You are currently viewing মিনার মনসুর: কবি ও কবিতার ভুবন

মিনার মনসুর: কবি ও কবিতার ভুবন

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ও হৃদয়মথিত কালো অধ্যায়ের নাম পচাত্তরের ১৫ই আগস্ট।এইদিনে বাঙালি জাতি হারিয়েছে তার সহস্র বছরের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। একদল নরপিশাচ একাত্তরে পরাজিত হায়েনাদের যোগসাজশে রাতের অন্ধকারে নির্মমভাবে হত্যা করে মুক্তিযুদ্ধের প্রাণপুরুষকে। এমন নৃশংসতায় বোবা হয়ে গিয়েছিলো পুরো জাতি। জাতির সেই বোবাকালে খুবই ক্ষুদ্রাকারে  ও ক্ষীণকন্ঠে শোকের সমুদ্র থেকে জেগে উঠেছিলো অল্পকিছু কন্ঠস্বর- মিনার মনসুর তাদের মধ্যে অন্যতম। বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের স্বপ্নাপ্লুত তারুণ্যের সেই মিনার মনসুর আজ দেশের একজন স্বনামখ্যাত কবি। তাঁর কবিতা ও কাব্যমানস নিয়ে মনমানচিত্র-এর এই প্রতিকৃতি আয়োজন।এই আয়োজনে সন্নিবেশিত হয়েছে মিনার মনসুরের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, একগুচ্ছ কবিতা, কাব্যভাবনা নিয়ে লিখেছেন শামস আরেফিন এবং বই আলোচনা করেছেন কামরুল হাসান।

 

 

 

 মিনার মনসুর: কবি ও কবিতার ভুবন

 

মিনার মনসুর বঙ্গবন্ধু-হত্যাপরবর্তী প্রতিবাদী সাহিত্যধারার নিবেদিতপ্রাণ এক কবি, সংগঠক ও গবেষক। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রথম মাইলফলক স্মারকগ্রন্থ ‘শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ’ সম্পাদনা ও প্রকাশ করেছেন ১৯৭৯ সালে। ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে বাংলা একাডেমি গ্রন্থটি পুনর্মুদ্রণ করেছে ২০২০ সালে। বঙ্গবন্ধুর তৃতীয় শাহাদত বার্ষিকী উপলক্ষ্যে ১৯৭৮ সালে প্রকাশ করেছেন বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত লিটলম্যাগ ‘এপিটাফ’। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে ‘আবার যুদ্ধে যাবো’ শিরোনামে একটি বিশেষ বুলেটিন প্রকাশ করেছেন ১৯৮০ সালে। এতে পঁচাত্তরের ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া তুলে ধরা হয়েছে। এটিও পুনর্মুদ্রণ করেছে বাংলা একাডেমি। ১৯৮৩ সালে সামরিক জান্তা কর্তৃক বাজেয়াপ্ত হয়েছে জাতির পিতাকে উৎসর্গকৃত তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘এই অবরুদ্ধ মানচিত্রে।’

বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদের পাশাপাশি তাঁর রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে অক্লান্তভাবে লেখালেখি করে চলেছেন চার দশকেরও বেশি সময় ধরে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তাঁর দুটি প্রবন্ধগ্রন্থ ‘আমার পিতা নয় পিতার অধিক’ এবং ‘বঙ্গবন্ধু কেন দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন’ বহুল পঠিত। কিশোর-তরুণদের জন্য তাঁর লেখা বঙ্গবন্ধুর জীবনভিত্তিক গ্রন্থ ‘অনন্য এক পিতাপুত্রীর গল্প’ ইতোমধ্যে ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। প্রকাশের অপেক্ষায় আছে বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব নিয়ে একটি অণুপুঙ্খ গবেষণাগ্রন্থ ‘কী ছিল বঙ্গবন্ধুর মনে’। তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে ‘মুক্তিযুদ্ধের উপেক্ষিত বীর যোদ্ধারা’ নামে গুরুত্বর্পূণ একটি গবেষণাগ্রন্থ।

লেখালেখির শুরু সত্তরের দ্বিতীয়ার্ধে। মূলত কবি। তবে গদ্যেও দ্যুতিময় তাঁর কলম। একেবারেই স্বতন্ত্র স্বর – সেটি কী সাহিত্যে কী ব্যক্তিত্বে। নিভৃতচারী হলেও নিরন্তর নিরীক্ষা এবং নিজেকে অতিক্রমণের প্রবল প্রয়াস তাঁকে করে তুলেছে বাংলা কবিতার বিশিষ্ট এক কণ্ঠস্বর। সহজতা ও সুদূরতা, অস্তিত্ব ও অস্তিত্বহীনতা এবং মৃত্যু ও মৃত্যুহীনতা হাত ধরাধরি করে চলে তাঁর কবিতায়। তবে প্রায়শ সবকিছুকে ছাপিয়ে ওঠে পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণ ও ধূলিকণার জন্যে অনন্য এক মমত্ববোধ।

বঙ্গবন্ধু পরিষদের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক এবং বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (কাদের চুন্নু) মনোনীত প্রার্থী হিসেবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু)-এর নির্বাচিত বার্ষিকী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন পঁচাত্তরপরবর্তী কঠিন সময়ে। শোককে শক্তিতে পরিণত করার প্রত্যয়ে তরুণদের সংগঠিত করেছেন। পরিচালনা করেছেন ‘শেকড়’ নামে একটি পাঠচক্র। প্রতিবাদী ও আপসহীন ভূমিকার কারণে সামরিক জান্তার রোষানলেও পড়তে হয়েছে তাঁকে। গদ্যপদ্য মিলিয়ে তাঁর প্রকাশিত ও সম্পাদিত গ্রন্থসংখ্যা ৩০টির অধিক। সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্যে ‘শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতিপদক’ (২০১৭) ও পটিয়া ফাউন্ডেশন প্রদত্ত গুণী সম্মাননা (২০২২)সহ পেয়েছেন বেশকিছু স্বীকৃতি ও সম্মাননা।

মিনার মনসুরের জন্ম ২০ জুলাই ১৯৬০ সালে চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার বরলিয়া গ্রামে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক (১৯৮৩) ও স্নাতকোত্তর (১৯৮৪)। উভয় পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর প্রাপ্তির জন্যে শহীদ নূতন চন্দ্র সিংহ স্মৃতি পুরস্কারপ্রাপ্ত। সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন দীর্ঘকাল। দৈনিক ‘সংবাদ’-এর সহকারী সম্পাদক ছিলেন। দীর্ঘ প্রায় এক যুগ কাজ করেছেন দৈনিক ইত্তেফাকের সহকারী সম্পাদক ও সম্পাদকীয় বিভাগের প্রধান হিসেবে। ২০১৯ সাল থেকে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। জাতীয় প্রেসক্লাবের স্থায়ী সদস্য এবং বাংলা একাডেমির জীবন সদস্য।

৩. উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ

কবিতা:

এই অবরুদ্ধ মানচিত্রে (১৯৮৩, বাজেয়াপ্ত);

জলের অতিথি (১৯৯৪)

কবিতা সংগ্রহ (২০০১)

মা এখন থেমে যাওয়া নদী (২০১২)

মিনার মনসুরের দ্রোহের কবিতা (২০১৩)

মিনার মনসুরের প্রেমের কবিতা (২০১৩)

পা পা করে তোমার দিকেই যাচ্ছি (কলকাতা, ২০১৬)

নির্বাচিত কবিতা (২০১৬)

আমার আজব ঘোড়া (২০১৯)

নির্বাচিত ১০০ কবিতা (২০২০)

ব্রাসেলসের সন্ধ্যাটি ছিল মনোরম (প্রকাশিতব্য)

গল্প:

অতল জলের টানে (২০১৭)

ছড়া:

চিরকালের নেতা (২০২০)

গবেষণা:

হাসান হাফিজুর রহমান: বিমুখ প্রান্তরে নিঃসঙ্গ বাতিঘর (বাংলা একাডেমি, ১৯৯৯)

ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত: জীবন ও কর্ম (বাংলা একাডেমি, ২০১২)।

প্রবন্ধ:

কবি ও কবিতার সংগ্রাম (২০১৩)

আমার পিতা নয় পিতার অধিক (২০১৯)

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শত্রুমিত্র (২০১৯)

বঙ্গবন্ধু কেন দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন (২০২১)

কী বার্তা বয়ে আনে ষাটোর্ধ্ব একুশ (২০২১)

কালান্তরে কবির মুখ ও মুখোশ (২০২১)

শেখ হাসিনার স্বদেশযাত্রা: কী ট্র্যাজিক কী মহাকাব্যিক (প্রকাশিতব্য)

জীবনী:

ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত (বাংলা একাডেমি, ১৯৯৬)

কিশোরগল্পগ্রন্থ:

জলপাইরঙের একটি হেলমেট আর এক জোড়া বুট (২০১৮)

কিশোরইতিহাসগ্রন্থ:

অনন্য এক পিতাপুত্রীর গল্প (২০২১)

An Extraordinary Father-Daughter Story (২০২২)

সম্পাদিতগ্রন্থ

শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ (প্রথম প্রকাশ: ১৯৭৯)

শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মারকগ্রন্থ (১৯৯৪, যৌথ)

শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের আত্মকথা (১৯৯৫, যৌথ)

মুক্তিযুদ্ধের উপেক্ষিত বীর যোদ্ধারা ( প্রথম প্রকাশ: ২০০৮);

বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি ও উন্নয়ন: বিশিষ্টজনের ভাবনা (প্রথম প্রকাশ: ২০১০)

সিকদার আমিনুল হক রচনাসমগ্র (২০১৫)

তারুণ্যের চোখে বঙ্গবন্ধু (২০২০)

মিনার মনসুর:  কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক। পরিচালক: জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র।

 

 

মিনার মনসুরের একগুচ্ছ কবিতা

 

কোথায় তোমার এত ঢালতলোয়ার?

তিনি কোনো আগন্তুক নন;

মোটেও অপ্রত্যাশিত নয় তার আগমন।

যেভাবে বিদ্যুৎ কিংবা পত্রিকার বিল নিয়ে আসে

ঝকঝকে জিন্স পরা অস্থির তরুণ;

আসে মুরগিওয়ালা, মাছের বেপারি, সেইভাবে–

ঠিক… ঠিক সেইভাবে তিনিও আসেন–

তুমি চাও বা না চাও!

বেজে ওঠে কলিংবেল একঘেয়ে স্বরে–

কখনো বাজে না তাও; তবু তিনি ঠিক পৌঁছে যান

প্রার্থিত গন্তব্যে তার এবং আচমকা

তুমি দেখো– নেই, নেই; যেখানে তোমার

হৃৎপিণ্ড রাখা ছিল– সেটি আর কোনোখানে নেই!

শুধু তোমার বেসুরো চিৎকার মাথা ঠুকে মরে

ইঁট-কাঠ-কংক্রীটের নিধুয়া পাথারে।

শুনে ডন কিহোতের ঘোড়ারাও মুখ টিপে হাসে–

ভ্রুকুঞ্চিত করে যত যুধ্যমান পাড়া-প্রতিবেশী!

তিনি আসছেন– যেভাবে আসেন তিনি সর্বদাই!

তফাৎ কেবল এই…এইটুকু যে এবার তিনি আসছেন

দামামা বাজিয়ে! প্রিয় পাড়া-প্রতিবেশী

কোথায় তোমার এত ঢাল-তলোয়ার?

 

সবাই তখন প্রমিথিউসকে খুঁজছিল

 

সত্যিই সেটি ছিল আমাদের এ যাবৎ কালের দেখা ভয়ঙ্করতম দুঃস্বপ্ন। আমি ক্রমাগত হাত-পা ছুড়ছিলাম আর ঘামছিলাম। আমার স্ত্রী চোখেমুখে জল ছিটাচ্ছিল আর আমার অবাধ্য হাতপাগুলোকে শান্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল অক্লান্তভাবে। আচমকা ধেয়ে আসা অতিকায় এক সাদা তিমির বিশাল কালো হা-এর ভেতর তলিয়ে যেতে যেতে আমি আবার ভেসে উঠি। আনন্দে লাফিয়ে উঠে ছুটে যাই রৌদ্রস্নাত ভোরের বারান্দায়– যেখানে তখনো দুটি দুরন্ত বুলবুলি ঝগড়া করছিল আর পুঁইশাকের বেগুনি ডগাটি মাথা নাড়ছিল আপনমনে!

আর তখনই তাকে ত্রস্ত ছুটে আসতে দেখি আমাদের পশ্চিম ধানমন্ডির সংকীর্ণ গলিপথ ধরে। এমন ভয়ার্ত মুখ কেউ কখনো দেখেনি আগে। যদি বলি তিনিই আমাদের আদিমাতা তাহলে সামান্যই বলা হবে। কত নিবিড়ভাবেই না চিনি আমরা তাকে– সর্বসংহা, অজাতশত্রু, শাশ্বত এ মাতৃমূর্তিটিকে! তার বিদীর্ণ বক্ষ থেকে ছিন্নভিন্ন মাংসপিণ্ডের মতো খসে পড়ছিল শত সহস্র সন্তানের শব!

হীরক ও স্বর্ণখচিত পদকগুলো ছিল পরিত্যক্ত। ঝলমলে পতাকাগুলো ছিল অর্ধনমিত। নাচঘর আর পানশালাগুলোতে উড়ছিল শোকের পতাকা। খাঁচাবন্দি শিশুদের অবাক হয়ে দেখছিল তাদের পোষা কুকুর ও প্রিয় পুতুলবাহিনী। বাতিগুলো নিভে আসছিল একে একে। বাতিগুলো নিভে আসছিল একে একে।

বাইরে খুব হট্টগোল। সবাই তখন প্রমিথিউসকে খুঁজছিল।

 

 

যুদ্ধ জারি আছে

 

জানি, তোমার অদৃশ্য থাবা দুমড়েমুচড়ে দেবে

দক্ষিণের বালাখানা– থেমে যাবে ক্লান্ত বায়ুকল।

সব, সবই কি থেমে যাবে!

তুমিই থামিয়ে দেবে মহাজাগতিক ঘড়ি? তুমি?

