্চিমের দেশে গ্রীষ্মকালে এক অদ্ভুত ব্যপার! সূর্য ডোবে ঘড়ির কাঁটা আটটা পেরোলে। কিন্তু তাই বলে স্বাস্থ্য সচেতন নাগরিকগণ রাত নামার জন্যে অপেক্ষা করবে কেনো? ছয়টা/সাতটা নাগাদ তাদের ডিনার শেষ করা চাই। রেস্তোরাঁটির বেশীরভাগ খদ্দের প্রবীণ। কাছেই কয়েকটি সিনিয়র সিটিজেন এপার্টমেন্ট। যাকে আমরা বলি বৃদ্ধনিবাস। এটিও একটি কারণ হতে পারে। জীবনের পড়ন্তবেলা ওরা বেশ উপভোগে অতিবাহিত করে। বেশভূষায় আভিজাত্যের ছাপ রেখে চলে।  

 

দক্ষিণের কোণের দিকের টেবিলে হাত নেড়ে গল্পে মশগুল বুড়োবুড়ির বয়স কত হবে? অনুমান ভুল না হলে আশির অধিক তো হবেই। শরীরের চামড়া কুঁচকে গিয়েছে। গঠনও অনেকটা পশ্চিমাকাশে হেলে পড়া সূর্যের মতো। কুঁজো হয়ে গিয়েছে। কিন্তু বুড়ির দুহাতের আঙুলের নখে লাল টুকটুকে নেইল পোলিশ। ঠোঁটে ম্যাচিং লিপস্টিক। চুল স্বর্ণকেশী। অনেকটা হলিউড অভিনেত্রী মেরিলিন মনরো মতো করে ঘাড় অব্দি ছাঁটা। এদেশের এই বিষয়টি আমার বেশ লাগে। বয়স বেড়েছে মানেই মৃত্যুচিন্তায় কাতর হতে হবে, শুয়েবসে অতীতস্মৃতি রোমন্থন করে দিনাতিপাত করতে হবে, এমন ভাবনা তাদের তাড়িত করে না। বরং পেছনে ফেলে আসা সময়ের অনেক নাপাওয়া তারা জীবনের বেলাশেষের এই সময়টায় পূর্ণ করে নেয়। ক্যারাভ্যান নিয়ে নির্ভার ঘুরে বেড়ায় এক স্থান থেকে অন্যস্থানে। সাগর, পাহাড়, সবুজের নিকটে, কিংবা সমতলে প্রকৃতির সান্নিধ্যে নিশ্চিন্ত এক জীবন। নিয়ম করে পার্লারে যায়। ম্যানিকিওর, প্যাডিকিওর করে হাতপায়ের যত্ন নেয়। ডিনারের সময়টায় বিকেলের ঘ্রাণ নিতে নিতে নিকটস্থ নদীর নীল জলরাশির সান্নিধ্যে কাটিয়ে দেয় রাত্রি ঘনাবার আগ অব্দি। তারা নিচু লয়ে পরস্পরের সঙ্গে কথা বলে। কী এত বলে, কে জানে! শুনেছি বয়স বাড়লে মানুষ দূর অতীতে ফিরে যায়। নয়ত জাগতিক সকল কিছুর সঙ্গে অভিমান বাড়ে। নইলে নীলার সঙ্গে এই যে এতবার বাইরে রাতের খাবার খেয়েছি, কই আমাদের তো এত কথা থাকে না। সংসারের প্রয়োজনীয় কথা, অফিসের ব্যস্ততা ম্যানেজ করে সন্তানের স্কুলের প্যারেন্টটিচার কনফারেন্সে এবার কে যাবো, কার অফিসের কাজের চাপ তুলনামূলক কম, সেইসব হিসেবনিকেশ করে রোজকার রুটিন ঠিক করাএইতো!  

