সুন্দরী
কাজী লাবণ্য
(১)
গাড়িটা থামলে মিলি তাকিয়ে দেখে পরিত্যক্ত পোড়ো বাড়িটা অপরূপ রূপ নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে আছে। অপার দৃষ্টিতে একবার বাড়ির দিকে একবার পাশে বসা মেয়ের উজ্জ্বল মুখের দিকে তাকায়। মেয়ে মিটিমিটি হাসে। বাড়ির একটা অংশ সংস্কার করা হয়েছে, নতুন করে শাদা রঙ করা হয়েছে। খাবলা ওঠা সিঁড়ি, বটপাকুড়ের আগাছায় ছাওয়া ছাদ, শ্যাওলা ধরা দেয়াল পরিষ্কার করে ঝকঝকে করা হয়েছে। ইলেকট্রিক পোলও দেখা যাচ্ছে। পূর্বে এখানে ইলেকট্রিসিটি ছিল না।
গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির দিকে পা বাড়ালে মেয়ে কোমল গলায় বলে, ‘মা চল আগে বাবাকে দেখে আসি’। মিলির চোখে বিস্ময় ফুটে উঠে। মেয়ের সাথে পা বাড়ায়।
গাড়ি থেকে নামানো হয় কিছু বাক্স, ব্যাগ, তৈজসপত্র, আর বড় বড় বইয়ের কার্টন। এখানে ‘প্রভাষক’ হিসেবে পোস্টিং হওয়াতে, মেয়ে, মা মিলিকে নিয়ে থাকতে এসেছে। আসার আগে কিছু কাজের তালিকা করে এনেছে।
তালিকায় প্রথমেই আছে- মায়ের জন্য একটি লাইব্রেরি বানানো, দাইমাকে কাছে এনে রাখা আর কয়েকজন সন্ত্রাসীর নামধাম ঠিকুজি খুঁজে বের করা।
ছাদে মা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেই কোনটিতে যেখানে গোলাপজাম গাছের ডালগুলি নেমে এসেছে ঝাপুর ঝুপুর। মেয়ে, তৃপ্ত মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে কয়েকটা রূপোলী চুলে অস্তগামী সূর্যের আলো চিকচিক করছে।
(২)
পঁচিশ বছর আগের এক পড়ন্ত বিকেল। ক্লান্ত সূর্যের নরম আলো তীর্যকভাবে আসছে গোলাপজাম গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে। সেই বিচ্ছুরিত আলোতে বিছানায় বসে জানালার শিকে হেলান দিয়ে তন্ময় হয়ে বইয়ের পাতায় ডুবে আছে মিলি। বাড়ির বড় মেয়ে। ক্লাস টেনে পড়ে, ক্লাসের খাতায় নাম লেখা আছে ‘মরিয়ম সুলতানা মিলি’। অনির্দিষ্ট কালের জন্য ক্লাস স্থগিত। লেখাপড়া নাই। একটা ঢাউস সাইজের বইয়ে ডুবে আছে কদিন ধরে। ছোটবেলা থেকেই বইয়ের পোকা। এখন সেটা আরও বেড়েছে। ক্লাসের পড়া শিথিল হওয়ায় আর মা, বাবা, শিক্ষক কারোরই কোনো অনুশাসন না থাকায় ইচ্ছেমতো বই পড়ে কাটাচ্ছে।
সারাদেশ যুদ্ধের অকল্পনীয় নিষ্ঠুরতা, অবর্ণনীয় দামামায় ক্ষতবিক্ষত। শহর, গ্রাম, অফিস, রাস্তা, সেতু, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সবকিছু আগুনে জ্বালিয়ে খাক করে দিচ্ছে পাক আর্মি।
চলমান যুদ্ধ নিয়ে একেকজনের আতংক, দুশ্চিন্তা একেকরকম। তবে সবাই মৃত্যু আতঙ্কে অস্থির। মিলি মরার কথা চিন্তাও করতে পারে না। সে ভাবে এখুনি কেন মরব? সমস্ত জীবন পড়ে আছে সামনে।
