You are currently viewing অকর্মণ্য/  নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর

অকর্মণ্য/ নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর

অকর্মণ্য

নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর

আমি বেচারাম শীল। আমার বাপ ভুবন শীল, দাদা পৃথ্বি শীল। আমরা বংশানুক্রমিক নাপিত। আমার দাদা ছিলেন জমিদারের ক্ষৌরকার। জমিদার বাহাদুর দেশ ছেড়ে চলে যাবার আগে দয়াপরবশ হয়ে হাট-চান্দিনার এক কোণে চুল কাটতে বসবার জন্য দাদার নামে একটা পাট্টা সই করে গিয়েছিলেন। জমিদারের সইকরা পাট্টা নিয়ে দাদার গর্বও কম ছিল না। জমিদার মহাশয় কলকাতা চলে গেলে পর জমিদারের দেওয়া চান্দিনার ভিটির ওপর একটা চালাঘর তুলে দাদা লোকের চুল কাটতে শুর করেছিলেন। জমিদারের ক্ষৌরকারকে হাটে বসে চুল কাটতে দেখে লোকে কটাক্ষ করে বলত, জমিদার দেশ ছেড়ে চলে গেল। সঙ্গে তুমিও গেলে পারতে। দাদা বলত, আমি আমার দেশ ছেড়ে কোথাও যাব না। যতদিন ভগবান বাঁচিয়ে রাখবে বাপদাদার ভিটিতেই থাকব। আর যখন মরণ আসবে স্বদেশের মাটিতেই মরব। প্রার্থনা করি, আমার মনোবাসনা যেন ভগবান পূরণ করে। দাদার ইচ্ছা ভগবান পূরণ করেছিল। দাদাকে তাঁর দেশ ছেড়ে যেতে হয়নি।দাদার স্বর্গলাভ হলে দাদার কর্মভার বাবার উপর বর্তায়। তাঁর রেখে যাওয়া চান্দিনা ভিটির উপর নাপিতের বাক্স খুলে আমার বাবাও চুল কাটতে শুরু করল।

পুনর্বার ৬৫ সালে রায়টের সময় হিন্দুরা দেশ ছেড়ে চলে যেতে থাকলে বাবাকেও কেউ কেউ একইরকম প্রশ্ন করেছিল, রাতের আঁন্ধারে পাল আর চক্রবর্ত্তীরা ইন্ডিয়া চলে গিয়েছে; তুই কবে যাবি? যার ইচ্ছা হয় সে যাক, আমি দেশ ছেড়ে যাব না। দেশটা এখন মুসলমানের, ব্রাহ্মণ হোক আর নাপিতই হোক― সব হিন্দুকে এ দেশ ছেড়ে ইন্ডিয়ায় চলে যেতে হবে। আমার বাপ ভুবন শীল তবু বাপদাদার ভিটি ছেড়ে যায়নি। বাবা বলত, আমার একটাই নিবাস, একটাই দেশ।

আমি দেশ ছেড়ে পালাব না। জান গেলেও না।  কয়েক বছর পর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো। পাকিস্তানি মিলিটারি গ্রামে গ্রামে আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে, যাকে পায় তাকেই গুলি করে মারছে। যে যেখানে পারে পালিয়ে বাঁচতে চেষ্টা করছে। কেবল হিন্দু নয়, জান বাঁচাতে সে বছর অনেক মুসলামানও ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। আমার মা পর্যন্ত বাবাকে বলেছিল, মুসলমানও ইন্ডিয়া চলে যাচ্ছে, আর তুমি যেতে চাও না। তোমার কি নিজের জানেরও মায়া নাই? তবু আমার বাপ গেল না। বাবার এক কথা

যুদ্ধের ডামাঢোলের মধ্যেও নাপিতের ঘরে বসে থাকলে চলে না। চুল কাটা ছাড়া তার আর কোনো উপায়ও ছিল না। এমন অশনি দিনে তাকে চুল কাটতে যেতে দেখে লোকে আশ্চর্য হয়ে বলত, ভুবন, পাক সেনারা হিন্দু-মুসলিম বাছে না। যারে তারে গুলি করে মারে। তুই মারা পড়বি, ইন্ডিয়া চলে যা, জান বাঁচা। বাবা বলত, আমি নাপিত। লোকের চুল-দাড়ি কাটি, আমাকে ওরা মারবে না। আর বাঁচামরা ভগবানের কৃপা। তার ইচ্ছায় যখন মরণ হবে, দেশের মাটিতেই মরব। ভগবানের ইচ্ছেও হয়ত সেরকমই ছিল। বাবাকে তার দেশ ছেড়ে কোথাও যেতে হয়নি।

একদিন রাজাকাররা পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে হাটে এসে বাবাকে চান্দিনা ভিটিতে পেল। বাবার বুকে বন্দুকের নল ঠেকিয়ে বলল, সাচ সাচ বাতাও, মুক্তি কাঁহা। বাবা বন্দুকের নল দেখেই হয়ত বোবা হয়ে গিয়েছিল; মুখে রা ছিল না তার। তাক করা বন্দুকের নলের দিকে ফ্যাল ফ্যাল চোখে তাকিয়ে ছিল কেবল। রুস্তম রাজাকার বাবাকে ধমক দিচ্ছিল বারবার, মুক্তি কোথায় থাকে, বলে দে, মালউনের বাচ্চা। তাতেও বাবা কোনো জবাব দেয়নি, অথবা দিতে পারেনি। মুক্তিযোদ্ধারা কোথায় লুকিয়ে আছে সে খবর না দেওয়ার জন্য অথবা উর্দুতে কথা বলতে না পারায়, অথবা ছোটো জাতের হলেও নাপিত যে হিন্দু সে কথা রুস্তম রাজাকার নিশ্চিত করায় পাকিস্তানি সেনারা বাবার হা করা মুখের ভেতরই গুলি করেছিল।

এসব কিছু আমার জানার উপায় ছিল না। বাবার মৃত্যুর ঘটনা আমি জানতে পারি সোমারু কাকার মুখে। পাকিস্তানি সেনারা হাটে আসবার আগে আগে সোমারু কাকা বাবার কাছে চুল কাটাচ্ছিলেন। ভগবান সহায় ছিল, সেনাদের আসবার আগে তার চ’ও কাটানো শেষ হয়েছিল। আর বের হয়েই লোকজনের আতঙ্কিত ছুটাছুটি দেখেই কাকা ভয়ে হাটের পাশের নদীর ঢালুতে নেমে পড়ে পাকসেনা দেখতে পেয়ে খাগড়ার ঝোপে কোনো রকমে গা ঢাকা দিয়ে লুকাতে পেরেছিলেন। বাবাকে জেরা করার সময় সোমারু নদীর ঢালুর ঝোপে লুকিয়ে শুনছিলেন। বাবাকে গুলি করে ফেলে রেখে পাক সেনা আর রাজাকাররা চলে গেলে সোমারু কাকা দেরী না করে কোনোরকম গা ঢাকা দিয়ে আমাদের বাড়ি এসে বাবার মৃত্যুর খবর দিয়েছিলেন। খবরটা শুনে দৌড়ে গিয়ে আমি দেখেছিলাম, বাবার নিথর দেহ কাঁঠাল গাছের তলে লুটিয়ে পড়ে আছে, চোখ খোলা, তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে, হা করা মুখ আর তাজা রক্তে ভিটি লাল।

বাবার জীবনাবসানের অল্প ক’দিন পরই দেশ স্বাধীন হয়ে গেল। আমিও বাপ-দাদার পদাঙ্ক অনুসরণ করে তাদের রেখে যাওয়া ক্ষুর-কাঁচি নিয়ে একই ভিটিতে চুল কাটতে শুরু করলাম।

চান্দিনা ভিটিতে চুল কাটতে কাটতে আমি ভুলে যেতে চাইতাম, আমার বাপ আমার হাতে ক্ষুর-কাঁচি তুলে দিতে চাইত না। বাবার ইচ্ছা ছিল, আমি স্কুলে পড়ালেখা করে অফিসে চাকরি করব। তখন লোকে আর নাপিত বলে, ছোটো জাত বলে গালি দেবে না। বংশ পরম্পরা নাপিতের জীবন থেকে তার ছেলে মুক্ত হবে। বাবার সে ইচ্ছার কথা মনে করে দীর্ঘশ্বাস ফেললেও আমি বুঝতে পেরেছি, বাবার একটা ইচ্ছা পূরণ করলেও আরেকটা ইচ্ছা পূরণ করা ভগবানের ইচ্ছা ছিল না। ভগবান যাকে নাপিত করে পৃথিবীতে পাঠান হয়ত তাকে নাপিতই রাখতে চান। আমি এখন আর আফসোস করি না। সবই ভগবানের ইচ্ছা। ভগবান কৃপা করে মানব জনম দিয়েছেন সেটাই কম কিসে। তিনি তো আরও অধম করে পৃথিবীতে আমাকে পাঠাতে পারতেন। হঠাৎ কখনো এমনও মনে হতো আমি যেন পৃথ্বী শীল। জমিদারের ক্ষৌরকার; কখনো মনে হতো আমি তারও আগের কোনো নাপিত। কত হাজার বছর আগে শূদ্র হিসেবে আমার পূর্বপুরুষের জন্ম হয়েছিল সে কথা আমি কী করে জানব? মানুষই বা কখন চুল-দাড়ি কাটাতে শুরু করেছিল আমি কী জানি? অবশেষে আমি বিশ্বাস করতে চেয়েছিলাম, সকলেরই কর্ম বদলায় কেবল নাপিতের ছাড়া। আমি ক্ষুর-কাঁচি হাতে একই কর্ম করছি যুগের পর যুগ, আর ভাবিকালেও করে যাব।

