You are currently viewing ওরা ফেরেনি কেউ – ৮ ||  বিচিত্রা সেন

ওরা ফেরেনি কেউ – ৮ || বিচিত্রা সেন

ওরা ফেরেনি কেউ

বিচিত্রা সেন

কিস্তি-৮

১৫.

ছেলের চিঠিটা পাওয়ার পর থেকে মনিবালা শুধু ভাবছে। আদিত্য লিখেছে ঘোষবাড়ির মেয়ে মালবিকাকে ওরা আদিত্যের হাতে তুলে দিতে চায়। আদিত্য এটাও লিখেছে মালবিকা কলকাতায় বড় হওয়া মেয়ে। সে এবার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে। মনিবালার ভাবনা বড়লোকের সুন্দরী, শিক্ষিতা, আধুনিকা মেয়ে গ্রামে এসে মানিয়ে নিতে পারবে তো? চিঠি পড়ে বোঝা যাচ্ছে আদিত্য এ বিয়েতে আগ্রহী। এখন মনিবালা এ বিয়েতে আপত্তি জানালে ছেলে হয়তো কষ্ট পাবে। শাশুড়ি বেঁচে থাকলে তিনি হয়তো একটা সুপরামর্শ দিতেন। এ মুহুর্তে মনিবালার নিজেকে খুব অসহায় মনে হয়। সারারাত সে এ বিষয়টি নিয়ে ভাবে। পরদিন সে এ বিয়েতে তার সম্মতি জানিয়ে বাড়ির কামলাকে দিয়ে আদিত্যের কাছে একটা চিঠি পোস্ট করে।
মায়ের চিঠির অপেক্ষাতেই ছিল এ কয়দিন আদিত্য। সে প্রতি সন্ধ্যায় আবারও বড়মাকে গান শোনাতে যায়। তার গান শুরু হলে বাড়ির বউ-ঝিরা সবাই এসে ভিড় জমায় বড়মার ঘরে। মালবিকাও আসে। তবে কথা হয় না। মালবিকা কেমন যেন লজ্জা পায়। এর মধ্যে বড়মা একবার জিজ্ঞেস করেছিল আদিত্য মাকে জানিয়েছে কিনা মালবিকার কথা। আদিত্য জানিয়েছে সে চিঠি লিখেছে। মায়ের উত্তরের অপেক্ষায় আছে। তাই মায়ের চিঠি আসার সাথে সাথে আদিত্য চিঠিটা খুলে পড়া শুরু করলো। পুরো চিঠি পড়ে সে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। যাক্ মা রাজি এ বিয়েতে। এ কথা বড়মাকে জানাতে হবে।
আদিত্যের কাছ থেকে খবরটা শুনে বড়মা খুব খুশি হলেন। বললেন,
-তোইলে এবার বিয়া র আয়োজন শুরু হোরির আঁরা।
আদিত্য মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো।
যেভাবে ঘোষবাড়ির বড় মেয়ের বিয়ে হওয়ার কথা ঠিক সেভাবেই বিয়ে হলো। প্রচুর লোক খাইয়ে হ্যাজাক বাতি জ্বালিয়ে জাঁকজমক করে মালবিকার বিয়েটা হয়ে গেলো। আদিত্যের আপন কেউ না থাকলেও জ্ঞাতি-গুষ্ঠিরা এসে বিয়ের আসর জমিয়ে তুললো। পরদিন ভোরে ঘোষবাড়ির নারীদের বিলাপের মধ্যে মালবিকাকে গাড়িতে তুলে দেওয়া হলো। এই গাড়ি মালবিকাদের ট্রেনে তুলে দেবে। পরে বেঙ্গুরা রেলস্টেশন থেকে পালকিতে করে মালবিকাকে শ্বশুরবাড়ি নিয়ে যাওয়া হবে। সবকিছু ঠিকঠাক মতোই হলো। শুধু যখন পালকিতে চড়ছিল তখন মালবিকার খুব ভয় লাগছিল পড়ে যাবে বলে। কারণ এর আগে সে কখনো পালকিতে চড়েনি।
মনিবালা বাড়ির মহিলাদের নিয়ে বর বরণ করতে দাঁড়িয়েছিল সদর দরজায়। বউ দেখে তো সবাই খুশিতে চিৎকার দিয়ে উঠলো। এত সুন্দর বউ! সবার প্রশংসাবাণী মালবিকা শুনতে পাচ্ছিল। নিজের প্রশংসা শুনতে কার না ভালো লাগে! বাড়ির বউ-ঝিরা আদিত্য আর মালবিকাকে পাশাপাশি বসিয়ে আচার-ধর্ম সব পালন করলো। এর মধ্যে আদিত্যকে নিয়ে বেশ হাসির রোল উঠলো। কারণ বিবাহের আচারের মধ্যে একটা হলো স্বামীর কাছ থেকে বউকে লুকিয়ে রাখা হয়। পরে ননদ-দেবররা মিলে বউকে খুঁজে বের করে স্বামীর কাছে নিয়ে আসে। তখন স্বামীর হাতে একটা কি দেওয়া হয় বউকে শাসন করার জন্য। এসময় দেবর ননদরা ওই কি দিয়ে বউয়ের হাতে কিংবা পিঠে আঘাত করে। আঘাতটা আলতো করে করার নিয়ম, কিন্তু দেবর, ননদ, নন্দাইরা এ আঘাতটা জোরেই করায়। এ নিয়ম আদিত্য সরাসরি নাকচ করে দিল। সে সোজা জানিয়ে দিলো নতুন বউয়ের গায়ে কোনোরূপ আঘাত করা যাবে না। বউয়ের প্রতি এমন দরদ দেখে আদিত্যের জ্ঞাতি ভাই-বোনেরা তো হেসে খুন। বড়রা একটু এ ব্যাপারে অসন্তোষ দেখালেও আদিত্যের দৃঢ়তা দেখে সবাই চুপ হয়ে গেলো। মালবিকা বুঝতে পারলো তার বড়মা সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করেনি।
