You are currently viewing ওরা ফেরেনি কেউ- ৯ || বিচিত্রা সেন

ওরা ফেরেনি কেউ- ৯ || বিচিত্রা সেন

Spread the love

ওরা ফেরেনি কেউ

বিচিত্রা সেন

কিস্তি-৯

১৭.

আজ সকাল থেকে শীতটা খুব বেশি লাগছে মনিবালার। নভেম্বর মাস, এ মাসে শীত এতটা লাগে না। কিন্তু বৃষ্টি হওয়াতে বাসাতটা কেমন ঠান্ডা হয়ে গেছে। বৌমাকে ডেকে নাতি-নাতনিদের শীতের কাপড় পরিয়ে দিতে বললো সে। তারপর রেডিওটা ছেড়ে দিলো। কতক্ষণ গান শুনে রেডিওটা বন্ধ করে দিলো সে। ভালো লাগছে না রেডিও শুনতে। দুপুরে তাড়াতাড়ি খেয়ে বড় দুই নাতনিকে দুইপাশে শুইয়ে সে ঘুমিয়ে পড়লো। মালবিকাও জোর করে দেবরাজকে ঘুম পাড়িয়ে ছোট মেয়ে রূপাকে নিয়ে শুয়ে পড়লো। মনিবালার ঘুম যখন ভাঙলো তখন বিকেল গড়িয়ে গেছে পশ্চিমে। বাইরে বেশ দমকা হাওয়াসহ বৃষ্টি পড়ছে। চারদিক অন্ধকার হয়ে আছে।
সে তাড়াতাড়ি বৌমা এবং নাতি-নাতনিদের ডেকে দিলো। সন্ধ্যাবাতি দিয়ে চা খেতে খেতে শুরু হয়ে গেলো ঝড়, প্রবল বাতাস বইছে। ওরা কাঠের ঘরটিতে থাকে। মনে ভয় করছিলা। এরকম তুফানে ঘরের চালা যদি উড়ে যায়, তবে ছোট ছোট বাচ্চা নিয়ে তারা খুব বিপদে পড়বে। সে হাতজোড় করে প্রণামের ভঙ্গিতে মা কালীকে ডাকতে লাগলো। ছোটবেলায় মায়ের কাছ থেকে শুনেছিল ভয়ংকর তা-বের সময় মা কালীর পায়ে আশ্রয় নিলে আর কোনো বিপদ থাকে না। মনিবালাও ঠাকুর ঘরে পড়ে আছে। বাচ্চাগুলো ভযে কুঁকড়ে আছে। রাত বাড়তে বাড়তে ঝড়ের তা-ব বাড়তে থাকে। একসময় মনে হতে থাকে এ রাত বুঝি আর ফুরোবে না। মালবিকার প্রচ- চিন্তা হয় আদিত্যের জন্য। শহরেও কি এমন তুফান হচ্ছে? মালবিকা শাশুড়ির উদ্দেশ্যে বলে,
-মা, আপনার ছেলের জন্য খুব চিন্তা হচ্ছে।
মনিবালারও খুব চিন্তা হচ্ছিল তার ছেলের জন্য। কিন্তু উপরে সেটা প্রকাশ করলে বৌমা আরও ঘাবড়ে যাবে। তাই সেটাকে আড়াল করে বলে,
-চিন্তা করো না। ও নিরাপদে থাকবে।
বাইরে শোঁ শোঁ আওয়াজ বুকের ভেতর কাঁপন ধরাচ্ছে। বিভিন্ন ভারী ভারী জিনিস পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। রূপা ভয় পেয়ে চিৎকার করে কান্না শুরু করে দিলো। মনিবালা নাতনিকে নিজের বুকে চেপে ধরেন। ভোর হতে হতে বাতাসের তা-ব কমে আসে। এখন শুধু বৃষ্টি হচ্ছে। মনিবালা দরজা খুলে বেরিয়ে আসেন। সর্বনাশ, তাদের পুরানো ঘরের চাল উড়ে গেছে। পুরো বাড়িতে শুধু তাদের এই নতুন ঘরটিরই চালা আছে। আর সবারই চালা উড়ে গেছে। মনিবালার পিছু পিছু মালবিকাও বেরিয়ে আসে। বাড়ির এ হতচ্ছাড়া রূপ দেখে তার ভীষণ কান্না পায়। বাড়ির জ্ঞাতিগুষ্টিরা উঠোনে নেমে হৈ চৈ করছে। কেউবা করছে কান্নাকাটি। মনিবালাও তাদের পুরানো ঘরের দিকে তাকিয়ে স্বামী-শাশুড়ির কথা মনে করে বিলাপ করে কাঁদে। মনিবালারা তখনো জানে না সমগ্র চট্টগ্রামের ওপর কী ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড় এবং জলোচ্ছ্বাসই না বয়ে গেছে। বেসরকারি হিসেবে প্রায় দশ লাখ মানুষ নাকি মারা গিয়েছিল এ জলোচ্ছ্বাসে।
এদিকে আদিত্য সারারাত পাগলের মতো ছটফট করে মরেছে মেসে। তার রুমমেটদেরও একই দশা। সবারই পরিবার থাকে গ্রামে। এরকম তান্ডবে গ্রামের ঘরবাড়িগুলোর কী অবস্থা হচ্ছে তা ভেবে সবাই উৎকন্ঠিত। সকাল হওয়ার পর তাই সবাই বাড়ির দিকে ছুটতে থাকে। আদিত্য ও তার শ্বশুরবাড়ির লোকদেরকে জানিয়ে গ্রামের দিকে রওয়ানা দেয়। বাড়িতে গিয়ে তার মনটা ভালো হয়ে যায়। তার সখের কাঠের বাংলো মাথা উঁচু করে যেন নিজের বিজয় বার্তা ঘোষনা করছে। পুরানো ঘরের চালা উড়ে গিয়ে একটা খরচ বাড়িয়েছে ঠিকই, কিন্তু সবাই যে নিরাপদে আছে এটা দেখে তার অনেক ভালো লাগছে।
আদিত্যের তেমন বড় কোনো ক্ষতি না হলেও চট্টগ্রামের উপকূলবর্তী লোকরা সর্বস্বান্ত হয়ে যায় এ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে। খালে-বিলে, পথে-ঘাটে লাশ আর লাশ। স্বজন এবং সম্পদ হারিয়ে অনেকে পথের ফকিরে পরিণত হয়। কিন্তু সরকার থেকে এ ব্যাপারে কোনো সাহায্যের হাতই এগিয়ে আসে না। এর ফলে সাধারণ মানুষের মনে সরকারবিরোধী মনোভাব প্রবল হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নির্দেশে এসময় স্থানীয় আওয়ামীলীগের নেতারা জনগণের পাশে এসে দাঁড়ায়।
