You are currently viewing দুই পয়সার মানুষ / ফয়জুল ইসলাম

দুই পয়সার মানুষ / ফয়জুল ইসলাম

দুই পয়সার মানুষ

ফয়জুল ইসলাম

বাণী সিনেমাহলের চত্বরের পশ্চিমদিকে দুলুর পানবিড়ির দোকান। দোকানের ভেতরে বসে জাতি দিয়ে সুপারি কাটতে কাটতে দুলুর আবারো মনে হয়, নাইট শো আসলেই জঘন্য! একটা মেয়েও থাকে না! ম্যাটিনি আর ফার্স্ট শো ভাঙার পর তো রীতিমতো মেয়েদের আমদানি লেগে যায়! ম্যাটিনি আর ফার্স্ট শো শেষ হলে প্রতি দিনই দুলু দেখতে পায়, সিনেমাহল থেকে হড়হড় করে বের হচ্ছে ডয়কা ডয়কা সব মেয়ে। মেয়েদের কেউ কেউ তো ফিল্মের নায়িকাদের মতো করে তার মাথার ভেতরে যার-পর-নেই দপদপানি লাগিয়ে দিয়ে যায়! পাশের পানবিড়ির দোকানের লগি মজিদ ঠিকই বলে—শালা দেহিছিস! মিয়েগুলের গায়ের থেন যিন কারেন্ট বারাচ্ছে এহেবারে! ‌আমি তো আর বাঁচপ না মনে কয় ভাই!

এই মুহূর্তে বাণী হলের নাইট শো ভেঙেছে। গাদাগাদি মেরে খালাস হচ্ছে কেবল রাজ্যের মিনশেরা—দেখ! একটাও মেয়ে নেই! একে তো চৈত্রের চাঁদি ফাটানো গরম, তার ওপর আবার হাউসফুল। তাই কারো ঘামে ভেজা জামার ওপরের দিকের ক’টা বোতাম খোলা, কারোবা সবগুলোই। গরমে কেউ কেউ জামা খুলে ফেলে ঝুলিয়ে রেখেছে ঘাড়ে। মিনশেরা আবার হাঁটুর ওপর লুঙ্গি তুলে মাজায় গেরোও দিয়েছে দেখ! হিরোইনের শরীরের ঢলক দেখে এত ক্ষণ তো খুব শিস মেরেছিস! এখন আবার হল থেকে বের হতে হতে শিস মেরে কান ফাটাচ্ছিস কেনরে শালারা? রাত তো আর কম হ’ল না—ইতোমধ্যে রাত বারটা পার হয়ে গেছে! পানবিড়ির দোকানদারের কি ক্লান্তি আসে না, ঘুম পায় না নাকি?

সেই সকাল সাড়ে আটটার দিকে আর সব দিনের মতো আজো দোকান খুলেছে দুলু। মালিকের আদেশ—নাইট শু শ্যাষ না-হলি পরে খবরদার দুকান বন্ধু করবু না! শালার খচ্চর মালিক তো এত ক্ষণ নিশ্চয় বুড়ি বউয়ের ঝুলঝুলে বুকের ভেতর পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে! তবু সে মালিক। আর মালিকের কথা শিরধার্য। নয়-দশ বছরের একটা হেল্পার অবশ্য দেয়া হয়েছে তাকে। হেল্পারটা আছে বলেই দুলু কোনো একটা কাজে দোকান ছেড়ে বের হতে পারে, চাপ না-থাকলে হলের পেছনের কোনো হোটেলে গিয়ে দুপুরের খাওয়াটাও সেরে আসতে পারে সে। সন্ধ্যার পর পরই মুরগির মতো ঝিমাতে ঝিমাতে বাড়ি চলে যায় তার হেল্পার। ঐ ছোকরাটা থাকলে কি আর আলসেমি সরিয়ে রেখে এখন এই একহাতে নাইট শো ভাঙা কাস্টমারদেরকে নিয়ে তাকে পড়তে হয়? যন্ত্রণার একশেষ!

প্রথমে আসে সুতার ব্যবসায়ী রন্টু। সে জেলাপাড়ায় থাকে। তার একটা গোল্ড লিফ সিগারেট চাই। দুলু সিগারেট বের করে দেয়।

দ্বিতীয় জনকে দুলু চেনে না। তার চাই ডাবল পান আর চারটা স্টার ফিল্টার। তাকে সে সব দেয়া হয়। চেহারার দিকে তাকিয়ে বোঝা যায়, এই কাস্টমার পাবনা শহরের কেউ নয়। হয়তবা সে বাণী হলের উল্টোদিকের রিদ্দিক হোটেলের কোনো বোর্ডার হবে।

তৃতীয় জন আল্লেক—নিলুর ওয়েল্ডিংশপের কর্মচারি। একটা বিড়ি দেয়া আর পয়সা বুঝে নেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে তার সাথে একটু কুশল বিনিময় হয়।

তারপর আসে হলের সামনের লাহিড়ীপাড়ার বকুল—শাহীন ফোর্সের নতুন মস্তান। মাঝে মাঝে সে কোমরে পিস্তল নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। বকুল এসেই শুরু করে দেয় ফরফর, ‘এ দুলু! দু’ডে বেনসন দে তো!’ দুলু ভাবে: বকুল পয়সা দেবে তো আজ? মস্তান হিসাবে নাম করার পর থেকে বকুল কোনো দিনই তো পান-সিগারেটের দাম দেয় না! সন্দেহ নিয়েই তবু সিগারেট বের করে দেয় দুলু। একটা সিগারেট ধরিয়ে, আরেকটা বুক পকেটে ঢুকিয়ে হাঁটা দেয় বকুল। যথারীতি পয়সা দেয় না সে; দুলুকে বলে—খাতাত লিখে রাখেক। পরে দাম দেবনে। আর তা’তে মেজাজটা আরো কষটে যায় দুলুর! মনে মনে সে বলে: আর পয়সা দিছেও তুমি!

ততক্ষণে দুলুর দোকানে হামলে পড়েছে একগাদা কাস্টমার। ব্যস্ততায় আর কারো চেহারায় তাই চোখ ফেলতে সময় পাচ্ছে না দুলু। দ্রুত গতিতে তার হাত চলছে পান, সুপারি, জর্দা, চুন আর খয়েরের কৌটায়, নানান ব্রান্ডের সিগারেট আর বিড়ির প্যাকেটে। একটু শ্লথ হলেই বিপদ—পাশেই লগি মজিদের দোকানে পিছলে যাবে কাস্টমারেরা।

তখন খুব পরিচিত কন্ঠে কেউ তাকে ডাকে, ‘দুলুরে! একখেন ইস্টার ফিল্টার দে তো রে ভাই!’ কন্ঠটায় শব্দগুলো কেমন যেন জড়িয়ে গেছে, একটা শব্দ উঠে বসেছে আরেকটা শব্দের পিঠে। এটা আবার কে? কাজ থেকে মাথা তুলে তাকিয়ে তখন যার-পর-নেই চমকে যায় দুলু।

খলিল? পাঁচ বছর পর পাবনা শহরে? কী আশ্চর্য! চোখ দু’টো বার বার বন্ধ হয়ে আসছে বাণী হলের প্রাক্তন লাইটম্যান খলিলের। সস্তা মদের গন্ধও বের হচ্ছে তার মুখ থেকে। মদ টানার পুরনো অভ্যাসটা সে এখনো তবে ছাড়েনি! দুলুর দিকে না-তাকিয়েই খলিল শার্ট আর প্যান্টের পকেটে টাকা খুঁজতে বসেছে। শেষে তার প্যান্টের পকেট থেকে বের হয় দশ টাকার একটা নোট। নোটটা দুলুর দিকে এগিয়ে দিতে দিতে তারপর খলিল তাড়া মারছে, ‘জলদি সিগারেট দে না কীকামে! দাঁড়াবের পারতিছিনে মোটেই!’

ছোট দোকানটার ওপাশের দরজা দ্রুত খুলে দিয়ে দুলু তার বন্ধু খলিলকে দোকানের পাটাতনের ওপরে বসতে দেয়। সাথে সাথেই সেখানে বসে পড়ে খলিল। দোকানের আলোতে এবার ভাল করে সমবয়সী খলিলের দিকে তাকায় দুলু। বেটেখাট আর চওড়া নাকের খলিলের মিশমিশে কালো শরীরটা সেই পাঁচ বছর আগের চাইতে আরো বেশি মোটাতাজা হয়েছে। খলিলের মুখে এখন সংযোজিত হয়েছে একগাদা কালো দাঁড়ি আর তার গোল গোল চোখ দু’টো এখন আগের চাইতেও অনেক বেশি লাল। সবমিলিয়ে খলিলের শরীরে মধ্য-তিরিশের ঢিলেঢালা ছাপ বসে আছে এখন। অথচ তার বয়স এখন তেইশ কি চব্বিশ হবে!

খলিলের হাতে একটা স্টার ফিল্টার সিগারেট তুলে দেয় দুলু কিন্তু বিনিময়ে সে পয়সা নেয় না। তারপর দুলু খলিলকে বলে, ‘বসেক। কাম সারে লেই আগে। তারপর কথা হবিনি। কদ্দিন পরই না তোর সাথ দেহা হলে!’

বাড়িত যাব ব্যাটা! বেশি ক্ষণ কইল বসপের পারব লয়, বুঝলু! কাঁপা হাতে ম্যাচ জ্বালিয়ে সিগারেট ধরাতে ধরাতে খলিল দুলুকে জানায়। দুলুর তখন মনে পড়ে, ছোটকালে লিয়াকত স্কুলে পড়ার সময় দুলুরা খলিলকে ‘খৈল’ বলে ডাকত। ক্লাস সেভেনে খলিল পর পর দু’বার ফেল করেছিল এবং তাকে তখন স্কুল থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল। কালক্রমে খলিল বাণী হলে চাকরি নিয়েছিল লাইটম্যান হিসাবে। তারপর এক দিন সে পাবনা টাউন থেকে হাওয়া হয়ে গিয়েছিল।

এই মুহূর্তে রাত প্রায় সাড়ে বারটা। বাণী হলের চত্বরটা একেবারেই ফাঁকা হয়ে গেছে। যেই রিকশাগুলো সওয়ারি পায়নি, বাণী হলের চত্বর ছেড়ে চলে গেছে তারা। হলের সামনের নির্জন আব্দুল হামিদ রোড ধরে হেঁটে যাচ্ছে দু’এক জন মানুষ। রাস্তা ধরে দু’একটা রিকশা চলছে আর টপ গিয়ারে গোঁ গোঁ করতে করতে ট্রাফিক মোড়ের দিকে ছুটে যাচ্ছে গোঁয়ার গোবিন্দ একটা ট্রাক। নাইট শো শেষ হয়ে গেছে বলে লম্বা শরীরটাকে ঝুঁকিয়ে লগি মজিদ এদিকে তার পানবিড়ির দোকানটার ডালায় তালা লাগাতে বসেছে। দোকান বন্ধ করবে দুলু নিজেও। দোকানের পাটাতনে ধুম মেরে বসে থাকা খলিলকে তাই উঠে পড়তে বলছে দুলু, ‘চলরে খৈল! বাড়িত যাই। যাতি যাতি আলাপসালাপ হবিনি।’

দুলুর দোকানের পাটাতন থেকে উঠে বসতেই নেশার ঘোরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যেতে নেয় খলিল। তবে সাথে সাথেই সে পাশের ইলেকট্রিসিটির পোলটা ধরে সামলে ফেলেছে নিজেকে।

দোকানের ডালা নামিয়ে চারটা বড় বড় তালা আটকায় দুলু। পরনের লুঙ্গিটাকে সে ঝেরেঝুরে ফের শক্ত করে বেঁধে নেয়। ইলেকট্রিসিটির পোলে চেইন দিয়ে আটকানো পুরনো র‌্যালি সাইকেলটাকেও প্রতি দিনের মতো তালা থেকে সে মুক্ত করে। তারপর সাইকেল ঠেলে সামনে হাঁটতে শুরু করে দুলু। এলোমেলো পায়ে তার পিছে পিছে চলেছে মাতাল খলিল।

দুলু ভাবে, রাত হয়েছে তো কী হয়েছে, এক কাপ চা খাওয়া দরকার। চা খাওয়ার ছুতায় যদি খলিলকে ধরে রাখা যায় আরো কিছু ক্ষণ! শালা তো মদে পড়েছে! এখন খোঁচাখুঁচি করলে বের হয়েও আসতে পারে খলিলের পেটের ভেতর কপাট মেরে রাখা কথাগুলো। পাবনা টাউনের সকলেই জানে, খলিলের কাছে একটা গল্প আছে—অনেক অনেক পুরনো গল্প! এই খলিলই এক দিন ফেরদৌসি বেগম রত্না নামের এক জন সুন্দর মেয়েকে অপহরণ করে পাবনা শহরে সোর তুলেছিল। তারপর খলিল নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়াতে শহরের আর কেউই জানতে পারেনি গল্পটা। কাছের মানুষ হলেও দুলুরও তো সে গল্পটা জানা হয়নি! কাজেই ভাতের খিদে খাম করে দুলু এখন এই ওবেলায় খলিলকে নিয়ে চা খেতে বসতে চাইতেই পারে! দুলুর সে প্রস্তাবে রাজিও হয়ে যায় মাতাল খলিল।

রাত প্রায় সাড়ে বারটা এখন। সেলিমের চা’র দোকান বাদে বাণী হলের পশ্চিমপাশের আর সবগুলো দোকানেরই শাটার বন্ধ। খলিল আর দুলুর পুরনো বন্ধু সেলিমও তার চা’র দোকানের চুলা নিভিয়ে ফেলেছে। শলা দিয়ে ঝাঁট দেয়া চলছে সেলিমের ছোট্ট দোকানের মেঝেটা। তাই অবেলায় দুলু আর খলিলকে দোকানে ঢুকতে দেখেই দাবড়ানি মারছে সেলিম, ‘আয়লো শালারা অসুমায়! নাইট শু তো শ্যাষ হয়ছে সেই কহুন! আগে আইসপের পারিছিলু না? এহুন চা হবিনানে, যা!’

আল্লাহর কিড়ে লাগে ভাই! চা দে ইট্টু! বিশ্বেস করেক, মাথাডা ধরেছে খুব! মিথ্যে কথাটা অনুনয় করে বলছে দুলু। তবে খলিল নির্বিকার। সেলিমের দোকানের বাইরের দেয়ালে হেলান দিয়ে সে ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে আছে।

একটু ভাবে সেলিম। তারপর বিরক্তি নিয়ে সে বলছে, ‘কেতলিত কুসুম গরম পানি রয়ছে খাইনটেক। তুরা রাজি হলি পরে তা দিয়ে চা বানা দিবের পারি। পয়সা আবার কম দিবের পারবু লয় কিন্তুক, হ্যাঁ!’

আর উপায় কী? সেলিমের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেছে দুলু।

চা বানাতে বানাতে খলিলকে সেলিম জিজ্ঞাসা করছে, ‘মেলা দিন পর তোক পাবনা টাউনি দেখলেম! কোনে ছিলু তুই? তা কবে আলু?’

বাড়িত আইছি দিন দশেক তো হবিই! সেলিমের দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর দেয় খলিল। মাতাল খলিল হয়ত সেলিমের প্রথম প্রশ্নটা ভুলেই গেছে! তবে খলিলের উত্তরটা মোটেই বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না দুলুর কাছে। মদের ঘোরে কী না কী বলছে খলিল আল্লাই মালুম! এমনো তো হতে পারে যে গতকালকেই পাবনায় এসেছে সে!

যাহোক, সেলিম আবারো খলিলের কাছে জানতে চাচ্ছে, ‘তোর নামে পুলিশের খাতাত কীসব কেসটেস উঠিছিলে বলে শুনিছিলেম? সিসব নেকি মিটিও গিছিলে? তা’লি পরে তুই ফেরার হলু কীকামে?’

সেলিমের সে প্রশ্নটাও খলিল বোধহয় শুনতেই পায়নি! প্যান্টের পকেট থেকে কী একটা কাগজ বের করে সে মনোযোগ দিয়ে উল্টেপাল্টে দেখছে কাগজটা। আর কিছু না-বলে তখন চা বানাচ্ছে সেলিম।

কুসুম গরম পানির চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে সহজেই। দুলুর মনে হচ্ছে, এর চাইতে ছাগলের মুত খাওয়াটাও ভাল! অতৃপ্তিতে তাই ব্যাদান হয়ে গেছে তার চেহারাটা।

এদিকে মাথা নিচু করে আনমনে চা খাচ্ছে খলিল। তাকে জিজ্ঞাসা করছে দুলু, ‘তা ব্যাটা, চিটাগাংই তো ছিলু, নেকি?’

পাবনা ছাড়ার পরথম কয়ডা দিন ঢাহাত ছিলেম। তারপর থেন টানা চিটাগাং শহরে।

কদ্দিন পরই না পাবনাত আলু তুই!

তা পাঁচ বচ্ছর তো হবিই! এই বলে জামার বুকপকেট হাতড়াচ্ছে খলিল। সে সিগারেট খুঁজছে নিশ্চয়ই। চটজলদি পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা স্টার সিগারেট বের করে দুলু খলিলের হাতে তুলে দেয়। দুলু মনে মনে বলে—খা বাবা! যত লাগে সিগারেট খা! তবু রত্নার ঘটনাটা আজকে ভেঙে বল তুই! বছর পাঁচেক হয়ে গেছে, পাবনা শহরের অনেকেই এখনো সেকথা ভোলেনি। এই মুহূর্তে সেলিমও হয়ত রত্নার অপহরণের ঘটনাটাই ভাবছে।

খলিলকে দুলু জিজ্ঞাসা করছে, ‘চিটাগাং টাউনি গাড়ি চালাতু বলে শুনিছিলেম? তোর ছোড ভাই কইছিলে একবার।’

খলিল বলছে, ‘হ! পয়লাত…খাড়া! জায়গাডার নাম যিন কী…ও হ্যা! মনে পড়েছে—লালখান বাজার…লালখান বাজারের এক বাসাত পিরাইভেট চালাইতেম, পরে কুলসিত। ভালই ছিলে সব। কিন্তুক মন আর টিকলে না, বুঝলু? নিজির বাড়ি ছাড়ে কয় দিন আর হিল্লিদিল্লি ঘুরা যায়, ক?’

খলিলের আঙুলের ফাঁকে সিগারেট জ্বলছে। কিন্তু সে সিগারেট টানছে না। ঝুলতে ঝুলতে বাঁকা হয়ে গেছে সিগারেটের দীর্ঘ ছাই। ছাইটা হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাবে যেকোনো সময়ে। অর্থাৎ সিগারেট টানাতে খলিলের মন নেই। হয়ত সে কিছু একটা নিয়ে ভাবছে।

দুলু তখন সকৌতুকে হাসতে শুরু করেছে এই বলে: ‘কুলসি’ শুনে আমার কইল ‘কলসি’-র কথা মনে হলে! আর তা’তে রেগে গিয়ে খলিল দুলুকে বলছে, ‘ফাইজলামো করিসনে তো! পাবনা টাউনির বাইরে তো কুনু জায়গাই চিনলু না তুরা! কুলসিত চিটাগাং টাউনির বড়লোকেরা থাহে! চোদন আছে, বুঝলু?’

মাতাল খলিলকে কথা বলতে দেখে তখন উদ্দীপিত হচ্ছে দুলু। খলিলের কথাকে আরেকটু চড়িয়ে দিতে সে খলিলকে আবারো জিজ্ঞাসা করছে, ‘ব্যাতনট্যাতন তো ভালই পাইস, নেকি?

ব্যাতন পাঁচ হাজার ট্যাকা। থাকা-খাওয়া ফিরি। চাঁদে চাঁদে গাড়ির ত্যালম্যাল বেচে সারে আরো কিছু ট্যাকা পকেটে আসে পড়ে।

তালি পরে তো ডাঁটেই আছিস দেহা যায়!

তা ঠিকই কইছিস। কিন্তুক ব্যাটা শোনেক, পাবনা টাউন ছাড়ে ইবার আর কোনেও যাব না আমি। দেহি, কোন শালা আমাক কী করে! আমি হলেম সাধুপাড়ার ছাওয়াল! হারামজাদাক মারে হাড়হাড্ডি সব আলাদা করে দিবের পারি, বুঝলু? এভাবে হঠাৎই রেগে গেছে খলিল।

তোর জায়গাত তুইই থাকপু। তা’ত কার কী? কথার পিঠে এটুকুই বলছে দুলু। সে ভাবছে, খলিলের কথায় কেমন যেন একটা রহস্যের আভাস! ব্যাপার কী? খলিল ক্ষেপে গেল কার ওপরে?

