ডায়ান সিউস-এর কবিতা
বাঙলায়ন: ঋতো আহমেদ
[ডায়ান সিউস, ২০২১ সালে প্রকাশিত ‘frank: sonnets’ কাব্যগ্রন্থের জন্য এ বছর (২০২২) কবিতায় পুলিত্জার পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তিনি কালামাজু কলেজের দীর্ঘ-দিনের আবাসিক শিক্ষক ও লেখক। গত ৯ই মে পুরস্কার ঘোষণার পর এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “এটা এমন এক প্রাপ্তি যা আমি কখনও, কখনও, কখনওই কল্পনা করতে পারিনি। শক এবং বিস্ময়ের বাইরে অন্য কিছু অনুভব করতে পারছিনা এ মুহূর্তে।” এটি তাঁর পঞ্চম বই। সিউস নাইলে বেড়ে ওঠেন। আর ১৯৭৮ সালে কালামাজু কলেজ থেকে স্নাতক হন। তারপর ওই কলেজেই ইংরেজি বিভাগে শিক্ষকতা শুরু করেন। ২০১৭ পর্যন্ত প্রায় তিন দশক ধরে ওই কলেজের রাইটার-ইন-রেসিডেন্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয় এবং সেন্ট লুইসের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষকতা করেন। এই বইয়ের কবিতাগুলো তাঁর সেই জীবনের গল্প বলে যে জীবন নিয়ত জীবন-পাতার প্রান্তে পিছলে পড়ার ঝুঁকি নিয়ে যাপিত হয়েছে। এখানে সিউসের মিশিগানের শ্রমজীবী শ্রেণির শৈশব থেকে নিউইয়র্ক শহরের বিপজ্জনক প্রলোভনের দিকে এগিয়ে যাওয়া এবং ফিরে আসার গল্প রয়েছে। কবিতাগুলোতে সিউস চিন্তা ও সময়, কবিতা ও কাদা, এইডস ও আসক্তি, খ্রিস্ট আর মাতৃত্ব নিয়ে কোমলভাবে এগিয়ে যান। তিনি আমাদের দেখান কীসে আমাদের সক্ষমতা, কীসে আমাদের অপ্রয়োজন, আর দেখান যখন আমরা নিঃস্ব তখনও পরস্পরের জন্য কী অফার করতে পারি। গতানুগতিক দেখার বাইরে, তিনি আমাদের দেখান অন্যভাবে। কবিতাগুলো সনেট। কিন্তু ট্র্যাডিশনাল সনেট নয় কিছুতেই। তাঁর নিজস্ব ছন্দ ও গঠন এই সনেটগুলোয় বিশেষভাবে লক্ষণীয়।]
ফ্রাঙ্ক: সনেট্স
১.
গাড়ি চালিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে কেইপ ডিসএপোয়েন্টমেন্টে এসে হাজির হই
আমি, কিন্তু গাড়ি থেকে নামার একদমই কোনও শক্তি অবশিষ্ট ছিল না
শরীরে। ভাড়ার গাড়ি। নীল ফোর্ড ফোকাস। পথে একবার এক মাঠের মধ্যে
হিসু করার জন্য এক আধো-পাবলিক প্লেসে থামতে হয়েছিল। রাস্তার পাশেই
সেখানে উবু হয়ে বসে গিয়েছিলাম শুধু। ঠিক বুঝতে পারছিলাম না কী হচ্ছে
আমার মুত্রথলীতে। হিসু করলাম আর শেষ করার পর আবার হিসু চাপলো,
আবারও হিসু করলাম। কোনও দিকে না তাকিয়ে বেয়ে উঠলাম গাড়ির পেছন
সিটে আর একটা ন্যাপ নিলাম। দেখতে আমি কিছুটা ফ্রাঙ্ক ও’হারার মতো, সুন্দর
নাক নেই, বাড়া নেই, জীবনে আমার নিউইয়র্ক স্কুল নেই, ল্যারি রিভারসও নেই।
কেইপ ডিসএপোয়েন্টমেন্টে একটা দিন কাটানোর অর্থ খরচ করছি আর ভাবছি,
খুব করে ভেবে দেখছি ওই লাইটহাউজের চূড়া থেকে সমুদ্রের ঠাণ্ডা নোনা জলে
দীর্ঘ এক পতন— কেমন হবে। আরও ভেবেছি, ওই ওশান মেডিক্যাল সেন্টারে
একবার একটা চেক-আপের জন্য যাবো নিশ্চয়ই, কিন্তু কীভাবে যে বোঝাই তোমাদের
আমার এই বিরামহীন অনুসন্ধান আসলে সৌন্দর্যেরই অনুসন্ধান কিংবা মুক্তির?
