You are currently viewing মধুর আমার মায়ের হাসি…||  নুসরাত সুলতানা

মধুর আমার মায়ের হাসি…|| নুসরাত সুলতানা

মধুর আমার মায়ের হাসি…

নুসরাত সুলতানা

আমার মায়ের বিয়ে হয়েছিল নিজের চাইতে পনেরো বছরের বড় তাঁর স্কুলের মাস্টার মশাইয়ের সাথে। তাও আবার প্রেমের বিয়ে। সে নাকি এক হুলুস্থুল কাণ্ড! আমার মা খালেদা বেগম জানতেন না সেদিন তাঁর বিয়ে। তিনি ছিলেন তাঁর বড় বোনের বাড়িতে। মাস্টার মশাই এলাকার ডাকসাইটে আওয়ামী লীগ নেতা। খালেদা বেগমের বড় বোনের বাড়ি গিয়ে বললেন – অরে পাডাইয়া দ্যান। অর আইজগো বিয়া। শাড়িচুরি নিয়ে নেতা সাহেব হাজির। সঙ্গে নিয়ে গেলেন নিজের মেজ ভাইকে। কনেপক্ষের বাবা এবং অনেকেই রাজি না এই বিয়েতে। আবার বরপক্ষের অনেকে নিমরাজি।
বহুকষ্টে বর মশাই তাঁর মা’কে রাজি করিয়েছেন। যাহোক মাস্টার মশাই নিজের বাড়ি অনুষ্ঠান করলেন ধুমধাম করেই।

বিয়ের বছরে সাত মাসের মাথায়ই জন্ম নেয় এই প্রেমী যুগলের প্রথম পুত্র সন্তান। সাত মাসে জন্ম বিধায় সেই পুত্র সহজাত ভাবেই একটু নাজুক প্রকৃতির। পাঁচ বছর বয়স অব্দি তাকে নরম কেক, দুধ এসব খাওয়াতে হত।
আমার বড় ভাই কাঁদতে জানতেন না। তাকে আম্মু মেরে আবার নিজে কেঁদে দেখাতেন। উ উ এমন কইরা কান। তোরে মারছি তুই কান। এই অতি আদরের পুত্রকে তিনি আমৃত্যু মনু ডেকেছেন। তো এই মনুকে একদিন আব্বু ডেকে বলল- মনু শোন। আমি আইজ হারাদিনের লইগগা বাইরে যাই তুই গরু দুইডা দেহিশ।সন্ধ্যায় ফিরে আব্বু জিজ্ঞেস করল- মনু গরু দ্যাকছ? মাননীয় মনু কহিলেন – দ্যাকছি আব্বু। আব্বু আবার জিজ্ঞেস করল- কী দেকলি? মনুর সপ্রতিভ উত্তর- একবার দেকছি খাড়াইয়া রইছে আরেকবার দেকছি বইয়া রইছে। মায়ের মনুকে আমরা বাকি ভাইবোনরা দাদা বলে ডাকি।