প্রাচীন আমলের বাড়ি, যৌথ পরিবার। শাদা মোটা থামের দোতলা বাড়িতে মিলির চাচারা মিলে অনেক মানুষের বাস। প্রাচুর্যময় বাড়িটাতে সবকিছুই প্রচুর। বাড়ির সদস্য বেশি, কাজের মানুষ বেশি, আহারের আয়োজন বেশি আর এই যে বইয়ের লাইব্রেরি সেখানে বইয়ের সংখ্যাও বেশি। মিলির সবচেয়ে পছন্দের জায়গা এই লাইব্রেরি ঘর। আজকাল দিনরাতের বেশিরভাগ সময় তার এখানেই কাটে।
লাইব্রেরি নিচতলায়। মা বলে দিয়েছে, বই নিয়ে উপরের ঘরে গিয়ে পড়তে। মাঝে মাঝে মিলি লাইব্রেরি ঘরে বসে বা দেয়ালের ধারে পাতা পালংকে জানালার শিকে হেলান দিয়ে পড়তে পছন্দ করে।
এখন উঠতে হবে মসজিদে আজান শুরু হবে। এসময় ঘরে থাকলে মা বকে। তবে কয়েকমাস ধরে যুদ্ধের কারণে মায়ের মন ভালো নেই। কোনোদিকে তাকানোর সময়ও নেই। উঠব উঠব করেও সে ভাবে এই পাতাটা শেষ করেই উঠবে, এমন একটা জায়গায় আছে ওরই বয়সি একটি মেয়ের মনোজগতের উঠানামা বর্ণিত হয়েছে। মিলির নিজেকে বইয়ের মেয়েটির মতো মনে হয়। মাঝে মাঝেই কারণে অকারণে ওর বুকের ভেতরও হুহু করে। কেন করে কে জানে। মিলি কাউকে কিছু বলে না। কিছুতেই উঠতে ইচ্ছে না করলেও সে মায়ের কথার অবাধ্য হয় না। বইয়ের ফাঁকে হাতে বানানো কাগজের তিনকোণা বুক মার্কার রেখে উঠে দাঁড়ায়। জানালাগুলো বন্ধ করতে থাকে।
নিচের বারান্দায় বিকেলের চা নাস্তা খায় ওরা। সেখানে বিভিন্ন ধরনের মৌসুমী ফল, নারকেল দিয়ে মাখানো মুড়ি, পিঠা, কাপে চা আর মগে দুধ থাকে, বড়রা চা খায় আর বাকি সবার জন্য দুধ বাধ্যতামূলক।
বাড়ির বড়রা নামাজ পড়তে চলে গেছে। মিলি পায়ে পায়ে সিঁড়ি বেয়ে ছাদে যায়। ছাদের একেবারে পশ্চিম কোণে যেখানে গোলাপজাম গাছের ডালগুলো এসে পড়েছে সেখানে দাঁড়িয়ে ডুবে যাওয়া সূর্যের রেখে যাওয়া শেষ লালিমার দিকে তাকিয়ে থাকে। কেন এতো যুদ্ধ! কেন এতো হানাহানি! যারা এই দেশকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দিচ্ছে, মানুষকে পিঁপড়ার মতো বুটের তলায় পিষছে, মেয়েদেরকে নানাভাবে অপমান নির্যাতন করছে তারাও তো মানুষ, আবার তারা মুসলমানও। তাহলে এই গণহত্যা করতে তাদের বিবেকে বাধছে না! ভেতর থেকে এক হাহাকারে ওর বুকটা দুমড়ে মুচড়ে যেতে থাকে।
হঠাৎ মনে হয় আচ্ছা মা কোথায়? কতক্ষণ থেকে সে মাকে দেখে না। দ্রুত পায়ে নিচে নামে। দোতলার কোণার ঘরে যেটা ওদের পড়ার ঘর সেখানে এখন ওরা সবাই মিলে রাত কাটায়। সেখানে মা জায়নামাজে বসে আছে। লম্বা ঘোমটার আড়ালে মা দীর্ঘ মোনাজাত শেষ করে হাত বাড়িয়ে মেয়েকে টেনে নেয়। মা জানে এই মেয়েটি বড় নরম। মা সাহস দেয়, ‘কি হইছে মা? মন খারাপের কী আছে? সব ঠিক হয়ে যাবে। কিছু খাইছিস’?
