You are currently viewing ১০টি কবিতা / মুকুল ভট্টাচার্য 

১০টি কবিতা / মুকুল ভট্টাচার্য 

১০টি কবিতা / মুকুল ভট্টাচার্য   অবকাশ  ঢাকের বাদ্যি দূর থেকে ভেসে আসছেসুজনবাবু, বিশাল ঘরে একাশুয়ে শুয়ে ভাবেন,স্ত্রী নেই, ছেলে বাইরে, বন্ধু বান্ধবরাও ব্যস্তস্বভাব সুলভ দৃঢ়তায় অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকবিছানায়  নিজের সঙ্গে আড্ডা মারেন।জীবনের বর্ণময় দিনগুলি নিয়েলুডোর চাল দেন।ভেসে ওঠেন উত্তম কুমার,সত্যজিত রায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়,সুচিত্রা মিত্র আরও কত সেরা মানুষের স্মৃতিধুৎ! তাতে হতাশা বেড়ে যায় । শুয়ে শুয়ে সাফল্যের উজ্জ্বল দিনগুলি নিয়েকাটাকুটি খেলেন।নিজের ওপর কখনও অভিমানকখনও উদ্ভাসিত ।বেশ সময় কাটে নিজের সঙ্গে আড্ডা মারতে । এই সময় কেউ দরজার ঘন্টি বাজালেউঠতে ইচ্ছে করে না ।মনে মনে বলেন,এখন এসো না ভাইফিরে যাও ।বেশ আছিসুবর্ণ দিনগুলি আমাকে জড়িয়ে ধরেছে। আমি নিজের সঙ্গে এখন আড্ডা মারছি  ।  ওরে কৃপণ  সুযোগ পেলে কিছু দাও আমার পাত্রেমন উজাড় করে দাও না কখনওএতে কি দেমাক বাড়ে? নাকি ওইটুকুই দেবার কথাআমারই চাহিদার দোষ।এ জন্যই আরও কিছু আকাঙ্খাদুয়ারে ধাক্কা মারে । বাইরে অঝোর বৃষ্টিঅপলক তাকিয়ে ভাবছিএই বৃষ্টির মতোএকবার যদি নেমে আসতেপ্রাণ খুলে ভিজতামপক্ষীকুল দেখো কী আনন্দেগাছের ডালে ভিজছে । পাত্রখানি সরিয়ে রেখেছি।আমার যা দেবার কথাতোমাকে  আঁচল ভরে দিয়েছি সবটুকুএমনকি আস্ত একটা  নদী ।  মৃগয়া ক্ষেত্র   তোমাকে অচেনা বুনো ফুলের নাম বলে দেবোচেনাব পাপড়ির ভেতর কুঁড়িকান্ড বেয়ে শিকড়ে নিয়ে যাবমাটির নীচে জল। যেখানে যাচ্ছ তুমি আকাশ নেইমুক্তির হাতে রশির বাঁধন । ওটা মৃগয়া ক্ষেত্র।ঘাসের শেকড়ে জমাট রক্তহরিণীর বোকা সরল চোখ থেকেরোজ নিভে যায় আকাশপৌঁছয় না কোনো কবিরভিজে চোখের ভাষা । ওখানে সোনার খাঁচায় লেগে থাকে তোমার পালক ।বুকের ভেতর পাথরছিঁড়ে দেয় হৃদয়ের গূঢ় অভিমান । তোমাকে অচেনা বুনো ফুলের নাম বলে দেবোমাথায় গুঁজে নিয়ে যাবযেখানে আকাশের নীচেজলাশয়ে নেমে এসেছে গাঢ় নীল ছায়া ।সেই নীল জলে পা ডুবিয়েজীবনের না বলা কথা অমল শান্তির স্তব্ধতায়স্পর্শ কাতর ভোর ঘুম পাড়িয়ে দেবেদেখে নেব হরিণীর নিশ্চিন্ত নিদ্রা । যেখানে যাচ্ছ তুমি আকাশ নেইমুক্তির হাতে রশির বাঁধন।ওটা মৃগয়াক্ষেত্র।ফিরে এসো ,ফিরে এসো ওগো যুবতী হরিণী।   