আমাদের সন্তানেরা তখনো থাকবে।

আমাদের সন্তানেরা তখনো থাকবে।

তাদের অকুতোভয় তরবারি আর ঝলমলে শিরস্ত্রাণ

সাক্ষ্য দেবে– যুদ্ধ জারি আছে, থাকবেই।

 

হিসাবটা সাদাকালো

 

সকালেই যাহা তিনশত নয় ঠিক

দুপুরেই দশরাজ!

গতকাল যিনি কুতুব মিনার তিনি

শুধুই সংখ্যা আজ।

মিনার ভাঙবে মিনার উঠবে– সূর্য

ফেরি করবেই আলো;

ফিঙেরা গাইবে বেলিরা দোলাবে মাথা–

হিসাবটা সাদাকালো!

টাকার পাহাড়ে গড়াগড়ি যাও কিংবা

সন্ন্যাস নাও বনে;

আখেরে তো সেই বিশাল শূন্য এক

খেলিছে আপন মনে।

 

 

তবু বুক কাঁপে

 

বলছি বটে যে– পাচ্ছি না ভয় মোটে;

ডুবলে ডুবুক– নাগনাগিনীর ভোটে

অনেক সাধের সপ্তডিঙ্গাখানি;

বণিকের মাথা ঠিক উঁচু রবে, রানি!

বলছি বটে যে– যত জারিজুরি তার

জানা আছে সব; করি না পরোয়া আর!

দেবী বা ডাকিনি–কিবা আসে যায় তাতে–

কলিজাই খাবে কিংবা মারবে ভাতে!

বলছি বটে যে– তৈরি হয়ে আছি; মাছি

দেখুক মানুষ– কলজেটা ধরে আছি!

শবভুক তুমি– তোমার দৌড় তো জানি–

তবু বুক কাঁপে–কাঁপছে ভুবনখানি।

 

 

সহস্র এক রজনীর গল্প

 

 

আমি বললাম, ‘তোমরা একে অপরের শত্রু হিসেবে নেমে যাও। পৃথিবীতে কিছুকালের জন্য তোমাদের বসবাস ও জীবিকা রইল।’[সুরা বাকারা, রুকু-৪, আয়াত-৩৬]

 

তাহলে লাল টিপ দিয়েই শুরু করা যাক সহস্র এক রজনীর গল্প…। শাহজাদি তার গোলাপি নেকাবে ঢাকা অবয়বে শীতসকালের ধলেশ্বরীর মতো আলো-জলে মাখামাখি অদ্ভুত এক ঢেউ তুলে বাঁকা চোখে তাকালেন সেনাপতির দিকে। সেনাপতি গর্জে উঠলেন: ‘ইউক্রেন নয় কেন?… খাঁ সাহেবের উইকেট যদি উড়ে যায়—দুনিয়াজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ক্যাপ্টেন্স হেরেমের হবেটা কী গো! কৌন বাঁচায়গা হামারে পেয়ারে ইসলাম কো! হা হা হা।’গোলাপি দুলতে থাকেন—দুলতেই থাকেন—যেন জবরদস্ত এক কাওয়ালির আসরে জাঁদরেল কোনো প্রতিপক্ষের মুখোমুখি তিনি। তার চোখ জেনারেলের উপচে পড়া গ্লাসে। আর তার গনগনে ঠোঁট থেকে অনিচ্ছুক আঙুরের মতো গড়িয়ে পড়ে কিছু শব্দ: ‘কথা তো সেই একই, জাহাঁপনা। প্রতি রাতে আমাদের একটি নাদুসনুদুস শিকার চাই। নাদুসনুদুস শিকার! তাকে কীভাবে মারা হবে, সেটা নির্ভর করছে আপনার মেজাজ-মর্জির ওপর। বন্দুকে অরুচি হলে আমরা টেঁটাও ব্যবহার করতে পারি। খাঁটি নরসিংদীর টেঁটা!’

 

পিষেই তো ফেলতে চাই আমি আপনাকে, আপনি আমাকে। টম অ্যান্ড জেরি। জেরি অ্যান্ড টম। আজ রাতে আপনি টম, আমি জেরি। আবার দাবার ছক পাল্টেও যেতে পারে এই রাতে কিংবা অন্য কোনো রাতে। সারকথা হলো, আপনি আমাকে নিয়ে খেলছেন, আমি আপনাকে। বিশাল এক দাবার বোর্ডের দুই প্রান্তে থাবা পেতে বসে আছি আমরা দুজন।কী দুঃসাহস! আপনার-আমার মাথা টপকে এরই মধ্যে বাচ্চা মেয়েটি স্কুটি নিয়ে উঠে যায় কুড়িল ফ্লাইওভারে। [তসলিমা নাসরিনের মতো] সেও কিনা ভাবছে, দুনিয়াটাকে ভড়কে দেবে! দেবেই তো। দেবেই তো। একশবার দেবে। হাজারবার দেবে। কেননা ওর পিঠে সিগ্রেটের পোড়া দাগ। ওর হৃৎপিণ্ডে মনুষ্যনখরের দগদগে ঘা।বাচ্চা মেয়েটি জানে না, কোনো খেলাই একতরফা নয়!

 

চোরাই মোটরবাইকের ওপর আপনিই বসে আছেন আজানুলম্বিত আলখেল্লা পেতে। আর আমি হেঁটে যাচ্ছি খামারবাড়ির ভাঙা ফুটপাত ধরে। ঈগলের চেয়ে তীক্ষ্ণ আপনার চোখ। কত উঁচুতে আপনার আসন, তারপরও মুহূর্তে সব দেখে ফেলেন। স-অ-ব। আর কী আশ্চর্য, আপনি হুকুম জারি করবার আগেই খাঁটি নরসিংদীর টেঁটার মতো নেমে আসে আপনার ভয়ংকর থাবা। কেননা শিকারের ঘ্রাণ পেয়েছে সে। নাদুসনুদুস শিকার!থাবা তো আর জানে না, শিকারটি অকস্মাৎ ঘুরে দাঁড়াবে। তার উদ্যত ফণা পৌঁছে যাবে আপনার কণ্ঠনালি পর্যন্ত। আর জানলেই-বা কী, গল্পটা তো শেষ পর্যন্ত শিকার ও শিকারির! চোরাই মোটরবাইকের ওপর আমিই বসে থাকতে পারতাম উত্তাল শরীরের মায়াবী টোপ ফেলে। আর হেঁটে যেতে যেতে জামাল খাসোগির মতো আচমকা বড়শিতে বেমক্কা ঝুলে যেতে পারত আপনার চর্বিবহুল দেহ।যুবরাজ জানে, কোনো খেলাই একতরফা নয়। কিন্তু পরোয়া করে না—কেননা তার আছে আলাদিনের আশ্চর্য এক চেরাগ।

 

 

ভলোদিমির জেলেনস্কি জেনেশুনেই ফাঁদ পেতেছিল। টোপও ছিল খাসা। আরেক ভ্লাদিমির ক্ষুধার্ত শ্বেতভল্লুকের মতো সেই টোপ গলা পর্যন্ত গিলে বসে আছে! দেখুন, ইউক্রেন যখন পুড়ছে, তার দেবদূতসদৃশ নারীশিশুসমেত, জেলেনস্কি তখন মুখ টিপে হাসছেন—বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি করছেন—সার্কাসের জোকারের মতো। বেকুব ভল্লুকটাকে এবার বরফজলে চুবিয়েই ছাড়বেন তিনি!‘শেহেরজাদি!’—হুংকার ছাড়লেন জেনারেল, ‘তুমি জানো, ওসব ফালতু গল্প শোনার সময় আমার নেই।’‘জাহাঁপনা, আপনিই তো শুনতে চাইলেন…।’‘তুমি কি অই বেকুব ভল্লুকটার মতো আমাকেও বেকুব মনে করো, অ্যাঁ? বরফসমুদ্রে যার জন্ম তুমি কিনা তাকে বরফজলের ভয় দেখাচ্ছ!’‘জাহাঁপনা, সে তো দুনিয়া জানে। [কেবল ভলোদিমির জানে না!]

 

 

আসলে সেটি ছিল সত্যিকারের এক রক্তসমুদ্র। তার ভাইয়ের রক্ত এসে মিশেছিল সেখানে। তার গর্ভধারিণীর সম্ভ্রম এসে মিশেছিল সে সমুদ্রে। তার পাড়া-প্রতিবেশী-স্বজন—যাদের সঙ্গে সে খেলত শৈশবে, তাদের রক্ত এসে মিশেছিল সেখানে। আত্মভোলা যে-কিশোরটিকে দেবে বলে যত্নে গেঁথেছিল বকুলের মালা—সেই অধরা স্বপ্নের রক্ত এসে মিশেছিল সেখানে। তাই সমুদ্রটিকে সিঁদুরের মতো আপন ললাটে ধারণ করেছিল মেয়েটি—মহামতি শিব যেভাবে তার জটায় ধারণ করেছিল স্বর্গজাত পবিত্র গঙ্গাকে।দিগন্তজোড়া সবুজ কলরোল নিয়ে সেই রক্তসমুদ্র এখন পতপত করে উড়ছে জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে—এমনকি ধূলিমগ্ন তেজগাঁও কলেজেও। আমাকে বলতেই হবে, জাহাঁপনা, সবটাই এক অলৌকিক তর্জনীর কারসাজি। এ হলো আমাদের আলাদিনের চেরাগ—যা কখনোই নির্বাপিত হয় না। তেরশত রক্তনদী পার হয়ে আলোকের সেই ঝরনাধারায় স্নাত হতে হতে সুবর্ণজয়ন্তীর কুসুমাস্তীর্ণ পথরেখা ধরে মেয়েটি হেঁটে যাচ্ছিল আনমনে [হয়তোবা গুনগুন করে গাইছিল—‘ও আমার দেশের মাটি…’], তখনই ষাঁড়টি গর্জন করে উঠেছিল। জাহাঁপনা, ঠিক তখনই।‘শহরে আবার ষাঁড় এলো কোত্থেকে? কী সব গাঁজাখুরি গল্প…!’গোস্তাকি মাফ করবেন, জাহাঁপনা। রেড ওয়াইনসহযোগে আস্ত দুম্বার রোস্ট খেতে খেতে ষাঁড়টিকে আপনি ঠিকই দেখেছেন কলোসিয়ামে, প্লাজা ডি তোরোসে, গুয়ের্নিকায়। কুরুক্ষেত্র থেকে, কারবালা থেকে, রায়েরবাজার থেকে, চুকনগর থেকে, বত্রিশ নম্বর থেকে, জালিয়ানওয়ালাবাগ থেকে, মিরপুর জল্লাদখানা থেকে, আউশউইৎস বন্দিশিবির থেকে অবিরাম ভেসে আসছে সেই শিংয়ের গর্জন।জাহাঁপনা, আপনি কি একটু দোচুয়ানি ট্রাই করে দেখবেন?

 

 

 

একজন ব্যতিক্রমী কবি মিনার মনসুর এবং তাঁর প্রেমের কবিতা 

শামস আরেফিন 

 