কাঁঠাল গাছের তলে দাঁড়িয়ে গাছটার দিকে কখনো চোখ গেলে বাবার কথা আমার মনে পড়ত। বাবার মুখেই আমি শুনেছিলাম, বাবা নিজহাতে ভিটির পাশে কাঁঠাল চারা লাগিয়েছিল। বাবার রোপিত কাঁঠালের চারা আর আমি একই সঙ্গে বেড়ে উঠছিলাম। বাবা ছিল না, তবু তার স্মৃতি আমারই চোখের সামনে একদিন ফলবানও হয়েছিল। সে গাছের কাঁঠাল বাড়িতে নিয়ে গিয়ে মাকে বলেছিলাম, মা, দেখ, বাবার লাগানো চারাগাছ বড় হয়েছে; ফল ধরেছে। মা আশীর্বাদ করে বলেছিল, তোর বাপ বেঁচে নাই। আমি আশীর্বাদ করি, তোর জীবনও এমন ফলবান হোক। সন্তানের জীবন ফলবান করার জন্য মা আমার বিয়ে দিয়ে সংসারে শেফালি নামের একজনকে আমার বউ করে নিয়ে এল। মা বেঁচে থাকতে থাকতেই তার আশীর্বাদে আমার সংসারে নতুন মুখ এল। আমি পুত্রের মুখে বাবার আর নাতির মুখে মা তার স্বামীর ছায়া দেখে অতীতের দুঃখ খানিকটা ভুলে যেতে পেরেছিলাম।

বাপ-দাদার মতো চান্দিনা ভিটির উপর চুল কেটে কেটে আমার সংসারজীবন কেটে যাচ্ছিল। বাবার মতো আমার চুল কাটাও সকলের পছন্দ। কারও ত্বকে সামান্য আঁচড় পর্যন্ত লাগে না। এ তল্লাটের সকলেই আমার সেবা গ্রহণ করেন। বিশ্বকর্মার ইচ্ছায় মানুষের সেবা করে আমার পরিবারের আহার যেমন জোটে তেমনি মানুষের সেবা করে আমিও আনন্দ পাই। নাপিতের জীবন পেয়ে নিজেকে তখন ধন্য মনে হয়। পূর্বপুরুষ দাদা আর বাবাকে মনে মনে প্রণাম করে প্রতিদিন বিশ্বকর্মার নাম জপে চুল কাটতে বের হই। আর চুল কাটতে কাটতে কানো কোনো সময় আমার এরকমও মনে হয়, চান্দিনা ভিটির মাটিতে প্রোথিত কাঁঠাল গাছের শিকড়ের মতো আমার জীবন-শিকড়ও এই ভিটিতে গাঁথা আছে। এই ভিটির মাটি গাছটাকে যেমন বাঁচিয়ে রেখেছে তেমনি এই ভিটি আমার সংসারের মুখগুলোর জীবনও খাইয়ে পরিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে।

আমার সন্তান বড় হতে থাকলে তার মুখের আদল বাবার মুখের মতো দেখতে পেয়ে সহসা একদিন তার ইচ্ছার কথা মনে পড়ল। আমার আবার মনে পড়ে, আমার বাপ আমার হাতে ক্ষুর-কাঁচি তুলে দিতে চাইত না। বাবা বলত, আমি পড়ালেখা শিখে চাকরি করব। পড়ালেখা করলে লোকে ছোটো জাত বলে, নাপিত বলে গালি দেবে না। বংশপরম্পরা নাপিতের জীবন থেকে তার ছেলে মুক্ত হবে। বাবার ইচ্ছাপূরণ আমি আমার সন্তানের জীবনে করতে পারি না? আমি নতুন করে স্বপ্ন দেখতে থাকি, আর হৃষ্টচিত্তে কাজ করে যাই। ভগবানের দয়ায় দিনও চলে যায়। গরিব ধনী, আশপাশের সকল লোকই আমার কাছে চুলদাড়ি কাটাতে আসে।

সে দিন তহশিলদার কাকা চুল কাটাতে এলেন। প্রতিবার চুল কাটাতে এসে তিনি বাবার জন্য আফসোস করেন। বাবার স্মৃতি মনে রাখায় আমি তাকে যথেষ্ট সম্মান আর সমাদরও করি। আমি বুঝতে পারি, তিনিও আমাকে স্নেহ করেন।

আমি চুল কাটতে থাকলে তহশিলদার কাকা বাবার প্রসঙ্গ তুললেন, একটা সহজ সরল ভালো মানুষ ছিলেন তোর বাপ। আমি তার কথা কোনোদিন ভুলব নারে, বেচারাম। নিজের বুকে গুলি নিল, তবু মুক্তিবাহিনী কোথায় আছে সেকথা পাঞ্জাবিকে বলল না। তিনি আরো বললেন,  আমার চাকরি থাকতে থাকতে তোর বাপ-দাদার স্মৃতি জড়ানো এই ভিটিখানার একটা নথি করে নিতে পারলি না?

আমি জানতাম চান্দিনা ভিটিখান জমিদার মহাশয় দাদাকে পাট্টা লিখে দিয়ে গিয়েছেন। তাকে সে কথা বললাম, কাকা, ঠাকুরদার নামে জমিদারের পাট্টা লেখা আছে। কাকা বললেন, দুর বোকা! জমিদারের পাট্টা দিয়া কি যুগে চলে? জমিদারও নাই, পাট্টাও অচল। দাড়ি কাটা হয়ে গেলে কাকা বললেন, একটা লিজ নথি করে নিলে তো আর কোনো দুশিন্তা থাকে না। লিজ নথি? দিনকাল ভাল না, কে কখন কাগজ করে নেয়। আমি ভাবনায় পড়ে গেলাম, কী করা লাগবে, কাকা? সরকার থেকে বন্দোবস্ত করা লাগবে। দরখাস্ত নিয়া অফিসে আসিস। একটা নথি করে নিলে আর দুশ্চিন্তায় থাকতে হবে না। তহশিলদার কাকার কথা শুনে আমিও দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। তাকে বললাম, কাকা, আমরা বংশ পরম্পরায় আপনাদের সেবা করে বেঁচে আছি। আমার বাপ আপনাদের সেবা করতে করতেই স্বর্গে গিয়েছে। আমিও তার মতোই আপনার এবং এলাকার সকলেরই সেবা করে যাচ্ছি। আমি আপনার অফিসে যাব, কাকা। দয়া করে একটা ব্যবস্থা করে দিয়েন। আচ্ছা, ঠিক আছে।

দু’দিন পরই দেখি, হাটের আরেক পাশে, যেখানে এতকাল ধরে ছাপড়ার তলে পসারি দোকান বসত সেখানকার চালাঘর সরিয়ে কে বা কারা ইটের গাঁথুনি দিয়ে পাকাঘর তুলছে। আমি কাছে গিয়ে মিস্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলাম, কে তুলছে পাকা ঘর?

আমার বোকা বোকা প্রশ্ন শুনে রাজমিস্ত্রী হেসে বলল, পাকাঘর তুলবার ক্ষমতা যার আছে, সেই তুলছে। আমি তবু হাঁদারাম হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে বলে, তোর ভিটায় যখন তুলবে তখন টের পাবি হাটচান্দিনায় পাকা ঘর কে তুলতে পারে।

আমি আর কথা বাড়ালাম না। কেবল আমি নই, এ তল্লাটের সকলেই জানে এই ভিটির উপর রুসমত আর হাফিজ কাকারা পসারির ডালা সাজিয়ে হাটবারে বসে। কিন্তু আশপাশের সকলেই একথাও জানে, চান্দিনা ভিটি কেন, তাদের পক্ষে বাপদাদার ভিটিতেও পাকা দেওয়ালের উপর ঘর তোলা সম্ভব না। তাহলে এ ঘর কে তুলছে?

নিজের ভিটিতে ফিরে আসার পরও আমার নিজের মনেই প্রশ্নটা কাঁটার মতো খচ খচ বিঁধতে লাগল। তখন তহশিলদার কাকার কথাগুলো মনে পড়ল। আর দেরি না করে আমি তহশিল অফিসে গেলাম। কাকা, আমার একটা ব্যবস্থা করে দিন।

লিজমানি জোগাড় করছস? লিজমানি? নথির জন্য টাকা দেওয়া লাগবে না? কত লাগবে?

এক শতক জায়গা। দাদার আমল থেকেই তো দখলে আছিস। তেরশ ছিয়াশি সন থেকে হিসাব ধরলেও বকেয়া বিশ হাজার টাকার কম আসবে না। অত টাকা লাগবে! বলিস কী! আর কেউ হলে তো আমিই বিশ হাজার টাকা নিতাম। আমাকে না হয় কিছু না দিলে, সরকারের টাকা না দিয়ে কি লীজ হবে?’

