You are currently viewing জীবনানন্দ দাশ-এর কারুবাসনা: উপলব্ধির আরশিতে –সৃষ্টির মহিমা || দেববর্ণা 

জীবনানন্দ দাশ-এর কারুবাসনা: উপলব্ধির আরশিতে –সৃষ্টির মহিমা || দেববর্ণা 

জীবনানন্দ দাশ-এর কারুবাসনা: উপলব্ধির আরশিতে –সৃষ্টির মহিমা

দেববর্ণা 

ঈশ্বরকে আমি কোনোদিনও দেখিনি, তবুও কেনো কি জানি চেতনা ও বিশ্বাসের সম্পৃক্ততায় যে মান্যতা তৈরী হয়েছে তা নৈমিত্তিকতার জাল ছিঁড়ে অন্তরঙ্গভাবে বসে গেছে। উদ্ধারার্থে তাই তাঁর অনুকম্পায় শুরু করলাম — আমার দৃঢ় বিশ্বাস বিবর্ধকে চোখ রেখে আজন্মকাল বসে থাকলেও এমন একটি মানুষ এ জগতে পাওয়া যাবে না যার মধ্যে বিধাতা কোনোরকম গুণ বা বিশেষত্ত্ব না দিয়েই পাঠিয়ে দিয়েছেন। কনটেম্পরারি দর্শনের অন্তর্গত একটি ক্ষেত্রে, রবীন্দ্রনাথ তাঁর মানবতাবাদে স্পষ্টত বলেছিলেন –𝙴𝚟𝚎𝚛𝚢 𝙿𝚎𝚛𝚜𝚘𝚗 𝙱𝚘𝚛𝚗 𝚄𝚗𝚒𝚚𝚞𝚎”…
সুতরাং পশুর থেকে মানুষ আলাদা হওয়ার নেপথ্যে চেতনা বাদেও আরেকটি গুণক জোরদারভাবে কাজ করে তা হলো এই –প্রতিভা। খিদে শুধুই শরীরের নয়, আত্মারও থাকে। সত্যি বলতে কি, কারুবাসনা পড়বার আগে থেকেই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি ও জীবন দিয়ে উপলব্ধি করলাম –প্রতিভা নামক এই বিশেষ X ফ্যাক্টরটা দেওয়াই হয় যাতে বিষম যন্ত্রনার দিনগুলোয় দেরাজ ঘেঁটে শতবর্ষ প্রাচীন চিঠি বের করবার মতোই, প্রতিভাকেও টেনে হিচড়ে বের করে এনে, ফুঁ দিয়ে অভিমানী ধূলো ঝেড়ে  মননশীল উপায়ে একাকিত্ব কাটানো যায়। একাকিত্ব যেন কাউকে মৃত্যুপথচারী না করে তোলে উপরন্তু সেই ক্লেশক্লিষ্ট জীর্ণতা থেকে অবশ্যই যেন এমন কিছু সৃষ্টি হয় যাতে ধরিত্রী তাঁর সংগ্রহে সেটি রাখতে পারে।
মানুষ সামাজিক প্রাণী, নিঃসঙ্গতা কিন্তু মোটেই সহ্য হয় না তাঁর। পক্ষান্তরে, প্রতিভা আবার চূড়ান্ত অসামাজিক গুণক,তথাকথিত সুস্থ অবস্থায় সে তেমন বের-টের হয় না। মানুষকে একেবারে নিজের করে পেতে গুটিয়ে বসে থাকে। জাগতিক ঝড় বৃষ্টি কটূক্তি শুনে জরাজীর্ণ মানুষ যখন প্রায় মরে যাচ্ছে তখনই তাকে খুঁজে বের করা হয় বা বলা ভালো সেই একটু এগিয়ে এসে চুপ করে অপেক্ষা করে। যন্ত্রনার সাথে অমল সৃষ্টির যেন চিরাচরিত এক লুকোচুরির সম্পর্ক।
জীবনানন্দ দাশের কারুবাসনা উপন্যাসটি পড়তে পড়তে আমার মধ্যে স্থায়ী বসবাসকারী এই ধারণাটির উপর খানিক বিশ্বাসযোগ্যতার পরত চাপলো।
