You are currently viewing নিষ্ঠুরতা, সৌন্দর্য ও সময়: নবোকভের অ্যাডা এবং লোলিটা || অনুবাদক: খালেদ হামিদী

নিষ্ঠুরতা, সৌন্দর্য ও সময়: নবোকভের অ্যাডা এবং লোলিটা || অনুবাদক: খালেদ হামিদী

নিষ্ঠুরতা, সৌন্দর্য ও সময়: নবোকভের অ্যাডা এবং লোলিটা

খালেদ হামিদী

(তুরস্কের নোবেলজয়ী সাহিত্যিক ওরহান পামুকের গদ্যগ্রন্থ Other Colours (First Published by Faber and Faber Limited in the UK in 2007; Translated from the Turkish by Maureen Freely)-এর ঊনচল্লিশতম অধ্যায় Cruelty, Beauty, and Time: On Nabokov’s Ada and Lolita এখানে অনূদিত হলো। রুশ কথাসাহিত্যিক ভ্লাদিমির নবোকভের উপন্যাসের পামুককৃত এই মূল্যায়ন ভিন্নতর মনোযোগ দাবি করে।- অনুবাদক)

আমি যেমন বলেছি, এমন কিছু লেখক আছেন যাঁরা- যদিও তাঁরা আমাদের জীবন, লেখালেখি ও সাহিত্য সম্পর্কে অনেক কিছু শেখান এবং আমরা সেগুলো ভালোবাসা ও ব্যগ্রতাযোগে পড়ি- আমাদের অতীতে থেকে যান। তাঁরা আমাদের সাথে কথা বলেন বলে নয়, নস্টালজিয়া বা স্মরণবেদনাহেতু পরবর্তী কালে যদি আমরা তাঁদের কাছে ফিরে যাই, তাঁদেরকে প্রথম পড়ার আনন্দই আমরা লাভ করি। হেমিংওয়ে, সার্ত্র, কামু এবং এমনকি ফকনার এই শিবিরের অন্তর্ভুক্ত। আজ যখন আমি তাঁদের বই হাতে নিই তখন আমি আশা করি না যে নতুন অন্তর্দৃষ্টি দ্বারা অভিভূত হবো। শুধু স্মরণ করতে চাই কীভাবে তাঁরা আমাকে প্রভাবিত করেন এবং গঠন করেন আমার আত্মা। তাঁরা এমন লেখক যাঁদের আমি মাঝে মাঝে কামনা করি। কিন্তু তেমন লেখক নন যাঁদের এখনও আমার প্রয়োজন। অন্যদিকে প্রত্যেকবার আমি প্রুশ্তের রচনা হাতে তুলে নিই নিজেকে মনে করিয়ে দিতে কীভাবে তিনি তাঁর নায়কদের আবেগের প্রতি অসীম মনোযোগী ছিলেন। যখন আমি দস্তয়েভস্কি পড়ি তখন নিজেকে এটা স্মরণ করিয়ে দিতে পড়ি যে, অন্য উদ্বেগ ও উদ্ভাবন যা-ই থাক, ঔপন্যাসিকের মূল বিবেচ্য/প্রতিপাদ্য গভীরতা। এ যেন প্রায় এই ধরনের লেখকদের মহত্ত্ব যা তাঁদের জন্যে আমাদের গভীর আকাঙ্ক্ষা থেকে অংশত উদ্ভূত হয়। নবোকভ অন্য একজন লেখক যাঁকে আমি বারবার পড়ি এবং আমার সন্দেহ হয় আমি তাঁকে ছেড়ে দিতে সক্ষম হবো কি-না। যখন আমি বেড়াতে যাচ্ছি, গ্রীষ্মের ছুটির জন্যে আমার স্যুটকেস প্রস্তুত করছি কিংবা আমার সর্বশেষ উপন্যাসের শেষ পৃষ্ঠাগুলো লিখতে হোটেলে রওনা দিচ্ছি, যখন আমি আমার সারমেয়-কানযুক্ত লোলিটা, পেইল