(৩)
বাড়িতে শরণার্থী ভরা। একতলা দোতলার প্রত্যেক ঘরে মানুষ। নিজেরা একটা ঘর রেখে বাকি সব ঘর মানুষের জন্য ছেড়ে দিয়েছে মিলির বাবা মা। মিলির বাবা ওর মাকে বলেছে, ‘তোমার কাজের লোক আরো বাড়াও, মানুষের যেন খাওয়া দাওয়ার অসুবিধা না হয়। তারা আমাদের আশ্রিত। নিজেদের সব ছেড়েছুড়ে জীবনটা হাতে নিয়ে এই অসহায় মানুষেরা আমাদের কাছে এসেছে’।
মিলির মা স্বামীর কথায় সায় দেয়। বাড়িতে বলতে গেলে শ’খানেক মানুষের তিনবেলা আহারের ব্যবস্থা হয়। নিজের সন্তানদের অযত্ন হচ্ছে কিন্তু কিছু করার নাই। মিলির দাদী বয়স্ক মানুষ তিনিও আশ্রিত মানুষের খোঁজ খবর রাখেন। তার ঘরে আশ্রয় নিয়েছে এক ডাক্তার পরিবার, তাদের দুই মেয়ে আর প্রতিবন্ধী এক ছেলে। মিলির মা-বাবার ঘরে আশ্রয় নিয়েছে এক দম্পতি তারা নাকি কোন শহরের ডিসি। তাদের একমাত্র সন্তানকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। স্বামী স্ত্রী খায় না, নায় না, কথাও বলে না। বাড়িতে তিল ধারনের জায়গা যখন নাই তখনও মানুষ আসে আশ্রয়ের জন্য। তাদেরকে বাইরের কাছারি ঘরে ঠাঁই দেওয়া হয়। সেখানে কয়েকজন ছেলেও থাকে।
একদিন ছাদে মিলি ওই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে শেষ বিকেলের আকাশে রঙের খেলা দেখছিল। সকালে ওরা সব চাচাত ভাইবোন মিলে বাইরের বকুল গাছের নিচে পড়ে থাকা ফুল কুড়িয়ে এনেছে, মালা গেঁথেছে, সেই মালা তখনও মিলির গলায়, হাতে। সব বোন ফুল কুড়িয়ে এসবই করে থাকে। এতক্ষন সে একটা বই পড়ছিল। বইটা হাতে নিয়েই আকাশ পানে তাকিয়ে আছে মুগ্ধতা নিয়ে। হঠাৎ পেছন থেকে কেউ একজন বলে, ‘কি বই এটা’?