আদিত্যদের পুরানো ঘরটি চালাবিহীন অবস্থায় পড়ে থাকে। কারণ নির্বাচন নিয়ে আদিত্য এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে, ঘরের দিকে তাকাবার মতো অবসর তার আর মেলে না। মনিবালা আর মালবিকাও এ ব্যাপারে কোনো তাগাদা দেয় না। ভাবে, তাদের তো কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। এ চালা নির্বাচনের পরে দিলেও চলবে। ঘনিয়ে আসে নির্বাচন। বড়কর্তার পরামর্শকে অগ্রাহ্য করে আদিত্য আবারও ছুটি নিয়ে গ্রামে চলে আসে। অবশেষে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে ডিসেম্বরের ৭ তারিখ নির্বাচন হয়ে যায়। কোনো কোনো স্থানে সংঘর্ষের জন্য নির্বাচন জানুয়ারিতে পিছিয়ে যায়। এটাই ছিল অবিভক্ত পাকিস্তানের প্রথম এবং শেষ সাধারণ নির্বাচন। আওয়ামীলীগ ১৭০টি আসনে প্রার্থী দেয়। তারমধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে ছিল ১৬২টি আসন। এই ১৬২টি আসনের মধ্যে আওয়ামীলীগ প্রার্থীরা ১৬০টি আসনে ধ্বস নামানো বিজয় এনে দেয়। আদিত্যদের এলাকাতেও নৌকা জয়ী হয়। সাধারণ নির্বাচনের সাথে সাথে প্রাদেশিক নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয়। এতে ৩০০টি আসনের মধ্যে আওয়ামীলীগ পায় ২৮৮টি আসন।
নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর আদিত্যের নেতৃত্বে গ্রামে মিছিল বের হয়। প্রতি বাড়ির বৌ-ঝিয়েরাও এ মিছিল দেখতে বাড়ির সামনের ফটকে জড়ো হয়। সবার মনে কেমন উৎসব উৎসব ভাব। এবার বুঝি দেশে সবকিছু পাল্টে যাবে। বঙ্গবন্ধু এ দেশটাকে সোনার বাংলা বানাবেন। ভাত খেতে বসে সে স্বপ্নের কথা আদিত্য মালবিকাকে বলে,
-দেখো, শেখের ব্যাটা এ দেশটাকে পুরোটা পাল্টে দেবে। এ দেশের নাম হবে সোনার বাংলা। এ দেশে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান সবাই বাঙালি হিসেবেই থাকবে।
স্বামীর কথা শুনে চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে মালবিকার। বলে,
-সত্যি সত্যি এমন হবে তো? আমার কিন্তু মুসলিম লীগারদের নিয়ে খুব ভয় হয়। ওরা কি এত সহজে সব ছেড়ে দেবে?
আদিত্য হো হো করে হাসে। তারপর আরাম করে মাছের মুড়ো চিবোতে চিবোতে বলে,
-দূর, তুমি একটা ভীতু মেয়ে। মুসলিম লীগ বলতে এখন আর কিছু নেই। ওরা ভ্যানিশ হয়ে গেছে।
মালবিকা খুশি হয়ে বলে,
-তোমার কথা সত্যি হলে তো ভালো।
বলে সে রুপাকে ভাত খাইয়ে দিতে থাকে। দেব, দীপা, নীপা নিজের হাতেই খায়।
নির্বাচনের দুদিন পরে আদিত্য শহরে চলে আসে। বঙ্গবন্ধুর বিজয়ে ঘোষবাড়িতেও কেমন উৎসব উৎসব ভাব। অনেকদিন পরে আদিত্যরা চারবন্ধু আজ এক হয়েছে। তাই সবাই মিলে আজকের রাতের খাওয়াটা ওরা বাইরেই খায়। ঘোষবাড়ির পাশে ‘সাকী’ নামে একটা হোটেল আছে। ওখানকার রান্না বেশ মজা হয়। ভাত খেয়ে চার বন্ধু কিছুক্ষণ তাস খেলে। তাসখেলার ফাঁকে ফাঁকে চলতে থাকে রাজনীতি নিয়ে আড্ডা। সবাই এখন নতুন স্বপ্নে বিভোর।
তবে আদিত্যরা নতুন স্বপ্নে বিভোর হলেও পরিস্থিতি কিন্তু সেভাবে এগোয় না। আওয়ামীলীগকে ক্ষমতা দিতে টালবাহানা শুরু করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিযা খান। ওদিকে জুলফিকার আলী ভুট্টো শেখ মুজিবের এই বিজয়কে কিছুতেই মেনে নিতে পারলেন না। তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে ষড়যন্ত্রের শামিল হলেন। প্রতিদিনই দৃশ্যপট পাল্টে যেতে লাগলো। অবস্থাদৃষ্টে মনে হলো শেখ মুজিব সহজে ক্ষমতা পাচ্ছেন না। কারণ ইয়াহিয়া ১লা মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। বাধ্য হয়ে বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন।
বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে আদিত্যরা চার বন্ধুই অফিসে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। সে এক উন্মাতাল সময়। প্রতিটি বাঙালি যেন স্বাধীনতার উম্মাদনায় টগবগ করে ফুটছে। মার্চের ২ তারিখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা ‘সোনার বাংলা’র পতাকা ওড়ায়। এ পতাকায় গাঢ় সবুজের ওপর লাল বৃত্ত দিয়ে তার ওপর পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র এঁকে দেওয়া হয়। এ পতাকার নকশা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিব নারায়ন দাশ। প্রতিটি খবর চট্টগ্রামে বসেই রেডিও কিংবা পত্রিকা মারফত পাচ্ছিল আদিত্যরা। প্রতিটি রাত এবং প্রতিটি দিন ছিল চরম উৎকন্ঠার। এ অবস্থায় একরাতে আদিত্যকে ডেকে পাঠান তার শ্বশুর।