ফায়ার ও পিক মেমোরির কপিগুলো মোড়কে বাঁধি (যেটি আমার দৃষ্টিতে নবোকভের গদ্যকে এর সর্বোত্তম রূপে দেখায়), তখন কেন অনুভব করি যেন আমি আমার ওষুধের বাক্স মুড়ে দিচ্ছি মোড়কে? নবোকভীয় গদ্যের এটাই সৌন্দর্য। কিন্তু আমি যাকে সৌন্দর্য বলি তা ব্যাখ্যা করতে পারবো না। নবোকভের বইয়ের সৌন্দর্যের নিচে লুকিয়ে থাকার জন্যে সবসময় অশুভ (তিনি এই শব্দটি তাঁর রচনার শিরোনামগুলোর একটিতে ব্যবহার করেন) কিছু থাকে, অত্যাচারের এক ফুৎকার। যদি সৌন্দর্যের “সময়হীনতা” একটা বিভ্রম বা মায়া হয়ে থাকে তাহলে তা স্বয়ং নবোকভের জীবন ও কালেরই প্রতিফলন। তাহলে কীভাবে আমি এই সৌন্দর্যের দ্বারা প্রভাবিত হই, যেমনটি নিষ্ঠুরতা এবং শয়তানিযোগে একটি ফাউস্টীয় সন্ধি দ্বারা তা অন্তর্লিখিত হয়? যখন আমরা তাঁর বিখ্যাত দৃশ্যগুলো পড়ি- টেনিস খেলায় রত লোলিটা; শার্লটের ধীর গতির বালিঘড়ি লেকে; লোলিটাকে হারানোর পর হামবার্ট রাস্তার পাশের এক ছোট পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে, ছোট শহরে (এক তুষারহীন ব্রুগেল) খেলাধুলায় মগ্ন শিশুদের কলরব শোনায় নিবিষ্ট, এবং তারপর তার প্রিয় যৌবনকালের একজনের সঙ্গে জঙ্গলে সাক্ষাৎ; লোলিটার জন্যে উত্তরকথন (সে বলে যা লিখতে এক মাস লেগেছিলো, যদিও তা মাত্র দশ লাইন); কাসবিম শহরে নাপিতের দোকানে হামবার্টের সফর; অথবা অ্যাডায় জনাকীর্ণ পারিবারিক দৃশ্য- আমার প্রথম প্রতিক্রিয়া যে জীবন ঠিক এরকম; লেখক আমাদের এমন কিছু বলছেন যা-কিছু আমি জানি, কিন্তু বলছেন এক অতিশয় বেদনাদায়ক ও দৃঢ় সততাযোগে যা ঠিক সঠিক মুহূর্তে আমার চোখে অশ্রু আনে। নবোকভ- তাঁর উপহার বিষয়ে সঠিক জ্ঞানসম্পন্ন একজন গর্বিত ও আত্মবিশ্বাসী লেখক- একবার উল্লেখ করেন যে তিনি “সঠিক স্থানে সঠিক শব্দটি” বসানোর কাজে ভালো ছিলেন। le mot juste (সঠিক শব্দ, এই উজ্জ্বল নির্বাচনশীলতার জন্যে ফ্লুবার্টের পদ)-এর জন্যে তাঁর বিচক্ষণতা নবোকভের গদ্যকে এক চমকপ্রদ এবং অতিপ্রাকৃত গুণ দান করে। কিন্তু তাঁর আদি শব্দগুলোর পেছনে নিষ্ঠুরতা লুকিয়ে থাকে যা তাঁর প্রতিভা ও কল্পনাশক্তির অবদান। আমি যে নবোকভের নিষ্ঠুরতার কথা বলছি তা আরেকটু ভালোভাবে বোঝার জন্যে সেই রচনাংশে চোখ রাখা যাক যেখানে কাসবিম শহরের এক সেলুনে হামবার্ট সফর করে- শুধু কিছু সময় কাটানোর জন্যে, লোলিটা নিষ্ঠুরভাবে (এবং সঠিকভাবে) তাকে