আচার অনুষ্ঠানের পর আদিত্য মালবিকার চোখের আড়ালে চলে গেলো। কারণ সেদিন আবার কালরাত্রি। স্বামী-স্ত্রীর মুখদর্শন অমঙ্গল বলে বিবেচিত হয় সনাতন সমাজে। যতক্ষণ আদিত্য ছিল পাশে মালবিকার একটুও অস্বস্তি হয়নি। মনে হয়নি সে অপরিচিত জায়গায় আছে। কিন্তু আদিত্য সরে যাবার পর থেকে ওর খুব একা একা লাগছে। যদিও ঘরে লোকে গিজ গিজ করছে, তবুও তার মনটা হু হু করতে লাগলো। বিকেলের দিকে সবাই যার যার ঘরে ফিরে গেলো। মনিবালা এবার আদিত্যের রুমে এলো, যেটাতে এখন মালবিকা আছে। শাশুড়িকে আসতে দেখে মালবিকা সংকুচিত হয়ে বসলো। মনিবালা বৌমার পাশে বসে চিবুকটা তুলে ধরে বললো,
-আমার ছেলের পছন্দ আছে।
মনিবালাকে আদিত্য আগেই জানিয়ে দিয়েছিলো মালবিকা চট্টগ্রামের আ লিক ভাষা বলতে পারে না, তবে বোঝে। তাই বৌমার সাথে সে শুদ্ধ বাংলায় কথা শুরু করলো। যদিও তার উচ্চারণে যথেষ্ঠ আ লিকতার প্রভাব আছে তবুও সে মোটামুটি শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে পারে। লেখাপড়া শেখানোর পর নন্দলাল তাকে নানারকম বই এনে দিয়েছিল। ওসব পড়ে পড়ে সে ভাষাটা বোঝে এবং বলতে পারে। কিন্তু উচ্চারণে আ লিকতাটা রয়ে গেছে।
শাশুড়ির মুখে শুদ্ধ বাংলা শুনে মালবিকা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। সে এতক্ষণ ভাবছিলো, তার কথা তার শাশুড়ি বুঝবে তো? মনিবালা এবার মালবিকার হাত দুটো নিজের হাতে নিয়ে বললো,
-এ সংসার তোমার। তুমি এর দেখাশুনা করবা।
মালবিকা মাথা নেড়ে সায় দিলো।
আদিত্যদের বাড়িটা খুব সুন্দর। বিশাল বাড়ি। চারপাশে সব বড় বড় গাছ। বাড়ির সামনে শান বাঁধানো ঘাট দেওয়া বিশাল পুকুর। মালবিকার খুব পছন্দা হলো বাড়িটা। শুধু একটাই অসুবিধা। টয়লেটটা অনেক দূরে। এখন মালবিকাকে একা যেতে হচ্ছে না ঠিকই, কিন্তু একসময় তো একাই যেতে হবে। সেই ভাবনায় মালবিকা বেশ বিচলিত হয়ে পড়লো। তবে কাউকে সে এ কথা মুখ ফুটে বলতে পারলো না। ফুলশয্যার রাতে আদিত্য তাকে বলেছিল, সে সবসময বন্ধু হয়েই মালবিকার পাশে থাকতে চায়। সে বেঁচে থাকতে মালবিকার কোনো কষ্ট হতে দেবে না। বিনিময়ে শুধু মালবিকাকে গ্রামে মায়ের সাথে থাকতে হবে। মালববিকা আদিত্যকে কথা দিয়েছে। এখন টয়লেটের কথা বললে যদি আদিত্য আবার কিছু মনে করে! দিনের বেলায় তার সময়টা বেশ ভালোই কাটে। কিন্তু রাত্রে তার খুব ভয় করে। শুধু মনে হয় যদি ডাকাত আসে! এরকম করেই আদিত্যের দশদিনের ছুটি শেষ হয়। মালবিকাও দশরাত্রির ‘নাইওর’ আসে বাবার বাড়িতে।
ঘোষবাড়িতে সবাই মালবিকার ওপর হুমড়ি থেকে পড়ে। কেমন লাগছে গ্রাম তার? মালবিকা সবাইকে আশ্বস্ত করে সে ভালো আছে। টয়লেটের কথা আর ডাকাতের ভয়ের কথা সে চেপে যায়। মালবিকার মুখের দিকে তাকিয়ে বড়মা খুব স্বস্তি পায়। বোঝা যায় মেয়েটি বেশ ভালো আছে।
