You are currently viewing ওরা ফেরেনি কেউ-১০ ||  বিচিত্রা সেন

ওরা ফেরেনি কেউ-১০ || বিচিত্রা সেন

ওরা ফেরেনি কেউ

বিচিত্রা সেন

কিস্তি-১০

১৯.

সারা দেশব্যাপী যুদ্ধ চলছে। ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে এসে মুক্তিযোদ্ধারা মরণপন লড়াইয়ে নামছে। তাদের বিজয়ের খবর নিয়মিত প্রচারিত হচ্ছে স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র, আকাশবানী, বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা থেকে। আদিত্য, তার শ্বশুর, সম্বন্ধী সারাক্ষণ রেডিওর নব ঘুরিয়ে, এসব খবর শোনে। এর মধ্যে এক দালাল এসে আদিত্যের শ্বশুর ঘোষবাবুকে প্রস্তাব দিয়েছে ইন্ডিয়া চলে যাবার জন্য। সেই পার করে দেবে তবে টাকা দিতে হবে। কিন্তু মালবিকার মা রাজি হচ্ছেন না। তিনি ভয় পাচ্ছেন যদি ইন্ডিয়া নেবার নাম করে লোকটা পাকিস্তানিদের হাতে সবাইকে তুলে দেয়। উনি কথাটা বলার পর সবার মধ্যে এই সন্দেহটা ঢুকে গেছে। তাছাড়া এতবড় ব্যাটালিয়ান নিয়ে ইন্ডিয়া যাওয়া খুব ঝুঁকিপূর্ণ। এদিকে রূপার শরীরটাও ভালো না। ভীষণ ঠান্ডা লেগেছে মেয়েটার। ওকে নিয়ে এত লম্বা জার্নি করতে আদিত্য মোটেই রাজি নয়। যার ফলে এখানে জীবন প্রতি মুহুর্তে ঝুঁকিপূর্ণ মনে হলেও ইন্ডিয়া যাবার চিন্তাটা তারা মাথা থেকে এক প্রকার সরিয়েই রাখে। কিন্তু চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন জায়গায় প্রচুর গেরিলা আক্রমণ হচ্ছে। তাই পাকিস্তানি আর্মিরা পাগলা কুকুরের মতো হয়ে গেছে। যখন যাকে পাচ্ছে তুলে নিয়ে যাচ্ছে, কিংবা ব্রাশ ফায়ার করে মেরে ফেলছে। এসব খবর নিয়মিতই কানে আসে আদিত্যদের। কিন্তু কোনো উপায় নেই। এখানেই থাকতে হবে। গ্রামে গেলে তো নিশ্চিত মৃত্যু।
বাড়িওয়ালীটা বড্ড সরল। প্রায় সময় এদের বাসায় চলে আসে। এদের দুঃখ দুর্দশা দেখে তাঁর খুব কষ্ট হয়। মাঝে মাঝে সরলভাবে তিনি বলেই ফেলেন,
-তোঁয়ারা এক খান কাজ করো। বেয়াগ্গুন, কলমা পড়ি মুসলমান হই য। পাকিস্তানি অল মুসলমানদের মাইরতু ন।
এ প্রস্তাব শুনে ঘোষগিন্নী খুব বিব্রত হন। কিন্তু উপরে মুখ ফুটে কিছু বলেন না ভয়ে। মালবিকার বৌদি কখনো কখনো বলে,
-খালাম্মা, আঁরা ত এক প্রকার মুসলমান হোই গেইগুই। শাঁখা-সিন্দুর না ফরি। ফুজা ন দি। কেউ হোইবু না আঁরা হিন্দু?
বাড়িওয়ালী মাথা নেড়ে বলেন,
-হিয়ানও ঠিক হোইয়ু।
এ বাসায় সবার কেমন দমবন্ধ লাগে। একে তো জাত পরিচয় লুকাতে হচ্ছে। তার ওপর অন্দরমহলের বাইরে যাওয়া নিষেধাজ্ঞা। শুধু ঘোষবাবু বাইরে গিয়ে বাজার সওদা করে আনেন। মাঝে মাঝে ব্যাংকে টাকা তুলতে যান। তিনি যতক্ষণ ফিরে না আসেন ততক্ষণ সবাই প্রচ- আতংকে থাকে। দিনগুলো এমনভাবেই যাচ্ছিল। আকাশবাণী আর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের খবরগুলো শুনলে মনে হয় জয় অতি সন্নিকটে। আদিত্য সেই কথা সবাইকে বলে। শেখ মুজিবকে নিয়েও তাদের উৎকন্ঠার শেষ নেই। তিনি কি সত্যি সত্যি বেঁচে আছেন? পাকিস্তান সরকার মিথ্যা বলছে না তো? এসব নিয়ে সারাক্ষণ আদিত্য ও তার সম্বন্ধীর মধ্যে আলোচনা চলে। ঘোষবাবু মাঝে মাঝে এসবে অংশগ্রহণ করেন, মাঝে মাঝে চুপ থাকেন। রূপার অসুস্থতা বেড়েই চলেছে। প্রচন্ড টান ওঠে তার। সারাক্ষণ কাশে। গায়ে গায়ে জ্বরও থাকে। ওকে নিয়ে মাঝে মাঝে ডাক্তারের কাছেও যেতে হচ্ছে মালবিকাকে। বাড়িওয়ালীর কাছ থেকে একটা বোরখা নিয়ে সেই বোরখা পরেই সে ডাক্তারের কাছে যায়। কিন্তু ইন্ডিয়া যেতে ওরা ভয় পাচ্ছে। এতদূর পথ এতগুলো মানুষ কীভাবে যাবে? পথেই হয়তো কোনো একটা বিপদ ঘটে যাবে। ঘোষগিন্নীর একেবারেই মত নেই এ ব্যাপারে। ঘোষবাবুও অসুস্থ শরীর নিয়ে এ বয়সে এতটা সাহস করতে পারেন না। যার ফলে ইন্ডিয়া যাওযার চিন্তা তারা বাতিলই করে দেয়।

ফিরিঙ্গিবাজার এলাকার আশেপাশে কয়েকটি গেরিলা আক্রমণ হয়ে গেছে। তার মানে মুক্তিযোদ্ধারা আশেপাশেই আছে। একদিন দেখা গেলো আশাপাশে নয়, একেবারে ঘরের মধ্যেই মুক্তিযোদ্ধার অবস্থান। বাড়িওয়ালির দুই বোনের ছেল মুক্তিযোদ্ধা। তারা এসেছে খালার বাড়িতে। কেন এসেছে সেটা জানা গেলো না। তবে মুক্তিযোদ্ধা শুনে আদিত্য ও তার সম্বন্ধী তাদেরকে কিছু টাকা দিলে প্রথমে তারা নিতে চাইলো না। কিন্তু আদিত্যের পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত তারা টাকা নিলো। এবার মলয় এক অদ্ভুত কান্ড করে বসলো। মুক্তিযোদ্ধারা চলে যাবার সময় সেও একটা ব্যাগ নিয়ে ওদের সাথে বেরিয়ে যেতে চাইলো। ঘোষগিন্নী অবাক হয়ে জানতে চাইলো,
-কী রে, তুই হডে যর যে?