অত টাকার কথা শুনে আমার মন দমে গেল। আমি হতোদ্দম হয়ে মনে মনে বললাম, সাতমন ঘিও ঢালতে পারব না, আমারও ভিটি বন্দোবস্ত পাওয়াও হবে না। আমতা আমতা করে বললাম, আচ্ছা, আমি টাকা জোগাড় করে তার পর আসব।

দেরি করিস না। আমি চোখে অন্ধকার দেখতে দেখতে বাড়ি ফিরলাম। বাড়ি এসে একদিকে ভিটি হাতছাড়া হওয়ার শঙ্কা অন্য দিকে টাকা জোগাড়ের কোনো সম্ভাবনা না থাকায় ছটফট করতে লাগলাম। অতটাকা কোথায় পাব? আমার অস্থিরতা দেখে বউ বলল, তোমার কী হয়েছে গো, এমন করছ কেন? অত টাকা আমি কোথায় পাব? সব শুনে আমার বৌ তার যৎসামান্য গয়না যা ছিল সব আমার হাতে তুলে দিল। আমি বৌ-এর গয়না বেচে কিছু টাকা জোগাড় করলাম। তবু অর্ধেকমাত্র। দশ হাজার টাকা জোগাড় করার কোনো উপায়ই দেখতে পেলাম না।

আমার মতো নাপিতকে দশ হাজার টাকা কে দেবে?  আমার স্ত্রী বলল, যার কেউ নাই তার ভগবান আছে। আমার গৃহলক্ষ্মী স্ত্রীর বিশ্বাসের ফলও আমি অচিরেই পেলাম। পরদিনই ভগবানের সাক্ষাত প্রতিনিধি আমার চালাঘরের সামনে এসে তাঁর মটর সাইকেল থেকে নামলেন। এর আগে কখনো আমার এই তুচ্ছ চালার তলে তিনি চুল বা দাড়ি কাটাতে আসেন নি। তিনি বরাবরই আমাকে তাঁর বাড়িতে ডেকে নিতেন। তিনি আয়েশী মানুষ, তাঁর বহির্বাটির হাওয়া ঘরের খোলা চত্বরে অথবা বেলগাছের তলে আরাম চেয়ারে আয়েশ করে শরীর এলিয়ে দিয়ে আমাকে দিয়ে চুল-দাড়ি কাটান। চুল-দাড়ি কাটা হয়ে গেলে আমাকে দিয়ে তিনি তাঁর নাদুসনুদুস শরীরটা আচ্ছামতো দলাই-মোচড়াই করিয়ে নেন। আমিও খুব যত্নসহ তাঁর সেবা করি। ষাঁড়ের কুঁজের মতো তাঁর গর্দান, ভীমের গদার মতো দুটি মাংসল বাহু, ঘন চুলের তলে বড়সড়ো একটা তালের মতো মাথায় আঙুল আর হাতের চেটোয় দীর্ঘক্ষণ যাবত মালিশ করে দিই। শুরুতেই তিনি আদরখাওয়া শিশুর মতো আরামে চোখ বোজেন, তারপর কখনো বা আরাম খেতে খেতে এক পশলা ঘুমিয়েও নেন। আমিও তখন আর সময় হিসেব করি না। তাঁকে সেবা করার বিনিময়ে যা প্রত্যাশা করি না তিনি এর চাইতে অনেক বেশি টাকা পকেট থেকে বের করে আমাকে দেন। বলতে হয়, তাঁর দান আমাকে চৈত্রের বৃষ্টির চাইতেও বেশি খুশি করে। চুল-দাড়ি কাটার পর এই ভয়ানক ক্ষমতাধর মানুষটাই যখন আমার মালিশে পরম তৃপ্তি নিয়ে দিকে তাকিয়ে হাসেন, তখন আমিও পরম আনন্দ পাই। আমি শুধু কৃতজ্ঞ বোধ করি তা নয়, বরং তিনি যখন হাতে বড় একটা নোট তুলে দেন তখন আমার মনে হয়, আমি তাঁর খুব কাছের মানুষ। আমার বিশ্বাস ছিল, যতদিন তাঁর দয়া বর্ষিত হবে ততদিন ছেলেপুলে নিয়ে বাঁচার জন্য আমার চিন্তার কোনো কারণ নেই।

সেদিন তিনি প্রথমবার আমার তুচ্ছ চালাঘরে চুলকাটাতে আসায় আমি খুব খুশি হয়েছিলাম। তাঁকে আমার চালার তলে প্রথমবার পেয়ে আমি পরম আনন্দে অভিভুত। তাঁর বাড়িতে যে রকম করে সেবা করি, সেরকম সেবাই তাঁর করছিলাম। দাড়ি কামানো শেষ করে তাঁর ঘাড়ের চেকনাইওয়ালা মাংসের উপর দু’হাত দিয়ে আলতো করে টিপে দিতে থাকলে তিনি চোখ বন্ধ করে মালিশ উপভোগ করছিলেন।

আমার হাতের আরাম নিতে নিতে মান্যবর হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, এই জায়গাটা তুই লীজ নিবার চাস? আজ্ঞে, কর্তা। টাকা জোগাড় করছস?

সব পারি নাই। আরো দশ হাজার দরকার। সেইটা জোগাড় করতে না পারায় দুর্ভাবনায় আছি। টাকাটা জোগাড় করতে পারলেই লীজ নথি করতে পারব। মান্যবর একঝটকায় উঠে বসলেন। চেয়ারটা মার খাওয়া প্রাণীর মতো কঁকিয়ে উঠল। গায়ের উপর থেকে কাটাচুলসহ পর্দাটা মাটিতে ফেলে দিলেন। মনে হলো, সাদা পর্দাটার তল দিয়ে কোনো পোকা ঢুকে তাঁকে কামড়ে দিয়েছে। চোখ মেলে আমার দিক এমন করে তাকালেন যেন পোকাটাকে আমিই তাঁর গায়ে উঠতে দিয়েছি। অথবা পোকা যাতে তাঁকে না কামড়ায় আমার অবশ্যই খেয়াল রাখা উচিত ছিল। আমি শেষে বুঝলাম, পোকাটোকা কিছু না। বরং তিনি পকেট থেকে টাকা বের করলেন। একটা দু’টো নোট না, একতোড়া টাকা। মান্যবর সবগুলো টাকাই আমার দিকে বাড়িয়ে ধরলেন, নে, ধর। এখানে দশ হাজারই আছে। অতগুলো টাকা হঠাৎ দেখে আমার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল এবং আমি চোখের পাতাও ফেলতে পারছিলাম না। হতবাক হয়ে হা করে তাকিয়ে ছিলাম, মুখে কোনো কথা আসছিল না। মান্যবরের দয়ার সীমা অনুধাবন করি আমার মতো নাপিতের বেটার সাধ্য কী? আমি কিছুতেই মনে করতে পারছিলাম না, তাঁর দয়ার বিনিময়ে কী কথা বলে তাঁর প্রতি ঋণ স্বীকার করব, তাঁর জন্য আর কী কী করব। আমি অতীতেও দেখেছি, চুলই হোক, আর দাড়িই হোক যাই কাটি না কেন, তিনি আমাকে যা দেন হাত খুলেই দেন। কিন্তু এত টাকা কোনো দিনই দেন নি!

আমাকে থ’ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মান্যবর বললেন, হা করে তাকিয়ে আছিস কেন? টাকার মনে হয় তোর দরকার নাই?

আজ্ঞে, টাকার ত আমার খুবই দরকার। আপনার অনেক মেহেরবানি, কর্তা।

আমি টাকাটা হাতে তুলে নিয়ে ভগবান অথবা মান্যবরের উদ্দেশ্যে কপালে হাত ঠেকালাম।

বের হয়ে যাওয়ার আগে মান্যবর বলে গেলেন, পরে কোনো ঝামেলা করিস না কিন্তু। তোদের তো বিশ্বাস করা যায় না।

আমি বলতে চাইলাম, ভগবানে আমার বিশ্বাস আছে, আমি সে বিশ্বাস ভঙ্গ করব না। আমি যেভাবে পারি, এ ঋণ শোধ করব। কিন্তু আমি কোনো কথা বলার আগেই তিনি মটর সাইকেলে চড়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করলেন। আর আমি টাকা নিয়ে মান্যবরের জন্য ভগবানের কাছে আশীর্বাদ করতে করতে বাড়ি গেলাম।

বাড়ি গিয়ে মনে হচ্ছিল, আজ আমার পরম আনন্দের দিন। আমি স্থির হয়ে বসতেও পারছিলাম না। উঠোনে আর সারাবাড়ি পায়চারি করলাম। নদীর ধারে গেলাম, জীবনে প্রথম মাছরাঙার মাছ ধরা দেখলাম, কানি বক ধ্যান করে বসে আছে তাকে দেখে শিশুকালের মতো হাসলাম। কেবল আজই যেন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে আকাশটা ঘরে যাবার জন্য নতুন বধুর মতো রঙিন শাড়ি পরে সেজেছে বলে মনে হলো। আমি নাপিতের বেটা, ক্ষুর আর কাঁচি হাতে আমার সকাল-সন্ধ্যা কাটে, এমন করে একটা বিকাল কোনোদিন কাটাই নি, আজ কাটালাম।

রাতের আহারের পরও আমার ঘুম আসছিল না। ছেলেমেয়ে দুটোকে তাড়াতাড়ি ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে শেফালি আমার কাছে এসে বসল। খুব যত্ন করে পান বানিয়ে আমার হাতে তুলে দিয়ে বলল, অমন মানুষ এ কলিযুগে হয়!