প্রেম বা আবেগের বহিঃপ্রকাশে পৃথিবীতে মানুষের কোনো বিভেদ নেই। এই বিভেদ না থাকার কারণেই আজও প্রেম নামের বেলি ফুল ফোটে আর পৃথিবীকে তার সৌরভে মুগ্ধ করে। প্রেমের এই দান-দক্ষিণার পেছনে দেবী আফ্রোদিতির যতোটা না অবদান- তার চেয়ে কিন্তু স্রষ্টার অবদান কোনো ক্ষেত্রে কম নয়। চাই সে-প্রেমের স্রষ্টা কবিতার কবিই হোক, বা হোক কোনো যুগল- যাদের পদভার বুকে ধারণ করে পুলকিত হয় পৃথিবী। প্রত্যেক কবিরই থাকে স্বীয় কাব্যভাষা। এ কাব্যভাষাই কবিকে অকবি থেকে আলাদা করে। সমাজ সংস্কৃতি, জীবনবোধ, আত্মবিশ্বাস ও কাব্যদর্শন- কাব্যভাষা বিনির্মাণে রাখে প্রধানতম ভূমিকা। তার পর কবিতার শরীর নির্মাণে রূপক, উপমা, অলংকার, চিত্রকল্প, শব্দ ও শব্দ-সংস্থান ইত্যাদির উপর নির্ভর করে দাঁড়ায় কাব্যভাষা। বছরের পর বছর লিখেও কোনো কবি নিজস্বকাব্যভাষা তৈরি করতে পারেন না। কালস্রোতে শুধু তার নামের আগে ‘কবি’ শব্দটি ব্যবহারের বৈধতা আদায় করেন। আবার কেউ মহাকালে টিকে থেকে সমসাময়িক কবিদের স্বীকৃতি না পেয়েও কবি হিসেবে বেঁচে যান। কারণ সময় বলে দেয় কে প্রকৃতি কবি- আর কে নয়। আর সেই সময় হচ্ছে পাঠক- যারা কবিতা বুকে ধারণ করে কবিকে অমরত্ব দান করেন।
নদীর যেমন বেঁচে থাকার প্রমাণ তার তেজস্বিনী স্রোতের উপস্থিতি, ঠিক তেমনি জীবিত কবির প্রমাণ হলো- নিজেকে ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে স্বীয় সুর ও কাব্যভাষার বিবর্তন। আর অবশেষে কাব্যভাষার স্বকীয়তা অর্জন করা। সেই স্বকীয়তা অর্জনের গুনেই যেমন ত্রিশের কবিদের মাঝে জীবনানন্দ দাশ বেঁচে গেছেন- তেমনি স্বকীয়তার তীব্র দ্যুতি না থাকার কারণেই অবশিষ্ট চতুর্থপাণ্ডব হারিয়েছেন নিজেদের ঔজ্জ্বল্য। সম্ভবত জীবনানন্দ জন্মাবেন বলেই নিস্প্রভ হয়েছিলেন তার সতীর্থরা। আর জীবনানন্দের বেলায় জর্জ বার্নাড শ’র উক্তি ‘Men live in the world to shine out his neighbour’ সত্য। তাই রুদ্র জন্মাবেন বলেই সকল দ্রোহ ও প্রতিবাদের ক্ষমতা স্রষ্টা হয়তো সবার মাঝে বিলীন করে দিয়েছেন। আবার আবিদ আজাদ জন্মাবেন বলেই প্রেমের সুমিষ্ঠ বিমূর্তভাষা যেন ছেলেধরার মতো চুরি হয়ে গেছে বাংলা কবিতার সত্তরের দশকে। এই সময়কার সবচেয়ে আলোচিত ত্রিপাণ্ডব বললে যে আর একজন কবির অনিবার্য উপস্থিতি প্রয়োজন- তিনিই মিনার মনসুর। না তাঁর কবিতা বন্ধু রুদ্রনির্ভর রাজপথ শাসন করে শুধু, না তাঁর কবিতা আবিদ আজাদের অতি কোমল সুরের মোহনায় বিমূর্ত চেতনার সমুদ্রে আমাদের ভাসিয়ে দেয়। তাই স্বভাবত প্রশ্ন জাগে- মিনার মনসুরের কাব্যভাষা কী? তিনি কি চিরকালই দ্রোহের প্রতিবিম্ব না চিরকাল প্রেমের প্রতিবিম্ব। না তিনি এই দুই-এর মাঝামাঝি সমান্ত রাল রাস্তা। তিনি আধুনিক হয়েও ভুলে যাননি গ্রামের স্পর্শ, আবার বিদেশি মিথের উল্লেখ করেও ভুলে যাননি এখানকার ‘একলব্য’-এর স্মৃতি। তিনি কখনোই বাংলা সাহিত্যকে শুধু গ্রিক মেদভুঁড়িতে আক্রান্ত করেননি। অলংকার ব্যবহারে সার্বজনীন হয়েও, নিজস্ব ভাষা সৃষ্টি করে তিনি গড়ে তুলেছেন স্বীয় সত্তা। তাই একবাক্যে বলতে হয়- মিনার মনসুরের কবিতা না প্রেম না দ্রোহ। বরং প্রেম ও দ্রোহের সমন্বয়ে দেশীয় ঐতিহ্যনির্ভর শুধু মাত্র বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বশীল কবিতা। দেশ নামক একটি স্বাধীন সত্তা অর্জনে যে যুদ্ধ- তিনি এর দ্বারা সরাসরি প্রভাবিত । তিনি সচেতনভাবে দেশকে কখনো উপস্থাপন করেছেন প্রেমিকারূপে, কখনো জীবনসঙ্গিনী , আবার কখনো জীবনই ভেবেছেন। তাই না তিনি পুরোপুরি মজনু, না পুরোপুরি তিতুমিরের মতো দ্রোহের অধিকারী। তাঁর এই বাস্তবতা অ্যাডর্ন পাবলিকেশন প্রকাশিত ‘মিনার মনসুরের প্রেমের কবিতা’র বেলায় সত্য। তিনি বিদেশি সাহিত্যভান্ডার দ্বারা যেমন বাংলা কবিতাকে সমৃদ্ধ করেছেন, ঠিক তেমনি গ্রিকমিথাক্রান্ত ভাগাড়-সাহিত্য রচনা থেকে বিরত ছিলেন। বাংলাদেশের সমাজ-সংস্কৃতি, মিথ, ঐতিহ্য লুকিয়ে আছে তার কবিতার পরতে-পরতে। তিনি গ্লোবাল ভিলেজ ধারণায় বিশ্বাসী না। তিনি ‘গ্লোবালাইজেশন অব পয়েট্রি১’র বদলে রচনা করেছেন বাংলাদেশের কবিতা।তাই কবিতায় ‘Kafkaesque২’এর মতো অলংকার ব্যবহার করেও তিনি বাংলাদেশের কবিতা লিখতে পারেন। কাফকার মতো দুশ্চিন্তা, ভয়, দুঃস্বপ্নের পরিমণ্ডলকে প্রাধান্য দিয়ে চারপাশের মানুষের করুণ অবস্থা তুলে ধরেন। তুলে ধরেন রাষ্ট্রের যুক্তিহীন আচরণ আর অমানবিকতার স্থির প্রতিচিত্র। তাই ‘চলে যাবো’তে বলেন, ‘নারী কুকুর, হোটেল মালিক, নষ্টগলির ভণ্ডকবি/সব শালাদের কসম খেয়ে বলতে পারি/ …কুত্তামরা, মানুষমরা, সদরঘাটের নারীমরা/এমনি কতো হাজার মরার গন্ধ মেখে/ এবার আমি চলেই যাবো/..নারী তুমি রাগ করো না হয়তো ক’দিন কষ্ট পাবে/ টাকা দিয়ে রূপ কিনবার মানুষ কি আর অভাব হবে/… ভণ্ড কবি তুই শালা


১ অর্থাৎ আজকের রক বা ব্যন্ড সঙ্গীতের মতো পশ্চিমা গান; যা উন্নয়শীল দেশে অনেক জনপ্রিয়। আর এই ব্যন্ড সঙ্গীতের মিউজিকে লালন-হাছনরাজরর গান গাওয়াই গ্লোবালাইজেশন অব লালন সঙ্গীত। যাতে লালন গীতির কথা থাকবে; কিন্তু হারিয়ে যাবে মৌলিক সুর। একইভাবে গ্লোবালাইজেশন অব পয়েট্রি মানে টিএসএলিয়ট বা পশ্চিমা আধুনিক কবিদের মতো কবিতা লেখা; যা বাংলায় লেখা হলে পশ্চিমা কবিতার মতো লেখা পশ্চিমাদের অনুসরণে। ২ ১৮৮৩-১৯২৪ সালের রচনাশৈলী যা দৃষ্টিকোণ ও বিষয়বস্তুর দিক থেকে ফ্রানজ কাফকার সাহিত্যকর্মের অনুরূপ রচনা।


আর যাবি কোথায়?/ জীবনটা তো পরের ঘাড়ে কর্মবমিুখ কাটিয়ে দিলি’। তিনি সব দুঃখ-বেদনাকে প্রকাশ করছেন কাফকার ধারায় কিন্তু ‘রূপ কিনবার মানুষ’, ‘কুত্তামরা গন্ধ’, নষ্ট গলির ভণ্ড কবি’ এবং ‘সব শালাদের কসম খেয়েও’ শব্দগুলো বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। এর মাধ্যমে তিনি সমাজবাস্তবতার করুণ অবস্থা তুলে ধরে নিরেট বাংলাদেশের কবিতা রচনা করেছেন। কবিতাটির রচনাকাল ১৭ মার্চ ১৯৭৯; বঙ্গবন্ধু হত্যাপরবর্তী গুমোট স্তব্ধতার মধ্যে রচিত। কবিতার ভাষা যেমন সহজ, তার সুরও তেমন হৃদয় ছুঁয়ে যায়। তাই বলা যায়- তিনিও এ উক্তিতে বিশ্বাসী, ‘আধুনিক কবিতার তথাকথিত দুর্বোধ্যতা হটিয়ে কবিতাকে লোকপ্রিয় করতে চাই।৩’
এই অবরুদ্ধ মানচিত্রে কাব্যগ্রন্থে কখনো কাব্যভাষা সৃষ্টি করতে তিনি আবুল হাসানের দ্বারস্থহয়েছেন। উচ্চারণ করেছেন- ‘প্রত্যাশার মায়াবী প্রাসাদে বেড়ে ওঠে সুতীব্র ধ্বংসের কীট’। আবার কখনো আল মাহমুদের স্বরে উচ্চারণ করেছেন, ‘তেমন আশ্বাস নির্ভরতা যদি দিতে পারো, প্রিয়তমা নারী/ আদিম অরণ্যে এসো ছুঁড়ে ফেলি সভ্যতার সুবেশী মুখোশ/পদাঘাতে ছিন্ন করি ধর্মকর্ম জরাজীর্ণ সামাজিক রীতি।’ তার পরও এই অবরুদ্ধ মানচিত্রে থেকেই নিজস্ব ভাষা তৈরিতে কবির নিরন্তর চেষ্টার সফলতা পাওয়া যায় ‘স্বীকারোক্তি’ কবিতায়। তিনি বলেন, ‘বিগত সনের পঞ্জিকার মতো এখনো তা ঝুলে আছে/ নিষ্প্রয়োজন অবহেলায়।’ বা ‘তোমার অপূর্ব ভেজা ঠোঁটে/শরতের শুভ্র কাশফুলের মতো /এখনো কি ফুটে আছে পৃথিবীর শুদ্ধতম হাসি?’

আবার ‘অনন্তের দিনরাত্রি’ কবিতার বইটি যেন আরও একটি নতুন বাঁক নিয়েছে। এখানে তিনি কখনো রুমি-হাফিজের ভাষায় আলুলায়িত করেছেন তার কাব্যভাষা। আবার কখনো আল মাহমুদের প্রভাব বলয় কাটিয়ে গড়ে তুলেছেন নিজস্ব কাব্যসত্তা ও কাব্যবিশ্বাস। রূপক-উপমা-চিত্রকল্পের সফল ব্যবহারে তিনি একের পর এক কবিতার শরীর বুননে বাবুই পাখির মতো শৈল্পিক দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। এ কবিতার বইয়ের মাধ্যমে তিনি মূলত রুদ্র ও আবিদ আজাদের কাব্যভাষা থেকে আলাদা নিজস্ব ভাষা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন। তাই তিনি এখানে কখনো ‘নিজের স্বপ্নের তীরে বসে ব্যর্থতার ঢেউ’ গুনে ক্লান্ত হন; আর বলেন, ‘…তুমিহীন অসার জীবন- গলিত শবের মতো এও এক/ আরোপিত কুৎসিত বোঝা!’। আবার কখনো জীবিকার বোঝা বহন করতে না পারার বেদনায় চিত্রকল্প আঁকেন- ‘এই যে আকাশ- অসীমতা যার/আদিম উপমা- সেও কি হঠাৎ/বেকার কবির ভাড়াটে বাসার মতো/তড়িঘড়ি ছোট হয়ে আসে/সে কি সাপে কাটা মানুষের মতো/অবয়বহীন গাঢ় বেদনায় ক্রমে নীল হয়?’ এ চিত্রকল্প পাঠ করে সহজেই উচ্চারিত হবে,‘ A poem may itself may be an image composed from a multiplicity of images’ এখানে চিত্রকল্পের গতানুগতিক সংজ্ঞা, ‘A picture made of word’ একেবারে অনপোযোগী হয়ে পড়ে।৪

লক্ষ্মীর পুজো দিতে-দিতে কবি রিক্ত হস্ত। কিন্তু তার প্রেমিকার প্রতি ভালোবাসা নিবেদনে কার্পণ্য নেই। তাই প্রেমিকার স্তুতি করতে দ্বারস্থ হন হাফিজ-রুমির। তাদের মতো প্রেমিকাকে খুশি করতে চেষ্টা করেন। তিনি বিশ্বাস করেন না শেখ সাদীর মতো- ‘বিয়েহীন বাচ্চা ও অর্থবিত্তহীন ভালোবাসা আকাশকুসুম কল্পনা’৫। তাই দৃঢ়তার সাথে প্রশ্ন করেন, ‘তোমার সান্নিধ্য গেলে/কেন জ্বলে ওঠে মুহূর্তেই বেদনায় ব্যর্থতায়/হিমায়িত মুমূর্ষ যৌবন?’ বলেন- ‘…তোমার অবাধ্য চুল/ কদাচিৎ ছুঁয়ে যায় বেদনায় দুমড়ানো/আমার শরীর;…’। তবুভালোবাসার আগুনে পুড়ে মোমের শরীর যে চিরতরে বিলীন হয় এটি জানেন কবি। কবি বুঝতে পারেন আলো
আঁধারির মতো প্রেমিকা। তাই বলেন, ‘আলো-আঁধারির পটে আঁকা সদা ছন্দময় এইটুকু মোমের শরীরে, বলো/ লুকিয়ে রেখেছো এতো মোহময় কিসের বন্ধন।’ প্রেমিকা সাড়া দিচ্ছেন না। তাই তিনি ক্ষিপ্ত। ভীরু প্রেমের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশে হন উদ্যত। তাঁর সমসাময়িক কবি রুদ্র যখন ‘মানুষের মানচিত্র ১’ কবিতায় ১৯৮৫ সালে বলেন, – ‘শরীর গুটায়ে রাখি শামুকের মতো যাই গুটায়ে ভেতর’ আবার ২০০৩ সালে আর এক কবির কবিতায় উচ্চারিত হয়, ‘শামুক বালিকার মতো খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসো’ তখন ১৯৭৯ সালেই সবার আগেই তিনি উচ্চারণ করেন-‘বিনষ্ট স্বপ্নের মতো সে কেমন ছোট হয়ে গেছে;/ ভীরু শামুকের মতো ক্ষিপ্রতায় গুটায় নিজেকে’। এ বই থেকেই মিনার মনসুর ও তাঁর সমসাময়িকদের পথ আলাদা হয়ে যায়। রুদ্র যেখানে পুরোপুরি রাজপথ থেকে পুরোপুরি ভালোবাসায় আচ্ছন্ন একজন মানুষ, অন্যদিকে মিনার মনসুর- প্রেম দিয়ে শুরু করেও দ্রোহেই শেষ জবাব দেন। তাই তিনি বলেন, ‘অনল নিঃশ্বাসে তার বিধ্বস্ত ফিলিস্তিনের মতো/ বারংবার ধসে যায় আমাদের আদিগন্ত স্বপ্নের প্রাসাদ’। আর তাই এতো আবেগঘন পঙক্তি রচনা করার পরেও দ্রোহের ভাব লুকাতে পারেন না তিনি।


৩ রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ ও কবি নুরুল হুদার কথোপকথন, নুরুল হুদা সম্পাদিত রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ রচনাবলী ১ এর ভূমিকা।
৪ সি. ডে. লিউইস তাঁর পোয়েটিক ইমেজ গ্রন্থে (১৯৪৮) বলেছেন দ্বীতিয় সজ্ঞাটি। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ক্যারোলাইন স্পার্জন তাঁর প্রভাবশালী গ্রন্থ শেক্সপিয়র ইমেজারি অ্যান্ড হোয়াট ইট টেলস এস এ সজ্ঞা প্রদান করেন। যাকে তিনি এক কথায় শেক্সপিয়রের নাটকে ‘ Cluster Image’ বলে উলে­ খ করেন। ৫ শেখ সাদী রচিত গুলিস্তা বুস্তা; রুবাইয়্যাত থেকে উদ্ধৃত