তবে খলিলকে বেশি কিছু বলতে যায় না দুলু। এই মুহূর্তে খলিলকে কোনো প্রশ্ন করাটা মোটেই ঠিক হবে না। ভ্যাবলার মতো চেহারা বানিয়ে ক্যাশ গুনলে কী হবে, ঠিকই কান খাড়া করে সবকথা শুনছে পেট পাতলা সেলিম। খলিল কিছু গুমোর খুল্লে কাল সকালেই বাণী হল, সমবায় মার্কেট, গোবিন্দা এমনকি ট্রাফিক মোড় পর্যন্ত সেলিম সব ঢোল মেরে দেবেই দেবে! এটা সেলিমের পুরনো অভ্যাস। নেশায় বোম হয়ে আছে খলিল। কখন কী বলে ফেলে সে—তার তো ঠিক নেই! তাই খলিলকে নিয়ে সেলিমের চা’র দোকান থেকে জলদি উঠে পড়েছে দুলু। এই মুহূর্তে খলিলকে তার একা চাই। গোপালপুরের রত্নার অপহরণের গল্পটা খলিল ছাড়া আর কেইবা জানে! আজ থেকে বছর পাঁচেক আগে খলিলই তো পাবনা টাউনের গোবিন্দা এলাকা থেকে একসময়ের শহর কাঁপানো সুন্দরী রত্নাকে হাইজ্যাক করেছিল! শহরের অদূরের বাঁশের বাদা থেকে রত্না বাড়ি ফিরে আসার পর পর উধাও হয়ে গিয়েছিল খলিল। খলিল কেন রাতারাতি উধাও হয়ে গিয়েছিল সেকথা খলিলকে আর জিজ্ঞাসা করার সুযোগই হয়নি দুলুর। পাবনা টাউন থেকে চলে যাওয়ার পর খলিলের সাথে তো আর দুলুর দেখাই হয়নি কোনো দিন!

সেলিমের দোকান থেকে উঠে বাড়ি যাবে বলে বাণী হলের পেছনদিক দিয়ে আগাচ্ছে দুলু আর খলিল। সাইকেলটার হ্যান্ডেল ডান হাতে ধরে রেখে সমুখে হাঁটছে দুলু। খলিল ঠিক তার পিছে। ছোট একটা ব্রিজ পার হয়ে দক্ষিণদিকে গেলে গোবিন্দা, তারপর কৃষ্ণপুর, তারপর লাইব্রেরি বাজার। লাইব্রেরি বাজার থেকে পশ্চিমে আরেকটু আগালেই উদ্দিনের গলি। দুলুদের বাড়ি সেখানেই। খলিলের বাড়ি সাধুপাড়া—লাইব্রেরি বাজার থেকে সামান্য দক্ষিণে, দুলুদের বাড়ি থেকে মোটেই দুরে নয়। কাজেই দুলুর সাইকেলের সামনের রডে বসে খলিল সহজেই লাইব্রেরি বাজার পর্যন্ত যেতে পারবে। দুলু ভাবছে, যেতে যেতেই খুলতে চেষ্টা করা যাবে রত্নার অপহরণের রহস্যটা। কিন্তু খলিল সাইকেলে উঠবে না কিছুতেই! টলোমলো পায়ে হাঁটতে হাঁটতে ব্রিজটার গোড়ায় দাঁড়িয়ে গিয়ে খলিল চেঁচিয়ে বলছে, ‘শালা বোকাচুদা! চিনিস আমি কিডা? চার বচ্ছর ধরে টয়োটা কোম্পানির পিরাভেট কার চালাই আমি, হ্যাঁ! আমার একখেন পেস্টিজ নেই নেকি? সাইকলের রডে চড়বের পারব লয়। রিকশা লে তুই।’

মর ভরাপরা! তা’লি পরে রাইত-বিরেতে সাইকেল রাখপ কোনে? দ্বিধায় পড়ে গিয়ে তাই খলিলকে জিজ্ঞাসা করছে দুলু।

তার আমি কী জানি! সাইকলখেন কি আমার? দরকার হলি পরে পকেটে ঢুকা লেগা, যা! ব্রিজের গোড়ায় দাঁড়িয়ে থেকেই উত্তর দিচ্ছে খলিল আর সে হাসতে শুরু করেছে গলা ফাটিয়ে।

খুব ভাঁজ নিচ্ছে এই শালার খলিল! চাইলে কি আর দুলু ওর মতো টয়োটাগাড়ি চালাতে পারত না, ড্রাইভারের চাকরি নিয়ে যেতে পারত না সৌদি আরবে? ড্রাইভারি করাটা কী আর এমন কঠিন কাজ? সিটে বসে বসে স্টিয়ারিং ঘুরালেই তো হয়! আর মাঝে মাঝে গিয়ার পাল্টানো—এইতো?

দুলুর মেজার খারপ হয়ে যাচ্ছে কেননা সে বুঝতে পারছে যে আচ্ছা একটা কলে তাকে আটকে দিয়েছে খলিল! এত রাতে রিকশা পাওয়া যাবে কই? আর তা পেলেও তার এই সাইকেলটা সে কোথায় রেখে যাবে? এমন একটা ঝামেলাতে পড়লেও খলিলকে তো এখন ছাড়া যাবে না কিছুতেই! আবার কবে খলিলের সাথে দেখা হবে তা কে জানে! হয়ত দেখা যাবে, কালকেই ব্যাটা আবারো নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে! কাজেই গোপালপুরের রত্নাকে কেন হাইজ্যাক করতে গিয়েছিল খলিল তা আজই জানতে পারলে ভাল হ’ত। রত্নার মতো অপরূপ একটা মেয়েকে তুলে নিয়ে গিয়ে খলিল তাকে বিয়ে করেনি বলে জানা যায়। তবে রত্নাকে তুলে নিয়ে গিয়ে কী করেছিল বাণী সিনেমাহলের লাইটম্যান খলিল? রত্না কি ভালবেসেছিল খলিলকে? আল্লায় জানে! আহা! রত্নার চেহারাটা মনে পড়লে এখনো কেমন উদাস-হতাশ লাগে দুলুর! তখন পাবনা টাউনে রত্নার মতো ওত সুন্দর মেয়ে আর একটাও ছিল না! লিয়াকত স্কুলের ক্লাস ফাঁকি দিয়ে কত দিন  দুলু তার বন্ধুদের সাথে পাবনা গার্লস স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে থেকেছে রত্নাকে শুধু একচোখ দেখার জন্য!

এত রাতে সাইকেল রাখার জন্য শেষপর্যন্ত সেই সেলিমেরই দ্বারস্থ হতে হয়েছে দুলুকে। হারুনের হার্ডওয়ারের দোকান খোলা থাকলে আর ভাবতেই হ’ত না দুলুকে কেননা সেলিমের চাইতে হারুন তার অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ বন্ধু। যা হয়, একরাতের জন্য দোকানে সাইকেল রাখার প্রস্তাব শুনে সেলিম একটা খেটকি মেরেছে। সাইকেল রাখতে রাজি হয়েও অসন্তুষ্ট সেলিম চুপ করে থাকছে না। সে বলছে, ‘দুলু! তোর চিহারা দেখলি পরে না দিনডা মাটি হবিই হবি! সাইকল থুয়ে কোনে যাচ্ছেও শালারা, বুঝিনে না? এ! তোরে ঘরে বউ নেই যে লোটিবাড়িত যাইস তুরা?’

হাসতে হাসতে এই মুহূর্তে মাতাল খলিল সেলিমকে বলছে, ‘দুলুর বউ আটুয়াত। আমার বউ কুলসিত। তারা যার যার ঘরেই রয়ছে, বুঝলু? আমারে আর লোটিবাড়িত যাওয়া লাগবিনানে। তুইই যাগা! তয় আমি এহুন চাকীবাড়িত যাচ্ছি। টিন কাটা বাংলা মদ খোলা হয়ছে আইজ। আরেক পাক ঘুরে আসিগে!’

সাইকল গছা দিয়ে যাচ্ছেও আবার লেকচারও মারতিছেও? কাটে পড়েক এহুন হেন থেন, যা! না-গেলি পরে মারে তোরে দাঁত খুলে ফেলাবনে কলেম! রাইতের বেলা আসে তান্না লাগা দেছে তারা! দোকানের শাটার নামাতে নামাতে এভাবে খেউখেউ করে উঠছে সেলিম।

দুলু ভাবছে: সেকি? এখন এত রাতে আবার চাকীবাড়িতে বাংলা মদ টানতে যাবে খলিল? এমনিতেই খলিল যথেষ্ট মাতাল হয়ে আছে! মদ বেশি খেলে তার মাতালামি তো চাড়া দেবেই! তখন হয়ত খলিল আর সাজিয়েগুছিয়ে কথাও বলতে পারবে না! রত্নাকে হাইজ্যাক করার পরের ঘটনাগুলো তা’হলে জানা যাবে কী করে? খলিলের সাথে আদারেপাদারে পড়ে থাকতে থাকতেই উল্টো সকাল হয়ে যাওয়ার জোর সম্ভাবনা! আচ্ছা হুজুগে পাবলিকের ফ্যারে পড়া গেল! কাজেই চাকীবাড়িতে পৌছানোর আগেই খলিলের পেট থেকে রত্নার অপহরণের গল্পটা বের করে নেয়া দরকার।

চাকীবাড়িতে যাওয়ার জন্য বাণী হলের পাশের রাস্তাটা দিয়ে খলিল এসে দাঁড়িয়েছে আব্দুল হামিদ রোডের ধারে। এটাকেই পাবনা শহরের বড় রাস্তা বলা হয়। রাতের রাস্তায় একটাও রিকশা নেই। তাই অনেক ক্ষণ ধরে দুলু আর খলিল ঠ্যাংয়ের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। দক্ষিণের রায় বাহাদুরের গেট পার হয়ে শেষপর্যন্ত মোড়ের দিকে রিকশা আসে একটা। ধীরে ধীরে চালাও প্যাডেল—রিকশাওয়ালা এ গানটা গাচ্ছে গলা ছেড়ে। হাত তুলে তাকে থামতে বলছে খলিল, ‘এই ব্যাটা! চাকীবাড়ি’ত যাবু?’

না ভাই, যাব লয়। খলিলের ডাকে রিকশার গতি কমিয়ে উত্তর দিচ্ছে রিকশাওয়ালা।

শালার ব্যাটা শালা! তা’লি পরে তুই কোনে যাবু? তোর শ্বশুরবাড়িত? রিকশাওয়ালার উত্তর শুনে ক্ষিপ্ত হয় গেছে খলিল।

বাড়িত যাচ্ছি। রাইত হয়ছে। খেপ আর লেব না ভাই! খলিলের খোঁচা খেয়েও কিছু না-বলে নির্বিকার রিকশাওয়ালা প্যাডেল মেরে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে।

মারাও গা যায়ে! ব্যাটা শালা আমার! রিকশাওয়ালার ওপরে খলিলের রাগ আর থামছেই না!

দুলু ভাবছে, সাইকেল নেই, রিকশাও পাওয়া যাচ্ছে না তা’হলে তারা এই গভীর রাতে চাকীবাড়ি পর্যন্ত যাবে কী করে? খলিলের মতো পাঁড় এক মাতালকে নিয়ে হেঁটে যাওয়া যাবে অত দূর? তাই দুলু খলিলকে বলছে ‘এই রাত্তিরবেলা চাকীবাড়িত যায়ে আর কী করবু ব্যাটা? শোনেক খৈল, তার থেন চলেক হাঁটতি হাঁটতি বাড়িত যাই আর গল্প করিগে। কী কইস?’

কথাটা বলেই দুলুর ভয় হচ্ছে। চওড়া পাঞ্জা দিয়ে খলিল আবার তাকে চাটি মেরে না-বসে! রোগাপটকা দুলু তা সামলাতে পারবে না মোটেই।

এই মুহূর্তে উত্তর দিচ্ছে বিমর্ষ খলিল, ‘কী ছাতার গল্প করবু তুই? আমার মতন ফাটাকপালের জীবনে কুনু গল্প থাহে নেকি, তুইই ক? শালার লাইফখেন তো ফাতাফাতাই হয়ে গেল। আর কুলাবের পারতিছিনেরে ভাই!’

তা ঠিকই কইছিস! লাইফ হলে ফুটেফাটা লৌকার মতন, বুঝলু? পানি ওঠতেছে, পানি ওঠতেছে…। যেই পানি ছেঁচপের ভু্ল্লু, ওম্বাই—যাহ্। টুক্কুস করে ডুবে গেল! এভাবে খলিলকে সহমর্মীতা জানাচ্ছে দুলু।

দুলুর কথা শুনে হো-হো করে হাসি লাগিয়েছে খলিল। খলিল তাকে বলছে, ‘মাইনষের লাইফখেন যে ফুটে হয়ে যাওয়া লাওয়ের মতন—এই কথাডা কইল আগে আমি ভাবিই নেই! ভাল কথা কইছিস তুই ব্যাটা!’

মাতাল খলিলকে কথা বলতে দেখে দুলু এবার জলদি প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে ফেলে আসল প্রসঙ্গে ঢুকতে চায়। তাই খলিলকে সে বলছে, ‘কচ্ছিলেম কী, রত্নার ব্যাপারডা লিয়ে তো তোর সাথ কুনু দিন কুনু কথাই হলে না! তার আগেই তো তুই পাবনা ছাড়লু!’

ধাম করে কথাটা বলে ফেলে দুলু একটু অপ্রস্তুত হয়ে যায়। কিন্তু দুলুর কথাতে খলিলের বিন্দুমাত্র অস্বস্তি নেই! বরং সে হাসতে হাসতে বলছে, ‘রত্নার গল্প শুনবু? তা’লি পরে তো চাকীবাড়িত যায়ে আরেক রাউন্ড বাংলা খাওয়াই লাগে!’ এই বলে ফিচ করে একটু হাসছে খলিল। দুষ্টামি ভরা হাসিটা তার হলুদ দাঁতে, অত্যধিক সিগারেটে পুড়ে যাওয়া ঠোঁটে আর নেশাগ্রস্ত লাল চোখে ক্রমশ মেখে যাচ্ছে।

চাকীবাড়ি যাওয়া থেকে এ পাগলকে আটকানোর আর কোনো রাস্তাই আর দুলুর হাতে নেই এখন। অতঃপর খলিলের সাথে লাহিড়ীপাড়ার ভেতর দিয়ে পাথরতলা বরাবর হাঁটা দেয় বেজার হয়ে যাওয়া দুলু। আজ রাতের ঘুমটা ল্যাং খেল আরকি! তবু যদি মাতাল খলিলের কাছ থেকে রত্নার গল্পটা বের করা যায়! তবে ভয়টা এখানে যে দোতরফায় বাংলা খেয়ে আরো বেশি মাতাল হয়ে গেলে পরে খলিল হয়ত একেবারেই আউলে যাবে! এখন হয়ত কেবল উল্টোপাল্টাই বকতে থাকবে খলিল—রত্নার গল্পটা আর জানা হবে না দুলুর!

চাকীবাড়ি যাওয়ার জন্য তারা দু’জন বাণী হলের সামনে দিয়ে লাহিড়ীপাড়ার ভেতরে ঢোকে। বেশ খানিকটা পথ ধীরে ধীরে হেঁটে তারা পৌঁছায় গিয়ে চার রাস্তার মাথায়। বামে সুলতানদের বাসা, ডানে মুকুলদের।

খলিল চুপ। দুলুও মুখ আটকে রেখেছে। দুলুর মনে হচ্ছে, রত্না বিষয়ক আলোচনায় ঢোকার আগে খলিলের মুডটা ঠিকঠাক বোঝা দরকার।

এই মুহূর্তে হঠাৎ করেই নিজের মনেই খ্যাঁ-খ্যাঁ করে হেসে উঠছে খলিল। কী ব্যাপার? খলিল হাসে কেন?

ব্যাপার হ’ল, একবার পটিয়া থেকে চিটাগাং শহরে ফিরছে খলিল আর খলিলের মালিক কুলসির আজিম সওদাগর। তখন রাত বারটা পার হয়ে গেছে। হাটহাজারি পার হতেই খলিলের কারের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে চার জন ডাকাত।

পটিয়া থেকে চিটাগাংয়ের পথে ডাকাত পড়ার গল্পে স্বভাবতই আগ্রহ পাচ্ছে না দুলু। তাই খলিলের ওপরে দুলু রেগে যাচ্ছে এবং সে বলছে, ‘দুর কলা! বন্দ করেক তো তোর ইসব ফতে পড়া কাহিনী! রত্না তোক ভালবাসতে কিনা সিডা ক আগে!’

কিন্তু খলিল দুলুর বিরক্তি গায়েই মাখছে না। উৎসাহী খলিল বলেই চলেছে, ‘আরে ব্যাটা! শোনেকই না আগে…!’

রাস্তার ওপরে ডাকাতগুলো এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে যে গাড়িটাকে বাউচি মেরে ডাকাতদের খপ্পর থেকে বের হয়ে যাওয়ারও কোনো উপায়ই নেই তখন! খলিলের সামনে তাক করা একটা কাটা রাইফেল আর একটা দেশি পিস্তল। কাজেই খলিলকে গাড়ি থামাতেই হয়। খলিলের মালিক আজিম সওদাগরের কাছে সেই মুহূর্তে গুনেগেঁথে মাত্র হাজার দেড়েক টাকা আছে। আর খলিলের মানিব্যাগে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট মাত্র। ডাকাতরা সেগুলো সব হস্তগত করে। আর কিছু? নাহ্! তাদের দু’জনের কাছে আর কিচ্ছু নেই।

খলিল বলেই চলেছে: তারপরই মজার ঘটনাটা ঘটে। ডাকাতরা খলিল আর খলিলের সাহেব আজিম সওদাগরকে গাড়ি থেকে রাস্তায় বের করে দিয়ে তাদের গায়ের কাপড়চোপড় সব খুলে নেয়। আন্ডারওয়্যার পর্যন্ত খুলে নিয়ে যায় শালারা! তখন কি শীত ছিল?…ও হ্যাঁ! শীতের রাতই হবে। তো সেই শীতের রাতে উদোম গায়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকাটা কত কষ্টের হতে পারে তা তো সহজেই বোঝা যায়! তারপর যেন কী হয়েছিল? ও হ্যাঁ! মনে পড়েছে—গাড়ি মোছার ময়লা গামছাটা তখন তার মালিককে পরতে দেয় খলিল আর সে পরে নেয় বনেটে পড়ে থাকা একটা ছেঁড়াফাটা চট। মজার ব্যাপার হ’ল যে মালিক আর লজ্জায় খলিলের চোখের দিকে তাকাচ্ছে না মোটেই। মালিকের দুরাবস্থা দেখে খলিল তো তখন মনে মনে হাসছে খুব! ঠিক হয়েছে! মালিক শালা সোনা স্মাগলিং করে টাকাও বানিয়েছে অনেক! মাটিতে টাকা ছড়িয়ে দিলে পরে দাঁড়িয়ে যাবে টাকার একটা পাহাড়। টাকার সেই পাহাড় চিটাগাং শহরের বাটালি হিলের সমান উচ্চতায় পৌঁছে যেতে পারে! এমনটাই মনে হয় খলিলের।

হাসতে হাসতে গল্পটা শেষ করছে খলিল। কিন্তু দুলুর হাসি আসছে না মোটেই। এমন একটা থার্ড ক্লাস গল্পও মানুষ করতে পারে—এই ভেবে বিরক্ত হচ্ছে দুলু।

খলিল এবার দুলুকে প্রশ্ন করছে, ‘ব্যাটা! তুই কি বাটালি হিল দেহিছিস?’

না, দুলু তো ঢাকা পার দিয়ে উত্তর, দক্ষিণ অথবা পশ্চিমে আর কোথাও যায়ইনি!

ও! তা’লি তুই বাটালি হিল দেখপু ক্যাম্বা করে! একথা বলে আবারো বোকার মতো হাসছে মাতাল খলিল।

খলিলের ওপরে এখন মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে দুলুর, ‘চিটাগাং যায়ে খুব লাম্বার লিচ্ছিস? এইসব বাটালি হিল ফাটালি হিল আমি চিনিওনে, চিনবেরও চাইনে! দুই দিনের বৈরাগী ভাতেক কয় অন্ন!’