আজ অনেকদিন পর ঘোষবাড়ির অন্ত:পুরে প্রবেশ করলো আদিত্য। এর মধ্যে অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে এ বাড়িতে। সরকার তাদের অনেক জায়গা জবরদস্ত দখল করেছে। মালবিকার বাবা তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে। কাজটা হয়তো ভালো হয়নি। মামলা না করলে কিছু টাকা পয়সা পাওয়া যেতো। এখন মামলা করাতে সবকিছু আদালতের সিদ্ধান্তের ওপরই নির্ভর করবে। প্রচুর টাকা পয়সা খরচ করতে হচ্ছে মামলা বাবদ। ব্যবসার অবস্থাও তেমন ভালো না এই উম্মাতাল সময়ে। আদিত্যকে দেখে মালবিকার বাবা খুব আন্তরিক স্বরে বললেন,
-আইয়ু বাজি, বোইয়ু।
আদিত্য বসলো। এ কথা সে কথার পর তিনি বললেন,
-দেশের পরিস্থিতি তো আঁত্তে ভালা না লার। তুঁই তো অফিসত্ ন র্য। হঁত্তে কী অ হন্ না র্যা। তুঁই এক কাজ হরো। মালবিকা তারারে এডে লোই্ আইয়ু।
ততক্ষনে আদিত্যের শাশুড়িও এসে বসেছেন। তিনিও সায় দিলেন এ কথায়। আদিত্য একটু ভেবে বললো,
-কিন্তু মা তো আইস্তু ন।
মালবিকার বাবা বললেন,
-দিদি নো আইলে বাড়িত্ থাকিবু যে এরি। তুঁই মালবিকা তারারে লোই আইয়ু। এডে নিরাপদে থাকিবু হিতারা।
মালবিকার বাবা যখন এ কথা বলছিলেন, তখন তিনি বুঝতেও পারেননি আর কয়েকদিন পরে এ চট্টগ্রাম শহর যে কতটা অনিরাপদ হয়ে উঠবে। তিনি বুঝতেও পারেননি আর কয়দিন পরে এ সোনার বাংলায় আগুন জ্বলে উঠবে এবং সে আগুনে ভস্মীভূত হয়ে যাবে ঘোষবাড়ির প্রভাব-প্রতিপত্তি, সম্পদ-স্বজন সব।
শ্বশুরের কথা শুনে আদিত্য পরদিন গিয়ে মালবিকাদের শহরে নিয়ে আসবে বলে জানায়। তারপর চা-মিষ্টি খেয়ে নিজের মেসে ফিরে আসে। মেসের রুমমেটদের মধ্যে দুজন আগেই বাড়ি চলে গেছেন। আদিত্য পরদিন বাড়ি যাবে শুনে বাকিজনও বাড়ি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো। সবাই গ্রামের দিকে ছুটছে। আর আদিত্য গ্রাম থেকে শহরমুখী হচ্ছে। কাজটা কি ঠিক হচ্ছে, আদিত্য ভাবে। যাক্ কথা যখন দিয়েছে, তখন কয়দিনের জন্য হলেও ওদের নিয়ে আসা যাক। পরদিন ফার্স্ট ট্রেনেই আদিত্য বাড়ি চলে গেলো।
আদিত্যকে সকাল সকাল বাড়িতে দেখে মনিবালা তো খুব খুশি। বলে,
-তুই আইশ্শুশ্ না? আঁই আরও তোর হতা ভার্বি যে।
আদিত্য একটু সংকুচিত হলো। মা ভেবেছে সে এখানে থাকতে এসেছে। কিন্তু ও যে বৌ-বাচ্চাকে শহরে নিয়ে যেতে এসেছে মা সেটা কল্পনাও করেনি। একটু চালাকির আশ্রয় নেয় সে। বলে,
-অ মা, আঁই তোঁয়ারা বেগ্গুনরে শহরত নিতাম আইশ্শি যে।
মনিবালার মুখটা কালো হয়ে গেলো। বললো,
-না বাজি, আঁই তো যাইত ফাইরতাম ন। আঁর বাড়ি ঘর ফালাই আঁই হডে যাইয়ুম? তুই তোর বৌ ফোয়ারে লোই যা।
আদিত্য বুঝতে পারে মা কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু এ মুহূর্তে সেই বা কী করবে! সে তো মালবিকার বাবা-মাকে কথা দিয়ে এসেছে। তাই মায়ের কথার সূত্র ধরে সে আবারও মাকে বলে-
-বাড়ি-ঘর ফরি থাক। তুঁই আঁরার অঙ্গে চলো।
মনিবালা জোর দিয়ে বলে,
-না, না, বাজি, আঁরে জোর ন হোরিশ। আঁই যাইতাম ন।
অগত্যা আদিত্যকে হার মানতে হয়। এতক্ষণ মালবিকা পাশে দাঁড়িয়ে মা-ছেলের কথা শুনছিলো। কথা শেষ হলে সে আদিত্যের জন্য জলখাবারের ব্যবস্থা করতে ভেতরে চলে যায়।
মামার বাড়ি যাবে শুনে দীপা, নীপাদের খুব খুশি। সারারাত তারা জামাকাপড় গুছায়। তারপর শেষরাতে ঘুমিয়ে পড়ে। ওরা ঘুমালে মালবিকা আদিত্যের কাছ ঘেঁষে বসে। তারপর বলে,
-মাকে এসময়ে এভাবে একা রেখে যেতে আমার একটুও ভালো লাগছে না। মনের মধ্যে কেমন অমঙ্গল লাগছে।
আদিত্য মালবিকার হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বলে,
-আমারও ভালো লাগছে না। কিন্তু তোমার বাবা-মা তোমাকে নিয়ে খুব ভাবছে। কয়দিন থেকে আসো ওদের কাছে। বেশিদিন থাকবে না আর কি!
মালবিকা সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে।
পরদিন সকালে সবাই মনিবালার পা ছুঁয়ে প্রণাম করে শহরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। আজ একটা অদ্ভুত কা- ঘটে, যা আগে কখনো ঘটেনি।
ওরা বেরিয়ে যাওয়ার সময় মনিবালার ডান চোখটা কেঁপে ওঠে। তারপর বুকের ভেতর হু হু করে কান্না চাপে। সেই কান্না আড়াল করার জন্য মনিবালা দ্রুত ঘরে ঢুকে পড়ে। ওদেরকে আর ঘাঁটা পর্যন্ত এগিয়ে দেওয়া হয় না। ওরা কিন্তু অভ্যাসবশত ঘাঁটার মাথায় গিয়ে পিছু ফিরে দেখে। মনিবালাকে না দেখে তারা একটু অবাকই হয়। অনেক ঝক্কি ঝামেলা করে শেষ পর্যন্ত তারা ঘোষ বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়।
ঘোষবাড়িতে আসার পর ওদের সবাই ঘিরে ধরে। মালবিকার মা নাতি-নাতনিদের বুকে নেন। একটু পরই হৈ-হুল্লোড়ে মেতে উঠে পুরো ঘোষবাড়ি।

১৮.