ছেড়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ আগে। সে এক বৃদ্ধ মফস্বলীয় নরসুন্দর যে না চাইতে বৃথা গল্প করে এবং হামবার্টের দাড়ি কামানোর সময় নিজের বেজ-বল খেলোয়াড় পুত্র সম্পর্কে বকবক করে। সে হামবার্টের গা ঘেঁষেই এপ্রোনে চশমা মোছে এবং তার ছেলের সম্পর্কে পত্রিকার ক্লিপিংস (কাটা টুকরা) পড়তে নিজের কাঁচি নামিয়ে রাখে। নবোকভ অল্প কিছু বিস্ময়কর বাক্যে এই নাপিতকে জীবন্ত করে তোলেন। এই ক্ষৌরকারকে আমাদের এমন পরিচিত মনে হয় যেন সে তুর্কিয়েতেই থাকে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে নবোকভ তাঁর শেষ এবং সবচেয়ে বেদনাদায়ক কার্ডটা খেলেন। শেষ মুহূর্তে এটা বুঝতে না পারা পর্যন্ত হামবার্ট নাপিতের প্রতি সামান্য আগ্রহই বোধ করেন যে, পত্রিকার খবরের ওই পুত্র মারা গেছে তিরিশ বছর আগে। দুটি বাক্যে- যে বাক্যগুলো নিখুঁত হতে দু’মাস সময় নেয়- নবোকভ এক মফস্বলীয় সেলুন এবং পুত্রকে নিয়ে গর্বিত বাচাল নরসুন্দরের আবির্ভাব ঘটান প্রাণবন্ততা ও চেকভ (নবোকভ স্পষ্টভাবে যাঁর প্রশংসা করেন)-সদৃশ পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনার প্রতি মনোযোগ সহকারে। তারপর, ইচ্ছুক পাঠককে তিনি “মৃত পুত্রের” মেলোড্রামার প্রতি আকৃষ্ট করে অবিলম্বে প্রসঙ্গটা বাদ দেন এবং আমরা হামবার্টের ভুবনে ফিরে আসি। এই নির্মম এবং ব্যঙ্গাত্মক ফাটল থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, ওই নাপিতের দুর্ভোগ বিষয়ে বর্ণনাকারীর ন্যূনতম আগ্রহও নেই। আরও যা, তিনি নিশ্চিত যে, কেননা আমরাও হামবার্টের প্রেমময় আতঙ্কের মধ্যে আটকা পড়েছি, আমরা ক্ষৌরকারের ছেলেকে নিয়ে থাকবো যে তিরিশ বছর ধরে মৃত, এর চেয়ে বেশি কিছু নয়। এবং তাই আমরা, সৌন্দর্যের মূল্য ওই নিষ্ঠুরতার জন্যে, অপরাধবোধ ভাগ করে নিই। আমার বিশের দশকে অপরাধবোধের এক অদ্ভুত অনুভূতি নিয়ে আমি সবসময় নবোকভ পড়েছি। এবং, আমি পড়ি সেই অপরাধের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার আবরণ উন্নয়নের নবোকভীয় গর্ব সহকারে। তা ছিলো উপন্যাসগুলোর সৌন্দর্য এবং সেগুলো থেকে পাওয়া আমার আনন্দেরও মূল্য পরিশোধ। নবোকভের নিষ্ঠুরতা এবং এর সৌন্দর্য বুঝতে হলে আমাদের প্রথমে অবশ্যই স্মরণ করতে হবে জীবন তাঁর সাথে কত নির্মম আচরণ করেছে। রাশিয়ার অভিজাত পরিবারে জন্ম নেয়া নবোকভ বলশেভিক বিপ্লবের পরে সমস্ত ভূসম্পত্তি ও সম্পদ থেকে