দুলুর কথা শুনে খলিলের হাসি আর থামছেই না।

কিন্তু খলিলের গ্যাজগ্যাজানির ঠ্যালায় রত্নার ব্যাপারটা যে চাপা পড়ে যাচ্ছে! তাই এবার অস্থির দুলু সরাসরিই প্রশ্ন করছে খলিলকে, ‘ঠিক করে ক তো, রত্নাক তুই জোর করে তুলে লিয়ে গিছিলু কীকামে? আর তুলেই যুদি লিয়ে গিছিলু তা’লি পরে উয়েক বিয়ে করলু না ক্যা? খায়েদায়ে ছাড়ে দিলু? আমি হলি তো আলবত রত্নাক বিয়ে কইরতেম! এত সোন্দর একখেন মিয়ে! বুঝতিছিনে তোর কাজকারবার!’

পাঁচ-ছয় বচ্ছর পরও ইসব ফায়শা কথাবারতা তুই মনেই রাখিছিস? হা-হা করে হাসতে হাসতে দুলুকে জিজ্ঞাসা করছে খলিল। তবে সে রাগছে না মোটেই।

কোনো উত্তর না-পেয়ে দুলু আবার খলিলকে জিজ্ঞাসা করছে, ‘নেকি রত্নাক তুই ভজাইছিলু? এমন তো হতি পারে যে রত্না আপসেই তোর সাথ ভাগে গিছিলে! ছুরি না-হলি পিস্তল ধরে আসলে লাটকফাটকই করিছিলু তুই? ঠিক করে ক তো ভাই!’

যাও হে! রত্নাক আমি ভজাবের যাব কীকামে? গল্পডা আসলে ত্যাম্বা লয় ব্যাটা! দাঁত বের করে আবারো হাসছে খলিল। কিন্তু সে আর বলছে না কিছু।

লাহিড়ীপাড়া পার হয়ে তারা দু’জনে চুপচাপ হেঁটে যাচ্ছে চারতলা মোড়ের দিকে। হাঁটতে হাঁটতে মাতাল খলিল টাল খাচ্ছে বার বার। দুলুর ভয় লাগছে এই ভেবে যে শালা আবার ড্রেনের ভেতরে পড়ে না-যায়! মাতালদের নিয়ে পথ হাঁটার এটাই বড় অসুবিধা! এই মুহূর্তে দুলু কেবল রত্নার কথাই ভাবছে। রত্নার কথা কী ভোলা যায়? ভোলা যায় তার অপহরণের ঘটনাটা?

পাবনা শহরের গোপালপুর এলাকায় সপরিবারে থাকত রত্নারা। টেলিফোন অফিসের উল্টোদিকে যে কানাগলিটা পুবে ঢুকে গেছে সে গলিটা ধরে আগালে গলিটার শেষমাথার বামে রত্নাদের বাড়ি। ওর বাবা দবির কন্ট্রাকটার নম্র, ভদ্র মানুষ। রত্না তার বাবা-মা’র একমাত্র সন্তান। লম্বা আর পাতলাসাতলা রত্না তখন পাবনা শহরের সবচেয়ে সুন্দর মেয়ে। প্রতিমার মুখের মতো নিখুঁত তার মুখের গড়ন। রাজ্যের ফর্সা ফর্সা সব মেয়েরা শ্যামলা রত্নার পাশে ট্যালট্যালে ঘোল। পনের-ষোল বছর বয়সী রত্নার জন্য তখন হামলে পড়ছে অজস্র উড়ো ফোন, তাদের বাসার সামনে দিয়ে বেড়ে যাচ্ছে চ্যাংড়াপ্যাংড়াদের যাতায়াত, রত্নার জন্য গার্লস স্কুলের পথে মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে তার প্রেমপ্রার্থীরা, রত্নার জন্য রিকশাতে উড়ে আসছে দলা পাকানো ব্যাকুল চিঠি, স্কুলগামী রত্নার রিকশা প্রদক্ষিণ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে অনেক মটরসাইকেল, রত্নাকে কেন্দ্র করে তখন পাড়ায় পাড়ায় তার প্রেমিকদের ভেতরে ঠুকঠাক মারামারিও চলছে।

সে সময়ে অন্য পাড়ার সাথে গোপালপুর যতগুলো মারামারিতে জড়িয়েছিল তার বেশির ভাগই ঘটেছিল রত্নাকে নিয়েই। একবার রত্নাদের পাড়া আক্রমণ করেছিল রাঘবপুরের মিলনরা। রত্নার প্রেমে পড়েছিল মিলন। পাড়ার মানসম্মান বাঁচাতে তখন গোপালপুরের ছেলেরা এক হয়েছিল। মারামারিতে হটে গিয়েছিল রাঘবপুর আর মিলনের ডান হাঁটুতে লেগেছিল বাবুলের পাইপগানের গুলি। সেই মিলন এখনো পা ঘষটে ঘষটে হাঁটে। অথচ রত্না নির্বিকার—এসব কোনো কিছুতেই যেন তার কিছুই যায়-আসে না। প্রতি দিন সকাল ন’টার দিকে গম্ভীর মুখে হুড তুলে সে মাসচুক্তির রিকশায় চেপে বসত এবং সে একা-একাই স্কুলে যেত। আবার বিকাল চারটার পর পর সেই একই রিকশায় করে সে বাসায় ফিরে যেত স্কুল শেষ করে।

সেই রত্নাকে আটুয়ার দুলুরও ভীষণ ভাল লাগত। দুলুর বয়স তখন সতের কি আঠার। লিয়াকত স্কুল থেকে দু’বার ম্যাট্রিক ফেল করে সে তখন বাণী হলের ওপরে সোলেমান দারোগার পানবিড়ির দোকান চালায়। মেয়েটাকে শুধু একচোখ দেখার জন্য তার হেল্পারের হাতে দোকান চালানোর সাময়িক দায়িত্ব দিয়ে সে তখন প্রায়ই দাঁড়িয়ে থেকেছে বাণী হল এলাকায়, বিশেষ করে নিলুর ওয়েলডিংশপের সামনে। মেরুন কামিজ, সাদা সালোয়ার আর সাদা ওড়না পরে রত্না তখন দুলুর সামনে দিয়ে বাণী হলের চারমাথা হয়ে হুডতোলা রিকশায় চেপে গার্লস স্কুলে যেত আবার সে স্কুল থেকে বাসার দিকে ফিরত বিকালবেলায়। এটুকু দেখাই তো আর যথেষ্ট নয়! রত্নাকে দেখার জন্য আরো সুযোগ চাই। ব্যবস্থাও হয়েছিল একটা। সমবায় মার্কেটের একটা লন্ড্রিতে তখন কাজ করত ইলিয়াস। ইলিয়াসের মালিকের বাসা রত্নাদের গলিতেই। রত্নাকে দেখার জন্য ইলিয়াসকে বাগিয়ে দুলু প্রায়ই ইলিয়াসকে নিয়ে চলে যেত সেখানে। মালিকের বাসায় যাওয়ার জন্য স্বভাবতই ছুঁতোনাতা খুঁজতে হ’ত ইলিয়াসকে। তাই ইলিয়াসকে লাইনে আনতে কম পয়সাপাতি ঘুষ দিতে হয়নি দুলুকে—আজ সিঙ্গারা, কাল সন্দেশ, পরশু সিনেমার টিকেট, তরশু নগদ টাকা। ছোকরাটা কোনো দিন মাগ্না-মাগ্না কাজ করে দেয়নি! রত্নাকে একটু দেখার জন্যই তো এত অর্থ মাশুল দিয়েছিল দুলু! চোখের দেখা ছাড়া পানবিড়ির এক জন দোকানদার আর কত দূরই বা আগানোর সাহস করতে পারত? রত্নাকে দেখার জন্য দোকান ফেলে বন্ধুদের নিয়ে মোড়ে-মোড়ে জাল পেতে বসে থাকার সময় কোনো দিনই হয়নি দুলুর। রত্নাদের প্রতিবেশী মনোয়ার স্যারের বাসায় আর সবার মতো ইন্টারমিডিয়েট পর্বের বাংলা পড়তে যাওয়ার অভিযানেও যোগ দেয়া হয়নি তার। দু’বার ম্যাট্রিক ফেল করার পর সে তো আর পড়াশুনাই করেনি!

এক দিন সেই রত্নাকে কিনা ছুরি দেখিয়ে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে গেল খলিল নামের বাণী হলের সামান্য এক জন লাইটম্যান! নায়কোচিত চেহারাও ছিল না খলিলের যে রত্না তার প্রেমে পড়বে! খলিল বেশ বেটে, মোটা, তার গায়ের রঙ পাতিলের তলার মতো মিশমিশে কালো, নাক চওড়া, গোলগোল দু’টো চোখ—এইতো! রত্নার ওপরে যে খলিলেরও টার্গেট ছিল, শহরের তরুণ আর যুবকেরা কেউই আগেভাগে একটুকুও তা বুঝতে পারেনি! খলিল এমনই ঘোরচালু সলুই ইঁদুর, এমনই ডুবো সাবমেরিন—সামান্য একটু নাক জাগিয়ে সে চলেছে। তার মতলবখানা তাই ধরতেই পারেনি কেউ!

এই মুহূর্তে দুলুর মনে পড়ছে, লিয়াকত স্কুল থেকে ক্লাস সেভেন ফেল করার পর খলিল আর পড়াশুনা করার সুযোগই পায়নি। খলিলের ‌আব্বা—লাইব্রেরি বাজারে শাকসব্জির বিক্রেতা—ততদিনে হাপের রোগে আক্রান্ত হয়েছে এবং কমে গেছে তার কর্মশক্তি। তাই পরিবারের সামান্য কিছু ধানীজমিও বেচতে বেচতে প্রায় শেষ হয়ে গেছে তখন। খলিলদের ভিটেটাও পড়ে আছে বন্ধকে। পড়াশুনা বন্ধ হয়ে গেলে পর তাই নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য সাধুপাড়ার মাস্তানদের সাথে চলাফেরা শুরু করেছিল খলিল, দল বেঁধে লাইব্রেরি বাজারের দোকানগুলো থেকে চাঁদা তুলে খাচ্ছিল, প্রভাব বিস্তারের জন্য সে মারামারি করছিল বিভিন্ন গ্রুপের সাথে। মারামারির সময় তার হাতে শোভা পেত কাটা রাইফেল অথবা ভোজালি। একবার হাউসপাড়ার ছেলেদের হাতে ডান পা’র উড়ুতে টাঙ্গির কোপ খেলে খলিলকে সদর হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল। হাসপাতাল আর বাসা মিলিয়ে তখন তাকে পড়ে থাকতে হয়েছিল প্রায় মাস ছয়েক। সুস্থ হওয়ার পর সে মারামারি ছেড়ে দিয়েছিল অবশ্য। তারপর বাণী হলের লাইটম্যানের কাজ নেয়ার আগে কিছু দিন খলিল গাড়ি মেরামতের কাজ শিখেছিল বরকতের গ্যারেজে।

সেই পাঁচ বছর আগে খলিলের চাইতেও বহুত বড় বড় মাস্তানদের নজর ছিল রত্নার ওপর। তারা কেউই সাহস পেল না মেয়েটাকে জোর করে তুলে নিয়ে যেতে। তাদের সবাইকে ডাউন দিয়ে রত্নাকে হাইজ্যাক করল কিনা সাধুপাড়ার খলিল! রত্নার আর সব প্রেমিকের মতো দুলুও সে সময় ঈর্ষা করেছে খলিলকে, এখনো করে। খলিল রত্নাকে হাইজ্যাক না-করলে হয়ত কোনো দিন দুলু রত্নার সাথে সামনাসামনি কথাটথা বলার সুযোগ করে নিতে পারত, নিউমার্কেটের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করতে করতে সে আর রত্না আইসক্রিম খেতে পারত কোনো না কোনো দিন। সেসব সম্ভাবনা নষ্ট করেছে খলিল। নয় কি? কাজেই খলিলের ওপর থেকে দুলুর মেজাজ খারপটা আসলে চলে যায়নি।

হাইজ্যাক হয়ে যাওয়ার দিন পনের পর কীভাবে যেন বাড়িতে ফিরে এসেছিল ফেরদৌসি বেগম রত্না! তারপর নাকি সে থানায় ফোন করে বলেছিল, খলিল নামের এক জন ক্রিমিনাল তাকে হাইজ্যাক করে নিয়ে গিয়ে আটকে রেখেছিল বাঁশের বাদা এলাকায়। পাবনা টাউন থেকে খুব একটা দূরে নয় জায়গাটা। রত্না পুলিশকে আরো বলেছিল, খলিল নামের ক্রিমিনালটা এখনো সেই ঠিকানাতেই আছে।

তারপর রত্নার অভিযোগের প্রেক্ষিতে পুলিশ ফোর্স বাঁশের বাদা গিয়ে দেখে, কোনো এক পুকুরে ছিপ ফেলে মাছ ধরছে খলিল। পুলিশের সোর্স চিনিয়ে দিয়েছিল খলিলকে। পুলিশকে আসতে দেখে খলিল নাকি ধানক্ষেতের ভেতর দিয়ে একদৌড় দিয়েছিল। খাকিরা ছুটেছিল তার পিছু পিছু। অল্প সময়ের ভেতরেই পুলিশের হাতে ধরা পড়ে গিয়েছিল খলিল। পরে পুলিশরা অনানুষ্ঠানিকভাবে মন্তব্য করেছিল যে খলিল দৌড়ে ভাল ছিল না মোটেই! তাই খুব সহজেই ধরা পড়েছিল সে। ছেলেটা কোনো প্রাইজ-ট্রাইজ পায়নি স্কুলজীবনে অথবা পাড়ার ক্রীড়া প্রতিযোগিতায়—সেটা স্পষ্ট হয়েছিল। পরে দুলু এসব শুনেছিল তার নিজের খাতিরের এক জন কনস্টেবলের কাছ থেকে।

খলিলকে বেশি দিন পুলিশ ধরে রাখতে পারেনি অবশ্য। পুলিশের কাস্টডিতে চার দিন থাকা আর এমনকি! শোনা যায়, রত্নার বাবা দবির কন্ট্রাকটার নাকি থানায় গিয়ে সাব ইন্সপেক্টরকে বলেছিল: তিনি এ শহরের এক জন সম্মানীয় মানুষ, তার মেয়ের কেসটা নিয়ে আর আগালে তার ভাবমূর্তী নষ্ট হবে। রত্নার বাবার সাথে থানায় গিয়েছিল কুঠিপাড়ার বাসমালিক তালেব মিয়ার ছোট ছেলে—সে সময়কার মারদাঙ্গা ছাত্রনেতা বিল্লাহ। বিল্লাহর সামনেই জেরা করা হয়েছিল খলিলকে। জেরাতে বোঝা গিয়েছিল যে অপহরণ জাতীয় কোনো ঘটনাই আসলে ঘটেনি। সে দিন বাঁশের বাদায় জনৈক বন্ধুর বাসায় বেড়াতে গিয়েছিল খলিল। রত্না নামের কোনো মেয়েকে সে চেনেই না! পুলিশ দেখে ভয় পেয়ে ধানক্ষেতের ভেতর দিয়ে দৌড় দিয়েছিল সে। স্বভাবতই তখন প্রশ্ন উঠেছিল: তবে ফেরদৌসি বেগম রত্না থানায় ফোন করেছিল কেন! রত্নার বাবা রত্নার হয়ে যুক্তি দিয়েছিল তখন: রত্না তাদের এক আত্মীয়ের বাসাতে বেড়িয়ে বাঁশের বাদা থেকে সবে ফিরেছে। ফোনে পুলিশের সাথে রত্না মজা করেছে মাত্র! আর মেয়েটার বয়সটাও তো দেখতে হবে! তার সার্টিফিকেট এজ মাত্র ষোল। পাবনা মহিলা কলেজে কেবল ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছে মেয়েটা! কুঠিপাড়ার বিল্লাহও সায় দিয়েছিল রত্নার বাবার যুক্তিতে। সাব ইন্সপেক্টর তখন মন্তব্য করেছিল যে ব্যাপারটা তেমন সিরিয়াস কিছু না-হলেও পুলিশের সাথে এভাবে ইয়ার্কি মারাটা কারো ঠিক নয়। রত্নার বাবার উচিত এ ব্যাপারে রত্নাকে সাবধান করে দেয়া। রত্নার বাবা তখন সাগ্রহে সাব ইন্সপেক্টরের পরামর্শ মেনে নিয়েছিল। এভাবেই ডিসমিস হয়ে গিয়েছিল ফেরদৌসি বেগম রত্নার অপহরণের কেসটা।

পুলিশের কাস্টডি থেকে মুক্তি পাওয়ার পরদিন থেকেই খলিল নিরুদ্দেশ হয়েছিল। তার প্রায় এক বছর পর গোবিন্দার আনিসের কাছে জানা গিয়েছিল, চট্টগ্রাম শহরের দামপাড়ায় খলিলের সাথে তার দেখা হয়েছিল হঠাৎ করেই। খলিল তখন লালখান বাজারের এক বাসার ড্রাইভার। বছর তিনেক আগে বাবার লাশ দাফনের জন্য খলিল একবার বাড়ি এসেছিল বটে। পাবনা ছাড়ার পর সেই প্রথম তার বাড়িতে আসা! সে যাত্রায় খলিল পাবনা শহরে থেকেছিল মাত্র তিন দিন। সে তখন কারো সাথেই দেখা করেনি। খলিলদের সাধুপাড়ার বাসায় দুলু দু’বার গিয়েছিল তার খোঁজে। প্রথমবারে গভীর ঘুমে ছিল খলিল। তাই তার সাথে দুলুর আর দেখা হয়নি। আর দ্বিতীয়বারে যখন দুলু তার বাড়িতে গিয়েছিল ততক্ষণে খলিল রওনা দিয়ে দিয়েছিল ঢাকার উদ্দেশ্যে। বাবার মৃত্যুর পর অবশ্য খলিল আর পাবনায় আসেনি।

লাহিড়ীপাড়া থেকে পুবদিকে এগিয়ে দুলু আর খলিল এখন পৌঁছেছে চারতলার মোড়ে। মোড় থেকে হাতের ডানে কাটছে তারা। এ রাস্তা ধরে সোজা হেঁটে গেলে পাথরতলা মোড়। মোড়ের বামের রাস্তায় পড়বে চাকীবাড়ি। চাকীবাড়ি পর্যন্ত যেতে পথ এখনো অর্ধেক মতো বাকি আছে। কিন্তু পাথরতলার দিকে একটু হেঁটেই দাঁড়িয়ে গেছে খলিল। দুলুকে সে বলছে, ‘ব্যাটা! আর হাইটপের পারতিছিনে! পা’ডা ক্যাম্বা যিন বিষবিষ করতেছে! খাইনটেক জিরা লেই, কী কইস?’ এই বলে দুলুর মতের অপেক্ষা না-করেই হাজির সিমেন্টের দোকানের নিচু সিঁড়িতে বসে পড়েছে খলিল।

এই মুহূর্তে ঝাঁঝিয়ে উঠছে দুলু, ‘আবারো ভেজাল লাগালু তুই? টাইম লষ্ট করতিছিস কীকামে? বাড়িত ফিরা লাগবি না? চাকীবাড়িত যাবু, দারু খাবু, তারপর উঠপু। কয় ঘন্টা লাগবি তোর তা আল্লাই জানে!’

আরে, বাড়িতই তো যাবু! জুলিখা বিবি না-হয় ইছুপ সাবের জন্যি আর খাইনটেক রাইত জাগে বসেই রলে!

খলিলের চোখেমুখে চিকচিক করছে কৌতুক। আদিরসাত্মক ইঙ্গিতের পরে সে দুলুর কাছে একটা সিগারেট দাবি করছে, ‘এ দুলু! সিগারেট দে না একখেন, খাই!’

এখন আরেক তরফা খটখটে হয়ে যাচ্ছে দুলুর মেজাজ। তোয়াজ ভুলে গিয়ে শ্লেষের তাড়ায় সে খলিলকে বলছে, ‘মাল খায়ে লোড হলি কি হবি, শালা তুমার তাল কইল ঠিকই রয়ছে! ইট্টু পর পরই যে খুব আমার থেন সিগারেট চাচ্ছিস, প্যাকেট ধরে সিগারেট কিনে লিয়ে আসপের পারলু না তুই?’