আমি পান মুখে নিয়ে বললাম, মানুষ বলছ কি, তিনি সাক্ষাত অবতার।

রাত গভীর হয়ে এলেও আমার ঘুম আসছে না দেখে শেফালি আমার মাথায় ওর নরম আঙুলের স্পর্শে মালিশ করে দিতে থাকে। নিশুতিরাতে ওর আঙুলের ছোঁয়ায় আমার শরীর মন জেগে উঠেছিল। তার দেহের ঘ্রাণ আমার কাছে সত্যি সত্যি শেফালি ফুলের সুবাস বলে বোধ হলে আমি সেই সুবাস উপভোগও করলাম।

তারপর ঘুমিয়ে পড়লে স্বপ্ন দেখতে থাকলাম―চান্দিনা ভিটির ওপর আমি ইটের একটা ঘর তুলেছি। আমার ছেলে নিধিরাম শীল সাবালক হয়ে গিয়েছে। সে আরামদায়ক ঘুর্ণিচেয়ারে বসিয়ে লোকের চুলদাড়ি কাটে। আমার আর কোনো অভাব নেই। আমার মেয়েটার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ছেলেটার বিয়ে দেবার জন্য একটা টুকটুকে মেয়ে খুঁজছি।

ঊষাকালে ঘুম ভাঙলে স্বপ্নটা আমাকে বিলের বুকের নৌকার মতো দোলাচ্ছিল। স্বপ্নের দোলায় দুলতে দুলতে আমি তহশিল অফিসে গিয়ে উপস্থিত হলাম। কিন্তু তহশিলদার কাকা যেন আজ কেমন করে তাকালেন। মনে হলো, তিনি যেন আমাকে ঠিক চিনতেও পারছেন না। আমি বুঝলাম, তহশিলদার কাকা তার অফিসে অন্যরকম। চুল কাটাবার সময় কাকা হলেও অফিসে তিনি তহশিলদার সাহেব। আমি প্রতীক্ষা করতে লাগলাম, কখন তাঁর দৃষ্টি আমার দিকে প্রসন্ন হয়।

আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেয়াল করছিলাম, আমাকে বসিয়ে রেখে তহশিলদার কাকা এটা ওটা নাড়ছেন অথবা কাগজে কলম দিয়ে কিছু লিখছেন। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আমার মনে হলো, তিনি কী যেন ভাবছেন। ধৈর্য ধরে রাখতে না পেরে অবশেষে আমি তাঁর কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। তিনি তখন কাগজ থেকে কলম তুলে আমার দিকে তাকালেন।

তুই দেরি করে ফেলেছিস―আরো আগে আসা দরকার ছিল।

কাকা, সব টাকা জোগাড় করতে করতেই না দেরি হয়ে গেল। ভগবানের কৃপায় কালই টাকাটা জোগাড় করতে পারলাম।

টাকা কীভাবে জোগাড় করেছিস?

মান্যবর দশ হাজার টাকা দিয়েছেন।

দশ হাজার টাকা এমনি এমনি তোকে দিলেন!

তিনি আমাকে দিয়ে সবসময় চুলদাড়ি কাটান। আমাকে স্নেহ করেন। তিনি আমার পিতৃতুল্য, কলিযুগে তাঁর মতো মানুষ হয় না।

সত্যি বলছিস!

আমি সবিস্তার তহশিলদার কাকাকে মান্যবরের দয়ার কথা বললাম। কাকা আমার কথা শুনে অবাক হলেন কিন্তু কোনো মন্তব্য করলেন না। খুশি হয়েছেন বলেও মনে হলো না। আমার মতো এক নাপিতকে একজন গণ্যমান্য ব্যক্তির এতগুলো টাকা দেওয়ার বিষয়টা সম্ভবত তহশিলদারের মনঃপুত হয়নি। যা হোক, তাতে আমার কিছু আসে যায় না। মান্যবর কি কেবল তেলের মাথায় তেল ঢালবেন? তিনি কি ভুখানাঙা মানুষের দিকে তাকাবেন না? সেটা না করলে তিনি কী করে আরও বড় নেতা হবেন? লোকে বলে, গরিব মানুষের দিকে যার হাত যত প্রসারিত, নেতাও তিনি তত বড়।

আমি সে চিন্তা বাদ দিয়ে তহশিলদারের কাছে জানতে চাইলাম, কাকা, ডিসি অফিসে কবে যাওয়া লাগবে?

শুকনো মুখ তহশিলদার বললেন, তোর আর ডিসি অফিসে যাওয়া লাগবে না।

না গেলেও চলবে?

লিজ নথি অনুমোদনের জন্য ডিসি অফিসে চলে গিয়েছে।

ততদিনে লিজ নথি কীভাবে, কোথায় অনুমোদন হয় সে সম্পর্কে আমি কিছুটা ধারণা পেয়েছিলাম। তহশিলদারের কথা শুনে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়বার অবস্থা।

আমি তো আবেদনই করিনি! আবেদন ছাড়াই নথি চলে গিয়েছে?

এজন্যই লোকে তোর নাম দিয়েছে হাঁদারাম।

লোকে আমাকে যা বলে বলুক, তহশিলদার আমাকে হাঁদারাম বলার কারণ আমি বুঝতে পারছিলাম না। আমি তাঁর উপর খুব অসন্তুষ্ট হয়েছিলাম। আমার মনে হয়েছিল, তহশিলদার ভেবেছিলেন অত সহজে আমি টাকা জোগাড় করতে পারব না, আর লীজও নিতে পারব না। হয়ত আমার নিকট থেকে ঘুষ পাওয়ার জন্য আমাকে মিথ্যা কথা বলছেন।

তহশিলদার বললেন, দাঁড়িয়ে আছিস কেন? দাঁড়িয়ে থেকে কোনো লাভ নেই। যা, বাড়ি যা।

আমি অগত্যা তহশিল অফিস থেকে বেরিয়ে এলাম। কী করব, কোথায় যাব বুঝতে পারছিলাম না। পথ চলতে চলতে ভাবছিলাম, ভগবান আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে চান্দিনা ভিটির পাশে কখন চলে এসেছি বুঝতেও পারিনি। যা দেখলাম তাতে আমার চক্ষু চড়কগাছ। নিজেকে আমি মাটিতে দাঁড় করিয়ে রাখতে পারছিলাম না।

শূন্য ভিটি খা খা করছে। কাঁঠালগাছটাও নেই। কেটে নিয়ে গিয়েছে। আশপাশে তাকালে নজরে পড়ল, কে বা কারা আমার ভিটির চাল সরিয়ে নদীর ঢালুতে ফেলে রেখে গিয়েছে! আমি সামান্য এক নাপিত, কারও সাতে পাঁচে নাই, আমার কোনো শত্রু থাকতে পারে, আমি বিশ্বাস করি না। কে আমার এমন সর্বনাশ করল আমি কিছুতেই ভেবে পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ মনে পড়ল, তহশিলদার কাকা বলছিলেন নথি অনুমোদন হয়ে গিয়েছে। সন্দেহ হলো, তাহলে কি চালা সরিয়ে ফেলার সঙ্গে নথির কোনো যোগসূত্র আছে! আমি বুঝে গেছি, যেই করুক, ভিটিখানা দখল করতেই আমার চালাটা সরিয়েছে। আমার তো সমূহ বিপদ!

আর তখন মান্যবরের কথাই আমার মনে পড়ল। আমার মনে হলো, ভগবান এ বিপদ থেকে আমায় উদ্ধার করতে না পারলেও তিনি পারবেন। এমন কি ভগবান মুখ ফিরিয়ে নিলেও তিনি আমাকে ফেরাবেন না।

আমি আমার সমূহ বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য ভগবানের বদলে সেই মান্যবর ব্যক্তির শরণাপন্ন হওয়ার কথা চিন্তা করলাম। যিনি লীজ পাওয়ার জন্য আমাকে অতগুলো টাকা দিতে পারেন, তিনি এ ব্যাপারেও আমাকে অবশ্যই সাহায্য করবেন। মান্যবরের ক্ষমতা সম্পর্কে আমার ধারণা ছিল। তাঁর সম্পর্কে লোকে যা-ই বলুক, আড়ালে আবডালে যত খারাপ কথাই বলুক, আমি জানি, তিনি আমার কী উপকার করেছেন।

আমি বিলম্ব না করেই মান্যবরের শরণাপন্ন হলাম। আমার সৌভাগ্য, তাঁর বাড়িতে গিয়ে তাঁকে পেয়েও গেলাম। দেখলাম, কয়েকজন অনুসারীসহ বৈঠকখানায় তিনি বেশ খোশ মেজাজেই আছেন।

আমি বিলম্ব না করেই আমার সমস্যার কথা তাঁকে জানালাম।

কর্তা, কারা যেন আমার চান্দিনা ভিটির চালাঘরটা ভেঙে ফেলেছে। বাবার লাগানো কাঁঠালগাছটাও কেটে নিয়ে গিয়েছে।

