মনে করো, আমি এক মুক্তাচাষী/ মনির ইউসুফ
পৃথিবীর বারান্দায়, সমুদ্রের বেদনায়- যতদূর স্বপ্ন ততদূর উড়েয়েছি মনের ডানা; ততদূর হৃদয় বৈভব, ততদূর ঢেউয়ের ইশারা। সমুদ্রে হাঁটি আমি আধুনকি মানুষ, ভিজে বালি, শামুকের ভাঙা ছাল, ঝিনুকের রেখা, কাঁকড়ার শিল্প-আলপনা।
সমুদ্রের সীমায় আমি নই নতুন মানুষ। আমি এক মুক্তাচাষী, ঝিনুকে শামুকে স্বপ্ন ফলাই। মনে করো, মনে করো আমি এক স্বপ্নচাষী। স্রোতে ভাসে নৌকা, সাগরে ভাসে শূন্যতা। স্রোতের শিরায় পুরুষ ঢেউ খোঁজে নারী ঢেউ, নারী ঢেউ খোঁজে
পুরুষ, কি তির্যক তাদের গতিরেখা। এখানে স্রোতের বিহ্বলতা আমি চেয়ে চেয়ে দেখি। আমার বুকে এক পৃথিবী জখম।
কেউ নেই এখানে, আকাশে তারার পদ্ম, আকাশে নীল পদ্ম, সাগরের নীলতিমি। পৃথিবী ঘুমাতে যায়, আমি ও সাগর ঘুমাই না, ঘুমের সঙ্গে ওমের সর্ম্পক, হায়, কোথাও ওম খোঁজে পাই না। বাতাসে উড়ে চুল, বাতাসে পুঁজির জখম। বাতাসে দূষণ, সিসা, বাতাসে ধূলো, ধূলোর কণা।
আমার সৃষ্টিশীলতার সঙ্গে ঢেউয়ের সৃষ্টির মিল দেখে আর্শ্চয হয় না। বিকেল ঘনিয়ে আসে হঠাৎ অন্ধকারে ঝাঁপসা হয়ে ওঠে এ প্রাঙ্গণ, সীমানায় পায়ের নূপুর, পৃথিবী কি পদ্ম পুকুর! ঢেউ স্রোত সাগর- পৃথিবীরর তিনভাগ জল। কত ভাগ নোনা, কত ভাগ মিষ্টি। মেয়ে তুমি কত ভাগ নোনা, কত ভাগ মিষ্টি আমি তো ছুঁয়ে দেখিনি। ছেঁখে দেখা হয়নি আজও নোনা জলরে স্বাদ। বিভ্রমে নয়, ভ্রমে তুমি জেগে ওঠো সমুদ্র মেয়ে। তবুও ভালোবাসা নাও, দাও বা না দাও। এক জীবনে কত জীবন দিতে হয়, কত জীবন দিয়ে একটি জীবন শিখতে হয়। কি শিখেছো তুমি সমুদ্র তীরের মেয়ে? কান্না না রান্না- ঘরে রান্না যেমন শিখতে হয়, তার চেয়েও ঢের বেশি করে ভালোবাসা শিখতে হয়, জানো, তা নাহলে বেদনা সহ্য করা যায় না, যে বেদনা সহ্য করতে জানে না, যে ভবষ্যিতকে ভয় পায়, সে ভালোবাসতে জানে না।
সমুদ্রে ডুবে থাকা যায়, সাগরে ডুবে থাকা যায় না, ঢেউ এসে কামড়ায়, স্রোত এসে ধাক্কা দেয়, আমার ধ্যান ভাঙে, ধ্যান ভাঙে তারার ইশারায়।
ঝড়ো পাখির চিৎকারে মন ভরে ওঠে। আমি চাঁদের আলোয় এই পৃথিবী দেখি। বাতাসে সংবেদন, বাতাসে মনোবেদন, আমার মনে ভ্রমর এসে চুপি চুপি করে গুঞ্জরণ। আমি ও ভ্রমর কিসের জন্য পাগল। আমার চোখ সমুদ্রের গোলাপ হয়ে ফুটে ঢেউ পাপড়ির কোমল র্স্পশ, মন মিশে যায় মনে, হৃদয়ের চর, হৃদয়ের বালুমেখে বালুমেয়ে মিশ যাও কার বুকে?