বাংলার লোকসঙ্গীতের ছায়াও তাঁর কবিতায় ভাস্বর। যেমন; ‘বন্ধু তিনদিন তোর বাড়িত গেলাম দেখা পাইলাম না’র আদলে তিনি তিনদিন মিলনের যে সুখ, তা উপস্থাপন করেন অনন্যভাবে। কখনো তিনি এই তিনদিনের সুখকে তুলনা করেন পৃথিবীর সবচেয়ে শ্রেয়তর দিন হিসেবে। আর বলেন, ‘পৃথিবীর দেহে কোনো অসুখ ছিলো না তিনদিন/বার্ধক্যের স্বভাবজ বিকৃত প্রলাপ কিংবা তার/ জন্মগত উন্মাদনা অলৌকিক গিয়েছিলো থেমে’। দেশীয় ঐতিহ্য থেকে এভাবে কাঁচা স্বাদের কবিতা তুলে আনাই কবির কাজ। সম্ভবত এ কারণেই পাবলো নেরুদা বলেছিলেন, ‘কবিতায় আমি যাত্রা শুরু করেছি বাল্যকালের সময়গুলোর উদ্ধৃতি দিয়ে। তখন বৃষ্টি আমার নিকট স্মরণীয় উপস্থিতি নিয়ে আসত। দক্ষিণের সেই ক্যাপহর্ণের মনমাতানো বৃষ্টি পাহাড় থেকে ঝরনা ঝরার মতো ঝরত।’ এভাবে যেমন তিনি তার আর্দশ ও বাস্তবতাকে তুলে ধরেন; ঠিক তেমনি ‘Epigram’-এর সংক্ষিপ্ত বুদ্ধিদীপ্ত-ব্যঙ্গাত্মক-জ্ঞানগর্ভ উক্তি দিয়ে প্রেমিাকাকে করেন ক্ষতবিক্ষত। তাই ইংরেজ লেখক যেখানে উচ্চারণ করেন,’We think our father fools, so wise we grow/ Our wise sons, no doubt, will think so৬। তেমনি কবি চরম যৌক্তিকতার ছাঁচে তার বক্তব্যকে ঢেলে উপস্থাপন করেন ‘ভালোবাসা পেয়ে যদি হারাতেই হয়,/ মাননীয় ডারউইন, আশীর্বাদ করো-/আমি যেন ফের সেই নিরেট বানর হয়ে যাই।’ অর্থাৎ যে ভালোবাসার জোরে মানুষের সভ্য হয়ে ওঠা, সেই ভালোবাসা না থাকলে তো মানুষের বানর হয়ে যাওয়া উচিত। আর শুধুমাত্র জৈবিক ক্ষুধা মেটাতে নতুন নতুন সঙ্গী নির্বাচন করে নিলেই হয়। এই ‘Epigram’৭ কবির কাব্যভাষায় জ্বলজ্বল করছে।
কবিতাকে তালাক দেওয়ার যেমন শাস্তি পেতে হয় কবির, ঠিক তেমনি হয়তো কবি মিনার মনসুর এক সময়কার তাঁর কাব্যজীবনকে তালাক দেওয়ার খেসারত দিচ্ছেন বর্তমানে। তার প্রণিধানযোগ্য কাব্যগ্রন্থ ‘আমার আকাশ’ যেখানে তিনি নিজস্ব সুর ও স্বর সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছেন। কবির মূল্যায়ন একজন সমালোচক পুরোপুরি কখনোই করতে পারেন না। একজন কবি ও কবির জীবনই তাঁর কবিতার সর্বোত্তম ব্যাখ্যা। মিনার মনসুরের জীবন ব্যাখ্যা করলেই বোঝা যায়, কীভাবে তিনি তার কাব্যভাষা বির্নিমাণ করেছেন। হয়তো দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন অতিক্রম করার কারণে, তিনি শতোবার পুরোপুরি প্রেমিক হতে চেষ্টা করলেও কোনো-কোনো ক্ষেত্রে না পেরে বলেন, ‘মেঘাচ্ছন মুখে শুধু নক্ষত্রের মতো জেগে আছে/নির্নিমেষ একজোড়া মর্মঘাতী চোখ।’। আবার মর্মঘাতী চোখের বেদনায় লাল হয়েও সম্পূর্ণপ্রেমিক হতে চেষ্টা করে জালালুদ্দিন রুমির মতো বলেন, ‘সেও কি আমার মতো ভালোবেসে একা হয়ে গেছে!’। কারণ তার ভাব-কবি রুমি বলেছেন,‘ভালোবাসা হচ্ছে ফুলের বাগান, যদি তুমি তাকে পছন্দ করো/তবে তুমি এখানে আসতে পারো?’

কবি রাজনীতিকে কখনো জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে ভাবতে পারেন না। সময়ের হিংস্রতা দেখে তিনি অবাক হন। সময় যেন তাঁর প্রতিযোগী হয়ে প্রেম করতে চায় প্রেমিকার সাথে। ছিনিয়ে নিতে চায় তার স্বপ্ন। তাই মর্মাহত কবি তাকে তুলনা করেন এভাবে, ‘এ বড়ো কঠিন যাত্রা একাকী আমার।/সামরিক গোয়েন্দার মতো চতুষ্পার্শ্বে/ওত পেতে আছে এক ভয়ানক প্রতারক কাল।… যাওয়াটাই একমাত্র অনিবার্য নিয়তি আমার।/তবু তুমি কেনো জেনেশুনে এ পথেই বাড়ালে পা!’। শুধু এতটুকুন বলেও যদি তিনি থামতেন তবে সত্তরের আবিদ আজাদ, রুদ্র মুাম্মদ শহিদুল্লাহ’র পর তাঁর অবস্থান থাকত। কিন্তু কখনো তা চিরস্থায়ী হত না। আর এই অবস্থান চিরস্থায়ী করার জন্য স্রষ্টা হয়তো তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছেন ‘মৃগয়া’র মতো কবিতা। যেখানে নিরেট গদ্যের ভাষায় কবিতা নির্মাণ করেছেন অনেকের আগে। তাই গদ্যের ভাষায় যতিচিহ্নের যথার্থ ব্যবহার করে তিনি ‘লিভস অব গ্রাস’-এর মতো গদ্যের শরীরে কবিতা লিখেছেন। যেমন: ‘প্রথমেই কেড়ে নেওয়া হলো তার স্বপ্ন। এরপর হরণ করা হলো নিদ্রা। ক্রমেই লুণ্ঠিত হলো তার চৈতন্যের মাটি, মর্মের মেদমজ্জা এবং বিশ্বাসের অন্নও জল।’ একইভাবে ওয়াল্ট হুইটম্যান যতিচিহ্নসহ নিরেট গদ্যে রচনা করেন-‘Still though the one I sing,/(One, yet of contradictions made,) I dedicate to Nationality,/ I leave in him revolt,
(O latent right of insurrection! O quenchless,/indispensable fire!)৮’ মূলত নব্বইয়ের কবিতার যে ব্যতিক্রমী বাঁক, তাও অনেকটা এর দ্বারা প্রভাবিত হয়তো। বলা যায়, জীবনানন্দ যেমন আধুনিক ইংরেজি কবিতার আদলে নির্মাণ করেছেন বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ভুবন, যাতে শুধু রচিত হয়েছে বাংলা বা বাংলাদেশের কবিতা। ঠিক তেমনি কবি মিনার মনসুরও বিদেশি


৬ মহাকবি আলেকজান্ডার পোপ-এর বিখ্যাত উক্তি। তিনি ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম প্রধানতম কবি হিসেবে খ্যাত। যেমন তার এমন আরও উক্তি ‘ A little Learning is dangerous thing’

৭ An epigram is a short, pithy saying, usually in verse, often with a quick, satirical twist at the end. The subject is
usually a single thought or event. The word “epigram” comes from the Greek epigraphein, meaning “to write on,
inscribe,” and originally referred to the inscriptions written on stone monuments in ancient Greece. The first-century
epigrams of the Roman poet Martial became the model for the modern epigram. The epigram flourished in sixteenth
and seventeenth-century England thanks to John Donne, Robert Herrick, Ben Jonson, Alexander Pope, Lord George
Byron, and Samuel Taylor Coleridge.৮ ‘Leaves of Grass’ by Walt Whitman


অলংকারের বাঙলায়নে শতভাগ সফল। এ কারণে তিনি আধুনিক কবি। কারণ আধুনিক কবির কবিতা- মাতৃভূমি- দেশ, সময় ও কালকে ধারণ করে। সে শুধু অন্ধপশ্চিমা অনুসরণ করে না, কারণ সে জানে আধুনিকতা মানে- সময়কে ধারণ করা। সময়ের চাহিদা পূরণ করা, পাঠকের হৃদয়ে অনুভূতির হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করা। স্বাধীনতা, ভাষা-আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, গণতন্ত্র হরণকারী হায়েনার মুখোমুখি হওয়া। মুখোমুখি হওয়া সত্য ও সুন্দরের। সময়ের সাথে সাথে কবির প্রেমের বিবর্তনও ঘটেছে। তিনি কখনো ছিলেন প্রেমিকাকে না পাওয়ার বেদনায় কাতর। আবার কখনো প্রেমিকার রূপকীর্তন করে বেদনাহত। সবসময় তিনি অভিজাত শ্রেণির প্রেম ‘Courtly Love’৯ নিবেদন করেছেন যেখানে সর্ম্পক কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত। অভিজাত প্রেমিক তার প্রেমিকাকে দেবী মনে করে প্রেমিকার যাবতীয় খেয়ালিপনা সত্ত্বেও প্রেমে অটুট থাকতেন। কবিও প্রেমে অটুট থেকে প্রেমিকার বিরোধিতা করা থেকে মনকে বারণ করছেন। মনকে প্রেমিকার অনুগত থাকতে বলছেন এভাবে, ‘মন তুমি সেরে ওঠো; সাইবেরিয়ার তীব্র তুষার ঝড়ের মতো/তোমাকে যে হিমায়িত করে গেলো তাকে ভুলে যাও/…সদ্য যুবতীর মতো বিপুল বর্ণাঢ্য সাজে বসন্ত নাড়ছে কড়া- নির্বাসিত দুয়ারে তোমার।/… এই তোমাকে ফেরাবে বলে/কিশোরী রোদেরা এসে ব্যাকুল বুলায়/হাত তোমার কপালে।…/ নিঃসঙ্গ গোলাপটিও স্বেচ্ছায় মেতেছে মৌনব্রতে;-/সেও শুধু তোমারই আশু রোগমুক্তি কামনায়-/ প্রিয় মন তুমি সেরে ওঠো।’
ঊনবিংশ শতাব্দীর তিন দশকের প্রধান লেখকদের মাঝে যে রোমান্টিক আদর্শ ও বৈশিষ্ট্যসমূহ ছিল তা হলোÑ ‘ঈড়সসড়হ ষরভব, ংবষবপঃরড়হ ড়ভ ষধহমঁধমব ৎবধষষু ঁংবফ নু সবহ, ঢ়ড়বঃরপ ফরপঃরড়হ’১০। ফলে কবিতায় যেমন একদিকে দেখা গেল সহজ সরল সাধারণ গ্রামীণ জীবন, অন্যদিকে অতীন্দ্রিয় অপার্থিব জগৎ যাতে প্রাধান্য পেয়েছে আবেগঘন উপলব্ধি। ঠিক ওয়াডসওয়ার্থ যাকে ‘লিরাকাল ব্যালেডস’Ñএর ভূমিকায় বলেছেন ‘অ ংঢ়ড়হঃধহবড়ঁং ড়াবৎভষড়ি ড়ভ ঢ়ড়বিৎভঁষ ভববষরহমং’১১। তাÑই কবি এখানে ‘শোকের বাল্মীকি’ কবিতায় বলেন, ‘অন্যের শয্যায় তুমি প্রতিরাতে নিজেকে নিঃশেষে/খুলে দেবে পেশাদার এক নিঃস্ব পতিতার মতো- এই ভেবে…/… তোমার বিচ্ছেদে যার সব দিনরাত্রি হয়ে গেছে/অনিবার্য শহীদ দিবস আর নিয়ত একুশে ফেব্রুয়ারি;/ সে এখন তোমাকেই শহীদ মিনার ভেবে নিত্য ফুল দেয়-/… যে নিজেই হয়ে গেছে শোকাতীত এক শোকের বাল্মীকি আর/দুঃখের অক্ষয় রামায়ণ- সে কি আমি?’ এখানে অনুভূতির যে ব্যাপ্তি, তা পাঠককেও আক্রান্ত করে। সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা ব্যবহার করে, জীবন থেকে কবিতার কাঁচা স্বাদ আস্বাদন করে কাব্যভাষার বিনির্মাণের জন্য অবশ্যই কৃতিত্বের দাবিদার মিনার মনসুর। যে কাব্যভাষায় কখনো রুদ্রের মতো দ্রোহ প্রবল হয়নি, আবার আবিদ আজাদের মতো বিমূর্ত ভাবনার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে চারপাশ হারিয়ে যায়নি। এ এক সমান্তরাল প্রেম ও দ্রোহের শরীরের কবিতার সুমিষ্ট কাব্যভাষা যা শীতের কাঁচা খেজুরের রসের মতো তৃপ্তিদায়ক। কিন্তু তা যেমন আগুনে পুড়ে পাটালি গুড় বা দ্রোহে ভাস্বর রুদ্র হয়নি, তেমনি জাল দেয়ার পর আলুলায়িত দেহে মাখামাখা আবিদ আজাদের স্বাদ হয়নি।


৯ Courtly Love’s Main characteristics: 1. The poet sings the joy of his love, which is an exalted feeling. 2. He praises
and extols the woman he loves, who is superior and can be approached only with veneration and restraint. 3. Love is
a passion that affects the lover’s body and soul and tends to unbalance him 4. The lover becomes his lady’s servant.
Her love must be difficult to obtain, and he must prove his valor and faithfulness. The relation between lady and
lover is envisioned, often in the poetic imagery used as well as in manuscript illustrations, as a transfer of the feudal
relationship between lord and vassal 5. The effect of this love is that the male lover becomes ennobled in his whole
being, including his fighting power, social mores, and moral and religious attitudes. 6. In some cases, this
ennoblement is caused by the very thought of the beloved lady. 6. In some cases, this ennoblement is caused by the
very thought of the beloved lady.
১০ Wordsworth argues that poetry should concern itself with everyday life as experienced by common man. Equally
important, the language of poetry should be the kind of language most men use and understand. In this brief
passage, Wordsworth states his belief that poetic composition should center on the reality of the common man and
that poetic diction should reflect real speech. “Language really used by men” did not mean, however, the various
dialects used throughout Britain; rather, it meant that language which everyone used and understood–a dialect that
everyone had in common.
১১ “Spontaneous overflow of powerful feelings”, Wordsworth opines that poetry is a matter of mood and
inspiration. Poetry evolves from the feelings of the poet. Poetry’s source is the feeling in the heart, not the ideas of
the intellect. A poet cannot write under pressure. In this regard, poetry flows out of his heart in a natural and fluent
manner. Deep emotion is the basic condition of poetry; powerful feelings and emotions are fundamental. Without
them great poetry can not be written.