মিলি চমকে পেছন ফিরে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায়। এমনিতেই এ বাড়ির অন্দরে কারো ঢোকার অনুমতি নাই। ছাদে তো নয়ই। মিলি কোনো উত্তর দেয় না। দেয় না মানে দিতে পারে না। ওর বিস্ময়ের ঘোর না কাটতেই ছেলেটি, ‘কাল আমিও তোমাদের সাথে ফুল কুড়াব’ বলে যেভাবে এসেছিল সেভাবে চলে যায়।
পরদিন ফুল কুড়ানোর সময় মিলি চারদিকে তাকায় কিন্তু ভাইবোন ছাড়া কারো দেখা পায় না। তবে বিকেলে সেই ছেলে আবার ছাদে ওঠে। তাদের মধ্যে অল্পকিছু কথাবার্তা হয়। ছেলেটি ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। ক্লাস চলাকালীন যুদ্ধ শুরু হয়েছে। ছেলেটিও বই পড়তে ভালবাসে। কিন্তু সে এখন বই পড়তে চায় না, এটা বই পড়ার সময় নয়। এটুকু বলেই দ্রুত নিচে চলে যায়। পরদিন ঠিক ওই সময়ে মিলির পেছনে আবার ছেলেটি এসে কথা বলা শুরু করে। এই প্রথমবার তারা পরস্পরের নাম জেনে নেয়। কিছু কথা হতে না হতেই মঞ্জু নামের ছেলেটি দাঁড়ায় না অস্থির পায়ে নেমে যায়। মিলির মনে হয় একটু থাকলে কথা বলা যেত। এমন ভাবনার মাঝে মায়ের ডাক শোনা যায়, ‘মিলি’!
মিলির বুক কেঁপে ওঠে। মা কি ওই ছেলেকে ছাদে উঠতে দেখেছে? কিন্তু মা এসে দ্রুত ওকে সাথে আসতে বলে। মিলির বুকের কাঁপুনি আরো বেড়ে যায়। সে মায়ের পিছে পিছে নেমে আসে। আজান হয়ে গেছে। সবাই নামাজে। মা সোজা ঘরের পেছনে গোলাপজাম গাছের কাছে যায়। মিলির অবাক লাগে। সেখানে বড়ভাই, মেজোভাই উপস্থিত এবং গাছের গোড়ায় একটা গর্ত। মা ওদেরকে ফিসফিস করে বলে, শোন…
(৪)
দু’দিন পরে পাক আর্মিরা গ্রাম ঘিরে ফেলে। মুক্তির ছেলেরা গ্রামে আছে এই অভিযোগে পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে ছাই করে দেয়। মিলিদের বাড়ির এতোগুলো মানুষ সবাইকে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয়। কেবল মিলিসহ বাড়ির কয়েকজন তরুণীকে বাঁচিয়ে রাখা হয়। যে বাঁচা মৃত্যুর চেয়ে ভয়াবহ।
মৃত্যু, সম্ভ্রম আর দুঃখের মহাসাগর পেরিয়ে বিজয় আসে। দেশ স্বাধীন হয়। বহু ক্ষতবিক্ষত অর্ধমৃত নারীকে বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে পুনর্বাসন কেন্দ্রে আনা হয়েছে। তাদের সেবা যত্ন চলছে, অন্তত পরনে কাপড় উঠেছে। একদিন এক শীর্ণ, ক্রাচে ভর দেয়া যুবক কেন্দ্রে আসে, কাকে যেন খোঁজে। অবশেষে খুঁজে পায় মিলিকে। তারপর নানা কাগজপত্রে সই সাবুদ করে ওকে সাথে নিয়ে আসে।