২.
ঝকমকিয়ে ওঠার প্রয়োজন নেই, ভার্জিনিয়া উল্ফ লিখেছিলেন তাঁর “এ র্যুম অব
ওয়ান্জ অউন”এ, আহা, যদি ওটা সত্যি হোতো, যেই বাচ্চাদের ভালোবেসেছি—
ওরা ওঠেনি ঝকমকিয়ে, জুন, মনে করতে পারে না তার নামের পদবী, ওর কাত
হয়ে থাকা মাথা যেন শুকিয়ে যাওয়া অখ্যাত কোনও ফুল, পেনসিলের সীসার মতো
কালো ছোট্ট পচা দাঁত, ঘরোয়া জামাগুলোও পুরনো এমনকি ৪ নাম্বার গ্রেডের,
আর ওই ছেলেটা, ড্যানি ডেভিস, ওর ওই ধূসর ঘর, ঘোড়া, চোখ, কাপড়চোপড়,
আঙুলের ডগা আর ছাপ, অংকন যদিও তামাটে নয় তবে ধাতব খেউরির মতো
যে কোনও চুম্বক দিয়ে পরিষ্কার করতে পারবে। আর, ওই মিসেস লাপয়েন্ট
ছিলেন খুঁড়ে-তোলা এক হাড়ের মতো, যদিও ঝকমকালেন মিস এজ, ৩য় আর
৪থ শ্রেণির শ্রেণিকক্ষের মাঝ বরাবর শিট কেকের মতো কেটে, আধাআধি
ক্লাস নিলেন, পরনে ছিল তাঁর ল্যাভেন্ডার রঙের শিফনের জামা আর স্কুলে পরে
আসার পাতলা স্বচ্ছ ওড়না, নীলাভ-সবুজ আই শ্যাডো,— প্রিয়তমা, নিচু হয়ে
ফিসফিসিয়ে, পারফিউমের গন্ধ মাতিয়ে, এমনভাবে বললেন, তোমাদের বাবা মারা
গেছেন, যেন জোঁকের মতো কিংবা গয়নার মতোই অশ্রু তাঁর গলায় আটকে গেছে।
৩.
দুটো মেয়ে গর্ভপাত করেছি আমি, কিন্তু কীভাবে জানলাম ওরা মেয়ে, কারণ
একজন মা-ই তা বোঝেন, অন্তত একটা হলেও মেয়ে ছিল, হয়তো একটা মেয়ে
আর একটা ছেলে, ব্যথা লাগবে কি খুব, জানতে চাইছিলাম গর্ভপাত-পূর্ব ওই
মহিলার কাছে, চোখগুলো তাঁর খুবই নির্লিপ্ত ছিল, দেখে আমি এতোটা বোকা
আর জীবনেও হইনি, কী নিষ্ঠুর ও, যদিও ঠিকই বলেছিল, আমিই ছিলাম—
হ্যাঁ আমিই বোকা, দয়া করে কোনও রাজনীতি নয়, আমি কখনও ওটা
কাটিয়ে উঠতে পারিনি, না আমি অস্বীকারও করি না, দুটি মেয়ে এক কপর্দকহীন
মায়ের সাথে আর এক মাদকাসক্ত বাবা, মনে আছে আমার, ক্ষুধার তাড়নায়
একবার এক খরগোশকে গুলি করেছিলাম, না আমি আদিম নই, ভালো মানুষও না,
কোনোভাবেই ভালো নই আমি যীশু, কোনোভাবেই এমনকি খারাপও নই মেরী
ভালোর কথা ছাড়ো, আমি তো জীবিত ছেলেটাকেই ক্যামন করুণার ভঙ্গিতে
চেপে ধরেছিলাম তখন, বুঝতেও পারিনি ঘুণাক্ষরে সেই সময়, কিন্তু এখন যখন পেছনের
কথা স্মরণ করছি, দেখছি ওর ওভারডোজ হয়ে গিয়েছিল আর প্রায় মরতে বসেছিল,
প্রাণ আমার, বলল সে, ঠোঁট নীল হয়ে গেছে, চিন্তা করো না, পরিশোধ করে দিয়েছি আমি।
৪.