বাদল মেঘ   বাদল নামে মেয়েটির সঙ্গে কলেজে আলাপশান্ত, মিতভাষী, শ্যামলা সুন্দরী । ভুরু ছিল বাঁকা তলোয়ার ।নীচে দুটি উজ্জ্বল চোখ । নামটা আমাকে টেনে ছিল ।বাদল নামটা মনে পড়লেইমনের ভেতর এখনও গোল গোল চিৎকারভেসে আসে ।বাদলদা খুব ভালোফুটবল খেলতো । মেয়েটির নাম বাদল কেন?খুব বাদলা দিনে কি ও জন্মেছিল?প্রথম আলাপে জিজ্ঞেস করতে বলেছিল,আমি খরা ও দুর্ভিক্ষের ভেতর জন্মেছিলামঠাকুমা বলেছিলেন, ও আমাদের বাদলদেখিস বৃষ্টিতে ভাসিয়ে দেবে । মৃদু হেসে বলল,তখন সংসারে ঠাকুমাদের কর্তৃত্ব ছিলপরে পরে দেখলামসন্তানের নাম ঠিক করা ,কোন চ্যানেলে টিভিচলবেসবই দেখি ছেলেদের ইচ্ছায় ।কতবার মা সিরিয়াল দেখছেবাবা এসে চ্যানেল ঘুরিয়ে দিত।বলুন তোসংসারে মেয়েদের ভূমিকা কী ? শান্ত নদীর চোরা স্রোত দেখে দেখে বুঝেছিলাম —এ সত্যি বাদল মেঘ ।দেখতে দেখতে মনে হয়েছেবাদল নামটা ওকেই মানায়। আলাপ জমে ওঠার পর একদিন বলেছিল,তুমি মিছিলে যাওনি?অন্যায়গুলো মেনে নিয়েছ বুঝি? বাদল দাঁড়াও ।বুঝলাম ঝরে পড়লে থামে না সহজে ।বাদল দাঁড়াও যাচ্ছিফিরেও তাকায়নি । কেটে গেছে বেশ  কিছু বছর । বাদল মিছিল সেরে বাসের অপেক্ষায়আমাকে দেখে বলল, কেমন আছো?খুব বড় চাকরি করছ বুঝি? না বাদল, চাকরি পাইনি ।তোমার পিছন পিছন শ্লোগান দিচ্ছি ।তুমি কী করছ? ছাত্র পড়াই আর লড়াই । বিয়ে করনি ? পুরুষ খুঁজে পাইনি। মনে মনে ভরসা পেয়ে বললাম,আজ দুজনে ভাঁড়ে চা খাব । মেঘ ঘনিয়ে বৃষ্টি এল যেনবাদল বলল,চলো। চা খাওয়ার পর বাস এসে দাঁড়ায়দুজনেই হাঁটতে লাগলাম ।   পতন    কদিন তো ঠিকই থাকেদুপাড়ার ছেলেরা মিলেমিশে ক্রিকেট খেলেকেউ আউট হলেদুহাতের তালু দুজনে কী উল্লাসে ঠুকে নেয়।তাহলে? রাতের শান্ত শহরে কালি মাখানোর জন্যকেন শলাপরামর্শ চলে?কেন অলিগলিতে রক্ত ঝরে পড়ে? একবারও কি কোনো প্রতিজ্ঞা করোনি?একসাথে? হাত মিলিয়ে?নাকি গভীর কোনো কারণ আছেআমাদের প্রতিজ্ঞাগুলোঅন্য বাতাসে ভেসে যায়। রফিক, ক্রিকেট খেলার জন্যঅসীমকে ডাকতে যায় নাঅসীমও মুখ শুকিয়ে জানলার পাশেবসে থাকে । মাথা নত করে বাড়ি ফিরিয়ে দেয় কলকাতাআমরাও দীর্ঘনিশ্বাস ফেলতে ফেলতেদরজা বন্ধ করে পতনের শব্দ শুনি।  চক্ষু মেলে   কেবলই মনে হয়কিছু বাকি থেকে গেছেতার ভেতর ফাঁকিটা কদাচ মনে পড়ে না।আর কিছুদিন বেঁচেবর্তে থাকলেমনে হয় ফাঁকিটা ভরাট করেদুই চক্ষু সার্থক করে তবেই চলে যাব । কবি, এভাবে যাবার জন্য সত্যি বেঁচে আছ ?আর কিছু ইচ্ছে নেই?একবারও কি মনে পড়ে না ?