ডুগডুগির আসর, ছিন্নমূল মানুষের বেঁচে থাকার কান্না
মোস্তফা অভি
প্রশান্ত মৃধা ডুগডুগির আসর উপন্যাসে সমকালীন রাজনৈতিক আবহের সঙ্গে সঙ্গে নাগরিক নিম্নপেশার মানুষের শ্রেণিচেতনা, বঞ্চনা, প্রেম এবং জীবন-জীবিকার কথা বলেছেন। এ-উপন্যাসে তিনি মজমাওয়ালা, খেলাওয়ালা, ক্যানভাসার পেশার মানুষের অনবদ্য যে-জীবনচিত্র এঁকেছেন তা যে-কোনো পাঠককে আগ্রহী করে তুলবে। ১৫৯ পৃষ্ঠার বইটি প্রকাশ করেছে “কথা প্রকাশ”। বইটির বিনিময় মূল্য ২০০ টাকা।
উপন্যাসের প্লট বাগেরহাট আদালত চত্বর থেকে শুরু হয়ে লঞ্চঘাট, নাগেরবাজার, মোরেলগঞ্জ, ফকিরহাট হয়ে সেই পিরোজপুর। আবার মংলা রোড, কাটাখালি হয়ে কাহিনির প্রেক্ষাপট খুলনা পর্যন্ত বিস্তৃত। আছে উপন্যাসের চরিত্রের সঙ্গে মিশে থাকা হরেক মানুষের জীবনালেখ্য, যা শুধু একটি নির্দিষ্ট সীমারেখায় আটকে থাকে না; স্থানিকতার সীমা পেরিয়ে হয়ে ওঠে সকল স্থানের, এমনকি পুরো দেশের।
গত শতকের আশির দশকের শেষদিকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, দ্বন্দ্বময় সমাজের নৈরাজ্য, মফস্বল শহরের নিম্নবিত্ত মানুষের মনোজগৎ, এমনকি নাগরিক নিম্নবিত্ত মানুষের অস্তিত্বের সংকট ইত্যাদিকে লেখক নিপুণ দক্ষতার সাথে উপন্যাসে তুলে এনেছেন। এরশাদ সরকারের শাসনামলে মফস্বল শহর বাগেরহাটের ট্রেন তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আদালত চত্বরে পেট ও পেশার দায়ে অভুক্ত মানুষগুলোর মুখে ফুটে ওঠে চিন্তার ভাঁজ। এমনিতেই আদালতের কাজকর্ম উপজেলায় স্থানান্তরিত হয়েছে। সে-কারণে আয়-রোজগার কমে গেছে সাধারণ পেশার মানুষের। তার ওপর রেললাইন উঠে গেলে তাদের অন্নের সংস্থান আর থাকে না। উপন্যাসের একপর্যায়ে আমরা মফিজ শেখ স্বরচিত কবিতা পড়ে আদালত চত্বরের মানুষকে শোনায়,
শোনেন শোনেন শোনেন, শোনেন দিয়া মন,
ও বাগেরহাটবাসী আর থাকপে না টেরেন।।
বাগেরহাট থেকে রেললাইন তুলে দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্তের বিপক্ষে আন্দোলনে নামে সাধারণ মানুষ-স্থানীয় ছাত্রসমাজ। একসময় টনক নড়ে সরকারের। ট্রেন কলেজস্টেশনে থামার সিদ্ধান্ত হয়। আন্দোলনের সময় আটককৃতদের ছেড়ে দেওয়া হয়। উপন্যাসে বিধৃত কাহিনিতে আশির দশকের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিস্ফুটিত হয়ে ওঠে। সমকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক পট-পরিবর্তনের যে চিত্র, লেখকের অর্ন্তলোকে তা ধরা দিয়েছে সেই বাস্তবতার চিত্রায়ণ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠে উপন্যাসের পাতায়।
আছে বাগেরহাটের ইতিহাসের কথা। জনৈক রবার্ট মোরেল নামক ইংরেজ পত্তনি নিয়ে আসেন খুলনা-বাগেরহাট জনপদে। স্থানীয় ভূস্বামী রহিম শেখের সঙ্গে তার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। তাতে নিহত হয় রহিম শেখ। এই মামলাটি যখন বিচারাধীন তখন তৎকালীন খুলনা মহকুমার ম্যাজিস্ট্রেট বঙ্কিমচন্দ্র চট্রোপাধ্যায় মোরেলগঞ্জ আসেন। তিনি কলকাতায় ফিরে গিয়ে মোরেলগঞ্জে একটি থানা স্থাপনের সুপারিশ করেন। সেই থানার প্রথম প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের বন্ধু গৌরদাস বসাক।