বঙ্গবন্ধুর ডাকে পুরো পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে চলছে অসহযোগ আন্দোলন। দিন দিন পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে উঠছে। ঘোষবাড়ির খুব নিকটেই এক নম্বর জেটি। সোয়াত জাহাজে করে অস্ত্র আনা হয়েছে এবং সে অস্ত্র অচিরেই খালাস করা হবে এরকম একটি খবরে গত কয়েকদিন ধরে এলাকার পরিস্থিতি সংঘাতময়। ছাত্র শ্রমিক জনতা সবাই শপথ নিয়েছে এ অস্ত্র নামতে দেওয়া হবে না। আওয়ামীলীগের নেতারা সভা সমাবেশ করে জনগনকে উদ্বুদ্ধ করছে এ ব্যাপারে। কয়েকটি সমাবেশে আদিত্যরা চার বন্ধু গিয়েছিল। আজ মার্চের ২৪ তারিখ। বিকেল চারটায় নিউমুরিংয়ে সমাবেশ ডাকা হয়েছে। আদিত্য দুপুরের ভাত খেয়ে সাড়ে তিনটায় বেরিয়ে পড়লো সমাবেশের উদ্দেশ্যে। পথে দেখা হলো ইউসুফ এবং অনিলের সাথে। কামালকে পাওয়া গেল না। সমাবেশ চলা অবস্থাতেই খবর এলো সোয়াত জাহাজের অস্ত্র খালাস হচ্ছে। তারপর এক প্রলয়ংকরী কা- ঘটে গেলো। হাজার হাজার মানুষ যে যেটা পেলো হাতে নিয়ে ছুটতে লাগলো জেটির দিকে। চট্টগ্রাম কলেজ প্যারেড মাঠে নাটক চলছিল তখন। এ খবর কীভাবে যেন সেখানে পৌঁছে গেলো। সেখান থেকেও ছাত্র-জনতা-শ্রমিক ছুটে এলো জেটির দিকে। জনতার এমন রুদ্র রূপ এর আগে পাকিস্তানি আর্মি দেখেনি। ভয় পেয়ে তারা ব্রাশ ফায়ার করা শুরু করলো। মুহূর্তেই লুটিয়ে পড়লো কয়েকজন তরতাজা যুবক। মানুষ ছুটতে লাগলো এলোপাতাড়ি। আদিত্যও ছুটতে লাগলো। হারিয়ে ফেললো বন্ধুদের। কোনো রকমে সে ঘোষবাড়িতে এসে পৌঁছাতে পারলো।
তবে বিধ্বস্ত এ চেহারা নিয়ে সে আর অন্ত:পুরে গেলো না। মেসেই বসে রইলো। মেসে তার তিন রুমমেটের একজনও বাড়ি থেকে ফেরেনি। কতক্ষণ একা একা শুয়ে সে ভাবতে লাগলো, তবে কি দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হবে? যদি সত্যি যুদ্ধ লাগে তাহলে কী হবে? দুদিকে বিচ্ছিন্ন হয়ে না থেকে সবাই একসাথে থাকলে ভালো হতো। এসব ভাবতে ভাবতে সে ঘুমিয়েই পড়ে। ঘুম ভাঙে দেবরাজের ডাকে। দেবরাজ ডাকতে এসেছে তাকে ভাত খাওয়ার জন্য। সে উঠে ছেলেকে নিয়ে ঘোষবাড়ির ভেতর বাড়ির দিকে হাঁটা দেয়।
আজ ২৬ মার্চ ১৯৭১। দেশের পরিস্থিতি খুব খারাপ। গত রাত থেকে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। হালিশহরে রীতিমতো ভয়ংকর যুদ্ধ হয়েছে। সারা রাত গোলাগুলির আওয়াজে ঘুমানো যায়নি। ঘোষবাড়ির কর্তা অর্থাৎ মালবিকার বাবা আদিত্যকে ডেকে পাঠিয়েছেন আদিত্য এখন তাঁর সামনে বসা। তিনি গম্ভীর স্বরে বললেন,
-আঁর মনে অর যে এডে থাকন ঠিক হইত ন। আঁর্রা তে আজুবাই শরি যনগুই ফরিবু।
আদিত্য জিজ্ঞেস করলো,
-হডে যাইয়ুম আঁরা?
