You are currently viewing যুধিষ্ঠিরের সঙ্গী / প্রশান্ত মৃধা

যুধিষ্ঠিরের সঙ্গী / প্রশান্ত মৃধা

যুধিষ্ঠিরের সঙ্গী

প্রশান্ত মৃধা

শৈলবালার মনে হল, কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি পড়েছে।

আসলেই তাই। কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি পড়েছে। হয়তো এর বেশিই পড়েছে অথবা পড়বে। কিন্তু শৈলবালার যে মনে হয়েছে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি পড়েছে এর কারণ : মুখোমুখি গোলপাতা ও টিনের ঘর দুখানার ডাইন দিকে গোলপাতার ঘরটার পিছনে ডাক্তারবাড়ি আর এই বাড়ির সীমানায় যে-ড্রেন, সেখানে এক ঝাঁক মানকচুর ঝোঁপ, টিনের ঘরের পাশে গোলপাতা ছাওয়া রান্নাঘর, রান্নাঘরে বসে খুবই ধীরে সবজি কুটছে সে, তখন পিছন ফিরে, একবার দূরে, যদিও এখন প্রায় দেখা যায় না যে আকাশ- সেই আকাশের দিকে তাকিয়ে তার মনে হয়েছিল, একটু বাদেই বৃষ্টি হবে। আকাশের মুখ ভার, তাও অনেকক্ষণ, আকাশ মেঘ ছাওয়া না যদিও, কিন্তু ওই মুখ ভার গুমোট ভঙ্গিটিই যে বৃষ্টি নিয়ে আসবে খুব দ্রুতই, তা সে বুঝতে পেরেছিল। হয়তো, এই বৃষ্টি হবে অনেক্ষণ, দুপুরেরও পর পর্যন্ত, কতক্ষণ যে তাও যেন এই মুহূর্তে সে বুঝতে পারছে না।

তাই, পুঁই শাক কেটে ডাঁটার এক একটি ছোটো টুকুরো পাশের ছোটো গামলায় যখন রাখছিল তখন, অথবা তারও আগে, ওই কাটা টুকরোগুলো হাতে নিয়ে এক মুঠমতো করে, তারপর যখন সে একটা একটা ডাঁটার পাশ থেকে আঁশ সরিয়ে দিচ্ছিল, তখন এই চরাচরে, শৈলাবালার চার দিকে শব্দ বলতে ছিল একমাত্র বটিতে পুঁই শাকের খন্ডিত ডাঁটার আঁশ ছড়ানোরই শব্দ। আর কী ? আর কিছুই ছিল না। ফলে, যেইমাত্র বড় বড় কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি- একটু বিরতিতে যেন কেউ নির্দিষ্ট সময়ের পরে ওই জলের ফোঁটাগুলো ফেলছে এমন, সেইভাবে কচুর পাতায় পর পর কয়েকবার বৃষ্টি পড়ায় শৈলবালা বুঝেছে, হা, সত্যি কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি পড়েছে।

সত্যিই, কয়েক ফোঁটা বৃষ্টিই পড়েছে। তারপর আর শব্দ নেই। কিন্তু বাতাসে বন্ধ হয়ে যাওয়া ভাব ও গতিহীনতা অব্যবহত। রান্নাঘরের ভিতরে থেকে শৈলবালার তা বোঝার কথা নয়। যদিও ওই কয়েক ফোঁটা বৃষ্টিই তাকে আতঙ্কিত করে তুলল।

আঁশ ছড়িয়ে হাতে থাকা পুঁইয়ের কয়েকটি ডাঁটা সে হাত থেকে গামলায় রেখে শৈলবালা মনে মনে হায় হায় করে উঠল। বিড়বিড় করল, হায় হায়রে, গেছে, যাবে মনে হয় আমার আমসত্ত্ব !

না, যায় নাই। আমসত্ত্বর কিছু হয়নি। শৈলবালা রান্নাঘর থেকে বের হয়েই কচুপাতার দিকে তাকাল। হা, কচুপাতায় বড় বড় কয়েক ফোঁটা জল। উপরে, মাঝখানে, নীচে- সামনের দিকের কয়েকটি পাতায়। পিছনের পাতায় বৃষ্টি পড়েনি। পাতাগুলোর বাকি অংশ শুকনো। তাহলে বেশি পড়ে নাই। সে দুই ঘরের মাঝখানে ইটবিছানো জায়গায় জবা আর কয়েকটি তুলসী গাছের পরে যেখানে আমসত্ত¡ শুকাতে দেয়া সেখানে তাকাল। না, সত্যি পড়ে নাই। আমসত্ত¡ও ওপর সাদা পলিথিন দেওয়া, এখান থেকে তাকিয়ে ঠিক বোঝা যায় না, পলিথিনের ওপর জল পড়েছে কি না। কিন্তু সামনের এইটুকু ইটের পথ একদম শুকনো, সেখানে বৃষ্টির ফোঁটা বলতে নেই। তার মানে বেশি পড়ে নাই। হয়তো পড়েছে, চোখ তো গেইছে, এহন নিজে গেলি হয়। টিনের নিচু ঘরখানার বারান্দায় দাঁড়িয়ে চশমাটা খুলে সাদা শাড়িতে মুছে নিয়ে সে ধীরে ধীরে আমসত্ত¡র কাছে যায়।

সকালটা দেখে মনে হয়েছিল বৃষ্টি হবে না। শনিতে শুরু হল, শনিতে শনিতে সাত হওয়ার কথা, তা সাতদিন হল না, রবিতেই শেষ হল। তারপর আবার মঙ্গলে শুরু হল। তখন ভেবেছিল মঙ্গলে হলে তিন, তাও শেষ হল দুই দিনে। এহোন, এই কার্তিকে এইভাবে বৃষ্টি হওয়া লাগে ? না হোক শনিতে শুরু হইয়া দিন সাতেক, কি মঙ্গলে শুরু হইয়া দিন তিনে, তবু, ঝরার কি কমতি আচে ? এই দুই তিন দিনে যা হইছে, তা দিন সাতেক কি দিন তিনেক হওয়ার চেয়ে কম কিসে। এইরম বৃষ্টি ! এই কার্তিকে !

তাই, এখন, সে আবার আতঙ্কিত হল। অথচ সকালটা দেখে সে ভেবেছিল, আজ বৃষ্টি হবে না, গত এক সপ্তাহ ভেঙে ভেঙে তো কম হয় নাই। আশ্বিনের বড় পূজার পর তো এমনিতে বৃষ্টি হয় না। এই বার পূজা ঠেলতে ঠেলতে প্রায় কার্তিকে এসে ঠেকল, বিজয়ার দিন বৃষ্টি হল। তখন মনে করেছিল এই বুঝি এবারের শেষ ধারা, আর হবে না। তাও তো শেষ হল না। ল²ীপূজার সন্ধ্যায়ও হল। এখন মনে হয়, কালীপূজা পর্যন্ত যাবে। যাকগে দিন, আইজ কাইল বৃষ্টি বাদলার আর কিছু বোঝা যায় না, কখন কী হয় না-হয়।

শৈলবালা আমসত্বের কুলার কাছে দাঁড়াল। কুলাটা তুলে কোলের কাছে নিয়ে উপরের পলিথিন দেখল, না, বৃষ্টি পড়েনি। পিছনে ঘুরে ঘরের খুঁটির কোনায় যেখানে আমসত্ত¡র বোয়ামটা রেখেছিল সেখানে এসে দাঁড়িয়ে ভাবল, কুলাতেই থাকা আমসত্ত¡ বারান্দায় রেখে দেবে, না বোয়ামে ভরবে ? এই বোঝাবুঝির জন্য সে আবারও আকাশ দেখে নিল, না, বৃষ্টি হবে। গাছের পাতা নড়ছে না। ওই যে উপরে নারকেল গাছের পাতাগুলো স্থির, একটুও বাতাস নেই। তার মানে আইজকেও বাকি সারাদিন বৃষ্টি। তবু কী মনে করে শৈলবালা কুলা আর বোয়াম দুটোকেই বারান্দার মাঝ থেকে ঘরের বেড়ার কাছে এনে রাখল। তারপর রান্নাঘরে ফিরে এসে একবার ভাত দেখে আবার পুঁইশাক কাটতে শুরু করতে না করতেই বৃষ্টি শুরু হল।