আবেগ আর যুক্তির যে লড়াই তাতে বড় পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে ক্রাচে ভর দেওয়া সেই শীর্ণ যুবক মঞ্জু। অতঃপর আবেগ জয়ী হয়। সদ্য জন্ম নেওয়া দেশের বিধ্বস্ত মাটিতে সে বিয়ে করে বিধ্বস্ত এক যুদ্ধ-নারী মিলিকে। এই সেই মুক্তিযোদ্ধা মঞ্জু যাদের কারণে ওই গ্রাম এবং মিলিদের বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।
পরিত্যক্ত দোতলা বাড়িটাতে এখন আর কেউ থাকে না। নিচের এক প্রান্তের দু’টো কক্ষ সাফ করে তারা বসবাস শুরু করে। কারণ মঞ্জুর পরিবার এবং বাড়িও আগুনের পেটে চলে গেছে। থাকার আশ্রয় জুটলেও আহারের সংস্থান তেমনভাবে হয় না। মিলির এক চাচাতো ভাই এসে জমিজমা ভাগ করে মিলির হাতে কিছু অর্থকড়ি দিয়ে চলে যায়। মিলির ভাগের কিছু জমি বর্গা দেওয়া হয় তা দিয়ে তারা কোনোরকমে চলার চেষ্টা করে।
বিয়ের রাতেই মঞ্জু বুঝতে পেরেছিল মিলির গর্ভে সন্তান। কেবল কি সেদিনই বুঝেছিল? সেতো পুর্বাসন কেন্দ্রে থাকতেই বুঝেছিল। শুধু বিবেকের দংশনে, নিজের সাথে নানা বোঝাপড়া করে সে মিলিকে বিয়ে করেছিল। তার একটা পা নেই, শরীরে অসুখ বাসা বেঁধেছে, মন বিপর্যস্ত, আশ্রয়দাতার মেয়ে মিলির যেন কোনো অসম্মান না হয় এটা সে নিশ্চিত করতে চেয়েছিল। তবে সে মন থেকে মিলিকে বুকে টেনে নিতে পারে না। অর্ধমৃত মিলির তাতে কিছুই মনে হয় না। এভাবেই তাদের যাপন এগিয়ে যেতে থাকে।
যথা সময়ে মিলির সন্তান আসে। গ্রামের একজন দাই এসে প্রসব করায়। মা হয়তো চোখ খুলে মেয়ের মুখটা দেখে কিন্তু ক্রাচে ভর দেওয়া মানুষটা একটিবারও ক্রাচের ঠকঠক শব্দ শোনায় না সদ্য ভূমিষ্ট শিশুকে। দাই কিছুদিন নিয়মিত আসে, শিশুর দেখাশোনা করে। দাই একদিন বলে,
‘অমা তা বেটির নাম থোয়া নাগবে না’? কেউ কোনো কথা বলে না। তখন দাই শিশুকে সম্বোধন করে ‘সুন্দরী’ বলে। দেখতে সে অপরূপ সুন্দর। এভাবে একজন দু’জন ডাকতে ডাকতে মেয়ের নামই হয়ে যায় ‘সুন্দরী’।
আজ ম্যাট্রিক পরীক্ষার রেজাল্ট হয়েছে। সুন্দরীর চোখ উঠেছে, লাল চোখে রেজাল্ট নিয়ে ফিরছিল। বাড়ির কাছাকাছি আসতে পথ আটকায় কিছু ছেলেপেলে, যারা স্কুলে যাওয়া আসার পথে ওদেরকে প্রায় উত্যক্ত করত। সেদিন সারাদিন, সারারাত যায় মেয়ে ফেরে না। মিলি পাড়ার অনেকের কাছে মেয়ের রেজাল্ট জানতে পারে। মেয়েটা খুব ভালো রেজাল্ট করেছে, ভালো মানে অনেক ভালো। আরেকটা কথা জেনে মিলি হতবাক হয়ে যায়। সুন্দরী নাকি নাম রেজিস্ট্রেশনের সময় নিজের নাম দিয়েছিল, ‘মরিয়ম সুলতানা সুন্দরী’। পরদিন শেষ বিকেলে সুন্দরী ফিরে আসে। মেয়েকে দেখে একেবারে হতভম্ভ হয়ে যায় মিলি।