 

নীলা, আমার স্ত্রী। এই উইকএন্ডে ছেলেকে নিয়ে নিউজার্সি বেড়াতে গিয়েছে ভাইয়ের বাসায়। আমার উইকএন্ডে কাজ পড়ে যাওয়ায় যাওয়া হলো না। এমন পরিস্থিতিতে এখানেই রাতের খাবার সেরে নেই মাঝে মাঝে।সাং হিংনামের রেস্তোরাঁটির খাবারের চেয়েও অবস্থান আমাকে মুগ্ধ করে বেশি। নিকটস্থ পাহাড়ের মৌনতা, সবুজ প্রকৃতি, পাখির কলতান, জলের বিরামহীন কলকল শব্দ, শুধু আমি নই, যে কাউকে মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন করবে, নিশ্চিত। একদিকে বড় বড় পাইন, ওক গাছের সারি। মাঝে ছায়াচ্ছন্ন পথ। অন্যদিকে এই নদী। আমার মুখোমুখি ওপাশের টেবিলে চায়নিজ রমণী চোখ পিটপিট করে ডানেবাঁয়ে কাউকে খুঁজছে বোধ করি। পাশেই জলের উপর যখন একদল রাজহাঁস ক্ষণস্থায়ী পথরেখা ফেলে উত্তর থেকে দক্ষিণে এগিয়ে যাচ্ছিল, সেই মিলিয়ে যাওয়া জলের পথরেখার দিকে তাকিয়ে আচমকা মনটা প্রদীপের নিভু নিভু আলোর মতোন ম্লান হয়ে উঠল। কেউ যেন কানের কাছে ফিসফিস করে বলে গেল, গাঁয়ের দীঘির পারে বসে কী করছো হে? আমি জলের দিক থেকে মুখ তুলে পড়ন্ত সূর্যের বদলে যাওয়া আগুণ রঙ এর দিকে তাকিয়ে ছোট্ট শ্বাস নেই। দেশ ছেড়ে এসেছি দুই যুগ আগে। এতদিনে বিদেশি খাবার, পোশাক, ভাষা সবকিছুতেই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। তবুও সেই অজোপাড়াগাঁয়ের কথা সময়ে অসময়ে মনে পড়লে মনের তৃষিত জমিন বৃষ্টিধারার মতো আর্দ্র হয়ে ওঠে। কাঁটাচামচ দিয়ে স্যামন ফিসের টুকরো মুখে পুরতে গিয়ে বহুবছর বাদে চাচীর কথা মনে পড়ে যায়। মাছ খেতে রাজ্যের অনীহা ছিল আমার। কাঁটা বেছে খেতে শিখিয়েছিলেন তিনিই। আমার চাচী আম্মা।  

 

গভীর আত্নমর্যাদাবোধ সম্পন্ন এক মানুষ। তখন আমার বয়স ছয় কী সাত। পাঁচ ভাইবোনের সকলের ছোট। স্কুল মাস্টার বাবা কী মনে করে নাম রেখেছিলেন সমাপ্ত সোহরাব। বাবা বোধ হয় একরকম সিদ্ধান্তই নিয়ে নিয়েছিলেন, আমিই তার শেষ সন্তান। নইলে সমাপ্তিরেখা টেনে দেয়ার মতো করে আমার নামইবা রাখবেন কেনোসমাপ্ত‘? ভাগ্যিস বাবা বাংলার শিক্ষক ছিলেন, তাই নামটি অন্তত আধুনিক রেখেছেন। কিন্তু আর দশটা পরিবারে ছোটর কদর আদর যত বেশি থাকে, আমার ক্ষেত্রে তেমনটি ছিল না। অনেকগুলো ভাইবোন হওয়ায় আমার দিকে মনঃসংযোগ দেয়া সম্ভবপর হতো না হয়ত। অভাবঅনটন তো ছিলই। ভালোমন্দ রান্না হলে পেট ভরে তৃপ্তি নিয়ে খাওয়ার উপায় ছিল না। মাটির মেঝেতে পাটি বিছিয়ে পাঁচ ভাইবোনকে বসতে হতো বয়সের ক্রমানুসারে। মা পাতে খাবার তুলে দিতেনও ক্রমানুসারে। যে ছোট, তাকে পরিমানে অল্প, ক্রমশ একটু একটু করে পরিমান বাড়াতেন যে বড়, তার পাতে। কারোরই ভরপেট খাওয়া হতো না। মা বলতেন

খাইতে হয় পরিমিত। এখনই বেশি খায়া ফেললে সারাজীবন কম খাইতে হইব। তারচে এখন কম খাও, তাইলে বড় হইলে বেশি খাইতে পারবা, বুঝছো বাজান

 