আগের মতন শুরুতেই বড় বড় কয়েকটি ফোঁটা পড়ল কচু পাতায়। সেই সঙ্গে এই গোলপাতার রান্নাঘরের চালে, আর টিনেও বৃষ্টির শব্দ। শব্দ খুব দ্রুত তীব্র হল, খুব দ্রুতই শৈলবালা বুঝল, এই যে ঝেঁপে বৃষ্টি শুরু হল, আজও ঝরবে বাকি সারাদিন।

 

একটু বাদেই যখন সে পুঁইশাক কেটে গামলায় জলে ভিজিয়েছে, আর-একবার ভাত দেখে চুলার কাঠখানা টেনে একটু বাইরে এনে জ্বাল কমিয়ে দিয়েছে, তখন তার মনে হল, বৃষ্টির যে ধারা- টিনের চাল থেকে পড়া জলের ছাঁটে কুলার ওপর রাখা আমসত্ব ভিজে যাবে। শৈলবাল চুলার কাঠখানা টেনে প্রায় বেরই করে রাখল, কাঠটা ঝুলল চুলার মুখে। বটিটা কাৎ করে রেখে পুঁই শাকের পাতাগুলো যেমন গুছিয়ে রেখেছিল কুচানোর জন্য সেভাবে বটির একদম কোলের কাছে রেখে উঠে দাঁড়াল। এইরম বৃষ্টি কার্তিকে হওয়া লাগে ?

শৈলবাল যা ভেবেছিল তাই। বৃষ্টির ছোটো ছোটো ছাঁট পড়েছে কুলার আমসত্তে¡র উপরের পলিথিনে। ঘরের বেড়ায় হেলান দিয়ে বসে সে কুলার পলিথিনটা তুলল। তারপর এক এক টুকরো আমসত্ত¡ তুলে বোয়ামটায় ভরতে শুরু করল। ধীরে ধীরে, এমন যত্নের সঙ্গে যেন এখন ওই বোয়ামের ভিতর একটি একটি আমসত্ত¡ রেখেই সে মেয়ের মুখে তুলে দিতে পারছে। মেয়েটি বড় পূজার সময় আসার কথা ছিল। আসে নাই। ওর ছেলে আসবে আমেরিকা দিয়ে। ছেলে যে আসবে আগে জানত না মেয়ে। তবু সে আশায় ছিল, ভেবেছিল, নাতি চলে গেলে আসবে। এখন শোনে, কালীপূজার পরে। যাই হোক, মেয়ে তার আসলে হয়। কত দিন দেখে না। মেয়ের পাতে দুধ ঢেলে তাতে এই আমসত্ত¡ ছেড়ে দিয়ে সে এখনও দেখতে পায় কেমন হাপুসে করে খাচ্ছে। ছোটোবেলায় রবীন্দ্রনাথের আমসত্ত¡ দুধে ফেলি, তাহাতে কদলি দলি সে বলত। কল্যাণ তখন কলেজে পড়ে। কনিকা কল্যাণকে, দাদা, কদলি কী জিজ্ঞাসা করলে কল্যাণ বলেছিল, রবীন্দ্রনাথের কবিতায় ওই জমিদারি খাওয়ার মানে দিয়ে আমাগো দরকারডা কী ? বুর্জোয়া কবি !

কণিকা বলেছিল, কীসব কও দাদা ? জনিলি কও না ? শৈলবালা বলেছিল, কলা। কিন্তু ভিতরে ভিতরে ছেলের উত্তরে চমকে উঠেছিল। বুর্জোয়া কথাটার অর্থ সে একেবারেই বোঝে নাই, তা না। এতকাল ধরে তার স্বামী কমলাক্ষ রাজনীতি করে, ১৯৩৭-৩৮ সালে কলেজে ইউনিয়নের জেনারেল সেক্রেটারি, সেডুলকাস্টদের ভিতর প্রথম। এর বছর পাঁচেক পরে যখন বিয়ে হয়ে এ বাড়িতে এসেছে সে, তখন থেকে কতবার শুনেছে- কলেজে জল খাওয়ার জায়গায় নাকি তিনটা নল থাকত, নাকি তিনটা গ্লাস : একটা হায়ার কাস্টদের, কখনও কখনও কমলাক্ষ বলত, একটা বর্ণহিন্দুর, একটা মুসলমানের, একটা সিডুলকাস্টের। নিজেদের ভিতরে কথা বলার সময় কমলাক্ষ বলত, নোমোগো ! একবার কী মনে করে শৈলবালা জানতে চেয়েছিল, সত্যি ওই তিনটে পাইপ, তিনটে গ্লাস ! কোনওদিন সিডুলকাস্টের গ্লাসে জল খাইনি বর্ণহিন্দুরা ? কমলাক্ষের মেজাজ তখন কেমন ছিল কে জানে। হয়তো ওই কথায় কলেজের কোনও স্মৃতি তার মনে পড়ে গিয়েছিল। সে বলেছিল, কোনওদিনও খাতি দেহি নেই। তারা মেয়াগো গ্লাসে জল খাতিও খাতি পারে, কিন্তু নোমোগো গ্লাসে- কী যে কও না, তা’লি জাত যাবে ?

কিন্তু তখন জেলে যাওয়া, বেরিয়ে আসা, আবার যাওয়া এই করে আরও প্রায় বছর পাচেক যখন লাগেছিল কমলাক্ষের বিএ পাস করতে, ততদিনে শৈলবালার সঙ্গে বিয়ে হয় তার। তাই ওই জল খাওয়ার প্রসঙ্গে সেদিন, কমলাক্ষের সম্ভবত নিজের রাজনৈতিক জীবনের কথাই মনে উঠেছিল। নইলে, কী বুঝে সে আরও যোগ করত না, অথচ আমি যেবার জেনারেল সেক্রেটারি- সেই বার ফজলুল হক জিতে কংগ্রেসেরে ক’ল তার সাতে আসতি, কংগ্রেস আসল না। হকসাহেব গেল মুসলিম লিগের সাতে, সাতে গেল নোমোরা। তহোন আর মেয়াগো সাতে জল খা’ল না হায়ারকাস্ট। যা হওয়ার তাই হল, বাংলা ভাঙল। লাভডা হল কার ?