একসময় নাইওর শেষ করে মালবিকা আবার ফিরে যায় তার স্বামীর বাড়ি। আদিত্যই নিয়ে যায় তাকে। মনিবালা খুব আদর করে বৌমাকে। বলতে গেলে কোনো কাজই সে তাকে করতে দেয় না। মনিবালা তো নিরামিষ খায়। বৌমাকে সে মাছ/মাংস আর খেতে অনেক অনুরোধ করে। কিন্তু মালবিকা নিজের জন্য আলাদা রাঁধে না। শাশুড়ির সাথে নিরামিষ খেয়ে ফেলে। প্রতি শনিবার বিকেলে আদিত্য আসে। আসার সময় মাছ, কখনো বা কবুতর নিয়ে আসে। শনি, রবি দুদিন মালবিকা আমিষ খায় স্বামীর সাথে।
সোমবার খুব ভোরে আদিত্য চলে যায় শহরের উদ্দেশ্যে। শনি-রবি এ দুদিন যেন মালবিকা স্বপ্নের ঘোরে থাকে। আদিত্যকে তার এত ভালো লাগে কেন, সে নিজেই জানে না। আদিত্যের মধ্যে এমন কিছু আছে যা তাকে মোহগ্রস্থ করে রাখে। টয়লেটের ভয়টা সে শাশুড়িকে বলেছিল, তাই যখনই সে টয়লেটে যায়, তখনই শাশুড়িও তার সাথে যায়। ওই নির্জন বাগিচাকে মালবিকার প্রচন্ড ভয়। কীভাবে যেন এ বাড়িটা তার ভীষণ পছন্দ হয়ে গিয়েছে। গ্রামের পরিবেশে স্ত্রীর এভাবে মানিয়ে নেওয়াতে আদিত্য খুব খুশি। প্রতি সপ্তাহে বাড়িতে আসার সময় সে বৌয়ের জন্য কিছু না কিছু নিয়ে আসে। রাতে খাওয়া দাওয়ার পর ঘুমাতে গেলে আদিত্য যখন মালবিকার হাতে এসব উপহার তুলে দেয় তখন তার চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। বেশ ভালোমতোই সুখে শান্তিতে চলতে থাকে আদিত্য-মালবিকার সংসার।
মালবিকা এখন সাতমাসের অন্ত:সত্ত্বা। ওর শরীরটা তেমন ভালো না। মণিবালা ভাবছে বৌমাকে বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দেবে। কারণ এখানে হঠাৎ ব্যথা উঠলে সে একা সামলাতে পারবে না। আদিত্যকে সে বলে সে কথা। আদিত্যও এ ব্যাপারে একমত। এক রবিবারে মালবিকাকে ঘোষবাড়িতে নিয়ে আসে আদিত্য।
বাবার বাড়িতে এসে মালবিকা ভালোই আছে। তবে শরীরটা তার তেমন ভালো নয়। প্রথম সন্তান হতে যে এত যন্ত্রণা আগে জানতো না সে। প্রতি সন্ধ্যায আদিত্য এসে ওকে দেখে যায়। আদিত্য ঘোষবাড়ির জামাই হলেও এখনো সে মেসেই থাকে। তবে এখন আর ভাড়া নেয় না ওরা। মা, কাকীমা, ঠাকুরমা, বড়মা’র আদরে দিনগুলো ভালোই কাটে মালবিকার। এক শীতের দুপুরে মালবিকার ব্যথা ওঠে। তাড়াহুড়া করে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় আন্দরকিল্লা মেটারনিটি হাসপাতালে। সন্ধ্যায় তার এক পুত্রসন্তান জন্মায়। আদিত্যসহ ঘোষবাড়ির সবাই খুব খুশি। তিনদিন হাসপাতালে থেকে মালবিকা আবারও ঘোষবাড়িতে ফেরত আসে। ছয়দিনের দিন খুব বড় করে নাতির ষষ্ঠী করায় মালবিকার বাবা। আত্মীয় পরিজনে ভরে ওঠে ঘোষবাড়ি।

দিনগুলো খুব ভালোই কাটতে থাকে আদিত্য ও মালবিকার। ষষ্ঠী যেহেতু মামারবাড়িতে হয়েছে সেহেতু ছয়মাসের অন্নপ্রাশন নিজের বাড়িতে করার সিদ্ধান্ত নেয় আদিত্য। মালবিকারও তাতে আপত্তি নেই। এর মাঝে একবার আদিত্য মাকে নিয়ে এসেছে। তবে যে একদিন ছিল তাতে তার যত্নআত্তির ত্রুটি করেনি ঘোষবাড়ির লোকেরা। ঘোষবাড়ির সবাইকে বার বার করে অন্নপ্রাশনে যাবার তাগাদা দিয়ে আদিত্য আর মালবিকা বাড়ি চলে গেলো।

নাতিকে নিজের বাড়িতে পেয়ে মনিবালা খুব খুশি। মালবিকাকে এখন ছেলের কিছুই করতে হয় না। শাশুড়িই সামলায় সব। ছেলের নাম রাখা হয়েছে দেবরাজ চৌধুরী তরে ঘরে সবাই দেব বলেই ডাকে। দেব ঠাকুরমার ভীষণ ন্যাওটা হয়েছে। খুব ধুমধুাম করে অনেক লোক খাইয়ে দেবের অন্নপ্রাশন হয়ে যায়। ঘোষবাড়ির প্রায় সবাই আসে এ অনুষ্ঠানে। থাকেও তারা তিন চারদিন। অনেক বছর পর মনিবালা যেন আবার আগের দিনগুলোতে ফিরে যায়। যখন তার স্বামী ছিল এখন এভাবেই গমগম করতো সারাবাড়ি। কী যে আনন্দ লাগতো তখন তার। আদিত্য শহরমুখী হওয়ার পর থেকে তার ঘরটা একেবারে শূন্য হয়ে গেছে। দেবরাজ আসাতে ঘরটা যেন আবার ভরে উঠলো।