নাতিদীর্ঘ একটি উপন্যাস, অসম্ভব সাবলীল সুচারু হাতের ছোঁয়া আছে, সহজবোধ্য তবুও সহজলভ্য নয়। ১৯৩৩সালে দুটি পাণ্ডুলিপি যা লেখক, টুকরোতে লিখেছিলেন, পরবর্তীতে একত্রিত করে সম্পাদনা করা হয়। প্রকৃতির অবহেলিত দিকগুলো যা এড়িয়ে পার করে আসাটাই আমাদের সহজাত প্রবৃত্তি, সেটা ধরে বেঁধে পাকড়াও করে লেখাই বোধহয় লেখকের কাজ আর জীবনানন্দ সেই বিদ্যায় ক্ষেত্রজ্ঞ পন্ডিত। পড়তে বসলে মনে হবে এতো আমার কথা, উপন্যাসে উপভুক্ত প্রতিটি চরিত্রের সাথে আমার আপনার পারিপার্শিক পারিবারিক ও আত্মীয়-অনাত্মীয় অনেকেরই সাযুজ্য পাবেন।
সে বেহদ্দ কানকাটা বেহায়া মেজোকাকাই হোক কিংবা চিকণ সাজে চতুর যদুনাথ বা বেয়াড়া অহমিকায় কর্কশ গলার বিরাজ–সবাই যেন উপরি মোড়কে পোক্ত সেজে, নরম চামড়ার জুতো গলিয়ে আর চুরুট মদ্যপানের লোলুপ চোখেই পৃথিবীটাকে দেখে চলেছে। অভাবের সংসারে নির্লিপ্ত নির্লজ্জ মেজোকাকার দিনের পর দিন বসে বসে সাতিথ্য চেটেপুটে খাওয়া যেন পারদে ওঠা জ্যৈষ্ঠের দাবদাহের মতন ক্রমশ উদ্ভেদী বর্ধনশীল। বেয়াক্কেলে মেজোকাকার বিলাসী জীবনযাপনের গল্প, সেজোকাকার বিলেতি নকশার আদপ-কায়দা ও তাঁর যথেচ্ছ নিন্দামুখরতায় দিব্যি কাটছে তাঁর দিন। কাহিনীর প্রধান চরিত্র হেম বড়োই সজ্জন ব্যক্তি ধ্রিয়মাণ সৌজন্যবোধে সে কানায় কানায় ভরে উঠেছে। সম্ভ্রমবোধ ও সম্মান বড়োই শিক্ষার প্রক্রিয়া, ইস্কুল মাস্টারমশাই বাবা তাঁকে শিখিয়েছেন কেমন করে অতিথি এলে তাঁর মর্যাদা রক্ষা করতে হয়, নিরন্তর সেইটিই পালন করে চলে।
চুপ থেকে মাঝেমাঝে যন্ত্রনা পাক দিয়ে ওঠে হেমের, চোখের সামনে আস্ত গাছ, পোকা, পাখি, বাদুড় সবই কেমন যেন কবিতার মতন দেখায় –বড়ো মায়া হয় এমন মানুষ দেখলে আজও।
অর্থে সম্পদে প্রাচুর্যে যারা আজ জীবনকে উপহার দিতে পেরেছে, পেরেছে রোজের চমকে ভরিয়ে তুলতে জীবনের কোণা তাঁরা আজীবন কেবল, লিনেন কাপড়ের পাঞ্জাবী, বাবু স্যুট, মখমলি বিলেতি জুতো কখনো চীনেবাজারের নরম সোলের চটি পরে হেঁটে বেড়ায়। বেকারত্বকে দেখে নাকে রুমাল চাপা দিয়েই দিন গুজরান করে দিলো। এইসব ব্যক্তিত্বর মানস বড়োই শরীর-কেন্দ্রিক, নাম-কেন্দ্রিক, জগতের মহিমায় ও আপোষের আনুগত্যে অবশ্যই ছুঁয়ে ফেলা যায় মোহনভোগের মিষ্টত্ব তবুও কখনো আত্ম -কেন্দ্রিকতার গহীন কাব্যে ডুবতে পারবে না। পারবে না লেবুপাতার গন্ধ মেখে, খড়ের ছাউনি দিয়ে দিব্যি খুকুর মাথায় বিলি কেটে কেটে কবিতা বুনতে। এঁরা জানেই না নিজেদের, শুধু শরীর চিনেছে, চিনে রেখেছে বাংলো, বিদেশ, গাড়ি–শিকড় এঁদের ডাকে না।