মান্যবর হাসলেন, সঙ্গে তাঁর অনুসারীরাও। বললেন, চালাঘর ভেঙে ফেলেছে, পাকাঘর উঠবে।

আমার ভিটির নথি না কি সদরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

পাঠিয়ে দিয়েছে? সে তো আরও ভাল কথা।

তহশিলদার বলেছেন, আমার নামে না, অন্য কারো নামে নথি হয়েছে।

আরে বোকা, নথি তো কারো না কারো নামেই হয়।

আমি মান্যবরের পায়ে লুটিয়ে পড়লাম, আমার একটা ব্যবস্থা করুন। আপনার কৃপায় আমার পরিবারটা বাঁচবে। আপনার দয়ার কথা আমি কোনোদিন ভুলব না।

কথা বাড়াস না, এখন যা।

আমার বৌ-পোলাপান না খেয়ে মরে যাবে ।

তোকে আরও কিছু টাকা দিব নে, তুই এখন যা।

কর্তা, আপনি আমাকে বাঁচান।

বাঁচা-মরা তার ইশারায় হয়। ভাবিস না। আরও কিছু টাকা দিব নে। দশ হাজার টাকা তো একদিনেই খেয়ে ফেলবি না। যখন লাগবে, আছিস।

আমি বোধ বুদ্ধি হারিয়ে কর্তার মুখের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে তিনি বললেন, ঘরের ছাদ হয়ে গেলেই দোকান ভাড়া দিয়ে দেব। তখন কেউ না কেউ সেলুনও করবে। চুলদাড়ি কাটায় তোর হাত ভাল, তোকে যে কেউ কাজে লাগাবে। নাপিত কখনো বেকার থাকে না। আমি তোকে কামে লাগাতে বলে দেব। তোর বউ-পোলা না খেয়ে মরবে না।

মান্যবর কী বললেন আর কী ইঙ্গিত করলেন আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বুঝতে চেষ্টা করছিলাম, যদিও বুঝবার মতো মনের অবস্থা তখন আমার ছিল না। তবু আমার মনে হলো কিছুটা হলেও আমি বুঝতে পেরেছি।

আমি বলেই ফেললাম, কর্তা, আপনার টাকা আমি রেখে গেলাম। ভিটিই যদি আমার না থাকে তাহলে টাকার তো দরকার নাই।

আমি টাকাটা তাঁর সামনে টেবিলের উপর রেখে দিলে মান্যবর দেখলেন। তবে আর কিছু বলার দরকার মনে করলেন না। কেবল আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার গোঁয়ার্তুমি দেখে মুচকি হাসলেন। তাঁর অনুসারীরাও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার নির্বুদ্ধিতা দেখছিল, তারাও না হেসে পারল না।

আমি ঘর থেকে বের হয়ে চলে আসবার সময় তাদের কেউ একজন পেছন থেকে বলল, চালাটা বাড়ি নিয়ে যাস। টিন পুরোনো হলেও মজবুত আছে। এখন আর অত শক্ত টিন পাওয়া যায় না। পাওয়া গেলেও তুই তো আর অত দাম দিয়ে কিনতে পারবি না।

অতঃপর পথে নামা ছাড়া আমার কিছু করার ছিল না। পথে নেমে আমার ইচ্ছে করছিল, কোথাও চলে যাই। কিন্তু পথে দাঁড়িয়েও গন্তব্য খুঁজে পেলাম না। আমার মতো ছোটজােতর র জন্য গয়া-কাশী-বৃন্দাবনও নয়। আর সে কারণেই আমার পিতামহ বা পিতা কোথাও যেতে পারে নি। বুঝতে পারলাম, এ ধরাধামে নাপিতের মতো কারো যাওয়ার আসলে শ্মশান ছাড়া অন্য কোনো জায়গা নেই।

শ্মশানঘাটের পাকুড় গাছের তলে বসে আমি কামনা করছিলাম, ভগবান কেন আমার চিতা জ্বালানোর ব্যবস্থা করে না। একসময় চোখের সামনে আমার সন্তান আর স্ত্রীর মুখ ভেসে উঠলে আমি বাড়ির দিকে হাঁটা ধরলাম। আমি আমার জন্য বাঁচি না, বাঁচি ওদের জন্যই।

বাড়ি ফিরে ক্ষুর-কাঁচি হাতে নিয়ে চোখের জল ফেলতে থাকলে যে শেফালি সবসময় আমাকে সাহস জোগায় সেও নির্বাক হয়ে গেল। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কী ঘটেছে সেটা বুঝতে না পারলেও আমার স্ত্রী আর সন্তানরাও আমার চারপাশ ঘিরে বসে নীরব সমবেদনা জানাতে লাগল।

পরদিন চোখের জলে ক্ষুর-কাঁচি ধুয়ে মুছে যখন বের হতে যাব তখন অঝোরে বৃষ্টি নামল। এমন দিনে মানুষ বের হবে কি, ধারাজল সইতে না পেরে পশুপাখিও যেখানে পারে আশ্রয় নিয়েছে। একটা পথের কুকুর পর্যন্ত কোথাও ঠাঁই না পেয়ে আমার ঘরের দাওয়ায় উঠে এসে দাঁড়াল। কুকুরটিকে তাড়িয়ে না দেওয়ায় একসময় লেজগুটিয়ে বসে আমারই সঙ্গে বৃষ্টি দেখতে লাগল।

তার পর বৃষ্টি আর বৃষ্টি। সময় ক্রমশ বয়ে যেতে লাগল। ক’দিন কোনো রকম চালিয়ে নিয়েছে। অবশেষে শেফালির হাতের মুষ্ঠিও শেষ। আমার স্ত্রী তার সন্তানদের সামনে চিড়ামুড়ি কিছু একটা তুলে ধরতে গেলে দেখি কুকুরটাও গা ঝাড়া দিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। দাঁড়িয়ে কাঁইকুঁই করে। আমার হাতের বাটি থেকে দু’চারটে দানা কুকুরটার সামনে ফেলে দিলে সেগুলো এই বোবা প্রাণীটা জ্বিহ্বায় চেটে মুখে তুলে নিয়ে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়তে থাকে। একসময় শূন্য বাটিটা পাশে রেখে দিলে সে আর কাঁই-কুঁই না করে নিজের জায়গায় গিয়ে আগের মতোই লেজগুটিয়ে বসে পড়ে। আমি বুঝতে পারি অবোধ হলেও কোনো প্রাণীই অবুঝ নয়।

চিড়ামুরি খেয়ে, শুকনো চাল চিবিয়ে, জল খেয়ে কোনোরকম করে বাদলার দিনগুলো আমরা কাটাতে লাগলাম। ছেলেপেুলের শুকনো মুখের দিকে চোখ গেলে শেফালির চোখ থেকেও চালের ফুটো থেকে জল পড়বার মতো ফোটা ফোটা অশ্রু মাটিতে পড়তে থাকল। সে বারবার কপালে জোড়হাত ঠেকিয়ে কামনা করে যাচ্ছে, সূর্যদেব যেন তার সন্তানদের মুখের দিকে চোখ তুলে তাকান। আমিও মনে মনে ভগবানকেই ডাকি, হে বিশ্বকর্মা, আমার দিকে তুমি মুখ তুলে চাও। তুমি আমার স্ত্রীর চোখের জল থামাও। আমার সন্তানদের তুমি বাঁচাও।

অবশেষে সূর্যদেব মেঘের আড়াল থেকে বের হয়ে চোখ মেলে তাকালেন। লোকজনও নানা কাজে পথে ঘাটে নামতে শুরু করল। আমি আমার সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবলাম, না, বসে থাকব না। কর্মহীন লোককে বিশ্বকর্মা করুণা করেন না।

তোরঙ্গ থেকে যন্ত্রপাতি নামিয়ে দেখলাম, কাপড়ে মুড়িয়ে রাখলেও ক’দিনেই ক্ষুরটাতে মরিচা ধরে গিয়েছে। ক্ষুর ধারানোর একটা চামড়ার দোয়ালি (ফিতা) আমি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলাম। এই দোয়ালিটা আমার বাপও তার বাপের কাছ থেকে পেয়েছিল। আমার বাপই ফিতাটা ঘরের খুঁটির গায়ে পোঁতা পেরেকে ঝুলিয়ে রেখে গিয়েছে। প্রতিবারই ক্ষুরটা ধার করবার সময় আমার বাপ ভুবন শীলের কথা মনে পড়ে। বাবা বলত, প্রতিদিন ক্ষুর ধার না করলে বিশ্বকর্মা অখুশি হন। ক্ষুর ধার দিলে রোজগার বেশি হয়।

বাবার কথা মনে রেখে আমি প্রতিদিন সকালে উঠেই বিশ্বকর্মার পূঁজা দিয়ে ক্ষুর ধার করতে বসতাম। পুজো শেষে ধার দিতে দিতেই দেখতাম কোনো বনেদি পরিবার থেকে আমার ডাক এসে গিয়েছে। ভগবানের কৃপায় চান্দিনা ভিটিতে যাওয়ার আগেই কয়েক বাড়িতে সেবা করে মাছ তরকারি কেনার পয়সা হয়ে যেত।