নাগরিক জীবনে মাটির কাছে বসবাস করা মজমাওয়ালা ক্যানভাসারদের সংগ্রামী জীবনের আখ্যান বিধৃত হয়েছে উপন্যাসজুড়ে। এই শ্রেণির মানুষের নিরুৎসব জীবনে আনন্দ নেই। ভালোভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্ন নেই, আছে সীমাহীন জীবনের ক্লেদ। প্রাণান্ত পরিশ্রমে খেলা দেখানোর সব কৌশল ব্যবহার করে দিনশেষে তারা যা উপার্জন করে তা দিয়ে জীবন নির্বাহ করা সত্যিই কঠিন। বর্ষার দিনে প্রকৃতির বিষণ্নতায় চরাচর যখন বৃষ্টির কান্নায় ভেঙে পড়ে, তখন নাগরিক জীবনে নিম্নশ্রেণির এইসব পেশাওয়ালাদের দুর্ঃখ দুর্দশার সীমা থাকেনা। তখন বন্ধ থাকে তাদের পেট-চালানোর ধান্ধা। কোনো দিন মানুষগুলোর অভুক্ত সময়ই কেটে যায়।
মফস্বল থেকে আদালত চত্বরে প্রতিদিন বিভিন্ন পেশার মানুষ আসে মামলা-মোকদ্দমার কাজে। আদালত চত্ত্বরে বেহুদা মানুষের সমাগম ঘটে। অফিস-কাছারির কাজ ফুরালে জনশূন্য হয়ে পড়ে চত্বরটি। শুধু বিভিন্ন কোণায় পড়ে থাকে পেট আর পেশার দায়ে ব্যতিব্যস্ত মানুষগুলো। তাদের সামগ্রিক পরিচয় ক্যানভাসার। তারা আদালত চত্বরে ডুগডুগি বাজিয়ে, মুখে আউ, আউ শব্দ করে লোক জড়ো করে। কথার জাদুতে মানুষের কাছে বিক্রি করে নিজেদের তৈরি কাপড় ধোয়ার পাউডার। এদের মধ্যে কেউ দেখায় বানরের খেলা। কেউ আবার হাতের কারসাজিতে মানুষকে বিনোদন দিয়ে পয়সা চায়। মজমার আশপাশে ঘুরঘুর করে কান খেঁচানোর বাক্সওয়ালা, একটু দূরে রোগীপত্রের অপেক্ষায় থাকে দাঁত তোলার পথের ডাক্তার। সেইসঙ্গে দেখা মেলে যৌনশক্তিবর্ধক তেল-বিক্রেতার। এইসব চরিত্রের কাজ ভিন্ন হলেও তাদের অন্তরের ইরাদা এক, তারা ভূখা পেটে, ঘোলাদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে উদ্দেশ্যহীন পথ চলা মানুষের দিকে।
আদালত চত্বরের কিণারে নিভৃতে বসে থাকে বই-বিক্রেতা বারিক বুড়ো। আরো আছে মেঘনিশ গাছটি ছাড়িয়ে ছোট কাছারি ঘরে পেশাদার টাইপিস্ট মানুষগুলো। এছাড়া উকিল, মুহুরি এবং সাধারণ মানুষের ভিড়ে মিশে থাকে একশ্রেণির দালাল। আরো দেখা মেলে ভাসমান কয়েকজন মেয়েমানুষের।
উপন্যাসের চরিত্রগুলোর মধ্যে মোসলেম উদ্দিন, আজগর, সুকুমার, দিলদার, আলতাফ, ইব্রাহিম শেখ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আছে দুই নারী চরিত্র জরিনা আর ঝিলিক। চরিত্রগুলোর এককভাবে নির্দিষ্ট কোনো কাহিনি নেই। প্রত্যেকের জীবনচিত্র আলাদা অথচ কোন গোপন সুতোয় যেন একসাথে বেঁধে রাখে সবাইকে। তাদের ভিন্ন ভিন্ন কাহিনী বিভিন্ন বাঁক ঘুরে মিশে যায় একই কেন্দ্রবিদুতে।
পোশাকে ধোপদুরস্ত মোসলেম উদ্দিন আদালত চত্বরের প্রতিনিধি। সে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে মেঘনিশ গাছের ছায়ার নিচে অপেক্ষা করে লোক সমাগমের। মানুষ জড়ো হলে সে কাপড় ধোয়ার পাউডার বিক্রির ক্যানভাস করে। মোসলেম উদ্দীনের আসর ভেঙে গেল আদালত চত্তর ঝিমিয়ে পড়ে। দুটো বুড়া-থুরা বাঁনর নিয়ে সেখানে দাঁড়ায় মলিন বস্ত্রবেশধারী আসগর। সে বানরদুটোকে নাচায় আর বলে, এই যে ল্যাঙেরা পাহাড়ের বুড়া-থুড়া যায়!