স্বর্গ থেকে ফিরে আসাটাকেই আমার মনে হয় ওরা বলে
পুনরুত্থান। জামের কালো উজ্জ্বলতা, চকচকে উপসাগর,
পাহাড়ি ঝকমক, আনন্দময় ভয়াবহ নিঃসঙ্গতা—এইসব
কিছুই মনে রেখো না। সমুদ্র তীরের এলোমেলো ফেনা,
কাই বলে ওরা, প্রেম ও মৃত্যু এসে মিশে একাকার কাদা,
আর আছে অনভ্যস্ত পাখি। পেছনের এই সমস্ত কিছুই
ভুলে যাও, ভুলে যাও জন্মের আগে কোথায় তুমি ছিলে।
ডেল যখন বাচ্চা ছিল, যখন আঙুল চুষতো, বলেছিল
সে আমার রক্তের আওয়াজ মনে করতে পারে যা তাকে
টেনে নিয়ে যায় তার অতীত জরায়ুতে, আরাধ্য ভাষ্যের
অন্তরায় সহ, হয়তো বহু মিথ্যের এটাই প্রথম। সর্বদাই
ফিরি আমি, আমার স্বভাব, সেই মানুষটির মতোই, ক্রে
মাছের শক্ত গুঁতো না খেয়েও যে লোক মাছটিকে ছেড়ে
না দিয়ে পারে না, সেই গান, সেই গ্র্যান্ড অউল অপ্রি।
৫.
পরম বর্তমান কালের সাড়াই সবচেয়ে ভালো সাড়া,
আহ্ বৃষ্টি, ও বৃষ্টি, বৃষ্টি, বৃষ্টি আর বাতাস, ওই চিত্রাভ
আকাশ, আবারও বন্দুক-হামলা, আবারও জার্মানির এক
শপিং মলে, এ’জন্যই কি মানুষ চায় মানুষ তাকে দুহাতে
জড়িয়ে থাকুক, বরং সাগর পাড়ে হাঁটতে যেতে চাই
আমি, শান্তি আছে, শূন্যতা আছে, গোলাঘর গিলে নেয় ওই
নিপুণ ওড়া আর কান্না, যাদের শূন্যতা বা শান্তির বিলাসিতা
আছে, বজ্রের সৌন্দর্য তো সেখানেই যেখানে ব্জ্রপাত
হয় কম, হৃদয় যেন কাঁঠালের আঠার মতোই, আঠা, ভেজা
চুলের সাথে কাঁধের যেমন, দাদার সেলুন, হেয়ার টনিকের
রঙের সারি যেন এক রংধনু, শেষ দিনগুলো পার করতে
তৈরি হয় পরদাদীর ঘর, সরে যায় পুল টেবিল, আর বাবা
স্টোভ পাইপে ফিট করতে রান্নার টেবিলটা কাটেন আধো-
গোল করে, বৃষ্টি, আহ্ বৃষ্টি, অ্যামেরিকায় ফ্যাসিবাদ প্রবল।
৬.