দিনের পর দিন গড়ায়। দিন শেষে মাস, মাস শেষে বছর ঘোরে। মালবিকা গ্রামে নিজেকে সুন্দর মানিয়ে নিয়েছে। এ বাড়িটা তার খুব পছন্দ। এত বড় খোলা বাড়ি এর আগে সে কখনো দেখেনি। বিশেষ করে বড় বড় গাছগুলো এবং শান বাঁধানো ঘাটওয়ালা পুকুরটা এ বাড়িটাকে আলাদাভাবে মায়াময় করে রেখেছে। তাদের ঘরটাও তার খুব ভালো লাগে। মাটির দোতলা ঘর। চারকক্ষ ও দুই বারান্দা বিশিষ্ট এই ঘরটা একদম অন্যরকম। কিন্তু আদিত্য আবার নতুন ঘর তোলার পরিকল্পনা করেছে। মনের খেয়ালে একটি ছবি এঁকেছিল সে। ছবিটা ছিল একটা বাড়ির ছবি। চারপাশে তার বড় বড় গাছ। সামনে শান বাঁধানো ঘাট দেওয়া পুকুর। তবে বাড়িটি একদম আলাদা। কাঠের দোতলা বাড়ি। চারপাশে বারান্দা দেওয়া। বারান্দায় ফুলের টব ঝুলছে। ছবিটি যারাই দেখেছে, তারাই বাড়িটির উচ্ছ্বাসত প্রশংসা করেছে। সেই থেকে আদিত্যের খেয়াল চেপেছে এ রকম একটি বাড়ি করবে সে। মনিবালা বোঝায় এত বড় ঘর থাকতে আবার ঘর তোলার দরকার কী? আদিত্য বলে,
-আঁর তে শখ লাগের যে এরি। তুঁই আঁরে বাধা ন দিও।
মনিবালা আদিত্যকে চেনে। তাই সে আর বাধা দেয় না। তারপর সে এক লম্বা ইতিহাস। বিভিন্ন জায়গা থেকে সেরা কাঠ সংগ্রহ করে, বার্মিজ টিন দিয়ে দুই মাসের অক্লান্ত পরিশ্রমে এমন এক ঘর বানানো হয়, যা দেখতে প্রতিদিন গ্রামের লোকেরা ভিড় করে। ওদের পুরো থানাতেই কাঠের দোতলা চারপাশে বারান্দা দেওয়া বাড়ি এই প্রথম। বাড়ি দেখে মালবিকা সত্যি মুগ্ধ হয়ে যায়। গ্রামের বাড়ির রান্নাঘরগুলো থাকার ঘরের চেয়ে একটু দূরে রাখা হয়। এটা একদিকে যেমন পুতপবিত্রতার জন্য অন্যদিকে তেমন রান্নাঘরের কালো ধোঁয়া যেন থাকার ঘরের জিনিসপত্রকে নষ্ট করতে না পারে সেজন্য। কিন্তু নতুন ঘরে শহুরে বাড়ির মতো একসাথেই রান্নাঘর করা হয়েছে। এখন যত বড় বৃষ্টিই হোক, রান্নাঘরে যাওয়ার জন্য মালবিকা এবং মনিবালকে ভিজতে হবে না। ওই ঘরের জন্য আলাদা করে ফানির্চারও বানানো হয়। যেদিন ঘরস ার (নতুন ঘরে ওঠার অনুষ্ঠান) হয় সেদিন পুরো গ্রামের লোককে নিমন্ত্রণ করে আদিত্য। সবাই নন্দলালের ছেলের প্রশংসায় প মুখ হয়।
আদিত্য বউ ছেলেকে গ্রামে রেখেছে ঠিকই। কিন্তু তাদের শৌখিনতার ব্যাপারে সে কোনো ছাড় দিতে নারাজ। বাজারে যে শাড়িটা এবং পোশাকটা আগে আসে, সেটা প্রথম দফাতেই তার বৌ-ছেলেকে পড়ানো চায়। মনিবালা সাদা থান ছাড়া অন্য রঙ পড়ে না। তাই মায়ের জন্য সে কলকাতা থেকে আসা ফিনফিনে ধুতি কিনে আনে। এর মধ্যে মালবিকা আবার মা হবে। আদিত্য শনিবার বিকেলে বাড়ি আসলে সে সুখবরটা দেয়। শুনে আদিত্য বলে,
-এবার যেন আমাদের মেয়ে হয়। একটা মেয়ের খুব শখ আমার।
মালবিকা হেসে বলে,
-তাই যেন হয়। আমি ভগবানকে খুব করে ডাকবো তোমাকে মেয়ে দেওয়ার জন্য।