মেট্টিকপাশ সুকুমার যখন যখন কথার ঝুলি নিয়ে দাঁড়ায় তখন মেঘনিশ গাছের ছায়ায় স্তব্ধতা নামে। সে হাতের কারসাজি দেখিয়ে শিক্ষিত বচনে কথা বলে আসর জমিয়ে ফেলে। মোসলেম উদ্দীন সেই দৃশ্য দেখে হাসে।
তবু দিনশেষে এসব ছিন্নমূল মানুষের মাথা গোঁজার নিশ্চয়তা নেই, পেটপুরে ভাত জোটেনা। যেন জীবনটা আছে বলেই জীবনকে একরকম টেনে নেয়া।
লঞ্চঘাট ছাড়িয়ে একটি দোকানের পাশে আজগরের ঝুপড়ি। সে বাঁনরের েসাথে থেকে বুনো জীবনযাপনে অভ্যস্ত। ফোঁকলা দাঁতে হাসলে তাকে বিদঘুটে দেখায়। জটা চুলগুলো পাটের আশের মত তার ঘাড় বেয়ে নামে। যেন বুড়ো বাঁনরদুটোর মত জীবনযুদ্ধে পরাজিত সে। লেখক আজগরের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন,– ‘জীবনটা কোর্টের চত্বরে, লঞ্চঘাটে, রেলস্টেশনে, বান্দরের পাছায় কুরুত দিয়ে কাটিয়ে দিল। এই জীবনে কোনোদিনও চালের তলায় মাথা দিল না, মেয়েমানুষ প্রায় গায়ের কাছে ঘেঁষতে দিল না।’
কিন্তু আজগরের এই ছন্নছাড়া জীবনেও জুড়ে যায় অনির্দিষ্ট গন্তব্যের জরিনা। আজগরের মনে হয়,-এই যে জরিনা তার সঙ্গে আছে, থাকুক। তার গায়ের রং কালো, দাঁত নেই, দলা পাকানো চুল, বানর নাচানো আজগরকে যদি তার ছেড়ে যেতে মন চায় তো চলে যাক। যখন সন্ধ্যায় আদালত চত্বর থেকে আজগরের ঝুপড়ির সামনে জরিনা আসে আজগর তখন তাকে বলে, ‘আচো থাহো। যদি কোনওদিন চইলগা যাইতে মন চায় চইলগা যাবা। কিন্তু কয়দিন থাইয়া ওই ঘর করার বাসনা চোদাবা না।’
আজগর সংসারবিরাগী। জরিনাকে নিয়ে একসঙ্গে থাকার স্বপ্ন তাকে আকৃষ্ট করে না। দুটো বানর নাচিয়ে সে জীবনের উদ্দেশ্যহীনভাবে পার করে দেয়। আর জরিনাও বন্ধনহীন স্রোতের শ্যাওলার মতো ভাসতে ভাসতে কেমন আজগরের সঙ্গে থেকে যায়। সে ছন্নছাড়া আজগরের দুঃখে সে কাতর হয়, তার অসুখে প্রাণান্ত সেবা করে। আজগর জ্বরে পড়লে মোসলেমকে ডেকে আনে, সুস্থ করার জন্য ব্যস্ত হয়। আবার জ্বর সেরে গেলে ভরা জোয়ারের জল দিয়ে আজগরকে গোসল করিয়ে দেয়। রাতে ঝুপড়িতে শুয়ে শুয়ে দুজন খুনসুটিতে মাতে। তাদের সভ্যতাবর্জিত জীবনের ক্লেদাগ্ধ কাহিনী সম্পর্কে লেখক বলেন, ‘জরিনার চোখ আবার ঘুমে জড়িয়ে আসে। কিন্তু আজগর না আসা পর্যন্ত আর সে ঘুমাবে না। কিন্তু চাইলেই কী তা হয়। কোনও কোনও দিন সে আজগরকে একেবারে নিঃস্ব করে দিতে চায়, কোনও দিন আজগর তাকে নিঃস্ব করে দেয়, একেবারে শরীরে তখন আর বল ভরসা থাকে না। এই নিঃস্ব করে দেওয়ার কায়দাটা বুড়ো ভালোই জানে।’