বাবা বলেছিল, দোয়ালিটা গণ্ডারের চামড়া দিয়ে বানানো। বাবার মৃত্যুর পর আমার বিশ্বাসও বদলে গিয়েছে, এখন আমার বিশ্বাস, এই ফিতেটা কোনো পশুর চামড়ার তৈরি নয়, এটা আমারই কোনো এক পূর্বপুরুষের গায়ের চামড়া দিয়ে তৈরি। আর এ কারণেই হয়ত বাবা বলত, এটা যত্ন করে রাখিস। ক্ষুর ধারানোর জন্য এর চাইতে ভাল কিছু পাবি না। এই দোয়ালির চামড়ার গুণ সম্পর্কে বাবা এ কথাও বলত, এই দোয়ালিতে ঘষে ক্ষুর ধার করলে কারো দাড়ি কেন―গলা কাটলেও টের পাবে না।

এ রকম ভাবনার সময় আমি শুনতে পেলাম―কেউ একজন আমার আঙিনায় এসে দাঁড়িয়ে আমার নাম ধরে ডাকছে―বেচারাম বাড়ি আছো? ভাই তোমাকে এখনি যেতে বলছে। তার চুল-দাড়ি কাটতে হবে।

মান্যবর আমাকে তাঁর বাড়িতে ডেকে পাঠিয়েছেন। তাঁর ডাক পেয়ে আমি যারপরনাই খুশি হলাম। আমি বুঝতে পারলাম, বিশ্বকর্মা আমার ডাকে সাড়া দিয়েছে। ভগবানই তাঁর অন্তরে বসে আমাকে ডেকে পাঠিয়েছে। আর এ কথাও আমার অজানা নয়, মান্যবর সাক্ষাত ভগবানের প্রতিনিধি। তিনি খুশি হয়ে চোখ বন্ধ করে আমাকে যা দেবেন তা দিয়ে আমার ক্ষুধার্ত সন্তানদের ভরপেট আহার জুটবে।

মান্যবরের মুখটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। আমি ক্ষুর ধার দিতে দিতে তাঁর কথা ভাবতে থাকি। আমি ভাবি, গত সাত দিনে তাঁর দাড়ি কেউ কাটে নি? মনে পড়ল, আমি ছাড়া তো আশপাশের গ্রামে আর কোনো নাপিত নেই।

অবিলম্বে আমি মান্যবরের সেবায় হাজির হওয়ার জন্য যন্ত্রপাতি গুছিয়ে নেওয়ার কথা ভাবলাম। আমি ভালো করেই জানি, মান্যবরের চুলদাড়ি কাটতে যাওয়ার আগে ক্ষুরটা উপযুক্ত করে ধার করে নেয়া উচিত। সে কথা ভাবতে ভাবতে যখন কাঁচি, ক্ষুর আর অন্যসব যন্ত্রপাতি পরখ করে নিচ্ছি তখন ক্ষুরে মরিচার দাগ থাকায়, দোয়ালিতে ছাতা পড়া দেখে আমার মেজাজ বিগড়ে যাবার উপক্রম হলো। আমার মনে হলো, আজ আমার মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। যদিও মনে পড়ল আমার মতো নাপিতের বেটা কেন, মেজাজ ঠিক না রেখে এ তল্লাটের কেউই তাঁর ছায়া মাড়ানোর কথা ভাবতে পারে না।

ক্ষুরটায় ভালো করে ধার দিয়ে দ্রুত পা চালিয়ে আমি মান্যবরের বাড়ি গিয়ে উপস্থিত হলাম। তার বৈঠকখানার বাইরে বেলগাছের তলে একটা টুলের উপর যন্ত্রপাতি সাজিয়ে আমি মান্যবরের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি।

আমার চোখের সামনে অনাহারী ছেলেটার ক্ষুধাকাতর মুখটা ভেসে ওঠে; কিশোরী মেয়েটার বিমর্ষ মুখটা আমাকে পীড়া দিতে থাকে। তবু আমি প্রতীক্ষা করি, কখন তিনি এসে চেয়ারে বসে শরীর এলিয়ে দেবেন। আমি তাঁর চুলদাড়ি যত্ন করে কেটে দেব। তিনি আমাকে মুক্ত হস্তে যা দেবেন তা দিয়ে চালডাল কিনে নিয়ে ঘরে ফিরব, অথচ তিনি আসতে দেরি করছেন। চারপাশে তাকাই, কোথাও কেউ নেই। কেউ কি বাড়িতে নেই! আমি যখন মান্যবরের জন্য প্রতীক্ষা করছি আর আর তাঁর দয়ায় আজ খাবার জুটবে ভাবছি তখন আমার চোখের সামনে চান্দিনা ভিটির উপর নতুন ইটের গাঁথুনি দেওয়া একটা ঘর ভেসে উঠল। তখন সহসা কী কারণে একটা ঝাঁকুনি খেয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। আসলে আমার ভাবনাকালে মান্যবর এসে চেয়ারে বসলেন বলে দশাসই শরীরের ভারে চেয়ারটা কঁকিয়ে ওঠায় আমার সম্বিত ফিরে এসেছে। অর্ধশায়িত মান্যবর তাঁর মাথাটা আমার দিকে এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করলেন। প্রতিবারই তিনি এরকম করেই চুলদাড়ি কাটবার সময় আমার কাছে নিজেকে সম্পূর্ণ সপে দেন। তাঁর মুখ ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি। আর দেরি না করে কোনো কথা না বলেই সাদা কাপড়ে আমি তাঁর গলা পর্যন্ত মুড়ে দিলাম। দিয়ে সেভের জন্য সেভিং ফোম, সেভের পর গালে মাখাবার জন্য ক্রিম বের করে নিলাম।

অন্যবারের মতো আজও আমি মান্যবরের মুখে সযত্নে সেভিং ক্রিম মাখাতে থাকি। প্রতিবারই ক্রিম মাখিয়ে প্রচুর ফেনা তুলে তার পর সেভ করি। ক্রিম মাখাতে গিয়ে তাঁর মুখের দিকে ভালো করে তাকাই। মান্যবরের মুখে ক্রিম মাখাতে মাখাতে আজ হঠাৎ আরেকজনের মুখ আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তার কথা আমি ভাবতে থাকি। ভাবতে ভাবতেই সে আমার সামনে এসে উপস্থিত হয়।

একদিন আমি মান্যবরের কৃপায় আমার বেঁচে থাকার কথা বলার পর সে আমার উপর অকারণে ক্ষ্যাপে গিয়েছিল।

তুই তোর জাতশত্রুর প্রশংসা করছিস!

মান্যবর আমার জাতশত্রু হতে যাবেন কেন?

যে জাতের কথা মনে করছিস সে জাত নয়।

তাহলে আর কী জাত আবার?

জগতে হিন্দু আর মুসলামান আসলে কোনো জাত নয়। জাত আসলে জগতে দুইটাই আছে, গরিব আর ধনী। সে আসলে তোর আর আমারও জাত শত্রু।

তিনি আমার শত্রু হবেন কেন? যদি তোর কথা মেনেও নিই, তিনি দেখতে দেখতেই উলুখাগড়া থেকে বটগাছ হয়ে গিয়েছেন বটে, আমার কোনো ক্ষতি তো তিনি করেন নি। বরং উপকার করেন।

গরিব জানে না―ধনীর হস্ত করে সমস্ত গরিবের ধন চুরি। যে গরিবের ধন চুরি করে সেই গরিবের শত্রু নয়?

কাঙালের কী এমন ধন থাকে, যা ধনী চুরি করবেন?

সময় এলে টের পাবি। ধনী গরিবের শত্রু হয় কি না।

কিন্তু তুই বলেছিলি নেতা নেতার শত্রু হয়।

আমার সে কথা মনে পড়ল। আরেক দিন সে আমাকে রাজা-প্রজা নেতা-জনগণ নিয়ে অনেক কথা বলেছিল। বলেছিল, আগে এক রাজার রাজ্য আরেক রাজা দখল করত। রাজায় রাজায় লড়াই হতো। সমান সমান না হলে লড়াই জমে না। প্রতিপক্ষ ক্ষমতাধর রাবণ না হলে রাম লড়াই করবেন কেন? পুঁথিতে আছে, বাঘও নিজের সীমানায় আরেকটা বাঘকে মেনে নেয় না। এমন কি, ক্ষুদ্র মৌমাছির রানীও নিজের মৌচাকে আর কোনো রানী বরদাস্ত করে না। নিজের গর্ভজাত হলেও টের পেলে সে রানী মৌমাছির চোখ না ফুটতেই হুল ফুটিয়ে মেরে ফেলে। তবে এখন তো আর রাজা-রানীর যুগ নেই। এখন নেতাদের যুগ। এক নেতা নিজের এলাকায় আরেক নেতা মেনে নেয় না। পুরাণকালে এক রাজ্যে যেমন দুই রাজা হতে পারত না, তেমনি কলিকালে এক এলাকায় দু’জন নেতা বেঁচে থাকতে পারে না। যদি কেউ নেতা হয়ে যায়― কে কাকে কীভাবে ঘায়েল করবে, এমন কি দুনিয়া থেকে কীভাবে সরিয়ে দেবে সেকথা ভাবে। তুই ভেবে দেখলে দেখবি, এখনকার নেতাদের কেউ কেউ আগেকার রাজাদের মতোই অপঘাতে মরে। আগে একজনের রাজা হবার বাসনা থেকে আরেক রাজা খুন হতো। আর এখন নেতা খুন হয় আরেকজন নেতা হতে চায় বলে। কিন্তু তারা সত্যিকার অর্থে একে অপরের শত্রু নয়। এটা হচ্ছে ক্ষমতায় যাওয়ার উপায় মাত্র। আসলে নেতা নেতার শত্রু নয়, প্রতিদ্বন্ধী। যুদ্ধ করা আর শত্রুতা করা এক নয়।

আমি প্রতিবাদ করেছিলাম, প্রজা সবকালেই গরিব ছিল, একালের জনগণও তাই। রাজার কালে রাজার ব্রত থাকে প্রজাপালন। আর নেতার কালে নেতার ব্রত জনকল্যাণ। গরিব মানুষ নেতার শত্রু হবে?