রাগিস কীকামে? পাথরতলার পর কুনু দুকান খুলাও থাইকপের পারে। তখুন আমিই সিগারেট কেনবনে, যা শালা! তালি পরে হবিনি তোর? হাসতে হাসতেই কথাটা বলছে খলিল। কিন্তু হঠাৎ করেই সে দুলুর ওপর রেগেও যাচ্ছে, ‘যাহ্! শালার কিপটেচুদা! তোক আইজ যুদি এক প্যাকেট ব্যানসন কিনে না-দিছি তো আমি মাইনষেরই পয়দাই লয়! চট্টগ্রাম শহরের আজিম সওদাগরের ডিরাইভার আমি! আমার একখেন পেসটিজ আছে, বুঝলু?’

আর দুলু ভাবছে, খলিল তো আচ্ছা হুজ্জুতি লাগাল! এ‌ই শালার মাতালটাতালদের সাথে স্বাভাবিক মানুষদের আসলে চলাফেরা করাই উচিত নয়! রত্নার গল্প শোনার লোভে খলিলের সাথে জুটে ভুলই হয়েছে আসলে! রত্নাকে নিয়ে গল্প তো হচ্ছেই না, মাঝখান থেকে তাকে সহ্য করতে হচ্ছে খলিলের সব আজগুবি কাজকারবার!

‘লে শালা, খা!’—বলে গজগজ করতে করতে দুলু তার পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা স্টার সিগারেট বের করে খলিলকে দিয়েছে। সেই সাথে সে খলিলকে স্পষ্ট করে বলছে: তবে এই শেষ! রত্নার গল্প না-বল্লে খলিলকে আর একটাও সিগারেট দেবে না সে! কোনোমতেই না!

মেজাজ চাঙে উঠলেও কিন্তু খলিলের ওপরে খুব একটা গরম নিতে পারছে না দুলু। খলিল বিগড়ে গেলে মাঠে মারা যাবে সব—রত্নার গল্পটা আর জানা হবে না তার! ক’মিনিট পরেই নরম গলায় সে খলিলকে জিজ্ঞাসা করছে, ‘রত্নাক যে এদ্দিন আটকা রাখিছিলু, উয়ের সাথ কিছু করিস নেই তুই? ক না ক্যা ভাই?’

দুরো! খালি ফালতু কথা। কহুন থেন ‘রত্না! রত্না!’ করে এক প্যাচাল লাগা দিছিস তুই! শালার কানের মধ্যি ধাপা লাগে গেল এহেবারে! কব না, যা। দুলুর এত আকুতির পরো খলিল বিরক্তিতে ক্যা-ক্যা করে উঠছে।।

দুলুও রাগে কামান ফাটাচ্ছে, ‘শালার বজ্জাত! রত্নার কথা কলি পরে কি তুমার মুখি চুন লাগবিনি নেকি? ঠিকই তো মিয়েডাক তুলে লিয়ে যায়ে দুই সপ্তা আটকা রাখে মজমা করিছিস! সেকথা কতি এখুন লজ্জা লাগতেছে নেকিরে তোর?’

কিন্তু খলিল সেই প্রশ্নের কোনো উত্তর দিচ্ছে না। হাজি’র সিমেন্টের দোকানের সিঁড়িতে বসে সে মাথা নিচু করে বসে আছে। তার পাশে রাজ্যের অস্থিরতা নিয়ে বসে উসখুস করছে দুলু।

তারপর দু’বন্ধু চাকীবাড়ি অভিমুখে হাঁটা দিচ্ছে আবারো। আবারো আধো অন্ধকারে পাথরতলার দিকে ঢুগুরঢুগুর করে হাঁটছে নেশাগ্রস্ত খলিল। তার পাশে দুলু হাঁটা মারছে চুপচাপ।

দপদপ করে জ্বলছে, নিভছে পৌরসভার স্ট্রিট লাইটগুলো। দুলু তাই খলিলকে সাবধান করে দিচ্ছে, ‘এদিককার রাস্তার খুয়ামুয়া উঠে সব শ্যাষ! তুই তো মেলা দিন আসিসনে এদিক। খেয়াল করে হাঁটিস কইল! না-হলি পরে আবার উল্টে পড়ে যাবুনি!’

চারতলা থেকে দক্ষিণে পাথরতলার রাস্তাটায় মানুষজন কেউ নেই, কোনো মাতালও নয়। একটু আগালে দেখা যায়, গোটা পাঁচেক রিকশা চেইন দিয়ে বাঁধা আছে একটা লাইটপোস্টের সাথে। লাইটপোস্টের পাশে দাঁড়িয়ে দুলু আর খলিলের দিকে সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে একটা ঘেয়ো কুকুর। বলা-নেই-কওয়া-নেই, টলোমলো পায়ে দৌড়ে গিয়ে কুকুরটার পেটে সরোষে একটা লাথি বসিয়ে দেয় খলিল। ফিরে এসে দুলুকে সে বলছে, ‘রত্নার সাথ কিচ্ছু করি নেই ব্যাটা! আল্লাহর কিড়ে! রত্নাক আমি ছুঁয়েও দেখি নেই!’

তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কোমরে হাত রেখে দুলু বলছে, ‘বিশ্বেস করলেম না, যাহ্! এমন একখেন খাইখাই মাল ছুরি ধরে তুলে লিয়ে যায়ে তুই তাক একবারো লাগাইস নেই? ক্যা, কুঠিপাড়ার চামেলি, গোবিন্দার আয়শা, তারপর কিষ্টুপুরের…কি যিন নাম ছিলে মিয়েডার–তারে কাউক তুই না-লাগা ছাড়িছিলু?’

বিশ্বেস না-করলি পরে কী আর করা যাবি! এটুকু বলেই খলিল থেমে গেছে। একটু যেন মুষড়েই পড়েছে সে। কিন্তু তা পাত্তা দিচ্ছে না দুলু। তার গলায় বজবজে শ্লেষ, ‘কী আর করবু! বসেবসে বোগল বাজা এহুন!’

দুলু ভাবছে, রত্নাকে কলে ফেলে হাইজ্যাক করে নিয়ে গিয়ে তোর এত ডাঁট? পেটের ভেতরে আটকে রাখা কথাগুলো বের করতে পছন্দ হচ্ছে না এখন? না-হয় তুই রত্নার মতো সুন্দরীকে দু’সপ্তাহ ধরে খেয়েছিলি কিন্তু তাই বলে কি এত ভাব নিতে হবে তোকে? আর দুলু কি তখন একেবারেই গাব ছিল নাকি? সেও কি পাবনা শহরের কম মেয়ে হুকায়নি? রত্নার মতো জান খারাপ করা সুন্দরী না হলেও স্বপ্না, লাকি, বুলবুলি—এরা কি একেবারে ধরধরে লড়লড়ে ছিল? তাদেরকে তো আর ছুরি বা পিস্তল দেখিয়ে তুলে নিয়ে যেতে হয়নি দুলুকে! এমন যদি হ’ত যে রত্না আপসে ভেগে গিয়েছিল খলিলের সাথে তা’হলে খলিলের এ ধরনের ডাঁট নেয়াটা মানাত! ওমন করে পিস্তল ধরে মেয়ে তুলে নিয়ে গিয়ে লাগানোটা সহজ কাজ নয় তো কী?

চাকীবাড়ির গেটটা খোলাই ছিল। গেট দিয়ে ঢুকে একটা চত্বর পার হলে নিচতলায় শুঁড়িখানা। সেখানে বসে বাংলা মদ টানছে কেবলমাত্র মাঝবয়সী এক জন খদ্দের। শুঁড়িখানার পরিচারক সুরেশ নামের ছোকরাটা ক্যাশ কাউন্টারের চেয়ারে বসে বসে ঝিমাচ্ছে। ঘুমের ঝুলে হেলে পড়ছে তার মাথা। সুরেশকে জাগাতে তাই সুরেশের মাথায় আঙুল দিয়ে আস্তে একটা গুঁতো দেয় খলিল। খলিলের মুখের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে সুরেশের বিরক্তি ভরা দৃষ্টি। সুরেশ উচ্চ কন্ঠে তাকে বলে, ‘আবারো আইসলে তুমি? নাহ্ বাফু! তুমারে তান্নায় তো আর ঘুমানে যাবি না দেহা যায়!’

সুরেশের ওপরে ঝাল ঝারতে ছাড়ছে না খলিল। সেও খেঁকিয়ে উঠছে সমান তালে, ‘এই শালা! চাকীরা কি তোক বসে বসে ঘুমানের জন্যি এখেনে রাখেছে?’

তারপর সেগুনকাঠের একটা টেবিলে সামনাসামনি বসে পড়ে খলিল আর দুলু। বাংলা মদের একটা পেট মোটা বোতল আর মোটে কাঁচের দু’টো সবুজাভ গ্লাস টেবিলে রেখে যায় সুরেশ। জড়ানো গলায় খলিল সুরেশকে ঝারি দেয়, ‘টিন কাটা মাল দিছিস তো? পুরেন মাল হলি কিন্তু আমি খাবনানে!’

খলিলের ঝারিবাজি পাত্তা দিচ্ছে না সুরশে। তাই সুরেশকে শাঁসাচ্ছে খলিল: শোনেক শালা! বেশি তেরিবেরি করলি পরে এক ঠাপে তুমাক মাতপুর পাঠা দেবনে! বুঝবেনে তহুন! হালটের পর একখেন গরুর গাড়িও খুঁজে পাবেনানে অদ্দুর থেন পাবনা টাউনি ফিরে আসার জন্যি!’

লেও, এহুন গলা পয্যন্ত মদ খাও! বেশি লেকচার মারে না আর! রাইত কইল মেলা হয়ছে! খলিলকে একথা বলে ক্যাশ কাউন্টারের দিকে হাঁটা দেয় সুরেশ।

প্রস্থানরত সুরেশের দিকে আঙুল নাচিয়ে খলিল বলছে, ‘জরুর লেকচার মারেগা, কামিনে! বায়ঠে বায়ঠে ঘুমানেকে লিয়ে তুমকো ইঁহা পার ম্যায় রাখ‌্খা হায়, না?’

ভালই তো হিন্দি ডায়লগ মারলু! কোন ফিলিমেররে? দুলু হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করছে খলিলকে।

সুরেশের ওপরে তীব্র রোষের কারণে সেকথা শুনতে পায় না খলিল। সুরেশকে পেটানোর জন্য এই মুহূর্তে চেয়ার থেকে সে উঠে দাঁড়িয়েছে খলিল। তবে হাত ধরে টেনে খলিলকে ফের চেয়ারে বসিয়ে দিয়েছে দুলু। কিন্তু খলিলের শাসানি থামছে না, ‘শালা সুরেশের বাচ্চা সুরেশ! আমার পর নাম্বার লিচ্ছেও খুব? খাড়াও! কঞ্চি দিয়ে বাড়ে তুমাক ফিলাট বানা দেবনে!’ সুরেশের কানে খলিলের সেই আস্ফালন ঢুকেছে বলে মনে হয় না দুলুর কেননা ক্যাশের চেয়ারে ফিরে গিয়ে অনেক আগেই ঘুমে ঢলে গেছে সুরেশ।

এই মুহূর্তে খলিলের গ্লাসটা বাংলা মদ দিয়ে পুরোই ভর্তি। দুলু তার নিজের গ্লাসে মদ নিয়েছে সামান্যই। দুলু আশঙ্কা করছে যে অবেলায় মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরলে তার বউ তাকে মেরে তক্তা বানিয়ে ফেলবে! এই মেয়েটা মদের গন্ধ একেবারেই সহ্যই করতে পারে না! জর্দা দেয়া পান খেয়ে বাসায় ঢুকলেও তার বউ ঠিকই মদের গন্ধ পেয়ে যায়! তখন কেরোসিনের চুলা ধরিয়ে খাবার গরম করে দেবে না কেউ, আদর-সোহাগ তো দূরের কথা!

প্রথমেই ঢকঢক করে আধা গ্লাস গলায় নামিয়ে নিচ্ছে খলিল। দুলু তার নিজের গ্লাসে ছোট ছোট চুমুক দিচ্ছে মাত্র। মাতাল হওয়া চলবে না তাকে। খলিলকে খুঁচিয়ে আজকে তাকে জানতেই হবে রত্নার কথাগুলো। তাই বন্ধুর দিকে সিগারেট বাড়িয়ে দিয়ে আবারো জিজ্ঞাসা করছে দুলু, ‘আচ্ছা খৈল! তুই কচ্ছিস যে রত্নাক উঠা লিয়ে যায়ে তুই মেয়েডাক একখেন চুমে পয্যন্তও খাইস নেই। তুই মিয়েডাক জোর করে বিয়েও করলু না! তা’লি পরে তুই মিয়িডাক তুলে লিয়ে গেলু কীকামে? আমি তো ভাই তোর ভাবগতিক বুইঝবেরই পারতিছিনে!’

দুলুরে! আমি লিজেই তা বুঝিনে! তার আর তুই বুঝবু কী!

আবারো মারেফতি কথা শুরু করলু?

সেই অভিযোগ খলিল শুনতে পায় কি পায় না তা বুঝতে পারছে না দুলু। গ্লাসের বাকি মদটুকু একবারে খেয়ে নিয়ে টেবিলের ওপরে খলিল ঠকাস করে রাখছে গ্লাসটা।

তারপর খলিল দুলুকে বলে, ‘কী যিন কচ্ছিলেম?…ও! মনে পড়েছে। রত্নাক লিয়ে সে যাত্তারা গিরামে-গিরামে খুব ঘুরা লাগিছিল।’

খলিলের গল্পটা এমন: পয়লা রত্নাকে নিয়ে সে পাবনা টাউনের অদূরের হিমায়েতপুরে পরিচিত একজনের বাসায় গিয়েছিল। ঐদিকে খলিল খবর পেয়েছিল যে পুলিশ তাকে হারিকেন লাগিয়ে খুঁজছে। বার বার জায়গা না পাল্টালে আর উপায় কী? কাজেই হিমায়েতপুর থেকে আরেক সূত্রে চর ঘোষপুর, তারপর শেষে বাঁশের বাদায় গিয়ে সে উপস্থিত হয়েছিল রত্নাকে নিয়ে। বাঁশের বাদায় গিয়ে খলিল চরম বিপদে পড়েছিল। যে বাড়িতে তারা লুকিয়েছিল সে বাসার মানুষেরা তরকারিতে প্রচণ্ড ঝাল দিত। রত্না শহুরে মেয়ে বলে সে তো আর ওত ঝাল খেতে পারে না! ঝাল খেতে অভ্যস্ত খলিলের চোখ বেয়েই পানি গড়িয়ে পড়ত। এমন করে দু’দিন প্রায়-অভুক্ত থাকার পর মেয়েটা খলিলকে ডেকে পাউরুটি, মাখন আর নসিলা কিনে আনতে বলেছিল। বাঁশের বাদার মতো অজ পাড়াগাঁয়ে ঐসব মাল কি আর কিনতে পাওয়া যায় নাকি! মুড়ি, খাগরাই, তিলেমটকা আর বিস্কুট বাদে গ্রামের দিকে আর কিছুই খুঁজে পাওয়া যায় না! খলিল তো পুলিশের ওয়ারেন্ট খেয়ে বসে আছে! কাজেই রত্নার ফরমাশ মতো খাবার জিনিস কিনতে সে আর পাবনা টাউনেও যেতে পারছে না। উপায়ন্তর না-দেখে বহুত সাধ্যিসাধনা করে আশ্রয়দানকারীর বাসার এক ছেলেকে খলিল রাজি করিয়েছিল পাবনা টাউনে যাওয়ার জন্য। সেই ছেলেটা এমনই ধলতা কিসিমের যে দোকানে গিয়ে সে আর নসিলা শব্দটা মনে করতে পারেনি কিছুতেই। তাই কেবল পাউরুটি আর মাখন কিনে সাইকেল চালিয়ে বাঁশের বাদায় ছেলেটা ফিরে এসেছিল। কিন্তু ততক্ষণে বাজারের ব্যাগের ভেতরে মাখন গলে শেষ! কী আর করা! দুধের মধ্যে চিনি গুলিয়ে নিয়ে পাউরুটি খেল রত্না।

বাজারের ব্যাগের ভেতরে মাখন গলে পড়ে যাচ্ছে—এমন একটা দৃশ্য ভেবে এদিকে দুলুর ভীষণ হাসি পেয়ে গেছে। হাসতে হাসতেই সে খলিলকে জিজ্ঞাসা করছে, ‘আর রত্নার কাপুড়চুপুড়ের ব্যবস্থা কী করিছিলু?’

সিডা শাঁইয়ের আরেক তাফালিং! আমার মা’র হাতেপায়ে ধরে তিনডে পুরেন শাড়ি, দু’ডে ছায়া আর দু’ডে বিলাউজ লিলেম; কলেম, পরে কিনে দেবনে। ঐসব মুটা কাপুড় কী ভদ্দরলোকের মিয়েরা আবার পইরবের পারে নেকি? তা বাদে রত্না আবার সালোয়ার-কামিজ ছাড়া আর কিছু পইরবের পারে না! সালোয়ার-কামিজ আমি পাব কোনে? তো রত্না শেষে মুখ ব্যাজার করে তার গায়ের সালোয়ার-কামিজখেন আর আমার মা’র শাড়িগুলি অদলবদল করে পরলে।

কথার ফাঁকে ফাঁকে আরো এক গ্লাস বাংলা মদ মেরে দেয় খলিল। তারপর সে দুলুকে বলে, ‘নিশাডা ইবার কইল জমে ওঠতেছে! আচ্ছা ব্যাটা, আমি কি খুব বেশি কথা কচ্ছি?’

কথা আর বেশি কচ্ছিস কোনে? রত্না’ক ক্যাম্বা করে লাগাইছিলু তা’তো কলুই না এহুন পর্যন্ত! অনুযোগ জানাচ্ছে দুলু।

হবিনি! হবিনি! সব কথাই হবিনি! দিন কি আর চলে যাচ্ছেরে পাগল? তা ব্যাটা ইবার তুমার কথা কিছু কও। তুমার সুংসার ক্যাম্বা চলতেছে? দুলুকে প্রশ্ন করছে খলিল।

এত ক্ষণ পর খলিলের গল্প গিয়ারে উঠছে। কিন্তু এর ভেতরে আবার অন্য বিষয় নিয়ে আলাপ তোলা কেন? মদের ঘোর বাড়লে খলিল যদি আর রত্নার গল্পে ফিরে নাইই যায়? তবে? তাই শঙ্কিত হয়ে উঠছে দুলু। কিন্তু খলিল দুলুর খবরসবর নিয়ে আলাপ করবেই। ওর ঘ্যানরঘ্যানরের মুখে তাই নিজের সংসার নিয়ে দু’টো কথা বলতেই হয় দুলুকে।

দুলু বলছে, আর সুংসার! লাল সুতা বের হয়ে যাচ্ছে একেবারে! সোলেমান দারোগার দোকান থেকে দুলু বেতন পায় মাত্র চার হাজার টাকা। এদিকে চুরি-চামারির সুযোগ অল্পস্বল্প কেননা সোলেমান দারোগা আবার প্রতি সপ্তাহে দোকানের মালের হিসাব আর টাকার হিসাব চেক করে। বেতনের এই ক’টা টাকা দিয়ে কি আর সংসার চলতে পারে নাকি! তিন-তিনটা গ্যাদাপ্যাদা নিয়ে তার ঢাউস সংসার। এ যন্ত্রণা আর ভাল লাগে না দুলুর! খলিলের মতো করে ড্রাইভারিটা শিখলেও কাজ হ’ত। হয় দুবাই না-হয় সৌদি আরবে চলে যেতে পারত দুলু, ঢাকা বা চট্টগ্রামেও খুঁজে নিতে পারত ভাল কোনো কাজ। সেটা তো আর হচ্ছে না! অথচ ঢিকিয়েঢিকিয়ে চলতে গেলেও অনেক টাকা দরকার। ভাগ্যি ভাল যে দুলু তার পরিবার নিয়ে এখনো তার বাবা-মা’র সংসারে থাকতে পারছে আর তা’তে করে তাকে অন্তত বাড়িভাড়াটা দিতে হচ্ছে না।

খলিলের মুখটাও বিষণ্ন হয়ে উঠছে দুলুর অভাবের বৃত্তান্ত শুনে। খলিল দুলুকে বলছে, ‘মন খারাপ করিসনেরে ভাই! আল্লাহ চাহে তো সবকিছু ঠিক হয়ে যাবিনি। যে শালারা খুব ঝামেলা করতেছে, সবটিক কুপা ভাঁজ করে ফেলাবনে ইবার! আমিও রেডি হয়ে আইছি এ যাত্তারা। এহুনো এক ডাক দিলি পরে পাবনা টাউনির একশ ছাওয়াল দেন আন দেন আসে আমার পাশে দাঁড়াবিনি। শালা খানকীর ছাওয়াল! আমার জীবনডা পুড়া একেবারে ঝামা বানা ফেলাইলে!’