মালবিকার বাবা বললেন,
-আপাতত ফিরিঙ্গিবাজার যাইয়ুম। হেডে একজনে আঁরারে থাকতো দিব হোইয়ে।
আদিত্য ভাবনায় পড়লো। ঘোষবাড়ির এতগুলো সদস্য নিয়ে মানুষের বাসায় তো ওঠা যাবে না। অল্প মানুষ হলে কথা ছিল। এখন তো বিশাল ব্যাটালিয়ান। কিন্তু শ্বশুর যখন বলেছেন, নিশ্চয় বুঝে শুনেই বলেছেন। এর মধ্যে তার সম্বন্ধী ও শালাও এসে পড়েছে এ ঘরে। সবাই এ বাড়ি ছেড়ে যেতে উদগ্রীব। কারণ একেবারে রাস্তার ওপরেই এ বাড়ি। আর্মি খুব সহজেই ঢুকে যেতে পারবে। শেষ পর্যন্ত নানা আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হলো মালবিকার বাবারা তিন ভাই যার যার পরিবার পরিজন নিয়ে যার যার সুবিধাজনক স্থানে যাবে। মালবিকার বাবা-মা, দুই ভাই, ভাইয়ের বৌ, ছেলেমেয়ে, মালবিকা, আদিত্য তাদের ছেলেমেয়েসহ ফিরিঙ্গিবাজার যাবে। আদিত্য মনে মনে ভাবে আপাতত ওখানে যাওয়া যাক। পরবর্তীতে সে তার পরিবার নিয়ে বাড়ি চলে যাবে। সেদিন বিকেলেই এত বিশাল ঘোষবাড়ি সুনসান হয়ে গেলো। শুধু বাড়ির বুড়ো চাকরটা রয়ে গেলো তার আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই বলে।
ফিরিঙ্গিবাজারে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের ভাড়াটিয়া হিসেবে আশ্রয় নিলো মালবিকাদের পরিবার। মুসলিম বাড়িওয়ালাটা খুব ভালোমানুষ। ঘোষবাবুকে আগে থেকেই চিনতেন তিনি চাক্তাই ব্যবসা করার সুবাধে। ঘোষবাবুদের প্রভাব প্রতিপত্তি সম্বন্ধেও তাঁর জানা ছিল। তিনি সাদরে তাঁদেরকে আশ্রয় দিলেন। তবে নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থেই ঘোষবাবুদের মুসলিম পরিবার হিসেবে পরিচয় দিতে অনুরোধ করলেন। মালবিকার বাবা বিষয়টা বুঝতে পেরে মালবিকার মাকে ডেকে বললেন,
-তোঁয়ারা মাইয়া ফোয়া বেগ্গুন্ শাঁখা খুলি ফালো। সিঁদুরও মুছি ফেলো।
অমঙ্গল আশংকায় কেঁপে উঠলো মালবিকার মায়ের মন। বললেন,
-অবুক অনে কী হতন যে, আঁরা সধবা মাইয়াফোয়া, শাঁখা সিন্দুর ন দিলি অনরার অমঙ্গল হইবু ত।
মালবিকার বাবা চোখ গরম করে বললেন,
-যিয়ান হোই হিয়ান হুনো। এডে মুসলিম হিসাবে আঁরারতে থাকন ফরিবু।
স্বামীর মেজাজের উত্তাপ বুঝতে পেরে মালবিকার মা আর কথা বাড়ান না। অনিচ্ছাসত্ত্বেও নিজের সিঁদুর মুছে ফেলেন, শাঁখা খুলে ফেলেন। তাঁর দেখাদেখি তাঁর মেয়ে এবং পুত্রবধুও একই কাজ করে। তাদের এ বেশে দেখতে বাড়ির পুরুষদের খুব কষ্ট হয়। তবুও জীবনের মায়ায় তারা তা মেনে নেয়।
এ বাড়িটার গড়নটা অদ্ভুত রকমের। বাইরে থেকে বোঝাই যায় না ভেতর বাড়িতে কয়েকটা ভাড়াটিয়ার ঘর আছে। মালবিকারা সবাই মিলে পনেরো জন মানুষ। মালবিকার বাবা, মা, বড় ভাই, বৌদি, তাদের চার ছেলে, মেয়ে, ছোট ভাই, মালবিকা, আদিত্য, তাদের চার সন্তান। পাশাপাশি তিনটি বাসা ভাড়া নিয়েছে ওরা। খায় সবাই একসাথে। মালবিকার দাদা এবং আদিত্য অফিসে যায় না। মালবিকার বাবাও চাক্তাইতে দোকান খোলে না। এত বড় পরিবারকে টানতে সম্বল ব্যাংক ব্যালেন্স। ব্যাংক থেকে ঘোষবাবু গিয়ে টাাকা তুলে আনেন, আর সেটা দিয়েই সংসার খরচসহ যাবতীয় খরচ মেটান।
আদিত্যের কিছু ভালো লাগে না। তার খুব ইচ্ছে করছে যুদ্ধে যোগ দিতে। এর মধ্যে তার পরিচিত অনেকেই পাড়ি দিচ্ছে ইন্ডিয়া। তার মধ্যে কেউ যাচ্ছে ট্রেনিং নিতে, আর কেউ আশ্রয় নিতে। যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার পর থেকে ইউসুফ, কামাল, অনিলের সাথে দেখা নেই। কে কোথায় ছিটকে পড়েছে কে জানে! বাড়িতে মা একা। মায়ের জন্য মনটা খুব অস্থির লাগে। এ মুসলিম বাড়িটাতে তারা নিরাপদে আছে ঠিকই, কিন্তু সবসময় একটা চাপা আতংকের মধ্যে থাকতে হয়। বাড়িওয়ালার আত্মীয় স্বজন আসলে কেমন যেন সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকায় ওদের দিকে। আসলে সব থেকে বড় সমস্যা হচ্ছে ভাষা নিয়ে। চট্টগ্রামের হিন্দু এবং মুসলমানদের আ লিক ভাষার মধ্যে বেশ ভালোরকমই পার্থক্য আছে। যেমন হিন্দুরা বলে আজুবা (আজকে), কালুবা (কালকে), কিন্তু মুসলিমররা বলে আজিয়া (আজকে), কালিয়া (কালকে), এছাড়াও হিন্দুরা কাউকে বসতে বললে বলে, ‘বসতক’, কিন্তু মুসলমান বলে ‘বইয়ুন’। ঘোষবাড়ির মহিলা সদস্যরা শাঁখা-সিঁদুর ত্যাগ করে মুসলিম সেজে থাকলেও দীর্ঘ দিনের অভ্যস্ত ভাষাটা ত্যাগ করতে পারেনি। যার ফলে তাদের সাথে কথা বলে বাড়িওয়ালার আত্মীয়রা সন্দিগ্ধ হয়ে ওঠে। বিশেষ করে বাড়িওয়ালার দুই ভাগিনা আবার রাজাকারে নাম লিখিয়েছে। তাদের কৌতুহলটা একটু বেশি।
কয়েকদিন ধরে আদিত্য শ্বশুরকে একটা কথা বলতে চাচ্ছে, কিন্তু সাহস করে বলতে পারছে না। আজ সন্ধ্যায় চা খাওয়ার সময় সে প্রস্তাবটা তোলে, বলে,
-বাবা, অনরে একখান হতা হোইতাম চাইর যে। হোইয়ুম না?
ঘোষবাবু একটু অবাক হয়ে তাকান জামাতার দিকে। তারপর বলেন,
-হ না কী হোইতা চউর।
আদিত্য শাশুড়ির দিকে তাকায়। তারপর মালবিকার দিকে। শেষে আবারো শ্বশুরের দিকে তাকিয়ে বলে,
-আসলে আঁই চাইর যে এবার দেবরাজ তারারে লোইয়ারে বাড়িত্ যাইতাম্ গুই। মা বাড়িত্ একা।
ঘোষবাবু একটু ভাবেন। আদিত্যের প্রস্তাবটা খারাপ না। শহরের পরিস্থিতি খুব খারাপ। এই সময় গ্রামে হয়তো অনেকটা নিরাপদে থাকা যাবে। তবে শুধু মালবিকারা নয়, তাঁর ছেলে, বৌমা এবং নাতি নাতনিরাও চলে যাক ওদের সাথে। তিনি আদিত্যের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-হিয়ান তো ভালা হতা। হুদা তোঁয়ার পরিবার লোই যাইবা না? আঁর ফোয়ার পরিবাররেও লোই য। কিন্তু যাইবা ক্যানে?
