নুসরাত সুলতানা
বন্ধু কিংবা বন্ধুত্ব
বন্ধু শব্দটার ব্যুৎপত্তি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় শব্দটি আমরা যতদূর জানি 900 সালের চেয়ে পুরানো। এটি ওল্ড স্যাক্সন শব্দ “ফ্রিউন্ড”, ওল্ড হাই জার্মান শব্দ “ফ্রিউন্ট” (এবং আধুনিক জার্মান শব্দ ফ্রুন্ড) এবং গথিক শব্দ “ফ্রিজোন্ডস” এর সাথে একটি সমঝোতা।
এর থেকে বোঝা যায় বন্ধু বা বন্ধুত্বের সাথে আত্মিক সমঝোতা এবং স্নেহ শব্দটি জড়িত। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর তেল প্রবন্ধে বলেছেন – তেল মানে স্নিগ্ধ বা স্নেহ।
Webster dictionary বলছে-
one attached to another by affection or esteem. ওপরের উৎপত্তি এবং সংজ্ঞা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়- যার সাথে আত্মিক বোঝাপড়া এবং স্নেহের সম্পর্ক বিদ্যমান তাকে বন্ধু বলে অভিহিত করা যায়। অর্থাৎ বন্ধুকে দিয়ে আমরা অপমান, অপদস্ত, হিংসা প্রতিহিংসার শিকার হওয়ার কথা নয় সহজে । বরং প্রশ্রয় পাওয়ার কথা মানসিক, আত্মিক, বাস্তবিক এমনকি আর্থিক পরিপ্রেক্ষিতেও।
এখন দেখি আমরা চলার পথে বেড়ে উঠতে উঠতে কিভাবে বন্ধু পাই বা বন্ধুত্বের সম্পর্কে জড়িয়ে যাই। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সহপাঠী থেকে বন্ধু হয়ে উঠি অনেকেই। আবার চাকরি করতে গিয়ে সহকর্মী থেকেও কেউ কেউ বন্ধু হয়ে উঠি। কিন্তু সবচেয়ে ট্রাজেডির বিষয় হল- বছরের পর বছর বন্ধুত্বের চর্চা করেও অনেক সময়ই সম্পর্কে কোনো আত্মিকতা তৈরি হয় না। এমনকি পারষ্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বা স্নেহ থাকে না। সেইসব সম্পর্ক কেবলই তৈরি হয় নীতি, আদর্শ, আত্মিকতা বিবর্জিত সময়ের নষ্ট অপচয় হিসেবে। এর আবেদন কখনো স্বার্থ, আবার কখনো সামাজিক প্রদর্শন। কিংবা অন্যকোনো মেরুকরণ। কিন্তু অই সম্পর্ক ২৫ বছর পরেও মুহূর্তেই ঝরে যায় হলুদ পাতার মতো। তাতে না তৈরি হয় কোনো বেদনা, না কোনো বিরহ যাতনা। আসলে স্নেহ বা ভালোবাসা বেদনা ধারণ না করে টিকে থাকতে পারে না। আবার সংবেদনশীলতা ছাড়া যেকোনো সম্পর্কই হয়ে ওঠে মানসিক বোঝা। আসুন দেখে নিই বন্ধু সম্পর্কে বিশ্বের প্রসিদ্ধ কিছু মানুষের চিন্তা -চেতনা।
বন্ধু সম্পর্কে চার্লি চ্যাপলিন বলেছেন -আমার সব থেকে ভালো বন্ধু হল
আয়না, কারন আমি যখন কাঁদি তখন সে
হাঁসে না। হেলেন কিলার বলেছেন -আলোতে একাকী হাটার চেয়ে
বন্ধুকে নিয়ে অন্ধকারে হাটা উত্তম।
মার্টিন লুথার কিংব বলেছেন
সবকিছুর শেষে আমরা আমাদের
শত্রুদের বাক্য মনে রাখবো না, কিন্তু
বন্ধুর নীরবতা মনে রাখবো।