ওদিকে মোল্লারহাটের ভক্তের মামাত ভাই সুকুমার। সে এখানে সেখানে ফুটবল খেলে সময় পার করে দেয়। ম্যাট্রিক পাশ করে খেলার নেশায় আর পড়াশোনা হয়ে ওঠেনি তার। একদিন খুলনায় গিয়ে ভক্ত আর ঝিলিকের সংসারে সে অনাহূতভাবে থাকতে শুরু করে। যদিও খুলনায় সে বউদি ঝিলিককে নিয়ে আসে। ভক্ত কাজ করে বাইরে, সুকুমার প্রাইভেট পড়ায় আর বউদির সঙ্গে নিত্য রঙ্গ করে। লেখক বলেন,
”ছাপরায় ঢুকে সুকুমার গামছা খুঁজতে খুঁজতে বলে, ‘হ্যাঁ মাইজে বউ, আমি তোমার মতো খেলোয়াড় নাকি?
– আমি আবার কবে খেলোয়াড় অইলাম, শুনচি তুমি খেলা দেখাও বল দিয়ে।
সুকুমার হাসে। ঝিলিক হাসতে হাসতে ছাপরায় ঢুকে একই হাসিমুখে সুকুমারের দিকে তাকায়। সুকুমার বলে, ‘তুমি খেলা দেখাও ভক্তদারে। আমি মানুষেরে দেখাই এক বল দিয়ে, তুমি দেখাও দুই বল দিয়ে।’
‘আইজ পিঠে সত্যি সত্যি গরানের চলা ভাঙব, দেওরা!’ … ঝিলিক সুকুমারের শরীরে লেপ্টে যায়। অথবা সুকুমার তাকে লেপ্টে ফেলে, এমনকি এই স্মৃতি আরো বহুদিন মনে থাকে ঝিলিকের। এমন নিঃস্ব তাকে কোনওদিনও করেনি ভক্ত।’
এই নিঃস্ব হওয়া না হওয়ার মাঝে ভক্তের বউ ঝিলিকের সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে মিশে যায় সুকুমার।জীবনটা যেন একটা আকস্মিক স্রোত, কোথা থেকে মানুষকে কোথায় নিয়ে ঠেকায় কেউ জানে না।
একদিন সুকুমার রেলস্টেশনের কাছে সার্কাসের প্যান্ডেলে খেলা দেখে। তার মনে বাসনা জাগে ফুটবল খেলার যে ক্যারিশমাটা সে জানে সেটা সার্কাসে দেখানোর। বল এক পা থেকে অন্য পা, তারপর হাঁটুতে, ঊরুতে, ঘাড়ে, মাথায়। এই একটা খেলাই জানে সুকুমার। খেলা দেখানোর নেশায় সে একদিন চলেও যায় ভক্ত আর ঝিলিকের সংসার ছেড়ে। অনেক জায়গা ঘুরেটুরে সুকুমার যখন যশোর, তখন সে জানতে পারে, ভক্তদা এক মহিলাকে নিয়ে ইন্ডিয়ায় নিরুদ্দেশ। ছেলে ভরতকে সঙ্গে নিয়ে গেছে। আর ঝিলিক? সে স্বামী হারিয়ে, ছেলে হারিয়ে দিশেহারা। অবশেষে খবর পায় পথের দেবর সুকুমারের। তারপর একদিন সন্ধ্যায় মোরেলগঞ্জের লঞ্চে আসে বাগেরহাট। তারপর কিছুদিন থাকেও সুকুমারের সঙ্গে। পরে ঝিলিক চলে যায় ছেলের সন্ধানে। ঝিলিক যেন স্রোতের টানে চলে আসে আবার স্রোতের টানেই ফিরে যায়।