রাজনীতির অত লাভ লোকসান শৈলবালা কখনওই বোঝেনি, এখনও বোঝে না। তবে জলের কল ও জল খাওয়া নিয়ে কমলাক্ষের কথার হিসাবে শেষ পর্যন্ত এইটুকু বুঝেছিল, হয়, পাকিস্তান না হলি মাইয়াডা তো এই দেশেই থাকত, অর নয় দেশ একটাই থাকত। তখন আর এই দেশ আর ওই দেশ কি- দেশই তো ভাগ হইত না। কণিকারও যাতি হত না তারে ছাইড়ে। একদিন ইস্কুল দে ফিরে আইসে ক’ল, আর ইস্কুলে যাবে না, বাড়ির এক দুই রাস্তা পরে ইস্কুল- এইটুক জায়গা যাতি আসতি এমন কী হইচে যে মাইয়ে যাতি যাচ্ছে না ? বারবার জিগানোর পরও কণিকা কিছু কয় নাই। ওদিকে কল্যাণ শুনলে কোন অনিষ্ট বাধায় কে জানে। কমলাক্ষ তখন পার্টির কাছে ঢাকা, শেখসাহেবের সাথে মিটিং। শহরের দে অনেকজন গেইছে। কয়দিন আগে জেল দে ছাড়া পাইচে শেখসাহেব। কমলাক্ষ নিজেই কতবার জেলে গেইচে আইছে। দোকান তখন কর্মচারীগো হাতে। আয় রোজগারের ঠিক নাই। কল্যাণের সঙ্গে কমলাক্ষের তখন রাজনীতি নিয়ে কী বিরোধ-যদিও আইয়ুব সরকারের কাছে বাপ পো দুইজনের রেহাই নাই। শৈলবালার শাশুড়ি বিছানপড়তা। এইসমস্তের ভিতরে পুরনো বাজারের কোন ছেলে কণিকার গায়ে চিঠি ছুড়ে মেরেছে। আর আগে একদিন ইস্কুলে যাওয়ার পথে বলেছে, তোর বাপ-ভাই দুইজোন জেলে গেলি তোরে দেকপে কেডা ? আওয়ামী লীগ বাড়ির মাইয়ে তহোন যেডারে যেডারে পাব উঠইয়ে লইয়ে যাব। যদিও কণিকা এসে এর কিছুই তাকে বলত না। বলার কথাও না। ও যাগো সাতে পড়ত বিদ্যাময়ী গার্লসে, তাদের অনেকেরই এই সমস্যা ছিল না ; শুধু হিন্দুর মেয়ে আর আওয়ামী লীগ করা বাড়ির মেয়ে হলিই হ’ল, তার ওপর কণিকা আবার কম্নিস্টের বোন- একেবারে সোনায় সোহাগা। সুফিয়া তাকে এইসব বলেছিল। ওর বাপ ভাই সবাই মুসলিম লীগ- কিন্তু শিক্ষিত বাড়ির মেয়ে। টিফিনের সময় কতদিন এসেছে এই বাড়ি। আমরিকা পড়তি গেলি সুফিয়ার ওই দেশের ছেলের সাতে বিয়ে হয়, পরে ও নাকি ঢাকা ভার্সিটির প্রফেসর হইচে… সুফিয়া মাইয়াডারে দেহি না কতদিন ! বাসায় আসলে খালি হাসত আর শুধু মাসিমা-মাসিমা করত। সুফিয়া একদিন এসে বলেছিল, মাসিমা, কল্যাণদা কমনিস্ট করে কেন ? এর উত্তর তো শৈলবালার তখন জানা ছিল না, আজও জানা নেই। এমনকি এও এখনও আর মনে পড়ে না যে, কবে হঠাৎ কী কারণে কল্যাণ রাজনীতি করা ছেড়ে দিল। তবে কল্যাণের সঙ্গে তার বাপের রাজনীতির বিরোধটা সে বুঝতে পারত। সেদিন সে সুফিয়াকে কী উত্তর দিয়েছিলেন মনে নেই। কলেজে কল্যাণের সঙ্গেই পড়ত সুফিয়ার মেজদা আলতাফ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিয়ে এম.এসসি. পাস করে কলেজে প্রফেসরি শুরু করেছে। আলতাফ নাকি সুফিয়া কাছে জানতে চেয়েছে, কল্যাণের ছোটো বোন কণিকা ওর সাথে পড়ে কি না, কণিকা দেখতে খুব সুন্দরী কি না- এই সব। সুফিয়া এত সমস্ত কথার কারণ জানতে চাইলে আলতাফ বলেছিল, না সেই ছোটোবেলায় ইস্কুলে পড়ার সময় কল্যাণগো বাড়ি গেলি দেহিলাম কণিরে। তহনই দেখতি অনেক সুন্দর ছেল, এহোন বড় হইচে। এই কথা বলে নাকি আলতাফ প্রসঙ্গ ঘুরাতে চেয়েছিল, সুফিয়ার কাছে জানতে চেয়েছে কল্যাণরে দেখেছে বাসায় ? সুফিয়া বলেছে, না। কেন ? আলতাফ বলেছিল, কল্যাণকেই বলবে। কিন্তু সুফিয়া কী মনে করে বারবার আলতাফের কাছে জানতে চাইলে, আলতাফ বলেছিল, কলেজে কয়জন ছেলেকে কণিকারে নিয়ে কথা বলেতে শুনেছে। হয়তো, সুফিয়াকে নিয়েও বলত, অথবা, হতে পারে সুফিয়া তার বোন এই জন্যে, অথবা হতে পারে… এই হতে পারেটা শৈলবালা জানে। সুফিয়ার কিছু হবে না। মুসলিম লিগ বাড়ির মাইয়াগো এহন কেউ কিচু কইয়ে দেইচে ? ওদিকে কণিকার বাপ আওয়ামী লীগ, ভাই কমিউনিষ্ট আর হিন্দু।

এই সময় একদিন বাসায় এসেছিল শৈলবালার দেবর বিরূপাক্ষ। বিরূপাক্ষ হিসাবি মানুষ। তার দাদার মতন না। ফলে, ছেলেটা বড় হইতে হইতেই ইন্ডিয়ায় পাঠাইচে, এহন মেডিকেলে পড়ে। ওদেশে নাকি সিডুল কাস্টদের জন্যে কীসব আলাদা কোটা আছে, ভালো চাকরি পাবে। এহোন মেয়েটাকেও পাঠাতে চায়। মেয়ে তখন সেভেনে পড়ে। কিন্তু দেখলে মনে হয় কণিকার সমবয়সী। বিরূপাক্ষ গায়ে গতরে বড়সড় মেয়েটা বাপের ধাত পাইচে, যদিও দেখতে তেমন ঢকপদ নেই। হোক, কিন্তু বিরূপাক্ষের কথা শুনে শৈলবালা আকাশ থেকে পড়েছিল, অতটুকু মেয়ে ! ‘ও বিরু, কও কী তুমি ?’ বলে উঠেছিলেন। শৈলবালা জানত, বিরূপাক্ষ কম কথার মানুষ। হিসাব করেই এসেছে। আর এখন কী জন্যে এসেছে সেটা যদিও বুঝতে পারে নাই শৈলবালা। কিন্তু জানে, কিছুক্ষণের ভিতরে বুঝে যাবে। অথবা, বিরূপাক্ষই বলবে।

বিরূপাক্ষ বলেছিল। আজ এতদিন বাদে, শৈলবালার মনে হয়, স্বার্থের কথা চিন্তা করে বুদ্ধিটা দিলেও সেদিন বুদ্ধিটা খারাপ দেয় নাই বিরু। শৈলবালা এখন জানে, তখনও জানত বিরু ওই বুদ্ধি না দিলে কণিকারে কহনওই ওই দেশে পাঠাতে হইত না। বড় জোর বিয়ে দিয়ে দিত।

কমলাক্ষ-বিরূপাক্ষের ছোটো বোনের হিন্দুস্থান-পাকিস্তানের আগে বিয়ে হয়েছিল জলপাইগুড়ি। নন্দেজামাইর আসল বাড়ি ছিল বিক্রমপুর। বিয়ের পর পর চাকরি নিয়ে চলে যায়। তারপর চলে আসা হাওড়া, এখনও সেখানেই আছে। বিরূপাক্ষ ছেলে পাঠানোর পর কতবার গেছে, কমলাক্ষ একবারও যেতে পারে নাই। শ্ত্রুরাষ্ট্র ইন্ডিয়া। ইন্ডিয়ায় গেলেই সরকার কথা শোনাবে। তখন ? সেই জন্যে বিরূপাক্ষ বলেছে, তার কাছেই শোনা, সবিতার কত বড় বাড়ি, ছেলে মেয়ে বড় হয়ে গেছে। তারা কলকাতায় পড়ে। হাওড়ায় গার্লস ইস্কুল কলেজ সবই আছে। এখন শিপ্রা এই দেখতে দেখতে বড় হইয়া গেল… হিন্দুর মাইয়ে-ঝিবুতের এই দেশে ভরসাডা কী- এই জন্যি বিরূপাক্ষ শিপ্রাকে ইন্ডিয়ায় সবিতার কাছে পাঠাতে চায়, আর কণিকাও বড় হইয়ে গেইচে, সাতে গেলি দুই বুন দুইজনের দেইয়ে রাকতি পারবে। যদি বড়দা রাজি হয়, তালি বিরূপাক্ষই সব ব্যবস্থা করবে।