খলিলের কথাবার্তায় ফের সন্দেহ জাগছে দুলুর। কার ওপরে এত ঝাল ঝারছে খলিল? দুলু ভাবছে, খলিলকে এবার সরাসরি প্রশ্নটা করা দরকার। প্রশ্ন তো বেশ ক’টাই সে করল খলিলকে! কিন্তু নেশার চোটে ভাল করে কিছুই উত্তর দিতে পারছে না খলিল।

অনেক আগেই পুলিশ লাইনে রাত দু’টোর ঘন্টা বেজেছে। কাল সকালেই তো আবার শুরু হবে পানবিড়ির দোকানের নিত্যিকার ডিউটি! তাই দুলু তার বন্ধুকে মদ্যপানপর্ব শেষ করার জন্য তাড়া দিচ্ছে—মেলা রাত হয়ছে ব্যাটা! ওঠেক এহুন।

খলিলের ঐ এককথা, রিকশা ছাড়া এককদমও নড়বে না সে। কিন্তু চাকীবাড়ি থেকে বেরিয়ে দেখা যায়, সামনের রাস্তায় কিম্বা পাথরতলার মোড়ে একটাও রিকশা নেই।

মেজাজ টঙে উঠে যায় দুলুর। তাই এখন সে খলিলের ওপরে তার বিরক্তি ঝারছে, ‘এই দেহেক! রিকশাটিকশার কুনু চিহ্নই চোখে পড়তেছে না! তহুনই তোক কলেম, সাইকলডা থুয়ে আসার কাম নেই! তুই শুনলুই না! বেশ হয়ছে! মোড়ের পর বসেবসে এহুন খেঁচগা তুমি!’

ভুলই হয়ছেরে ব্যাটা! তোর সাইকলখেন লিয়ে আসা লাইগতে! তা’লি ইট্টু বসি। ইদিক যদি কুনু রিকশা আসে! এই বলে পাথরতলা মোড়ের একটা তালাবন্ধ মুদিদোকানের সিঁড়ির ওপরে বসে পড়েছে খলিল। দো’তরফায় বাংলা টানার পর তার নেশাটা এমনই চাগা দিয়েছে যে সে আর দাঁড়িয়েই থাকতে পারছে না।

পাথরতলা মোড়ের চারপাশের বাড়িগুলোতে এই গভীর রাতে কেউই জেগে নেই। নিস্তব্ধতার ভেতরে পাক খাচ্ছে কোনো এক বাসার ফ্যানের আর্তনাদ—ঘরঘর, ঘরঘর…। খুবই বিরক্তিকর সে আওয়াজটা! রাস্তার ওপরে পড়ে আছে দুর্বল স্ট্রিটলাইটের নিভুনিভু আলো, তার সহগামী অন্ধকার। একটা বাসার বারান্দায় একশ ওয়াটের বাতি জ্বালানো। আলোটা এসে বসে আছে স্ট্রিটলাইটের আলোর পাশাপাশি। রাস্তায় পড়ে থাকা আইসক্রিমের কাঠি দিয়ে আলোকিত ধুলার ওপরে খলিল কিছু একটা লিখছে আর বিড়বিড় করছে কী যেন! উসখুস করতে করতে দুলু তাকিয়ে আছে দক্ষিণে ঢাকাগামী মহাসড়কের দিকে—যদি সেখানে কোনো রিকশা দেখা যায়! এই মাতালকে হাঁটিয়ে সাধুপাড়া পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া যাবে বলে তার মনে হয় না। সাধুপাড়া এখান থেকে কম করে হলেও দেড় কিলোমিটার। মাতাল খলিল হয়ত গা ছেড়ে দেবে পথের মাঝে কোথাও!

পাথরতলা মোড়ে দাঁড়িয়ে রিকশার প্রতীক্ষায় থাকতে থাকতে দুলু ভাবছে, খলিল যে রত্নাকে বিয়ে করেনি—সেটা মোটামুটিভাবে বোঝা যাচ্ছে এখন। কিন্তু খলিল কি সত্যিই তবে রত্নার সাথে যৌন সংসর্গ না-করেই রত্নাকে ছেড়ে দিয়েছিল? লম্বা শরীরের ওপরে উদ্ধত বুক, চিকন কোমড়, ভারি পাছা, ফিল্মের নায়িকাদের মতো সুন্দর মুখ, আয়ত চোখ, পাতলা ঠোঁট—সেই রত্নাকে আটকে রেখে গাড়লটা কিনা রত্নাকে ছুঁয়েও দেখল না? দুলুর এখন এও মনে হয়, খলিলের এ দাবিটা সত্যি হলেও হতে পারে! নেশার চিপায় পড়লে পুরুষেরা সুন্দরী মেয়েদের সাথে তাদের নৈকট্য সংক্রান্ত কথা খুব একটা চেপে রাখতে পারে না, সত্যি কথাটা তড়বড় করে বেরিয়েই আসে। কিন্তু মদের ঘোরে অসংলগ্ন খলিল এখন পর্যন্ত তেমন কিছুর ইঙ্গিতও দেয়নি। কেন জানি দুলুর মনে হয় না যে খলিল মিথ্যে ফাঁদছে কিছু। কিন্তু তাই বলে তো খলিলকে খোঁচানো বন্ধ করা যায় না! তার দ্বিতীয় ধারণাটা তো ভুলও হতে পারে!

জ্বলতে জ্বলতে আঙুলের কাছে নেমে আসা সিগারেটটা ফেলে দিয়ে দুলু এখন খলিলকে বলছে, ‘বাবাজি! চাইর দিক তো রিকশা বলে কুনু কিছু নেই! হাঁটাই লাইগলে শেষপর্যন্ত! ইবার তো তুমার উঠা লাগে।’

কিন্তু মুদিদোকানের সিঁড়ি থেকে উঠতেই চাচ্ছে না খলিল। দুলুর তাড়ার পিঠে সে বলছে, ‘আরেকটু বসি না ক্যা ব্যাটা! শরীলে ক্যাম্বা আলসি ধরেছে!’

শালা ধ্বজভঙ্গ! উঠলু না? এই বলে দুলু এগিয়ে গিয়ে খলিলের কোমরে কাতুকাতু দিয়ে দেয়। কাজ হয় তা’তে।

চল! তা’লি আইজ হাঁটেই বাড়িত যাব। কী আছে জীবনে!

কথা বলতে বলতে মুদিদোকানের সিঁড়ি থেকে উঠে পড়ে একটা টাল খায় খলিল। তারপর সে জোরে চেপে ধরে লাইটপোস্ট।

এই মুহূর্তে তাই ঘোরতর সংশয় প্রকাশ করছে দুলু, ‘তুই কি আদতেই হাঁইটপের পারবুনি? গলা পর্যন্ত তো মাল খাইছিস আইজ!’

শালা কয় কী? আমি হলেম পায়ে হাঁটে বাটালি হিলে উঠা মাল! খাড়া, আগে জামা খুলে লেই। ছাতার গরমের চোদনে জানডা এহেবারে তাম্মাতাম্মা হয়ে গেল! এই বলে গরমের বিরুদ্ধে গজগজ করতে করতে জামা খুলে ফেলেছে খলিল।

দুলুরও পাঞ্জাবিটা ভিজে নাশ হয়ে গেছে! আজ একেবারে প্যাচপেচে গরম। ক্রমাগত ঘাম ফুটছে, ঘাম ভাঙছে, তারপর শিরদাঁড়া বেয়ে সর সর করে নামছে নিচের দিকে।

জামা হাতে নিয়েই খলিল টলোমলো পায়ে একদৌড় দিচ্ছে মেইনরোডের দিকে। এতো আচ্ছা পাগলের পাল্লায় পড়া গেল! লুঙ্গিটা হাঁটুর ওপরে তুলে নিয়ে বন্ধুর পিছে দ্রুত হাঁটা লাগায় দুলু। একটু দূরে গিয়েই অবশ্য থেমে গেছে খলিল। কোমরে হাত রেখে রাস্তায় বসে পড়ে সে হাঁপাচ্ছে এখন। খলিল দুলুকে বলছে, ‘দৌড়াতি যায়ে মাজার কোটে তো লড়েই গেলরে ভাই! বুকির মিদিনও ক্যাম্বা হাঁপ ধরে আসতেছে। মরে যাবনানে তো?’

খলিলের কথা শুনে তার ওপর খুব রাগ হয় দুলুর। তাই খলিলকে সে বলছে, ‘এ! তোক দৌড়াবের কইছিলে কিডা? মোড়ের পরই কইল একখেন ঢাকনি খুলা ম্যানহোল ছিলে! যদি ম্যানহোলের মধ্যি যায়ে পড়তু?’

শারীরিক ক্লান্তিতে রাস্তা থেকে আর উঠতেই পারছে না খলিল! দুলু এই মুহূর্তে তাকে হাত ধরে একহেঁচকায় রাস্তা থেকে উঠিয়ে ফেলেছে। তারপর মহাসড়ক ধরে পশ্চিমে সাধুপাড়ার উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করেছে তারা।

শরীরটা ভাল লাগছে না দুলুর। এক গ্লাস বাংলা খেয়ে কি আর নেশা হয়? খলিলের পাল্লায় পড়ে মাল খেয়ে মাঝখান থেকে তিতকে তিতকে লাগছে গলার কাছটায়। মাথার ভেতরটা ঢ্যাবঢ্যাব করছে কেমন! তদুপরি প্রচণ্ড গরমে অশান্তি লাগছে তার।

উল্টো দিক থেকে রাত্রির নির্জনতাকে ভেঙেচুড়ে ঢাকার অভিমুখে এই মুহূর্তে ছুটে যাচ্ছে ভোমা ভোমা দু’টো ট্রাক। সভয়ে রাস্তা থেকে পথের পাশের মাটিতে নেমে পড়েছে তারা দু’জন। পথ পরিবর্তন করতে গিয়ে খলিল একটু বেশিই টাল খেয়ে গেছে।

রাস্তাটা একেবারে নিস্তব্ধ বলা যাবে না। পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের গেটে দারোয়ানের পাশে দাঁড়িয়ে অনবরত ঘেউঘেউ করে চলেছে একটা কুকুর। ইনস্টিটিউটের উল্টোদিকের যে বাড়িটাতে কোনো এককালে বাংলা সিনেমার নায়িকা সুচিত্রা সেন থাকত, সে বাড়ির ছাদে বসে কে যেন বাঁশি বাজাচ্ছে। একটু এগিয়েই আফজালদের ট্রাকের গ্যারেজে কোনো লেবার রেডিওতে ফুল ভলিউমে হিন্দি গান বাজাচ্ছে আর গোঁ-গোঁ, গরগর আওয়াজ তুলে সেখানে ঝগড়া করছে দু’টো বেড়াল।

আফজালদের ট্রাকের গ্যারেজের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে খলিল দুলুকে বলছে, ‘চলেক! শালার বিলেইরে গায়ে মুতে দিয়ে আসি। তা’লি পরে উয়েরে ঝগড়া থামে যাবিনি।’

এখন খলিলের ওপরে আবারো মেজাজ খারাপ হচ্ছে দুলুর। খলিলের পিঠে সে একটা গুঁতো দিয়ে বলছে, ‘ফায়শা কথা বন্ধ করেক! রত্নার কথা ক ব্যাটা!’

হাঁটতে হাঁটতে জজকুঠির সামনে এসে তারপর মুখ খুলছে খলিল, ‘শরীলডা, বুঝলু, লষ্টই হয়ে গেল আসলে! পাবনা থেন পয়লা ঢাহাত গিছিলেম। আমারে সাধুপাড়ার সাত্তার যেই গাড়ির ওয়ার্কশপে কাম কইরতে, হোনে মিকানিকের কাম লিলেম। ওয়ার্কশপখেন ছিলে মুগদাত। মুগদাতই এক মেচে একখেন বেড ভাড়া করিছিলেম। ওম্বা ইল্লেতে জায়গাত কি থাহা যায়, তুইই ক?

তারপর কী হলে শুনি? জিজ্গাসা করছে দুলু।

তারপর মুগদার মেসের আশপাশ থেকে সকল সময়ে ধেয়ে আসত ডাস্টবিনের দুর্গন্ধ। সাপ্লাইয়ের পানি থাকত না, যখন আসত—টিপটিপ, টিপটিপ করে কল থেকে পানি পড়তে থাকে। গোসলের জন্য লাইন। হাগামুতার জন্য লাইন। কাজের বিটির রান্না জঘন্য, বিস্বাদ। সবচাইতে বড় সমস্যা হত যখন রাত-নেই-বিরেত-নেই মহল্লার মাস্তানরা এসে ঢুকে পড়ত মেসের কোনো না কোনো রুমে। সেখানে বোর্ডারদের বিছানায় বসে তারা তাস ফেলে জুয়া খেলবে; মদ-গাঁজা টানবে; গণিকা ধরে আনবে কখনো কখনো; জোর করে কেড়ে নিয়ে যাবে বোর্ডারদের টাকাপয়সা, জামাকাপড় এমনকি প্রিয় কোনো জিনিসপত্তর পর্যন্ত। কিছু বলতে যাও, মেরে চামড়া খুলে ফেলবে দামড়াগুলো। কাজেই রাতে ঘুম না-হলেও চুপ করে থাক, দাঁত দেখিয়ে হাস আর তাল মেরে যাও মাস্তানদের সাথে। মেসটায় আবার চোরের আমদানিও কম ছিল না! মেসে ফিরলে প্রায়ই দেখা যেত, চৌকির নিচে রাখা টিনের ট্রাঙ্কের তালা ভেঙে ফেলেছে কেউ আর আর ট্রাঙ্ক থেকে এটা-ওটা হাওয়া হয়ে গেছে। পাবনা টাউনের নামকরা মাস্তান খলিলের ওপরে এতসব হুজ্জুতি চলেছিল! ভাবাই যায় না!

মহল্লায় মাস্তানদের যন্ত্রণায় প্রায় প্রায়ই রাতে খলিলের ঘুম হ’ত কম। তারপর সারা দিন মুগদার মটর ওয়ার্কশপের কাজের চাপ তো ছিলই! রাত নয়টার আগে কোনো দিন খলিল গ্যারেজ থেকে মুক্তি পায়নি। ওমন একটা বেজায়গায় থাকলে কি আর শরীর টেকে? ব্যাস! হয়ে গেল জন্ডিস। জন্ডিস ভালও হয়ে গেল। কিন্তু দু’মাস পর আবারো ঘুরে এল মরার অসুখটা। মুগদাবাসের সময় সেই যে খলিলের শরীরের জোরটা কমল, বাড়ল না আর!

সব মিলিয়ে মুগদার মেসে থাকতে তাই ভালই লাগেনি খলিলের। এমন একটা সময়ে চট্টগ্রাম শহরের লালখান বাজারের একবাসায় ড্রাইভারির প্রস্তাব নিয়ে আসে সাধুপাড়ার সাত্তার। মুগদা ছাড়তে পারা যাবে ভেবে তখন স্বস্তি পায় খলিল। লালখান বাজারের মালিক কুমিল্লার মানুষ। সেই ভদ্রলোক চাকরি করত চট্টগ্রাম শহরের একটা বেসরকারি ব্যাংকে। বলতে হবে, সেখানে খলিল ভালই ছিল। অন্তত সেখানে মুগদার বস্তির মতো কোনো আকাঠে ফ্যাকড়ায় তাকে পড়তে হয়নি। তবে লালখান বাজারের মালিক খুব কিপটে ধরনের ছিল—বেতন দিত মাসে মাত্র চার হাজার টাকা। বাড়িতে সিংহভাগ টাকা পাঠিয়ে তাই চলতে অসুবিধাই হ’ত খলিলের। তাই সে অল্প ক’দিনের ভেতরেই লালখান বাজারের কাজটা ছেড়ে দেয়ার পরিকল্পনা করেছিল। রামগতির নতুন এক ড্রাইভার-বন্ধুর মাধ্যমে কপালগুণে সে বেশি বেতনে কাজ পেয়ে যায় কুলসির আজিম সওদাগরের বাসায়। শিপব্রেকিংয়ের ব্যবসায়ী আজিম সওদাগরের বাসাতেই এখনো ড্রাইভারি করছে খলিল।

আজিম সওদাগরের বাসায় কাজ করে খলিল মাসে পাঁচ হাজার টাকা বেতন পায় এখন। কুলসির মতো চট্টগ্রাম শহরের অভিজাত এলাকায় আজিম সওদাগর বাড়ি একটা বানিয়েছে বাফু—রাজারাজরাদের প্রাসাদের মতো আলিশান বাড়ি! চাকরবাকরদের জন্য আছে আলাদা একতলা কোয়ার্টার। সেখানে একটা ঘর বরাদ্দ করা হয়েছে খলিলের নামে। খাওয়াদাওয়াও খুব ভাল দেয় বিবিসাহেব।

হাঁটতে হাঁটতে খলিল আরো বলছে: আচ্ছা দুলু, তুই কি কখনো সমুদ্রের রূপচাঁদা মাছ খাইছিস? সে এত্ত বড় বড় মাছ আর মাছটা খুব স্বাদের।

নাহ্! দুলু কখনো রূপচাঁদা মাছ খায়নি। রূপচাঁদা মাছ সে দেখবেই বা কী করে? পাবনা শহরের বাজারে কোনো সামুদ্রিক মাছ তো ওঠেই না!

যাহোক, আজিম সওদাগরের বাসায় থাকতে থাকতেই খলিলের ধসে যাওয়া শরীরটায় বল ফিরতে শুরু করে। কিন্তু মাথার ভেতরে সবসময়ই পাক খায় দুশ্চিন্তা। বাড়িতে সে ফেলে এসেছে বুড়ো বাপ-মা’কে। বাপটা একেবারেই অকেজো। তার হাপের ব্যারামটা আর ভাল হ’ল না! ছোট ভাইটা লেবারের চাকরি নিয়ে দুবাই যাওয়ার জন্য ঢাকার এক দালাল ধরে ব্যর্থ হয়েছে ইতোমধ্যেই। দালাল ব্যাটা মেরে দিয়েছে তিন লাখ টাকা। ছোট ভাইটার আর দুবাই যাওয়া হয়নি। খলিলদের মতো অবস্থাহীন পরিবারের জন্য এ টাকাটা অনেক! এদিকে তার বড় বোনটা আবিয়েত্তা এখনো। কোনো কাজবাজও করে না তার বড় বোন। এমনকি তার বড় বোন ঘরে বসে কাঁথা সিলাই করারও যুগ্যি না! এমন একটা অবস্থায় নিজের বেতন থেকে বাসায় প্রতি মাসে বড় অংকের একটা টাকা পাঠায় খলিল। কিন্তু তা’তে কি আর পরিবারের সব সমস্যার সমাধান হয়? হয় না। তা’ছাড়া খলিল বাড়িতে নেই দেখে জমিজমা নিয়ে ফরফর শুরু করেছে শরিকেরা। মেঝচাচার ছেলেরা তো জমি ঠেলতে ঠেলতে ঢুকেই পড়েছে তাদের ভিটার সীমানায়! খলিলের ছোট ভাইটা আবার আলাভোলা ধরনের! তার পক্ষে লাঠালাঠি করে কোনো কিছু ঠিক করা অসম্ভব। কিন্তু চাইলেই তো আর খলিল পাবনায় যেতে পারছে না!

কেন? খলিলের পাবনায় আসতে অসুবিধা কি?

খলিল এখন দুলুকে বলছে, ‘সে আরেক কিচ্ছা ব্যাটা! পরে কবনে। এহুন খালি মনে হয়, কীকামে যে রত্নাক তুলে লিয়ে গিছিলেম! অ্যাম্বা পিচেটি কাজকারবার কুন শালা করবের যায়?’

এহুন বসে বসে চুল ছিড়তিছিস লিজের? তা’লি পরে তহুন ভেজালে জড়াবের গিছিলু ক্যা? ভেংচি মেরে খলিলকে জিজ্ঞাসা করছে দুলু।

আর কইসনে! লোটির বাচ্চারে পাল্লায় পড়েই তো বেহালডা হলেম!