কিন্তু সে যুক্তি দিয়ে বলেছিল, তোর কথা সত্য নয়। রাজা কি ফসল ফলাত? সে প্রজাদের ফলন থেকে খাজনা নিত। ইংরেজ রাজার রাজ্য দখল করে নিয়েছিল। রাজ্য দখল করে কার উপর জমিদার বসিয়েছিল? আর জমিদার আবার কার নিকট থেকে লাঠিয়াল দিয়ে খাজনা আদায় করত? জমি চাষ করত এখনো করে সেই প্রজাই। পাকিস্তানি শাসকদের কথাই ধর। রাজার ধন নয়, এদেশের গরীব মানুষের বেঁচে থাকার অবলম্বন মাটিই তারা দখল করে রাখতে চেয়েছিল। মাটি দখল রাখতে গিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ মেরেছে। আর বাঙালি রুখে দাঁড়িয়েছিল বলে, তারা দখল রাখতে না পারায় চলে গিয়েছে। কিন্তু যাবার আগে যাদের বুদ্ধি ছিল, যারা গরিব মানুষকে মুক্তির পথ, ভালোভাবে বেঁচে থাকার পথ দেখাতে পারত, তাঁদের খুন করে গিয়েছে। আর এ যুগেও দেখ, নেতারা মাটিই দখল করে। ধনীর মাটি তো আর দখল করতে পারে না, গরিব মানুষের সম্বল ভিটিমাটি যে নেতা জবরদখল করে সে কী গরিবের শত্রু নয়?

আজ আমি মান্যবরের মুখে সেভিং ক্রিম মাখতে থাকি আর তার কথা ভাবতে থাকি। সে আমার মনের ভেতর ঢুকে আছে, তাকে মন থেকে আমি বের করতে পারি না। আমাকে আড়াল থেকে খোঁচাতে থাকে, ঠিক মতো ভেবে দেখ, কে কার দুশমন? সে আমাকে আবারও জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা, সত্যি করে বলত, তোর মনে হয় না কেন, তুই তাঁর দুশমন?

আমি সেভিং ক্রিম মাখাতে মাখাতে তার প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে থাকি। কিন্তু উত্তর খুঁজে পাই না। আর আমি উত্তর দিতে না পারায় সে আমার হয়ে উত্তর দেয়, আমি হলপ করে বলতে পারি। অবশ্যই তুই তাঁর দুশমন। তুই দুশমন, তোর সন্তানও দুশমন। আর তুই তাঁর দুশমন না হলে সে তোর এত বড় ক্ষতি করত না।

ভাবতে ভাবতে আমি তাঁর মুখ ফেনায় ফেনায় ভরে দিয়েছি। আমি তাঁর মুখ ঢেকে দিয়েছি। যে মুখটা দেখলে লোকের অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে, তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে সেই ভয়ঙ্কর মুখটা খুঁজতে থাকি। আমি তাঁর সাহসী মুখটা খুঁজি, যে বেপরোয়া সাহসের জন্য সকলেই তাঁকে সমীহ করে। তাঁর সাহসের জন্যই তিনি অল্পকালের মধ্যে অন্যদের পেছনে ফেলে সামনে চলে এসেছেন। লোকে এখন বিশ্বাস করে, তিনি যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছেন, তিনি একদিন সবাইকে ছাড়িয়ে যাবেন। লোকে এমনটাও বলাবলি করে, কেউ তাঁর পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। তিনি যে পথের কাঁটা সরিয়ে দিয়ে পথ তৈরি করে চলেন। লোকে জানে, সাত খুন না হলেও এ পর্যন্ত কয়েকটি কয়েকটি খুন কাগজে কলমে মাফ করে দেওয়া হয়েছে, আর দু’একটি মামলা সাক্ষী না থাকায় প্রমাণও হয় নি।

মান্যবরের মুখে ফেনা মাখাতে মাখাতে, ক্ষুর হাতে তুলে নেবার আগে মান্যবরের নানা কথা ভাবতে ভাবতে, আমি তাঁর অর্ধবোজা চোখ আর ফেনার ওপর পানি-জোঁকের মতো মোটা দু’টি ঠোঁট দেখতে পাই। ক্ষুর হাতে তুলে নেবার আগে তাঁর দিকে তাকিয়ে আমি ভাবতে চেষ্টা করি, যখন তিনি সবাইকে ছাড়িয়ে যাবেন তখন তাঁর চেহারাটা কেমন হবে? নিশ্চয় আরো দশাসই, আরো ভয়ঙ্কর! তাঁর দশাসই ভবিষ্যৎ চেহারাটা কল্পনা করতে গিয়ে আমার চোখের সামনে কালভৈরবের মূর্তি ভেসে উঠল। তবু কী কারণে ভয়-ডর আমার অন্তর থেকে উবে যায়। ভাবতে ভাবতে ফেনায় ফেনায় আমি মান্যবরের মুখ ঢেকে দিয়েছি। তাঁর মুখ ঢেকে দিয়ে সাদা কাপড়ের পুটলিটা খুলে ক্ষুরটা বের করি। আমি ক্ষুরটা হাতে তুলে নিই। আর তখন মান্যবর আমাকে তাড়া দিলেন, কী রে, দেরি করছিস কেন? তাড়াতাড়ি কর।

জ্বী, কর্তা। ক্ষুরটা একটু দেখে নিচ্ছি।

সত্যিই তো আমি দেরি করছি কেন? তিনি আমাকে আর কতক্ষণ সময় দেবেন? আমি ভাবি, না, আমার আর সময় নেয়া মোটেই ঠিক হবে না।

কাজটা সেরে ফেলার জন্য আমি নিজের ভেতর থেকেও আরও বেশি তাগিদ পেতে থাকি। আমি ক্ষুরটা হাতে নিয়ে ধারাল অংশে ভালো করে তাকাই, ধার সম্পর্কে আমি সম্পূর্ণ সন্দেহমুক্ত হতে চাই। আবার আড়চোখে মান্যবরের মুখের দিকে তাকাই; দেখতে পাই এবং নিশ্চিত হই তিনি আমার সামনে কাফনে মোড়ানো লাশের মতো পড়ে আছেন। অনেক দিন আগে লাশঘরের দরোজায় দাঁড়িয়ে উঁকি দিয়ে ডোমের লাশকাটা দেখার কথা আমার মনে পড়ে। আমি দেখেছিলাম, লাশ কাটার সময় শুয়ে থাকা লাশের বুকের ভেতর কেমন নির্বাধায় একটা ছুরি বসিয়ে দিয়েছিল। আমার মনে হয়েছিল, লাশটা বুঝি ওঠে ডোম বেটাকে জাঁপটে ধরবে। কিন্তু না, কিছুই করে নি। মৃত লাশ আর আর কী করবে!

মান্যবরের মুখের দিকে তাকিয়ে এখন আমারও মনে হতে থাকে, তিনিও বুঝি একটা মরা লাশ। মরা লাশ না হলেও লাশের মতোই তিনি শুয়ে আছেন। তবে ইচ্ছা করলেই আমি তাঁকে লাশ বানিয়ে দিতে পারি। এখন, এই জনশূন্য বাড়িতে তাঁকে লাশ বানাতে আমার তেমন কোনো কসরত করতে হবে না। তাঁর উদরটা চোখের সামনে খুব ধীরে ধীরে ওঠানামা করছে, এটা একটা ফাঁপা বেলুনের মতো যেন, একটা সুঁই ফুটিয়ে দিলেই হাওয়া বেরিয়ে যাবে। অথচ আমার হাতে আছে একটা সুঁচালো কাঁচি আর একটা ধারালো ক্ষুর। তিনি চোখ মেলার আগেই যা ঘটাবার আমি ঘটিয়ে ফেলতে পারব।