মলয় ছোটবেলা থেকে দাদা-দিদির সাথে কোলকাতায় ছিল। তাই সে চট্টগ্রামের ভাষাটা বলতে পারে না, তবে বোঝে।
মায়ের প্রশ্নের উত্তরে সে বলে,
-আমি মুক্তিযুদ্ধে যাবো মা।
ঘোষগিন্নী আঁতকে ওঠেন ছেলের কথা শুনে। বলেন,
-না, না, তোকে মুক্তিযুদ্ধে যেতে হবে না। আমি তোকে ছাড়া থাকতে পারবো না।
-মা, বাধা দিও না তো। আমার মরণ আসলে এমনিতেও মরবো। তার চেয়ে যুদ্ধে গিয়ে মরা ভালো।
ঘোষগিন্নী চিৎকার করে কান্না শুরু করে দিলেন। তাঁর কান্না দেখে মুক্তিযোদ্ধারা অনেক বুঝিয়ে মলয়কে শান্ত করলো। একজন বললো,
-তুমি আগে মা বাবাকে বুঝিয়ে রাজি করাও, আমরা পরের বার এসে তোমাকে নিয়ে যাবো।
মলয় মুখটা কালো করে নিজের রুমে ঢুকে গেলো। ওইরুমে তার সাথে ভাগিনা দেবরাজ এবং ভাইপো নির্মলও থাকে। সে রুমে ঢুকে ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললো,
-মা, আজকে একটা বড় ভুল করলো। এর জন্য মা একদিন পস্তাবে।
সত্যি সত্যি কিন্তু একদিন এই দিনটির কথা স্মরণ করে ঘোষগিন্নী বিলাপ করবেন।
মলয়কে যুদ্ধে যেতে না দেবার পর থেকে ঘরের মধ্যে কেমন একটা থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে। মলয় এরপর থেকে বড়দের কারো সাথে কথাই বলছে না। আদিত্য অনেক বুঝিয়েও শালাকে শান্ত করতে পারছে না। মলয় এর এর গোঁ সে যুদ্ধে যাবেই। ওর এই একরোখা ভাব দেখে শেষ পর্যন্ত ঘোষবাবু বললেন,
-ঠিক আছে। ওরা আবার আসুক, তখন ওদের সাথে চলে যাস।
কথাটা শোনার পর থেকে আদিত্যেরও খুব ইচ্ছে করছে যুদ্ধে চলে যেতে। এভাবে প্রতি মুহূর্তে আতংকের মধ্যে বেঁচে থাকার চেয়ে যুদ্ধে গিয়ে দু’চারজন পাকিস্তানি খান সেনাকে মেরে মরতে পারা তো অনেক গৌরবের। কিন্তু মালবিকার ঘাড়ে এতসব দায়িত্ব চাপিয়ে সে সরে গেলে মালবিকা তো বেদিশা হয়ে যাবে। ও খুব নরম মনের মেয়ে। বড় লোকের আদরের দুলালী। কখনো কখনো এত দায়িত্ব মাথায় নেয়নি। ওর ওপর এটা অত্যাচার হয়ে যাবে। এসব কিছু ভেবে সে আবার পিছিয়ে আসে সিদ্ধান্ত থেকে। তবে সুখের কথা, ওর কেবলই মনে হচ্ছে যুদ্ধ আর বেশিদিন চলবে না। খুব শিঘ্রি তারা জয় বাংলা নামক দেশটি পেয়ে যাবে।
ইদানিং রাত হলেই খুব গোলাগুলির আওয়াজ শোনা যায়। লোকমুখেও শোনা যাচ্ছে শহরের আনাচে কানাচে নাকি গেরিলারা হামলা করে পাকিস্তানি সৈন্যদের নাস্তানুবুদ করে ছাড়ছে। এসব খবর শুনলে আদিত্যরা খুশিতে দিগি¦দিক হারিয়ে ফেলে। অনেক সময় ‘জয় বাংলা’ বলে চিৎকারও করে ওঠে। পরক্ষণে সমূহ বিপদের আশংকায় চুপ হয়ে যায়।
এ সময় হঠাৎ একদিন বাড়িওয়ালা এসে ঘোষবাবুকে খোঁজ করলেন। ঘোষবাবু বেরিয়ে আসলে বাড়িওয়ালা একটু থমকে বললেন,
-অ বা ঘোষ ব, অনরে একখান হতা হোইতাম আইশ্শি যে। হতা ইয়ান হতে আঁর তে খুব খারাপ লার্গে, কিন্তু আঁই উপায়হীন।
ঘোষবাবু অবাক হয়ে চেয়ে আছেন বাড়িওয়ালার দিকে। কী এমন কথা যা বলতে বাড়িওয়ালা এমন ইতস্তত করছেন? তবু তিনি অভয় দিয়ে বললেন,
-কী হতা? হোই ফালন।
বাড়িওয়ালা বললেন,
-খুব শরমর হতা। আঁর দুই ভাগিনা রাজাকার হোইয়ে। হিতারা ক্যানে জানি বুঝি ফালাইয়ে অনরা হিন্দু। কালিয়া রাতিয়া আইয়ারে হিতারা আঁরে হুমকি দিয়ে, আঁই যদি অনরারে এন্ডে থাইকতাম দি, তোইলে হিতারা পাঞ্জাবি লোই আইয়ারে অনরারে ধরাই দিব।
এ কথা শুনে ঘোষবাবুর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। এখন তাহলে তাঁরা কোথায় যাবেন? আদিত্যদের বাড়িতে তো যাওয়া যাবে না। সেখানে শান্তিকমিটির রাজাকাররা আদিত্যকে খুঁজছে। এখানেও রাজাকার চলে এসেছে। ইন্ডিয়া না গিয়ে তাঁরা কি তবে ভুল করেছেন? হায়, এখন তিনি এত লোক নিয়ে কোথায় যাবেন? ঘোষবাবুর অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে অপরাধীর মতো বাড়িওয়ালা বললেন,