দাদার জন্মের দুই বছর আট মাসের মাথায় এই রোমান্টিক দম্পতির দ্বিতীয় সন্তান বা বড় মেয়ের জন্ম।
হতচ্ছাড়া এই মেয়েটিই হচ্ছি এই গদ্য লেখক আমি। নুসরাত সুলতানা। একেবারে শৈশব থেকেই বাবা পূর্ণ নারীর সম্মান করেছেন। তাই দায়িত্ববোধ ও গড়ে উঠেছিল সেই শৈশব থেকেই। কেউ আমাকে নিজের কাজ করতে বললে রাগে গজগজ করতাম। আমাকে আম্মু কঠিন পরিশ্রমী করে গড়ে তুলতে চেয়েছেন। একবার রোযায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাড়ি গিয়েছিলাম। এই নিঠুর মনোহর আমাকে দিয়ে ধান সিদ্ধ করিয়েছেন, রোযা রাখাইছেন, রান্না করাইছেন, কোরান শরীফ খতম করাইছেন। তারপর সন্ধ্যার পরে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়লে উনি বলতেন- কোন লোমার ঢাকা ইউভার্সিটি পড় তুই? তোর লেহাপড়া নাই? উনি আমাকে বলতেন- পারি না বইলা কিছু নাই। যেহানে রুইবে হেহানে গজাবি। তবে পোলাউ খেতে পছন্দ করতাম বলে- দুই ঈদে বেশি করে পোলাও রান্না করতেন। পান্তা পোলাও করেও আমি খেতাম। সিন্ড্রেলা তেল মেখে লাল ফিতায় চুল বেঁধে দিতেন। যেই রাগ উঠত – উনার সামনে গিয়ে চুল খুলতাম। বেশি জেদি বলে আমাকে ডাকতেন পশুডা। তখন পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ি।
চাঁদে অভিযান একটা গল্প ছিল আমাদের বইয়ে। অই গল্প পড়ে – বললাম আম্মু চাঁদে কেমনে যায়? উনি বললেন – বেশি করে অংক করলেই চাঁদে যাওয়া যায়। আমি সারারাত উনার পায়ের কাছে বসে অংক করলাম। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষে। শামসুন্নাহার হলে পুলিশ প্রবেশের প্রতিবাদে উত্তাল আন্দোলন চলছে। হল ভ্যাকান্ট করে দিয়েছে। আমি আমার কারিগরকে জিজ্ঞেস করলাম- আম্মু হল তো ফাঁকা করতে বলছে। কী করমু? উনি বললেন- তোর কোনো দায়িত্ব নাই? যে মেয়েগুলোকে অত্যাচার করল ওদের কী দোষ? এই আন্দোলন শ্যাষ কইররা মাঠ ছাড়বি। এভাবেই উনি উস্কে দিয়েছিলেন সাধনা আর বিপ্লবে।

আমার চাইতে দুই বছরের ছোট আমার মায়ের তৃতীয় সন্তান। দ্বিতীয় পুত্র। এর ডাকনাম পরশ। চরম ফাঁকিবাজ এবং অলস এই ছেলে খুব ছোট বেলায়ই
আমার মা’কে ভীষণ যন্ত্রণা দিয়েছে। এই ছেলে দুই বছর বয়সে দিনে দুই কেজি দুধ খেত। ওর টয়লেট, বমি সব ছিল দুধ। দেড় বছর বয়সে ওকে নিয়ে আম্মুর পুরো চৈত্র মাস হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল। কারণ উনার নধরকান্তি সুপুত্র নিউমোনিয়া বাঁধিয়েছেন। একমাস আম্মু গোসল করতে পারেনি। তো এই আহ্লাদী পুত্র এমনই মিষ্টি খোর হল যে- ওর জন্য কাশির সিরাপ ঘরে রাখা যেত না। একবার কাশির সিরাপ ওপরে শেলফে রাখা। পরশ জানালা বেয়ে বেয়ে উঠছে সিরাপ খাবে।।
তো দাদা জিজ্ঞেস করে – অ কী পরইশশা তুই কী কর?
আর পরশ বলে যে- হুউউ। মুই এহোনো খাইনাই। মুই হপায় ধরছিই! একবার রোযার সময় আব্বু খেজুরের পাটালি কিনে আনলেন। দুপুরে আমাদের দুধ দিয়ে পাটালি দিয়ে ভাত দেবেন। এই ফাঁকে বলি আমার বাবা গরু পুষতেন। আমাদের দুইটা গরু থেকে দিনে দশ কেজি দুধ পেতাম আমরা। তো ভাত দিতে গিয়ে আম্মু দেখল- যে পাটালি অনেকখানি কেউ খেয়ে ফেলেছে। আম্মু জিজ্ঞেস করল- বাডালি মিডা কেডা খাইছে? আমরা সবাই বললাম যে আমরা খাইনি। পরশ বল্ল যে- আম্মো আফায় খাইছে আর মোরে দেছে। অথচ আমি খাইনি। আম্মু আমাকে মাইর দিল। বলল যে- তুই মিত্তা কতা কইলি ক্যা? সেই রাগ আম্মুর ওপর বহুদিন ছিল।
পরশ যত কুকীর্তি করুক না কেন ও খেয়াল করত আম্মুর মুখে পান আছে কি না। আম্মুর মুখ খুব লাল হত পান খেলে। আম্মুকে তখন অদ্ভুত সুন্দর লাগত।
তখন না কি আম্মু মারতে পারবে না। একটু বড় হলে পরশ আম্মুর দুই হাত জড়িয়ে ধরে রাখত আর বলত- আম্মো মুই আর করমু না। আর আম্মু ওকে মারতে পারত না।