আমাদের গ্রামে ছয়টি ঘর ছিল বৃত্তাকারে। দাদার পূর্বপুরুষের আমলে তৈরি। মাঝখানে অনেকটা জায়গা জুড়ে উঠান। উঠানে ধান শুকাতে দেয়া হতো। ছয়টি ঘরে বাবার ছয় ভাইয়ের পরিবার। আমাদের ঘরের উত্তরপূর্ব কোণায় বড় চাচার ঘর। তাদের কোনো সন্তানাদি ছিল না। নিঃসন্তান। কিন্তু বিষয়টি এমন ছিল যে, এই সন্তান না হওয়াটা একটা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। চাচী আম্মা আমাদের ছোট ছোট চাচাত ভাইবোনদের কী ভীষণ মমতায় আগলে রাখতেন! সন্তানহীন হওয়ায় কিনা জানিনা, সন্তানের জন্যে বরাদ্দকৃত সকল মাতৃমমতা ঢেলে দিতেন আমাদের সকলের মাঝে। তাঁর আদর, স্নেহের তীব্রতায় আমার প্রায়শই দৃঢ়ভাবে ভাবতে ভালো বোধ হতো যে, তিনিই আমার আম্মা। এতদসত্ত্বেও আমার মা বা অন্য চাচীরা আমাদের বড়চাচীঅন্তঃপ্রাণ বিষয়টি সুনজরে দেখতেন না। কী জানি, পাছে আবার আমাদের অমঙ্গল হয় বাঁজা মানুষের সংস্পর্শে!   

 

সেদিন ছিল মাথার উপর বসন্ত শুরুর মুগ্ধ আকাশ। বাড়ির পেছনের ঝোপ থেকে নেশা জাগানিয়া বুনো ফুলের মিষ্টি সুবাস ভেসে আসছিল। আর চাচী আম্মার ঘর থেকে ভেসে আসছিল পোলাওয়ের লোভনীয় সুঘ্রাণ। দুপুরের গাঢ় নির্জনতায় পা টিপে টিপে বড় চাচার ঘর আর রান্নাঘরের মাঝের ছোট্ট উঠানে গিয়ে দাঁড়াই। চাচী আম্মা সবে রান্না শেষে হাড়ি নিয়ে ঘরের দিকে যাচ্ছিলেন। রাঁধাচূড়া রঙের হলদে ছাপার সুতি কাপড় পরা চাচী আম্মার মুখে হলদেটে আভা ছড়িয়ে পড়েছে। আমায় দেখে থামলেন। হাড়িটি ঘরে রেখে কাছে এলেন। একটু ঝুঁকে আমার মুখের সমান্তরালে মুখ নামিয়ে বললেন

আমার আব্বা, কিছু বলবেন

আমি ডানেবাঁয়ে না সূচক মাথা নাড়ি। তিনি গভীর মমতায় আমার ছোট্ট হাতটি ধরে ঘরের ভেতরে নিয়ে গেলেন। যাবার আগে ঘাড় ঘুরিয়ে চারপাশটা দেখে নিলেন সচেতনভাবে। মাতৃসম এই মানুষটি কেনো যে আমায় আপনি করে বলতেন, সেই ব্যাখ্যা কোনোদিন জানতে চাইনি। শুধু জানি, আমার প্রতি তাঁর ভালোবাসা অসীম, অব্যক্ত। মেঝেতে মাদুর পেতে বসতে বললেন। প্লেট বাড়িয়ে দিলেন। পোলাও, মুরগির রোস্ট, সেদ্ধ ডিমের কোর্মা। আমি গপাগপ খেলাম। পেট ভরে তৃপ্তি সহকারে খেলাম। চাচী আম্মা আঁচলে মুখ মুছিয়ে নিচু স্বরে বললেন

আব্বা, এইখানে যে খাইছেন, কাউরে বইল্যেন না। 

চাচী আম্মার মায়াবী মুখে ব্যথাকাতর দৃষ্টি। এই মানুষটার হৃদয়ভরা শুধুই অর্থহীন ভালোবাসা। চাচী আম্মার ঘরে আমার সেদিনই প্রথম খাওয়া হয়েছে তা তো নয়। জন্মাবধি তাঁকে এমনই দেখেছি। সুযোগ পেলেই বিস্কিট, চানাচুর, আম, কাঁঠাল যখন যা থাকে তিনি খুব যত্নে খাওয়াতেন। তবে ভালোমন্দ রান্নার সুবাস ছড়িয়ে পড়লে বিড়ালের মতো পা টিপে টিপে এসে উপস্থিত হতাম। কেননা ঘরে তো পেটভরে এইসব বিলাসী খাবার খাওয়ার উপায় নেই। দুই ঈদে মা পোলাও রান্না করেন বটে। আমাদের ভাইবোনদের জন্যে এক চামচ করে পোলাও বরাদ্দ থাকে। খাওয়া শেষে দুই চামচ ভাত পাতে তুলে দিতেন। পেট তো ভরতে হবে অন্তত!  