সত্তরের কবিদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য- তারা প্রতিবাদপ্রবণ ও সংগ্রামী। সম্ভবত স্বাধীনতা আন্দোলন, স্বৈরশাসন পরবর্তী সামাজিক অবক্ষয়ই তাদের সরাসরি প্রতিবাদ করতে উদ্বুদ্ধ করে। তাই যখন রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ রচনা করেন, ‘বেশ্যাকে তবু বিশ্বাস করা চলে, রাজনীতিকের ধমনী শিরায় সুবিধাবাদের পাপ…’। তখন হয়তো প্রেমের প্রতি আস্থা বাড়ানোর জন্য তিনিও সরবে উচ্চারণ করেন ‘অর্ন্তযাত্রা ২২ ফেব্র“য়ারি ১৯৯০’ ‘দুঃখের তাবৎ পৃথিবীর নামে আমার শপথ:/ সত্য ছাড়া কারো প্রতি পক্ষপাত আমার হবে না।’

কবি শব্দ নিয়ে খেলা করেন। শব্দের ব্যবহারিক অর্থ পাল্টে দেয়াই কবির কাজ। শব্দকে নিয়ন্ত্রণ করে গড়ে ওঠে তার বাক্য। বাক্যের নিজস্ব আঙ্গিক ও শব্দ প্রয়োগই স্বীয় কাব্যভাষা বিনির্মাণে প্রস্তুত করে। যেমন ভাস্কর্য শব্দটিকে যখন এভাবে ব্যবহার করা হয় ‘এই সেই আরাধ্য সুন্দর-/পাথরে খোদাই করা যেন দুঃখের ভাস্কর্য এক’। তখন ‘ভাস্কর্য’ শব্দটি দুঃখকে এক চিরঞ্জীব ঘাতকের মতো উপস্থাপন করে। তা হৃদয়কে দুমড়েমুচড়ে দেয়। এই যে বেদনা বা মর্মাহত হওয়ার অনুভূতি পাঠকের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া বা প্রমথ চৌধুরীর ভাষায়, আনন্দ ও বেদনার সংক্রমণ সাহিত্যের মাধ্যমে, ১২ তা-ই একজন প্রকৃত কবির সফলতা। এ কারণে ‘আমার আকাশ’ কাব্যগ্রন্থ থেকে ‘জলের অতিথি’ পর্যন্ত তাঁর স্বরূপ খুব ভালোভাবেই ফুটে উঠেছে। তাঁর কবিতার প্রভাবে সমসাময়িক অনেকে প্রভাবিতও হয়েছেন। যেমন ‘কুশল সংবাদ’ কবিতায় তিনি বলেন ‘তুমি নেই তবু কী চমৎকার আছি দেখে যাও;-/ এখনো স্মৃতির মতো তরতাজা ভোর এসে নিত্য/কড়া নাড়ে আমার দুয়ারে।…/ জমে থাকা জিজ্ঞাসার মতো জমকালো রাত্রির রাধারা এসে/ভালোবেসে জড়ায় আমাকে’। তারই সমসাময়িক এক কবি এতে প্রভাবিত হয়ে বলেন, ‘রৌদ্র যদি কড়া নেড়ে হাজির হয় রৌদ্র বিল নিয়ে’। অর্থাৎ তিনি যেহেতু ভোরকে দাঁড় করিয়েছেন, তাই তাঁর বন্ধু ২০০৩ সালে কিশোরীকীর্তনে রৌদ্রকে দাঁড় করিয়েছেন। ঠিক একইভাবে ‘প্রিয় ইথাকা আমার’ কবিতাটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এখানে কবি প্রিয় ইথাকা বলতে বাংলাদেশকে বুঝিয়েছেন। যাকে কবি প্রশ্ন করেন, ‘বাংলাদেশ প্রিয় ইথাকা আমার, তুমিও কি হয়েছো পাথর!’ এখানে তিনি বাংলাদেশকে বসিয়েছেন প্রেমিকার স্থানে। তারই সমসাময়িক কবি বলতে বাধ্য হন, ‘বাংলাদেশ নামের মেয়েটি পা দোলায়’। একজন বড়ো কবির কবিতায় সমসাময়িকরা প্রভাবিত হবেন এটাই স্বাভাবিক। উক্ত পঙক্তিতেও ঠিক একই ঘটনা ঘটেছে। তাই তিনি যখন একই কবিতায় বাংলদেশকে প্রেমিকারূপে কল্পনা করে লেখেন, ‘আমাদের উষ্ণ আলিঙ্গনগুলি/ নতুন পলির মতো সুফলা করেছে বন্ধ্যা মাটির শরীর’, তখন আমরা বুঝতে পার-দেশপ্রেম যদি বাংলাদেশ নামের রূপসীর সাথে মিশে যায়, তবে অনুন্নত বাংলাদেশ স্বনির্ভর হয়ে পড়বে। আর তাই তরুণরাও এর দ্বারা আক্রান্ত হয়।

উপমা অনেক কবিই ব্যবহার করেন। কিন্তু উপমা ব্যবহারে এত পরীক্ষা-নিরিক্ষা খুব কম কবির মধ্যে লক্ষ করা গেছে। তিনি ‘পেত্রার্কিয়ান কনসিট’১৩ বা পেত্রার্কীয় উপমাও ব্যবহার করেছেন অত্যন্ত সাবলীলভাবে। কিন্ত তা কখনো মুড়িয়ে যায়নি ইংরেজির মতো। কারণ পেত্রার্কীয় উপমা তিনি বাংলার দৈনন্দিন জীবনের সাথে মিশিয়ে দিয়েছেন- যা পাঠকের অনুভূতিকে নাড়া না দিয়ে পারে না। যেমন; ‘চকিতে তোমাকে দেখলাম চৌরাস্তার মোড়ে। /চতুর্দিকে পরিত্যক্ত পতিতার মতো অর্ধনগ্ন/ শায়িত পাহাড়;…।’ অথচ স্বয়ং শেক্সপিয়রও এ ধরনের উপমার সমালোচনায় ছিলেন মুখর। শেক্সপিয়র এর সমালোচনা করে বলেন, ‘My mistress eyes are nothing like the sun/ Coral is far mor than her lips১৪’। শুধু মাত্র দেশীয় ঐতিহ্য ব্যবহারের কারণে এ ধরনের উপমা ব্যবহার করেও সমালোচনা থেকে মুক্তি পেয়েছেন কবি; যেমন; ‘হুড-তোলা চলন্ত রিক্সায়; যেন ছুটন্ত অতীত/অলৌকিক পড়েছিলো ঢুকে ব্যস্ততম বর্তমানের জংশনে।’ পেত্রার্কের মতো তা এতো গম্ভীর হয়ে যায়নি যে সমালোচকরা তার সমালোচনা করতে পারেন। কারণ এ উপমা আমাদের সমাজবাস্তবতা থেকেই নেয়া। তা কিন্তু আবিদ আজাদের মতো উচ্চারণ করে না, ‘যে শহরে আমি নেই আমি থাকবো না/ সে শহরে বুড়ো বার্মিজ মহিলার মতো তোমাকে ঘিরে থাকবে ভৌতিক নির্জনতা’১৫।


১২ প্রমথ চৌধুরী; সাহিত্যে খেলা।

১৩ ) The Petrarchan conceit is a type of metaphor used in love poems written by the 14th-century Italian poet Petrarch, but became cliched in some of his later Elizabethan imitators. A typical Petrarchan conceit involves a cold, imperious beauty and her distressed male lover, who suffers from the lady’s rejection, while praises her beauty, her cruelty and exaggerates his own misery. For example, the despairing lover is a ship on a stormy sea, or a lady’s eyes shine like stars, her lips are as red as coral, her breasts and her
forehead are as white as snow, and so forth.১৪ সাহিত্য কোষ;কবির চৌধুরী১৫ কবিতা: যে শহরে আমি নেই আমি থাকবো না, ‘বনতরুদের মর্ম’, প্রকাশকাল: ১৯৮২, আবিদ আজাদ


রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ বলেছিলেন, ‘রাজনীতিহীন সাহিত্যচর্চা কপটতা ছাড়া আর কি?’ কেননা রাজনীতি কবির আদর্শের মাপকাঠি। সামাজিক দায়বদ্ধতা কখনো কবি এড়িয়ে যেতে পারেন না। কবিতা হবে সমাজ, সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। কবিতা যেমন হতাশের বুকে আশা জাগাবে, তেমনি দুর্নীতিবাজদের চপেটাঘাতে করবে পর্যদুস্ত। এ বাস্তবতাই যদি কবিতায় না থাকল, তবে কবিতার সততা কতটুকুন টিকল। সত্তরের রাজনীতি-সচেতন, নিভৃতচারী কবি হিসেবে খ্যাত মিনার মনসুর। ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘এই অবরুদ্ধ মানচিত্রে’ বাজেয়াপ্ত হয়। শেষ কবিতার বই প্রকাশিত হয় ২০০১ সালে। তারপর কবিতার অলিগলিতে কবিকে খুব একটা দেখা যায়নি। দীর্ঘ বিরতির পর গত বছর প্রকাশিত হয় ‘মা এখন থেমে যাওয়া নদী’। শিরোনাম শুনেই মনে হবে, এ যেন নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত কোনো কবিতার বই। এখানে স্মৃতিরা যেন তাঁর সঙ্গ ছাড়তে চায় না; নস্টালজিয়ায় মন যেন ডুবে থাকে কবির। এ কারণে ‘অশরীরী ঈগলের ছায়া’ কবিতায় তিনি বলেন, ‘আমাদের নাম ধরে ডাকে পেছনের ফেলে আসা পথ…/যুগল স্বপ্নের কিছু হাড়গোড় আর সাইবেরিয়ার হংসের মতন/ধবধবে শাদা সেইসব প্রতিশ্র“তির ফসিল’। এই যে শব্দের ঝংকার তা হৃদয় না ছুঁয়ে পারে না। একে Allusion বললে ভুল হবে না। কারণ এখানে কবি পরোক্ষভাবে উলে­ খ করে বাস্তবতাকে আরও তির্যক করে তুলেছেন। এভাবেই কবি যখন বলেন, ‘মহাপরাক্রান্ত পতাকা’, ‘সমুদ্রের সম্মোহন’, ‘শীতের তীক্ষè দাঁত’, ‘প্রিয়তম দশকেরা’, ‘ধুলোর চাবুক’, ‘বাঁধভাঙা প্রাণের প্লাবন’, ‘রূপসী রাজনীতি’, ‘বর্ষণের তীক্ষ্ম শর’, ‘বাচালতার বীজ’, তখন তাঁকে সত্তরের আবুল হাসান না বললে ভুল হবে।

উপমায় যেন কবিতার বইটি ষোড়শীর মতো। কবি এ কবিতার বইয়ে পাঠককে ভিজিয়ে দিয়েছেন উপমার বৃষ্টিতে। তিনি যখন বলেন, ‘অন্ধকার অক্টোপাশের মতো নৃত্য করে তাকে ঘিরে।’ বা ‘কে হায় মূর্খের মতো জড়ো করে স্মৃতি সোনার শো-কেসে’, বা ‘কোথাও বৃক্ষের ডালে কিংবা বিদ্যুতের তারে মৃত হলুদ ব্যাঙের মতো ঝুলে আছে এক কিশোরী পুতুল’ বা ‘চোখ যার মৃত ইলিশের মতো- তখন পাঠক বুঝতে পারে উপমা কীভাবে কবিতা হয়; উপমা কেমন করে ছুঁয়ে যায় হৃদয়ের প্রতিটি কোণ। কীভাবে প্রমাণ করা যায়, একটি সাবলীল উপমা একটি কবিতার প্রাণ? আর জীবনানন্দ কেন যে বলেছেন, ‘উপমাই কবিতা’-তা বুঝে আসে।
নারী সকল কবিতায় কমবেশি গুরুত্ব পাবার বিষয়। পৃথিবীর অর্ধেক সৌন্দর্যের আধার এই নারী। তাই তার হাতে হৃদয় বন্ধক রেখেই কবিতা লেখা কবির স্বভাব। এ ক্ষেত্রে মিনার মনসুরও ব্যতিক্রম নন। তাঁর কবিতায় আমরা কখনো নারীকে দেখি সুবিধাবাদী পিংকিরূপে। যাকে কবি চিত্রায়িত করেন এভাবে, ‘পিংকিরা চলিয়া যায় বারংবার কবিকে মথিত করে’। আবার কখনো সেই নারীর রূপেই কবি মুগ্ধ হন। মৃত্যুর চেয়ে নারীর সৌন্দর্যের দাপটে আপ্ল ুত হয়ে বলেন, ‘মৃত্যুর দাপট কে বলে অধিক নারীর বক্ষের চেয়ে?’। এই যে নতুন যুক্তি দাঁড় করিয়ে পাঠককে ভাবিয়ে তোলা, এই যে সাধারণ বাস্তবতাকে অসাধারণ উপস্থাপনায় দর্শন করে তোলা, তা কেবল মিনার মনসুরের পক্ষেই সম্ভব। একজন কবি যে শুধু চিত্রাতীত বাস্তবতা তুলে ধরে উপমানির্ভর হন, তা সবসময়ে সত্য নাও হতে পারে। বরং কবিতার আকাশে তার ব্যতিক্রমও হতে পারে। তাই নারীও যে ফুলের মতো ফুটতে পারে, তা কবি ছাড়া আর কে ভাবাতে পারে- যেমন; ‘এই যে অপরূপ নারীফুল ফুটিয়াছে- তাহার সৌরভে মোহিত চারিদিক’ তখন সহজেই বোঝা যায় ফুলের গন্ধে যেমন মাতোয়ারা হয়ে থাকে চারিদিক, তেমনি সুন্দরীর সৌন্দর্যে চারিদিকে অবস্থানকারী কবির মন মোহিত হয়ে থাকে। সত্যিকার অর্থে একজন কবির সার্থকতা এই যে, তিনি পাঠকের নতুন ভালো লাগার বিষয় তৈরি করবেন। সৃষ্টি করবেন এমন কিছু শব্দ, যা হৃদয়কে ভিন্নভাবে নাড়া দেয়। মন ছুঁয়ে যাওয়ার তো অনেক মাধ্যম আছে, তবে তার মাঝে কবির মন ছোঁয়ার ভাষা হবে ব্যতিক্রম। তাই নারীর প্রতি অনুভূতি প্রকাশে তিনি যখন বলেন, ‘কলসি ভরাই ছিল তবু বুকে তৃষ্ণার তুফান’ বা ‘নারীর নিতম্বের ঢেউ কিংবা চোখের বিদ্যুৎ’ বা ‘অনিচ্ছুক শাড়ি দিয়ে ঢেকে দিতে চায় প্রমত্ত বুকের উচ্ছাস’ তখন বাঙালি নারীর সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে আমাদের আর কিছু পাঠের প্রয়োজন হয় না। এই ধরনের শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করে, তিনি অসংখ্য অসাধারণ চিত্রকল্প তৈরি করেছেন। শব্দের সাথে শব্দের গাঁথুনি দিয়ে যে চিত্র তৈরি করা হয়, তাকেই যদি বলা হয় চিত্রকল্প, তবে এর চাইতে সুন্দর চিত্রকল্প নারীকে নিয়ে আর কী হতে পারে! তাঁর প্রতিটি কবিতার পঙক্তিতে আমরা খুঁজে পাই সম্মোহনী চিত্রকল্প। চিত্রকল্পের নায়ক বিখ্যাত কবি এজরা পাউন্ড হয়তো তাঁর এ পথ চলাকে জীবিত থাকলে স্বাগতই জানাতেন। কারণ তিনিই মনে করতেন, ‘Image is the basic unit
of poetry’১৬ আর এ বাস্তবতা সত্তরের কবিদের মাঝে নান্দনিকরূপে উপস্থিত মিনার মনসুরের কবিতায়; যা পাঠকের মনে প্রেম, দ্রোহ ও নারীর প্রতি আকর্ষণের নতুন মাত্রা সৃষ্টি করে না পাওয়ার বেদনাকে উসকে দেয়।