এই দম্পতি এইবার থেমে যেতে চাইলেন। আর সন্তান গ্রহণ করতে চাইলেন না। কিন্তু গর্ভবতী হয়ে পড়লেন খালেদা বেগম। বাচ্চা নষ্ট করার জন্য ইঞ্জেকশন পুষ করলেন হাতে কিন্তু ইঞ্জেকশন ছিটকে বেরিয়ে গেল।
পরে উনারা মানত করলেন – সুস্থ বাচ্চা হলে আর ছেলে হলে মাদ্রাসায় পড়াবেন। এই সেজ পুত্রধনটির নাম ফেরদৌস। দুষ্ট’র শিরোমণি এই পুত্র। যদিও আমাদের বাপ কালো। কিন্তু এই পুত্র কালো মানুষ দুই চোক্ষে দেখতে পারে না। যেদিন প্রথম স্কুলে দেয়া হল সেদিন এক কালো ছেলে ওর পাশে বসেছিল। সেই কারণে স্কুল ছেড়ে চলে আসলো। কালা পোলার লগে মুই কেলাস করমু না- এই হল কথা। ছোট বেলা থেকেই উনার টাকা পয়সা লাগত। আব্বু ওর চুরি করার জন্য পকেটে টাকা রেখে দিত। তো ও একদিন আমার পরের ছোট ভাইকে মারল খুব। আম্মু ওকে ঘরের দেউড়ার ওপর মাথা রেখে ওর গলায় বটি ধরে বলল- তোরে আইজগো জবাই করমু। আর ফেরদৌস বলে- ও দাদা তুমি কই?
আম্মো মোরে জবাই করলে। আমরা চিৎকার করে বললাম – আম্মো অরে জবাই কইরো না। কিন্তু এই ভয়ানক রাগী মহিলার কাছে যাবার সাহস আমাদের ছিল না। একদিন চৈত্রের দুপুর বেলা আম্মু ফেরদৌসকে মেরেছে। ফেরদৌসকে কাঁদতে দেখে ওকে কোলে নিয়ে খড়ের গাদার ওখানে বসে আম্মুও কাঁদতেছিল। এরমধ্যে কারিগর বিড়ি বানিয়ে বিড়ি জমা দিতে যাচ্ছেন রানু ফুপু। আম্মুকে ফুপু জিজ্ঞেস করলেন- অ কী ভাবী ও কান্দে ক্যা? আম্মু বলে যে- অরে মারছি। রানু ফুপু আবার বললেন- আহারে! এই দুহাইররা কালে পোলাডারে মারলেন ক্যা? অমনি আম্মু বলে- যা মাগী এহাইনদা। আমার পোলা আমি মারছি।হ্যাতে তোর কী! ফেরদৌস খুব নগদ ফিটফাট বুঝত। ধরুন – ফেরদৌস মাছ ধরছে। ওর সমস্ত শরীরে কাদা লেগে আছে। হঠাৎ যদি ও শুনতে পায়- বাড়িতে মেহমান আসবে। সাথে সাথে মাছ ধরা রেখে উঠে হাত-পা না ধুয়ে গায়ে নারকেল তেল দিয়ে রেডি ফিটফাট । খুব ফর্সা আর স্বাস্থ্যবান, গোলগাল মুখের ফেরদৌস আব্বু-আম্মুকে একসাথে ঘুমাতে বা শুয়ে থাকতে দেখলেই এসে বলত- আফা, আফা বউ-জামাই ঘুমায়। বলে হি হি হি করে হাসতে থাকত। এই সেজপুত্রই ভারতের বেলভিউ হাসপাতালে আম্মুর সাথে তার জীবনের শেষ দিনগুলো কাটিয়েছে।

