সোনালী আঁশের গল্প
কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়
সোনালী আঁশের গল্প ১
ক.
দ্বিতীয়-তৃতীয় নেই,
এই দেশে বাণিজ্য-বহরে শুধু পাটচক্রে বাঁধা,
ঘাটে-ঘাটে দেখি তার এক পণ্য সাধা।
সারা গায়ে পট্টরজ্জু ভিখারি সেজেছে,
কৌশলে থলের কলে কে তাকে বেঁধেছে!
একমাত্র উপার্জক পুত্রটির হরিহর নামে
বৃদ্ধের সান্ত¡না,
সোনালী আঁশের গল্প দেশ তার শিশুকে শোনায় ।
খ.
সবুজের দেশ সহসা দেখেনি চোখে ধোঁয়া,
বৃহৎ ধোঁয়াটে যন্ত্র, কল-কারখানা।
‘নীল দর্পণ’-এ দেখে
বিষনীল মুখচ্ছবি
ছুটেছিল যারা নীলবর্ণ শৃগালের রূপ
সুচতুর লোভী,
ডান্ডি-ম্যানচেস্টারে পুনরায় একদিন
বাঁধা তারা পড়ে পুঁজির খোঁয়াড়ে,
রক্তপুঁজ-মাখা এক একমাত্র কাঁচামাল সম্বল তাদের।
সোনালি আঁশের গল্প ২
ক
একখানি পাটক্ষেত আত্কা লাফিয়ে উঠে দোলে না বাতাসে,
ভাঙ্গাচোরা মাচায়-বেড়ায় রোদে-মেলে-দেয়া গুচ্ছের সোনালি আঁশেরাও
নয় কোনো হাওয়ায়-ভেসে-আসা ধন, পরনকথার
রানীর সাজের মতো ভূত-জিন-পৈরীর যাদু
তক্ দির ছাড়াও চাই যে তদ্বির-
এই গূঢ় কথা মেনে জমির জায়নামাজে চাষীগণ সপে দেয়
শতভাগ সেজদার দেহ, দেয় তারা ঘাম-জবজবে শ্রম,
পৈতৃক দক্ষতার সবটুকু, ঢেলে দেয় তারা
ঠিক যেন এবাদতী মন।
প্রথমেই পিতার নিষ্ঠায় গড়ে থরোথরো মাটির মা-টিকে,
পরে নিবিড় বন্টনে বোনে বীজ।
শয়তান পাখিদের ঠোঁট থেকে রক্ষা পেলে সেই বীজ
মাটির নরম পেটে ওঠে বেঁচে, ওঠে বেড়ে,
প্রত্যাশিত একদিন মেলে ধরে দু’টি কচিপাতা
কাতর চাষীর চাতক চোখের নিচে। ক্লিষ্ট মুখে হাসি নিয়ে
সে-চাষীর কর্তব্য তখন নিষ্ঠুর নিপুণ নিড়ানিতে আগাছাকে দূর করা,
রোগ-পোকা-বালাইয়ের হাত থেকে কচি খোকা চারাদেরে রক্ষা করা,
তার বাদবাকি দেহমনও ঝরে পড়ে সেচের পানিতে,
আর মেঘের আশায়।
এইভাবে আসে একহারা তন্বীদেহে ভরাট সবুজ,
তথাপিও দীঘল আঁশেরা ধরে না তো সামান্যও সোনারঙ।
কৃষকের ধুলোট সন্তান সহসা ধরে না সোনারঙ,
উঠোনে এসেই হাসে না সে উজ্জ্বল সোনালি হাসিটি।
প্রথমে তো বাড়ির-ভিটার যাবতীয় খানা-ডোবা-পুকুরের
সব জল বর্ণে-বর্ণে কালো করে
কটু গন্ধ ঘোরে চারধারে,
ভেজা খড়ি থেকে, আঁশ থেকে
তীব্র ছড়ায় বাতাসে-বাতাসে।
তারপর ধীরে-ধীরে চাষী বউদের-মেয়েদের হাতে-পায়ে, আঙুলের করে
যায় অনুরূপ হীন দাগ ধরে।
তপ্ত দেহে লীন ফসলের-আবাদের জোর চিন এইসব