-অনরা আঁরে ক্ষমা গোইরগুন। আঁই নিরুপায়। এন্ডে থাইলে অনরা বেগ্গুন মারা ফরিবান্। অনরা গ্রামত যনগুই।
ঘোষবাবু ফ্যাল ফ্যাল করে বাড়িওয়ালার দিকে তাকিয়ে রইলেন। ততক্ষণে ঘোষ পরিবারের সবাই এসে দাঁড়িয়েছে। এমন অপ্রত্যাশিত বিপদের জন্য তারা তো কেউ প্রস্তুত ছিল না। এখন সারা শহরে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় তাদেরকে কে আশ্রয় দেবে? কথাগুলো বলে বাড়িওয়ালা বিদায় নিলেন। ঘোষ পরিবারে যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো। সেদিন দুপুরে কেউ ঠিকমতো খেতে পারলো না। বিকেলে ঘোষবাবু বড় ছেলে এবং আদিত্যকে নিয়ে বসলো পরামর্শের জন্য। কী করা যায় এখন? আদিত্য বললো,
-এডেতুন যাইতোগুই যেঁওে হোইয়ে যনগুই ফড়িবু। আপাতত আঁরও বাড়িত্ যাই।
ঘোষবাবু বললেন,
-কিন্তু হেডে ত তোঁয়ার নাম শান্তি কমিটিত উডি গেইয়ে।
আদিত্য বললো,
-আঁই একজন মোইরলাম্ আর কি? আরগুন তো বাঁচি থাকিবু।
কথাটা শুনতে খারাপ লাগলেও যুক্তিযুক্ত। এখানে তো সবাইকে মেরে ফেলবে পাঞ্জাবিরা আসলে। তাহলে আপাতত সেটাই করা যাক। কাল সকালে আদিত্যদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতে হবে। ঘোষবাবু গিয়ে সিদ্ধান্তটা জানিয়ে দিয়ে এলেন। বাড়িওয়ালালি এসে ঘোষগিন্নীর গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন। নয় মাস ধরে দুটি পরিবার পাশাপাশি থাকতে থাকতে নিজেদের অজান্তে একটা মায়ার বাঁধন তৈরি হয়ে গেছে। আজ যখন তা ছিন্ন করার পালা এসেছে তখন দুপক্ষই বেদনায় মূহ্যমান হয়ে পড়েছে। মাঝখানে একবার আদিত্যরা গ্রামে গিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু ঘোষবাবু আর গিন্নী এখানে রয়ে গিয়েছিলেন। এবার একেবারে বিদায় নিয়ে যেতে হচ্ছে। নয়মাস থাকতে থাকতে এখানে অনেক জিনিস কিনতে হয়েছিল। সেসব এখন নিতে পারছেন না। যুদ্ধ থামলে তখন এসে নিয়ে যাবেন। বাড়িওয়ালা তাতে সম্মতি দিয়েছেন। বাংলা বাজার কত বড় বাড়ি পড়ে আছে ঘোষবাবুদের। খবর পেয়েছেন, সেখানে নাকি পাঞ্জাবিরা আস্তানা গেড়েছে। অথচ সেই প্রবল প্রতাপশালী ঘোষবাড়ির মানুষরা আজ একটা আশ্রয়ের জন্য মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরছে। কথাটা ভাবতেই ঘোষবাবুর বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। তবুও বাস্তবকে তো মেনে নিতে হবে। সিদ্ধান্ত হয় পরদিন সকালে তারা আদিত্যদের বাড়ি রওয়ানা দেবে।
পরদিন সকালে সবাই বিদায় নেবার সময় এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। বাড়িওয়ালা এবং তাঁর ছেলেমেয়েরা সবাই হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। যেন তাদের কোনো নিকট আত্মীয় দূরদেশে চলে যাচ্ছে। বাড়িওয়ালী ক্ষনে ক্ষনে বাড়িওয়ালার ভাগিনাদের অভিসম্পাত করতে থাকে রাজাকারের খাতায় নাম লেখানোর জন্য। শেষমেষ কান্নাকাটি সেরে সবাই সদরঘাটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। সাম্পানে গেলে নাকি নিরাপদে যাওয়া যাবে। পাঞ্জাবিরা নাকি পানিকে ভয় পায়। ফিরিঙ্গিবাজার থেকে রিকসা করে তারা নিরাপদে সদরঘাট গিয়ে পৌঁছায়। তারপর একটা সাম্পানে ঠাসাঠাসি করে বসে। আদিত্যের সম্বন্ধী মাঝিকে তাড়া লাগায়। বলে,
-তাড়াতাড়ি সাম্পান ছাড়ো।
ঘোষবাবুও তাড়া লাগায়। মাঝি বদর বদর বলে সাম্পানে টান মারে। কিন্তু দুই/তিন গজ যাওয়ার পরেই ঘাটের ওপর থেকে হুকুম আসে,
-সাম্পান ভেড়াও।
দেখা যায়, দুই ট্রাক মিলিটারি এসে নেমেছে ঘাটে। সবাই অস্ত্র তাক করে আছে সাম্পানের দিকে। তাদের সাথে শার্টপ্যান্ট পরা দুজন বাঙালি যুবক। তাদের মধ্যে একজন চিৎকার দিয়ে বললো,
-They are all hindus sir..