ফেরদৌস জন্মাবার এক বছর আট মাসের মাথায় জন্ম নিয়েছে মায়ের ছোট পুত্র আশীষ মাওলা। এই পুত্রকে আম্মু বলত- লাউল্লা বান্দর। আম্মু মারলে আমরা সবাই দৌড়াতাম। এই লাউল্লা বান্দর শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে মার খেত। আর দাঁত মুখ খিচিয়ে থাকত। আমাদের ছয় ভাইবোনকে ছয়টা ছোট পাটি বিছিয়ে খেতে দিত আম্মু। সবাই যখন বলতাম ভাত খামু না। আইশষা মানে আশীষ বলত- দে দে মোরে দে। আমরা সবাই ওর থালায় ভাত ঢেলে দিতাম। ওর প্লেটটা একটা ছোট ঢিবি হয়ে যেত। একটু পরে ও বলত- আম্মোরে ভাত খাইতে মোল্লায় না। আম্মু এসে ওর হাত ধুয়ে দিত। ওর দেড় বছরের মাথায় আমার ছোট বোনের জন্ম। তাই মাটিতে ধুলায় একা একা খেলে বড় হয়েছে। একটা লাঠি হাতে নিয়ে বলত- পিলাম, পিলাম কুত্তা পিলাম, পিলাম, পিলাম বিলাই পিলাম, পিলাম পিলাম আশীষ পিলাম। আরও বলত- কম্ব, কম্ব ভোন্দোইরারে লড়া।

সবশেষে আমার ছোট বোনের জন্ম। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, মাথা ভর্তি চুল। কী যে সুন্দর ছিল আমার মায়ের ছোট মেয়ে! একটা সাদা-কালো বিড়াল পুষতো সে। কালো ফ্রোক পরে যখন সাদা-কালো বিড়ালটাকে কোলে নিত তখন অদ্ভুত সুন্দর লাগতো ওকে।

আম্মু গোসল করতে গিয়ে পুকুরে ছুড়ে মারত আর ও ভয় পেয়ে ছুটে আসত। এভাবে ও দুই বছরে সাঁতার শিখে ফেলল। কারেন্ট গেলে স্বজন বলত- আম্মো মুই কই? বাকি পাঁচ ভাইবোনের ঠুয়া খেয়ে আমার এই বোনটা বড় হয়েছে। পড়াশোনায় চরম ফাঁকিবাজ এই বোনকে নিয়ে আমৃত্যু আমার মা দুশ্চিন্তা করেছেন।

আমার চার ভাই বর্ষাকালে ঘরের ভেতর ফুটবল -ক্রিকেট খেলে ফার্নিচারের কাচ ভাঙত। কিন্তু কিছু বলত না আম্মু। মারামারি করে যে নালিশ দিতে আসবে – তাকেই মারবে। পড়াশোনা আর নামাজ বা কোরান তেলাওয়াত ফাঁকি দিলে তাহলে রক্ষে নেই এই জাদরেল রমণীর হাত থেকে। যাকে মারবে তাকে দিয়েই লাঠি আনাবে। একদিন ফেরদৌসকে বলল- ফেরদৌস একটা লাডি আনতো বাবা। ফেরদৌস ভাবল- আম্মু আশীষকে মারবে। ফেরদৌস লাঠি নিয়ে গিয়ে বলল- আম্মো এই লাডি। অমনি ওর হাত ধরে সপাং সপাং লাগিয়ে দিল। পড়ালেহা বাদ দিয়া নাগরামি কর! আর করবি?

এই ছয় কিসিমের ছয়টি সন্তান বড় করে তাঁকে পরিনত বয়সে আরও দুটি সন্তানের ভার নিতে হয়েছিল। পরিস্থিতির চাপে পড়ে ছোট খালার দুই ছেলেকে আমার মাকেই লালন -পালন করতে হয়েছে। বড়টার নাম শমসের। ছোটবেলায় ছোট ছোট হাঁস-মুরগির বাচ্চা ধরে চেপে মেরে ফেলত। বড় হয়ে বেশ বুঝদার হয়ে গিয়েছিল। আমরা যখন সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলে আসি শমসের তখন আম্মুর সাথে থাকতো। আব্বুর তখন ডিমেনশিয়া হয়ে গেছে। শমসেরই সংসার সামলাতো। ওর ছোট ভাই রাদিনকে আম্মু কিছুতেই নিজের কাছে রাখবে না। কিন্তু রাদিন আম্মুর কাছেই থাকবে। তো রাদিন একদিন ক্লাস থ্রিতে বসে আম্মুর বিরুদ্ধে ওর সহপাঠীদের ক্ষেপিয়ে তুলল। বলল- ল মোরা পরী আফার কেলাস করমু না। মোরা বাইর অইয়া যাই। পরী আফায় খুব খারাপ। আম্মু যখন মারা গেলেন রাদিন শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র। ওর বন্ধুরা জানল রাদিনের মা মারা গেছে। এখনো রাদিন বলে- আম্মু আমাকে কখনো বলেনাই, তাঁকে ছাড়া আমার কীভাবে থাকতে হবে! রাদিন এবং শমসের আমাদের চাইতে তিনগুণ আদর বেশি পেয়েছে আমার মায়ের।