অধিকারচ্যুত হন। (পরে তিনি সগর্বে অনাসক্তি দাবি করেন।) ইস্তানবুলের (যেখানে, সিরকেয়ি হোটেলে মাত্র একদিন অবস্থান করেন) উদ্দেশ্যে রাশিয়া ত্যাগ করে প্রথমে তিনি বার্লিনে নির্বাসনে যান। সেখান থেকে তিনি প্যারিসে যান এবং জার্মানরা ফ্রান্স আক্রমণ করলে এমেরিকায় অভিবাসিত হন। যদিও বার্লিনে তিনি একজন খাঁটি রুশ সাহিত্যিক, তবুও এমেরিকায় একদা তাঁর মাতৃভাষা হারিয়ে ফেলেন। এক উদার রাজনীতিবিদ তাঁর পিতা, পেইল ফায়ার-এ একজন যেভাবে ব্যঙ্গাত্মক হৃদয়হীনতা সহকারে বর্ণনা করে সেভাবে, এক ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। তাঁর চল্লিশ বছর বয়সের দশকের মধ্যে এমেরিকায় এসে তিনি শুধু মাতৃভাষাই হারান না, হারান তাঁর পিতা, বাবার পিতৃত্ব এবং পিতৃপরিবারকেও। এই পরিবারের সদস্যরা পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। যদি আমরা তাঁর বিদ্বেষের কৌতূহলী চিহ্নের জন্যে তাঁকে অত্যন্ত কঠোরভাবে বিচার করতে না চাই- এডমুন্ড উইলসন যাকে অভিহিত করেন “আন্ডারডগকে পদাঘাত” ব’লে- অথবা যে গর্ব নিয়ে তিনি রাজনীতিতে সমস্ত আগ্রহ পরিত্যাগ করেন- কিংবা যেভাবে তিনি উপহাস করেন এবং এমনকি সাধারণ মানুষকে তাদের ধারার আচার-ব্যবহার ও রুচির দরুন হেয় করেন, এবং বাস্তব জীবনে নবোকভ যেসব ক্ষতির সম্মুখীন হন সেসব আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, বিশেষ করে মহান করুণার সঙ্গে সম্পর্কিত যা-কিছু তিনি লোলিটা, সেবাস্টিয়ান নাইট ও জন শেডের মতো তাঁরই নায়ক ও নায়িকাদের দেখান। কাসবিম নরসুন্দরের বর্ণনা থেকে যেমন স্পষ্ট হয়, বিস্তারিত নিখুঁত প্রদর্শনের মধ্যে নবোকভের নিষ্ঠুরতা নির্গত, তা আমাদের দেখায় যে জীবনে- প্রকৃতিতে, অপর জনমণ্ডলিতে, আমাদের চারপাশে, রাস্তাঘাটে, আমাদের শহরগুলোতে- কিছুই, কেউই আমাদের ব্যথার, আমাদের যন্ত্রণার উত্তর দেয় না। এই সচেতনতা মৃত্যু সম্পর্কে লোলিটার মন্তব্য (“তুমি সম্পূর্ণরূপে তোমার নিজের ইচ্ছার অধীন”) আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, তার সৎ পিতা যে-মন্তব্যের প্রশংসা করেন। নবোকভ পাঠে আমরা গভীর আনন্দ পাই এই নিঠুর সত্য দেখে যে আমাদের জীবন পৃথিবীর যুক্তির সাথে মোটেও খাপ খায় না। এই সত্যের শর্তে আমরা এর নিজের জন্যে সৌন্দর্যের প্রশংসা শুরু করতে পারি। যখন আমরা শুধু পৃথিবী শাসনকারী গভীর যুক্তি আবিষ্কার করি- বিশ্বকে