পাশের কলোনিতেভাতের গন্ধ ওড়ে না রোজফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেছেলে বুড়োর দল। ওদের কারো নাম আনোয়ার, মকবুল, রফিকুলকারো নাম সঞ্জয়, অর্জুন, বুলবুল । ভাবো কবি, তোমাকেই ভাবতে হবে ।ওদের ঘরে ভাতের গন্ধে ভরে গেলেতারপর না হয়আমাকেও সঙ্গে নিয়ে চলে যেও ।  বলিরেখা   পোস্ট অফিসে অসহায় বয়স্ক মানুষটি বললেন,ভাই আমার টাকা তোলার ফর্মটাভরে দেবেন ? অত কিন্তু করছেন কেন?  দিন ফর্মটা । কতজনকে বললাম, কেউ দিল না । হায় নাগরিক! তোমারা বিপ্লবের স্বপ্ন দেখো?ফর্ম ভর্তি হলে কাঁপা কাঁপা হাতে সই করলেনঅসিত মান্না। আপনি ফুটবলার অসিত মান্না ? মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।আপনার মনে আছে?আপনার খেলা যে আমি দেখেছি ।কী সৌভাগ্য । বললেন, পরের মাসেরটা যদি ভরে দেন … নিশ্চয়ই দেব ।কত টাকা আর তারিখ লিখে নিতে হবে । টাকা ওই তিনশো পঞ্চাশ ।প্রতি মাসে পাই।কপালের বলিরেখা গভীর হয়ে উঠল। আর কিছু পান না? এক ছাত্র আমাকে কিছু সাহায্য করে । টাকা তুলে কাঁপতে কাঁপতে লাঠি ঠুকেচলে গেলেন দুঁদে ফুটবলার অসিত মান্না। ঠুঁটো জগন্নাথের মতো চেয়ে চেয়ে দেখলাম।  পাতাজন্ম   ওরা দাগি ক্রিমিনাল হয়ে যাচ্ছে । কেন লিখলাম হয়ে যাচ্ছে?এও লিখতে পারতামযুগ যুগ ধরে পরিকল্পিত ভাবেক্রিমিনাল তৈরি করা হচ্ছে । কোনটা ঠিক ভাবছিভেতর ঘর থেকে গলা উঁচু করে বললেন গিন্নি, এটা নেই,সেটা নেই এখনই বাজারযেতে হবে ।লেখা বন্ধ । যদি লিখি ক্রিমিনাল তৈরি করা হচ্ছেপরের লাইনে কী লিখব?ফর্দের চিরকুটে লিখে যা হোক কিনেঘরে ফিরে লিখে ফেললাম । নিজেদের সুখ আগলে রাখার জন্যএক শ্রেণির মানুষ যুগ যুগ ধরে ক্রিমিনালেরজন্ম দিয়ে চলেছে। লক্ষ্য রাখে যাতে না প্রেম করে দুর্বল হয়ে পড়ে ।তাই নাইট ক্লাবে যাবার টাকা দেয় । থামতে হল।দু এক জন প্রেম না করলেঅপরাধ থেকে পিছু না হটলেবসের সঙ্গে মন কষাকষি না হলেকবিতা হয় কী করে? কলিং বেল বেজে উঠল ।আঃ!সব মাটি হয়ে গেল । সিকিউরিটি বলছে ইলেট্রিসিয়ানকে খবর দিন বাবু,পাম্পে জল উঠছে না ।যেন সাক্ষাৎ ক্রিমিনাল । আবার সব মিটে যেতে বললাম,হে ধৃতরাষ্ট্র তুমি বলতে পার ?ভীষ্ম, কৃষ্ণ, রামচন্দ্র তোমরা কেউ বলতে পার ?সবাই দেখি অপরাধীর মতো চুপ।ধর্মপুত্র তুমি কিছু বলো। সে কি? তুমিও চুপ? কী লিখি এখন? রমণীরা আপনাকে চিনে নেয় ইন্দ্রের সভায়।আপনি চিনতে পারেননি কোনোদিন ।তোমায় যে সৃষ্টি করেছেতোমাকে নিয়েই বরাবর ডুবেছে সে। পরের লাইন আর লেখা হয় নানতুন পাতাজন্মের টানেআবার পাতা খসে ।  