কমলাক্ষকে রাজি করাতে কত কষ্ট হয়েছিল শৈলবালার মনে আছে। সুফিয়ার কথা, আলতাফ কলেজে যা শুনেছিল, আলতাফ যা জানতে চেয়েছিল সুফিয়ার কাছে এইসব কথা। আর এ সময় কণিকাদের ইস্কুলের নাম বিদ্যাময়ী বহুমুখী বালিকা বিদ্যালয় থেকে সদর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় করা হয়। পাকিস্তানে হিন্দু মহিলাদের নামে মেয়েদের ইস্কুল, সেই ইস্কুলের মেয়েদের পড়ানোর টাকা কেন দেবে পাকিস্তান সরকার ? কলেজের নামও নাকি পাল্টানোর কথা ছিল, কিন্তু কমলাক্ষদের চাপে নাকি সেটা হয় নাই। এইসব মিলে কমলাক্ষ রাজি হয়েছিল। হয়তো ভেবেছিল, বিরূপাক্ষর মতো হিসাবি মানুষ যা ভেবেছে, আর সবিতার সবিতার দায়িত্বজ্ঞান। সেদিন সবিতার কাছে একখানা দীর্ঘ চিঠি লিখেছিল কমলাক্ষ। ডাকে ছেড়ে ছিল। কিন্তু যুদ্ধের পরে ওই চিঠি কতদিন বাদে পৌঁছেছিল, কে জানে ? বিরূপাক্ষের হাতে দিয়েছিল ছোটো চিঠি। তাতে লিখেছিল, পরে তোমাকে বিস্তারিত লিখিব। এই একটা ব্যাপারে কমলাক্ষ অসাধারণ, চিঠি লেখায়। চিঠি লিখে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখায়। বললে বলত, এই এট্টা গুণ সিডুলকাস্ট হইয়েও হায়ারকাস্টের কাছ থেকে রেখে দিয়েছে সে।

ওদিকে কল্যাণ উপরে উপরে রাজি না হলেও ভিতরে ভিতরে নিমরাজি ছিল না। কিন্তু কণিকা চলে যাওয়ার পরে কিছু দিন কল্যাণের মুখের দিকে তাকানো যায়নি, শত হলেও ছোটো বোন ! কলাণের সব কিছু জুড়ে ছিল কণিকা।

কিন্তু প্রায় দায়িত্বজ্ঞানহীন কল্যাণ কিছুদিনের ভিতরেই তা ভুলে যায়। কিন্তু শৈলবালা জানত যে, মেয়েটাই ছিল তার একমাত্র সম্বল, সেই মেয়েটি চলে গেলে তার আর সামনে থাকল কী ? বাপ-পোয় আছে রাজনীতি নিয়ে, তাই নিয়ে থাকে সারাদিন। ব্যবসাপাতি লাটে ওডছে প্রায়। তবু কণিকাই ছিল তার সামনে। তারপর বলতে গেলে আর কখনওই সেভাবে মেয়েকে সামনে বসে দেখে নাই।

 

কণিকার জন্যে একটা আমসত্ত¡র টুকরো বোয়ামে ভরতে ভরতে শৈলবালা যে এতখানিক পিছন থেকে ঘুরে এল, তাতে কমলাক্ষ আর বিরূপাক্ষকে নিয়ে সে যে এখন আর কাতর হল না, তা একটু অবাক হওয়ারই মতন। কমলাক্ষর জন্যে মন খারাপ হল না, বিরূপাক্ষ তার হাতের আমসত্ত¡ খেতে এই বাড়িতে আসত- এতকিছুর কোনওটাই মনে পড়ল না। এমনকি সেই ঘণ্টাখানেক আগে দোকানে গেছে কল্যাণ আর তারও ঘন্টাখানেক আগে ইস্কুলে গেল ছেলের বউ সুনন্দা, কারও কথাই মনে পড়ল না। না, মনে পড়েনি। মনে না পড়লে কী-ই-বা করার আছে। বয়স হয়েছে, জীবনের শেষদিক এক পা প্রায় শ্মশানে আর এক পা ছেলের সংসারে, তবু কতকিছু কত সময়ে মনে পড়ে, কত কিছু মনে পড়ে না। মৃত স্বামী-দেবরের মুখ মনে না-পড়লে আর কী করার আছে ?

কল্যাণ এই বয়সে বিয়ে করে সংসারি হয়েছে, তাই কত ! এতে আর তাদের মনে পড়ার কী আর না পড়ার কী। বউমা সুনন্দা ইস্কুলে কণিকার সঙ্গেই পড়ত। কিন্তু সেই মেয়ের সঙ্গে কল্যাণের বিয়ে হল এই সেদিন। হিসাব করে দেখছে সে সুনন্দা যদি কণিকার বয়সী হয়, তা’লি বয়স কম করে হলেও পয়তাল্লিশে ছেচল্লিশ। হিন্দুস্থান পাকিস্তান হওয়ার বছর চার পাঁচে পরে জন্মেছিল কণিকা। আর হিন্দুস্থান পাকিস্তানের বছর কল্যাণ। এই ছেলের ঘরে আর নাতি নাতনির স্বপ্ন দেখে না সে। সে উপায় আর নাই। একদিন এই বাড়িতে পুতের বউর মুখ না-দেখেই চোখ বুঝেছে কমলাক্ষ। তারপর ? তারপরের হিসাব ঠিক দিন মানে আজকাল করত পারে না শৈলবালা। অস্থির লাগে। হাত-পা অবশ হয়ে আসে। বরং, সন্ধ্যার পর থেকেই কোনওদিনও সুনন্দার সাথে টিভিতে সিরিয়াল দেখতে দেখতে অথবা তারপর দুই মুঠ সেবা করে যখন চোখ ঝিমুনিতে জড়িয়ে আসে, তখন বরং ওই চিন্তায় বিভোর হয়ে সে তন্দ্রায় তলিয়ে যায়। তন্দ্রায় মাঝ রাত। যেন কোনওদিন কোনওদিন ওই আধো জাগরণ আধো স্বপ্নে সে দেখে, যখন সে থাকবে না, তখনও রাতে কল্যাণ বাড়ি আসপে, সন্ধ্যার পর পরপর চাকরি থেকে রিটায়ার করা সুনন্দা দুটো ভাত জ্বালিয়ে বসে থাকবে, দুজনে খাবে তারপর ঘুমাবে। কিন্তু ভালোমন্দে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে একজনের দরকারে আর একজন ছাড়া আর থাকবে কে ? এর ভিতর একজন যদি চোখ বোজে ? তারপর ?

সেই তারপর আর ভাবল না শৈলবালা। মন খারাপ হয়ে গেল। এমনিতে বৃষ্টিতে মনটা একটু কেমন হয়ে গেছে। এমন অঝোর ধারার বৃষ্টি ! ওই পাশের ঘরের ওই কোনার নারকেল গাছের গা বেয়ে বৃষ্টি পড়েছে যেন কেউ উপরে জল ঢেলে দিচ্ছে আর সেই জল সমস্ত অর্গল খুলে অঝোরে এইভাবে ঝরে পড়েছে।

কমলাক্ষ মারা যাওয়ার পরে একবার তারা ভেবেছিল ইন্ডিয়ায় চলে যাবে। ব্যবসাপতি বিক্রি করে কল্যাণের কেন যেন আর যাওয়া হল না। তারপর সুনন্দা আসার পর, সুনন্দার এই চাকরি- এই দেশে ওর সবাই আছে, মা ভাই বোন- সবমিলে ওই কথা আর ওঠে নাই। কিন্তু, শৈলবালা ভাবে, তাই বরং ভালো ছিল। সে জানে না, তার এই এক জোড়া চক্ষু বোঝার পর কী হবে ?