ফরাসি দার্শনিক দেকার্ত’-এর হাত ধরে কবিতায় ‘ডিসকোর্স অন মেথড’এর আগমন। এ হচ্ছে এমন এক ধরনের উচ্চারণ, যার একদিকে বক্তা কবি অন্যদিকে পাঠক বা শ্রোতা। আর এই ডিসকোর্সের বাস্তবতাও আমরা খুঁজে পাই মিনার মনসুরের বইটিতে। যেমন; ‘ছেলেটি কোথায় তাতে কী-বা আসে যায়! শুধু মেয়েটি উড়ুক!’। এ ধরনের মনোমুগ্ধকর ডিসকোর্স সত্তরের হাতে গোনা


১৬ A brief, intentional reference to a historical, mythic, or literary person, place, event, or movement. “The Waste Land,” T. S. Eliot’s influential long poem is dense with allusions. The title of Seamus Heaney’s autobiographical poem “Singing School” alludes to a line from W.B. Yeats’s “Sailing to Byzantium” (“Nor is there singing school but studying /Monuments of its own magnificence”).


কয়েকজন কবির সম্পদ। তাঁর এ শক্তি প্রকৃতি থেকে সঞ্চারিত। আবেগের শৈল্পিক প্রকাশও নিজস্ব। কবিতার সম্মোহনী শক্তিতে তিনি সহজেই অভিভূত করেন পাঠককে। তার নিভৃতচারী মনোভাব যেন এ শক্তিকে আরও সীমা অতিক্রম হওয়ার পর্যায়ে নিয়ে গেছে। আবুল হাসানের ভাষা শৈলী ও সিকদার আমিনুল হকের অসাধারণ দর্শনের সমন্বয় এই বইয়ে তাঁকে একটি আলাদা কাব্যভাষার আকাশ বিনির্মাণে সক্ষম করে তুলেছে। তিনি তাঁর সমসাময়িকদের মতো শুধু ‘Discourse dependent poet’১৭ নয়, যে শুধু বালিকাকীর্তনে ব্যস্ত বা ছন্দের ভারাক্রান্ত নুয়ে পড়া পদ্যের রচয়িতা। বাংলা কবিতায় তাঁর উপস্থিতি অম্ল ান হবে। কবিতাপ্রেমী এ বাংলার আবহাওয়া তাকে নিঃসন্দেহে স্বাগতম জানাবে। মিনার মনসুরের পাঠককে বিমোহিত করার শক্তি অবাক করার মতো। আমরা কবির পথচলাকে সুগম করতে হয়তো কিছু উৎসাহ দিতে পারি। দিতে পারি কিছু সাহস। তাই বইটি পড়া একজন কবি ও পাঠকের মৌলিক দায়িত্ব বলেই মনে করি।


তথ্যসূত্র:
১. সাহিত্যকোষ: কবীর চৌধুরী, প্রকাশ কাল : ডিসেম্বর ২০০৫, প্রকাশক: শিল্পতরু প্রকশনী।
২. রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ রচনাবলী ১ , সম্পাদনা : মুহম্মদ নূরুল হুদা, প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি ২০০৫, প্রকাশক : মাওলা ব্রাদার্স
৩. কবিতাসমগ্র : আবিদ আজাদ, প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি ২০০৮, প্রকাশক : শিল্পতরু প্রকাশনী
৪. মিনার মনসুরের প্রেমের কবিতা, মিনার মনসুর, প্রকাশকাল ২০১৪, প্রকাশক : অ্যার্ডন পাবলিকেশন ৫. গুলিস্তা-বুস্তা; শেখ সাদী, অনুবাদ: মাওলানা হাফিজুর রহমান যশোরী, প্রকাশকাল : ২০০৩
৬. পাবলো নেরুদার আত্মজীবনী, অনুবাদ: শ্রী শংকর বর্ধন, প্রকাশক : ম্যাগনাম ওপাস, প্রকাশকাল : ২০০৭

৭. প্রমথ চৌধুরী; সাহিত্যে খেলা, প্রথম প্রকাশ- সবুজপত্র, শ্রাবণ সংখ্যা, ১৩২২ বঙ্গাব্দ (১৯১৫ খ্রিস্টাব্দ) পরে প্রবন্ধসংগ্রহ (১৯৫২)-এ সংকলিত
৮. Masnavi i Rumi, Teaching of Rumi, Translated and abridged by E.H Whinefield, Electronic version in Pdf, published by Omphaloskepsis
৯. Leaves of Grass by Walt Whitman, The Electronic Classics Series, Jim Manis, Editor, PSU-Hazleton, USA১০. http://www.poets.org/viewmedia.php/prmMID/5777#sthash.p3uVmZNK.dpuf১১. 11. http://mahan.wonkwang.ac.kr/link/med/society/marriage/marriage/courtly- love/fact3a.html.১২. http://literarydevices.net/


১৭.  Discourse is the presentation of language in its entirety while performing an intellectual inquiry in a particular
area

 

 

বই আলোচনা
মিনার মনসুর : অবরুদ্ধ মানচিত্রে অবিনশ্বর প্রেমিক
কামরুল হাসান  

 

২০১৪ সাল কবি মিনার মনসুরের কবিজীবনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বছর। এ বছর একইসঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে তার ‘প্রেমের কবিতা’ ও ‘দ্রোহের কবিতা’। বাংলা কবিতার এই দুই প্রধান আবেগ মিনার মনসুরের কবিতায় বারংবার বিভিন্ন কাব্যিকপ্রকাশে অনুরণিত হয়েছে। প্রেম ও দ্রোহ তার কবিতার প্রধান সুর ও আবেগ। যিনি বেড়ে উঠেছেন ষাটের উত্তাল দিনগুলোয়, কবিতা রচনায় ব্রতী হযেছেন সত্তরের গনগনে আগুনলাগা সময়ে- যখন একটি সদ্যস্বাধীন দেশ অস্থির সময় পার করছে; যার প্রথম কাব্য প্রকাশিত হয়েছে আশির স্বৈরশাসক-শাসিত সময়ে তিনি যে দ্রোহী হবেন- সেটাই সঙ্গত ও স্বাভাবিক। প্রেমের ভেতর যেমন দ্রোহ রয়েছে, তেমনি দ্রোহের ভেতর রয়েছে প্রেমের অধিষ্ঠান। এ দু’টি প্রধান আবেগের মাঝে কবির পক্ষপাত প্রেমের প্রতি। তিনি সুস্পষ্টই বলেছেন, ‘যদি প্রশ্ন করা হয় আমার কবিতার মুল সুর কোনটি- প্রেম না দ্রোহ- তাহলে আমি বলবো অবশ্যই প্রেম। আর যা কিছুতা সবই এ-প্রেমেরই গর্ভজাত।’ যদিও এ পর্যন্ত প্রকাশিত তার সাতটি কাব্য ও কিছুঅগ্রন্থিত কবিতা থেকে পাখির দুটি ডানার মতো উড়াল দিয়ে একপক্ষে প্রেমের কবিতা আর অন্যপক্ষে দ্রোহের কবিতা জড়ো করা হয়েছে, তবু দ্রোহের কবিতার ভূমিকায় তিনি এ সংশয় প্রকাশ করেছেন ‘কবিতা কি আসলেই শতভাগ রাজনৈতিক বা প্রেমের হয় বা হওয়া সম্ভব- আমি নিশ্চিত নই।’ বিশুদ্ধ রাজনৈতিক কবিতা বা প্রেমের কবিতাকে কবির কাছে সোনার পাথর বাটির মতোই মনে হয়েছে। তার এই সংশয় যৌক্তিক, কেননা একটি কবিতায় বিভিন্ন আবেগ ও চিন্তা ছায়া ফেলে যায়। তবু পাঠকের কথা ভেবেই হয়তো এই বিভাজন, আর বক্ষ্যমাণ নিবন্ধটি বিভাজনের একপক্ষ- প্রেমের কবিতাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত।

প্রেম- এই চিরন্তন মানবিক আবেগ চর্যাপদের কাল থেকে শুরু করে মধ্যযুগের বৈষ্ণবকাব্য ও পুঁথিসাহিত্য ঘুরে, মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ প্রমুখ মহারথীদের প্রতিভাবান হাত গড়িয়ে সাম্প্রতিক তরুণতম কবিকেও আলোড়িত করছে। তবে কালের পরিক্রমায় কবিতার গতিপথ পাল্টে গেছে, রোমান্টিক কবিদের কাল অবসিত হয়ে উদ্ভাসিত হয়েছিল আধুনিক কালের উষা, এখন সে কালও উত্তরাধুনিক যুগের কাছে অপস্রিয়মাণ। উত্তরাধুনিকতার এই যুগপর্বে প্রেম প্রকাশের ধরনও পাল্টে গেছে। রোমান্টিক যুগের কামহীন শুদ্ধাচারী প্রেম আধুনিক কবিদের হাতে দেহময় যৌনগন্ধী হয়ে উঠেছে, কেবল সৌন্দর্য নয়, তারা প্রত্যক্ষ করেছেন ক্ষয় ও বিনষ্টি। উত্তরাধুনিক যুগে প্রেম ব্যক্তিক আবেগের সঙ্কীর্ণ গণ্ডি ছাড়িয়ে সমাগ্রিকতার দিকে যাত্রা শুরু করেছে, হয়েছে শেকড়অভিমুখী। মিনার মনসুরের প্রেমের কবিতার মূলসূত্রটি আধুনিকতার সঙ্গে গাঁথা।

‘প্রেমের কবিতা’র ভূমিকায় তিনি বলেছেন তার হৃদয়ের সুস্পষ্ট পক্ষপাত সহজ প্রকাশের দিকে। সামগ্রিকভাবে সে চেষ্টাই তিনি করেছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি যেন বাংলার মরমী কবিদের উত্তরসূরী। কতটা সহজবোধ্যভাবে কবির হৃদয়াবেগ পাঠকের কাছে তুলে ধরা যায়- সে ক্ষেত্রে প্রচলিত কাব্যিক অলঙ্কারসমূহ তিনি অনেকটাই এড়িয়ে গেছেন। কবিতার দেহকে প্রসাধন ও অলঙ্কারসর্বস্ব না করে মেদমুক্ত রাখতে চেয়েছেন। আজকের আধুনিক নারীর প্রসাধন ও অঙ্গসজ্জার মতোই তার কবিতার রূপ- নিরাভরণ নির্মেদ সৌন্দর্যে আলোকিত। মধ্যযুগের প্রেমের কবিতায় যেমনটা দেখা যায়, প্রেমিকার রূপবর্ণনা, তেমনটা কিছু নেই মিনার মনসুরের কবিতায়। রূপবর্ণনার চেয়ে তিনি জোর দিয়েছেন নায়িকার মানবিক সত্তার উপর; বিচ্ছিন্ন নয়, সমগ্রতার উপর। নারীকে তিনি প্রসাধিত পুতুল হিসেবে দেখেননি, দেখেছেন মানবিক গুণাবলীতে ভাস্বর এক সামগ্রিক সত্তা হিসেবে।