হয়তো তারাই বাড়িওয়ালার ভাগিনা। বাড়িওয়ালার ভাগিনাদেরকে তো দেখেনি কেউ। মলয় ফিস ফিস করে মাঝিকে বলে,
-আপনি থামবেন না। আপনি সাম্পান চালাতে থাকেন।
কিন্তু মাঝি সে কথা শোনে না। সে ঘাটের দিকে নিয়ে যায় সাম্পানকে। মালবিকার মনে হয় তাহলে কি মাঝিও তাদের লোক ছিল? সাম্পান তীরে ভিড়ে। পাকিস্তানি মিলিটারি অর্ডার দেয় সবাই যেন মাথার ওপর হাত তুলে তীরে উঠে আসে। ঘোষবাবু, তাঁর দুই ছেলে, আদিত্য উঠে আসে মাথার ওপর হাত তুলে। দেবরাজ এবং নির্মল মায়েদের পেছনে গুটিশুটি মেরে লুকিয়ে থাকে। রূপা চিৎকার করে কাঁদতে থাকে বাবার কোলে যাবার জন্য। মেয়ের চিৎকার আদিত্যকে অস্থির করে তোলে। সে একবার পেছন ফিরে তাকায় মেয়ের দিকে। সাথে সাথে এক পাকিস্তানি সৈন্য তার ঘাড়ে রাইফেল দিয়ে আঘাত করে। আকস্মিক আঘাতে কঁকিয়ে ওঠে আদিত্য। মালবিকা আর্তনাদ করে ওঠে। ঘোষগিন্নী মালবিকার মুখটা চেপে ধরে। তিনি শুনেছেন সুন্দরী নারী দেখলে পাঞ্জাবি সৈন্যদের মাথা ঠিক থাকে না। এই সাম্পানের প্রত্যেকটা নারী খুব সুন্দরী। কিশোরী নাতনি গুলোর দিকে লোলুপ দৃষ্টি তাকাচ্ছে হায়েনাগুলো। চারটা ছেলেমেয়ে হলেও মালবিকা এখনো অপূর্ব সুন্দরী। ওদের ওপর নজর পড়লে তো সর্বনাশ হয়ে যাবে। ঘোষবাবুও কি মনে মনে তাই ভাবছিলেন! ওদের সবাইকে ট্রাকে তুলে ট্রাক দুটো বামদিকে চলে গেলো। ওরা চলে যাবার পর সাম্পানে কান্নার রোল উঠলো। এখন তাদের কোনদিকে যাওয়া উচিত, কী করা উচিত, কেউ বুঝে উঠতে পারলো না। শেষে ঘোষগিন্নীর সিদ্ধান্তে সবাই আদিত্যদের গ্রামের দিকেই রওয়ানা হলো।

 

২০.

দুপুর গড়িয়ে বিকেল নেমেছে তখন। উঠোনের গাছগুলোর ওপর থেকে রোদ সরে গিয়ে ক্রমশ ছায়াকে জায়গা করে দিচ্ছে। মনিবালা বারান্দায় বসে নকশীকাঁথায় ফুল তুলছিলো। আজসকাল থেকে তার ডানচোখটা কাঁপছে। মনে মধ্যে কেমন অমঙ্গলও ডাকছে। কাল সারারাত বাড়ির কুকুরটা কান্না করছে। সবমিলিয়ে মনিবালা বড্ড অস্থিরতায় আছে। আদিত্যরা শহরে কেমন আছে কে জানে! কালকে নীলুর বাপ এসে বলছিল শহরে নাকি যুদ্ধ চলছে খুব। আদিত্যদের বাসার ওখানটায় নিরাপদ আছে তো? কত ভাবনাই যে আজ ক্ষণে ক্ষণে আসছে মনে। দূর! আজকে আর কাঁথা সেলাই করতে ইচ্ছে করছে না। মনিবালা সবগুছিয়ে উঠতে যাবে ঠিক তখনি উঠোনে এসে উপস্থিত হয় মালবিকারা ওদের দেখে মনিবালা হতভম্ব হয়ে যান। সবাই কেমন বিধ্বস্ত। ছোট বাচ্চারা সবাই মনিবালাকে দেখে হাঁউমাঁও করে কেঁদে ওঠে। বাচ্চাদের কান্না দেখে মালবিকার বৌদিও বিলাপ জুড়ে দেয়। মনিবালা থ মেরে দাঁড়িয়ে আছে। ওরা সবাই এভাবে কাঁদছে কেন? আদিত্যরা কই। এত জিনিসপত্র নিয়ে শুধু মহিলা এবং বাচ্চারা এসেছে কেন? মালবিকা ছুটে এসে মনিবালাকে জড়িয়ে ধরে। তারপর চিৎকার করে বলতে থাকে,
-মাগো, আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে মা, সর্বনাশ হয়ে গেছে।
মনিবালা শুনতে চায় কী সর্বনাশ হয়েছে। কিন্তু মুখ দিয়ে তার একটি শব্দও বের হয় না। সে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে বৌমার দিকে। কিন্তু শ্বাশুড়িকে কিছু বলার আগে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে মালবিকা। জ্ঞান হারিয়েছে সে। তাদের ঘরের হৈ চৈ কান্নাকাটিতে ততক্ষণে বাড়ির অন্য জ্ঞাতিরাও এসে দাঁড়িয়েছে আদিত্যদের ঘরের সামনে। মালবিকাকে সবাই ধরাধরি করে বিছানায় শুইয়ে দেয়। মনিবালা দেবরাজের কাছে জানতে চায়,
-তোর বাবারা কোথায়? এখনো আসছে না কেন?