রত্নাক হাইজ্যাক করার জন্যি তোক আবার তাল দিলে কিডা? কইস কী তুই? হতবাক হয়ে খলিলকে জিজ্গাসা করছে দুলু।

খলিলের কথায় প্রচণ্ড একটা ধাক্কা খেয়েছে দুলু। তার মাথার ভেতরে পাক খাচ্ছে নানা আজগুবি সম্ভাবনা। কিন্তু দুলু উপসংহার টানতে পারছে না কোনো। দুলু ভাবছে, রত্নার হাইজ্যাক হয়ে যাওয়ার গল্পটা এবারই তবে বের হবে! তাই সে খলিলের কথায় আরো মনোযোগী হচ্ছে। কিন্তু তার প্রশ্নটা শুনতেই পাচ্ছে না মাতাল খলিল। হাঁটতে হাঁটতে খলিল এখন অদৃশ্য কাউকে মা-মাইনষি তুলে গালিগালাজ দিচ্ছে এইভাবে: সে কোনো এক জনকে দেখে নেবে! সে তাকে ছাড়বে না কিছুতেই! সে সাধুপাড়ার ছেলে। একগালে চড় বসালে সাধুপাড়ার ছেলেরা কোনো দিন আরেক গাল পেতে দেয় না। উল্টো তারা কাটা রাইফেল মেরে বিপক্ষের মাথার খুলি উড়িয়ে দেয়। আমার জীবন দোজখ বানানো হচ্ছে, না? দাঁড়া! তোকে দেখাচ্ছি!

খলিলের পাশে হাঁটতে হাঁটতে খলিলের এসব আস্ফালনের আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছে না দুলু। সে মেলাতে চেষ্টা করছে রত্নাকে নিয়ে ঘটে যাওয়া ছিটকেছাটকা ঘটনাগুলো। খলিলের কথার থেকে বোঝা যাচ্ছে যে রত্নাকে নিয়ে প্রচলিত গল্পের ভেতরে কোনো একটা ফাঁক আছেই আছে! কিন্তু সেই ফাঁকটা কোথায়?

অল্প একটু মাল টেনেই এখন দুলুর শরীর থেকে ভাপ বের হচ্ছে গাদাগাদা। অনেকটা পথ হাঁটার কারণে তার শরীরে গরমটা লাগছে আরো বেশি করে। রাত দু’টোর ফুরফুরে বাতাসেও তার গা আর ঠাণ্ডা হচ্ছে না কিছুতেই। খলিলের মতো করেই তাই দুলু নিজের পাঞ্জাবিটা খুলে ঘাড়ে ঝুলিয়ে নিয়েছে।

তখন চিটাগাংবাসের গল্পটা আপনাতেই বলতে শুরু করেছে খলিল।

খলিল বলছে, তার মন খুব খারাপ হলে প্রায় প্রায়ই সে চলে যায় পতেঙ্গা বিচে; সেখানে বসে থাকে একা-একা। পতেঙ্গাতে বার্মিজ হুইস্কি পাওয়া যায়। সেটা খুবই কড়া। কিন্তু বার্মিজ হুইস্কি ছাড়া আর কোনো গতি নেই পতেঙ্গা বিচে। বাটালি হিলের ওপরে উঠেও খলিল একা-একা বসে বার্মিজ হুইস্কি খায় আর ভাবে, একজীবনে এতগুলো ভুল না-করলেই পারত সে! আত্মহত্যার ইচ্ছাও চাগিয়ে ওঠে কখনো কখনো। কিন্তু খলিল কাপুরুষ। ছুরি-চাক্কু নিয়ে পাবনা টাউনে মারামারি করে বেড়ালেও আত্মহত্যা করার মতো মানসিক শক্তি তার নেই।

মাতাল খলিলের গলার ভেতরে শব্দগুলো সব জড়িয়ে পেঁচিয়ে যাচ্ছে। কাচারি জামে মসজিদের সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে দুলু খলিলকে জিজ্ঞাসা করছে, ‘কইস কিরে পাগল? একা-একা মাল খায়ে কি সুখ আছেরে ব্যাটা? হোনেকার ছাওয়াল-পাওয়াল সব জুমা লিছিলু না?’

খলিল বলে, ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল মাত্র একজনের সাথে। সেই ব্যাটা ছিল পাশের বাড়ির ড্রাইভার। তার ছিল খালি মেয়ে পটানোর ধান্দা। আর মেয়ে বিষয়ক বিভিন্ন ফায়শা কথাবার্তা ছাড়া তার আর কোনো গল্পই ছিল না। এছাড়া খলিল যদি কখনো তাকে বলত—চল! নিউমার্কেট থেকে বেড়িয়ে আসি, সেই ব্যাটা তখন যাবে বেশ্যাবাড়িতে। খলিলের মন তো কষেই থাকত সকল সময়! তাই তার আবার কোথাও বেড়াতে যেতে মন চাইত খুব। কিন্তু তাই বলে তো আর বেশ্যাবাড়ি যাওয়া যায় না! সোজা কথা, খলিলের পোষাত না পাশের বাড়ির ড্রাইভারটার সাথে।

খলিলের কথা শুনে হেসে ফেলছে দুলু। খলিলের পেটে গুঁতো দিয়ে সে বলছে, ‘সুফি টাইপের ভাব লিচ্ছিস যে? ব্যাপারডা কী? তুমি সুনা কি আর লোটিবাড়ি না-যায়ে ছিলে?’

খলিলের হেসে উঠেই দুলুর কৌতুকের উত্তরে বলছে, ‘তোর কাছ লুকাব লয় দুলু। চিটাগাং টাউনি যাওয়ার পর পর  গিছিলেম বার চারেক। ভাল লাগে নেই তেমুন। ক্যালা দিয়ে পড়ে থাকে শালির মাগীগুলে! অম্বা ফাসেক কাজকাম কি আর সবসুমায় করবের মন চায়রে?’

পরে কি তা’লি ধন বন্ধক দিছিলু? হাসতে হাসতে খলিলকে জিজ্গাসা করছে দুলু।

তা দেব ক্যা? মিয়েরে সাথ লাইন লাগাইতেম। ফের হাসতে হাসতেই বলছে খলিল।

চিটাগাং যায়েও মিয়ে বাগাইছিস তুই? আল্লাহ তোক ক্ষেমতাও দেছে! দুলুর প্রশংসাবাক্য শোনার পর একটু ভাব বেড়ে গেছে মাতাল খলিলের। তারপর দুলুকে খলিল বলছে: তো কী? সে ডাক দিলে পরে চিটাগাং শহরের পাঁচশ মেয়ে হাজির হয়ে যাবে যখন-তখন! সে কি আর দুলুর মতন ধাতুদুর্বল মানুষ নাকি?

এদিক-ওদিক মেয়েদের সাথে লাইন মেরে কুলসিতে মালিকের বাসায় ভালই দিন কাটাচ্ছিল খলিল। মালিকের বাসার এক জন ডয়গা কাজের মেয়ে, যে মেয়েটাকে সোনাগাজী থেকে আমদানি করেছিল বিবিসাহেব, খলিলকে কাবু করে ফেলেছিল শেষপর্যন্ত। ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল কুলসির বাড়িটায় খলিলের চাকরি নেয়ার বছর দেড়েক পরে। প্রথমে পাঁচ-ছয় দিন ধরে কাপড় ক্যালেন্ডার করার ঘরে একা পেয়ে সে বুক টেপে পরী নামের সোনাগাজীর সেই মেয়েটার। তখন কিচ্ছু বলনি মেয়েটা। উল্টো মেয়েটা লেটকে পড়েছিল খলিলের গায়ের ওপরে। তো খলিল তখন পরিষ্কার সিগনাল পেয়েছিল—আরো আগানো যাবে তা’হলে! মন্দ না! তারপর খলিল মেয়েটাকে অন্ধকার ছাদে একা পেয়ে জড়িয়েও ধরেছিল দিন দুয়েক। মেয়েটা এক দিন পটাস করে খলিলের গলায় চুমু খেয়ে বসেছিল। খলিল তখন ভাবছিল, আর তো দেরি করা যায় না! অনেক দিন ধরে তক্কেতক্কে সময় পার করেছিল খলিল। এক দিন সাঁঝের বেলায় পরী ছাদে এসেছিল তারে নেড়ে দেয়া কাপড় তুলতে। তো আর দেরি না-করে পানির টাংকির আড়ালে মেয়েটাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল খলিল। মেয়াটাকে সে শুইয়েও ফেলেছিল শানের ওপরে। কিন্তু তখনই সেই বাসার আরেক জন কাজের মেয়ে কোনো কাজে ছাদে এসে উপস্থিত হয়েছিল। প্রাকসঙ্গমের দৃশ্যটা দেখেও ফেলেছিল আম্বিয়া নামের সেই মেয়েটা। আর তখন খলিল তো ছিটে দৌড়!

তারপর কী হলে ব্যাটা? মজা পেয়ে খলিলকে জিজ্গাসা করছে দুলু।

তার পর দিন বিকালবেলা বিবিসাহেব যাচ্ছে আগ্রাবাদের এক আত্মীয়ের বাসায়। গাড়ি চালাচ্ছে খলিল। গাড়িতে বিবিসাহেব একা। বিবিসাহেব তখন খলিলকে প্রশ্ন করে, বাড়িতে কে কে আছে। উত্তরটা ভদ্রমহিলার জানা। তবু খলিল উত্তর দেয়—বাবা, মা আর ভাই-বোন। তখন আবারো প্রশ্ন আসে: বিয়ে করেছ? যথারীতি খলিল উত্তর দেয়: না। বিবিসাহেব ফের প্রশ্ন করে: কোথাও বিয়ের কথা ঠিক হয়ে আছে নাকি? বিপদ বুঝে গুল মেরে দেয় খলিল: হ্যাঁ, আছে। বিবিসাহেব তখন রাগে কড়মড় করছে: তা’হলে তুমি পরীর সর্বনাশ করতে বসলে কেন? এসব লা-শরিয়তি কাজকারবার এ বাসায় চলবে না। দু’দিন সময় দেয়া হ’ল তোমাকে। ভেবে দেখ। পরীকে বিয়ে করতেই হবে তোমাকে! না-হলে তোমার চাকরি খতম! তোমার মতো চরিত্রহীনের এটাই শাস্তি। তো খলিল ভাবে: কী আর করা! এবাদে স্বীকার যেতেই হবে, সংসার করার লোভও জেগেছিল তার। তাই দোনোমনা করতে করতে শেষমেষ খলিল পরীর সাথে বিয়েতে রাজিই হয়ে গিয়েছিল।

তারপর?

তারপর আর কী? ও জামাই বস হে উচেল ডুয়ার পর!

বিবিসাহেব তাদেরকে সার্ভেন্টেস কোয়ার্টারের একটা ঘরে থাকতে দিয়েছে। দেড় বছরের মাথায় পরী আর খলিলের মেয়েও জন্মেছে একটা।

খলিলের বিয়ের কথা শুনে এই মুহূর্তে দুলু লাফিয়ে উঠছে উত্তেজনায়। পুরনো ব্রিজ অভিমুখী রাস্তায় ঠিক পাবনা কালেক্টরেটের সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছে দুলু। দুলু খলিলকে সে বলছে, ‘সেকিরে? এমন একখেন ভাল সুংবাদ এত ক্ষণ পরে দিলু তুই? ইডা তো খুব খুশির কথা ব্যাটা!’

মৃদু হাসিতে খলিল মন্তব্য করছে, ‘কব কহুন? তুই তো খালি রত্না-রত্না করে পকপক করেই যাচ্ছিস!’

তা তোর বউ ক্যাম্বা দেখতি? রত্নার মতন সুন্দর? কী কইস তুই? উত্তরটা শোনার জন্য জ্বলজ্বল করে উঠছে দুলুর চোখ।

খলিল উত্তর দিচ্ছে, ‘দুর বোকাচুদা! রত্নার পাশে কুনু মিয়ে খাড়াবের পারবি নেকিরে? তয় ইডা তোক কবের পারি,  পরী মিয়েডার চিহারার ঢক খুব একটা খারাপ লয়।’

দেখলিই বোঝবনে। লিয়ে আইছিস তো সাথ করে? খলিলকে প্রশ্ন করছে উত্তেজিত দুলু।

উত্তর দিচ্ছে খলিল, ‘নাহে! ক্যাম্বা করে আনব? পরী তো কুলসির মালিকের বাড়িতই কাম করে। বিবিসাহেব উয়েক ছাড়লেই না! তোক কই, আমি লিজেও ইবার পরীক পাবনা লিয়ে আসপের চাই নেই। ইবার তো আমি জরুরি কামে আইছি ব্যাটা। পরের যাত্তারাত লিয়ে আসপনে উয়েরে।’

মরিছিস তা’লি! বউ ছাড়ে থাকাডা আসলেই জানের পর আজাব! মিচকি হাসিতে চোখ মারছে দুলু।

যৌনজীবনের ইঙ্গিতটুকু খলিলেরও বুঝতে অসুবিধা হয় না। সে একটু হাসে বটে কিন্তু কৌতুক করত নামে না। পুরনো ব্রিজের দিকে হাঁটতে হাঁটতে উদাস হয়ে খলিল দুলুকে বলছে, ‘মনডা আসলে ছুটে যাবের চায় বাচ্চাডার জন্যিই। মেলা দিন বাচ্চাডাক দেহিনিরে ব্যাটা—দিন দশেক তো হয়েই গেল!’

তুই তা’লি পরে চিটাগাং চলে যাচ্ছিস কবে? এবার আর কৌতুক করছে না দুলু।

খলিল দুলুকে জানাচ্ছে, বিবিসাহেবকে সে বানিয়ে বানিয়ে বলেছে যে তার মা’র কঠিন অসুখ। থেকে থেকেই মা’র হার্টে খুব ব্যথা উঠছে আজকাল। বার বার মা’কে পাবনা সদর হাসপাতালে চিকিৎসা করেও কোনো লাভ হয়নি। মা হয়ত এবার মরেই যাবে! তাই শেষবারের মতো মা’কে ডাক্তার দেখিয়ে খলিল নিজে একবার চেষ্টা করে দেখতে চায়। কিন্তু বদলি-ড্রাইভারের ব্যবস্থা না করে দিলে তো আর ছুটি মিলবে না! আজিম সওদাগর সারা দিন তার শিপব্রেকিংয়ের কাজে শহরময় দৌড়াদৌড়ি করে বেড়ায়। তাই গাড়ি ছাড়া তার চলে না। ঐ বাড়ির আরেক ড্রাইভার কালামকে তাই ধরেপেরে কালামের ভাগ্নেকে বদলি-ড্রাইভার হিসাবে ম্যানেজ করতে হয়েছে খলিলকে। সুখের বিষয় হ’ল যে বিকল্প ব্যবস্থায় সাহেব রাজি হয়েছে শেষমেষ। তারপরই না পনের দিনের ছুটি পাওয়া গেল! সেই লম্বা ছুটিটা তো এখন প্রায় ফুরিয়েই যাচ্ছে! খলিলকে চিটাগাং শহরে চলে যেতে হবে এখন থেকে ঠিক  পাঁচ দিন পরে।

খলিল আরো বলছে, ছুটি নিয়ে তার পাবনাতে আসার পেছনে বিশেষ একটা কারণও আছে বটে। পাবনা শহরে সে কাজ খুঁজছে একটা; কিন্তু পাচ্ছে না। ড্রাইভারি না-হয় যা-তা একটা কাজ পেলে খলিল ডাংগুলি মেরে দেবে চিটাগাং টাউনের চাকরিটাকে। তারপর সে পরী আর তাদের সন্তানকে নিয়ে আসবে পাবনায়।

তাই দুলুকে খলিল জিজ্ঞাসা করছে, ‘তোর কাছ কামকাজের কুনু খবর আছে নেকিরে ব্যাটা? আমি তো পাবনা টাউনি ফিরে আসপের চাই!’

খলিলের সমস্যা শুনে প্রয়োজনীয় পন্থা নিয়ে একটু ভাবছে দুলু। তারপর সে তার বন্ধুকে বলছে, ‘তা’লি পরে লাহিড়ীপাড়ার রেজার সাথ একবার কথা কয়ে দেখপের পারি। শুনিছি, উয়ের এক মামাত ভাই নেকি মাইক্রোবাস কিনবি শিগগিরি। ডেরাইভার তো লাগবিইনি তারে! তোর জন্যি হোনে চিষ্টা করে দেখপনে, যা।’

খলিল এই মুহূর্তে দুলুকে তার অনুনয় জানাচ্ছে, ‘ভাল করে চিষ্টা করিস কইল ভাই! যা করার আর তিন-চার দিনের মধ্যেই করবু। আর পাঁচ দিন পর আমাক চিটাগাং ফেরত যাওয়া লাগবিই লাগবি!’

দুলু ভাবছে, কাজকর্ম কি আর গাছের ফল নাকি যে ঝাঁকি মারলেই ঝুপ্পুরঝুপ্পুর করে পড়তে থাকবে? খলিলের কথাকে সেজন্য সে আমল দিচ্ছে না তেমন। বরং সে খলিলকে বলছে, ‘সে হবিনি! এহুন ক, রত্নার বুকির পর কয়খেন তিল ছিলে। দু’ডে, তিনডে নেকি চারডে?’

দুলুর ঘোরানো প্রশ্নের উদ্দেশ্য বুঝতে পারে না মাতাল খলিল। কপাল চুলকাতে চুলকাতে সে উত্তরটা ভাবতে চেষ্টা করছে। একটু থেমে সে উত্তর দিচ্ছে, ‘সিডা তো জানিনে ব্যাটা!’

নখরামি? নেশার জোরে টাল হলে কি হবে, খলিলের বোধবুদ্ধি এখনো তবে জাগ্রত! এমনটাই মনে হয় দুলুর। তবে আবারো মাতাল খলিলের পেট থেকে কথা বের করার সুযোগ নিচ্ছে দুলু। সে বলছে, ‘ঠিক করে মনে করে দেখেক, রত্না উয়ের জামা খসা ফেলায়ছে, আসে বয়ছে তোর কোলের পর। তহুন তুই …!’

দুলুর খোঁচাখুঁচির কায়দা দেখে এখন ঝাঁঝিয়ে উঠছে খলিল, ‘দুর ভুদাই! আবারো সেই পুরেন গীত শুরু করলু? তোক না কলেম, রত্নাক আমি কিছুই করি নেই? মিয়েডাক আমি তুলে লিয়ে গিছিলেম ঠিকই কিন্তু উয়েক আমি ছুঁয়েও দেখিনি! বিশ্বেস যাচ্ছিসনে কীকামে?’

খলিলের সে কথা এবারেও বিশ্বাস করতে পারছে না দুলু। তাই দুলুও তেড়ে উঠছে সঙ্গত কারণেই,‘তা’লি পরে কি রত্নাক বাঁশের বাদা লিয়ে যায়ে পিঁড়ের পর বসাবসা পুজে করিছিলু? তুই এত বড্ডা ছাগল বলে তো আমার বিশ্বেস হচ্ছে না!’

প্যাচাল পারিসনে তো! থামেক। দুলুকে ধমক দিচ্ছে খলিল। আর দুলু সমানে গজগজ করছে এখন। দুলু বলছে, ‘খুব তেল হয়ছে তুমার! রত্নার কথা ভাঙবের মন চায় না, না? এ শালা! রত্না কি তোর বাবাতি সম্পত্তি? মিয়েডাক তুলে লিয়ে যায়ে সারে তুই কী কী করিছিলু তা কি আমারে জানার অধিকার নেই নেকি? কী কবের চাইস তুই?’

রাত প্রায় পৌনে তিনটা। চাঁদের আলোয় দেখা যায়, কয়েকটা ছোবড়াছাবড়া অলস মেঘ আকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে গড়িয়ে গড়িয়ে। এমন পাতলা মেঘে বৃষ্টি হয় না, তাপ ছোটে শুধু শুধু। এই মুহূর্তে পুলিশ লাইন পার হয়ে পুরনো ব্রিজের ওপরে উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছে খলিল। ব্রিজের লোহার রেলিংয়ে হেলান দিয়ে একটুখানি দাঁড়ানোর ইচ্ছা তার। অনেক ক্ষণ ধরে হাঁটতে হাঁটতে গরম ধরে গেছে খলিলের গায়ে। তো একটু থামা যাক! হঠাৎ করেই বাতাসও ছুটেছে একটা। মন্দ নয়!

খলিল দুলুকে বলছে: কার্বুরেটারে আরো খানিকটা পানি ঢালতি পারলি পরে জানডা একটু ঠাণ্ডা হ’তে মনে হয়! মানে খলিলের আরেক বোতল বাংলা লাগবে আরকি!