আদিত্য শ্বশুরের কথা শুনে খুব খুশি হয়ে গেলো, বললো,
-সাম্পাত যন যাইবু। তোইলি আঁরা কালুবা রওয়ানা দিই।
ঘোষবাবু সম্মতি দেন। সিদ্ধান্ত হয় তিনি এবং তাঁর স্ত্রী ছাড়া সবাই পরদিন মালবিকার শ্বশুরবাড়ির চলে যাবে।
পরদিন সবাই যখন বেরিয়ে যাচ্ছে তখন বাড়ি-ওয়ালী এসে উপস্থিত। খুব অবাক হয়ে তিনি বললেন,
-ও মা, তোঁয়ারা বেগ্গুন্ হন্ডে যাইতা লাইগ্গু দে?
মালবিকা হেসে বললো,
-আমার শ্বশুরবাড়ি খালাম্মা।
তিনি আরও অবাক হয়ে বললেন,
-ও মা বেগ্গুন যাইতাগুই লাইগ্ গু দে?
মালবিকার মা বললেন,
-না, না, বেগ্গুন্ ন যাইর। আঁই আর ইতারার বাপ থাইক্কুম্।
আদিত্য আর কথা বাড়ায় না। সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে সদরঘাটের উদ্দেশ্যে। ওখান থেকে সাম্পানে বাড়ি যাওয়া যাবে। পথে প্রতি মুহূর্তে বিপদের আশংকা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তারা বিনা বাধায় সাম্পানে করে বোয়ালখালী এসে পৌঁছায়।
সবাইকে দেখে মনিবালার সে কি উচ্ছ্বাস। সবাই হৈ চৈ করে কাঠের বাংলোটাতে গিয়ে ওঠে। বাড়িতে লোকে গিজ গিজ করছে। শহর থেকে নানান আত্মীয়রা এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছে। প্রত্যেক ঘরে ঘরে আশ্রিতের ভিড়। মনিবালার মনে হয় তার ঘরে যেন অনেকদিন পরে উৎসব লেগেছে। এর আগে কখনো মালবিকার ভাই, ভাইয়ের বউ এ বাড়িতে থাকে নি। তাই তাদের আপ্যায়ন করতে মনিবালা ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আদিত্যদের বিশাল বাড়ি দেখে মালবিকার ভাইপো ভাইঝিরা আনন্দে মেতে ওঠে।
গ্রামে আসার পর সবার দিনগুলো ভালোই কাটছিলো। ফিরিঙ্গিবাজারের বাসায় আত্মপরিচয় লুকিয়ে থাকাটা কেমন গ্লানিকর মনে হতো সবার কাছে। এখানে এসে সবাই যেন স্বাধীনতার স্বাদ পেলো। দেবরাজ, দীপা, নীপা তো সারাক্ষণ মামাতো ভাইবোনদের নিয়ে পুরো বাড়ি চষে বেড়াতো। আদিত্যও তার সম্বন্ধী-শালাকে নিয়ে পুরো গ্রামে ঘুরে বেড়াতো। এরই মধ্যে একদিন সন্ধ্যার পর পাড়ার কয়েকজন তরুন এসে দেখা করলো আদিত্যের সাথে। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করে। আজ আদিত্যের কাছে এসেছে সাহায্য চাইতে। আদিত্য এবং তার সম্বন্ধী খুব আগ্রহ নিয়েই তাদের হাতে নগদ টাকা তুলে দিলো। তরুণরা খুব খুশি মনেই বিদায় নিলো। পরদিন থেকে আদিত্য সেই তরুণদের সাথে যোগাযোগ রাখা শুরু করলো। আর মাঝে মাঝে ঘর থেকে নিয়ে চাল, ডাল, সবজি ওদের কাছে দিয়ে আসতে লাগলো। মালবিকা আর মনিবালা সব বুঝতে পারলেও কোনো বাধা দিল না। কারণ তারা জানে বাধা দিলেও আদিত্য যা ভালো মনে করবে তাই করবে।
সেদিন দুপুরে খেয়ে সবাই বড় বারান্দায় বসে গল্প করছিলো, হঠাৎ মনিবালা খেয়াল করলো বাড়ির মধ্যে কেমন হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে। সবাই যার যার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে। মনিবালা কিছু বুঝে উঠতে পারলো না। ছেলের দিকে তাকিয়ে বলেলো,
-চা তো কী হোইয়ে? বেগ্গুন এরইম্মা ছুডাছুডি ক্যায়া হরের?
আদিত্য বারান্দা থেকে উঠোনে নামলো, তারপর ঘাঁটার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলো। মুসলিমলীগের নেতা ফজল আকতার তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে তাদের বাড়িতে ঢুকে পড়েছে। এরকমটা আগে কখনো ঘটেনি। আদিত্যদের বাড়ি গ্রামে খুব সম্ভ্রান্ত বাড়ি হিসেবেই পরিচিত। যে কেউ ঢুকতে পারে না। এর আগে কেউ ঢোকেও নি। এমনকি দেশবিভাগের সময়ও অনাহুত কেউ তাদের বাড়িতে ঢোকার সাহস করেনি। তাই আজ মুসলিম লীগ নেতার এত সাহস দেখে আদিত্য অবাকই হলো। ফজল আকতার তার সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে আদিত্যের ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালো। তারপর ধূর্ত একটা হাসি দিয়ে আদিত্যকে বললো,
-কী হবর বাজি? তুঁই বলে হোরো গুষ্ঠিরে লই আইশ্শু?