ভগবান সত্যি সত্যি হয়তো মালবিকার কথা শুনেছে। তাই এবার মালবিকার মেয়েই হয়। এবারও তাকে শহরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মনিবালা বউয়ের ব্যাপারে কোনো ঝুঁকি নিতে নারাজ। এবারও আন্দরকিল্লা মেটারনিটিতে মেয়ের জন্ম হয়। জন্মের পর প্রথম পাঁচ মাস মেযে নিয়ে মালবিকা বাবার বাড়িতেই থাকে। অন্নপ্রসান ছেলের মতো মেয়েরও গ্রামে হয়। আবারও নন্দলালের ভিটেতে চাঁদের হাট বসে। পুরো গ্রাম নিমন্ত্রণ করা হয় মেয়ের অন্নপ্রসানে। মেয়ের জন্য এত টাকা পয়সা খরচ করাতে গ্রামের সবাই খুব অবাকই হয়। কিন্তু আদিত্য জানিয়ে দেয় তার কাছে ছেলে মেয়ে উভয়ই সমান।
গ্রাম এবং শহরে আসা যাওয়া করে আদিত্যের সংসার চলতে থাকে। আদিত্য ঘোষবাড়ির মেসেই থাকে এখনো। বড়মা মারা গেছেন এক রাতে হুট করে। কাউকে কোনো কষ্ট দেননি। বড়মার মৃত্যুর সাথে সাথে যেন ঘোষবাড়িতে একটা অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে। এবার সংসারে কর্ত্রী হন বড় ঠাকুরমা, তবে তিনি খুব শান্ত স্বভাবের বলে তাঁকে সবাই খুব একটা গুরুত্ব দেন না। তাঁকে না জানিয়েও বাড়ির বৌ-ঝিরা অনেক কাজ করে ফেলে। আদিত্য চেয়ে চেয়ে দেখে শ্বশুরবাড়ির এ পরিবর্তন। তবে যত পরিবর্তনই ঘটুক আদিত্য এবং মালবিকার আদর এ বাড়িতে আগের মতোই থাকে।
ইদানিং আদিত্য একটা সংকটে পড়েছে। ছেলেকে স্কুলে দেবে সে। কিন্তু বুঝে উঠতে পারছে না ছেলেকে শহরের স্কুলে ভর্তি করাবে নাকি গ্রামের স্কুলে? একবার ভাবছে এই সুযোগে শহরে একটা বাসা নিয়ে মালবিকাকে শহরে নিয়ে আসবে। পরমুহূর্তে মায়ের কথা মনে হতেই মনটা চুপসে যাচ্ছে। বন্ধু অনিল, ইউসুফ, কামালের সাথে তার এখনো যোগাযোগ আছে। ওদের সাথে একটু পরামর্শ করলে কেমন হয়। এক বিকেলে অফিস থেকে ফিরে বন্ধুদের সাথে চায়ের আড্ডায় কথাটা তোলে আদিত্য। বলে,
-আঁই একখান জিনিস লই খুব চিন্তাত আছি।
তিনবন্ধু একসাথে হৈ হৈ করে ওঠে। কিসের চিন্তা? আদিত্য এবার স্পষ্ট করে বলে,
-আঁই চার্ই যে আঁর ফোয়ারে শহরর স্কুলত ফড়াইয়ুম। এডে বাসাও একখান লইয়ুম্। তোরা কী হস্?
অনিল বলে,
-মাসীমা তো খুব একলা হোই যাইবু।
ইউসুফ সমর্থন দিয়ে বলে,
-এহন ন, আরও কয়েক বছর ফরে আনিস বৌ ফোয়ারে শহরত্।
কামালও সমর্থন দেয় এতে।
কারও সমর্থন না পেয়ে আদিত্য বোঝে কয়েক বছর তাকে অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু প্রতি সপ্তাহে এরকম দৌঁড়াদৌঁড়ি তার কষ্ট হয়ে যায়। প্রতি শনিবার অফিস করে বিকেলে সে বাড়ি যায়। আবার সোমবার ভোরে উঠে চলে আসে। এসে অফিস করে। শহরে একটা বাসা থাকলে তার এত কষ্ট হতো না। কিন্তু বন্ধুরা যেহেতু বারণ করছে নিশ্চয় তার ভালোর জন্যই করছে।
এভাবে সময় গড়িয়ে যায়। শহরে আনবে আনবে করেও আদিত্যের আর শহরে পরিবার আনা হয় না। যতবারই এ উদ্যোগ নেয়, ততবারই কোনো না কোনো বাধা পড়্ তেবে তাতে খুব একটা অসুবিধা হচ্ছে না মালবিকার। গ্রামের সুন্দর বাড়িটা ছেড়ে সে এখন শহরেই আসতে চায় না। এর মধ্যে তার আরও দুটো মেয়ে হয়েছে। আদিত্য-মালবিকার সংসারে এখন এক ছেলে, তিন মেয়ে। গ্রামের স্কুলেই পড়ছে বড় তিনজন, ছোটটাকে এখনো স্কুলে দেওয়া হয়নি। বাচ্চাদের স্কুল ছুটি হলেই মালবিকা বাবার বাড়ি চলে আসে। এরই মধ্যে ঘোষবাড়ির বড় ঠাকুরদা ও মেঝ ঠাকুরদা এক মাসের ব্যবধানে মারা গেছেন। ছোট ঠাকুরদা ব্যবসার কাজ দেখাশোনা করলেও পরিবারের কর্তা বানানো হয়েছে মালবিকার বাবাকে। তিনিই এখন ঘোষবাড়ির সবকিছু দেখাশোনা করেন। আদিত্য এখনো তাঁদের মেসেই আছে। যদিও খাওয়া দাওয়া ঘোষবাড়িতেই করে।

১৬.