ডুগডুগির আসর উপন্যাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র বই-বিক্রেতা বারিক। যদিও লেখক এই চরিত্রটি সংযমের সঙ্গে রূপায়িত করেছেন কিন্তু চরিত্রটির রহস্য অনেক। বারিক বুড়ো মেঘনিশ গাছের তলায় বই বিক্রি করে। সারাক্ষণ তন্দ্রাচ্ছন্ন ঢুলুঢুলু করে। ঘুমজড়ানো চোখে বইয়ের পসরা সাজিয়ে চুপ করে বসে থাকে। মোসলেম, আজগর, সুকুমার, জরিনা এমনকি ঝিলিক এসে মাঝেমধ্যে বারিক বুড়োর কাছে পরামর্শ চায়। বারিক বুড়োর বইয়ের তলা থেকে কেউ যৌনরসাত্মক চটি বের করলে সে চোখ খুলে তাকায়। যেন তার বন্ধ চোখের আড়ালে আছে তৃতীয় নয়ন। সবাই তার কাছে সমস্যা নিয়ে আসে, আলাপ করে। যেন লোকটি আদালত চত্বরের একটি বটবৃক্ষ অথবা একজন বিবেক। প্রতীকী অর্থে খেয়াল করলে দেখা যায় বারিক বুড়োই ছিন্নমুল মানুষগুলোর প্রতিনিধিত্ব করে। সেই অর্থে উপন্যাসে বারিক চরিত্রটি একজন মূক-পথনির্দেশক।
উপন্যাসের ভাষাবৈচিত্র নিয়ে দু-চার কথা না বললে মনে হয় কিছু একটা বাদ থেকে যায়। এই উপন্যাসের ভাষা ব্যবহারে আমরা নতুন এক প্রশান্ত মৃধাকে আবিষ্কার করি, যা তাঁর আগের সব লেখা থেকে স্বতন্ত্র। লেখক এখানে বাগেরহাট এবং তৎসংলগ্ন জনপদের সাধারণ মানুষের মুখের ভাষাকে ব্যবহার করেছেন সংলাপে, এমনকি আখ্যান বর্ণনায়।
চরিত্রের বিচারে কাউকে আলাদা বৈশিষ্ট্যের মর্যাদা দিয়ে নায়কের আসনে বসানো মুশকিল। মোসলেম আদালত চত্বরে ক্যানভাসারদের প্রতিনিধিত্ব করলেও উপন্যাসের শেষের দিকে তার কর্তৃত্ব প্রায় থাকে না। আজগরের পুরো উপন্যাসজুড়ে বিচরণ থাকলেও কোথাও কোথাও সুকুমার চরিত্রটি আজগরকে ছাপিয়ে আরো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সেই অর্থে আজগর এবং সুকুমার চরিত্রদ্বয় সমান মর্যাদার। তবে নারী চরিত্রে ঝিলিকের তুলনায় জরিনা জ্বলজ্বলে তারার মতো শেষ পর্যন্ত আলো ছড়াতে থাকে।
১৫৯ পৃষ্ঠার উপন্যাসটিতে ছিন্নমূল, পথের মানুষদের জীবনচিত্র এমনভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, নাগরিক জীবনের এই শ্রেণির মানুষকে নিয়ে এমন উপন্যাস ইতোপূর্বে হয়ত আর লেখা হয়নি।
=====================
মোস্তফা অভি
গল্পকার ও প্রাবন্ধিক
=====================