বাঁচতে গেলে আমাদের সবার বন্ধু প্রয়োজন। বন্ধু বা বন্ধুত্ব হল স্বস্তিদাতা বা প্রশ্রয়দাতা। এই প্রশ্রয় আমাদের প্রয়োজন স্বামী /স্ত্রী, সন্তান /পিতামাতা, সহকর্মী, সহপাঠী সবার থেকেই। আবার বাইরের জগতে যদি খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু নাও থাকে ঘরে বা পরিবারে সকলের বন্ধুভাবাপন্ন হওয়া অত্যন্ত জরুরি। অর্থাৎ পরিবারের সকলের সকলের প্রতি স্নেহ বা সহমর্মিতা থাকা একান্ত প্রয়োজন। বন্ধু অনেক থাকতেও পারে আবার দুয়েকজনও থাকতে পারে। অন্যদিকে বলা যায় বন্ধু প্রেমিক বা স্বামী কিংবা স্ত্রী নাও হতে পারে। কিন্তু স্ত্রী কিংবা প্রেমিকা বা স্বামী কিংবা প্রেমিক বন্ধু না হয়ে উঠলে জীবন এবং সম্পর্ক বিষিয়ে ওঠে। বেঁচে থাকাই মুশকিল হয়ে পড়ে। আসলে আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু থাকুক বা না থাকুক বন্ধুভাবাপন্ন পরিবার, পরিবেশ, সমাজ এবং দেশ দরকার সর্বাগ্রে। যেখানে নিরাপত্তা এবং স্বস্তি বিরাজ করবে।
ওপরের এসব আলোচনার সবটার সত্যতা মেনে নিয়েও বলা যায়- সবার আগে মানুষকে প্রশ্রয় দেয় নিজের শরীর এবং মন। তাই সবার আগে নিজেকে নিজের জন্য কল্যাণকর বন্ধু হয়ে উঠতে হবে। নিজের সাথে বসবাস করা শেখা এবং নিজেকে ধারণ এবং বহন করতে শেখা অত্যন্ত জরুরি। যে ব্যক্তি নিজের ভেতর নিজে রোপিত হয়ে একটি বৃক্ষ হয়ে ওঠে সে প্রকৃত অর্থেই সমস্ত বিশ্বের জন্য কল্যাণকর হয়ে ওঠে।
তবে হ্যাঁ কৃত্রিম বা প্রতিহিংসাকারী বন্ধুর চেয়ে বন্ধু না থাকা অনেক নিরাপদ। আবার যার সংবেদনশীল, বিবেকবান মনন নেই সে বন্ধুত্বের মর্যাদা দিতে পারে না। সে আপনাকে অপদস্ত করতে পারে অসুস্থ অবস্থায় যদি আপনি তাকে হাসপাতালে দেখতে যান তখনও। তাই অসংবেদী আত্মা থেকে নিজেকে দূরে রাখুন। কারন কারণ সহস্র বছর পাথর জলে থেকেও যেমন ভিজে ওঠে না তেমনি অসংবেদী আত্মার ভালোবাসা বা স্নেহের আলো গ্রহণে সক্ষমতা থাকে না। সেই সঙ্কীর্ণ অন্তর হিংসা এবং বিদ্বেষে পরিপূর্ণ থাকে। তাই এমন বন্ধুকে বিদায় জানান অতি সত্তর। যাতে আপনাকে সঙ্কীর্ণতা এবং প্রতিহিংসার চর্চা করতে না হয়।
পরিশেষে বলব – মানুষের বন্ধু শুধু অন্য মানুষই হয় না। হতে পারে একটা বাগান, ভালো বই, পোষা প্রাণী এমনকি আপনি -আমি যে বিছানায় ঘুমাই সেই বিছানাটিও। সর্বোপরি মানুষের প্রকৃত বন্ধু সে নিজে, জ্ঞান, প্রকৃতি এবং সংস্কৃতি ও প্রার্থনা। তবে সারাজীবনে যদি একজন ও মানুষ বন্ধু পান আপনি নি: সন্দেহে ভাগ্যবান।
বন্ধুত্ব একমাত্র সিমেন্ট যা সবসময় পৃথিবীকে একত্র রাখতে পারবে। উড্রো উইলসনের এই কথায় আমিও সম্পূর্ণভাবে সহমত। মানব সভ্যতা, সমাজ এবং সম্পর্ক বন্ধুত্ব বা বন্ধুভাবাপন্ন হলেই কেবল সুস্থভাবে টিকে যাবে।
*********************************