কল্যাণ আর সুনন্দার যে কী হবে ? এট্টা ছেলেমেয়ে হল না। আর হওয়ার ভরসাও নাই। শৈলবালা বসা থেকে উঠতে চাইল। ভাত মনে হয় এখন গড় দেয়ার সময় হইচে। জ্বাল টেনে দিয়ে এসেছিল, এতক্ষণে হয়ে যাওয়ার কথা।

এই সময়ে, শৈলবাল হাতের বোয়ামটা এক পাশে সরিয়ে রাখতেই টের পেল, সামনের গেটের কাছে একটা কুকুর ডাকছে। গেটের নীচের দিকে প্রায় হাতখানেক উপরে-নীচে আড়াআড়ি রড় সেখানে, কেউ দাঁড়ালে পা দেখা যায়। এখন কুকুরটাকে দেখা যাচ্ছে। কুকুরটা আবার ওই রডে মুখ দিয়ে ধাক্কা দিল। ওখানে নুয়ে প্রায় ঝুঁকে শৈলবালার দিকে চাইল। এই চাহনির অর্থ শৈলবালা বুঝল, কুকুরটা তার দিকে তাকিয়ে গেট খুলে দিতে বলছে।

দুই ঘরের মাঝখানের ইটের রাস্তা ধরে এগলে হাত পনের বিশেক দূরে গেট। শৈলবালা ইচ্ছে করলে এখন গেটটা খুলে দিতে পারে। কিন্তু এত সময়ের বৃষ্টির পর কুকুরটা এল কোত্থকে ? ভাবল সে। তাকিয়ে দেখল। ভিজে গেছে। আর এরপরই শৈলবালা লক্ষ করল কুকুরটা পোয়াতি। বিয়ানোর সময় কাছিয়ে এসেছে। কিন্তু এই সময়ে, এতক্ষণের বৃষ্টির পরে এই কুকুর !

সে একবার বসা থেকেই হাত উঁচু করল, ‘এই কুকুর যা এহান দে’

ওই একবারই। তারপর কুকুরটার গোঙ্গানি মতন ডাক শুনল। নীচের রডগুলোর ভিতর গলা ভরে দিয়ে একটু বাদেই আটকে যাওয়া, তারপর বিকট গলায় গোঙ্গানির চিৎকারসহ গলা টেনে পিছনে সরিয়ে নেয়া দেখল। তবুও, তখনও পর্যন্ত শৈলবালা স্থির যে গেট খুলবে না। এখন গেট খুললে কুকুরটা এই বারান্দায় আসবে। তারপর ওই ভেজা গা নিয়ে শুয়ে পড়বে। তার এমন ধোয়ামোছা নিকোনো বারান্দা নষ্ট হবে। শৈলবালা ঠিক করল, যতই চেঁচাক এই কুকুর, সে গেট খুলবে না।

শৈলবালা গেট খুলল না। বোয়ামটা ঘরের দরজা থেকে একটু ভিতরে এক পাশে রেখে কুলাটা নিয়ে রান্নাঘরে গেল। ভাত টিপে দেখল, হয়েছে। নামাবে। এই হাড়িটা জীবনেও বড় হইল না, ওই তিনজন তো তিনজন- বাড়ল না। এই সময় আবার কুকুরটার ডাক। একদম ঘেউ ঘেউ। গোঙানি নেই। আগে কখনও তো কুকুরটাকে দেখিনি সে, নাকি কুকুরটা দেখেছে তাকে। শৈলবালা মনে করতে চেষ্টা করল। মনে আসল না। তা বাছা, কোথায় ছিলি এতক্ষণ ? শফিক উকিলের বাসার সামনে ? ওই জায়গায় সে এই কুকুরটাকে শুয়ে থাকতে দেখেছে। তা তোরে ওই জায়গা দিয়ে আসতি ক’ল কেডা ? হতে পারে শফিকের কাছে লোকজন এসেছে, বারান্দা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। সেই জন্যে। হোক, তা আমার বাড়ি কী ? এই গেটে আগে কখনও কুকুর দেখিনি। তা যা-না, ওই পাশে তথ্য অফিস অফিসের বারান্দায় যাইয়ে শুইয়ে থাক। মানা করিচে কেডা ?

কুকুরটা আবার ডাকল। চরাচরে বৃষ্টির শব্দ। টিনের চালে অবিরাম বৃষ্টিপাতের ভিতরে শৈলবালা কুকুরের ডাক শুনল। কড়াইয়ে তুলেছে পুঁই শাক, একটু তেলের ভিতরে শাক পড়ার শব্দের ভিতরে কুকুরের ডাক তাকে কাতর করল না। অথবা, কুকুরের এই ডাকটা কেন, কী জন্যে- এর ভিতরে তা বুঝে নিতে সে হয়তো আরও একবার ডাকটা শুনতে চায় না। কুকুরটা গেটের কাছ থেকে গেলেই বাঁচে। সুনন্দার স্কুলের টিফিনে আসার সময় হল প্রায়, মাছের ঝোল আর শাক- বউকে ভাত দিতে হবে। এর ভিতর এই কুকুর ! ডাকুক।

কিন্তু আর-একবার ডাকলেই হয়তো শৈলবালা কুকুরের ডাকটাকে বিবেচনা করবেন। কেন ডাকছে ?

এমনিতে শৈলবালা বা সুনন্দা কেউই বাড়িঘরে কুকুর পছন্দ করে না। প্রতিবেশীরা কেউ কেউ বলে, তাদের বাড়ি এমন যে, একটা কুকুর ঢুকতে পারে না। শৈলবালা হয়তো তা জানে না। কিন্তু তার আচরণ যে এমন, এই কথা সে নিজের জন্য ভেবে নিতে পারে। বাড়িঘর চৌহদ্দি এমন নিকোনো ! ছোটো ছেলেপুলে কেউ নেই। ফলে, বাড়ি সব সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকবে, তাই স্বাভাবিক। হয়তো, পাড়া প্রতিবেশি একটু বেশিই বলে। কিন্তু যা-ই বলুক, এটা ঠিক, এই বাড়ির সামনে দিয়ে একটা কুকুর ঢুকছে কবে ? অথবা, পিছনের সরদারদের পুকুরের পাড় বেয়ে এসে পিছনের জবা ঝোপটার ভিতর দিয়ে ঢুকে সামনে দিয়ে তো কখনও বেরিয়ে যায়নি। কুকুরের তো জানা আছে, এই পাড়ার কোন্ বাড়ির সামনে পিছন কোন্ পাশ দিয়ে ঢুকে কোন্ দিক দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু এই কুকুরটা কি তা জানে না ? অথবা, কুকুরটা বুঝছে না তা ?

বৃষ্টি একটু কমেছে। হয়তো এদিকের গাছ হয়ে টিনের চালে সেভাবে পড়ছে না। অথবা হতে পারে, শৈলবালার তাই মনে হল। শাকে জল ঢেলে দেয়ার পর রান্নাঘরেও রান্নার শব্দ কমে এসেছে। এর ভিতর কুকুরটা আবার ডাকল।

এইবার শৈলবালা রান্নাঘর থেকে পাশের ঘরটার বারান্দায় এসে দাঁড়াল। গেটের কাছে লক্ষ করল : কুকুরটা দেখি গেট ভাইঙ্গে ফেলাবে ? যেভাবে আঁচড়াচ্ছে ! কুকুরটা আবার ডাকল।

শৈলবালা মাথায় কাপড় টেনে দিয়ে গেটের দিকে যেতে যেতে একবার বলল, এ কুকুর, এ তোর হইচে কী ? কী চাইস্ এহেনে ?

এই কথায় কুকুরটা কী বুঝল, কে জানে ? গেট থেকে একটু পিছনে সরে দাঁড়াল। আর শৈলবালা গেটের একদম কাছে যাওয়ার আগে গেটের নীচের দিকে লক্ষ করল, দেখল কুকুরা সরে গেছে। সরে গেছে খুব ধীরে। এত ধীরে কুকুর সরে না।

শৈলবাল গেট খুলে দিল। খোলামাত্র কুকুরটা তার দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। শৈলবালা প্রায় বিড়বিড় করার মতো করে জিজ্ঞাসা করল, ‘ওই হইচে কী ? এ কুকুর ?’