দেবরাজ কাঁদে না। কেমন যেন পাথর হয়ে গেছে সে। তার চোখের সামনে বার বার ভাসছে বাবার পিঠে রাইফেল দিয়ে আঘাত করার দৃশ্যটা। সে উত্তর দিতে পারে না ঠাকুর মাকে। তার মামাতো ভাই নির্মল কাঁদতে কাঁদতে বলে,
-ঠাকুর মা, আমার বাবাদের সবাইকে মিলিটারিরা ধরে নিয়ে গেছে।
নির্মলের মুখে এ কথা শুনে জ্ঞাতিদের কেউ কেউ আতংকে চিৎকার করে ওঠে। মনিবালা হা করে তাকিয়ে থাকে নির্মলের দিকে। সবাইকে মিলিটারিরা নিয়ে গেছে মানে? কোথায় নিয়ে গেছে? তাহলে ওরা কখন আসবে? সে ঘোষগিন্নীর দিকে তাকায়। ঘোষগিন্নীর দুচোখে অশ্রুর বান নেমেছে। কিন্তু সে কান্না নীরব কান্না। মনিবালা সত্যি কিছু বুঝতে পারছে না। তার আদিত্য, ওর শ্বশুর, সম্বন্ধী, শালা সবাইকে নিয়ে গেছে মিলিটারিরা? কোথায় পেলো ওদের? সবাই কাঁদছে, সবাই বিলাপ করছে। কে দেবে তাকে এসব প্রশ্নের উত্তর। শেষে ঘোষগিন্নীই মুখ খোলেন, বলেন,
-অ দিদি। আঁরার কোয়াল ফুইরগে। আঁরা সর্বস্বান্ত হোই গেলাম্। এডে আসতের সময় সাম্পানত্তুন বেগ্গুনরে ধরি লোই গেলগুই আঁরার চোখর সামনাদি।
মনিবালা মাটিতে ধপ করে বসে পড়ে। তার একমাত্র ছেলে আদিত্য তার বুক থেকে হারিয়ে গেলো। একবার শেষ দেখাও দেখতে পেলো না সে। সহ্য করতে পারে না সে। জ্ঞান হারিয়ে আস্তে করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সে।
জ্ঞাতিরা সব ছুটে এসে মনিবালাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সেই রাতটা কীভাবে যে কাটে তা আসলে বর্ণনাতীত। কে কাকে সান্ত¦না দেবে। সর্বস্বান্ত দুটি পরিবার শুধু পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে আকুল কান্নায় ভেঙে পড়ছিল।
খবর ছড়াতে দেরি হয় না। পরদিন সকাল থেকে আদিত্যদের ঘরে গ্রামের লোক এসে ভিড় করতে লাগলো সহানুভূতি জানাতে। সব পুরুষ কর্তাকে হারিয়ে দুটি পরিবার তখন উদ্ভ্রান্ত। শহরে কোথায় গেলে, কার কাছে গেলে তাদের হদিশ পাওয়া যাবে তাও তো তারা জানে না।
একবার ভাবলো বাড়িওয়ালার কাছে গিয়ে সাহায্য চাইবে এ ব্যাপারে। কিন্তু ঘোষগিন্নী এ ব্যাপারে রাজি না। কারণ তাঁর মনে হচ্ছে ওখানে গেলে বিপদ আরও বাড়বে। তার রাজাকার ভাগিনাগুলোর খপ্পরে পড়লে বাড়ির বৌঝিদের নিয়েও বিপদে পড়তে হবে। মনিবালাকে তিনি তাঁর মত জানালে মনিবালাও এতে সায় দেয়। মালবিকা আর তার বৌদিকে সামলানো কঠিন হয়ে পড়েছে। তারা বার বারই জ্ঞান হারাচ্ছিল। ছোট ছোট বাচ্চারা অযত্নে, অবহেলায় এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াতে লাগলো। তাদের দিকে তাকানোর সময়ও আজ কারো নেই। একমাত্র পুত্রকে হারিয়ে মনিবালাও আজ শোকে পাথর। বাড়ির জ্ঞাতিরা এসে সান্ত¦না দিয়ে সবাইকে তবু কিছু কিছু খাওয়াতে সমর্থ হলো। সিদ্ধান্তহীনতায়, উদ্ভ্রান্তির মধ্যে কেটে গেলো চারদিন। হঠাৎ এক বিকেলে মুহূর্মুহূ গোলাগুলির আওয়াজে সবাই হতচকিত হয়ে গেলো। বোঝা গেলো পাকিস্তানি মিলিটারি হয়তো গ্রামে ঢুকে পড়েছে। কিন্তু চারদিকে এত শোরগোল কেন? কেমন যেন মনে হচেছ ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিচ্ছে কেউ কেউ! ঠিক এসময় নির্মল ও দেবরাজ বাইরে থেকে ছুটে এলো, বললো,
-মা, মা, দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে।
কথাটা দুজনে একসাথেই বললো। মালবিকা ছুটে এলো বাইরে সত্যি দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে? তাহলে হয়তো আদিত্যদের খোঁজ পাওয়া যাবে। মাত্র চারদিন আগেই তো ওদের নিলো। মালবিকা ছুটে যায় মায়ের কাছে। একসাথে স্বামী, দুই পুত্র, একমাত্র জামাতাকে হারিয়ে ঘোষগিন্নী এখন মৃতপ্রায়। তবুও মেয়ের ডাকে তিনি উঠে বসেন। মালবিকা বলে, 
ঘোষগিন্নী সায় দিলে বলেন,
-ঠিক আছে। কালকেই আমরা শহরে যাবো।