মিনার মনসুরের প্রথম দিককার কবিতায় প্রেমের প্রকাশটি সরল আবেগে ঠাসা, কিন্তু সময়ের অগ্রগমনে সেখানে ক্রমশ ফুটে উঠেছে না পাবার ক্ষোভ, প্রেমিকার প্রতারণার প্রতি ঘৃণা। নরম প্রেমিকসত্তাটি নম্র উচ্চারণ ছেড়ে দ্রোহী উচ্চারণে উচ্চকিত হয়েছে। যে কাব্যদশকে কবি মিনার মনসুরের আর্বিভাব সে-ই সত্তরের দশক পরিচিত দ্রোহীকাল হিসেবে, যেখানে উচ্চকিত বিদ্রোহীর পোশাকের নীচেই রয়েছে অতৃপ্ত প্রেমিক সত্তা। মিনার মনসুরেও তাই দেখি। কবি মিনার মনসুরের কবিতায় একটি হাহাকারবোধ ছড়িয়ে আছে পঙ্ক্তিসমূহে, না-পাবার বেদনায় নীল এ কবি, সেই নীলে ছোপানো নীলরঙা তার কবিতা। দ্রোহের লালের পাশে তা এক বৈপরীত্য সৃষ্টি করে বৈকি! প্রাপ্তি নয়, অপ্রাপ্তি থেকেই তার কবিতার জন্ম। এক্ষেত্রে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের একটি উক্তি মনে পড়ছে। তিনি বলেছেন, ‘না পাওয়াই প্রেম, আর পাওয়া হলো বিবাহ।’ মিনার মনসুরের কবিতায় না পাওয়াই পরম পাওয়া, প্রেরণার উৎসস্থল। তবে অবাক হই যে ‘প্রেমের কবিতা’-র প্রথম কবিতাটিই একটি রাগী কবিতা যেখানে হতাশ, ব্যর্থ কবি পরিচিত সবকিছু ছেড়ে দ্রোহী মেজাজে চলে যাচ্ছেন। অপ্রাপ্তি থেকে কেবল হাহাকার ও বেদনা নয়, সৃষ্টি হয়েছে ক্ষোভ, কখনো ক্রোধে তিনি ফেটে পড়ছেন। ‘যে যায়’, ‘তবু তুমি থাকো’, ‘এখনো ফিরতে পারো’ কবিতাসমূহে এ ক্ষোভ বেশ প্রকাশিত।‘এখনো ফিরতে পারো’ কবিতাটি পতিত সময়ের একটি চালচিত্র; ভালোবাসার কোমলতার ভেতরেও সময় তার শ্বাপদ নখর, হিংস্র চোয়াল ঢুকিয়ে দিয়েছে।

‘সহসাই অন্ধকার গিলে খাবে পৃথিবীর শেষ আলোটুকু; হলিউডি চৌকশ অভিনেত্রীর মতো এই মায়াবী নিসর্গ চকিতেই পরে নেবে আরণ্যক বেশ।
মানব খোলসটুকু ছুঁড়ে ফেলে মুহূর্তেই পড়বে বেরিয়ে
নেকড়ের অগণিত জান্তব নখর; তরী নয়,
ঘাটে ঘাটে দন্ত প্রদর্শন করে স্বাগত জানাবে
এ-কালের ভয়াল কুমির!’ (এখনো ফিরতে পারো/আমার আকাশ)
‘হলিউডি চৌকশ অভিনেত্রীর মতো/এই মায়াবী নিসর্গ চকিতেই পরে নেবে আরণ্যক বেশ’ লাইনটি চমৎকার। তবে প্রতীকায়িত হলেও কবিতাটি বেশ খোলামেলা, আড়ালহীন। ‘তবু তুমি থাকো’-তে তিনি লিখেন, ‘জানি অনন্যা অন্যের পণ্য হবে তুমি;’। পণ্যশাসিত মুনাফালোভী সময়ে কবি তার প্রেমাস্পদকে রক্ষা করতে অসমর্থ। এই অসামর্থতা রূপ নেয় চূড়ান্ত বিবমিষায়- ‘প্রেমও পচনশীল/নারীও পচনশীল/শিল্পও পচনশীল/ঈশ্বর মূলত এক পচনতাড়িত/সম্মিলিত উৎকণ্ঠার নাম।’ শেষ দু’টি পঙ্ক্তি সাহসী ও দারুণ। ‘যে যায়’ কবিতায় প্রতারিত হবার ক্ষোভ থেকে উগড়ে দিয়েছেন ঘৃণা, অভিশাপে জর্জরিত করেছেন প্রেমাস্পদকে, সে অভিশাপ কখনো শালীনতার সীমাও ছাড়িয়েছে। ফুটে উঠেছে কবির সীমাবদ্ধতা, কেননা তিনি বেপথু প্রেমিকাকে ফেরাতে অক্ষম।
‘যে নধর মাংসপিণ্ড যায় দুলিয়ে বর্ণাঢ্য পাছা-
সেও যাক। যে নির্লজ্জ স্তন যায়, নগ্ন
কামার্ত ঊরুরা যায়, উগ্র যোনি যায়,
অবিশ্বাসী ঠোঁট যায়, প্রতারক চক্ষু যায়, ভ্রষ্টা
চুল যায়, হন্তারক দুই হাত যায়-’ (যে যায়/আমার আকাশ)

আমরা যদি কবিতাকে মোটা দাগে হৃদয়জাত এবং মস্তিস্কজাত- এই দুইভাগে ভাগ করি, তবে নির্দ্বিধায় বলা যায়, কবি মিনার মনসুরের বেশিরভাগ কবিতা হৃদয় বা আবেগসঞ্জাত। তার কবিতা যতখানি আবেগতাড়িত করে, ততখানি চেতনাতাড়িত করে না। খুব আবেগাপ্লুতও করে কি? আধুনিক সময়ের কবি হিসেবে তিনি নিরাবেগে প্রকাশ করেন হৃদয়ের তীব্রতম আবেগ। এখানেই বর্তমান সময়ের প্রেমের কবিতা চিরকালীন প্রেমের কবিতা থেকে আলাদা হয়ে যায়। পুরোদস্তুর নাগরিক এ কবির হৃদয়জাত কবিতার মাঝে অবশ্য চেতনা ও বোধের সমাগম আকছারই ঘটে।

যদিও তার আরাধ্য আবেগের, সত্যের সরল প্রকাশ, যেসব কবিতায় তিনি সরল আবেগ ছেড়ে তির্যক হয়েছেন, শ্লেষ ও হাস্যরস, এমনকি আত্মকরুণা জুড়ে দিয়েছেন সেসব কবিতা অধিকতর আড়ালসম্পন্ন ও আকর্ষণীয় হয়েছে। প্রথমদিককার কাব্যসমূহের সারল্য ছেড়ে শেষের দিককার কাব্যসমূহে আমরা এই বাঁকবদলটি লক্ষ করি। বস্তুত তার প্রথমদিককার কবিতা অতিকথনে ভরপুর, যা ছিল তার দশকের একটি প্রধান দুর্বলতা। পুনরাবৃত্তিতে ঠাসা এসব কবিতা আবৃত্তির মে যতটা আলোড়ন তোলে, পাঠে ততখানিই নি®প্রভ করে রাখে। সময়ের প্রভাব তিনি এড়াতে পারেননি; যদিও তার ব্যক্তিমানস ও কবিসত্তার ভিতর একটি লাজুক, সংগোপী ও নম্র সত্তা রয়েছে। আচরণ ও ব্যক্তিত্বে এই নম্রপ্রকাশটি দ্রোহী মানুষটিকে প্রেমিক বানিয়েছে, তার কবিতাও অবশেষে দ্বারস্থ হয়েছে প্রেমের।

কবি অবশ্যই তার কবিতার কথক, কিন্তু নিজেকে যতটা আড়াল করা যায়, কবিতা ততই নৈর্ব্যক্তিক হয়ে ওঠে, একের অভিজ্ঞতা হয়ে ওঠে বহুর অভিজ্ঞতার অংশ। সময়ের হাত ধরে মিনার মনসুরের কবিতা যত এগিয়েছে, এই নৈর্ব্যক্তিকতা তত প্রকাশিত হয়েছে। প্রথাগত প্রেমের প্রকাশ তার প্রথমদিককার কবিতাকে ভারি করে তুললেও তিনি ক্রমশই সামষ্টিক বোধের দিকে এগিয়েছেন।

কথোপথনের একটি ভঙ্গি মিনার মনসুরের কাব্যদেহে অন্তঃসলিলা নদীর তো প্রবাহিত। তিনি যে কেবল তার প্রেমিকার সঙ্গেই অবিরত কথা বলেছেন তা নয়, তিনি কথা বলেছেন প্রকৃতির সঙ্গে, তার প্রবহমান সময়ের সঙ্গে, তার পাঠকের সঙ্গেÑ যাদের হৃদয়সংবেদ তার কবিতার গন্তব্য। হৃদয়ের সরল আবেগ তিনি আড়াল করতে চাননি, সহজবোধ্য এক ভাষায়, উপমা প্রতীক-রূপক-চিত্রকল্পের কাব্যিক ভার যতটা সম্ভব এড়িয়ে তিনি নিজ হৃদয়ের মর্মবাণী প্রকাশ করতে চেয়েছেন। প্রেমের কবিতা বলেই এসব কবিতায় প্রথাগত ‘আমি’-‘তুমি’ সর্বনামের আধিক্য রয়েছে, রয়েছে অতিকথন। আমার কাছে বর অধিকতর প্রিয় তার ছোট কবিতাসমূহ। ‘ও আকাশ’, ‘ও তন্বী বিদ্যুৎ’, ‘শ্মশানের কাদাজল’, ‘হরিপদ’, ‘নবকৃষ্ণলীলা’ প্রভৃতি কবিতা কেবল আয়তনে ছোট নয়, ভাবপ্রকাশে সংহত ও ব্যঞ্জনাধর্মী। যেমন ‘হরিপদ’ কবিতাটি পুরোটাই উদ্ধৃত করছি:

‘চন্দ্রমল্লিকার যদি সাধ হয় চলে যাক চন্দ্রে-
নয়তো চুলায়-
তাতে তোর কী? তুই তো তলাহীন
এক তরকাররিওয়ালা-তল্পিবাহক
কিনু গোয়ালা- দরকারের
বারোয়ারি হাটে! ঘাটে-মাঠে
মল্লিকার কুমারিকা বাটে-
কাঁখের কলসি যদি
তার ভেসে যায় হেসে হেসে
চন্দ্রের চতুর চন্দ্রাতপে-
তাতে তোর কী হে হরিপদ-
গদগদ আদার বেপারি!’ (হরিপদ/জলের অতিথি)

এই হরিপদ হচ্ছেন বাংলা প্রবাদের কেরানি, প্রেমের মানদণ্ডে আকবর বাদশাহর সাথে যার তেমন কোনো পার্থক্য নেই। কবিতাটির প্রকাশভঙ্গিটি অভিনব। ‘নবকৃষ্ণলীলা’ কবিতাতেও সেই অভিনবত্ব ধরা পড়ে:

কালো মেঘ- সে যতোই কালো হোক- বুনো
মোষ রক্তচোখ আস্ফালনে
ভাঙুক আকাশ; রামপুরানিবাসিনী রাধিকার
পাকা চোখ জানে- অই ঘনকৃষ্ণ মেঘেদের বনে
চলিতেছে নবকৃষ্ণলীলা;- (নবকৃষ্ণলীলা/ জলের অতিথি)
রাধা এখন রামপুরানিবাসী। বাংলা কবিতা ও ঐতিহ্যের যে সমৃদ্ধ ভাণ্ডার তা থেকে কবিরা ঋণ নেবেন- এটাই প্রত্যাশিত, কিন্তু উপস্থাপন করবেন নবতর ব্যাঞ্জনায়, যা আমরা এসব কবিতায় দেখি। ‘ও তন্বী বিদ্যুৎ’ কবিতাটিও প্রতীকায়িত আর পরিমিত বলেই ঋদ্ধ।
‘এই যে আয়ত চোখ- মৌনতার মেঘে
ঢাকা গহন শ্রাবণ; এবং সহসা
আকাশ বিদীর্ণ করা চোখের বিদ্যুৎ-
কবি কেন বজ্রাহত? ও তন্বী বিদ্যুৎ
কবিকেই খুলে বলো নৈর্ব্যক্তিক
তোমার স্বরূপ।’ (ও তন্বী বিদ্যুৎ/আমার আকাশ)

ত্রিশের দোলা যেন পাই। সে তুলনায় তার সিরিজ কবিতাসমূহ যেমন ‘অনন্তের দিনরাত্রি’ গ্রন্থের ওই একই শিরোনামের ৮টি সংখ্যা সংবলিত কবিতা; কিংবা ‘আমার আকাশ’ গ্রন্থের ‘অন্তর্যাত্রা : ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৯০’-এর ১৪টি কবিতার সমাহারে রচিত
দীর্ঘ কবিতা আমাকে তেমন টানেনি। আমাকে টেনেছে তার আড়ালসম্পন্ন কবিতাসমূহ। ‘কবিতাসংগ্রহ’ গ্রন্থের ‘মহান দীনতা’, ‘কুয়াশার কার্ডিগান পরা সেই নারী’, ‘দুই রমণীর গল্প’, ‘মীন রাশির জাতিকা’, ‘যদি একাকী তবু’ আমার ভালো লেগেছে। এসব কবিতায় কবি যে সংশয় প্রকাশ করেছেন ‘শতভাগ প্রেমের কবিতা বলে কিছু নেই’, তা ফুটে উঠেছে, তবে প্রেমই এসব কবিতার মূল প্রেরণা।

মাঝে মাঝে তিনি অত্যন্তমনোহরণ, চিত্তাকর্ষক সব পঙ্ক্তি রচনা করেন-
‘দিন বড়ো ম্রিয়মান-পার্শ্বচরিত্রেও বেমানান
তিনি অধুনা নাটকে। তার হিরন্ময়ী আলো করে
দীনতার ঘর; দীনতাই নায়ক এখানে। .. (মহান দীনতা/কবিতাসংগ্রহ)
‘অথচ অদম্য এক শ্রমণের মতো নিয়ত তোমাকে দেখি
দুর্গম বিবরগামী। বিবরে নির্বাণ নেই- নেই পাপক্ষয়;
যতই করো না অন্ধ চোখ- বন্ধ হবে না প্রলয়।
আগুনেই ঝাঁপ দাও- সেখানে উদ্ধার; আর সব মেকি।’ (কুয়াশার কার্ডিগান পরা সেই নারী/কবিতাসংগ্রহ)
‘.. .. .. .. .. প্রশান্ত দিঘীর মতো গূঢ়
শরীরের জলে যখন উঠতো বেজে
মাছেদের রূপালী ঝিলিক- তখনও মাছ নয়,
জলের রহস্য তার মনে জাগাতো বিস্ময়।’ (দুই রমণীর গল্প/কবিতাসংগ্রহ)
পুরোটাই কবিতা। একই কবিতায় তার শৈল্পিক অবলোকন
‘.. .. .. .. .. .. চোখ তার-পতঙ্গের মতো- উড়ে
উড়ে আলোর পৌরুষ দ্যাখে- দ্যাখে আকাশকুসুম।’ ’ (দুই রমণীর গল্প/কবিতাসংগ্রহ)