কুকুরটা একইভাবে চেয়েই থাকল। যেন বাড়ির ভিতরে ঢোকায় শৈলবালার অনুমোদন চাই। আর বৃষ্টিতে শৈলবালাই-বা কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। সে তো এসেছিল গেট খুলে দিতে, কুকুরটা ভিতরে ঢুকুক। ঘরের চালের তলে বসে গেটের নিচ থেকে সে কুকুরের পেট যতটুকু দেখেছিল, দেখে যত দিনের পেয়াতি ভেবেছিল, তার চেয়ে বেশি ঝোলা পেট। প্রায় যেন মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। এমনিতেই কুকুরটা ছোটোখাটো। গায়ে হ্যাংলা আর নিচু। এবারই হয়তো প্রথম বিয়াবে। এইসব তার বয়সী চোখে যত দ্রুত দেখে ও বুঝে নেওয়া সম্ভব, বুঝে নিল। আর কুকুরটা তার দিকে না-চাইলেও ওই চাইনিতে কোনও অনুমোদনের আশা না-থাকলে, অথবা থাকলেও, শৈলবালা ওই গেট খুলে কুকুরকটাকে দেখাই সব, তারপরই গেটটা আটকে দিত। দিয়ে চলে আসত। কিন্তু এখন আর তা করে কী ভাবে ? হয়তো, সে জানে না এখনই তার মনে হল, অন্য সময় সে কী করত সে জানে না। কিন্তু এখন এই অবস্থায়, এই বর্ষায় হয়তো একটু আশ্রয়ের জন্য কুকুরটাকে ঢুকাবার জন্য গেটের এক পাশে সরে দাঁড়াল। ডাকল, ‘আয় ?’

কুকুরটা বাড়ির ভিতরে ঢুকল। আর শৈলবালার কাছে যা অপ্রত্যাশিত, কুকুরটা ঘরের দিকে গেল না। তাকে এক পাক দিয়ে ডান দিকের নারকেল গাছটার পরে এই পাশের ঘরের চালের তলে যেয়ে দাঁড়াল। বেড়ার একদম কাছ ঘেঁষে গা ঝাড়ল। শৈলবালার দিকে তাকাল। কৃতজ্ঞতা। কানে শব্দ তুলে মাথা ঝাড়ল। শৈলবালা কুকুরটার এই বিবেচনায় খুশিই হল। তারপর ঘরের দিকে এসে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বলল, ‘থাক, ওই জায়গায় দাঁড়াইয়ে, ওই ঘরে উঠিস না যেন।’

কুকুরটা শৈলবালার কথা পুরোপুরি শুনল না। ওইখানে দাঁড়িয়ে থাকল না, বারান্দায়ও উঠল না। যেখানে দাঁড়িয়ে, ওখানেই একটা পাক দিয়ে বসে পড়ল। জায়গাটা শুকনো। শৈলবালা হাসল।

শৈলবালা রান্নাঘরে এসে ভাত গড় দেয়ার জায়গায় তাকাল। ভাবল, কুকুরটা ভাগ্য ভালো, ফ্যানটুকু এখনও ফেলেনি। ফেলনি অবশ্য বৃষ্টির জন্য। নয়তো এতক্ষণে কখন বাড়ির পিছনে ভাগাড়ে ছুড়ে দিত ওই ফ্যান। কুয়োতলার পাশে যেখানে চাপকল, থালা বাসন মাজে, সেখানে ছাইয়ের মালসার পাশে একটা দুটো দইয়ের মালসা থাকতে পারে। ওই রকম একটা মালসায় ফ্যান ঢেলে দেবে নাকি সামনের ওই নারকেল গাছটা গোড়ায় ? রান্নাঘরের দরজা থেকে চাইলে নারকেল গাছটার গোড়া দেখা যায়। শৈলবালা দেখল। কিন্তু ওই ঘরের সামনের পাশে ওই জায়গায় ? ঘরের উত্তরের জানালা খুললেই মালসাটার দেখা যাবে। বউ এসে যদি কিছু বলে। ওইখানে কুকুরের খাদা ? তাছাড়া গাছটার গা বেয়ে যেভাবে বৃষ্টির জল পড়ে, তাতে ওখানে মালসাটা দিলে ? সে ভাবল। কিন্তু এই মুহূর্তে আর কোনও জায়গার কথা তার মনে পড়ছে না। এর চেয়ে ভালো জায়গা তার জানা নেই। কুকুরটা নিজের সামনের পা দুটো চাটছে। শৈলবালা বুঝতে পারল না, কেন কুকুরটা ওইভাবে ডাকছিল, ঢুকে ওইখানে বসার জন্য ? হতে পারে, হয়তো, তা নাও হতে পারে। নাকি ?

হা। শৈলবাল ভাবল। অথবা, এইমাত্র ভেবে নিজের জন্যে প্রয়োজনীয় কুল করতে পারল, এতক্ষণ পরে তার মনে হল, হয়তো এই বাড়ির ভিতরে এই জায়গা, যেখানে কুকুরটা বাচ্চা হতে পারে। শৈলবালার দীর্ঘ দিনের চোখ, সে তো তাকিয়ে দেখেই বুঝেছে যে, আজ কাল দুই এক দিনের ভিতরে বিয়াবে এই কুকুর। কিন্তু তাই বলে এই বাড়িতে, ওই জায়গায়, বাড়ির প্রায় সামনের দিকে- গেট খোলার পর চেয়ে পড়লেই ওইভাবে দেখা যাবে ?

এই যে, কুকুরটাকে ঢুকতে দিতেই ওই জায়গায় প্রায় শুয়েই পড়েছে কুকুরটা, তারপর যদি নারকেল গাছটার গোড়ায় একটা দইয়ের মালসায় ফ্যান দেয়, তাই-ই দেখে সুনন্দা এসে যদি কিছু বলে ? আর তারপর যদি ওই ফ্যানটুকু খেয়ে কুকুরকটা এই বাড়ি না-ছাড়ে। ওইখানে বাচ্চা বিয়ায় ? অথচ, কুকুরকটাকে ঢুকতে দিয়ে শৈলবালা ভেবেছিল মেলা পুণ্য সঞ্চয় করেছে। এখন সেইসব তার কাছ থেকে হঠাৎ উবে যেতে লাগল। সে ভাবল, না কুকুরটাকে বিদায় করতে হবে। সুনন্দা এসে তারে দুই কথা শোনানোর আগেই কাজটা করতে পারলে হয়। কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব ? দুর্যোগে মানুষ তো মানুষের বাড়ি থেকে বিড়াল-কুকুরে তাড়ায় না। অধর্ম হয়। আর এমন ঘোরতর বর্ষায় এসেছে এটা। এই কুকুর তো সাক্ষাৎ ধর্ম !

এই বাড়ি আসার পর এইসব ধম্মকম্মের ব্যাপার তার জীবন থেকে উঠে গেছে। কল্যাণ আর তার বাপ কমলাক্ষ কোনওদিনই এই সবে ছিল না। কল্যাণের দেখাদেখি কাণিকাও না। শুধু বিরূপাক্ষর সাথে যা-একটু ধম্মকম্ম নিয়া কথাবার্তা হইত পুরানবাজারের বাড়িতে থাকতে, এই বাড়িতে আসার আগে। আর তখন, জীবনের সেই উলটা পালটা সময়ে, দেশের এ জায়গা ও জায়গায় দাঙ্গা, মানুষ মানুষে অবিশ্বাস- এই দেশ পাকিস্তান হয়ে গেলে হিন্দুরা আর এইখানে থাকতে পারবে কি না এই ছিল হিসাব। এই জেলা ইন্ডিয়ায় যাবে যাবে করেও গেল না, কয়দিন হিন্দুস্তান কয়দিন পাকিস্তান এই চলল, আর তারপর একদিন যখন পাকিস্তানেই চলে গেল, তখন ধম্মেকম্মে এত কার কী খেয়াল ? তবে রামায়ণ-মহাভারত তো পড়াই যায়। কিন্তু কল্যাণের বাপের এইসব ভাবার তো সময় ছিল না। সে এ সবের মানুষও ছিল না। জানত সবই, সময় পেলে পড়তও। কিন্তু বিরূপাক্ষর মতন হিন্দু-হিন্দু কোনও রব তার ভিতর ছিল না।