এদিকে দেবরাজ এবং নির্মল ছুটে বেরিয়ে গেছে। তারা বিজয়মিছিলে যাবে। বিজয়মিছিল পুরো গ্রাম ঘুরছে। ঘরে ঘরে আনন্দের বন্যা। শুধু অশ্রুর বন্যা মালবিকা এবং ঘোষবাবুদের ঘরে। বিজয় মিছিলের উল্লাস শুনে মনিবালা আজ বুক চাপড়ে বিলাপ করে কাঁদে আদিত্যের জন্য। প্রথম যৌবনে স্বামীকে হারিয়েছিল সে। তারপর থেকে এই ছেলেকে একাই মানুষ করেছিল। সেই ছেলে আজ কোথায় হারিয়ে গেলো! ছোট ছোট ছেলেমেয়ে গুলো কাকে বাবা বলে ডাকবে? ঘোষগিন্নীও এসে শরিক হন বেয়াইনের সাথে। দুই বেয়াইন পরস্পরের গলা জড়িয়ে আকুল হয়ে কাঁদেন।
পরদিন ওরা সবাই মিলে শহর অভিমুখী হয়। দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। নিজেদের বাড়িতে তারা এখন উঠতে পারবে। এই নিশ্চয়তাটুকু এ মুহূর্তে তাদের কাছে অনেক। শহরে এসে রাস্তাঘাটের সবকিছু তাদের কাছে কেমন অচেনা ঠেকে। রাস্তায় দলে দলে মানুষ। সবাই ছুটছে। কোথায় ছুটছে কে বা জানে। এর মধ্যে অনেকেই তাদের স্বজনদের খুঁজে ফিরছে। মালবিকারা প্রথমে ঘোষবাড়িতে এসেই ওঠে। বুড়ো চাকরটা এখানেই রয়ে গিয়েছিল। তার কাছ থেকে জানা গেলো প্রায় সময় ঘোষবাবুদের খোঁজে এখানে পাকিস্তানি সৈন্যরা হানা দিতো। কী ভেবে যে বুড়ো চাকরটাকে মেরে রেখে যায়নি তা তারাই ভালো জানে। ঘরে এসে সবকিছু গুছাতে গুছাতে সময় লেগে যায়। বিকেলে মালবিকা ছেলেকে নিয়ে চলে যায় সোজা থানায়। কিন্তু সেখানে গিয়ে তাদের নিরাশ হতে হয়। এসব নামে কোনো বন্দী নাই এখানে। মায়ের উদভ্রান্ত চেহারা দেখে দেবরাজ বলে,
-মা, একবার ক্যান্টনমেন্টে গেলে হয় না? ওখানে হয়তো পাওয়া যাবে বাবাদের।
কথাটা মনে ধরে মালবিকার। কিন্তু ক্যান্টনমেন্টে তো এমনি এমনি ঢুকতে দেবে না। পরিচিত কাউকে ধরে যেতে হবে। আপাতত তাহলে ঘরে ফেরা যাক। মায়ের সাথে পরামর্শ করে ঠিক করতে হবে ক্যান্টনমেন্টে যাওয়ার ব্যাপারটা। শেষ পর্যন্ত তাদের ভাড়াটিয়ার আত্মীয়ের মাধ্যমে ক্যান্টনমেন্টেও গিয়েছিল মালবিকা, দেবরাজ ও নির্মল। কিন্তু ওখানেও পাওয়া যায়নি আদিত্যদের খোঁজ। হতাশায়, ক্লান্তিতে ভেঙে পড়েছে পুরো ঘোষ পরিবার। একসাথে পরিবারের সব পুরুষ কর্তাকে হারিয়ে তারা যেন অধিক শোকে পাথর হয়ে গেছে। যে যেখানে বলছে, যেভাবে বলছে, সেখানে সেভাবে গিয়ে হাজির হচ্ছে তারা, কিন্তু কোথাও চারজনের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। এভাবে প্রায় মাসখানেক কেটে গেলে তারা ধরে নেয়, ওরা হয়তো আর বেঁচে নেই। কিন্তু এ নির্মম সত্যটি গ্রহণ করার মতো মানসিক শক্তি তারা তো এখনো অর্জন করতে পারেনি। প্রভাব প্রতিপত্তিসম্পন্ন ঘোষবাড়ি এখন নিস্তেজ, নিরুত্তাপ, নিরানন্দ।
এরই মধ্যে একদিন বিকেলে ইউসুফ এসে হাজির। মালবিকার কাছে এসেছে সে। স্বামী, ভাই, বাবাকে হারিয়ে মালবিকা এখন এমনই যে, সে ভুলেই গিয়েছিল তার সমস্ত গয়না এবং জমির কাগজপত্র ইউসুপের হাতেই গচ্ছিত রেখেছিল। ইউসুফকে দেখে তার তা মনে পড়ে। ইউসুফ সেসব ফিরিয়ে দিতে এসেছে। কৃতজ্ঞতায় মালবিকার দুচোখ ছাপিয়ে জল নামে। ইউসুফ সেসব ফিরিয়ে দিতে দিতে মালবিকাকে বলে,
-বৌদি, একটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম। যদি আপনি অভয় দেন।
মালবিকা জিজ্ঞাসু চোখে ইউসুফের দিকে তাকায়। সেই প্রশ্নবোধক দৃষ্টিকে অভয় ভেবে ইউসুফ বলে,
-বৌদি, আদিত্যদের তো কোনো খোঁজ পাওয়া গেলো না। যদি বেঁচে থাকে, তবে একদিন ওরা নিশ্চয় ফিরে আসবে। কিন্তু না আসা পর্যন্ত আপনাকে তো সংসারের হাল ধরতে হবে। আপনাকে অনেক শক্ত হতে হবে। না হলে বৌদি, আপনার ছেলেমেয়েগুলো ভেসে যাবে।
মালবিকা খুব মন দিয়ে ইউসুফ ভাইয়ের কথাগুলো শুনছিল। এই মানুষটা তার স্বামীর অতি প্রিয়জন। খুব বিশ্বস্ত বন্ধু। এ পরিবারের একজন বড় শুভাকাঙ্খী। তাই ইউসুফের কথা শেষ হলে মালবিকা বললো,
-এখন তাহলে আমার কী করা উচিত ইউসুফ ভাই?