পতঙ্গ আলোর দিকে অনিবার্য আকর্ষণে ধাবিত হয়, যে আকর্ষণ বিনাশী; কিন্তু উড়ে উড়ে আলোর পৌরুষ দেখা অভাবিত। ‘মীন রাশির জাতিকা’ কবিতায় মিনার মনসুর লিখেন, ‘এ কথা যে বলেছিলো তার প্রাণ ছিলো/মাছেদের মতো খুব সমুদ্র কাতর।’ ‘মাছেদের মতো খুব সমুদ্র-কাতর’-এককথায় চমৎকার। প্রকৃতির অবারিত প্রান্তর ছেড়ে কেবলই গুটিয়ে যাওয়া খাঁচাবন্দী আধুনিক মানুষকে দেখে তার করুণা ‘কেউ বাঁচে অ্যাকুরিয়ামের জলে। ‘যদিও একাকী তবু’ কবিতার শুরুটা এরূপ:

‘যদিও একাকী তবু দুইজন থাকে
এক ঘরে; অনিবার্য এই সহবাস।’ (যদিও একাকী তবু/কবিতাসংগ্রহ)
এই দ্বৈতসত্তা কবি মিনার মনসুরের কবিতায় প্রত্যক্ষ করা যায়। প্রেমের কবিতায় কখনো তিনি প্রেমিক সত্তা, কখনো অবলোকনকারী কবি সত্তা। প্রথম ভূমিকায় তিনি নিমগ্ন, দ্বিতীয় ভূমিকায় নির্মোহ। তিনি লিখেন,
‘আমি তো বলি না কিছু- অন্য কেউ বলে।’ (আমি তো বলি না কিছু/কবিতাসংগ্রহ))
অন্য কেউ দরোজায় কড়া নাড়ে, কড়া নেড়ে যায়… (কে এক জান্তব স্বর/কবিতাসংগ্রহ)
নিজেকে বিযুক্ত করে নেবার, স্বতন্ত্র হবার এই শক্তি কবিতায় ব্যক্তি অভিজ্ঞতাকে সামগ্রিক অভিজ্ঞতার অংশ করে তোলে, কবিতা সার্থকতা পায়। তার কবিতার আরেকটি দিক – সংশয়। প্রেমেও সংশায়িত আধুনিক কবি, কেননা স্বপ্নের পৃথিবীটি আর নেই, প্লাটুনিক প্রেমের জগৎটি অবসিত।
‘একটু আগেও তুমি ছিলে- ছিলে নাকি?’ (একটু আগেও/আমার আকাশ))
‘সেই যে দুপুর তুমি দিয়েছিলে সারাটি দুপুর
সে কি ভালোবেসে? নাকি করুণাবশত!’ (ভালবেসে যতোটুকু দাও/আমার আকাশ)

সিলেটগামী ট্রেনে, ওই কমলালেবুপ্রধান অ লে, এক সদ্যবিবাহিত দম্পতিকে দেখে তার কমলালেবুর মতো মনে হয়, যারা পরস্পরের রঙিন খোসা ছাড়াতে ব্যস্ত। নিঃসন্দেহে দারুণ উপমা। ওই একই কবিতার তৃতীয় অংশে তিনি দম্পতিকে ফিরে আসতে দেখেন খোসাহীন বিবর্ণ কমলার মতো অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে। খোসাহীন কমলা বিবর্ণ হলেও অন্ধকারাচ্ছন্ন কেন হবে? এই প্রশ্নের মীমাংসা না হলেও জীবনের ওই নিষ্করুণ, বিপ্রতীপ পরিণতি আমরা সকলেই জানি, কবির চোখে তা কী অনিন্দ্যরূপে ধরা পড়েছে। তিনি আমাদের মুগ্ধ করেন যখন লিখেন,

‘ছেড়া শেমিজের মতো বিদ্ধ তার চোখ
বহুকাল; ভেতরের কিশোরী উধাও।’ (তরুণ, তোমাকে দেখে/কবিতাসংগ্রহ)
‘সে শুধু শব্দেই বাঁচে’ কবিতায় মিনার মনসুরের উচ্চারণ:
‘তার যতো পত্রপুষ্প শস্যের সম্ভার- সব, তোমার অজ্ঞাতে-
হেঁশেলের জঞ্জালের মতো প্রত্যহ নিজেই তুমি দাও তুলে
কালের ময়লাবাহী ভয়ঙ্কর এক ট্রাকে; কোনো এক ভোরে
মৃত ইঁদুরের মতো তোমাকেও নিয়ে যায় ট্রাক।
তোমার যা কিছু- সে শুধু শব্দেই বাঁচে।’ (সে শুধু শব্দেই বাঁচে/কবিতাসংগ্রহ)

অর্থাৎ নশ্বর প্রেয়সী অবিনশ্বর হয় কেবল কবির রচনায়, শব্দেই সে বাঁচে। স্মরণে আসে মিনার মনসুরের একটি কাব্যের নাম ‘অবিনশ্বর মানুষ’। তবে সে প্রেক্ষাপট ভিন্ন। পুরোপুরি কামহীন নয় তার কবিতা, হওয়া উচিৎও নয় এই আশরীর কামজ আধুনিক যুগে। ‘পিংকি’ কবিতায় গোলাপী মেয়েটির দেহ নিয়ে রীতিমতো বেহিসেবী হয়ে উঠেছে কবির কলম।
‘জামার ভেতরে তার ঘৃতবর্ণ দেহটাও হয়ে ওঠে পিংক।

সহসা আছড়ে পড়ে সমুদ্রের যৌনগন্ধী ঢেউ;
ঘুরপাক খায় তার সুডৌল জঙ্ঘাকে ঘিরে; আমি শুধু তার
অপরূপ পায়ের গোড়ালি দেখি- সেখানেও পিংকের ঝিলিক!’ (পিংকি/মা এখন থেমে যাওয়া নদী)
কামজ হতে গিয়েও তিনি আত্মবিস্মৃত হন না, হন সংবৃত; পায়ের গোড়ালির রূপ দেখে ফিরে আসেন। মিনার মনসুরের কবিতায় বিরামচিহ্নের প্রচুর এবং ব্যাকরণসম্মত ব্যবহার দেখে মনে হয় তিনি খুব প্রথাসম্মত কবি। কবিতাপাঠকে নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতি বলেই বিশ্বাস করেন। ‘তোমার কোনো ত্রাণকর্তা নেই’ শিরোনামের টানাগদ্যে লেখা তিনটি কবিতাই দেহজ প্রেমের ইঙ্গিতবহুল; কেবল ইঙ্গিত নয়, প্রকাশ্য বর্ণনায় বাক্সময়। কাব্যিক পরিভ্রমণের এ দীর্ঘপথ পর্যন্তদৈহিক লীলা বর্ণনায় মোটামুটি বিরত কবি শারীরিক মিলনের অনিবার্যতাকে কখনো প্রতীকে, কখনো প্রত্যক্ষভাবে উপস্থাপন করেছেন। তবে মানবিক ব্যর্থতাই ঝরে পড়েছে টিকটিকির মিথুনের সঙ্গে পাল্লা দিতে ব্যর্থ মানুষের গ্লানি, শরীরি প্রেমের অনিবার্য একঘেয়েমী, গেরস্থ বেড়ালের মতো যেখানেই নির্বাসন দেওয়া হোক না কেন, ফিরে আসে, আর অবদমিত আকাক্সক্ষা প্রভৃতি ফুটে উঠেছে। ‘জেগে উঠি দংশনে দংশনে’ কবিতায় কবির সুস্পষ্ট উচ্চারণ-
‘ছবিটি ধরতে চাই-কাম ও ক্রোধের লালাসিক্ত
আব্রুহীন সম্পূর্ণ ছবি;’ (জেগে উঠি দংশনে দংশনে/মা এখন থেমে যাওয়া নদী)

মিনার মনসুরের প্রেমের কবিতার ভুবনটি জাগতিক হলেও শেষের দিককার কবিতায় দেখতে পাই মহাজাগতিক উড়াল। জগতের সীমা ছেড়ে মহাজগতের অসীমের পানে পাড়ি দিতে তৈরি যেন। ‘বহুদিন পর কণ্ঠ তোমার’ কবিতায় তিনি লিপিবদ্ধ করেন:
‘বহুদিন পর কণ্ঠ তোমার ভেসে আসে যেন মহাজাগতিক গান-

সুদূরের কোনো অজ্ঞাত গ্রহ থেকে।
কৃষ্ণবিবর আলো করে ফোটে গুচ্ছ গুচ্ছ তারাদের মতো
অপরূপ কিছু স্বপ্নের ফুল; .. .. .. .. .. .. ..’ (বহুদিন পর কণ্ঠ তোমার/মা এখন থেমে যাওয়া নদী)
‘শুধুমেয়েটি উড়–ক’ কবিতায় যাত্রীঠাসা এক ট্রেনের ভিতর হাঁসফাঁস করা মানুষের বর্ণনা রয়েছে, রয়েছে ক্ষুধাতৃষ্ণাহীন একটি যান্ত্রিক রেলগাড়ির পথচলার ইতিবৃত্ত। কিন্তু এর ভেতরেই বিদ্যুচ্চমকের মতো একটি মেয়ে ট্রেনের গরাদ ফুঁড়ে একটি ছেলের দিকে উড়াল দেয়। পরাবাস্তব ছবিটি অর্থবহ। কবিতাটির শেষ দুটি চরণ:
‘মেয়েটির ডানা হয়; ট্রেনের গরাদ ফুঁড়ে উড়ে যায় ছেলেটির দিকে।
ছেলেটি কোথায়- তাতে কী বা আসে যায়! শুধু মেয়েটি উড়–ক!’
(শুধু মেয়েটি উড়ুক/ মা এখন থেমে যাওয়া নদী)
ভালোবাসা অমনই। দমবন্ধ করা খাঁচা ভেঙে যে উড়াল দেয় ডানাঅলা পাখি কিংবা পরী হয়ে। প্রেমিক সেখানে উপলক্ষ মাত্র, মূল লক্ষ্য মুক্তি, সুবাতাস।

মূলত প্রথাগত ভাষা ও আঙ্গিকে লিখলেও মাঝে মাঝে বিশেষ করে শেষের দিকে মিনার মনসুর বেশ কিছু কবিতা টানাগদ্যে লিখেছেন। তার টানাগদ্যে লেখা কবিতার মাঝে কথোপথনের ভঙ্গিটিই বেশি ফুটে ওঠে। এদের মাঝে ‘মা এখন থেমে যাওয়া নদী’ কাব্যে বেশকিছু ভালো কবিতা রয়েছে। যেমন ‘আমার সবটা শৈশব ডুবেছিলো থইথই জলে’, ‘দৌড় তো থামেনি’ প্রভৃতি কবিতা বেশ ভালো। প্রথম কবিতাটিতে ভালোবাসা অপত্য স্নেহে প্রকাশিত আর দ্বিতীয় কবিতা প্রবহমান- ছুটে চলা জীবনের ছবি, যে ছুটে চলার প্রবাহে কবির প্রেয়সী নেই, অবেলায় সে ঘুমিয়ে পড়েছে। অগ্রন্থিত কবিতাসমূহের প্রথম কবিতা ‘কানামাছি কানামাছি’ ছড়ার ছন্দে লিখিত; আমাকে টানেনি, তবে এখানে একটি পঙক্তি রয়েছে, ‘যাকে ছুঁই সেই-ই তো নেই হয়ে যায়!’ অসামান্য! শৈশবের খেলাটির রূপকে আধুনিক মানুষের নিঃসঙ্গতাকে দারুণ লিপিবদ্ধ করেছেন, এ যেন ‘যেখানেই হাত রাখি সেখানেই তোমার শরীর’-এর বিপ্রতীপ উচ্চারণ।

‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’ চলচ্চিত্র ও উপন্যাসে আমরা একজন সাধুর দেখা পাই। তাকে যখন জিজ্ঞেস করা হলো, “সাধু বাবাজী, আপনি কোথায় যাচ্ছেন?” উত্তরে তিনি বললেন, “কোথায় যাচ্ছি, সেটা বড় কথা নয়; যাচ্ছি-সেটাই বড় কথা।” কবির পথচলাও তেমনি, গন্তব্য নয়, পথচলাতেই তার আনন্দ। কাব্যিক পরিভ্রমণে ক্লান্তিহীন মিনার মনসুর এখনো পা পা করে প্রেমের দিকেই যাচ্ছেন। বইটির সর্বশেষ কবিতা ‘পা পা করে তোমার দিকেই যাচ্ছি’ সেকথারই সাক্ষ্য দেয়। প্রেমাস্পদকে পাবার জন্য তার হৃদয়ের তীব্রতা কতখানি তা বোঝানোর জন্য রাজনীতি-সচেতন কবি সাতই মার্চের জনসমুদ্রের স্বাধীনতাকামী মানুষের চিৎকারকে তুলে এনেছেন (প্রশংসনীয়)। প্রেমাস্পদের দেখা তিনি আজও পাননি, পাবেন তার নিশ্চয়তাও নেই, (‘তোমার সঙ্গে যে আমার দেখা হবে তা বলার মতো দেবত্ব আমার নেই’)। তবু খুঁজে চলাই তার কাজ। দেখা না হওয়াই বর ভালো; কবির অভিযাত্রা, অনুসন্ধান, উৎসুক্য যে তাতে টিঁকে থাকে। তার এই প্রেমশাসিত পদযাত্রা অব্যাহত থাকুক! কাদামাটি হাতে আশৈশব বসে থাকা এই বিপন্ন শব্দভাস্করকে অভিনন্দন! যিনি লিখেন ‘যদি-বা মেলে জল, তৃষ্ণা কি মিটিবে?’, তিনি যে তার পাঠককে সতৃষ্ণ রাখবেন তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। নতুন পাত্রে পুরনো জল নয়, তার কাছে চাই নবতৃষ্ণার নবতর জল!

মিনার মনসুরের প্রেমের কবিতা; প্রকাশক: অ্যাডর্ন পাবলিকেশন; প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৪; প্রচ্ছদ: সৈয়দ ইকবাল; মূল্য: ২৫০ টাকা।