দেশের পরিস্থিতি ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা ঘোষনণা করার পর থেকে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের মধ্যে কেমন যেন বাঁধভাঙ্গা জোয়ার এসেছে। এর মধ্যে আবার ছাত্ররা ঘোষণা করেছে এগারো দফা। বিভিন্ন সভা সমাবেশে প্রচুর মানুষ যোগ দিচ্ছে। আদিত্য কেমন যেন সেসবের প্রতি ঝুঁকে পড়ছে। সভা সমাবেশে সে নিয়মিত যাওয়া শুরু করেছে। এম.এ. আজিজ, জহুর আহমেদ চৌধুরী, শেখ মুজাফফর আহমেদের বক্তব্যগুলো তাকে বেশ টানে। ইউসুফ, কামাল ও অনিলও তার সাথে সাথে এসব সভা সমাবেশে যায়।
শেখ মুজিব পুরো দেশ চষে বেড়াচ্ছেন। তাঁর ছয় দফার বক্তব্য জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। চট্টগ্রামেও এসেছিলেন। যে আগুন ঝরা বক্তব্য তিনি রাখলেন তাতে আদিত্য পুরোপুরিই শেখ মুজিবের ভক্ত হয়ে গেলো। তার মনে হতে লাগলো চট্টগ্রামের সূর্যসন্তান সূর্য সেন যে স্বপ্ন দেখেছিলো তারই পূর্ণতা দিতে যেন শেখ মুজিবের জন্ম হয়েছে আদিত্য যেহেতু সরকারি চাকরি করে, সেহেতু সরাসরি সরকারের বিরুদ্ধে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব না। তাছাড়া তার ওপর ছয়জনের একটি পরিবার নির্ভরশীল। তাই সে সরাসরি রাজনীতির সাথে যুক্ত হয় না। তবে তার কেবলই মনে হতে থাকে শেখ সাহেবের হাত দিয়ে এ দেশে একটা বড় পরিবর্তন আসবে। গ্রামে গেলেও সে একটা বড় পরিবর্তন লক্ষ্য করে। গ্রামের মানুষও সারাক্ষণ রেডিও, পত্রিকাতে শেখ সাহেবের খবর খোঁজে। মাঝে মাঝে সে মালবিকার সাথে এসব বিষয়ে আলাপ করে। বলে,
-আমার মনে হয় শেখ মুজিবের হাত দিয়ে এদেশে একটা বড় পরিবর্তন আসবে। বাঘের বাচ্চা শেখের ব্যাটা। কী যে চমৎকার বক্তব্য দেয় তুমি যদি শুনতে!
মালবিকার রাজনীতিতে তেমন আগ্রহ নেই। তবু স্বামীর উচ্ছ্বাস তাকে টানে। স্বামীর উজ্জ্বল চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে তারও যেন মনে হয় কিছু একটা ঘটবে। সে তাই স্বামীকে উৎসাহ দিয়ে বলে,
-তুমি সামনাসামনি দেখেছো শেখ মুজিবকে?
আদিত্য মাথা নেড়ে বলে,
-দেখেছি মানে! একেবারে সামনে থেকে দেখেছি। কী সুন্দর দেখতে! নেতা একেবারে নেতার মতোই।
আদিত্যের চোখের উজ্জ্বলতা মালবিকার মাঝেও ছড়িয়ে পড়ে।
বাড়িতে আসলে ছেলেমেয়েরা সারাক্ষণ আদিত্যকে ঘিরে থাকে। ছেলেটা তবু কিছুক্ষণ পর পর খেলতে চলে গেলেও মেয়ে তিনটা বাবার কাছ থেকে একটু নড়ে না। ছোটটাতো সারাক্ষণ বাবার কোলেই থাকে। বাবা মায়ের এই কথার মাঝখানে মেজমেয়ে নীপা থামিয়ে দিয়ে বলে,
-বাবা, চলো না, আমরা মাছ ধরবো বড়শি দিয়ে।
বড়শি দিয়ে মাছ ধরা আদিত্যের একটা সখ। যে যখন মাছধরে তখন তার তিন মেয়ে তিন পাশে বসে থাকে। নীপার কথা শেষ হতেই বড় মেয়ে দীপা বলে,
-হ্যাঁ, বাবা চলো।
ছোট মেয়ে রূপা কিছু না বুঝেই বলে,
-চলো বাবা, চলো।
মেয়ে তিনটার আবদারে অগত্যা আদিত্যকে উঠতে হয়। বড়শিটা নিয়ে সে পুকুরের দিকে পা বাড়ায়। মেয়ে তিনটাও তার সঙ্গী হয়।
গ্রামে থাকলেও মালবিকা মেয়েদেরকে প্রমিত বাংলাই শিখিয়েছে। তবে চট্টগ্রামের ভাষা ওরা বোঝে এবং বলতে পারে। কিন্তু মালবিকার সামনে বলে না। দেবরাজ খুব দুরন্ত হয়েছে। মাকে সে একটুও ভয় পায় না। ঠাকুরমাকে কিছুটা ভয় পায়। তবে বাবার সামনে সে একেবারে গোবেচারা সেজে থাকে। তবে পড়ালেখায় খুব মেধাবী হয়েছে সে। বাবার মতো ভালো ছবিও আঁকতে পারে। আদিত্যের ইচ্ছা আছে আগামী দু/তিন বছরের মধ্যে মাকেসহ নিয়ে শহরে একটা বাসা নেবে। তার ছেলেমেয়েদের নিয়ে অনেক স্বপ্ন। গ্রামে থাকলে সে স্বপ্নগুলো পূরণ করতে পারবে না। মেয়েদের ভাগ্যে কিনা জানি না, তবে সেদিন আদিত্য বড়শিতে বড় বড় দুটো মাছ পায়। মালবিকা চমৎকার করে রাঁধে। সবাই খুব তৃপ্তি করে খায় দুপুরে।