ধম্মকম্ম মনে পড়ায় শৈলবালা একটু চমকাল। হ্যা, ঠিকই মনে আছে তার। ষুধিষ্ঠির ভীম অর্জুন নকুল সহদেব আর দ্রেীপদী যখন মহাপ্রস্থানের পথে স্বর্গে যাচ্ছে, সেই সময় একে বিদায় নিল সবই। যুধিষ্ঠির চেয়ে দেখল সাথেপাশে কেউ নেই। সঙ্গে আছে শুধু সেই কুকুরটা, যেটা ছিল তাদের ছয়জনের পিছনে। একজন একজন করে মরেছে আর কুকুরটা শেষ পর্যন্ত তার সঙ্গেই চলছে। দেবরাজ ইন্দ্র ষুধিষ্ঠিরকে যখন স্বর্গের দরজায় আহান জানাল, পরম ধার্মিক যুধিষ্ঠির ওই কুকুরটাকে না নিয়ে স্বর্গে যেতে চাইল না। তখন কুকুরটা নিজের রূপ ধরে যুধিষ্ঠিরকে বলল, আমি ধর্ম। জীবনের অন্তিম পরীক্ষায়ও তুমি উত্তীর্ণ হয়েছ।

ধর্মের রূপ ধরেছিল কুকুর।

কিন্তু, ধর্ম হল, মানুষ যা ধারণ করে।

তাহলে, কুকুরের ভিতরে ধর্ম তার রূপ ধারণ করে।

সেই কুকুর একটা আজ তার ঘরে। শৈলবালার অনিচ্ছায়ও এত বড় রাস্তাঘাট, অফিসের বারান্দা এতকিছু থাকার পরও তার বাড়ি এসেছে কুকুর। কয়টা বাচ্চা বিয়ানোর জন্য। যাবে আর কোথায় ? থাক, থাক না এখানে। ভগবানের নীলা বোঝা বড় ভার। কার কখন কী হয়।

কিন্তু ? শৈলবালা একটু হাসল। কোথায় কুকুরবেশী ধর্ম আর কোথায় এই মাদি কুকুর ? এই হাসির কারণ শৈলবালা জানে।

তবু নিজের সন্তানসন্ততি, মাত্র একটি ছেলে আর একটি মেয়ে, আরও দুজন হয়েছিল, বাঁচেনি একদিনও। যখন নিজের জ্ঞাতিগুষ্টি চেনা পরিচিত আর পড়া প্রতিবেশির প্রত্যেকের আটজন দশজন তখন তার ওই দুইজন, মেয়েটার একটি ছেলে, শেষ কবে নাতির মুখ দেখেছিল, মনেও নেই। আর, ছেলেটার কোনও সন্তানাদি নেই এই ভাবনায়, নিজের জীবনের এই ঘটনায়, এই সব মিলিয়ে হঠাৎই শৈলবালার ভিতর অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া হল। সে ঠিক করল কুকুরটাকে ফ্যান দেবে। ফ্যানের ভিতর চারটি ভাতও। যদি খাওয়ার পরে ঝোল তরকারি কিছু থাকে, তাই মেখে আর চারটি দেবে সন্ধ্যার দিকে। হোক রাস্তার কুকুর, এই সময় খাওয়া লাগে। রাস্তায় খাওয়া জোটে ? মানুষের বাড়ির এ জায়গা ও জায়গা, ভাগাড়ে এখানে ওখানে আর কী জোটে ? কুকুরটা যদি এইখানে বিয়ায় ? বিয়াক না। খুব ভালো জায়গা যদি ওঠা পিছনের জবা ঝোপটার কাছে নারকেল গাছের গোড়ায় যায়। কিন্তু বাড়ির পিছন দিক খোলা, যদি ফ্যানটুকু খাওয়া হলে সরদারদের পুকুরের পাড় বেয়ে চলে যায় ?

নিজের একটুক্ষণের প্রতিক্রিয়ায় সে অবাকই হল। এখন কুকুরটা যেন না-যায়, তাই ভাবছে।

শৈলবালা মাছের ঝোল নামাল। আর রান্না নেই। রান্নাঘরটা একটু গুছিয়ে বাড়ির পিছন দিকে কল আর কুয়োতলার যেয়ে একটা পুরনো দইয়ের মালসা ভালো করে মেজে ধুইয়ে নিল। তারপর মালসাটা রান্নাঘরের বাইরে রেখে তাতে কাঠের কাউটা থেকে ফ্যান ঢালল। ভাতের হাড়ি থেকে এক চামচ ভাত নিয়ে সেই ফ্যানে ঢেলে মালসাটা এনে রাখল নারকেল গাছ আর ঘরের মাঝখানের জায়গায়। এখানে বৃষ্টি পড়ে না। কুকুরটা ভেজা গা ইতিমধ্যে শুকিয়ে গেছে।

মালসাটা রেখে সরে আসতে আসতে কুকুরটা উঠে যখন মালসায় মুখ ঢুকিয়েছে, তখন নিজের ঘরে সামনে দাঁড়িয়ে শৈলবালা পরম তৃপ্তিতে ওইদিকে চেয়ে থাকল, শৈলবালার মুখ ও চোখে খুশি। অনেকদিন বাদে সে যেন শাড়ির আঁচলে মুখ মুছতে মুছতে পুণ্য সঞ্চয়ের সুযোগ পেয়েছে। অথবা, সুযোগ হয়েছে তার, হোক মাদী কুকুর, ধর্ম একদিন কুকুর সেজেছিল মহাভারতের যুধিষ্ঠিরের স্বর্গে পাওয়ার আগে।

এই সময়ে গেটের হ্যাচবোন্ডে দুইবার শব্দ হল। সুনন্দা এসেছে। কুকুরটা খাওয়া বন্ধ করে প্রথমে গেটের দিকে, তারপর শৈলবালার দিকে তাকাল। দেখল কুকুরটা একবার সুনন্দাকে দেখে নিয়ে আবার ফ্যান খেতে শুরু করেছে। সুনন্দাও শৈলবালার চোখের দিকে তাকিয়ে নিজেদের ঘরের পাশে কুকুরটাকে দেখেছে।

এখন আর গোলপাতার ঘরে যাবে না সুনন্দা। টিফিনে এসে এই ঘরে খেয়ে চলে যায়। শৈলবালার পিছন পিছন বারান্দায় উঠে কুকুরটাকে দেখে সে কিছু জানতে চাওয়ার আগে শৈলবালা বলল, ‘আসলা কিসে ?’

‘রিকশায়।’

‘কই রিকশা দেখলাম না ?’

‘আমার সাথে আবিদা আইচে। আমি রাস্তার ওই পাশে নামিচি। আবিদা রিকশা নিয়ে বাসায় গেচে।’

‘ও-’

শৈলবালার সঙ্গে রান্নাঘরের দিকে যেতে সুনন্দা জানতে চাইল, ‘ওমা, এডা আসল কী ভাবে ?’

‘আর কইয়ে না বাছা, গেট প্রায় ভাইঙ্গে ফেলায়- বাচ্চা হবে তো, লাগিচে খিদে। বিষ্টির মদ্যি আর যাবে কোয়াবে। আমি এট্টু ফ্যান দেলাম-

সুনন্দা দেখল, ‘হ। সময় কচাইয়ে আইচে- ওলান পেরায় মাটিতে ঝুইলে গেইচে।’

‘হয়। তুমি হাত মুখ ধোয়ও। খাবা না ?’

‘হয়। এট্টু ভাতও দেতে পারতেন ওডারে ? সকালের ভাত নেই ?’

সকালের ভাত নেই। ভিখিরেকে দিয়ে দিয়েছে শৈলবালা। কিন্তু সুনন্দার কথায় শৈলবালা একটু অবাকই হয়, ‘দেবানে, এহোন ফ্যান খাক, দুপুরের পর বিকালের দিক দেবানে। ততক্ষণ থাহে না থাছে জানে কেডা। দেহা গেল, বৃষ্টি কুমলি চইলে গেল- রাস্তার কুকুরের কিছু ঠিক আছে ?’

