উদয় তারার খোঁজে
মোহাম্মাদ শহিদুল্লাহ্
ছোটবেলায় বাঁশের কঞ্চিতে কয়লার কালি মেখে তালপাতায় বাংলা বর্ণমালা শিখেছি, মাস্টার মশাইর সামনে খোলা মাঠে ঘাঁসের উপর লাইন ধরে বসে ওই তালপাতায় বাঁশের কঞ্চি ঘুরাতাম আর সবাই সমস্বরে গাইতাম ক খ…, মনে পড়ে সে সব কথা। সকালের সূর্যটা যেন একটু একটু করে উঠছে, দখিনপাশের পুকুরধারে আকাশছোঁয়া শিরিষ গাছ, তার নিচে ছোট ছোট ঢেউগুলো যেন চিক চিক করে উঠছে, পুকুরের চারিদিকে লতাপাতা, কলকে ফুল, ধুতরা ফুল, প্রকৃতি যেন সবুজের ডালা সাজিয়ে বসেছে আমাদের চারিদিকে। একটু একটু করে যেন সব দেখতে পাচ্ছি মনের জানালা থেকে।
একটু বড়ো হয়ে যখন হাইস্কুলে ভর্তি হলাম, মনে পরে হেমন্তের সকালে খালি পায়ে শিশির ভেজা ধানক্ষেতের মধ্যে ‘ছিলা’ (বা সিঁথি) পথে হেঁটে যেতাম স্কুলে।তখনকার ধানগাছ ছিল অনেক উঁচু সহজেই হারিয়ে যাওয়া যেতো, এখনকার মতো নয়। এসবই এখন সুখস্মৃতি।
যে গ্রামে আমার জন্ম তার নাম উদয় তারা বুড়িরচর, পাশের পোনা নদীটাই এই গ্রামের উত্তর সীমানা, এটি মঠবাড়িয়া উপজেলারও উত্তর সীমানা। বইয়ের পাতায় এটার নাম পোনার দোন, দোন হচ্ছে পাশাপাশি বয়ে যাওয়া দুই নদীকে যে আড়াআড়িভাবে বাঁধে তেমন ছোট নদী, অতীতে পোনার দোন পাশাপাশি বয়ে যাওয়া বলেশ্বর ও বিষখালি নদীকে ভালবাসায় বেঁধেছিল, এখন সে ছোট হয়ে শুধু বলেশ্বরের পানি বুকে নিয়ে বেড়ায়। উদয় তারা গ্রামের মাঝখানে খোলা মাঠে ছিল এক ছোট্ট নদী, তাকে পূর্বদিকে সাফা বাজারের দিকে বয়ে যেতে দেখেছি, সেখানে ভাসতে দেখেছি নৌকাও, সে নদীটি এখন আর নেই, আমার স্বপ্ন থেকেও সে যেন প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছিল; মজার ব্যাপার, আমেরিকায় এসে সেই হারিয়ে যাওয়া নদীটির খবর বেড় করতে পেরেছি, সেকথা পরে বলছি। তার আগে বলি, যখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই, তখন হলের এক বড়ো ভাই আমার কাছে জানতে চাইল আমার বাড়ি কোথায়, কথাপ্রসঙ্গে বাড়ির কাছের বাজার ‘তুষখালি’ শব্দটি বলাতেই উনি বললেন “ঐ যে কৃষক-বিদ্রোহ হয়েছিল” আরও বললেন “তুষখালি কৃষক বিদ্রোহ বাংলার কৃষক আন্দোলন ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ”। সেই যে শুরু হল উদায় তারাকে খোঁজা, এখনো তাকে খুঁজে বেড়াই। তারপর গবেষণার কাজে বিদেশে থাকা অবস্থায় ১৯৯৬ এ হঠাৎ বাবা মারা গেলে দাদা মমিন উদ্দিন আকনের তৈরি সম্পূর্ন কাঠে নির্মিত ‘মমিন মসজিদ’ ভীষণ রকমের অস্তিত্ব সঙ্কটে পরে। সেটিকে বাঁচাতে গিয়ে আগের সেই ঐতিহ্য খোঁজার নেশায় যেন ভালবাসা বইতে শুরু করলো।
আমি তখন আমেরিকার পেন্সিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গবেষক, হঠাৎ খবর পাই মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি এশিয়ান রিসার্চ সেন্টারের, খবর নিয়ে জানলাম সেখানে উদয়তারা বুড়িরচর সহ আশেপাশের চব্বিশটি গ্রামের আর্থসামাজিক অবস্থা মাইক্রোফিল্মে সংরক্ষিত আছে। বিশ্বের ইতিহাসে জঙ্গল কেটে মানব বসতির যে বিস্তার এবং তাতে নতুন জমিনদার ও কৃষক এর মধ্যে পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ায় যে সামাজিক আন্দোলন গড়ে ওঠে, এই চব্বিশটি গ্রাম তার অনন্য এক উদাহরণ, বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে সেগুলো পড়ানো হয়। এভাবেই নিজেকে একটু একটু করে আবিষ্কার করতে শুরু করি।
১৭৭৬ সনে তৈরি রেনেলের ম্যাপে দেখা যায় পিরোজপুরের দক্ষিণ দিকে পুরোটাই সুন্দরবনে বিস্তৃত। ১৮৩৯ সনে আঁকা চিত্রশিল্পী এফ পি লেয়ারড এর একটি পেন্সিল স্কেচ রয়েছে ব্রিটিশ লাইব্রেরীতে, সে ছবিতে ধরা আছে সুন্দরবন কেটে কেটে বসতি গড়ার কথা। উদয়তারার সঙ্গে যে আরও ২৩ টি গ্রাম নিয়ে যে অঞ্চলের কথা বলা হয়েছে তার নাম ‘তুষখালি আবাদ’, বা তুষখালি স্টেট যা এখনকার পুরো মঠবাড়িয়া উপজেলা।
আমার ভাবনা হয় এই অঞ্চলে যারা বসতি শুরু করেছিল তারা কতোইনা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে জীবন কাটিয়েছেন। গভীর জংগল কেটে জমিকে চাষযোগ্য করতে হয়েছে, এ অঞ্চলে বাঘ ও কুমিড়ের আধিপত্যের কথা ঐতিহাসিক ও ততকালিন বাকেরগন্জের জেলা মেজিস্ট্রেট বেভারিজ তার বইয়ে লিখেছেন, বোধ করি এলাকার বাসিন্দারা নির্ভয়ে থাকতে পারেননি। সবচেয়ে বড়ো প্রতিবন্ধকতা ছিলো মানুষরাই, যারা জমিনদার! নানান রকমের জমিনদার: তালুকদার, ওশাত তালুকদার, হাওলাদার, নিম হাওলাদার, জোতদার, সরকারী কৃষক তারপর রেয়াতি বা আসল চাষা। এইসব চক্রাকার জমিদারদের উপর লাঠি ঘুরাতো ব্রিটিশ সরকার। শুধু কি তাই! মাঝে মধ্যেই পর্তূগীজ ও মগরা এখানে আক্রমন করতো। সর্বপরি ঘন ঘন সাইক্লোনের প্রভাব। এইসব নানান প্রতিকূলতা ও অস্থির পরিবেশে মানুষের মননশীলতা ঠিকঠাক কাজ করেনা। ঐতিহাসিক মি: বেভারিজের কথার সংগে সুর মিলিয়ে বলতে চাই কোন অঞ্চলের সঠিক ইতিহাস জানা বা তাদের শরীরের রক্তপ্রবাহ বা পাল্স জানতে হলে ঐ অঞ্চলের লোকদেরকেই করতে হবে।