খলিলের কথা শুনে তাই খেইখেই করে উঠছে দুলু, ‘আবারো ঝামেলা লাগালু? আমি এহুন বাড়িত যাবের চাই। রাইত কত হয়ছে তা খিয়াল করিছিস তুই? পুলিশ লাইনের ঘড়িত রাইত তিনডের ঘন্টা পড়লে এই মাত্তর। বিরিজের রেলিং থেন ওঠেক তো! আর ভাল লাগতেছে না বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ানি! পা চালা জলদি বাড়িত যাই চলেক।’

খলিল এখন দার্শনিক। দুলুর কাছে থেকে একটা সিগারেট নিয়ে ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে সে বলছে, ‘ঝামেলা ছাড়া জীবনে আর কিছু আছে নেকি বাবাজি? এই আমাক দেখেক না, একের পর এক ফাতনা ফ্যাসাদ লাগেই রয়ছে আমার, আর থামবের চাচ্ছে না মোটেই! রত্নাক হাইজ্যাক করে কী খিটকেলই না পাকাইছি আমি! বুঝলু, খানকির ছাওয়াল বিল্লাহই আমাক যত ঝামেলায় ফেলায়লে! আর আমি বাল কত বড় ভুদাই, দড়িছিঁড়া গরুর মতো ছুটে যায়ে মারা দিয়ে আইসলেম!’

কুঠিপাড়ার বিল্লাহর কথা কচ্ছিস? রহস্যের আঁচ পেয়ে একাগ্র হচ্ছে দুলু।

হয়রে হয়! ঐ লোটির বাচ্চার কথাই কচ্ছি। বিল্লাহ এহুন টিরাক-বাস করেছে কতগুলেন, দেহিছিস? তাও সাইট-সত্তুরখেন তো হবিইনি! শালা বলে আবার পাবনা মটর মালিক সমিতির লিডারও হয়ছে! টলতে টলতে এটুকু বলছে খলিল।

সে আর কিডা না-জানে? আসুল কথাডা ক দেহি। বিল্লাহ কি অনিষ্ট করেছেরে তোর? দুলু অধৈর্য হয়ে খলিলকে জিজ্ঞাসা করছে।

কিন্তু সেই প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে না খলিল। গুনগুন করে কোনো একটা হিন্দি গান গাইতে গাইতে দুলুকে খলিল বলছে, ‘গলাডা শুকা গেছে ব্যাটা! পানি খাতেম ইকটু!’

খলিলের কথা শুনে আবারো ক্ষিপ্ত হয়ে যাচ্ছে দুলু। খলিলকে সে বলছে, ‘ফালা রাখ তোর পানি! বিল্লাহ তোর কী করেছে তা আগে ক তু্‌ই!’

এখন আসল কথাটা বলতে শুরু করেছে খলিল। রত্নাকে হাইজ্যাক করার একসপ্তাহ মতো আগে বিল্লাহ খলিলকে নিজের বাসায় ডেকে পাঠিয়েছিল।

তারপর? তারপর? একাগ্র হচ্ছে দুলু।

তারপর বিল্লাহ খলিলের কাছে প্রকাশ করে: তুই যে পঞ্চাশ হাজার টাকা কর্জ চেয়েছিলি, সেটা তোকে দেয়া হবে। তবে কাজ করে দিতে হবে একটা।

এর আগের ঘটনা হ’ল, খলিল তখন টাকার জন্য সব কাজ করতেই প্রস্ত্তত। টাকা চাই—অনেক অনেক। তার ছোট ভাইটা লেবারের কাজ নিয়ে দুবাই যেতে চেয়েছিল তখন। ঢাকার এক ম্যানপাওয়ারের দালালের সাথে চুক্তি হয়েছিল সেইমতো। টাকা লাগবে পাক্কা তিন লাখ। পরিবারের একটা দশ কাঠার সরেস ধানীজমি ছিল কোলের ধারে। সেটা বিক্রি করে দু’লাখ টাকা পাওয়া গিয়েছিল। বানী হলের মালিকের বড় ছেলে সুন্দার তার লাইটম্যান খলিলকে হাওলাত দিয়েছিল কুড়ি হাজার। খলিলের ছোট ভাই নিজেও টাকা জোগাড় করেছিল কিছু। তারপরো পঞ্চাশ হাজার টাকা কম পড়ে গিয়েছিল তাদের। কাজেই উপায়ন্তর না-দেখে খলিল পঞ্চাশ হাজার টাকা ধার চেয়েছিল তার একসময়ের লিডার বিল্লাহর কাছে। বিল্লাহকে সে বলেছিল: আপনার হয়ে তো অনেক বার জান বাজি রাখলাম। আপনি বড় ছাত্রনেতাও হলেন। এবার আপনি আমাকে বাঁচান! আমি বাণী হলের সামান্য লাইটম্যান। আমার আর কী সঙ্গতি আছে? ছোট ভাইটা তো দেশে কিছু করতে পারছে না। ডেকোরেটরের দোকান দিয়ে সে অল্পদিনেই ব্যবসায় ফেল মেরে বসে আছে।

বিল্লাহ খলিলকে জিজ্ঞাসা করেছিল: তা’হলে সমাধানটা কী? খলিল বলেছিল: লেবারের কাজ নিয়ে সবাইই তো আজকাল দুবাই যাচ্ছে। বেতন দিয়ে তারা নিজেরা তো চলছেই, বাড়িতেও টাকা পাঠাচ্ছে ভালই। এসব সুবিধার কথা ভেবে ছোট ভাইটাকে খলিল দুবাই পাঠাতে চায়। কাজেই পঞ্চাশ হাজার টাকা তার খুব দরকার। ধীরে ধীরে খলিল বিল্লাহকে শোধ করে দেবে টাকাটা।

এত অনুনয়ের পরো খলিলকে একবার ঘুরিয়ে দিয়েছিল বিল্লাহ। বিল্লাহর প্রত্যাখ্যানের পর খলিল তখন এর-ওর কাছে গিয়েছিল টাকা ধার পাওয়ার জন্য। দিতে চায়নি কেউই, ভাড়িয়েছিল অনেকেই।

এমন সময় বিল্লাহর ডাক আসে। ছুটে যায় খলিল। বিল্লাহকে সে জিজ্ঞাসা করে: কী কাজ বিল্লাহ ভাই, কন।

খুব সোজা। একটা মেয়েকে তুলে আনতে হবে।

বলেন কী? রিস্কি ব্যাপার!

হ্যাঁ, তাইই। দু’দিন পর বিকালে গোবিন্দায় এক বন্ধুর বাসায় যাবে রত্না।

কোন রত্না?

ঐ যে গোপালপুরে বাড়ি—দবির কন্ট্রাকটারের মেয়ে! মেয়েটাকে সব বলাই আছে। গোবিন্দায় ওর রিকশা থামিয়ে তুই তোর নাম বলবি। ব্যাস! রত্না তোর সাথে চলে যাবে। তবে ব্যাপারটাকে হাইজ্যাকিংয়ের কালার দিতে হবে। তার জন্য তোকে অভিনয় করা চাই। বুঝলি তো?

বিল্লাহর কথা থেকে প্ল্যানটা বুঝতে দেরি হয়নি খলিলের। ঠিক হ্যায়! তার মানে, মানুষজনের সামনেই ঘটনাটা ঘটাতে হবে। আর কাটা রাইফেল চালিয়ে পুলিশকে জানান দিয়ে কোনো লাভ নেই। একটা ড্যাগার বের করে রত্নাকে দেখানোটাই যথেষ্ট। ড্যাগারটা বড় হওয়া দরকার যাতে করে সেটা সবার চোখে পড়ে।

তখন বিল্লাহ খলিলকে বলেছিল: একদম ঠিক। রাস্তার পাশে ভাঙাচোরা একটা সবুজ জিপ থাকবে। ড্যাগারের মুখে জিপে রত্নাকে তুলে নেবে খলিল। তবে খলিলের হাত থেকে ছুটে যাওয়ার জন্য পরিকল্পনা মতো একটু পাচড়াপাচড়ি করবে রত্না। সে কয়েকটা আর্তচিৎকারও দেবে। কিন্তু ঠিকই সে জিপে উঠে বসবে, দেরি করবে না মোটেই। রত্নাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হবে সেটা ঠিক করতে হবে খলিলকেই। বিল্লাহ মোটেই জড়াবেনা পুরো ঘটনার কোথাও।

বিল্লাহর শেষকথা ছিল এমন: কোনোভাবেই পুলিশের হাতে ধরা পড়া চলবে না খলিলকে। আর ধরা পড়লেও পুলিশের কাছে স্বীকার করা যাবে না যে রত্না-হাইজ্যাকিংয়ের ঘটনার মূল নায়ক স্বয়ং বিল্লাহ। এর অন্যথা হলে খলিলের পরিণতি হবে ভীষণ ভীষণ খারাপ। তুই রাজি তো?

তাই সই। শোনেন বিল্লাহ ভাই! পঞ্চাশ হাজার টাকার জন্য আমি সব করতে পারি! বলেছিল খলিল।

বিল্লাহ একরার করেছিল যে রত্নাকে তুলে নেয়ার নাটকটা করলে খলিলকে সে পঞ্চাশ হাজার টাকা দেবে। কিন্তু বিল্লাহর ছকটা বুঝতে পেরে সে নিজের জন্য সত্যই শঙ্কিত হয়ে পড়ছিল। পুলিশের হাতে ধরা পড়লে নারী-অপহরণের মামলায় ফেঁসে যাবে সে। তখন তার তো জামিন হবেই না, হাজতে বসে বসে পুলিশের ছ্যাঁচা খেতে হবে তাকে এবং মামলা নিষ্পত্তির পরে সাত-আট বছর জেলখানা থেকে বের হলে নির্ঘাত বিল্লাহর হাতে মারা পড়বে সে। বিল্লাহর পক্ষে সবকিছুই করা সম্ভব!

খলিলের ঘটনা শুনে এই মুহূর্তে আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছে দুলু। রত্না-অপহরণের নেপথ্যের এসব ঘটনার ঘনঘটা তো পাবনা টাউনের কেউই জানে না? সেই সাথে তার রাগও হচ্ছে খলিলেরই ওপরে। তাই খলিলকে সে বলছে, ‘এই কয়ডা ট্যাকার জন্যি এরম একখেন ইল্লেতি কাম করবের রাজি হয়ে গেলু তুই?’ দুলুর গলায় হিসহিসে শ্লেষ।

কী আর করব, ক? দাঁড়িয়ে পড়া দুলুর দিকে নোনা হাসিতে তাকিয়ে থেকে খলিল তার নিজের যত অক্ষমতা জানাতে চায় তার বন্ধুকে। দুলুকে খলিল বলছে, ‘ছোট ভাইডাক দুবাই পাঠানে দরকার ছিলরে ব্যাটা!’

তারপর এলোমেলোভাবে বুকপকেট হাতড়িয়ে খলিল সিগারেট খুঁজতে বসেছে। দুলু জানে, ওর স্টকে কোনো সিগারেট নেই। তাই দুলু খলিলকে একটা স্টার সিগারেট ধরিয়ে দিয়ে বলছে, ‘রত্নাক তুলে লিয়ে যায়ে খামোখা ঝামেলাত জড়ালু তুই! তোর মুখির মধ্যি আগুন ঢুকা দিয়া উচিত!’

খলিল কিছু বলছে না।

গম্ভীর দুলু আবার খলিলকে জিজ্ঞাসা করছে, ‘তা পঞ্চাশ হাজার ট্যাকা কি বিল্লাহ তোক দিছিলে শ্যাষপর্যন্ত?’

তা দিছিলে ঠিকমতোই। দেনান দেন দশ হাজার, হাজত থেন বাইর হওয়ার পর বাকি চল্লিশ। কিন্তু শালার ট্যাকা লিয়ে কুনু লাভই হলে না বুঝলু? ছোড ভাইডা অ্যাম্বা একখেন চিটার দালাল ধরলে, সেকথা আর কওয়ার লয়! শালার চিটার পুরে ট্যাকাডাই মারে দিলে! ছোট ভাইডার আর দুবাই যাওয়া হলে না! সেই দালালেক আর খুঁজেই পাওয়া গেল না কুথাও! শালার দালাল যে কোনে পগার পার হইছিলে, কিডা কবি! আমার আমও গেল, ছালাডাও গেল! ভুলই হয়ছে ব্যাটা! এভাবে দুলুকে আফসোস জানাচ্ছে খলিল।

দুলু এখন রাগে জ্ঞানশূন্য হয়েছে। খলিলকে সে বলছে, ‘খুব চুদাইছেও ভ্যারানেশে আমার! আরো যাও রত্নাক হাইজ্যাক কইরবের! এহুন হা-পিত্যেশ করে আর কী লাভ হবিরে তোর?’

খলিল দুলুর কাছে স্বীকার যাচ্ছে, তাও বিল্লাহ যদি শেষমেষ রত্নাকে বিয়েটা করত তা’হলেও জানে শান্তি পেত সে। শালা বিল্লাহ তো রত্নাকে পনের দিন ধরে খেয়েদেয়ে ছেড়েই দিল! মেয়েটা বিল্লাহকে কত করে বল্ল—আমাকে বিয়ে করতে লাগবে এখনই। ঐসব পরেটরে বুঝি না! শালার জারের দুনা বিল্লাহ সেই কথা শুনলই না! আর রত্না এমনই ছাগল যে সে নিজেকে বাঁচাতেই পারল না বিল্লাহর লালসা থেকে! রত্নার সেই অসহায়ত্বের কথা ভাবলে পরে মনটাই খারাপ হয়ে যায় খলিলের! অবশ্য খলিল দুলুর কাছে এও স্বীকার যায় যে বাঁশের বাদা এলাকায় লুকিয়ে থাকার সময় একবার সে ভেবেছিল, বিল্লাহর ষড়যন্ত্র সম্পর্কে রত্নাকে সে সাবধান করে দেবে। পরে আবার তার মনে হয়েছিল যে তার তো কেবল টাকা পাওয়া দিয়ে কাম। কে কাকে নাশ করল, তা’তে তার কী যায় আসে?

পুলিশ লাইনে রাত তিনটার ঘন্টা বাজছে। রাতের অন্ধকারে পুরনো ব্রিজের রেলিংয়ে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে খলিল আর দুলু। মরে যাওয়া ইছামতি নদীর দিকে তাকিয়ে থেকে কী যেন ভাবছে খলিল! খলিলের চেহারাটা দুলুর কাছে আরো তোবড়াতাবড়া মনে হচ্ছে এখন। এদিকে দুলু মনে করার চেষ্টা করছে রত্নার স্বামীর চেহারাটা। রত্না আর রত্নার স্বামীকে সে একবার দেখেছিল পাবনা নিউ মার্কেটের সাত্তার স্টোরে। রত্নার স্বামী এমবিবিএস ডাক্তার। তার বাড়ি নাটোরে। হিজলায় তার পোস্টিং। রত্না তার স্বামীর সাথে হিজলাতেই থাকে এখন।

তারপর?

মাতাল খলিল দুলুকে বলছে, ‘ও! তোক তো বলতি ভুলিই গিছিলেম!’ রত্নাকে নিয়ে বাঁশের বাদায় লুকিয়ে থাকার সময়কার গল্প সেটা। একরাতে যথারীতি মটর সাইকেল চালিয়ে বিল্লাহ পাবনা টাউন থেকে ফেরত এসেছিল বাঁশের বাদায়। রাতের খাবারের পর তখন হারিকেনের আলো কমিয়ে ঘরে শুয়ে ছিল রত্না। ঘুমিয়ে গিয়েছিল আশ্রয়দাতা-পরিবারের সবাই। উঠানের আমড়াগাছের নিচে পাটি পেতে শুয়ে শুয়ে রত্নাকে পাহারা দিচ্ছিল খলিল। সে দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে পাবনা টাউনে চলে যাওয়ার আগে বিল্লাহ খলিলকে চুপিচুপি বলে গেছে, ‘লজর রাখিস কিন্তুক! পাখি কইল ভাগে যাবের পারে! অবস্থা সুবিধের লয়!’ সারা দিনই তাই রত্নার ওপরে চোখ রাখছিল খলিল।

মটর সাইকেল থেকে নেমে যে ঘরে রত্নাকে রাখা হয়েছিল, যথারীতি বিল্লাহ সেখানে ঢুকেছিল। আমড়াতলা থেকে ঘরের খিল আটকে দেয়ার শব্দ পেয়েছিল খলিল। তারপর কী মনে করে আমড়াতলা থেকে সে উঠে গিয়ে কান পেতেছিল ঘরটার পেছনদিকের জানালায়। সে শুনতেও পেয়েছিল দু’জনের কথপোকথন। তখন রত্নাকে বিল্লাহ বলছিল, ‘কালকে তুমি বাসায় চলে যাও। ঘাবড়ায়ও না। আমার পিলান মতোই সব কাজ চলতেছে, বুঝিছ? আমি চিন্তা করে দেখলেম, লুকায় লুকায় বিয়ে করলি পরে আমার পলিটিক্সের বারটা বাজে যাবিনি! সবাই কবিনি কী? তুমি বাড়িত ফিরে যাওয়ার পর তোমারে বাসায় আমি বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবোনে। হাইজ্যাক হয়ে যাওয়া মেয়েক খুব তাড়াতাড়ি তো কেউ আর বিয়ে করতি আসতেছে না! দেইখেনে, তুমার আব্বা সাথে সাথেই রাজি হয়ে যাবিনি!’

রত্না তখন কাঁদতে কাঁদতে বলছিল, ‘এমন তো কথা ছিল না! আপনে বলছিলেন যে এইখানেই আমাদের বিয়ে হবে! কাজি ডাকেন এখনই। আজকেই আমাকে বিয়ে করবেন আপনে! এই লজ্জা নিয়ে আমি বাসায় ফিরত যেতে পারব না!’

একটু থেমে বিল্লাহ রত্নার কথার পিঠে বলেছিল, ‘তখন তো আসলে বুঝি নেই! আমি তোমাক ভাগা লিয়ে যায়ে বিয়ে করিছি—এইকথা টাউনের মানুষজন জানলি পরে ঢি-ঢি পড়ে যাবিনি চাইরদিক! আমি উপরে উঠি—সিডা কি চাও না তুমি? আমার উন্নতি হলি তো তুমারই লাভ! কী কও?’

রত্না তখনো কাঁদছিল; একটা কথাও বলছিল না আর।

বিল্লাহ তখন চাপা গলায় রত্নাকে বুদ্ধি দিয়েছিল, ‘বাসায় যায়ে পয়লাতই তুমি পুলিশেক ফোন করে কবে যে সাধুপাড়ার খলিল তুমাক ধরে লিয়ে গেছিলে। তুমাক আটকা রাখা হইছিলে বাঁশের বাদায়। সিখান থেন তুমি পালায় আইছ। পুলিশ আসে তারপর খলিলেক অ্যারেস্ট করবে। খলিল অবশ্য পুলিশেক আমার কথা কিছু কবিনানে। সিডা ভয়ের বিষয় লয়। তুমি ভুলেও পুলিশেক আমার সাথ তুমার সম্পর্কের কথা আবার কয়ে ফালায়ও না যিন! তা’লি আর তোমার সাথে না, বিয়ে বসতি হবি জেলখানার সাথে! বুইঝ তখন!’ এই বলে সকৌতুকে হেসে উঠেছিল বিল্লাহ।

রত্নাকে বিল্লাহ আরো বলেছিল, ‘স্টেটম্যান্ট লিয়ার নামে পুলিশ যাতে তুমার পর বেশি হুজ্জুতি না-করে সিডা দেখার দায়িত্ব তো আমার, নেকি? তুমি খালি ভয় পায়ে না লক্ষ্ণীসুনা আমার! সব আমি ঠিক করে ফালাবনে।’

রত্না তখনো কাঁদছিল। তারপর রত্না আর বিল্লাহর কথোপকথন আর শুনতে চায়নি খলিল। আমড়াতলায় ফিরে গিয়ে পাটিতে শুয়ে শুয়ে সে বুঝতে পেরেছিল যে বিল্লাহর পরিকল্পনা অনুয়ায়ী দু’একদিনের মধ্যেই পুলিশ তাকে অ্যারেস্ট করবে এবং এই বাঁশের বাদা থেকেই। নির্ঘুম সেই রাতে সে রেডিও শিলং-এর হিন্দি গান শুনেছিল আর মনে মনে সে তৈরি হচ্ছিল আসন্ন ঝড় সামাল দেয়ার জন্য। পুলিশি গ্যানজামের কথা ভেবে খুব হতাশ লাগছিল তার। কী দিয়ে আবার কী হয়ে যায়! পুলিশদেরকে তো কোনো বিশ্বাস নেই। কার্যত দেখা গেল যে বিল্লাহর পরিকল্পনা মাফিক সে আর খালাস পেল না! কিন্তু তখনো কাজ বাবদ বিল্লাহর কাছে তার চল্লিশ হাজার টাকা পাওয়া বাকি। কাজেই পাওনা টাকা তুলতে গেলে তাকে তো গ্যানজামের ভেতর দিয়ে যেতেই হবে!