ঠিক এরকমই এক অনাবিল সাদৃশ্য প্রতীয়মান মেজোকাকা – যদুনাথ ও বিরাজের মধ্যে।
গল্প সংলাপের প্রতি স্তরে উঠে এসেছে পারিবারিক সুতোয় বাঁধা পড়লেও প্রতিটি মানুষ চরিত্র কি ভীষণ আলাদা, আলাদা তাঁদের চাহিদা দর্শন, উঠে এসেছে নারী মনের গভীর অসন্তোষ, অতৃপ্তি, একাকিত্ব ও জাগাতিক চাহিদার ভারসাম্যহিনতা। দিনের আলোর মতন বোঝা গেলো, ভুখা পেটের অশ্লীল জ্বালা কেমন এক নিমিষে ধুয়ে দিতে পারে সাংসারিক শ্রদ্ধার কাদা। আজীবনকাল ধরে চর্চিত নিরলস অনভ্যাসে এক মা, এক স্ত্রী ধীরে ধীরে ভুলতে থাকে স্বীয় আদর্শ শিক্ষা রুচি। প্রকৃতির মহিমা তখন শুধুই জ্বালানি হয়ে ঢুকে যায় উনুনের আঁচে, বেড়ালের কান্না হয়ে ওঠে আগাম অশনি সংকেত আর পেঁচার রাত্রিডাক শুধুই টেনে আনে ভোরের অপেক্ষা। এসবে যে আদৌ কবিতা নেই, শিল্প নেই, সৃষ্টি নেই তা নয় তবুও জঠরাগ্নির জ্বালায় ভোগা নাথবতী ভার্যা তখন দামিনী হতে ভুলে যায়। এ সংসার যেন শুধুই বিধ্বস্ত যন্তর-মন্তরখানা, মুখ বন্ধ করে দিতে জানে। দোষ কার? পুরুষ জানে তাঁর ব্যর্থতা কোথায় তবুও যেন কিছুতেই সেই নিরর্থক ব্যবধান মেটাতে সে অক্ষম। এই উপন্যাসের পুরুষ এক অনবদ্য মানুষ তবুও যেন বিফল পিতা, বিকল স্বামী –শুধুমাত্র আর্থিক অসংগতি অপরাগতা মানুষকে এতো নীচে নামাতে পারে তা বোধহয় মানবজন্ম ছাড়া বোঝা অসম্ভব।
হেমের স্নাতকোত্তর শংসাপত্র, আদর্শ, সততা, শিল্পীসত্তা, কবিত্ব সবই বজায় থাকে শুধু ভেসে যায় তাঁর জাগাতিক পরিচয়। তুলনামূলক বিত্তবানেরা বাড়ি আসে, নির্জিত ঘরের কোণে বসে কখনো লুচি কখনো ধার করে কিনে আনা সোডায় মদ্যপান কখনো বা চুরুটের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন করে দিচ্ছে হেমের যাবতীয় পড়ার বই। উইপোকা রসস্থ হয়ে ওঠে, বংশবৃদ্ধি করে চলে বেবাক স্বরে। পেট আদতে শয়তান–আড়াই বছরের খুকির পিঠেও চাবুকের মতন দাগ রেখে যায় হাতপাখার আদর, মা ভুলে যায় মাতৃত্ব, মা ভুলে যায় বাঁচতে। বাবারা হেরে বসে থাকে স্বামীর বুকে প্রেম শুষে নেয় কলকাতার মেসবাড়ি আর খাঁ খাঁ ডাকপেড়ে দুপুর। ক্ষয় রোগে আক্রান্ত কে? হেম- কল্যাণী -খুকু? নাকি এই ক্ষয় মানবতার? এই ক্ষয় ঈশ্বরের? এই লজ্জা রাষ্ট্রের?