আদিত্য একটু হেসে বললো,
-অ চাচা। শহরত নিরাপদ ন লাগে, এতর লাই গ্রামত চলি আইলাম যে।
ফজল আকতার কেমন এক বিকৃত হাসি হাসলেন ঠোঁট বাঁকা করে। তারপর আদিত্যের সখের কাঠের দোতলাটা ভালো করে নিরীক্ষণ করতে লাগলেন। তার তাকানোর মধ্যে এমন কিছু ছিল আদিত্যের বুকটা কেমন ঢিব ঢিব করতে লাগলো। ফজল আকতারের সঙ্গীরা কেমন উসখুস করছে। কী যেন তারা বলতে চায়, কিন্তু নেতা বলছে না দেখে তারাও বলতে পারছে না। নেতা এবার সঙ্গীদের দিকে তাকালেন, তারপর ডান হাত দিয়ে লুঙ্গির কোণাটা হাঁটু পর্যন্ত তুলে বললেন,
-কী রে, তোরা কী হোইতি আইশ্শুশ্ ক।
সাথে সাথে দাড়িওয়ালা টুপি পরা মাস্তান টাইপের লোকটা আদিত্যের দিকে তাকিয়ে বললো,
-আঁরারে হুকুম দিয়ে যে, অনর এই ঘর ইয়্যনত্ অইন্ লাগাই দিতাম। আঁরা আইশ্শি যে হেতর লাই।
আদিত্যের বুকটা কেঁপে ওঠে। কী বলে ওরা এসব? ওর এত সখের কাঠের দোতলা বাড়িটা পুড়িয়ে দেবে? সে ফজল আকতারকে বলে,
-চাচা, ইতারা ইয়িন কী র্হ যে? আঁর ঘর পুড়াই দিব মানে? আঁর অপরাধ কী?
খ্যাক খ্যাক করে নেতা হাসেন। তারপর রহস্যময় চোখে আদিত্যের দিকে তাকিয়ে বলেন,
-ঘর ইয়ান তোঁয়ার বেশি প্রিয় নাকি? তোইলে এক খান কাজ হরো। ঘর রাইখতু চাইলি আঁরারে কিছু ট্যায়া দেও।
আদিত্য যেন অকুল সাগরে তীরের সন্ধান পায়। বলে,
-অবশ্যই দিয়ুম্ চাচা। ত আঁর ঘরগানত্ অইন্ ন দিবাক।
বলে আদিত্য ছুটে যায় ঘরে। মালবিকা ছুটে আসে। জানতে চায় ওরা কী চাচ্ছে। আদিত্য বলে,
-তোমাকে সব পরে বলবো। আগে ওদেরকে বিদায় করি।
দুই হাজার টাকা আলমারি থেকে বের করে আদিত্য ফজল আকতারের হাতে তুলে দেয়। ফজল আকতারের মুখ দেখে মনে হয় না খুব একটা সন্তুষ্ট হয়েছে। তবুও টাকাটা তিনি নেন। তারপর যাওয়ার সময় বলে যান,
-আরা আজিয়া যাইরগুই। পরে আবার আইশ্শুম।
আদিত্যের বুকটা আবারও কেঁপে ওঠে। বুঝতে পারে বিপদ একেবারে কেটে যায়নি। নিজের বাড়িতে থাকাটাও তাদের জন্য বিপদজনক হয়ে গেলো।
ফজল আকতারের এভাবে হুমকি দিযে টাকা নেওয়াটা ভীষণ উদ্বেগের সৃষ্টি করে আদিত্যদের পরিবারে। সবার মধ্যে কেমন একটা আতংক এসে ভর করে। মনিবালাও কেমন একটা অস্বস্তিতে পড়ে যায়। বিয়ের পরে এমন ধরনের ঘটনার সে কখনো মুখোমুখি হয়নি। এই প্রথম কেউ তাদেরকে হুমকি দিয়ে টাকা নিলো। নিজের চৌদ্দপুরুষের ভিটায় নিজের বাড়ি রক্ষার জন্য টাকা দিতে হলো। এটা যেন ভীষণ মর্মপীড়ার কারণ হয়ে দেখা দিলো মা-ছেলের মধ্যে। মালবিকার ভাইদের মধ্যেও কেমন একটা চাপা আতংক কাজ করছে। এ ঘটনার পর দুদিন কেউ ঘর থেকে বেরই হলো না। নিজেদের ঘরেই কেমন যেন পরাধীনতার গ্লানি অনুভব করছে তারা।
দুদিন পর সকালে হঠাৎ করে ইউসুফ এসে হাজির আদিত্যদের ঘরে। আদিত্য তো ইউসুফকে দেখে খুব খুশি। বন্ধুকে বুকে জড়িয়ে সে নিজের রুমে নিয়ে গেলো। ইউসুফ কিন্তু গম্ভীর। আদিত্যের রুমে ঢুকে চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে ইউসুফ বললো,
-তোর লগে গোফন হতা আছে। তুই বলে মুক্তিযোদ্ধা অলরে সাহায্য হরর?
আদিত্য মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। বলে,
-নিজে তো ফরিবার ফালাই যুদ্ধত যাইত্ না ফারি। অন্তত ট্যাঁয়া-পয়সা দিয়ারে কিছু সাহায্য হরির যে এরি।
ইউসুফ বলে,
-কিন্তু সর্বনাশ তো হোই গিয়ে। এই হবর তো শান্তি কমিটি জানি গেইয়ে। তোর নাম লিস্টত্ উডি গেইয়ি। তোরতে এডত্তুন যনগুই ফরিবু।
আদিত্যের মুখ কালো হয়ে যায়। কী বলছে তার প্রিয়বন্ধু? তার নাম শান্তিকমিটিতে যাওয়া মানে যে কোনোদিন ওরা আসবে তাকে ধরতে। এখন এতগুলো মানুষ নিয়ে ও কীভাবে পালাবে এ গ্রাম ছেড়ে? ওকে চুপ দেখে ইউসুফ বলে,
-চিন্তা হরর্ন সময় নাই। আজিয়া রাতিয়া তোরা গ্রাম ছাড়িবি। আঁই এহন যাই।
বলে ইউসুফ যখন উঠতে যাবে, তখন চা নিয়ে প্রবেশ করে মালবিকা। বলে,
-আরে কোথায় যাচ্ছেন ইউসুফ ভাই? বসেন, চা খান, নাস্তা খান।
ইউসুফ বসে। নাস্তা হাতে তুলে নিয়ে খেতে থাকে। আদিত্য হঠাৎ মালবিকাকে বলে,
-এক কাজ করো, তোমার সব গয়না, মায়ের সব গয়না ইউসুফকে দিয়ে দাও। আমি বাড়ির দলিলগুলো ওকে দিয়ে দিচ্ছি। আমাদেরকে আজ রাতেই গ্রাম ছাড়তে হবে।
মালবিকা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। কী বলছে এসব আদিত্য। সব গয়না-দলিলপত্র ইউসুফ ভাইকে দিয়ে আজকেই গ্রাম ছাড়তে হবে কেন তাদের? তবে কি দুদিন আগে মুসলীম লীগের যে নেতাটা এসেছিলেন তিনি কোনো হুমকি দিয়ে গেছেন? মালবিকার নীরব দাঁড়িয়ে থাকা আদিত্যকে অসহিষ্ণু করে তোলে। তাই সে স্ত্রীকে তাড়া লাগায়। বলে,
-কী হলো, দাঁড়িয়ে আছো কেন? তাড়াতাড়ি করো। বলে সে নিজে আলমারি খুলে দলিলপত্রের পুটলিটা বের করে। একটা লাল কাপড় দিয়ে মোড়ানো পুটলিটা সেখানে তাদের জমির সব কাগজপত্র। সেটা ইউসুফের হাতে তুলে দিয়ে আদিত্য বললো,
-ইবা তোর কাছে রাখ্ বন্ধু। যুদ্ধ থামিলে তন তোর তুন যাইয়ারে আঁই লই আইশ্শুম।
ততক্ষনে মালবিকা তার গয়নার বাক্সটা বের করে ইউসুফের দিকে এগিয়ে দেয়। ইউসুফ হাত বাড়িয়ে নেয়। তারপর মালবিকার দিকে তাকিয়ে বলে?