দিনগুলো এভাবেই গড়াতে থাকে। ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে দেশ। ছয়দফার দাবী আদায়ের সমর্থনে শেখ মুজিবর রহমান যেভাবে সারাদেশ চষে বেড়াচ্ছিলেন, তাতে ভীত হযে ১৯৬৮ সালৈর ১৯ জুন পাকিস্তান সরকার তাঁকেসহ ৩৫ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে তাঁদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা দায়ের করে। এই মামলা ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ হিসেবেই সবার মুখে পরিচিতি পায়। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে এই মামলার বিচার শুরু হয়। এরই প্রতিবাদে সারাদেশ ফুঁসে ওঠে। প্রতিদিন সকাল বিকাল মিছিল বের হতে থাকে চট্টগ্রাম শহরের রাজপথে, অলিতে গলিতে। “জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনবো”- এই স্লোগানে প্রকম্পিত হতে থাকে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ সারাদেশের জনপদ। আদিত্যও অফিস থেকে ফিরতে কখনো কখনো এসব মিছিলে ঢুকে পড়ে। অন্যদের সাথে গলা মিলিয়ে সেও স্লোগান দেয়- “জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনবো”।
এ আন্দোলন এতটা গণমুখী হয়ে ওঠে দেখা যায় চায়ের দোকানদার থেকে পত্রিকা হকার সবাই কোনো না কোনো সময় মিছিলে শরিক হয়। ধীরে ধীরে শেখ মুজিবের মুক্তির আন্দোলন সরকারবিরোধী আন্দোলনের দিকে এগুতে থাকে। ছাত্রসংগঠনগুলো আওয়ামীলীগের আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে। নতুন এক স্লোগান চট্টগ্রামের আকাশ বাতাসকে আলোড়িত করে- “তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা”। ঘোষবাড়ির মেসে শুয়েও আদিত্য শুনতে পায় রাস্তায় মিছিলের স্লোগান- “পিন্ডি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা”, “জাগো জাগো, বাঙালি জাগো”। কখনো কখনো সে ছুটে যায় রাস্তায়। দেখে, মিছিলের কারো কারো হাতে লাঠিও আছে। ছয়দফাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা একসময়ের অহিংস আন্দোলন পাকিস্তান সরকারের স্বৈরাচারী এবং দমননীতির কারণে ক্রমান্বয়ে যেন সহিংসতার দিকে ধাবিত হতে থাকে।
পরিস্থিতি এত দ্রুতই পাল্টে যাচ্ছিলো যে, আদিত্য পর পর দুসপ্তাহ বাড়িতেও যেতে পারে না। এদিকে ১৯৬৯ সালের জানুয়ারীতে ঢাকায় পুলিশের গুলিতে মারা যায় আসাদুজ্জামান ও মতিউর রহমান নামে দুইজন ছাত্র। এর পর পর ফেব্রুয়ারীতে পুলিশের গুলিতে মারা যায় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামী সার্জেন্ট জহুরুল হক। এরপরে রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড: শামসুজ্জোহাকে গুলি করে মারা হয়। রেডিওতে এ খবরগুলো শুনে আদিত্য কিছুতেই নিজেকে শান্ত রাখতে পারছিল না। মনে হচ্ছিল এখুনি সরকারি চাকুরিটা ছেড়ে দিয়ে অস্ত্র হাতে প্রতিশোধ নিতে। কিন্তু তার এই হঠকারী সিদ্ধান্ত তার পরিবারকে বিপদে ফেলবে ভেবে সে আবার পিছিয়ে যায়। সারা দেশের তীব্র আন্দোলনের চাপে শেষ পর্যন্ত সরকার ফেব্রুয়ারি মাসে এই মামলা প্রত্যাহার করে। মুক্তি পান শেখ মুজিবসহ অন্য সব বন্দী। ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সালে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমানকে “বঙ্গবন্ধু” উপাধি দেওয়া হয়। খবরটি পত্রিকায় পড়ার পর থেকে আদিত্য অনবরত কাঁদছিলো। এ কান্না আবেগের, এ কান্না আনন্দের। শেখ মুজিবকে সে এতটাই ভালোবেসে ফেলেছে যে, তার মনে হচ্ছিল এ প্রাপ্তি যেন তারই প্রাপ্তি।
এ আন্দোলনের প্রভাব ক্রামন্নয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছিল। ইউসুফ, অনিল, কামাল ও এখন প্রায়সময় মিছিলে ঢুকে পড়ে। সভা-সমাবেশেও যায়। ঘোষবাড়ির বড়রা কেউ এ আন্দোলনে না জড়ালেও নবীণরা সভা সমাবেশে যেতে শুরু করে। এরই মধ্যে গণ আন্দোলনের চাপে দেশে বড় পরিবর্তন ঘটে যায়। স্বাধীকারের আকাঙক্ষায় রাজপথে নামা উন্মাতাল বাঙালিকে দমন করতে না পেরে রাষ্ট্রপতি জেনারেল আইয়ুব খান দেশে সামরিক শাসন জারি করে এবং সেনাবাহিনী প্রধান জেনালের ইয়াহিয়ার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন ১৯৬৯ এর মার্চে।
সেনাপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান দায়িত্ব গ্রহণ করে সামরিক শাসন জারি করেন। সে এক দুঃসহ পরিস্থিতি। সাধারণ নাগরিকদের পর্যন্ত সব অধিকার খর্ব করা হয়। আদিত্য এসময় গ্রামে আসা যাওয়া বাড়িয়ে দেয়। কারণ সে খেয়াল করে দেখেছে তাদের গ্রামের মানুষগুলো শেখ সাহেবের অন্ধ ভক্ত হয়ে উঠেছে। তাদের সাথে গল্প গুজবের মাধ্যমে সময়টা বেশ ভালো কাটে। এদিকে ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন। নির্বাচনের তারিখ ঘোষনার পরে সারাদেশে যেন উৎসবের আমেজ তৈরি হয়। এবার আদিত্য ইউসুফের সাথে পরামর্শ করে ছুটি নিয়ে গ্রামে চলে যায় মানুষকে নির্বাচনের প্রতি উদ্বুদ্ধ করতে। ১৯৭০ সালের জুন মাসের ৭ তারিখ থেকে আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনি প্রচার শুরু করে। তাদের প্রচারাভিযানে ছয়দফার সাথে সাথে স্থানীয় বিভিন্ন বিষয়গুলোতে তুলে ধরা হচ্ছিল।