মানস জগতের সাথে বাহির জগতের এই অসমতায় এসে দাঁড়িয়ে থাকে শিল্পী – কবি, তার সাথে পিতা স্বামীর কোনোরূপ মিল নেই, মুখ দেখাদেখি নেই। অহরাত্রির এই কলহের মুখে দাঁড়িয়ে নিরস্ত্র দাম্পত্য। অশান্তির মুখে এসে প্রাণ ত্যেজে দেয় সমস্ত শিক্ষা আদর্শ রুচি। কে জানে শেষ অবধি কি সত্যিই কলুষ জিতে যায়? আর প্রতিভারা মরে যায় নাকি এই কারাগারে বন্দীদশায় দাঁড়াতে দাঁড়াতে হেম-কল্যাণীদের স্বপ্নগুলো খিদেতে ছটফট করতে করতে কোনো নারকীয় দৈত্যের আকার নেয়? সে এক আজব দৈত্য যার অন্তরে আজও দেবতা বাস করে, ভীষণ খিদেতে মনে হয় লুট করি কিন্তু বেড়ালের ছানার মতন নির্জীব হাত পা’দুটো শেষ অবধি ছুটতে পারে না, ছুঁতে পারে না। এই জীবন-কারুতে কিসের যে বাসনা আর কিসেরই বা কামনা? নাকি একমাত্র খিদেই সত্যি? বাকি সবই এ জীবনে ব্রাত্য?
পড়তে পড়তে চোখ বেয়ে জল নেমেছে, আমার বড়ো সাধের সদ্য কেনা বইয়ের বহু পাতা কুঁচকে গেছে, অপারগ হেমের জন্য অসহ্য যন্ত্রনায় মনে হয়েছে –এই জগতে যারা জীবনকে উপহার দিতে পেরেছে তাঁরা কি সত্যিই পারতো না পাশে থাকতে? নাকি অর্থহীনের কবিতা লেখা বারণ এখানে? যন্ত্রনা ছেঁচে যদি কারুবাসনা হয়, বনলতা সেন উঠে আসে কবি-মানসে নিত্যদিন… তবে কি শব্দের মহিমায় পেট ভরে? নাকি এইসবই নালা দিয়ে বয়ে যায় আর উঠে আসে নৃশংস মানব খিদে?
নিরতিশয় দুর্দশা, খিদের মতন বাস্তবতা, কুঁচে মাছের মতন যৌনতা, অপার প্রেমের নিষিদ্ধ ডাক, একাকিত্বর ম্লানিমা, বিত্তবানের ধোঁয়াটে গরিমা, হেরে দাঁড়িয়ে থাকা প্রহৃত জাগাতিক নাম আর বচসার সংঘাতে চলমান মানসসত্তা ও চর্মচরিত জৈবিক লাশের টেকসই কলহ —এইসব মিলিয়েই আমার কাছে কারুবাসনা আমার নিজ জীবনের এক টানাপোড়েনকে ভীষণভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে। এমন কিছু সৃষ্টির জন্য বোধহয় না খেয়ে দিন কাটানো সত্যিই দরকার –ভরা পেটে আর সুখী সংসারে আর যাই হোক একটা কারুবাসনা হবে না, নাতো তৈরী হবে জীবনানন্দ দাশ। আসলে জীবনানন্দ কোনো কবি নয়, জীবনানন্দ এক দৈবাৎ পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনার নাম —𝙰 𝙿𝚛𝚎-𝙳𝚎𝚜𝚝𝚒𝚗𝚎𝚍 𝙿𝚕𝚊𝚗 𝙸𝚗𝚍𝚎𝚎𝚍…
~~**~~**~~**~`**~~**~~**~~**