-বৌদি আপনারা আজ আমার প্রতি যে বিশ্বাস স্থাপন করলেন, আশীর্বাদ করবেন আমি যেন তার মর্যাদা রাখতে পারি।
মালবিকার বুকের ভেতরটা হু হু করছিল। কেমন যেন অমঙ্গল আশঙ্কায় তার বুকটা কেঁপে কেঁপে উঠছিল। তবুও নিজেকে সামলে বললো,
ইউসুফ উঠে দাঁড়ালো। তারপর আদিত্যের দিকে তাকিয়ে বললো,
-আঁই যার্ই। তোরা দেরি ন হোরিস্। আজিয়া রাতিয়াই শোরি যাগুই।
ইউসুফ বেরিয়ে যায়। ইউসুফকে এগিয়ে দিতে আদিত্যও যায় সাথে। মালবিকা নিজের রুম থেকে বেরিয়ে দাদার রুমে যায়। দাদা-বৌদি বাচ্চাদের নিয়ে খাটের ওপর বসে গল্প করছে। মালবিকা দরজায় টোকা দিয়ে বলে,
-বৌদি আসবো?
বৌদি সাথে সাথে বলে,
-হ্যাঁ, আসো আসো।
মালবিকার মুখে দিকে ওর দাদা বললো,
-কী রে, কোনো সমস্যা?
মালবিকা বললো,
-হ্যাঁ দাদা, আমাদেরকে আজ রাতেই এখান থেকে সরে যেতে হবে। তোমার ভগ্নিপতির নাম নাকি শান্তি কমিটির লিস্টে উঠেছে। ইউসুফ ভাই এসে বলে গেলো।
মালবিকার কথা শেষ হতেই ওর বৌদি আতংকে চিৎকার করে ওঠে। বলে,
-হায় হায়, এখন তাহলে কী হবে?
মালবিকার দাদা ধমক দিয়ে বলে,
-কী হবে আবার? আমরা আজ রাতেই এখান থেকে সরে যাবো। তুমি তাড়াতাড়ি সব গুছিয়ে নাও।
মালবিকা দাদার রুম থেকে বেরিয়ে ছোটভাইয়ের রুমে যায়। সেখানে তার ছেলেমেয়েরা সবাই আছে। মালবিকা ছোট ভাই মলয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
-মলয়, সবাইকে নিয়ে তৈরি হয়ে নে। আমরা আজ রাতেই আবার শহরে চলে যাবো।
মলয়, দেবরাজ, দীপা, নীপা হা করে তাকিয়ে থাকে মালবিকার দিকে। মলয় ভ্রু কুঁচকে দিদির দিকে তাকিয়ে বলে,
-কেন দিদি? কী হয়েছে? এখানে তো বেশ ভালো ছিলাম আমরা। আবার শহরে যাবো কেন?
মালবিকার দুচোখ ছাপিয়ে অশ্রুর বন্যা নামে। ভারী গলায় বলে,
-তোর দাদাবাবুর নাম নাকি শান্তিকমিটির লিস্টে উঠেছে। তাই এখান থেকে সরে যেতে হচ্ছে।
ঘরে পিনপতন নীরবতা নেমে আসে। মাকে কাঁদতে দেখে দীপা-নীপা এসে মাকে জড়িয়ে ধরে। মালবিকা মেয়েদের বুকে জড়িয়ে ও রুম থেকে বেরিয়ে আসে। এবার শাশুড়িকে গিয়ে সব বলতে হবে। শাশুড়ির রুমে ঢুকতে গিয়ে দেখে আদিত্য মায়ের সাথে কথা বলছে। বৌমাকে দেখে মনিবালা বলে,
-বৌমা, কেঁদো না। মনকে শক্ত করো। বাড়ির অন্য কাউকে কিছু বলো না। আজ রাতেই দুটো খেয়ে তোমরা বেরিয়ে পড়বে।
সেই রাতেই আদিত্য সদলবলে গ্রাম ছেড়েছিল। তবে মনিবালা গ্রামেই রয়ে গিয়েছিল। ইউসুফ দুটো সাম্পানের ব্যবস্থা করেছিল। বাড়ির সবাই যখন ঘুমে তখনই চুপে চুপে আদিত্যরা বেরিয়ে পড়েছিল। মাইলখানেক হেঁটে তারপর সাম্পানে উঠেছিল তারা। শহরে ফিরিঙ্গিবাজার আসা পর্যন্ত প্রতিটি মুহুর্তে তারা যেন মৃত্যুকে অনুভব করছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কীভাবে যেন তারা কোনো বিপদ ছাড়াই ফিরিঙ্গিবাজারের বাসায় উঠতে পেরেছিল। এত রাতে তাদেরকে দেখে বাড়িওয়ালা অবাক হলেও বিরক্ত হননি। আদিত্যের শ্বশুর-শ্বাশুড়ি তো ভীষণ অবাক। কী এমন ঘটলো যে, তাদেরকে এত রাতে শহরে আসতে হলো। শান্তিকমিটিতে নাম ওঠার ব্যাপারটি শুনে তাঁরা দুজনেই মুষড়ে পড়লেন। সেই রাতে তারা গল্প করেই ভোর নিয়ে এসেছিল।

******************************