একদিন বাড়ি থেকে ফিরছিল আদিত্য। হঠাৎ রাস্তায় তার চোখ পড়ে একটা পোস্টারের দিকে। পোস্টারটির স্লোগানটি তাকে ভীষণভাবে উদ্দীপ্ত করে। ওতে লেখা ছিল, “সোনার বাংলা শ্মশান কেন?” চারটি শব্দ আদিত্যকে যেন কেমন ভেঙ্গে চুড়ে দেয়। তার কেবলই মনে হতে থাকে, সত্যিই তো তার মাতৃভূমি প্রিয় সোনার বাংলার আজ এ দশা কেন? তাকে কিছু একটা করতেই হবে দেশের জন্য। কিন্তু কিছু করার ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তার এই সরকারি চাকরি। কিন্তু চাকরি ছেড়ে দিলে মালবিকা খুব অসন্তুষ্ট হবে। নাহলে তাদের যে সহায সম্পত্তি আছে, তা দিয়েই তারা কয়েক প্রজন্ম খেয়ে যেতে পারবে। আদিত্য ভীষণ ভাবনায় পড়ে। কীভাবে সে দেশের জন্য কিছু করতে পারে? শেষে চার বন্ধু মিলে সিদ্ধান্ত নেয় এলাকার মানুষকে নির্বাচনমুখী করাটাই এখন তাদের প্রধান কাজ। মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে আওয়ামীলীগকে ভোট দিতে। ভোটের জোয়ারে ভাসিয়ে দিতে হবে পশ্চিম পাকিস্তানিদের সমস্ত ষড়যন্ত্র। কামাল এবং অনিল শহরের দায়িত্ব নেয়। ইউসুফ এবং আদিত্য গ্রামের দায়িত্ব নেয় স্বেচ্ছায়।
আদিত্য এখন ঘন ঘন বাড়িতে আসে। তবে মালবিকা এখন আর তাকে তেমন করে পায় না, বাড়িতে এসেই ব্যাগটা রেখে এক কাপ চা খেয়ে সে বেরিয়ে যায়। আসে রাত এগারোটার পরে। এসেই খেয়ে শুয়ে পড়ে। কখনো কখনো হয়তো কিছুক্ষণ গল্প করে। তবে তাতে শুধু নির্বাচনের আলাপই ঘুরে ফিরে আসে। মালবিকা বুঝতে পারে আদিত্য নিজেরই অজান্তে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছে।
প্রথমে নির্বাচন অক্টোবরে করার কথা থাকলেও পরে সেটা ৭ ডিসেম্বর নিয়ে যাওয়া হয়। আদিত্য আর ইউসুফ বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে আওয়ামীলীগকে ভোট দেওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে থাকে। স্বামীর এভাবে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া মালবিকাকে উৎকন্ঠিত করে তোলে। তার খুব ভয় হয়। মনে হয় দেশে তো শুধু আওয়ামীলীগ না, মুসলিম লীগ ও আছে। আদিত্যের এসব কর্মকা- ওরা কি ভালোচোখে নেবে? যদি ওরা আদিত্যের কোনো ক্ষতি করে?
এক রাতে ভাতপাতে মালবিকা আদিত্যের কাছে প্রশ্নটি তোলে। বলে,
-তুমি যে আওয়ামীলীগের জন্য এভাবে দৌঁড়াচ্ছো, মুসলিম লীগের ওরা যদি তোমার কোনো ক্ষতি করে?
আদিত্য হো হো করে হাসে। তারপর বলে,
আরে রাখো তোমার মুসলিম লীগ। আওয়ামীলীগের জোয়ারে, নৌকার ধাক্কায়, সব উড়ে যাবে।
তবুও মালবিকা স্বস্তি পায় না। তার মনের মধ্যে অজানা আশংকা ঘুরপাক খায়।
বার বার ছুটি নিয়ে আদিত্যের বাড়ি যাওয়া অফিসের বড়কর্তারও চোখে পড়ে। একদিন বড়কর্তার রুমে তার ডাক পড়ে। এ কথা সে কথা বলার পর বড়কর্তা এবার আসল কথায় আসেন। বলেন,
-আদিত্য নারায়ন বাবু, একটা জিনিস খেয়াল করলাম আপনি ইদানিং খুব ঘন ঘন ছুটি নিচ্ছেন আর বাড়ি যাচ্ছেন। ব্যাপারটা কী জানতে পারি?
আকস্মিক এ প্রশ্নের জন্য আদিত্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না। তাই সে আমতা আমতা করে। বড়কর্তা বলেন,
-দেখেন, আমরা সরকারি কর্মচারি-কর্মকর্তা। আমাদের রাজনীতিতে জড়ানো ঠিক না। গোয়েন্দাদের নজর থাকে আমাদের ওপর। যা করেন, ভেবেচিন্তে করবেন।
আদিত্য মাথা নেড়ে বললো,
-ঠিক আছে স্যার।
বড়কর্তার রুম থেকে বেরিয়ে আদিত্য ভাবনায় পড়ে গেলো। তাহলে কি তার পেছনে গোয়েন্দা লেগেছে? স্যার এভাবে একটা প্রচ্ছন্ন হুমকি দিলেন কেন? তার মাথাটা কাজ করছে না। আসলে ইদানিং মাথায় বঙ্গবন্ধু, নৌকা আর নির্বাচন ছাড়া কিচ্ছু ঢোকে না। নির্বাচন, নির্বাচন করে ইদানিং তার খাওয়া, দাওয়া, ঘুম লাটে উঠেছে। যাক, স্যার যখন বলেছেন তখন কিছুটা সাবধান হতে হবে, এই ভেবে আদিত্য নিজের কাজে মন দিলো।

======================