তা অবশ্য। সুনন্দাও জানে।

কিন্তু শৈলবালা ও সুনন্দা- শাশুড়ি পুতের বউ দুজনের ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে কুকুরটা থেকে গেল। কল্যাণ দুপুরে আসবে না, বলে গিয়েছিল, তাছাড়া আজ গেছেই বেলা করে। সুনন্দা আসতে আসতে বিকাল সাড়ে চারটে। এই সময় টিভিতে উত্তমকুমার আর সাবিত্রীর একটা ছবি দেখেছে। চারটায় খবর দেখেছে। কোথায় যেন ফেরিঘাটে দুটো গাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষে অনেক লোক মারা গেছে, আর এক জায়গায় একজন বয়সী রাজনীতিক। কমলাক্ষ বেঁচে থাকতে ভদ্রলোকের নাম দুই একবার বলতে শুনেছে। সে বহু আগের কথা, হয়তো দেশ স্বাধীনেরও আগে। জীবনে কত লোকের নাম জানা হয়, কত লোকের নাম হারিয়েও যায়। ওই লোকটার নামটা রাতে খবর দেখলে কল্যাণ বলতে পারবে কেন তার বাপের কাছে ভদ্রলোকের নাম শুনত। কিন্তু শোনার এই ঘণ্টাখানেক পরে নামটা তার কিছুতেই মনে আসছে না। বিছানায় শুয়ে এই মনে পড়া আর ভুলে যাওয়া এইসমস্ত কিছুর ভিতরে শৈলবালা অবশ্য কুকুরটার কথাও ভুলে গেছিল।

উঠে, সামনের ঘরের বারান্দায় কী একটা প্রয়োজনে যাওয়ার আগে কুকুরটাকে দেখে কুকুরটার কথা মনে পড়ল। কুকুরকটা তাকে দেখে লেজ নাড়ল। শৈলবালা মনে মনে বলল, তুই এহোন আচো। যাও নাই ?

সে অবশ্য ভেবেছিল, বৃষ্টি থামলে ভরা পেটে চলে যাবে এই কুকুর। যায় নাই।

শৈলবালা এখন ঘরদোর ঝাঁট দেবে কি দেবে না ভাবল। এখনও সুনন্দা কেন এল না ? হতে পারে ইস্কুলে কাজ। অথবা, আবিদার বাসায় গেছে। বউমা আজও সংসারের দিকে তাকাল না। পাড়ায় সবাই জানে, সুনন্দার সংসার চালায় শাশুড়ি, সুনন্দার করা লাগে না কিছু। কী করবে ? ছেলেপুলে নাই। তারও নাতিপুতি নাই। ওষুক বিষুকও নাই বলতে গেলে, এই বয়েসে শৈলবালার ওই দুইজন ছেলেমেয়ে, এদের সে দেখে রাখে। এই করে দিন কাটে। কিন্তু এই কথা ভাবলে তার মন খারাপ হয়ে যায়, সে না থাকলে এই দুইডা মানুষের হবে কী ? যাক এই দিনের শেষে, ঘোর সইন্ধার আগে সেই কথা ভেবে সে মন খারাপ করতে চায় না।

শৈলবালা কী ভেবে ঘরের পাশে যেখানে কুকুরটা শুয়ে আছে, সেখানে আসল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কুকুরটা দেখল। পুরুষ জাতের এই মজা- এই দেহো, যাই করুক বোঝা বইয়া বেড়াইতে হয় মাইয়া জাতের। এই কুকুরেরও বাচ্চা হবে। সেই বাচ্চা খাওয়াইতে হবে। সাথে রাখতে হবে। বড় হবে। তারপর… আর মর্দাটা ? সে এহোন কোথায় কোথায় যেন গায় বাতাস লাগাইয়া বেড়াইয়া বেড়াইতেছে।

হঁ, সময় আর বেশি নাই। আর দুই একদিন। কি এই সপ্তাহ। এর ভিতর বাচ্চা হবে। কিন্তু এই জায়গায় থাকবে কুকুরটা ? কল্যাণ আইসে যদি কিচু কয়। আইজ তো থাকুক।

শৈলবালা রান্নাঘরে যেয়ে টেংরা মাছের তরকারির ভিতর থেকে আলু আর বেগুন বেছে একটা ছোটো থালায় রাখে। একটু ঝোলও দেয় আর তার ভিতরে ভাত দিয়ে মাখিয়ে কুকুরটার মালসায় দিল। তারপর হাত মুখ ধুয়ে সন্ধ্যাবাতি জ্বালানোর প্রস্তুতি নিয়ে বসে থাকে। ছেলে বউর ঘরে লক্ষ্মীর একখানাও ফটোও নেই। অনেকবার বলেছে সে, কিন্তু কল্যাণ মানা করেছে, সুনন্দা বললেও কল্যাণ শোনেনি। কিন্তু এইঘরের লক্ষ্মীর ফটোর নীচে একটি ধুপকাঠি আর প্রদীপের সলতে জ্বেলে দিয়ে শৈলবালা ভাত চড়াতে যাবে। তার আগে অবশ্য সুনন্দা আসবে। সন্ধ্যার আগেই আসবে সুনন্দা। শৈলবালা জানে। কুকুরটাকে রাতে আর ভাত না-দিলেও চলবে। তবু, শৈলবালার কেন যেন মনে হল, যদি রাতে কুকুরটার পেটে কিছু না-পড়ে, আর সেই জন্যে চেঁচায়, তারপর চলে যায় ?

সুনন্দা ফিরে গেট থেকে ঢুকতে ঢুকতে বলল, ‘ওমা, কুকুরটা তো আছে।’

শৈলবালা সুনন্দার মুখ দেখল। যেন বহুদিন কুকুর দেখে নাই বউ।

সুনন্দা বলল, ‘আবিদারে কুকুরডার কথা ক’লাম, মা।’

‘কী ক’ল আবিদা ?’

সুনন্দার গলা নেমে গেছে, ‘কী আর কবে ? এট্টু যেন খোঁচা দিল।’

‘খোঁচা দেল ? কেন, কী জন্যি ?’

‘সেইয়েই’ সুনন্দা বলতে চাইল না। সে জানে, আবিদা হয়তো হঠাৎ বলেছে, ঠিক তাকে খোঁচা দেয়ার জন্যে না। আর, সুনন্দাও কথার পিঠে কথাটা না বলায় শৈলবালাও আর শুনতে চাইল না। তবু, সুনন্দা বলল। বলে যেন নিজেই নিজের অপরাগতাকে খোঁচা দিল, ‘ক’ল তোগো বাড়ি মেলা দিন পর বাচ্চা হবে।’

শৈলবালা ঘরে ঢুকে পড়েছিল। সুনন্দা নিজেদের ঘরের দরজায়। কুকুরটার ভাত খাওয়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। সুনন্দার কথা শুনে শৈলবালা কিছু বলল না। কিন্তু তার মনে হল, ঠিক বলেছে আবিদা। কিন্তু এতে হাত আছে কার ? সবই মানুষের ভাগ্য। তার কপাল। শৈলবালা ভাবল।

 

পরদিন খুব সকালে, প্রায় ভোর ভোর তখনও, শৈলবালা উঠে আর কুকুরটার ওই পাশের ঘরের নারকেল গাছটার কাছে দেখে না। বাড়ির পিছনের দিকে যেতে যেতে দেখল, ছেলে-বউর ঘরের পিছন পাশে জবা গাছটার নীচে কুকুরটা তিনটে বাচ্চা নিয়ে শুয়ে আছে। কোত্থেকে এনেছে একটা ছেঁড়া ছালার চট। হা, এটা কুয়োতলায় ছিল। কয়েকটা গোলপাতার টুকরোও। একটা দুটো পুরনো জবার ডাল এর পাশে। তার মানে, এখানে বিয়েইছে কুকুর। শৈলবালা নিজের ঘরের বারান্দা ধরে বাড়ির সামনের দিকে গেল। না, মাসলটা এখানেই আছে। আর গেটের কাছে একটা মরা বাচ্চা। হয়তো, এই ঘরের পাশেই জন্মেছিল বাচ্চাগুলো। মরা বাচ্চাটাকে কুকুরটা গেটের কাছে রেখে বাকিগুলো নিয়ে বাড়ির পিছন দিকে গেছে।

শৈলবালা কুকুরের বাচ্চাগুলো দেখতে জবা গাছের নীচে গেল। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবল, হা, তবু বহু বহুদিন পরে এ বাড়িতে দেখার মতো কিছু একটা জন্মাইচে !…#