আমার মা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। ছয় ছেলেমেয়েকে পড়াশোনা করিয়ে নিজের হাতের চাল খেতেন। হাঁস-মুরগি, গরু পালতেন। বাড়ির আঙিনায় পুঁই, লাউ, কুমরা চাষ করতেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন, প্রতিদিন সুরা ইয়াসমিন, আর-রাহমান, ওয়াকিয়া, মুজাম্মিল পাঠ করতেন। আমরা সবাই আমাদের গ্রামের স্কুলে প্রথম হতাম। আমাদেরকে বলতেন- তোগো মানসে ভালো কয় ঠেইককা। তোরা অইলি – নাই দ্যাশে ভ্যারন বৃক্ষ।

নিজের চাইতে পনেরো বছরের বড় মাস্টার মশাই স্বামী তাঁকে খুব সমীহ করতেন। দিনে ষোল ঘন্টা পরিশ্রম করে অনেক সময়ই সন্ধ্যার পরে ঘুমিয়ে পড়তেন। আব্বু বলত- সূর্য দেবী সন্ধ্যা হলে নিদ্রা যায়। ছেলেমেয়েকে সহজে মারতেন না আব্বু। আম্মু যেই বলবে – পোলাপান শাসন করে না। অমনি আব্বু গিয়ে ধুপধাপ থাপ্পড় কষে বলবে- বদনাইশি করবি! ঝগড়া হলে আব্বুকে বলত- তোমারে আমার সংসার দিয়া বাইর কইরা দিমু। একেকদিন বাড়ি ফিরে যদি দেখতে পেতেন – আম্মুর অগ্নিমূর্তি আমাদের জিজ্ঞেস করতেন কী অইছে? সূর্য দেবী ক্ষ্যাপছে ক্যা? আমরা বলতে নিলে আব্বু বলত- আস্তে ক, কাল বৈশাখী আমার দিকে আইবে!

এই মাস্টার মশাই একবার নবম শ্রেণিতে বসে আম্মুর বান্ধবী নূরজাহান আন্টিকে বাংলায় তিন নাম্বার বেশি দিয়েছিলেন। এই খোটা স্বামী বেচারাকে জীবনের শেষ দিন অব্দি শুনতে হয়েছে। ঠোঁট বাঁকিয়ে বলত- ইহ! নুরজাহানরে নাম্বার বেশি দেছে! আর আব্বু হেসে বলতা- হ্যাতে কোন কাফাডা অইছে!

আজ যখন চাকরি করে একটা ছেলে মানুষ করে আমি হয়রান হয়ে যচ্ছি তখন অবাক বিষ্ময়ে ভাবি- এত বড় সংসার সামলে আটটি সন্তান কী করে তিনি পরম মমতায় লালন -পালন করেছেন! তারপর সামলেছেন শত শত ছাত্র-ছাত্রী। গরীব ছাত্র-ছাত্রীদের তিনি শুধু বিনা পারিশ্রমিকে বাড়িতে টিউশনই দিতেন না। প্রায়শই আম্মু তাদের খাওয়াতেন। ছাত্র-ছাত্রীরা পরী আফা বলতে অজ্ঞান ছিল। এলাকার মানুষের কাছে তিনি ছিলেন সার্বজনীন জননী। মারা যাবার পর দশ হাজার মানুষ তাঁর জানাযা পড়েছে। আমি ধন্য তাঁর আত্মজা হয়ে। স্যালুট সূর্যদেবী। তোমাকে ভালোবাসি।

নুসরাত সুলতানা
কবি ও কথাসাহিত্যিক
*****************************