সাত সমুদ্রের নোনাজলে পা ভিজাই, এসো পৃথিবীর পথে হাঁটি, আলোছায়া অন্ধকারে দুটি বুক, দুটি বুকে শামুক হয়ে চরে পড়ে থাকি। চর ও ঘর, ঘর কি চর! এই চরাচরে আমি তুমি, তুমি আমি শির শির স্বপ্নবুকে, জলের ঘূর্ণিতে জাল ছড়িয়ে রাখি। জোয়ারে আমি জাল ছড়িয়ে দিই, ভাটায়ও আমি জাল ছড়িয়ে দিই, আমার বুকের লোনা জল শিসা ঢালা প্রাচীর গড়ে তুলে। চাঁদের আর্কষণ ভরা কটাল, ভরা জোনাফ্ফর। প্যারাবন ঝাউবন, বাইবনে শিরতা, তোমার অতৃপ্ত মনের শিরতা। পৃথিবীর বারান্দায়, এই সাগরের উন্মুক্ত বেদনায়, আমি মিশিয়ে নিই আমার বেদনা। আমার যত জখম আমার যত জ্বালা, আমি তা দিয়ে ঘষে ঘষে আগুন জ্বালি আর পুড়ি। এ দহন ভ্রমরের গুঞ্জন, এ দহন সাগরের র্গজন।
সাগরের গহনে তারাভরা রাত, আমি তোমাকইে খুঁজি রেতবালি কন্যা। ধূসর এই অন্ধকার, দিনের সমস্ত নীল ডুবে যায় আমার বুকে। তোমার রেতে ধার কি রকম যদি বুঝতাম, যদি বুঝতে দিতে তপ্ত রোদের বালির ছুরিতে কাটত না আমার পা,
পঁচা শামুকে কাটত না- পা। এখন আমার পা কেটেছে পঁচা শামুকে, হায়, যদি জানতাম, পঁচা শামুক, তাহলে কত না সতর্ক হতাম। আমার এ জীবন তামা তামা হওয়ার জন্য তুমি কি দায়ী? হে বোকা মেয়ে চারুলতা। যদি বুঝতে মানুষের হৃদয়
ঢেউয়ের র্আতনাদ, যদি অতটুকু শিক্ষিত হতে একটু শিক্ষিত হতে। মানুষ কি করে ওমন অশক্ষিতি থেকে যায়।
প্রিয়, বঙ্গোপসাগরীয় শুশুকী কন্যা, তুমি ওমন হবে না, আশা করি। তুমি প্রকৃতি বুঝবে, প্রকৃতরি সৌর্ন্দয বুঝবে, সাগরের হৃদয় বুঝবে। সাগর কথা বলে না, সাগর অনেক গভীর, সাগর শুধু স্রোত ঢেলে দেয়, সাগর শুধু ধারণ করে, সাগরিকা তুমিও ধারণ করবে পৃথিবী। ধারণ করতে পারা মানে জয় করা। তুমি জয় করবে এ জগত। এ কি স্বপ্ন, এ কি কোনদনি বাস্তব হবে না! সৃষ্টিশীল মানুষ হিসেবে আমি এ তীরে মৎস্য কন্যাদের থেকে তা কি আশা করতে পারি! অবশ্যই, মহত্ত্ব বুঝতে ও শিখতে হয়। জ্ঞানর্চচায় ফিরে আসতে হবে। দ্বান্দিক ও ক্ষণিক জীবনে এত এত চাহদিা কমিয়ে তাকে জয় করতে হবে। প্রিয় নিজেকে জয় করা কি এত সহজ! সময়কে মেনে নেওয়া এক রকম ব্যাপার স্যাপার, আর সময়ের হাতে নিজেকে ছেড়ে দেওয়া আরেক রকম ব্যাপার। তাই নিজেকে জয় করতে পারলে মহত্ত্ব কি বুঝতে পারবে। মহত্ত্ব কি বুঝতে পারলে নিজেকে জয় করতে পারবে। কি অদ্ভুত না?
আমি বলবো শিক্ষিত হতে হবে, আমাকে তোমাকে তাকে। এই সীমাহীন পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির পৃথিবীতে তুমি নিজেকে চিনবে কি দিয়ে? যেখানে তোমার জন্য ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে হাজার প্রলোভন। প্রলোভনের লোভ কি তাকে সনাক্ত করতে জানতে হবে। তখন মহত্ত্ব তোমাকে খোঁজে নেবে, তুমি মহত্ত্বকে। প্রিয়, বক্ষ উন্মোচন করা স্বাধীনতা নয়, মন ও মস্তিষ্ক উন্মোচন করাই স্বাধীনতা।
পৃথিবীর বারান্দায়- সমুদ্ররে বেদনায়, আমি এসব কষ্টকে ধারণ করে ঝিনুক হয়ে নিরবে সয়ে যায়। ঝিনুক নিরবে সহে না, ঝিনুক সরবে বেদনা উগরে দেয় আর মুক্তা ফলাই। এই দিগন্তের তীরে আমি আরও মুক্তা ফলাতে চাই। মনে করো আমি
একজন মুক্তাচাষী। আমার বুকের খামারে গোলাপী মুক্তারই চাষ হয় বেশি, যার মানবিক মূল্য ব্যাপক।