মেয়ে ধীর পায়ে নিজের ঘরে চলে যায়। মেয়ের গমনপথে তাকিয়ে মিলি বুঝতে পারে সবই। ভাবে, এখন তো দেশ স্বাধীন, যুদ্ধ নাই, পাক আর্মি নাই, সবাই আমরা আমরা তাহলে তার মেয়ের এমন অবস্থা করল কে? একদিন পাক আর্মিরা তার নিজের উপর যে পাশবিক নির্যাতন করেছিল সেই একই পাশবিকতা তার মেয়ের উপরও তো হলো! এখন সে কাকে দায়ী করবে? নানা ভাবনায়, আক্রোশে, মেয়ের প্রতি অনুশোচনায় রাত কেটে যায়।
সেই যে একদিন চোখের সামনে বাবা মা, ভাইবোন, বাড়িভর্তি মানুষের মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া দেখা আবার নিজেকে শকুনদের থাবায় দিনের পর দিন ক্ষতবিক্ষত হওয়ার দিনগুলির বীভৎস স্মৃতি মনে করে রাতের পর রাত তার নির্ঘুম কেটে গেছে। আজ প্রথম সে সন্তানের জন্য রাত জাগে, আজ প্রথম সে মাতৃত্বের অনুভবে রাত জাগে। আজ প্রথম মনে হয় মেয়েটার প্রতি অবিচার করেছে সে, তার বুকের ভেতর থেকে এক হুহু দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।
মসজিদে আজান হয়। মিলি উঠে দাঁড়ায়। মেয়ের কাছে যায়। আস্তে করে মাথায় হাত রেখে ডাকে, ‘মা’! ঘুমের ঘোরে, জ্বরের ঘোরে মেয়ে চমকে ওঠে। তার মা কোনোদিন তাকে মা বলা দূরে থাক তাকে আদুরে স্বরে ডাকেনি, কোনোদিন মায়ের মতো আচরণ করেনি। বাবাও না, বাবা তো আজ বেঁচেই নেই। নিজস্ব বোধ, বুদ্ধি, পরিবেশ থেকেই সে সব সত্য উপলব্ধি করতে পেরেছিল আগেই। মনুষ্য জন্মের পদ্ধতি বুঝেছিল বোঝার বয়স হওয়ার আগেই। সেজন্যই সে লেখাপড়া করত জান বাজি রেখে। সেজন্যই সে একদিন মায়ের নামটা নিজের করে রেজিস্ট্রেশন করিয়েছিল, যেন তার শক্ত একটা পরিচয় থাকে।
মেয়ের গায়ে অনেক জ্বর। গরম পানিতে কাপড় ভিজিয়ে, আলাদা করে খাবার বানিয়ে, মেয়ের জন্য দুর্ভাবনায় অধীর হয়ে মিলি আজ প্রথম মা হয়ে ওঠে। মেয়ের জ্বর কমিয়ে, কাপড় বদলে দিয়ে, খাইয়ে দিয়ে বলে,
‘ওঠতো মা ওঠ, আয় আমার সাথে’।
মেয়েকে নিয়ে বাড়ির পেছনে গোলাপজাম গাছের গোড়ায় যায়। একদিন মায়ের ডাকে মিলি যেমন অবাক হয়েছিল আজ সুন্দরীও অবাক হয় মায়ের আচরণে।
মিলি দৃঢ় হাতে গাছের গোড়া খুঁড়তে থাকে। হাঁফাতে হাঁফাতে বের করে আনে মায়ের লুকিয়ে রাখা সেই অলংকার। ওর একটি বারের জন্যও মনে হয়নি সেই অলংকার আজ নাও পেতে পারে।
আজ সে সন্তানের দিকে তাকিয়েছে, তাকিয়েছে জীবনের দিকে। সে যেন পনেরো বছর পরে পূর্ণ জীবন ফিরে পেয়েছে। সে আর এই গ্রামে থাকবে না।
মেয়ে নিয়ে শহরে যাবে। যেভাবে হোক মেয়েকে মানুষ করবে। এ কেবল তার মেয়ে, তার একার মেয়ে, মেয়ের জন্ম ইতিহাস সে একেবারে মুছে ফেলে।
মেয়ের সমস্ত দায়িত্ব তার।
পঁচিশ বছর পরে প্রভাষক মেয়ে, মাকে নিয়ে আবার সেই বাড়িতে এসেছে থাকার জন্য।
****************************