তারপর?

তারপর আর কী? পর দিন সকালে বিল্লাহ খলিলকে তার প্ল্যানটা জানায়। খলিল চুপচাপ শোনে। কথা শেষ হলে সে বিল্লাহকে জিজ্ঞাসা করে, ‘আর আমার বাকি ট্যাকাডা?’ নো প্রবলেম। পুলিশের কাস্টডি থেকে তাকে বের করে আনার পর বাকি টাকাটা বিল্লাহ দিয়ে দেবে একদম সাথে সাথেই। আর মনে আছে তো, পুলিশের কাছে কোনরকমেই বিল্লাহর নাম উচ্চারণ করা যাবে না? সেকথা খলিল ভোলেনি। বিল্লাহ তাকে আবারো সাবধান করে দেয়, ‘তুই যুদি বেচাল করিস তো পুলিশ আমার বালও ছিড়বের পারবি না, বুঝলু তো? মাঝখান থেন তুইই জেলের ঘানি টানবু! আর তারপর তো তোর লাশ এক দিন না এক দিন ময়লাগাড়িত পড়ে থাকপিইনি!’

তখন খলিল ভাবতে থাকে, মওকা পেলে কাটা রাইফেল মেরে সে খুলি উড়িয়ে দেবে বিল্লাহর! পঞ্চাশ হাজার টাকার জন্য বিল্লাহর ঝারিও তাকে শুনতে হ’ল!

এই মুহূর্তে পুরনো ব্রিজের ঢাল দিয়ে নেমে লাইব্রেরি বাজারের দিকে হাঁটতে হাঁটতে দুলু খলিলকে প্রশ্ন করছে, ‘পুলিশেক আবার বিল্লাহর কথা কিছু কয়ে ফেলাইস নেই তো? পুলিশ কইল জিগের আঠার মতন গুয়ায় লাগে থাকে!’

আরে না হে! পুলিশ আমাক…পুলিশ না আমাক…। হাসির ধাক্কায় কথা শেষ করতে পারে না মাতাল খলিল। তার হাসি থামেই না। দুলু তাই খেঁচকি মেরে উঠছে, ‘গাধার মতন হাসিসনে তো! কথাডা আগে শেষ করেক।’

খলিলের হাসি আর থামছে না, শুধু কমেছে হাসির মাত্রাটা। খলিল আবার কথা শুরু করেছে, ‘বাঁশের বাদা থেন পুলিশ আমাক ধরে লিয়ে যায়ে তেমুন একটা জিজ্ঞাসাবাদ করলেই না, জানিস! আমি অবাক হই নেই! বুঝিছিলেম, বিল্লাহ দারোগাক ম্যানেজ করে ফালায়ছে। তয় শালার দারোগা আমাক ব্যাটন দিয়ে পিটাইছিলে খাইনটেক। চান্স লিছিলে আরকি! তার কারণও ছিলে। দারোগা শালার ব্যাটা শালাক এক দিন কাচারিপাড়ায় মটর সাইকেল থেন নামা লিয়ে খুব থেরেট করিছিলেম। সেইথেন আমার পর দারোগার রাগ ছিলে।’

কথা বলতে বলতে দুলু আর খলিল পৌঁছে গেছে লাইব্রেরি বাজারে। মোড়ের ওপরে ট্রাফিক আইল্যান্ড। একলাফে ট্রাফিক আইল্যান্ডে উঠে খলিল শুয়ে পড়েছে চিৎ হয়ে। তার চোখ বন্ধ। তার গলায় গান—ম্যায় তো রাস্তে সে যা রাহা থা, ম্যায় তো ভেলপুরি খা রাহা থা…!

দুলু এখন উত্তেজনায় খলিলকে খোঁচাচ্ছে বার বার, ‘হাজত থেন ছাড়া পালু ক্যাম্বা করে, ক!’

ট্রাফিক আইল্যান্ডে শুয়ে শুয়ে খলিল বলছে, সেটা খুব সোজা হিসাব। বিল্লাহ আগে থেকেই পুলিশকে টিপে রেখেছিল। রত্নার বাপ এসে দারোগাকে অনুরোধ করেছিল: এই ঘটনার কেস হলি পরে আমার মান-সম্মান সব ডুবে যাবিনি ভাই! চাপে যান! পুলিশ চেপেও গেল। মামলা না-নিলে পরে তো পুলিশই বেঁচে যায়—তাই না? মামলাও পরিচালনা করতে হ’ল না, মাঝখান থেকে শালার দারোগা রত্নার বাপের টাকা খসিয়ে নিল! রত্নার বাবাকে বিল্লাহই টাকাটা দিয়েছিল কিনা তা অবশ্য জানে না খলিল। এদিকে ছেড়ে দেয়ারে আগে দারোগা খলিলকে প্রচণ্ড বকাবাদ্যি করল; তারপর তাকে হাজত থেকে ছেড়েও দিল। তবে হাজত থেকে বের হয়ে আসার দিনই খলিলের সর্বনাশটা করে দিল বিল্লাহর বাচ্চা বিল্লাহ!

সেটা কেমন?

খলিল দুলুকে জানাচ্ছে যে কয়েদখানা থেকে ছাড়া পাওয়ার দিন বিকালবেলায় তাদের বাড়িতে বিল্লাহ এসে উপস্থিত। তার পকেটে খলিলের পাওনা চল্লিশ হাজার টাকা। তবে চল্লিশ হাজার টাকাটা খলিলকে দেয়া হবে এক শর্তে—কাল ভোরেই অনির্দিষ্ট কালের জন্য খলিলকে পাবনা টাউন ছেড়ে চলে যেতে হবে অন্য কোথাও।

বিল্লাহর শর্ত শুনে আর্তনাদ করে উঠেছিল দুলু: সেকি বিল্লাহ ভাই? নিজের বাসাবাড়ি ছেড়ে কোথায় যাবটা আমি?

বিল্লাহ তখন বলেছিল, সে চায় না, মানুষজন কোনোভাবে খলিলকে উসকে দিয়ে রত্না হাইজ্যাক হওয়ার আসল ঘটনাটা বের করে ফেলুক! স্বাভাবিক অবস্থায় না-হোক, শরাব খেয়ে সেকথা খলিল তো কাউকে না কাউকে বলে ফেলতেই পারে!  বিল্লাহ এভাবে এই পাবনা টাউনে তার নিজের ভাবমূর্তি কিছুতেই নষ্ট হতে দেবে না।

হাতজোড় করে পুনরায় বিল্লাহকে অনুনয় জানিয়েছিল খলিল: আরেকবার ভেবে দেখেন বিল্লাহ ভাই, বাপ-মা ছেড়ে থাকব কী করে? অন্য কোথাও গিয়ে কাজকামই বা কী করব আমি?

কিন্তু খলিলের অনুনয় আমলে নেয়নি বিল্লাহ। বিল্লাহ তাকে বলেছিল: প্রস্তাব না-মানলে তুই টাকার টাকা তো পাবিই না, জানটাও খোয়াবি এখনই!

হ্যাঁ, কাউকে খসিয়ে দেয়ার কায়দা বিল্লাহর ভালই জানা ছিল। তাই ভয় পেয়ে গিয়েছিল খলিল। কাটা রাইফেল নিয়ে এপাড়া-ওপাড়ায় মারামারি করার সময়ও কোনো দিন তার এত ভয় লাগেনি। তো ছোট ভাইয়ের হাতে চল্লিশ হাজার টাকা দিয়ে পর দিন ভোরে পাবনা টাউন ছেড়েছিল খলিল। যাবার সময় খলিল তার মা’কে বলেছিল যে সে ক’দিনের জন্য বেড়াতে যাচ্ছে ঢাকায়। জলদি বাড়ি ফিরে আসবে সে। তারপরের ঘটনা তো দুলুর জানা।

এই মুহূর্তে লাইব্রেরি বাজারের ট্রাফিক আইল্যান্ডে চিত হয়ে শুয়ে আছে খলিল। হঠাৎ এক মোচড় দিয়ে সে আইল্যান্ড থেকে উঠে পড়ে। টাল সামলাতে না-পেরে সে কানি খায় একটা। তারপর আইল্যান্ডের পোল ধরে সে সোজা হয়ে দাঁড়ায় কোনোরকমে। পোল ধরে দাঁড়িয়ে তর্জনী শূন্যে তুলে চেঁচাতে শুরু করে খলিল, ‘এহুন আর শাঁইয়ের বিল্লাহক আমি ভয় পাইনে! আর আমি বাড়ি ছাড়ে থাকপ লয়। ও শালা আমাক কিছু করার আগেই ওয়েরই মাথার খুলি আমি উড়া দেব কাটা রাইফেল মারে। আমাক তো চেনে না!’

খলিলের আস্ফালন দেখে জিজ্ঞাসা করছে দুলু, ‘খুব তো ফাল পাড়তিছিস? অস্তরপাতিগুলেন রয়ছে নেকি অলরেডি সব বেচে খাইছিস?’

মাথা নিচু রেখে খলিল দুলুকে বলছে, ‘সে দুঃখির কথা আর কইসনে ভাই! অস্তরপাতি একখেনও নেই! আমি যহুন মাস্তানি ছাড়ে দিলেম, তার পর পরই বিল্লাহ সব ফিরত লিয়ে গিছিলে। পাবনা টাউনির কানেকশনগুলেও লষ্ট হয়ে গেছে সব! এহুন কি আর কোনো শালা আমাক কাটা রাইফেল দিবিনি? আমাক এহুন পোছে কিডা?’

তা’লি পরে দাপাচ্ছিস কীকামে?

কী আর করব, ক? বিল্লাহক কুপা ভাঁজ করে ফেলাবের পারলি পরে জানডা ঠাণ্ডা হতে আমার!

শঙ্কিত দুলু তার বন্ধুকে বলছে, ‘দেহিস ব্যাটা! বিল্লাহ কইল আরো বেশি পিচেট হয়ছে! তুই পাবনা ছাড়িছিস পরে কত জনেক যে খুন করে ময়লাগাড়িত ফেলা দিয়ে আইসলে এই শালার বিল্লাহ! উয়ের ল্যাজে পারা দিবের যাইসনে যিন! তুই চিটাগাং চলে যা গা! তোর জন্যি এহুন চিন্তেই হচ্ছে আমার!’

খলিল হাসতে হাসতে দুলুকে বলছে, ‘আমার জন্যি চিন্তেই করিসনে তুই! সে কাম আইজ আমি সারে আইছি।’

তার মানেডা কি? খলিলকে প্রশ্ন করছে দুলু।

মানে হ’ল, আজ সন্ধ্যায় খলিল গিয়েছিল বিল্লাহর ট্রাক-বাসের গ্যারেজে। তাকে দেখে বিল্লাহ তো অবাক! তারপর আড়ালে ডেকে নিয়ে বিল্লাহ খলিলকে বলেছিল: তুই আবার পাবনায় আইসপের গেলু ক্যা? আইসপের মানা করেছিলেম না তোকে?

নিজের বাড়িতে আসপ না তো কী করব? বিল্লাহকে পাল্টা প্রশ্ন করেছিল খলিল।

খুব সাহস হয়ছে তোর দেখা যায়?

বিল্লাহর সেই প্রশ্নের পিঠে খলিল কোনো উত্তর দেয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। বরং সে ঘোষণা দিয়েছিল, সে এখন থেকে পাবনা টাউনেই থাকবে। তা’তে কার বাপের কী?

হতভম্ব হয়ে বিল্লাহ দুলুকে বলেছিল, ‘আবার বাপ তুলেও কথা বলা হচ্ছে? শালা হারামখোর! এর পরিণামডা কি হবি তা তুই জানিসনে?’

ভয় দেখাইচ্ছেন নেকি বিল্লাহ ভাই?

হ! ভয়ই দেখাচ্ছি তোক!

তারপর বিল্লাহকে উল্টো সাবধান করে দিয়েছিল খলিল। খলিল বলেছিল, ‘আমার সাথ ঝামেলা বাঁধালি পরে আমিও ঝামেলা পাকা দেব ইবার!’

কী বল্লু তুই? ছোট মুখে বড় কথা কচ্ছিস!

কলেম যে ঝামেলা করলি পরে রত্না হাইজ্যাক হওয়ার আসল নায়ক যে আপনে তা আমি পাবনা টাউনের সবাইক কয়ে দেব!

খলিলের কথা শুনে বিল্লাহ আরো ক্ষেপে গিয়েছিল তখন। খলিলকে সে প্রশ্ন করেছিল: আমার পলিটিকাল ক্যারিয়ার ডুম করে দিয়ার ধান্দা লিছিস তুই, তাই না?

জবাব দিয়েছিল খলিল: কার ক্যারিয়ারের কী হ’ল কী না-হ’ল, সেটা জানার কোনো প্রয়োজন আর তার নেই। পাঁচ-পাঁচটা বছর ধরে সে পাবনার বাইরে বাইরে থেকেছে এই বিল্লাহর পলিটিকাল ক্যারিয়ার ঠিক রাখার জন্য! ব্যাস! আর না! আরো বেশি ঝামেলা করলে খলিল সত্যিই গিয়ে বিল্লাহর বিরোধী গ্রুপের সাথে হাত মেলাবে!

একথা শুনে রেগে আরো রেগে গিয়েছিল বিল্লাহ। খলিলকে সে ভয় দেখিয়েছিল: আবারো কচ্ছি, দুইদিনের মধ্যি পাবনা টাউন ছাড়ে চলে যাবু তুই! আর কোনো দিন যদি তোক পাবনা শহরে দেখি তা’লি পরে তোর লাশ পড়ে থাকপি ময়লাগাড়িত!

তা শুনে খলিল হো-হো করে হেসে উঠেছিল আর বিল্লাহকে সে বলেছিল. ‘ফাইনাল কথা হ’লে, কেউ যিন পাবনা টাউনে আমার ফিরে আসা লিয়ে কোনোরকম ঝামেলা না-করে!’

এটুকু বলে খলিল থামছে। খলিলের এসব কথায় তখন ধন্দে পড়ে গেছে দুলু—ঠিকঠাক কথা বলছে তো খলিল? মাতালের কথায় আর বিশ্বাস কি? তবু বিল্লাহর শক্তিময়তার কথা মনে হয়ে তখন সত্যিই ভয় পেয়ে যাচ্ছে দুলু। খলিলের শেষকথা শুনে তাই সে আর্তনাদ করে উঠছে, ‘এ কী সব্বোনাশে কাম করিছিস তুই? বিল্লাক তুই চটা দিছিস? তোর কথা শুনে আমার পালপিটিশন বাড়ে যাচ্ছে ব্যাটা!’

দুলুকে অভয় দিতে খলিল বলছে, ‘ঠিকই করিছি! বিল্লাহ শালা আমার বালও ছিঁড়বের পারবিনানে, দেহিস! আমি আর কোনো কিছুত ভয় করিনে!’

তবু দুলু তার শঙ্কা ব্যক্ত করছে, ‘খৈল শোনেক, তুই কইল বিল্লাহক আন্ডার এস্টিমেট করতিছিস! খুনটুন করে ফেলানে উয়ের জন্যি ওয়ান-টু’র কাজ!’

খলিল দুলুর সেই শঙ্কার কথা পাত্তাই দিচ্ছে না। উল্টো দুলুকে সে বলছে, ‘বুদ্ধি একখান বাইর করিছি ব্যাটা! কাইলই আমি কিষ্টুপুরের আজমের সাথ কথা কব। বিল্লাহ বোঝতেছে না যে সেরের পরো সুয়া সের থাইকপের পারে! আজম আমাক শেল্টার দিবিই দিবি!’

আজম কৃষ্ণপুরের সন্তান। তার সাথে বিল্লাহর শত্রুতা দীর্ঘদিনের। লাইব্রেরি বাজারের দখল নিয়ে দু’দলের ভেতরে আজকাল প্রায়ই সংঘর্ষ হচ্ছে। কিন্তু দুলু তো জানে যে আজমও তো কোনো সুবিধার মানুষ নয়! তার হাতেও রক্তের দাগ স্পষ্ট। আজম আর বিল্লাহ একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। খলিলকে নিয়ে তাই দুর্ভাবনা শুরু হয়েছে দুলুর ভেতরে। উৎকন্ঠার গাঁদ থেকে সে উঠতে পারছে না কিছুতেই।

পুলিশ লাইনের সময়সূচক ঘন্টা বেজে উঠছে ফের। এখন ভোর চারটা। লাইব্রেরি বাজার থেকে পশ্চিমে যাবে দুলু আর দক্ষিণে খলিল। বিযুক্ত হওয়ার আগে লাইব্রেরি বাজারের মোড়ে দাঁড়িয়ে তারা দিনের শেষসিগারেট ধরাচ্ছে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে এই মুহূর্তে নেশার ঘোরে টলছে খলিল। দুলু বুঝতে পারছে, দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্টই হচ্ছে খলিলের।

সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে দুলু মাতাল খলিলকে পরামর্শ দিচ্ছে, ‘একটা কথা কই? চিটাগাং চলে গিলি পরে কি ভাল হতে না? হোনে তো তোর বউ-মিয়ে রয়ছে! বাপ-মা’কও ওখেনে লিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেক না কীকামে? তা’লি তো আর তোর পাবনা টাউনে থাকে যাওয়ার দরকার পড়তেছে না! বিল্লাহর সাথে ভেজালে যায়ে লাভ কী ভাই? জান খুয়াবের চাইস নাকি তুই?’

দুলুর দিকে আঙুল তুলে নেশা জড়ানো গলায় শাসাচ্ছে খলিল, ‘বেশি কথা কইসনে তো দুলু! কহুন থেন ফ্যাঁচফ্যাঁচ করেই যাচ্ছিস! সুজা কথা শোনেক, পাবনা টাউন ছাড়ে আমি আর কুথাও যাচ্ছিনে, লাখ ট্যাকা দিলিও না!’ ফের প্রত্যয় জেগে উঠছে মাতাল খলিলের গলায়।

এই মুহূর্তে রাস্তার পশ্চিমদিকে অন্ধকারের ভেতরে দাঁড়ানো দু’জন পুলিশ থেকেথেকেই লক্ষ করছে খলিল আর দুলুকে। খলিল মাতাল বলেই হয়ত পুলিশরা তাদেরকে জিজ্ঞাসা করছে না কিছু।

লাইব্রেরি বাজারের মোড় থেকে সোজা দক্ষিণে হেঁটে গেলে খলিলদের সাধুপাড়া। আর লাইব্রেরি বাজারের এই মোড় থেকে ডানে উদ্দিনের গলিতে ঢুকে যাবে দুলু। দক্ষিণে হাঁটা দেয়ার আগ মুহূর্তে খলিল দুলুকে বলছে, ‘কাইল সাঁঝের বেলা বাণী হলের পর যাবনে। তুই তো দুকানেই থাকপু। দেহা হবিনি তহুন।’

দু’গজ মতো এগিয়ে আবার হাসতে হাসতে ফিরে আসছে খলিল এবং সে পুনরায় ঘোষণা দিচ্ছে, ‘আমি কইল পাবনা টাউন ছাড়ে কুথাও আর চলে যাচ্ছিনে, বুঝলু তো?’

তারপর হাসতে হাসতেই সে দুলুকে বলছে, ‘তুই জলদি বাড়িত চলে যা গা! তোর সুহাগী বউ আইজ তোক মারে তুলে ধুনা করবিনি! লগর হবিনি ব্যাটা! পিঠে ছালা বাঁধে বাড়িত যাইস।…নাহ্! গিলেম। তোক দেখলিই এহুন ক্যাম্বা যিন খালি হাসি উঠে আসতেছে!’

রাস্তার পাশে দাঁড়ানো পুলিশ দু’জনকে স্যালুট মেরে টলোমলো পায়ে কুইক মার্চ করতে করতে দক্ষিণে সাধুপাড়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে খলিল—লেফট রাইট, লেফট রাইট, লেফট…।

লাইব্রেরি বাজারের মোড়ে দাঁড়িয়ে বন্ধুর প্রস্থানের দিকে দুলু আনমনে তাকিয়ে আছে।

একসময় অন্ধকারের ভেতরে মিলিয়ে যাচ্ছে খলিল।