 

দৃষ্টি প্রসারিত করে নদীর ওপারে তাকিয়ে আছি। আইস টি কাপে চুমুক দেই। অহেতুক চোখের পাতায় ঝুলে আছে সেইসব দিন। ঘাড় বেয়ে নেমে যাচ্ছে একরকম উষ্ণ আনন্দবিষাদের ঢেউ। রেস্তোরাঁর সুন্দরী কর্মীর রিনিঝিনি কণ্ঠে ভাবনায় ছেদ পড়ে। আমার আর কিছু লাগবে কিনা জিগ্যেস করে। ধন্যবাদ জানিয়ে হাতের ইশারায় না সূচক জবাব দেই। ভাবনাগুলো স্মৃতির আশপাশ দিয়ে যেতে যেতে তাল কেটে যায়। একঝাঁক পাখি জলের উপর ছায়া ফেলে উড়ে যায়। কোথায় যেন পড়েছিলাম পাখি নদীর নির্দিষ্ট কোনো দেশ নেই। তবে কি এই নদী, উড়ন্ত পাখি, আমার দেশ অব্দি যায়? নদীর পাশ দিয়ে এক কৃষ্ণাঙ্গ বিশালদেহী তরুণ হেঁটে গেলো দূরের সড়কের দিকে। যেন বড় বড় পদক্ষেপে হেঁটে যাওয়া ঘোড়া। কর্মভারে কুঁজো হয়ে গভীর মনোযোগে রেস্তোরাঁর পরিচ্ছন্নতার কাজ করে চলেছে মধ্যবয়েসী এক হিস্প্যানিক। শান্ত, স্থির। দেখে মনে হচ্ছে কোনোদিন কোনো আনন্দের ছায়া স্পর্শ করেনি তাকে। জীবন সম্পর্কে উদাসীন। হাজার হাজার মাইল আকাশপথ পাড়ি দিয়ে কোথা থেকে কোথায় এলাম! কতটা সময় চলে গেছে জীবন থেকে। চলে গেছে কত মানুষ। নদীর বিরামহীন বয়ে চলা স্রোতধারার সঙ্গে আমি আমার জীবনকে তুলনা করি। ভাবি, জীবন বুঝি গভীর এক রহস্যের জাল, যার আস্টেপিষ্টে জড়িয়ে আছে সুখদুঃখবেদনাবোধ। এর অর্থ বোঝার সাধ্য আমাদের পৃথিবীর মানুষের নেই।  

 

চাচী আম্মা একবার আমায় সঙ্গে নিয়ে পাশের গ্রামে গিয়েছিলেন। গ্রামটি হুজুরবাড়ি হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করেছে। যেতে যেতে পথের ধারের দোকান থেকে মুরালি কিনে দিয়েছিলেন। মচমচে মুরালি খেতে খেতে অনেকটা পথ হেঁটে আমরা হুজুরবাড়ি পৌঁছেছিলাম। সঙ্গে করে নিয়ে ফিরেছিলাম পানি পড়া আর তাবিজ। সন্তানের জন্যে চাচী আম্মার হাহাকার ছিল একজীবন। তবুও সেদিন ফেরার পথে পাইনের সূচালো পাতার মতো বিষণ্ণ স্বরে বলেছিলেন

আব্বা, আল্লাহ তাঁর যেই বান্দারে বেশি ভালোবাসেন, তারেই বোধ হয় বেশি কষ্ট দেন।

 

আমি তাঁর এই কথার সঙ্গে একমত পোষণ করতে পারতাম না। পছন্দের বান্দারে তো সুখেশান্তিতে রাখবার কথা। যে মানুষ কোনোদিন কারো অনিষ্ট করার কথা ভাবেন নাই, কারো মনঃকষ্টের কারণ হন নাই, সেই মানুষটির মনে কেনো এত হাহাকার? অনেকেই বড়চাচাকে বংশ রক্ষার্থে আবারো বিবাহ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। চাচী আম্মার প্রতি বড় চাচার ভালোবাসা এত তীব্র, তীক্ষ্ণ ছিল যে, তিনি সে পথে পা বাড়ানোর ভাবনা করেন নাই। বলতেন, ভাইবোনের সন্তানরা সকলে আমার সন্তান। চাচার এহেন মনোভাবে তাঁর প্রতি আমার ভেতরে একরকম দুর্বলতা সেই ছোট থেকে অনুভব করি। বুকের বাঁ পাশে নতজানু এক প্রার্থনারত বালকের কৃতজ্ঞতায় নত হয়ে থাকা টের পাই।  