আমরা কেবল মহান সাহিত্যের মাধ্যমেই উপলব্ধি করতে পারি- তখন আমাদের হাতে থাকা সৌন্দর্য দ্বারা আমরা আমরা কি সান্ত্বনা পেতে পারি?; শেষে, জীবনের নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে আমাদের একমাত্র প্রতিরক্ষা হয়ে ওঠে নবোকভের সুন্দর প্রতিসাম্য, তাঁর স্ব-নির্দেশক কৌতুক ও আয়না খেলা, তাঁর আলো উদযাপন (যাকে সবসময় অত্যন্ত স্ব-সচেতন লেখক ত্রিমাত্রিক হট্টগোল হিসেবে উল্লেখ করেন), এবং তাঁরই প্রজাপতির উড়ন্ত পাখার মতো সুন্দর গদ্য। লোলিটাকে হারানোর পর হামবার্ট পাঠককে বলেন যে যা-কিছু সে কথায় এবং আধো ঠাট্টা-বিদ্রুপের ভঙ্গিতে রেখে গেছে সেসব কিছু “শেষ আশ্রয় হিসেবে ভালোবাসা”র কথাই বায়বীয়ভাবে বলে। এই আশ্রয় গ্রহণের মূল্য হলো নিষ্ঠুরতা যা এমন অপরাধবোধের জন্ম দেয়, যেমনটা আমি বর্ণনা করেছি। কেননা নবোকভের গদ্যের সৌন্দর্য নিষ্ঠুরতার কাছে ঋণী। তা এবং হামবার্টও তাই একই দোষে বিকল, যেমন তিনি একটা ছোট শিশুর সমস্ত নিষ্পাপতা দিয়ে নিরবধি সৌন্দর্যের সন্ধান করেন। আমরা অনুভব করি যে এই বিস্ময়কর গদ্যের লেখক, বর্ণনাকারী ও বক্তা চিরকালের জন্যে এই অপরাধকে জয় করার চেষ্টা করে চলেছেন, যে চেষ্টা বা অন্বেষণ কেবল তাঁর নির্ভীক নিন্দাবাদ, উজ্জ্বল তীব্র সমালোচনা এবং ঘন ঘন অতীতে তথা শৈশবের স্মৃতিতে ফিরে যাওয়ার ইন্ধন যোগায়। যেমনটি আমরা তাঁর স্মৃতিতে দেখতে পাই, নবোকভ তাঁর শৈশবকে স্বর্ণযুগ হিসেবে দেখেন। টলস্টয়ের শৈশব, কৈশোর ও মনের তারুণ্যের উদাহরণ দিয়ে লিখেও নবোকভ রুশো থেকে প্রাপ্ত টলস্টয়ের অপরাধবোধের ব্যাপারে কোনও আগ্রহ দেখান না। এটা পরিষ্কার যে অপরাধবোধ একটা যন্ত্রণা যা শৈশবের পরে আসে। বলশেভিকরা বল প্রয়োগে রুশ সুখী জীবন থেকে তাঁকে বিচ্যুত করার পর, নিজের ঠাটকে মাননীয় করে তোলার সময়টায় তিনি যন্ত্রণায় ভুগছিলেন। পুশকিন একবার বলেন, “যদি সকল রুশ লেখক তাঁদের হারানো শৈশব নিয়েই লেখেন, তাহলে, স্বয়ং রাশিয়ার কথা কে বলবে?” যদিও নবোকভ সেই ঐতিহ্যের এক আধুনিক উদাহরণ যার বিরুদ্ধে পুশকিন অভিযোগ করেন। তবে জমিদার অভিজাতদের সাহিত্যের চেয়েও নবোকভের কাছে তা অনেক বেশি কিছু। ফ্রয়েডের সঙ্গে নবোকভের বিবাদ এবং তাঁর নেয়া ফ্রয়েডের প্রয়োজনীয়তার মজা বাতলে দেয় যে, নিজের শৈশবের স্বর্ণযুগ বিষয়ে অনুভূত ভয়ানক অপরাধবোধের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার চেষ্টাই তিনি করছিলেন। বিষয়টাকে ভিন্নভাবে দেখানোর জন্যে তিনি অপরাধবোধের রায় ও নিষেধাজ্ঞার (এবং ফ্রয়েডের নির্বুদ্ধিতা থেকে নয়, নবোকভ নিজে যেমন এগুলোর বর্ণনা দেন) বিরুদ্ধে নিজেকে রক্ষার চেষ্টা করছিলেন। যখন তিনি সময়, স্মৃতি এবং অনন্তকাল সম্পর্কে লিখতে শুরু করেন- যেসব বিষয়ক পৃষ্ঠাগুলোই তাঁর রচনার সবচেয়ে উজ্জ্বল অংশ- নবোকভ তখন ফ্রয়েডীয় রকমের জাদুর প্রয়াস পাচ্ছিলেন। নবোকভের সময়ের ধারণা নিষ্ঠুরতা থেকে পালানোর প্রস্তাব দেয় যে-নির্মমতা সৌন্দর্য হাজির করে এবং একই সঙ্গে অপরাধবোধেরও জন্ম দেয়। অ্যাডায় এই ধারণা তিনি যেমন দৈর্ঘ্যে বিস্তৃত করেন তেমন করে মনে করিয়ে দেন যে আমাদের স্মৃতিরা শৈশব এবং পেছনে ফেলে-আসা স্বর্ণযুগ বহনের অনুমোদন আমাদের দেয়। নবোকভ অতীত ও বর্তমান কীভাবে একক বাক্যে সহাবস্থান করতে পারে দেখিয়ে, সূক্ষ্ম গীতিধর্মিতাযোগে একটি সহজ ও স্বতঃসিদ্ধ ধারণা নিয়ে আসেন। সঙ্গের সবকিছুর মুখোমুখি হওয়াটা সবচেয়ে অপ্রত্যাশিত মুহূর্তে অতীতকে উদ্ভাসিত করে। আমাদের সঙ্গে সবসময় থাকা স্বর্ণযুগের দিকে চোখ মেলে তাকিয়ে ভাবমূর্তি-প্রতিমূর্তিগুলো অদ্ভুত স্মৃতিতে ভারাক্রান্ত হয়। তা ঘটে এমনকি বর্তমানের কুৎসিত বস্তুবিশ্বেও। নবোকভের মতে, স্মৃতি হলো লেখকের এবং তাঁর কল্পনা-প্রতিভার সবচেয় বড়ো সম্পদ যা বর্তমানকে অতীতের বর্ণবলয় দিয়ে আবৃত করে। কিন্তু তিনি প্রুশ্তীয় বর্ণনাকারী নন যিনি জীবনের শেষ প্রান্তে ভবিষ্যৎহীন দাঁড়িয়ে অতীতে ফিরে যান। নবোকভের স্মৃতির জোরদার অনুসন্ধান এবং সময় একজন লেখকের কথা বলে যিনি বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ বিষয়ে নিশ্চিত। কে না জানে তাঁর স্মৃতির জন্ম হয় নিয়তির খেলা থেকে এবং অভিজ্ঞতার অস্থিরতা একে আকার দেয়। লোলিটার ভারসাম্যপূর্ণ প্রাণবন্ততা অতীত ও বর্তমানের মধ্যে সামনে-পেছনে, কখনও কখনও নির্মল এবং কখনও কখনও উত্তেজিত, ওড়াউড়ি থেকে উদ্ভূত হয়। হামবার্টের বর্ণনা শৈশবের স্মৃতি (লোলিটার অনেক আগে) থেকে লোলিটার সাথে কাটানো সুখী সময়ের পলায়ন-পরবর্তী স্মৃতি পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। নবোকভ যখন বিস্ময়কর স্মৃতিগুলোর কথা বলেন তখন তিনি বারবার স্বর্গ শব্দটি ব্যবহার করেন। একটি অনুচ্ছেদে তিনি এমনকি স্বর্গের আইসবার্গের কথাও উল্লেখ করেন। এর বিপরীতে অ্যাডা হলো