কবিতা, একমাত্র পিতা, ভূ-দৃশ্য, চাঁদ, খাবার, নাহকোট্টায় ক্ল্যাম
চাউডার বাটি, আমি কি সুখী ছিলাম, ঝিনুক-খোলসের মতো চকচকে
রুপালী পর্বতমালা, কবিতা, একমাত্র সোনা, অথবা কী এটা, বক্ষজোড়,
পায়ের পাতা, আমার হাত, তর্জনী, নখর, উগ্দা, কাগজকুচি, শাশ্বত
কী জিনিস তবে, ছুটে যাই আমি সাগর পাড়ে, উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে
বেড়াতে, নিজের বৃক্ষ থেকে শুরু করেছি, মনে মনে বলেছি এই
আমার গাছ, এই আমার গাছ, কথা শেখার আগের সেই আমার কথা
ভেবেছি, মা-বাবার স্পর্শে কী যে উচ্ছ্বসিত ছিলাম, অকারণে মিল্ক-উইড
খুলেছি, পেঁজা তুলো উড়িয়েছি, কোনও তুলনায় যাইনি, তাৎপর্য
মুক্ত হতে, আঁটসাঁট চুলকানি-ওঠা সুয়েটারে শরীর মুচড়েছি, শরীর,
বক্ষজোড়, যোনিমুখ, জরায়ুর ছোট্ট গুহা, ভগাঙ্কুর, স্পর্শ চায়, এসো,
এইসব কী তা বুঝে ওঠার আগেই আমি সাড়া দিয়েছি, পাঁচমাত্রার
কাব্যে, অনুভব করতে পেরেছিলাম কি, ভাষা কি অনুভূতিকে
প্রকাশ করতে পারে ঠিকঠাক, পারে কি প্রকাশকে প্রকাশ করতে
৭.
আমি একটা স্বল্পদৈর্ঘ্যের মুভি দেখেছিলাম যেখানে একটা লোক ছোট্ট একটা পাখির গায়ে টোকা মারছে, পাখিটারে
দু’হাতের তর্জনী আর বুড়ো আঙুলের মাঝ বরাবর ধরে। সামান্য আদর পেতে পাখিটাও মাথা হেলিয়ে পাল্টা ঠোকর
মারছে, যেন তার মনে হচ্ছে সে এক প্রভু-সমান স্পর্শ পেল। তখন মুহূর্তের জন্য আমিও বুঝতে পারছিলাম প্রেমের
করুণার অনুভব কী জিনিস, সামান্য-মাত্রায়, ধরনটাই কেবল দেখানো হয়েছে কিন্তু মুখে তেমন কিছুই বলা হয়নি।
তাই তখন আমিও তোমাকে ছুঁতে ভয় পেয়েছিলাম। ভয় পেয়েছিলাম কারণ ফোনে যে-সব ক্ষতের কথা বলছিলে
আমায়। ওগুলোর প্রত্যেকটির অবস্থান, আকার আর সেন্টিমিটারে। তুমি যাদের যীশুর-দাগ বলে অভিহিত করো।
হ্যাঁ, এই সমস্ত কিছুর কারণ যেন আমি নিজেকে গুছিয়ে নিতে পারি, ভয় না পাই, অথবা কম ভয় পাই, কিন্তু তবু
মৃত্যুকে ভয় পাচ্ছিলাম আমি, যেন তুমিই মরে যাচ্ছিলে। যখন প্রথম এখানে এসেছিলাম, দীর্ঘক্ষণ তোমার চোখের
দিকে তাকিয়ে ছিলাম আর তুমি শিহরিত হচ্ছিলে, আমাকে বলেছিলে অন্যদিকে ফিরতে। মৃত্যুকে নিয়ে তুমি ছিলে
স্বেচ্ছাচারী, যদিও আমার ভয়কে ভদ্রভাবেই গ্রহণ করেছিলে, বুঝতে পেরেছিলে আমাকে, যেন ঝড়ো কোনও বিদ্যুৎ-
চমকে ভয়-পাওয়া এক শিশু, হ্যাঁ আমি ওতেই তাড়িত হতাম, দশ বছর বয়সে। আর ব্লু নিয়ে বলেছিলে একবার
যখন মরে যাবে তুমি, আমি আর শুনতে পাবো না ব্লু, জনি মিশেলের ওই ব্লু, শুধু এই গানটাই নয়, পুরো এ্যালবাম।
এইভাবে তুচ্ছ একটা অভিশাপ রাখলে আমার কাঁধে নীল-রং-করা পশমের মতো, আর তাই এখন শুনছি আমি
তোমাকে উপেক্ষা করেই। আর এই শ্রবণে সমস্ত সর্বনাম সরে গেছে। আমরা এখন শুনছি। মৃত্যু বলে কিছু নেই।
ঋতো আহমেদ- কবি, লেখক ও অনুবাদক