হুস  মন্তর    হুস মন্তর যে জানি না তাইমুঠোয় দেখি দু এক ফোঁটা ঘামজাদুবলে লাড্ডু কোথা পাইএসব জেনে কে আর দেবে দাম ? জানো যদি আলোর দুয়ার খুলেপালাক দেখি অন্ধকারের পাহাড়হাতের মুঠোয় আলোর রোশনি জ্বেলেনামুক মনের জমাট বাঁধা ভার। হয়তো আমার বড্ড বেশি চাওয়াবুকের ভেতর নিকষ কালো মেঘঝড়ের শব্দে মগজ ফাটায় রোজহেই সামালো হেই সামালো বেগ। কে ডেকেছিস, মৃদুল বাবুল সোনাকে ডেকেছিস,জোরে চিৎকার করেহুস মন্তরে ছুটছে নেকড়ে চিতাআনবে নাকি সোনার হরিণ ধরে । জলে কুমির ডাঁঙায় নেকড়ে চোখছুটছি জোরে আকাশ ছোটে সাথেপাখি হলে যেতাম সুদূর নীলেচক্ষু সজাগ জেগে থাকে রাতে । হেই সামালো হেই সামালো দেখ্ঘামের মুঠো ভাঙছে ভেল্কি জাদুলাঙল ফলা কাঁধে যখন আছেহইনি সবাই ধুনি জ্বেলে সাধু। দেখরে সবাই মানুষ মিছিল করেআনছে টেনে মস্ত বড়ো আলোচল দেখি আজ উঠবে আকাশ নীলেভুবন জুড়ে এবার মশাল জ্বালো। হুস মন্তরে মারছে চোখে ঢিলহবেন নাকি অনেক বড়ো নেতাডাহা মিথ্যে সভায় বলছে দেখোজাদুর টাকা বাড়ায় দেখি কেতা। জাদুসম্রাট ভাবতে বসেন ঘরেএ কীরকম উচ্চে ওঠার নেশা  ?দেখেশুনে হাসছে ঘোড়া যখনএবার আমায় ছাড়তে হবে পেশা। লাড্ডু কোথা, লাড্ডু কোথা,ডাহা মিথ্যে কথাহাতে লাঙল এটাই তোমার দামহেই সামালো, হেই সামালো দিনমুঠোর ভেতর সোনা রোদের ঘাম।  ছেলেটা দৌড়চ্ছে    সুকমল এখন আর সুকমল নেইসঙ্গদোষে সে এখন ছোট্টু ।ভুলে গেছেপ্রিয় শিক্ষক তপনবাবুর বাড়ি ।তোলাবাজদের সঙ্গেটাকা তুলতে দেখে তপনবাবু বলে উঠলেন,সুকমল, তুই ও ব্রুটাস ? তুইতো অঙ্কে একশোয় একশো পেয়ে পাশ করেছিলি । এ কী দশা তোর ?তুই সব ভুলে … দল ছেড়ে একলাফে বেরিয়ে দৌড়চ্ছে ।পিছন থেকে শাগরেদরা ডাকছে,ছোট্টু, কোথায় যাচ্ছিস ? কানে ঢোকে নাশুধু বাজছে তপনবাবুর স্বর ,তুইও ব্রুটাস? ছোট্টু পালাচ্ছে । ছোট্টু দৌড়চ্ছে ।কোথায় কতদূর যাবে?ঘামতে ঘামতে বলছে, সুকমল মৃতচাকরি না পেয়েআমি এখন ছোট্টু । তীব্র স্বর বিঁধছে, তুইও ব্রুটাস?নিজের থেকে পালাতে চাইছে সে। মনে পড়ছে, পড়াতে পড়াতে বলতেন,চাকরি না থাক রাস্তা ঝাঁট দিবি ,মুটেগিরি করবি, প্রতিবাদ মিছিলে যাবি। সুকমল, তুই অঙ্কে একশোয় একশো পেয়ে পাশ করেছিলি । কোন অঙ্ক কিনে নিল ? ছেলেটা দৌড়চ্ছে ।ছেলেটা ছোট্টুর জামা খুলে পালাচ্ছে । নৌকা ছাড়ছে চলে এসো …হাঁক পাড়ে মাঝি । ছেড়ে দাও আমি যাব না …. ছেলেটা আজ সাঁতরে পার হবে নদী ।ইস্! মাস্টারমশাই এর বাড়িটাইভুলে গিয়েছিলাম ।=======================   

Leave a Reply