ইউসুফ বললো,
-বৌদি, আমি চাই আপনি চাকরি করেন। আপনি চাকরি করলে ছেলেমেয়েগুলোকে ঠিকমতো মানুষ করতে পারবেন। নাহলে আপনাকে গ্রামেই থাকতে হবে। আদিত্যকে ছাড়া আপনি গ্রামে ওদের ঠিকমতো মানুষ করতে পারবেন কিনা সন্দেহ আছে। আপনি দুই মাসীমার সাথে কথা বলুন। উনাদেরকে রাজি করান। আপনার চাকরি করাটা খুব দরকার।
মালবিকা চুপ করে কথাগুলো শুনে গেলো। সে এখন নতুন করে ভাবছে। ইউসুফ ভাই ঠিকই বলছে। শোককে শক্তিতে পরিণত করে ওকে রুখে দাঁড়াতে হবে। বাইরের জগতের সাথে যোগাযোগ না রাখলে দু’পরিবারের বাচ্চাগুলোকে সঠিকবাবে মানুষ করা যাবে না। কিন্তু ওকে চাকরিটা দেবে কে? কথাটি সে সরাসরি ইউসুফকে জিজ্ঞেস করে ফেলে,
-কিন্তু ইউসুফ ভাই, আমি চাকরি করবো বললে তো আর হবে না, আমাকে চাকরিটা দিবে কে?
ইউসুফ বললো,
-বন্দরে লোক নেবে কিছুদিনের মধ্যে। আপনি ওখানে অ্যাপ্লিকেশন করবেন। বাকিটা আমি দেখবো। কামাল আর অনিলও আছে আমার সাথে।
এরপর আরও টুকটাক কিছু আলাপ করে ইউসুফ বিদায় নেয়।
সেদিন সন্ধ্যায় মালবিকা মা এবং শ্বাশুড়ি দুজনের সামনেই কথাটা ওঠায়। বলে,
-মা, তোমরা দুই মা-ই এখানে আছো। একটা কথা বলতে চাই।
মনিবালা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বৌমার দিকে তাকায়। ঘোষগিন্নীর এখন কথা বলতে একদম ভালো লাগে না। তবু মেয়ের দিকে তাকিয়ে নিস্পৃহ গলায় বললেন,
-কী বলবি বল।
মালবিকা কোনো ভণিতায় গেল না। সরাসরিই বললো,
-মা, আমি ঠিক করেছি আমি চাকরি করবো। তোমাদের তো ঘরভাড়া, দোকান অনেক কিছু আছে। তা দিয়ে তোমরা ভালোমতো চলতে পারবে। আমারও গ্রামে সম্পত্তি আছে। তবে শুধু সেসবের উপর নির্ভর করে চলতে গেলে আমি আমার সন্তানদের ঠিকমতো মানুষ করতে পারবো না।
বলতে বলতে গলাটা ধরে এলো মালবিকার। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো সে। কত স্বপ্ন দেখতো আদিত্য তার সন্তানদের নিয়ে। আজ কোথায় হারিয়ে গেলো সে? তার আদরের ছোট ভাই মলয় যুদ্ধে যেতে চেয়েছিল। মা বাধা দেওয়াতে যেতে পারেনি। আজ মনে হচ্ছে, হয়তো যুদ্ধে গেলে ছেলেটা বেঁচে থাকতো। তার নিরীহ দাদাটা কোথায় আছে কেমন আছে কে জানে! তার বৃদ্ধ বাবাটার কী পরিণতি হয়েছে একমাত্র ভগবানই জানেন।
মালবিকাকে কাঁদতে দেখে মনিবালা এসে তাকে জড়িয়ে ধরে, তারপর নিজেও কাঁদতে কাঁদতে বলে,
-তোমার চাকরি করতে ইচ্ছে করলে চাকরি করো মা। আমার কোনো বাধা নেই।
ঘোষগিন্নী বলেন,
-ঘোষবাড়ির মেয়ে হয়ে, চৌধুরী বাড়ির বউ হয়ে তুই চাকরিতে যাবি? পারবি করতে?