 

গাঁয়ের স্কুলকলেজের গণ্ডি পার হয়ে যেদিন দূরের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই, সেদিনের কথা। যেন গতদিনের ঘটনা। তখন সন্ধ্যার মেঘময় আকাশ ছিল। যেটুকু আলো ছিল, বিলিন হয়ে কেবল অন্ধকার নেমে এসেছিল। আমি চাচার ঘরে গিয়ে দেখি চাচী আম্মা একমনে প্রার্থনারত।  জানি প্রার্থনায় দীর্ঘ সময় কাঁদবেন তিনি। স্রষ্টার কাছে আকুল হয়ে কাঁদবেন। অদম্য কান্না। আমি সামনের রুমে মাথা নুইয়ে বসে থাকলাম। মাটির মেঝেতে তখন সারি সারি পিঁপড়ার দল হেঁটে যাচ্ছিল নির্বিঘ্নে মাচার দিকে। পিঁপড়াদেরও কি সুখদুঃখ থাকে? নাকি সৃষ্টির সেরা জীব বলে মানুষই কেবল এইসব দুঃখকষ্টের অনুভূতি নিয়ে বেঁচে থাকে

– ‘ আব্বা, কখন আসছেন? কিছু কইবেন?’ 

চাচী আম্মার প্রশ্নে মুখ তুলে তাকাই। শাদা কাপড়, ফোলা দুই চোখ। সদ্য জন্মানো শিশুর মতো নিস্পাপ আর পবিত্র এক মুখ। পা ছুঁয়ে সালাম করে জানালাম, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাওয়ার কথা। একই সঙ্গে আনন্দ আর বেদনার ছাপ ছিল আমার অবয়বে। চাচী আম্মার চোখ এড়ায় নাই। আমার ভেতরটা পড়ে ফেললেন অনায়াসে। চোখেমুখে আনন্দের ধারা তাঁর। যেন মেঘলা অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশ থেকে কোনো কারণ ছাড়াই মেঘ সরে গেছে। আলোকিত হয়ে উঠেছে ধরণী। কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে আশ্বস্ত করে বলেন

আব্বা, চিন্তা কইরেন না, খরচের জন্যে তো আর লেখাপড়া থাইম্যা থাকবো না। আমি আছি না? আমার জমাইন্যা কিছু টাকা আছে। সমস্যা হইব না। 

আমার মাথার উপর থেকে ভারী এক পাথর নেমে গেল যেন। তিনি আলমিরা থেকে কিছু টাকা আমার পকেটে রেখে বললেন

যখন যা লাগবো, আমারে জানাইয়েন, আব্বা।

আমার ভেতরে কান্না দলা পাকিয়ে থাকে। বানের জলের মতো বেরিয়ে এলে মুশকিল হবে। মাথা নুইয়ে দুই পায়ে সালাম করে তড়িঘড়ি বাইরে বেরিয়ে আসি। দিঘীর পারে এসে অন্ধকারে বসে থাকি। হু হু করে কাঁদি। এতদিন বৃত্তির টাকায় বইখাতা কিনতে পেরেছি। ক্লাসে প্রথম হওয়ায় বিনা বেতনে অধ্যয়নের সুযোগ ছিল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় অব্দি যাওয়ার বিষয়টি ছিল আকাশ কুসুম কল্পনা। বড় দুই ভাই কলেজ পাশের পর লেখাপড়ায় ইতি টানতে হয়েছে। অবশ্য তাদের নিজেদেরও আগ্রহের কমতি ছিল। কিন্তু আমার সীমাহীন অনুরাগ, জেদ আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে সাহসী করে তুলেছিল। শহরে যাওয়াআসার ভাড়া, যাবতীয় খরচ চাচী আম্মা দিয়েছিলেন। বাবার আয়ে কোনোমতে খেয়েপরে বেঁচে থাকা যেত। লেখাপড়ার বাড়তি খরচের জোগান হতো না। রাত কতক্ষণ নাগাদ দীঘির পারে বসেছিলাম, তা আজ আর মনে নাই। শুধু মনে আছে, প্রবল আনন্দে জীবন নিয়ে অনেক বড় স্বপ্ন দেখে ফেলেছিলাম সে রাতে। আমাকে পড়া শেষ করতে হবে কৃতিত্বের সঙ্গে। অনেক বড় কিছু হতে হবে।   