নবোকভের অতীতের স্বর্গকে বর্তমানে বয়ে নিয়ে আসার প্রচেষ্টা। কেননা নবোকভ জানতেন যে হারানো স্বর্ণযুগের স্মৃতি নিয়ে তৈরি একটি পৃথিবী না এমেরিকায় (যেখানে তিনি পরে বাস করেন, লোলিটার এমেরিকা যে-ভূভাগ স্বাধীনতা ও রুক্ষতার মধ্যে টলায়মান) টেকে না রাশিয়ায় (তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ)। তৃতীয় একটা দেশ সৃষ্টির জন্যে তিনি এই দুই বিশ্বের স্মৃতির মিশ্রণ ঘটান যে তৃতীয দেশ সম্পূর্ণভাবে কল্পিত এক সাহিত্যের স্বর্গ। শৈশব থেকে এ-যাবৎ কালের অতিশয় বিবরণের সমষ্টিকে তাঁর নির্দোষতা হিসেবে দেখা হলো এক অবারিত আত্মমুগ্ধতার অদ্ভুত এবং বিস্ময়কর জগতে থাকা, যা সম্পূর্ণরূপে শিশুসুলভ। আমাদের লেখক শৈশবের স্মৃতি সংগ্রহকারী বয়স্ক কেউ নন। নবোকভ তাঁর শৈশবকে বৃদ্ধ বয়সে প্রতিস্থাপনের জন্যে মার্জিত, গর্বিত অভিভূতকর সফরে অনেক কিছু সাজিয়ে তোলেন। আমরা দেখতে পাই যে তাঁর প্রেমিক নায়কেরা তাদের শৈশবকালের ভালোবাসাগুলোকে কেবল উপলব্ধি করে না, বরং এমন অবস্থাকে রক্ষা করে যা তাদের মৃত্যু পর্যন্ত তাদের সাথে এই ভালোবাসা বহন করতে দেয়। হামবার্ট শৈশবের হারানো ভালোবাসার সন্ধানে জীবন কাটিয়ে দিতে পারে। কিন্তু ভ্যান এবং অ্যাডা তাদের শৈশবের প্রেম থেকে দীপ্তিমান স্বর্গে চিরদিন বাঁচতে চায়। প্রথমে আমরা জানতে পারি যে তারা দুজন জ্ঞাতিভাই। পরে দেখি যে ওরা ভাই-বোন। ফ্রয়েডের মতো, যাকে তিনি ঘৃণা করতে খুব পছন্দ করতেন, নবোকভ সতর্কতার সাথে এটা প্রকাশ করেন এই পরামর্শ দিয়ে যে, ট্যাবুই (নিষিদ্ধকরণের নিয়ম) শৈশবের স্বর্গ থেকে আমাদের বিতাড়িত করে। নবোকভীয় শৈশব অপরাধবোধ ও পাপ থেকে দূরবর্তী একটা স্বর্গ। আমরা অ্যাডা এবং ভ্যানের প্রেমে অহংবোধের জন্যে সত্যিকার মুগ্ধতা অনুভব করতে পারি। এর ফলে আমরা দরিদ্র লুসেটের সাথে পরিচিত হতে পারি, ভ্যানের প্রতি যার মহান ভালোবাসা প্রতিদানহীন থেকে যায়। আখ্যায়কের সৃষ্টি মন্ত্রমুগ্ধকর স্বর্গ অ্যাডা এবং ভ্যান যেমন উপভোগ করেন, তেমনি আরেক দিকে লুসেট (বইয়ের সবচেয়ে আধুনিক, সমস্যাক্লিষ্ট এবং অসুখী চরিত্র) নবোকভীয় নিমর্মতার শিকার হয়। তাকে বাদ দেয়া হয় বইয়ের প্রধান দৃশ্যগুলো থেকে। ছেঁটে ফেলা হয় ওকে তার মহান ভালোবাসা থেকে যে-ভালোবাসা অনুভব করেন অনেক পাঠক। এটা সেই বিন্দু যেখানে লেখকের মহত্ত্ব পাঠকের ওপর নির্ভরশীল। নবোকভ আমাদের সময়ে, বাস্তবতা