মালবিকা স্বরকে দৃঢ় করে বলে,
করতে তো হবেই। নাহলে যে আমার সন্তানরা ভেসে যাবে মা।
মালবিকা চাকরি করার সিদ্ধান্ত নিলেও সাথে সাথে তার চাকরি হয়নি কিন্তু। এক বছর পরে তার চাকরি হয়েছিল। ইন্টারভিউতে টিকেই তার চাকরি হয়েছিল, কারো দয়ার দানে নয়। তবে আবেদন থেকে শুরু করে নিয়োগপত্র হাতে পাওয়া পর্যন্ত ইউসুফ, কামাল, অনিল খুব সহায়তা করেছিল। চাকরি করার জন্য মালবিকা ঘোষবাড়িতে এসে উঠেছিল। শ্বাশুড়ি গ্রামেই থাকতেন। মালবিকা তাঁর চার ছেলেমেয়ে নিয়ে বাবার বাড়িতে থাকতো। তবে ঘোষবাড়ি ততদিনে জৌলুসহীন। পরিবারের সব পুরুষকর্তাকে হারিয়ে তাদের ব্যবসা ওখানেই মুখ থুবড়ে পড়েছে। যে যেভাবে পেরেছে নিজেদের পকেট ভারি করেছে। শহিদ পরিবার হওয়া সত্ত্বেও তাদের অনেক সম্পত্তি সরকার জবরদখল নিয়েছে। মামলায় লড়ার মতো জনবল ও মনোবল তখন আর তাদের ছিল না।
মালবিকা শহরকেন্দ্রিক হয়ে যাওয়াতে গ্রামে মনিবালা একা হয়ে গেলো। যদিও সবাই ভেবেছিলো দেশ স্বাধীন হলে বুঝি আর কোনো অনাচার ঘটবে না, কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। ভূমিদস্যুরা, স্বাধীন বাংলাদেশেও তাদের থাবা বিস্তৃত করেছিল। যার ফলে তাদের সুপরিকল্পিত থাবায় মনিবালাদের অনেক সম্পত্তি বেহাত হয়ে গিয়েছিল। যারা এ থাবা বিস্তৃত করেছিল তারা অচেনা কেউ নয়, মনিবালাদের পরিচিতই। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে লড়ার মতো মানসিকতা তখন আর মনিবালার ছিল না। তার কেবলই মনে হতো, এরা তো তার বুক থেকে আদিত্যকে কেড়ে নিয়েছে! বেশি বাড়াবাড়ি করলে যদি দেবরাজকেও কেড়ে নেয়। ওই একটি ভয়ে ভূমিদস্যুদের বিরুদ্ধে লড়ার মতো সাহসিকতা কখনো অর্জন করতে পারেনি মালবিকা কিংবা মনিবালা।
মালবিকা চাকরি করে তার চার ছেলে মেয়েকেই মানুষ করেছে ঠিকই, কিন্তু নিজের গ্রাম থেকে সে ক্রমান্বয়ে বিচ্ছিন্নই হয়ে গেছে। শুধু দূর্গাপুজোয় কখনো কখনো বাড়ি এলে শুনতো, তাদের আরও কিছু সম্পত্তি বেদখলে গেছে। একসময় যে গ্রামে নন্দলালের সম্পত্তিই ছিল সবচেয়ে বেশি, কমতে কমতে তা এখন সামান্যতে এসে ঠেকেছে। মাঝে মাঝে মনিবালা দেবরাজকে উদ্দেশ্যে করে বলে,
-তোমার ঠাকুরদা ছিল এ গ্রামের সবচেয়ে বিত্তবান। তাঁর ছিল সবচেয়ে বেশি জমি। অথচ আজ দেখো, আমাদের সম্পত্তি বলতে এখন তেমন কিছুই নেই। আমি মরার পর যা আছে তারও দখল পাবে না। তোমরা তো গ্রাম থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে।
মনিবালার কথা সত্যি হয়েছিল। মনিবালার মৃত্যুর পর মালবিকা গ্রামে যাওয়া একেবারেই কমিয়ে দিলো। দেবরাজেরও কেন জানি গ্রামে যেতে ভালো লাগতো না। তাই সে শহরমুখীই হয়ে রইলো।

২১.

অতনুর কাছ থেকে এতটুকুই জানা হয়েছে আমার। সবকিছু খুলে বলতে চায় না সে। নন্দলাল ছিলেন অতনুর প্রপিতামহ। আদিত্য ছিলেন ঠাকুরদা। অতনুর ঠাকুরদারা কিন্তু আর কেউ ফিরে আসেননি। তাঁরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জীবন উৎসর্গ করেছেন। একটি পরিবার থেকে চারজন মানুষ জীবন উৎসর্গ করলেন অথচ বিনিময়ে তারা কোনো সরকারি সুবিধা পায়নি। ও হ্যাঁ পেয়েছিল, বঙ্গবন্ধুর স্বাক্ষর করা একটি করে সার্টিফিকেট। যাতে লেখা ছিল এ দেশের মুক্তির জন্য উল্লেখিত ব্যক্তিটি প্রাণ দেওয়াতে এ জাতি, এ দেশ কৃতজ্ঞ। ব্যাস্, এটুকুতেই সন্তুষ্ট ওরা। ওরা জানে প্রকৃত দেশপ্রেমিক কখনো দেশের কাছ থেকে কিছু চায় না, তারা শুধু দেশকে দিয়ে যায়।
তেমনি করে মনিবালা, মালবিকা, দেবরাজ, নির্মল, দীপা, নীপা, রূপা কিংবা আরও যারা আছে, তারাও দেশের কাছ থেকে কোনো প্রতিদান আশা করেনি। তবে কোন অভিমানে অতনুদের পরিবার একেবারে দেশান্তরী হলো তা এখনো আমার জানা হয়নি। জানি না আদৌ কোনোদিন জানতে পারবো কি না? কারণ অতনু খুব চাপা স্বভাবের। তবে দেশ ছাড়লেও অতনু এখনো বুকের মধ্যে লালন করে তার ঠাকুরদাকে, তার ঠাকুরদার এই দোতলা কাঠের বাংলোটাকে। তার কথায় বার বার এ দুটো প্রসঙ্গে ঘুরে ফিরে আসে। ওরই কথার সূত্র ধরে আমি আজ তাই এসেছিলাম এই গ্রামে। বাড়িটা দেখার পর থেকে আমিও কেমন যেন আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছি। মনে হচেছ আমার চারপাশেই যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে সেই প্রতাপশালী নন্দলাল চৌধুরী, তার ছেলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহিদ আদিত্য নারায়ণ চৌধুরী এবং ষোষবাড়ির চরিত্রগুলো। অনেক কিছু জানার আছে আমার। জানতে হবে অতনুর কাছ থেকে। অতনুর বাবা দেবরাজের কাহিনী বলতে গেলে আমার কিছুই জানা হয়নি। খুব সযতনে এই প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যায় অতনু। এমন কোন্ আঘাত তাঁকে দেশত্যাগে বাধ্য করেছিল তা আমাকে জেনে নিতেই হবে। আমার পরের গল্প হবে দেবরাজকে নিয়ে।

(সমাপ্ত)

***************************