 

মাবাবা, চাচাচাচীর অশ্রুজলে বিদায় পর্ব শেষে শহরের বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন এক জীবন শুরু হয়। মাস শেষে চিঠি লিখি। চাচী আম্মা কীভাবে টাকা ম্যনেজ করে সঠিক সময়ে পাঠাতেন, সে খবর নেইনি কোনোদিন। কৃতিত্বের সঙ্গে পড়া শেষ করে দেশের বাইরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়ার আবেদন করতে থাকি বিরামহীন। এক স্বপ্নবাজের দিকে স্রষ্টা বুঝি মুখ তুলে তাকালেন। কয়েক জায়গা থেকে আশানুরূপ সাড়া মেলে। পছন্দের শীর্ষে ছিল আমেরিকা। তাই এখানেই আসার সিদ্ধান্ত নেই। সকল আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। টিকেট, কেনাকাটা, কয়েকমাস চলার মতো ডলার, কোথায় পাবো এত অর্থ?   

 

তখন কার্তিক মাস। হালকা শীতের আমেজ। চারিদিকে পাকা আমন ধান কাটার ধুম। গেরস্থের ঘরে ঘরে ধান মাড়াই ঝাড়াইয়ের ব্যস্ততা। গভীর রাত অব্দি বাবাচাচারা উঠানে ব্যস্ত। খেজুর গাছের রস নামানোর প্রস্তুতি চলছিল। রস জ্বাল দেওয়া, রাত জেগে পাকের ঘরে পিঠা বানানোর ধুম মাচাচীদের। সে এক উৎসবের আমেজ সারা গাঁয়ে। কিন্তু ঘরের ভেতরে তীব্র মন খারাপের সময় কাটে আমার। এত টাকা কোথা থেকে, কেমন করে ম্যনেজ হবে ভেবে কুল কিনারা করতে পারছিলাম না। বড় চাচী ডেকে পাঠান এক মধ্যদুপুরে। বলা চলে অনেকটা অনিচ্ছা সত্ত্বে গিয়েছিলাম। মুখভর্তি খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। চেহারার বেহাল দশা। চাচী আম্মা কাছে এগিয়ে এসে বলেন

– ‘ আব্বা, বাড়িতে আসছেন দুই সপ্তাহ হইয়া গেল। আপনারে দেখি নাই। ওইদিন গিয়া দেখি অসময়ে শুইয়া আছেন। মনটা কি খারাপ?’ 

আমি চোখ তুলে তাকাই। সেকী! চাচীকে এমন রোগা লাগছে কেনো? আগের মতো পরিপাটি ভাব নেই। হাতে, কানে, গলায় সোনার অলংকার শোভা পাওয়া মানুষটিকে আজ বড় বেমানান লাগছে অলংকারহীন। নিজের হতাশার কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে বললাম

– ‘ চাচী আম্মা, আপনের শরীর ঠিক আছে তো?’  

চাচী কিছু বলার আগেই বড় চাচা ভেতরের রুম থেকে বেরিয়ে এলেন। বললেন

– ‘ বাবা সমাপ্ত, তোর চাচীর শরীরটা বেশি ভালো না রে। শহরে নিয়া ডাক্তার দেখামু একবার। কিন্তু তোর চাচীরে রাজি করানো যাইতেছে না। কয়, হুদাই টাকাপয়সা খরচ করনের কাম নাই।

 চাচার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে চাচী আম্মা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন

– ‘ এইসব রোগব্যারাম বেশি পাত্তা দিতে নাই, বুঝলেন আব্বা? বেশি পাত্তা দিলে আরো পাইয়া বসে।‘ 

চাচী আম্মা জোর করে হাসেন। কিন্তু সে হাসি অন্য সকল সময়ের মতো প্রাণবন্ত ছিল না। মলিন, ধূসর হাসি। 

একরকম জোরাজুরিতে নিজের মন খারাপের কারণ বললাম।নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে টাকা ম্যনেজ করতে না পারলে এতবড় সুযোগ ফসকে যাবে।‘ 