সেভ শুরু করবার আগে প্রতিবারের অভ্যাস মতো ক্ষুরটা ঠিকমত ধারালো হয়েছে কি না পরখ করবার কথা আজও আমার মনে পড়ে। আজও মনে পড়ে, ক্ষুরটা ধারালো না হলে তিনি কষ্ট পেতে পারেন। তাঁর কষ্টের কথা মনে পড়তেই আবার একটা ধাক্কা খাই। তবু সুস্থির হতে আমার সময় লাগে। আমার বুকের ভেতর কেন যে কাঁপতে থাকে। ভাবি, আমাকে প্রশান্ত থাকতে হবে। অশান্ত দেখলে তিনি অসন্তুষ্ট হবেন। এমন কি, আমার উপর রাগও করতে পারেন। কে না জানে―তিনি যার উপর রাগ করেন তার সর্বনাশ হয়ে যায়! তিনি রেগে গেলে আমার সর্বনাশ হয়ে যাবে। আমাকে তিনি গ্রামছাড়া, এমন কি দেশছাড়া, এমন কি পৃথিবী থেকেও সরিয়ে দিতে পারেন। তবু আমার বুক আর কাঁপে না। তাঁকে আর ভয়ঙ্কর মনে হচ্ছে না।

মান্যবরের চিবুকের নিচে ক্ষুর চালানোর আগে, ফেনায় ঢাকা, তাঁর নিমীলিত চোখের দিক তাকিয়েই খুব সাবধানে আমি ক্ষুরের বুকে আঙুল ছোঁয়াই। তারপর ঠাণ্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নিই, আমি আজ তাঁকে লাশকাটা ঘরে পাঠাব।

কীভাবে ক্ষুরটা চালাব সেটা নিয়ে আমি ভাবতে থাকি। জীবনভরই ক্ষুর সঠিকভাবে, সঠিক জায়গায় চালাই, যেখানে চালাতে চাই অনায়াসে, অবলীলায় চালাতে পারি। কখনো কোনো হিসাবের গরমিল হয়নি। আমি ভাবি, আজও গরমিল হবে না। আমার ক্ষুর এ পর্যন্ত কাউকে ব্যথা দেয় নি।

সাদা কাপড়ের তলে মান্যবরের বিশাল ছাতি ওঠানামা করছে। তাঁর বুকের ভেতর প্রাণবায়ুর আসা-যাওয়া দেখতে পাচ্ছি। আর সে কথাও মনে পড়ে, এ কথা সত্য যে, ভগবান কখন কেমন করে কার প্রাণবায়ু কার দ্বারা বের করে নেবে, রাজা আর নেতাও আগেবাগে টের পায় না। টের পেলে তো তেনারা উল্টো যমের প্রাণবায়ুই বের করে নিতেন।

কী করে ঘুণাক্ষরেও বুঝতে না দিয়ে, বিশ্রামরত আর সন্দেহমুক্ত রেখে পাখিটা শিকার করা যায়, আমি সে কথা ভাবতে থাকি। আর সে বিষয় মনে রেখে নিজের সঙ্গেই মনে মনে কথা বলি, খুব সাবধানে, বেশী সময় নিলে হবে না। আমি নিজেকে নিজে বলি, হ্যা, ঠিক আছে, বুঝতে না দিয়েই বের করে নেব।

ক্ষুরটা হাতে নিয়ে আমি জীবিত মান্যবরের মুখের দিকে শেষবার তাকাই। তার পর আবার ক্ষুরের দিকে। আমার অভ্যাস, ক্ষুর চালাবার আগে আঙুলে একবার ধার পরখ করে নেয়া, সেটাও করি। আমি সবসময় ক্ষুরের ধার পরীক্ষা করেই ক্ষুর চালাই। আমার যা অভ্যাস― ক্ষুর হাতে নিয়ে আঙুলের ডগা দিয়ে পরখ করা― এর ব্যতিক্রম আজও হয় না। অভ্যাসমতো, কাজ শুরু করার আগে যেমনটি করি, ক্ষুরটা বামহাতে নিয়ে ডান হাতের আঙুলের মাথায় ক্ষুরের ধার পরখ করতে চাই।

কিন্তু হঠাৎ কী কারণে একটা শির শির অনুভুতি― নির্বিষ ঢোড়া সাপে কমাড়ানোর অনুভূতির মতো― আমার হাঁটুর নিচ থেকে শরীর বেয়ে উপরের দিকে উঠতে থাকে। তার পর আমার দু’টো পা আমাকে পাত্তা না দিয়ে অনর্থক কাঁপতে শুরু করে। আমার মনে হয়, পায়ের তলায় শক্ত মাটি নয়, আমি দাঁড়িয়ে আছি চরের বালির উপর, চোরা স্রোত পায়ের তল থেকে বালি সরিয়ে নিচ্ছে। আমি ভাবি, আমাকে শক্ত হতেই হবে, দু’পায়ের ওপর শক্ত হয়ে আমাকে দাঁড়াতেই হবে― ভাবি, আমার ইচ্ছাটা আজ পূরণ করতেই হবে।

ঠিক তখন মান্যবর চোখ মেলে তাকালেন। সাদা ফেনার ভেতর থেকে তাঁর রক্তিম চোখ দেবতার চোখের মতো নিষ্পলক, শ্যেন দৃষ্টি আমার হাতের দিকে। আর আমার রক্তাক্ত হাতে চকচকে ক্ষুর।

আমার ভেতর এখন আর কোনো ভয়ডর কাজ করছে না। আমি এখন আর বিব্রত নই। আমি ক্ষুর হাতে তাঁর মুখের পানে তাকিয়ে ভাবি, আর বিলম্বও নয়, আর তাঁকে সুযোগ দেব না। আমি চাই― তিনি এখন চোখ গরম করুন। তিনি আমার উপর সাংঘাতিক রকমের রাগ করুন। সেরকম রাগ― যেরকম রাগ করলে তিনি কাউকে খুন করতে পারেন অথবা খুন করে ফেলার জন্য নির্দেশ দিতে পারেন। আমি চাই― তিনি আমাকে এমন ধমক দেন যেমনটি এর আগে কাউকে দেন নি। আমি তাঁর ধমকের সমুচিত জবাব দিতে আজ পুরোপুরি তৈরি।

কিন্তু মান্যবর আমাকে কিছুই বলেন না। বরং এক নির্লিপ্ত দানবশিশুর মতো তিনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন।

আমি দাঁড়িয়েই থাকি। সহসা আমি সাদা কাপড়ে ফোটা ফোটা লাল রক্ত পড়তে দেখি। কিন্তু আমি তো কিছুই করি নি! আমি বুঝে উঠতে পারি না― কী করে, কোথা থেকে তাঁর বুকের উপর ফোটা ফোটা রক্ত পড়ছে!

আমার হাতের আঙুল থেকে রক্ত ঝরতে দেখেও মান্যবরের চোখে মায়া মমতার লেশমাত্র চিহ্ন নেই। তাঁর কোনো বিকার নেই, আমার তখন মনে পড়ে, রক্ত দেখার অভিজ্ঞতা আমার চাইতে তাঁর অনেক বেশি। সামান্য রক্তপাতে তাঁর ঘাবড়াবার প্রশ্নই ওঠে না।

আমি তবু দাঁড়িয়েই থাকি। রক্তাক্ত হাতে ক্ষুর হাতে নিয়ে আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেও মান্যবর কিছুই বলেন না। বরং এক নির্লিপ্ত দানবশিশুর মতো তিনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমার আঙুল থেকে রক্ত ঝরতেই থাকে। রক্ত ঝরে ঝরে অথবা তাঁর হিম দৃষ্টিতে আমার ভেতরের আগুন নিভে পানি হয়ে গেলেও আমি বুঝতে পারি না।

অতঃপর খুব ধীরে, ভোরবেলা ঘুম ভাঙলে বিছানায় কিছুটা সময় আয়েশ করে গড়িয়ে নিয়ে বিছানা ছাড়ার মতো মান্যবর ওঠে বসেন। হাতের চেটোয় মুখের ফেনা মুছে নিয়ে তিনি আমার দিকে এবার পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকান।

আমি অনড় কলাগাছের মতো মান্যবরের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। সকরুণ চোখে কাতর দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাঁর ইশারার অপেক্ষা করতে থাকি। আমার আর নির্বোধ সাজবার কোনো অজুহাত চলে না। এর পর আমার ভাগ্যে কী ঘটবে তাও ঠিকই আন্দাজ করতে পারি। কতদিন যাবত চুলদাড়ি কাটি। কোনো দিন কারো ত্বকে সামান্য আঁচড়ও লাগে নি। আর আজ নিজেই নিজের আঙুল কেটে ফেললাম! আমি তাঁর ইশারার অপেক্ষা করি। আর আমার ডান হাতের বুড়ো আঙুল থেকে টপ টপ করে রক্ত পড়তে থাকে।

মান্যবর পকেট থেকে একটা শতিটাকার নোট বের করে আমার সামনে বাড়িয়ে দেন― নে, ধর।

সে টাকা আমি হাত পেতে নিতে পারি না। আমার হাত তো অবশ হয়ে গিয়েছে। মান্যবর আমার মুখের উপর একশ টাকার নোটটা ছুঁড়ে দিয়ে তাঁর দয়ার প্রকাশ ঘটিয়ে বলেন, তুই বাড়ি যা। ক্ষুর দিয়ে যে নাপিত নিজের আঙুল কাটে এমন অকর্মণ্যকে দিয়ে আমি আর চুলদাড়ি কাটাব না।

আমার বুঝতে বাকী থাকে না―আমার মতো অকর্মণ্য এ জগৎ-সংসারে দ্বিতীয়টি নেই, কেউ নেই।