থেকে মুক্তি পেতে নিজের জন্যে একটা আশ্রয়স্থল সৃষ্টির জন্যে, তাঁর নিজস্ব স্বর্গ ফিরিয়ে আনার সংগ্রাম করেন। তা করেন তাঁর ব্যক্তিগত কৌতুক ও শ্লেষ এবং গোপন আনন্দ ও খেলা চরিতার্থের ইচ্ছা আর উদ্দীপনার সীমানাহীনতায় নিজের বিস্ময় বিস্তারিত করতেও। আর এই আবেগ অ্যাডার মধ্যে তখন এমন মুহূর্ত তৈরি করে যখন সে অধৈর্য পাঠককে হারায়। এটা সেই সন্ধিক্ষণ যাতে এসে প্রুশত্, কাফকা এবং জয়েস পাঠকদের অস্বীকার করেন। কিন্তু এই অন্যান্য লেখকদের থেকে ভিন্ন নবোকভ, উত্তরাধুনিক কৌতুকের জনক, পাঠকের সাড়া অগ্রিম দেখতে পান এবং নিজেকে এক ক্রীড়ায় জড়ান। তিনি কথা বলেন ভ্যানের দার্শনিক উপন্যাসের কঠিনতা বিষয়ে। বলেন “বসার ঘরে পাখার হাওয়ার মৃদু ঝাপটা-খাওয়া মহিলাদের মধ্যকার কোলাহলের কথাও”, যাতে সাহিত্যিক খ্যাতির প্রতি উদাসীনতার দরুন ভ্যানকে অহংকারী হিসেবে দেখা হয়। আমার তারুণ্যে, যখন চারপাশের প্রত্যেকে আশা করতো যে ঔপন্যাসিকগণ সামাজিক ও নৈতিক বিশ্লেষণে ন্যস্ত থাকুক, তখন আমি এই গর্বিত নবোকভীয় অবস্থানকে আমার ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছি। তুর্কিয়েতে ১৯৭০- এর দশক থেকে অ্যাডা এবং নবোকভের অন্য উপন্যাসগুলোর চরিত্রগুলোকে দেখা হয় “বর্তমান থেকে বিচ্ছিন্ন” একটি অস্তিত্বহীন বিশ্বের কল্পনা হিসেবে। আমি যে সামাজিক পরিবেশের নিষ্ঠুর ও কুৎসিত চাহিদা দ্বারা ভয়ে স্তব্ধ হতে পারি, সেখানেই আমার উপন্যাসগুলো স্থাপনের পরিকল্পনা করি। আমি শুধু লোলিটা নয়, অ্যাডার মতো বইগুলোকেও বুকে জড়ানোর এক নৈতিক বাধ্যতা অনুভব করেছি। এই বইগুলোতে নবোকভ তাঁর শ্লেষ, যৌন কল্পনা, পাণ্ডিত্য, সাহিত্যিক খেলা, স্ব-উল্লেখ্য কৌতুক এবং ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের স্বাদকে বাহ্যিক সীমা পর্যন্ত প্রসারিত করেন। এই কারণেই আমার জন্যে মহান সাহিত্য বাস করে অপরাধবোধের বিচ্ছিন্ন বাতাসে শীতল, কাছাকাছি একটা জায়গায়। অ্যাডা হলো সাহিত্যের শক্তি ও ইচ্ছা ব্যবহার করে বর্তমান কালে স্বর্গ নিয়ে আসার জন্যে মহান লেখকের সেই অপরাধবোধ নির্মূল করার একটা প্রচেষ্টা। এই কারণেই, একবার আপনি এই বইয়ে এবং ভ্যান ও অ্যাডার অজাচারী মিলনে আস্থা হারিয়ে ফেললে বইটি এমন এক পাপে নিমজ্জিত হয় যা নবোকভের অভিপ্রায়ের বিপরীত। ০২, ০৫-০৯ ও ১৯ নভেম্বর ২০২৩ চট্টগ্রাম ******************************