চাচী আম্মার ম্লান মুখ আরো ম্লান হলো। বেদনা ভারাক্রান্ত হলো। কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল।  

 

এর পরের সপ্তাহখানেক আর চাচী আম্মার সঙ্গে দেখা নাই। মায়ের কাছে শুনেছি বাপের বাড়ি গিয়েছেন হাওয়া বদল করতে। এদিকে আমার সময় প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। শহরে ফিরতে হবে। চাকুরির চেষ্টা করতে হবে। অনিশ্চিত এক জীবন। কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন ধূলিসাৎ হতে চলেছে, এমনটি মেনে নিতে হবে ভেবে ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছিলাম বারবার। নিরুপায় আমি ব্যাগ গুছিয়ে রওয়ানা দেই শহরের উদ্দেশ্যে। রিক্সা গ্রামের বাজারের কাঠের ব্রিজ পার হতেই দেখি উল্টো দিক থেকে আসা রিক্সা থেকে কেউ ডাকছে, ‘ আব্বা, আব্বা রিক্সা থামিয়ে নামি। খানিক পেছনে চলে যাওয়া রিক্সার দিকে এগিয়ে যাই। বোরখায় আবৃত মুখ। কাছে যেতেই কাপড় সরিয়ে মুখাবয়ব উন্মুক্ত করে দেন। চোখেমুখে অলৌকিক প্রশান্তি ছড়িয়ে বলেন

–  ‘ আব্বা, অনেক চেষ্টা কইরা কিছু টাকা যোগাড় করছি। কতটুকু কাজে লাগবো, জানিনা।‘ 

হাতে একটি খাম ধরিয়ে দেন। অতঃপর চাচী আম্মাকে বহনকারী রিক্সাটি গাঁয়ের দিকে এগিয়ে যায়। আমি ধুলো ওড়া পথের দিকে চেয়ে রইলাম রিক্সা দৃষ্টিসীমায় মিলিয়ে যাওয়া অব্দি। তারপর দূরে দিগন্ত বিস্তৃত পথের দিকে, নির্মেঘ আকাশের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। শহরে ফেরার পুরোটা পথ মন আর্দ্র হয়ে রইল। গলায় উদ্গত কান্না আটকে থাকল। সে কী আনন্দের, নাকি কোনোদিন কারো অহিত কামানা না করা এক মাতৃসম নারীর প্রতি শ্রদ্ধায় নত আবাগের? সামান্য ধন্যবাদটুকু জানানো হলো না। জীবনে কিছু মুহূর্ত আসে, যখন মানুষের বোধবুদ্ধি লোপ পায় বলে তার সঠিক ব্যবহার করতে পারে না। সেদিন এমনই এক মুহূর্তর সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। 

 

মেসে ফিরে সন্ধ্যার অন্ধকারময় রুমে হাতড়ে সুইস অন করে বাতি জ্বালাই। খামটি খুলে গুণে দেখি, যে পরিমান অর্থ ভাঁজে ভাঁজে যত্নে রাখা আছে, তা দিয়ে যাত্রায় বিদেশগমন থেমে থাকবে না। মনে হলো বুকে দম ফিরে পেলাম। সমস্ত রাত্রি আনন্দে নিদ্রাহীন কাটল। অন্ধকারে সটান শুয়ে কপালে হাত রেখে ছাদের সিলিং ফ্যানের ঘূর্ণনের দিকে তাকিয়ে রইলাম। কখনো কখনো মানুষ একা থাকতে চায়, নিজস্ব নির্জনতার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে। কতক্ষণ নিজের ভেতরে মগ্ন হয়ে রইলাম, জানিনা। শুধু মনে আছে, আকাশের পটে আঁকা লালচেহলদেটেকমলা আভা জানালা দিয়ে ঘরের মেঝেয় এসে পড়েছিলো। 

 