উত্তেজিত রাতে-রাতে ফের হয় টের গৃহস্থের,
কলঙ্কের ঘের যেন।
এইভাবে আটপৌরে বসবাস, ঘর-বার সবটাই কালো হলে,
গোটা গেরস্থালি হলে নোংরা, ঘিন্ঘিনে, দুর্গন্ধে আচ্ছন্ন,
তখনই কেবল
প্রাকৃতিক পট্ট আঁশ ধরে বাণিজ্যিক সোনারঙ ।
খ
সফল শস্যের বুকে মুক্তি পেলে সোনার বরন,
মানুষের মুখ তবু জোতা থাকে অনড়-অসাড়, অকাট-বন্ধন।
জল-কাদা-পাঁক থেকে
হালের বলদ পেলে ছাড়,
হুসেন মিঞার অর্ধেক বাদ
বাকি ফসলেরা এলে ঘরে, উঠোনে-বাথানে,
তবু জোতা থাকে মানবিক কাঁধ।
বর্গাদার দেহে তার, তৃষ্ণার জলে তার কালসিঁটে ছোপ ,
আর বসতের চতুর্দিকে বাতাসে বদবু
সেই বজ্র আঁটুনির অকাট প্রমাণ।
অধিক প্রমাণ এই: কিয়দংশ জীবন-যাপনে,
ঋণে-অকুলানে ঘরে-ঘরে হলে অনাহার,
হলে মহাজন ফড়িয়া নেতার নিধুয়া আছড়-
সর্পরূপ আনাগোনা সকাল-সন্ধায়,-
তোসা-বটমের গুণাগুণ-নির্বিচার
জলের মতন দামে
পাট-ভাঙা পাট চলে গেলে মোকামে-দোকানে,
গঞ্জে-ম্যানচেস্টারে,
তখন অদ্ভুত সোনালি ফাঁসে ভুকবন্দী সময়ের সাথে
স্বাভাবিক যোগ হয়, হয় জোতা
জমিযুক্ত মানুষের অসহায় জীবনের আরো একটি বছর।
সোনালি আঁশের গল্প ৩
গভীর পাটের ক্ষেতে রাত জল-ভেজা বাতাসেরÑ
শন্-শন্ অশান্ত-আচ্ছন্ন দোলের,
শেয়ালের ততোধিক, কেন্দুয়া বাঘের।
দেশের নিজস্ব পশু তারা নির্বিবাদে দখল করেছে স্বর্ণশস্য।
আলোকে-উত্তাপে, দিনে,
শ্রমের নিমিত্ত শুধু
মানুষেরা অগণন ছিল।
তারা, মানুষের চেহারার কৃষকেরা, ছিল
পাঁকা-কাদা আর পচানো গন্ধের দায়ভাগী।
আকস্মিক এক অন্ধকারে
যুবতী বউর কোনো নিরুদ্ধার চিৎকার ভেঙ্গে হয়
খান খান আর্দ্রতার বুক, কৃষ্ণকায় সবুজের মাঠ,
নিরেট-নিপাট নৈঃশব্দ্য-
বন্য পশুরা তখন লজ্জিত, ত্রস্ত-পলাতক ।
আর কৃষিক্ষেত্রে অতিসা¤প্রতিক এই খুন,-
ভয়াবহ এই ক্ষয়-খাবলানো, নিশীথে তখন
ঝুল আকাশের মূল চাঁদে
আঁকা হয় কলঙ্কের ন্যুব্জ দাগে
পাপীয়সী বুড়িটির রূপে।
পাহাড়-পর্বত সে নয়, সে নয় বহু পুরাতন।
খুনী মহাজন হুসেন মিঞার তরে
ভয়ঙ্কর বুদ্ধির সুতা সে-বুড়ি
ওইভাবে কাটে আজ কিছুদিন,
কাটে প্যাঁচ।
ফলে ভগ্ন হয়, শূন্য হয় ক্রমান্বয়ে
ঘর-বার, সর্বস্ব-স্বরূপ
কৃষক প্রজার।
তার রক্ত-ঘাম চন্দ্রগ্রাসে বেশুমার যায়,
আল্লার সেজদায় যায় তার দিন।
আজতক এইভাবে অক্ষয়-অপরাজিত চাঁদ সনাতন বেনে
চিত্রিত কলঙ্ক নিয়ে মুখে
সে বাংলাদেশে হাসে তার লুণ্ঠনের হাসি
সোনালি আঁশের রঙে রাঙা ।