মাসুদ খান/ তিনটি কবিতা
কুড়িগ্রাম
কোনোদিন আমি যাইনি কুড়িগ্রাম।
রাত গভীর হলে আমাদের এই প্রচলিত ভূপৃষ্ঠ থেকে
ঘুমন্ত কুড়িগ্রাম ধীরে ধীরে আলগা হয়ে যায়।
অগ্রাহ্য করে সকল মাধ্যকর্ষণ।
তারপর তার ছোট রাজ্যপাট নিয়ে উড়ে উড়ে
চলে যায় দূর শূন্যলোকে।
আমরা তখন দেখি বসে বসে আকাশ কত-না নীল
ছোট গ্রাম আরো ছোট হয়ে যায় আকাশের মুখে তিল।
অনেকক্ষণ একা-একা ভাসে নিখিল নভোভারতের রাজ্যে রাজ্যে।
দক্ষিণ আকাশে ওই যে একনিষ্ঠ তারাটি,
একসময় কুড়িগ্রাম তার পাশে গিয়ে চিহ্নিত করে তার অবস্থান।
তখন নতুন এই জ্যোতিষ্কের দেহ থেকে মৃদু-মৃদু লালবাষ্প-ঘ্রাণ ভেসে আসে।
সেই দেশে, কুড়িগ্রামে, ওরা মাছরাঙা আর পানকৌড়ি দুই বৈমাত্রেয় ভাই
কুড়িগ্রামের সব নদী শান্ত হয়ে এলে
দুই ভাই নদীবুকে বাসা বাঁধে
স্ত্রীপুত্রকন্যাসহ তারা কলহ করে।
নদী শান্ত হয়ে এলে
শাস্ত্রবাক্যে বাঁধা যত গৃহনারী
প্রাচীর ডিঙিয়ে এসে নদীকূলে করে ভিড়
প্রকাণ্ড স্ফটিকের মতো তারা সপ্রতিভ হয়।
হঠাৎ বয়নসূত্র ভুলে যাওয়া এক নিঃসঙ্গ বাবুই
ঝড়াহত এক প্রাচীন মাস্তুলে ব’সে
দুলতে দুলতে আসে ওই স্বচ্ছ ইস্পাত-পাতের নদীজলে।
কুড়িগ্রাম, আহা কুড়িগ্রাম!
পৃথিবীর যে জায়গাটিতে কুড়িগ্রাম থাকে
এখন সেখানে নিঃস্ব কালো গহ্বর।
কোনোদিন আমি যাইনি কুড়িগ্রাম।
আহা, এ-মরজীবন!
কোনোদিন যাওয়া হবে কি কুড়িগ্রাম?
ডালিম
যুগের যুগের বহু বিষণ্ণ বিবর্ণ মানুষের দীর্ঘনিঃশ্বাসের সাথে
নির্গত কার্বন-ডাই-অক্সাইড–
তা-ই থেকে তিলতিল কার্বন কুড়িয়ে
জমাট বাঁধিয়ে, কাষ্ঠীভূত হয়ে
তবে ওই সারি-সারি দিব্যোন্মাদ ডালিমের গাছ।
বৃক্ষের যতটা সাধ্য, তারও বাইরে গিয়ে
তবেই-না ওই টানটান বেদানাবৃক্ষ, ব্যাকুল বেদনাকুঞ্জ,
মায়াতরু…রূপাঙ্কুর…রূপসনাতন…
পাতার আড়ালে ফাঁকে-ফাঁকে ফলোদয়
থোকা-থোকা গুপ্ত রক্তকুপিত উত্তপ্ত বিস্ফোরণ
রামধনুরঙে, মগ্নছন্দে
ফলিয়ে ফাটিয়ে তোলে ডালে-ডালে লালাভ ডালিম।
বসে আছি ম্রিয়মাণ…বেদনাবৃক্ষের নিচে, পড়ন্ত বেলায়।
সামনে খুলে মেলে-রাখা একটি ডালিমফল, তাতে
প্রভূত বেদানা-দানা, নিবিড় বেদনাকোষ…আর,
বেদানার দানারা তো আর কিছু নয়, জানি–
টলটলে করুণ চোখে রক্তজমা চাবুক-চাহনি…
ভাবি,
এতসব ডালিমকোষের মধ্যে, ঠিক কোন কোষটি রচিত
আমারই সে ন্যুব্জ ব্যর্থ বিষণ্ণ পিতার বাষ্পঠাসা দীর্ঘশ্বাসের কার্বনে!
ঘনীভূত হয়ে ওই বায়ব অঙ্গার, তিলে-তিলে, অনেক বছর ধ’রে…
হোমাপাখি
পড়তে থাকা শুরু হলে একবার, জানি না কতটা পতনের পর সূচিত হয় উত্থান আবার-
ভাবছি তা-ই আর মনে পড়ছে সেই হোমাপাখিদের কথা যারা থাকে আকাশের অনেক উঁচুতে। আকাশেই ডিম পাড়ে। পড়তে থাকে সেই ডিম। কিন্তু এত উঁচু যে পড়তে থাকে দিনের পর দিন। পড়তে পড়তেই ডিম ফুটে বাচ্চা হয়। তখন বাচ্চা পড়তে থাকে। পড়তে পড়তেই বাচ্চার চোখ ফোটে, ডানা হয়, পালক গজায়। একদিন দেখতে পায় সে পড়ে যাচ্ছে। অমনি চোঁ করে উড়ে যায় মায়ের দিকে। উঠে যায় অনেক উঁচুতে। এত উঁচুতে যে পাখিরা আকাশের গায়ে ইতস্তত ভাসমান তিলচিহ্ন হয়ে ফুটে থাকে।
ওই পক্ষিকুলে জন্ম পুনর্জন্ম আমাদের, ওই পক্ষিকুলেই পালন-পোষণ-পতন-উত্থান-উড্ডয়ন…