সমস্ত দিন এখানে ওখানে ছুটাছুটি চলল। নানান আনুষ্ঠানিকতা, টিকেট, গোছগাছ শেষে আনন্দে আত্মহারা আমি অধির হয়ে রইলাম। অরণ্য থেকে অরণ্যে দ্রুতবেগে ছড়িয়ে পড়া আগুনের লেলিহান শিখার মতো আমার সমস্ত শরীর, মন, অনুভূতিতে ছড়িয়ে পড়ল আনন্দ। এই মহা ব্রহ্মাণ্ডের কাউকে জানানোর প্রয়োজনবোধ করি নাই বন্ধু শেখর ছাড়া। এক রকম ঘোরের মধ্যে আমি যখন নিউইয়র্কের জন এফ কেনেডি এয়ারপোর্টে এসে নামি,তখন বাইরের পৃথিবী শাদা তুলার মতো তুষারাবৃত। শেখরের গাড়িটি তার বাসার উদ্দেশ্যে নিয়ে চলে আমাদের। হাইওয়েতে ধীর গতিতে ছুটে চলা তুষারাবৃত গাড়িগুলোকে ভাল্লুকের পালের মতো মনে হয়েছিল।

 

শেখরের জ্যামাইকার বাড়িতে ফিরে গোসল সেরে ক্লান্তিতে জড়িয়ে আসা শরীর বিছানায় এলিয়ে দেই। দুচোখে ঘুমের আগ্রাসন। দীর্ঘ ঘুম শেষে জেগে উঠি পরদিন। গাঁয়ের বাজারেররহিম ফোন ফ্যাক্সের দোকানেফোন করে স্বজনদের জানিয়ে দেই সহি সালামতে আমার বিদেশে এসে পৌঁছানোর সংবাদ। 

 

নিজেকে গুছিয়ে নিতে ব্যস্ততায় কেটে গিয়েছে অনেকগুলো বছর। আমার বিদেশযাত্রার মাস ছয়েকের মধ্যে কঠিন অসুখে চাচী আম্মা পৃথিবীর মায়া ছেড়ে যান। মায়ের এক পত্র মারফত জানতে পারি, চাচী আম্মা তাঁর সোনার অলংকার বিক্রি করে দিয়েছিলেন পর্যায়ক্রমে, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচের যোগান দিতে। শেষমেষ তীব্র শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও বাপের বাড়ি গিয়েছিলেন তাঁর প্রাপ্য সম্পত্তির অংশবিশেষ বিক্রি করতে। সেই টাকাই আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন শেষবার দেখা হওয়ার দিনে। মা এইসব জেনেছেন চাচী আম্মার মৃত্যুর পর বড় চাচার কাছে। সব জেনে আমার ভেতরে একরকম শূন্যতাবোধ পেয়ে বসে। নিজেকে স্বার্থপর এক অপরাধী মনে হয়। 

 

প্রায়শই ভাবি, তবুও তো আমায় নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসার মাতৃসম কেউ ছিল আলোহাওয়ার এই পৃথিবীতে। জীবনের কঠিন দুঃসময়ে যে অজান্তেই আমার মনের আঙিনায় ভরসার মানুষ হয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন বারবার।  

 

সাং হিংনামের রেস্তরাঁসংলগ্ন নদীতীরে রাত্রি ঘনিয়েছে। জলের গা ছুঁয়ে জলের ঢেউকে তিরতির করে কাঁপিয়ে বয়ে যায় হাওয়া। খানিক দূরের পানশালা থেকে উচ্চ ভলিওমে মিউজিকের শব্দ ভেসে আসে। ঝাপসা চোখে সেই দিকে তাকাই। অন্ধকার পানশালার ভেতরে নানান রঙের আলোর গোল্লা ছুটোছুটি করছে। জমিনে পাইনের দুই একটি সূচালো পাতা বাতাসে হুটোপুটি খাচ্ছে। বহু বছর বাদে বিস্মৃতপ্রায় কুয়াশাচ্ছন্ন স্মৃতি সামনে এসে ঘুরপাক খেতে খেতে পাইনের সূচালো পাতার সঙ্গে জড়াজড়ি খায়। ধীরে ধীরে কুয়াশা কেটে স্পষ্ট হতে থাকে। রাত্রি পা বাড়ায় ঘন অন্ধকারের দিকে। আমি পা বাড়াই ঘরে ফেরার তাগিদে। মাথার উপরে নীড়ে ফেরা পাখির ঝাঁক। একটি একলা পাখি দল থেকে পিছিয়ে পড়েছে। আমি ধীর পায়ে হাঁটছি আর সেইদিকে চেয়ে আছি। মনে মনে প্রার্থনা করি, পাখির দল ধিরে উড়ুক। দলছুট পাখিটি খুঁজে পাক নিজস্ব দল। পথ চিনে ফিরুক ব্যক্তিগত নীড়ে।

* * * * * *